সুইট অ্যান্ড সাওয়ার

সুইট অ্যান্ড সাওয়ার

প্রথমে দেখা হল। তারপর প্রাণ আঁকুপাঁকু। তারপর দেখাদেখি, ঘোরাঘুরি। মাইলের পর মাইল কথা। অর্থহীন হাসাহাসি। হাত ধরাধরি। নাকানাকি। বেড়াবেড়ি। তারপর বিয়ে। গুচ্ছের লোকের গুঁতোগুঁতি। কেউ আনল ফোল্ডিং ছাতা, কেউ শাড়ি, কেউ ননস্টিক প্যান, কেউ এক পয়সা সোনার নাকছাবি।

ভাড়া-করা বিয়েবাড়িতে প্রবল হুল্লোড়। বাকসে চাপা সুরে গান। ক্যাটারারের উর্দি-পরা কর্মীর দল সেই ভিড়ে উল-বোনা কাঁটার মতো মানুষের ফাঁসের মধ্যে অক্লেশে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। যখনই প্রয়োজন হচ্ছে হাতের ট্রে মাথার ওপর তুলে মাথার পর মাথা ‘পাস’ করাচ্ছে। কোনও দুর্ঘটনা ঘটছে না।

 মেয়েদের ঠোঁট দগদগে লাল। মোমপালিশ মুখ। খড়খড়ে শাড়ি, লেপ্টে থাকা শাড়ি, অদৃশ্য শাড়ি। ব্লাউজের নানা ধরন। কোনওটার পিঠের দিকটা ‘স্মৃতিটুকু থাক।’ কোন অতলে তার সীমারেখা পরিহিতাই জানেন। কোনও ব্লাউজ সামনের দিকে এতটাই দু:সাহসী যে, পুরুষদের মাথা ‘সিগন্যাল ডাউন।’ দৃষ্টির রেলগাড়ি পা ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

একালের শিশুরা টিভির কৃপায় অতি-পক্ক। বাপ-মাকেই জ্ঞান নিতে হয়। এমন সব পোশাক পরেছে, যা সেকালের পাগল-পাগলিরাই পরত। এখন ছেলেমেয়েরা খুব আদরে থাকে। ইউনিট ফ্যামিলি। সন্তান-সংখ্যা কম। একটা কি দুটো। ফলে চেহারা সব ফুটবলের মতো। সেই চেহারায় মেয়েদের পরিধানে টাইট পোশাক। এর আবার সব নাম আছে।

আমেরিকা থেকে মুম্বাই থেকে কলকাতা। এইরকম সব নাম, ‘হিপ-হাগিং’, ‘ব্রেস্ট প্রাোমোটিং’। এক কিশোরী পাজামার মতো কী একটা পরেছে।

তলার দিকটা ফালা-ফালা করে কাটা। যেন কেউ চিরে দিয়েছে। এটা হল বটম, আর টপটা হল সিল্কের স্যান্ডো গেঞ্জি। এই পোশাকের নাম হল, ‘ক্লাউন কাট’।

এই সিরিজে আর একটা ধরন আছে ‘আন্ডার কাট’। সেটা কী ফ্যাশন, যাঁরা জানেন তাঁরাই জানেন, মাছ যেমন জলে সাঁতার কাটে সেইভাবে এই মানবপুকুরে তারা ঘাই মেরে বেড়াচ্ছে। উঠতি বয়সের ছেলে আর মেয়েরা আগামী বিবাহের মহড়া দিচ্ছে। প্রবীণ-প্রবীণারা দেখেও দেখছেন না। যুগ একেবারে কেলেঙ্ককারি রকমের বদলে গিয়েছে। কেউ কারও কথা শুনছে না বলে, কেউই কাউকে কিছু বলছে না। সবাই ড্যাবা ড্যাবা চোখে, জগতের গ্যালারিতে বসে জীবনের তামাসা দেখছে।

কেউ হয়তো এইরকম বলছেন, ‘ওটা কার মেয়ে?’

