সিগারেট এবং কতিপয় ব্যক্তিগত স্কেচ
রাত্রির হালকা শরীর ভেঙে ভেঙে এক সময় পার্কের নির্জন উদাসিন কোনটায় নিজেকে আলতো কোরে রাখি লম্বা বেঞ্চিটার ওপর। লাইটপোস্টটি তখনো জেগে আছে। তুখোড় মাতালের মতো ধুসর চোখে কী দেখছিলো কে জানে! বাতাসের রেশমি চুল উড়ে উড়ে পড়ছিলো গায়ে। মোহময় মনে হচ্ছিলো সমস্ত কিছু। পার্কে প্রচুর লোকজন নেই এখন। যারা আছেন তারা সকলেই ফুলের মতো নিরব।
পাঞ্জাবির পকেটে সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না। একটিমাত্র অবশিষ্ট সিগারেট এতোক্ষন নিসঙ্গ একাকি প’ড়ে ছিলো প্যাকেটের এক কোনে যেন নিদারুন শূন্যতাবোধে জর্জরিত ও। ম্যাচের ওপর দিয়ে আমার হাতটি একবার ঘুরে গেলেই হেলমেটের মতো বারুদ লাগানো কাঠির মুখটি উজ্জ্বল হেসে উঠলো। বারুদের হাসিতে সিগারেট সমর্পিত হলেই একটা মিষ্টি অথচ ঝাঁঝালো ঘ্রান আমার আশেপাশে, পাঞ্জাবির বুক পকেটে উস্কোখুস্কো চুলের ভেতর বার কয়েক মৃদু পায়ে পায়চারী কোরে এক সময় অন্য কোথাও চ’লে গেল। ম্যাচটা পকেটে রাখতেই ম্লান স্বরে অস্পষ্ট কিছু বল্লো যেন।
সিগারেটের দীর্ঘশ্বাসগুলো আমার ফুসফুসে বিষ নিক্ষেপ কোরে আরো স্বচ্ছ হয় এবং পুনশ্চ ফিরে বসে নির্দিষ্ট পথে। অতপর কুয়াশার মতো চারপাশে বিচ্ছিন্ন জাল ফেলে রাখে।
.
সিগারেট ধরালেই লাজ বলতো ‘সিগারেটের ধোঁয়ায় তোমাকে বড়ো বেশি স্বপ্নময় মনে হয়।’ আমি ওর এ রকম কাব্যিকতায় প্রভাবিত হতাম না এবং বলতাম ‘তোমার সিফন শাড়ীটা পরোনি কেন?’
ও আকাশের মতো নির্বাক চোখে প্রশ্ন রাখতো। আমি নিরুত্তর ফিরে যেতাম অন্য কোথাও। রেশমের মতো কোমল স্বরে নেপথ্যে ডাকতো ও
—এই।
–হু
—কি ভাবছো?
—গাড়িটা বিক্রি কোরে দেবো!
মাও সেতুং-এর লাল বই-এর মতো ওর মুখটা পোশাক পাল্টে নিতো। আমি পিয়ানোর মতো হাসতাম।
একদিন আকাশটা ভীষন অভিমান করেছিলো। অঝোরে কাঁদছিলো। অশ্রুর ধারায় ঘাসের সাম্রাজ্য ভিজে গিয়েছিলো। তবু আকাশ কাঁদছিলো। লাজ আমার বাউন্ডুলে চুলের বাগানে সৌন্দর্য খুঁজতে খুঁজতে বলেছিলো—
‘এসো না এই বর্ষায় আমরা কৈশোরে ফিরে যাই’
আমি ওকে একটি চুম্বন উপহার দিলে ও হাসলো। প্রতি-উত্তরে ওর চোখের ক্যানভাসে কার স্কেচ আঁকা আমায় দেখতে বল্লো। অথচ আমি ওর আর্ট পেপারের মতো শাদা চোখের ভেতর গভীর কালো একটা তারকা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। মাঝে মাঝে ওর কথাগুলো কবিতার মতো দুর্বোধ্য মনে হতো। ও বলতো আমি নাকি ওর সম্পূর্ন বিপরীত।
কখনো টেলিফোনে ওর কন্ঠস্বর সিনেমার নায়িকাদের মতো চমৎকার মনে হলে কেন জানি বলতে ইচ্ছে হতো— আজ তুমি সত্যিই সুন্দর!
একবার আমি ওকে লিলি নামে ডাকতে চাইলে ও আমায় স্বাতি বোলে ডাকতে অনুরোধ করেছিলো। আমি তখন স্বাতি নামের অর্থ জানতাম না।
আমার ছোট বোন বীথির সাথে ওর ভীষন ভাব ছিলো। বীথিও মাঝে মাঝে বলতো আমি নাকি বড্ড জটিল। তাই একদিন সহজ হতে হবে ভেবেই একটি অচেনা মেয়েকে প্রিয়তমা বল্লে সে আমায় লম্পট বলেছিলো। আমি তাকে বিয়ে করবো বোলে প্ৰতীক্ষা করেছিলাম কিন্তু সফল হইনি। এখনো তার সাথে কখনো কখনো দেখা হয়। একটি পুরুষ তার স্বামী। স্বামীরা নাকি মেয়েদের সব কিছু— লাজ প্রায়ই বলতো। কিন্তু আমি আজো এর সার্বিক তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারি না।
অতপর একদিন গোলাপী বিকেলে সারা মুখে দুশ্চিন্তার প্রলেপ দিয়ে লাজ আমার ঘরে এসেছিলো। লাজের বিয়ে হবে শুনে বেশ ভালো লাগলো। অচেনা একটি সুঠাম পুরুষ লাজের স্বামী হবে। আমি ওর চোখে চোখ রেখে আশ্বাস দিলাম—
‘নিশ্চয়ই অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত থাকবো।’
অথচ আমার এ আশ্বাসে লাজের চোখ থেকে মুক্তার মতো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরলো। অশ্রুর অর্থ আমি বুঝি না। ওর কান্নার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আমার অজানা ছিলো।
লাজ নির্বাক যেভাবে এসেছিলো তেমনি চ’লে গেলে আমি ওর সমস্ত পুরোনো চিঠিগুলো চোখের সামনে তুলে ধরলাম। বীথি অভিজ্ঞের মতো নারী-চরিত্রের সব আমাকে নিখুঁত কোরে বোঝালেও লাজের কান্নার কোনো অর্থ আমি পেলাম না।
বীথির সব কথাগুলো সাজিয়ে সাজিয়ে আমি একটি নির্দিষ্ট সেতু তৈরি করতে চাইলাম, কিন্তু যেহেতু আদৌ কোনো সেতুর আবশ্যক ছিলো না তাই সেতুটি আর তৈরি করা হয়ে উঠলো না।
লাজসংক্রান্ত সমস্ত স্মৃতিগুলো অতপর একদিন নিজস্ব একটি নীল এ্যালবামে সুন্দর কোরে সাজিয়ে রাখলাম। একদিন ও তার পুরুষ স্বামীটিকে নিয়ে আমার বাসায় বেড়াতে এলো। পুরুষটি তৃতীয় স্বরে জিজ্ঞেস করলো-
‘আপনিই কি জনাব রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ?’
আমি বললাম— হ্যাঁ।
.
এরই মধ্যে সিগারেটটি বিদায় চাইছিলো। ঠোঁটে শেষ চুমু খেয়ে ছুঁড়ে দিলাম দূরে। তার থেকে সরু নরোম একটি ধোঁয়ার রেখা এঁকেবেঁকে বিস্তৃত হতে থাকলো। আমি পুনশ্চ রাতের শরীর ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে ফিরে এলাম।
১৯৭৪