‘আমাদের প্রমোদের মেয়ে।’

‘অ্যাঁ! এতটা এগিয়েছে?’

‘মেয়েরা ভীষণ স্পিডে এগোচ্ছে ভাই।’

‘কোন দিকে?’

‘সে আমি বলতে পারব না।’

‘ওই কালো পাঞ্জাবি পরা ছেলেটা কে? খুব লপচপ করছে।’

‘চিনতে পারছ না, মনোজের ছেলে। টেলি-সিরিয়ালে অভিনয় করে। ওই সিরিয়ালট তুমি দেখো না?’

‘কোনটা?’

‘এক আকাশে অনেক তারা। পাঁচ বছর ধরে চলছে, আমার মেয়ের বিয়ে হল, নাতি হল, সে স্কুলে ভরতি হল, এখনও চলছে।’

‘চলবেই তো! আকাশে কত তারা আছে, জানো? তা চুলগুলো অমন ঝুলঝাড়ুর মতো হয়ে আছে কেন?’

‘ওটা লেটেস্ট। টম হ্যাঙ্ক-কাট।’

‘সে আবার কী, আমাদের সময় ছিল ইটায়িলান কাট।’

‘টম হ্যাঙ্ক একজন বিলিতি স্টার। ও তাকে নকল করছে।’

‘আসল হতে আপত্তি কী?’

‘কাটবে না। গানের রিমেকের মতো। লতাকণ্ঠী, কিশোরকণ্ঠ।’

‘সব দু’নম্বরি।’

এরই মধ্যে একজনের উৎপাতে সকলেই অতিষ্ঠ। তিনি একটা ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে যার-তার ঘাড়ে পড়ছেন।

হঠাৎ শোরগোল, ‘গেল, গেল, গেল, গেল, রিনা মাসির পরচুল খুলে নিয়ে গেল।’

ক্যামরার তারে জড়িয়ে পরচুল উৎপাটিত। করুণ মাথার চেয়ে ভদ্রমহিলার মুখচ্ছবি আরও করুণ।

কী ছবি তুলছে বল তো! ঘুরে ঘুরে সেই একই দৃশ্য। ফালু মাসি এতখানি হাঁ করে মুখে পানের খিলি পুরছে। মহিলাসক্ত জগাদা মেয়েদের সঙ্গে ফাজলামো করছে। তারের চেয়ারে ফুলের গয়না পরে নববধূ সেঁটে বসে আছে। মাথার চুলে রজনীগন্ধার পোকা ঘুরঘুর করছে। বধূ সাজানোর কোম্পানি ঝাড়া চারঘন্টা সাজিয়েছে। চুলে শ্যাম্পু মেরেছে তিনবার। ফল বেরোচ্ছে। ফিঁচিত, ফিঁচিত হাঁচি। বর বড়ো উতলা হয়েছেন। বন্ধুদের ছোটাছুটি—অ্যান্টি অ্যালার্জিকের তল্লাশে।

একজন অভিজ্ঞ বললেন, ‘ডোন্ট ডু দ্যাট, ডোন্ট দু দ্যাট, বউ ঘুমিয়ে পড়বে। হাঁচতে দাও। কাশি হলে দেখা যাবে।’

‘ছেলেটি কী করে জানো? বউ মেন্টেন করতে পারবে তো?’

‘আজকালকার ছেলেরা কী করে বোঝা মুশকিল। আমাদের কালে বলা যেত। শুনেছি চাওমিন কাউন্টার আছে, খুব বিক্রি। মেয়েটি খদ্দের ছিল। প্রেম হল, পাকল, বিয়ে হল। কাউন্টারের রাস্তার দিক থেকে ভেতরের দিকে চলে এল।’

 ‘সে ভালো। এইবার চিলি চিকেনও বিক্রিও হবে। একেই বলে, জীবনের সস। সুইট অ্যান্ড সাওয়ার।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *