সিংহের থাবা – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
কুমার মাধোজি রাও আমার ছেলেবেলার বন্ধু। আমার বাবা ছিলেন সেকালের ব্যারিস্টার—অত্যন্ত সাহেবঘেঁষা। তাঁর ধারণা ছিল ছেলেবেলা থেকেই বিলেতে মানুষ না হলে সত্যিকার মানুষ হওয়া যায় না। তাই যে-বয়সে বাঙালি ছেলেরা সাধারণত ধারাপাত খুলে নামতা মুখস্থ করে, প্রায় সেই বয়সেই আমি গলায় টুকটুকে টাই বেঁধে ভরতি হলাম এসে ইংল্যান্ডের এক নাম-করা পাবলিক স্কুলে। এখানে আমার মতো আরও কয়েকটি ভারতীয় ছাত্র ছিল, কিন্তু তারা প্রায় সকলেই আমার তুলনায় অনেক বড়ঘরের ছেলে—বেশিরভাগই রাজা-মহারাজার ছেলে। কাজেই আমার সঙ্গে তারা খুব যে প্রাণ খুলে মিশত এমন কথা বলা যায় না।
কিন্তু মাধোজি ছিল ওদের মধ্যে স্বতন্ত্র। পশ্চিম ভারতে জুনাগড়ের কাছাকাছি নন্দকোট নামে যে-দেশীয় রাজ্য আছে—মাধোজি ছিল সেখানকারই রাজাবাহাদুরের ছেলে। কিন্তু রাজার ছেলে হলেও একেবারেই দেমাক ছিল না ওর। দুষ্টু অথচ মিষ্টি স্বভাবের জন্য হেডমাস্টার থেকে শুরু করে প্রতিটি ছাত্র ওকে ভালোবাসত,—এমনকী স্কুলের ডানপিটে ছাত্র হ্যারিস, টম, চার্লি এরাও। আর আমার সঙ্গে তো ছিল ওর গলাগলি।
তারপর বহুদিন কেটে গেছে। পাবলিক স্কুলের পড়া শেষ করে ইউনিভার্সিটির বেড়াও উতরে এসেছি। বাবার ইচ্ছা ছিল আমিও তাঁরই মতো ব্যারিস্টার হয়ে কলকাতার ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজের গণ্যমান্যদের মধ্যে একজন হয়ে উঠি। আমার কিন্তু অধ্যাপকের জীবনই বেশি পছন্দ হল। অর্থ বেশি না থাক—আছে সম্মান, স্বাধীনতা আর অবসর। আর ভালো বিলেতি ডিগ্রি থাকায়, ভদ্রগোছের একটা অধ্যাপক-পদ জোগাড় করতেও বেশি কষ্ট হল না।
পাবলিক স্কুল ছাড়ার পর মাধোজির সঙ্গে আর দেখা হয়নি। চিঠি পাইনি বহুদিন। তবে শুনেছি সে নাকি নানাদেশ ঘুরে এখন নন্দকোটেই ফিরে এসেছে। আমাদের মতো তো আর তার পয়সা রোজগারের চিন্তা নেই!
অনেকদিন কলকাতার বাইরে যাওয়া হয়নি, তাই এবার পুজোর ছুটিতে কোথাও একটু ঘুরে আসব ভাবছিলাম। না,—কন্টিনেন্টে আর নয়, নিজেদের দেশ ভারতবর্ষের অনেক কিছু আজও দেখা হয়নি—সেটাই এখন দেখা দরকার। সত্যি কথা বলতে কী, সারা ছাত্রজীবন বিলেতে কাটিয়েও বিলেতকে ততটা ভালোবাসতে পারিনি। হয়তো অতি কাছাকাছি থাকার ফলে ওদের গুণের সঙ্গে দোষ-গুলোও চোখের সামনে ভাসছে। কিন্তু যাই কোথায়?
এমন সময় হঠাৎ, আশ্চর্য কাণ্ড, একটা লম্বা তার এসে হাজির। চিঠির মতোই বড় সেই টেলিগ্রাম। বড়লোকের কাণ্ড! তার করেছে মাধোজি। লিখেছে :
বহুদিন দেখা হয়নি। দিনকতক এখানে বেড়িয়ে যা না! তোকে দেখলে ছেলেবেলার দিনগুলি মনে পড়বে। কী মিষ্টিই না ছিল সেই দিনগুলি!
এর পর আর কিছু ভাববার দরকার নেই। সুটকেসটা গুছিয়ে নিয়ে পরদিনই বেরিয়ে পড়লাম নন্দকোটের উদ্দেশে।
কী চমৎকার আমাদের এই ভারতবর্ষ! ট্রেনের জানলা দিয়ে চেয়ে-চেয়ে চোখ যেন জুড়িয়ে গেল। প্রকৃতি তার সমস্ত সম্পদ উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে—মাঠেঘাটে—বনে-জঙ্গলে। কোথাও একটুখানি কৃত্রিমতার আভাস পর্যন্ত নেই। এ ছেড়ে কোথায় ছিলাম এতদিন!
যথাসময়ে নন্দকোটে হাজির হলাম। মাধোজি নিজেই এসেছিল স্টেশনে অভ্যর্থনা করতে। এখানে সে আর মাধোজি নয়—কুমারবাহাদুর, ভবিষ্যতে রাজ্যের গদির উত্তরাধিকারী সে। চেহারা দেখে প্রথমটা চিনতেই পারিনি। কোথায় সে চোস্ত সাহেবি পোশাক পরা ছোট্ট ছেলেটি আর কোথায় এই পুরোদস্তুর ভারতীয় পোশাক পরা যুবক! হাঁটু পর্যন্ত আচকানের মতো লম্বা জামা গায়ে, মাথায় ফিনফিনে রঙিন পাগড়ি। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল যখন সে আমার সঙ্গে পরিষ্কার বাংলায় কথা বলতে শুরু করে দিল। উচ্চারণে একটু টান হয়তো ছিল, কিন্তু ভাষায় ভুল নেই একচুল। এ কী করে হল! মাধোজি ব্যাপার বুঝে শুধু মুখ টিপে-টিপে হাসতে লাগল।
পরে ব্যাপারটা জানতে পারলাম। কিছুদিন থেকে মাধোজি রবীন্দ্রনাথের ভীষণ ভক্ত হয়ে পড়ে। কবির ইংরেজি অনুবাদ পড়ে তার এত ভালো লাগে যে, সে আসল রবীন্দ্র-সাহিত্য পড়বার জন্যে বাংলা শিখতে শুরু করে। মেধাবী ছেলে সে, অল্প দিনেই এই ভাষা তার আয়ত্তে এসে যায়। এর পর আরও একটা ঘটনা ঘটে যার ফলে বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষার প্রতি তার টান আরও বেড়ে গেছে। কিছুদিন হল মাধোজি বিয়ে করেছে একটি বাঙালি মেয়েকে। বাঙালি হলেও মেয়েটি বোম্বাই অঞ্চলেই মানুষ—কাজেই ওদের পরিবারে বেশি বেমানান হয়নি। তবে রাজপরিবারের ছেলে হয়ে সাধারণ পরিবারে বিয়ে করাতে রাজাবাহাদুর খুব খুশি হননি—প্রজারাও নাকি বিরক্ত হয়েছে। কিন্তু যাক সে-কথা।
রাজপরিবারে রাজার হালেই অভ্যর্থনা হল আমার। রাজবাড়ির এই অংশ রাজ-অতিথিদের মহল। তারই কয়েকখানি ঘর অধিকার করলাম গিয়ে। দুটি ভৃত্য সর্বদা আমার সঙ্গে-সঙ্গে রইল, পাছে আমার একটু আরামের ব্যাঘাত হয়। ব্যাপার দেখে আমারই লজ্জা করতে লাগল।
রাজাবাহাদুরের সঙ্গেও আলাপ হল সেইদিনই। খুবই বুড়ো হয়েছেন। আর মনে হল ভারী ভালোমানুষ। শুধু ভালোমানুষ নন, বেশ একটু দুর্বল প্রকৃতিরও বলা চলে। অনেকক্ষণ ধরে গল্প করলেন আর সে-ই রাজ্যের অনেক খবরও বলে ফেললেন। মাধোজি তাঁর একমাত্র ছেলে, তাঁর অবর্তমানে সেই পাবে রাজ্যের গদি। ছেলেকে তাই তিনি উপযুক্ত করে গড়ে তুলবার জন্যে সবরকম ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ছেলেও শিক্ষাদীক্ষায় যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু চালচলনে মহারাজসুলভ আভিজাত্য আজও তার এল না। রাজ্যের সাধারণ প্রজাদের সঙ্গে সে অবাধে মেলামেশা করে, সমস্ত ব্যাপারে মাথা গলায়। ফলে প্রজারা হয়তো তাকে পছন্দ করে কিন্তু তেমন মান্য করে না। এটা তো ঠিক নয়। এমনকী দেওয়ান বিনায়ক রাও-ও এবিষয়ে তাঁর কাছে অনেকবার বলেছেন। রাজ্যের ছোটখাটো ব্যাপার যা দেওয়ান-বাহাদুরেরই দেখেশুনে ব্যবস্থা করবার কথা—তার মধ্যেও সে অযথা মাথা গলিয়ে নিজেকে লোকের কাছে সস্তা করে ফেলছে, অথচ দেওয়ান-বাহাদুর লোকটি খুবই কর্মঠ। চালাক-চতুর, পণ্ডিত লোক। অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট। তিনি আসবার পর রাজাবাহাদুর তাঁর হাতে সমস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত আরামে ছিলেন এত দিন, এখন দ্যাখো দেখি কাণ্ডটা—!
আমাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘তুমি হচ্ছ ওর বাল্যবন্ধু। তোমাকে ও খুব মানে, পছন্দ করে। তোমার কথা ওর কাছে অনেক শুনেছি। তা ছাড়া তোমরা, বাঙালিরা, বেশ বুদ্ধিমান। ওকে একটু বুঝিয়ে-শুনিয়ে দাও তো বাবা!’
একটু থেমে আবার বললেন, ‘এই তো প্রজাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটি বাঙালি পরিবারে বিয়ে করে বসল। বউমা অবশ্য সবদিক দিয়েই খাসা মেয়ে, অল্প দিনেই আমাদের আপনার করে নিয়েছে। কিন্তু প্রজারা তো তা বোঝে না! তারা বলে, উনি তো রাজবংশের মেয়ে নন, আব্রু মানেন না—পথেঘাটে একলা বেরোন। রাজ্যের যিনি একদিন রানিসাহেবা হবেন তাঁর এরকম বে-শরম হালফিল হলে চলবে কেন? মাধোজি শুনে হাসে, বউমাও হেসে উড়িয়ে দেয়। বলো দেখি কী করি?’
তাঁকে আশ্বাস দিয়ে তখনকার মতো বেরিয়ে এলাম। পরদিন সকালেই মাধোজির ডাকে ঘুম ভাঙল। সেই কোন ভোরে সটান আমার ঘরে চলে এসে ডাকাডাকি শুরু করেছে। কে বলবে রাজার ছেলে! বলল, ‘আর ঘুমোয় না, চল একবার স্টেশন থেকে ঘুরে আসি। আজ আমার আর-এক বন্ধু আসছেন—তোরই মতো বাঙালি—বিজন রায়। ভারী চমৎকার লোক। আলাপ হলে খুশি হবি। ফিরে এসে চা-টা খাওয়া যাবে। চল-চল।’
‘তুই ফের নিজে যাবি?’
‘কেন, মান খোয়া যাবে? ওঃ, বাবা বুঝি বুঝিয়েছেন তোকে?’ হো-হো করে হেসে উঠল মাধোজি। সরল, প্রাণখোলা হাসি ‘নাঃ, আমাকেই দেখছি এবার এই সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদ শুরু করতে হবে।’
বিজন রায়ের সঙ্গে আলাপ হল। তিনিও আমারই মতো মাধোজির নিমন্ত্রণে বেড়াতে এসেছেন। হাসিখুশি, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। বয়েসে আমাদের চেয়ে কিছু বড়ই হবেন। আমার পাশের ঘরেই তিনি আস্তানা পাতলেন।
দেওয়ান বিনায়ক রাওয়ের সঙ্গেও আলাপ হল। আলাপ-সালাপে ভালোই লাগল। কিন্তু খুব কেতাদুরস্ত—সাধারণ লোকে যাকে বলে ‘স্মার্ট’। ফরসা, ছিপছিপে চেহারা। পরনে ইংরেজি পোশাক—খুব ফিটফাট। কোথাও একটু ভাঁজ চোখে পড়বার উপায় নেই। চেহারার চাকচিক্যে বয়েস কত ঠিক বুঝবার উপায় নেই। বিনায়ক রাওয়েরও একজন অতিথি এসেছেন দেখলাম। লোকটি ইয়োরোপীয়। নাম শুনলাম মিস্টার হার্ডি। ইনি নাকি খুব ভালো শিকারি, শিকারের লোভেই এসেছেন। নন্দকোট রাজ্য হিসাবে ছোট হলেও প্রচুর অরণ্যসম্পদ রয়েছে এখানে। এই সব সংরক্ষিত বন থেকে বেশ মোটারকম আয়ও হয়। তা ছাড়া শিকারের পক্ষেও এগুলি খুব লোভনীয়। নানারকম জন্তু—এমনকী দুষ্প্রাপ্য ভারতীয় সিংহও নাকি এখানে মাঝে-মাঝে দেখতে পাওয়া যায়।
হইহই করে দিন কাটতে লাগল। মাধোজি কিছুতেই ছাড়তে চায় না। বিজন রায়কেও নয়। এদিকে মিঃ হার্ডি শিকারে যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। মাধোজিকেও তিনি সঙ্গে না নিয়ে ছাড়বেন না। কুমারবাহাদুর সঙ্গে থাকলে নানা দিক দিয়ে সুবিধে হবে—এও হয়তো তাঁর আগ্রহের একটা কারণ। দেওয়ানজিরও ইচ্ছে তাই। মাধোজির যেতে তেমন আপত্তি নেই—তবে তার শর্ত যে, আমাদেরও সঙ্গে নিতে হবে। আমাকে আর বিজনবাবুকে। আমি বেচারা জীবনে কোনওদিন বন্দুক ধরিনি, শিকারে যাব কী! স্রেফ বলে দিলাম, ওসব আমার দ্বারা হবে-টবে না। বিজনবাবুও দেখলাম আমারই দলে। বিনায়ক রাও হাসতে-হাসতে বললেন, ‘দেখলেন তো কুমারবাহাদুর, আপনার দুটি বাঙালি বন্ধুই শিকারের নামে ভয় পাচ্ছেন, আপনিও তো….।’
বিনায়ক হয়তো বলতে গিয়েছিলেন ‘আপনিও তো আধখানা বাঙালি হয়ে গেছেন—বাঙালির জামাই হয়ে। আপনিও কি ওদের দলে ভিড়বেন?’ নেহাত মনিব-পুত্র বলেই কথাটা শেষ করলেন না তিনি।
আমি বললাম, ‘যাও না হে, ওঁরা অত করে ধরেছেন। একটা দিনের তো ব্যাপার! আমরা না হয় তোমার বাবার সঙ্গে গল্প করে সেদিনটা কাটিয়ে দেব।’
মাধোজি রাজি হল শেষপর্যন্ত। বিনায়ক রাও পরদিনই শিকার-যাত্রার আয়োজন করলেন। হার্ডি আর তিনি পুরোদস্তুর শিকারির পোশাক পরে নিলেন। কিন্তু মাধোজি পোশাক বদলাতে রাজি হল না, বলল, ‘যখন ওদের দেশে যাব তখন ওইসব বিলিতি পোশাকের কথা ভাবা যাবে—নিজেদের দেশে যে-পোশাক এত দিন চলে আসছে তাই-ই যথেষ্ট।’ মিঃ হার্ডি আর বিনায়ক অন্তত একটা ব্রিচেস আর পাগড়িটা খুলে একটা ক্যাপ পরে নেওয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, কিন্তু মাধোজি তাতেও রাজি হল না। যাই হোক, শেষপর্যন্ত ওরা রওনা হয়ে গেল। আমি বিজন রায়কে নিয়ে চললাম বুড়ো রাজাবাহাদুরের কাছে, গল্প করতে।
রাজাবাহাদুর বিজনবাবুকে দেখেও খুব খুশি হলেন। বিজনের সঙ্গে এতদিন তাঁর দেখা হয়নি। বললেন, ‘তোমার নামও অনেক শুনেছি। তোমার অগাধ পাণ্ডিত্যের কথা আর তোমার সব খেয়ালের কথা। তোমরা যখন আছ তখন ছেলেটাকে একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যাও। দেওয়ানজি বলেছিলেন, ইদানীং ও আবার বড় ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে সময় নষ্ট করছে। আরে, ওসব করলে কি মান-সম্মান বজায় থাকে? প্রায়ই নাকি পুরোনো খাতাপত্র, ফাইল টাইল চেয়ে বসে, তারপর সামান্য কর্মচারীর মতো তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে থাকে। কী দরকার ওসবের? ওর জন্যে তো মাইনে করা লোকই আছে, আর ওপরে আছেন স্বয়ং দেওয়ান-বাহাদুর। তোমরা একটা ঠাট্টা-বিদ্রপ করলে লজ্জা পেয়ে হয়তো বন্ধ করতে পারে ওসব।’
অনেক বেলায় ওঁর কাছ থেকে ছাড়া পেলাম।
দুপুরবেলা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার একটু আগে। উঠেই মনে হল সমস্ত বাড়িময় কেমন যেন একটা থমথমে ভাব। যেন কী একটা ভীষণ ব্যাপার ঘটে গেছে। চাকরটাকে ডেকে জিগ্যেস করতে যা শুনলাম তাতে সমস্ত শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। কুমারবাহাদুর শিকারে গিয়েছিলেন। খানিক দূর মোটরে যাওয়ার পর জঙ্গল যখন ঘন হয়ে এল, মোটর আর চলে না, তখন সবাই হেঁটে এগোতে লাগলেন। কুমার আগে-আগে চলছিলেন, একটু পেছনে ছিলেন মিঃ হার্ডি আর দেওয়ানজি, বন্দুক হাতে। হঠাৎ আচমকা একটা ঝোপ থেকে একটা সিংহ বেরিয়ে এসে পেছন থেকে কুমারবাহাদুরকে আক্রমণ করে। তিনি সঙ্গে-সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। লোকজন ছুটে আসে, সিংহও পাশের ঝোপে গা-ঢাকা দেয়। অনেক খুঁজেও সেটাকে আর পাওয়া যায়নি। মিঃ হার্ডি প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে ঝোপের ভিতর অনেকটা চলে গিয়েছিলেন, শেষে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছেন। ওদিকে ঘটনার আকস্মিকতায় দেওয়ানজি এত বিমূঢ় অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, প্রাথমিক শুশ্রূষা করার কথাটা পর্যন্ত তাঁর মনে আসেনি। খানিক পরে দলের আর সবাই এসে পড়লে দ্যাখে—কুমারের প্রাণ তখনও ধুকধুক করছে। তখন সকলে ধরাধরি করে তাঁকে তুলে আনে মোটরে, এবং এই কতক্ষণ হল তাঁকে রাজবাড়িতে আনা হয়েছে। ডাক্তারেরা এখনও ঘিরে বসে আছেন। প্রাণ এখনও আছে, কিন্তু জ্ঞান আর ফিরে আসেনি।
তাড়াতাড়ি ছুটে বেরিয়ে এলাম। বিজনবাবুর খোঁজ নিয়ে শুনলাম তিনি সেই যে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে টহল দিতে বেরিয়েছেন এখনও তাঁর খোঁজ নেই।
সে-রাত কোনওরকমে কাটল। শুনলাম সিংহ মাথার ঠিক পেছন দিক লক্ষ্য করে থাবা মেরেছিল। হয়তো পাগড়ির জন্যেই থাবাটা ঠিক খুলির পেছনে লাগেনি, লেগেছে ঘাড়ের ওপর। পাঁচটা ধারালো নখের ছাপ গভীরভাবে গেঁথে গেছে সেখানে। তবে থাবা একটার বেশি মারতে পারেনি। যদি সেপটিক না হয় তবে হয়তো শেষপর্যন্ত বেঁচে যেতেও পারে। রাজাবাহাদুরকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। তিনি তো হাউহাউ করে কেঁদে আকুল। বউরানি হয়তো অত বিচলিত হননি। ধৈর্য না হারিয়ে স্বামীকে বাঁচিয়ে তুলবার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করছেন।
অত্যন্ত উদ্বেগের মধ্যে কয়েকটা দিন কাটলে পর ডাক্তার বললেন, এ-যাত্রা কুমারবাহাদুরের ফাঁড়া কেটে গেছে। জ্ঞান ফিরে এসেছে, ঘাড়ের ঘা-টাও আস্তে-আস্তে শুকিয়ে আসছে। এসব ঘা খুব অল্পতেই সেপটিক হয়ে পড়ে, তাই বড় ভাবনা ছিল।
সেদিন বিজনবাবুকে নিয়ে মাধোজিকে দেখতে গেলাম। বেশ হাসিমুখেই সে আজ আমাদের সঙ্গে গল্প করতে লাগল। তারই মুখে শুনলাম—জঙ্গলের পথ খুব সরু হওয়ায় তারা গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে চলছিল। সামনে ছিল তারা তিনজন—সে, হার্ডি আর বিনায়ক। দলের আর সবাই ছিল পেছনে। কথা বলতে-বলতে হঠাৎ আর দুজন একটু পিছিয়ে পড়ে, মাধোজিও একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা সিংহ এসে পেছন থেকে প্রচণ্ড বেগে তার পাগড়ি নিয়ে থাবা মারে। উলটে গুলি চালানো দূরে থাক, মুখ ফিরিয়ে সিংহটার দিকে তাকানোও তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সঙ্গে-সঙ্গে সে সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে যায়। তারপর আর কিচ্ছু মনে নেই।
গল্প শুনতে-শুনতে বিজন রায় কেমন যেন একটু উসখুস করছিলেন। একটু পরেই উঠে বললেন, ‘চলুন জয়ন্তবাবু রোগীকে বেশি উত্তেজিত না করাই ভালো। ওঁকে এখন একটু বিশ্রাম করতে দিন।’
বিজনবাবু কিন্তু নিজের ঘরে ফিরতে চাইলেন না, বললেন, ‘চলুন, একটু ঘুরে আসি। কাঁহাতক ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকা যায়? মন খারাপের দিন তো চলে গেছে।’
বড়রাস্তা ধরে অনেকটা হেঁটে আমরা একটা খুব বড় বাড়ির সামনে এসে পড়লাম। দেখলেই বোঝা যায় বেশ বড়লোক কারও বাড়ি। বেশ ছিমছাম দেখতে। কার বাড়ি ভাবছি, এমন সময় একজন সাহেবি পোশাক পরা লোক ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। আরে, এ যে আমাদের হার্ডিসাহেব!
হার্ডিও আমাদের দেখতে পেয়ে হাসিমুখে দেশি কায়দায় হাত তুলে বললেন, ‘নমুস্টে।’ আমরাও প্রত্যুত্তরে ‘নমস্তে’ জানালাম।
‘কার বাড়ি এটা?’
‘এটাই তো দেওয়ান-বাহাদুরের বাড়ি। এখানেই তো আপাতত আমার আস্তানা!’
‘দেওয়ানজি বাড়ি আছেন নাকি? চলুন, এলাম যখন তখন একবারে দেখা করেই যাই।’
বলে কারও অনুমোদনের অপেক্ষা না রেখেই বিজনবাবু আমার হাত ধরে বাড়ির ভিতর ঢুকে
পড়লেন ‘আপনি কোন দিকে থাকেন, মিঃ হার্ডি? চলুন, আপনার ওখানে গিয়েই বসি।’
অগত্যা মিঃ হার্ডিকেও আমাদের সঙ্গে আসতে হল।
ঘরের এক কোণে ছোট একটি শেলফ। অনেকগুলি বই রয়েছে সেখানে। দেওয়ালে অনেকগুলি জীবজন্তুর ছবি আর চার্ট। সবই প্রায় সিংহের।
‘আপনি বুঝি সিংহ না মেরে ছাড়বেন না কিছুতেই! সিংহ নিয়ে দস্তুরমতো গবেষণা শুরু করেছেন মনে হচ্ছে?’
হার্ডি সলজ্জভাবে বললেন, ‘হ্যাঁ, ওদের চালচলন, রকম-সকম একটু ভালো করে ”স্টাডি” করছিলাম। জানেন তো, ভারতবর্ষে সিংহ খুব কম পাওয়া যায়, শুধু এই অঞ্চলেই যা দু-চারটে এখনও আছে।’
শেলফের ওপরকার বইগুলি নাড়াচাড়া করতে-করতে বিজনবাবু বললেন, ‘এগুলিও তো দেখছি সব ওই সম্বন্ধেই। বাব্বাঃ, সিংহের ওপর এত বইও আছে! বড় শিকারি হতে গেলে ল্যাঠা তো কম নয়!’
আমি টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এখানেও দেখুন না, কাগজের ওপরে কত নকশা আঁকা হয়েছে। সিংহের থাবা, সিংহের নখ—কিছুই বাদ নেই! একেবারে স্কেল ফেলে মাপজোখ করে আঁকা!’
‘তা তো হবেই। ভালো করে মনে রাখতে হলে নিজে হাতে ড্রইং না করলে চলে না—প্রাণিবিজ্ঞানের ওটা গোড়ার কথা।’ বিজনবাবু তারিফ করে বললেন।
এই সময় বিনায়ক রাও ঘরে ঢুকলেন, আর তাঁর সঙ্গে ঢুকল একটি বছরদশেকের ছেলে। আমরা গল্প করতে লাগলাম, হঠাৎ দেখি বিজনবাবু কোন ফাঁকে ছেলেটির সঙ্গে দিব্যি জমিয়ে ফেলেছেন—যেন কতকালের বন্ধু! শুনলাম ওর নাম বাজিরাও—দেওয়ানজিরই ছেলে।
‘বেশ ইন্টেলিজেন্ট ছেলেটি। বাপেরই মতো।’ রাস্তায় বেরিয়ে বিজনবাবু বললেন।
‘এবারে কোন দিকে? বাড়ি তো?’
‘তা ছাড়া আর কোন চুলোয়? চলুন, যাওয়ার পথে এখানকার পাবলিক লাইব্রেরিটা একটু ঘুরে যাই। শুনেছি খুব ভালো লাইব্রেরি।’
লাইব্রেরি-ঘরে ঢুকে বিজনবাবু আর বেরোতে চান না। লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গেও অল্পসময়ের মধ্যে বেশ ভাব করে নিয়েছেন। অদ্ভুত লোক বটে! খানিক পরে দেখি, লাইব্রেরিয়ান সিংহ সম্বন্ধে লাইব্রেরিতে যত বই আছে সব এনে ওঁর সামনে জড়ো করেছেন।
‘এসব বই এখানকার লোকেরা খুব পড়ে বুঝি? পাতা-টাতা মাঝে-মাঝে আলগা হয়ে গেছে দেখছি!’ বিজনবাবু একখানা বই নাড়তে-নাড়তে প্রশ্ন করলেন।
‘কোথায় পড়ে! নেহাত সিংহের দেশ, তাই রাখতে হয় লাইব্রেরিতে। তবে হ্যাঁ, হালে ওই যে সাহেব শিকারিটি এসেছেন, তিনি এর প্রায় সব বই-ই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। অদ্ভুত জাত বটে! আর হয়তো তাতেই পাতা আলগা হয়ে গেছে।’
‘হুঁ,’ বলে বিজনবাবু ছবির পাতাগুলো গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখতে লাগলেন। তারপর বললেন, ‘এই বইটা একটু নিয়ে যেতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।’ কুমারবাহাদুরের বন্ধুকে লাইব্রেরিয়ান খাতির না করে পারলেন না।
‘আপনিও যে সিংহতত্ত্ববাগীশ হয়ে পড়লেন! কী ব্যাপার?’ পথে বেরিয়ে প্রশ্ন করলাম। বিজনবাবু অন্যমনস্কভাবে কী যেন ভাবছিলেন, চমকে উঠে বললেন, ‘অ্যাঁ? ও, তা দোষ কী? শুনলেন তো, এটা সিংহের দেশ!’
পরদিন সকালবেলা বিজনবাবুর সঙ্গে আবার বেড়াতে বেরোলাম।
‘আজ কোন দিকে?’ জিজ্ঞাসা করলাম তাঁকে।
‘যেদিকে খুশি। তবে দেওয়ান-বাহাদুরের বাড়ি আর-একবার যেতে হবে। তাঁর ছেলের কাছ থেকে নেমন্তন্ন আছে—অ্যালবাম দেখতে যাওয়ার। নানারকম অদ্ভুত জিনিস সংগ্রহের বাতিক আছে ছেলেটির। আমাকে না দেখিয়ে ছাড়বে না বলেছে।’
দেওয়ানজি বা তাঁর বন্ধু হার্ডি কেউই বাড়ি ছিলেন না, কিন্তু বাজিরাও থাকায় অভ্যর্থনার কোনও ত্রুটি হল না। ঘরে বসিয়ে তার যাবতীয় সংগ্রহশালা সে একটি-একটি করে এনে হাজির করল। সিগারেটের ছবি, দেশলাই-বাক্সের ছবি, চায়ের মোড়কের ছবি—এক-এক অ্যালবামে এক-এক জিনিস।
‘এত চায়ের মোড়কের ছবি জোগাড় করলে কোত্থেকে? তোমাদের বাড়িতে বুঝি খুব চায়ের পাট?’
‘মোটেই না। চা আমরা খুব কম খাই। কফিই ভালোবাসি সবাই। কিন্তু কফির প্যাকেট তো আর সীসে মোড়া থাকে না, তাই বাবা অনেকগুলো চায়ের প্যকেট আনিয়েছিলেন।’
‘সীসের জন্যে?’ আমি হাসতে-হাসতে বললাম, ‘ভেতরের চা ফেলে দিয়ে তোমার বাবা বুঝি সীসেটুকু জমা করেন?’
‘হাসছেন যে! বাবা গলফ খেলতে ভালোবাসেন খুব। গলফের লাঠি দেখেছেন তো, তলাটা কেমন ভারী! এখানে ও-জিনিস পাওয়া যাচ্ছিল না। বাবার আর তর সইল না, বললেন নিজেরাই তৈরি করে নেবেন। সীসের দোকানেই অর্ডার দিচ্ছিলেন, বাবার বন্ধু ওই যে সাহেবটি, আঙ্কল হার্ডি, উনি বললেন, তার চাইতে বরঞ্চ সীসের মোড়া চায়ের প্যাকেট আনিয়ে নিন। ভেতরের চা-টা কাজে লাগবে, সীসেও পাওয়া যাবে। তাইতেই তো বাবা গাদা-গাদা চায়ের প্যাকেট এনে জড়ো করেছিলেন। সীসেটা বাবা নিয়েছেন, চাগুলো চাকর-বাকরদের বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর আমি পেয়েছি মোড়কগুলো।’
‘তাই নাকি? বাঃ’! বিজনবাবু হো-হো করে হেসে উঠলেন ‘আচ্ছা, দেখি তোমার বাবা কী রকম গলফ-স্টিক তৈরি করেছেন?’
‘সে দেখাবার উপায় নেই। পাছে আমরা নেড়েচেড়ে নষ্ট করে ফেলি, সেজন্যে বাবা সেগুলো আলমারিতে চাবিবন্ধ করে রাখেন। শুধু কী তাই, লম্বা চোঙার মতো এক-একটা কেস তৈরি করে তার মধ্যে পুরে রাখেন সেগুলো। হুম বাবা!’
তার কথা বলার ভঙ্গিতে আমরা দুজনেই হেসে ফেললাম।
বিজনবাবু বললেন, ‘আচ্ছা ভাই বাজিরাও, তোমার অ্যালবামে তো সবই আছে, কিন্তু সিংহের ছবি নেই কেন? তোমাদের নন্দকোট তো হচ্ছে সিংহের দেশ, আর সেই সিংহের ছবিই রাখোনি—এঃ!’
বাজিরাও একটু থতমত খেয়ে বলল, ‘তাও শুরু করেছি। এখনও তেমন ভালো ছবি বেশি জোগাড় করতে পারিনি, তবে হাতে আঁকা ছবি কয়েকখানা পেয়েছি। আঙ্কল হার্ডির কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছি। এই দেখুন না, আর কয়েকখানা হলেই অ্যালবামে এঁটে ফেলব।’ বলে বাজিরাও খাতার ভেতর থেকে পেনসিলে আঁকা কয়েকখানা ছবির স্কেচ বের করল।
বিজনবাবু তার ভিতর থেকে একখানা ছবি বেছে নিয়ে বললেন, ‘এটা আমায় একটু দেবে? আমারও ছবি আঁকার শখ আছে, আর আমার কাছেও এরকম কিছু ছবি আছে। মনে হচ্ছে আমারটায় কিছু ভুল হয়েছে। তবে সেগুলো আফ্রিকার সিংহ কিনা—পায়ের গড়নটা একটু অন্যরকম। যাই হোক, তোমারটার সঙ্গে একটু মিলিয়ে নেব। আর সেইসঙ্গে আরও কয়েকখানা ছবি তোমাকে দিতে পারব।’
সারাদিন আর বিজনবাবুর সঙ্গে দেখা নেই। সন্ধেবেলা একজন চাকর ব্যস্তসমস্ত হয়ে এসে বলল, ‘রাজাবাহাদুর এখুনি আপনাকে একবার আসতে বললেন। খুব তাড়াতাড়ি।’
তখনই ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি, রাজাবাহাদুর অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ঘন-ঘন আলবোলা টানছেন। সামনে বিজনবাবু বসে আছেন, আর আছেন একজন ভদ্রলোক। চেহারা আর পোশাক দেখে মনে হল এখানকার পুলিশের কর্তা-টর্তা কেউ হবেন।
আমি যেতেই রাজাবাহাদুর বললেন, ‘বোসো, জয়ন্ত!’ তারপর সেই লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে উনি যা বলেছেন সত্যি-সত্যি তা মিলে গেছে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। খানাতল্লাশ করে সব কিছুই পাওয়া গেছে। আপনার হুকুমমতো দেওয়ানজি আর তাঁর সাহেব বন্ধুটিকেও আটক করেছি।’
‘করেছেন? বেশ। আচ্ছা, এখন তাহলে আসুন। কাল সকালে আবার কথা হবে।’
পুলিশ-অফিসারটি চলে গেলে রাজাবাহাদুর যেন ভেঙে পড়লেন। দু-হাতে বিজনবাবুর হাত চেপে ধরে বললেন, ‘আর-জন্মে নিশ্চয়ই তুমি আমার অত্যন্ত আপনার কেউ ছিলে। নইলে এত বড় উপকার তুমি কী করে করলে? বাঙালি বুদ্ধিমান জানতাম, কিন্তু এত বড় রত্ন তা জানতাম না।’ আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘রত্ন-রত্ন, জহরত। তোমাদের এই বন্ধুটি খাঁটি জহরত, জয়ন্ত!’
ফিরবার পথে বিজনবাবু সমস্ত কথা খুলে বললেন।
‘ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে, না? আমার কিন্তু গোড়া থেকেই কেমন-কেমন লাগছিল। সেই কারণেই হয়তো কুমারবাহাদুরকে শিকারে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ওদের আগ্রহটাও একটু অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। বিনায়ক রাও লোকটি মুখে যেমন বিনয়ী আসলে যে সেরকম নয় তাও আমি এখানে আসার পরই জানতে পেরেছিলাম। বুড়ো রাজাবাহাদুরের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আস্তে-আস্তে সে রাজ্যের সমস্ত বিষয়ে সর্বময় কর্তা হয়ে দাঁড়ায়। কুমারবাহাদুর এসেই কিন্তু এটা ধরে ফেললেন। ফলে তার কর্তৃত্বে অল্প-অল্প করে বাধা পড়তে লাগল। তারপর কুমারবাহাদুর ধীরে-ধীরে সব ব্যাপারেই হস্তক্ষেপ করতে শুরু করায় সে অত্যন্ত অসোয়াস্তি বোধ করতে থাকে। হয়তো এমন সব কাণ্ড—বিশেষ করে স্টেটের টাকাপয়সা নিয়ে—ইতিপূর্বে সে করে রেখেছিল যা ধরা পড়লে সমূহ বিপদ। তাই সময় পেলেই সে রাজাবাহাদুরকে বোঝাবার চেষ্টা করত যে, কুমারবাহাদুর ছোটখাটো ব্যাপারে মাথা গলিয়ে নিজের মান খোয়াচ্ছেন। কুমারবাহাদুর সাধারণের সঙ্গে সমানভাবে মিশতে থাকায় তার আরও অসুবিধে হতে লাগল, কেন-না যে-কেউ যখন খুশি সত্যি কথা ফাঁস করে দিতে পারে। এজন্যে সে রাজাবাহাদুরকে বলে সাধারণের সঙ্গে কুমারবাহাদুরের মাখামাখি বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগল।
‘কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে অবশেষে সে ঠিক করল, যেভাবেই হোক ওঁকে সরিয়ে ফেলতে হবে। সে তখন বেপরোয়া!
‘কিন্তু এ তো যে-সে লোক নয়, স্বয়ং রাজকুমার—রাজ্যের ভাবী উত্তরাধিকারী। সরাব বললেই তো আর সরানো যায় না! নিজের বুদ্ধিতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে শেষে সে একজন লোক ভাড়া করে আনাই ঠিক করল। এই ভাড়াটে লোকটিই হচ্ছে আপনাদের হার্ডি। শিকারি-টিকারি কিচ্ছু নয় ও—বিনয়ক রাও-এর ভাড়া করা গুণ্ডা। কিন্তু সাধারণ গুণ্ডা নয়—ভদ্রবেশী, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান গুণ্ডা। বিলেতে এ ধরনের গুণ্ডা টাকা দিয়ে অনেক পাওয়া যায় শুনেছি। এও তাদেরই দলের একজন।
‘হার্ডি এসে পরামর্শ দিল—খোলাখুলিভাবে কুমারবাহাদুরকে মারতে গেলে ধরা পড়বার সমূহ সম্ভাবনা। কাজেই কাজটা এমনভাবে করতে হবে যাতে কেউ ব্যাপারটাকে হত্যা বলে সন্দেহ না করে দুর্ঘটনা বলেই মনে করে। নন্দকোটের জঙ্গলে সিংহ পাওয়া যায় বলে একটা প্রবাদ আছে। আমার এখনও মনে হয় ওটা প্রবাদই, কেননা ভারতীয় সিংহ এখন প্রায় লোপ পেয়ে এসেছে। অবশ্য এখান থেকে সে-জায়গাটা খুব দূর নয়। যাই হোক, এই সিংহ-শিকারের অছিলায় কুমারবাহাদুরকে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে যদি ছদ্মবেশী সিংহের বেশে ঘায়েল করা যায় তাহলে সহজেই কার্যসিদ্ধি হতে পারে। কিন্তু সিংহ হতে গেলে তার খুঁটিনাটি এমনভাবে জানা চাই যাতে কেউ ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে না পারে। এইজন্যেই হার্ডিসাহেবকে সিংহ সম্বন্ধে অত বই ঘাঁটাঘাটি করতে হয়েছে—অত নকশা, ছবি নাড়াচাড়ার প্রয়োজন হয়েছে। আপনি লক্ষ করেছেন কি না জানি না, ওর ঘরে যতসব ছবি ছিল তার মধ্যে সিংহের থাবা, নখ—এইসবের ছবিই ছিল বেশি। অর্থাৎ, সিংহের অন্য সবকিছু খবরের চেয়ে ওইগুলির খবরই ছিল ওর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। সেদিন লাইব্রেরি থেকে যে বইটা এনেছিলাম আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে। কেন এনেছিলাম জানেন? বইটাতে নানা জাতের সিংহের থাবার নকশা আঁকা একটা ছবি ছিল। বই নাড়তে-চাড়তে মনে হল—ছবিটা কেউ কাগজে ট্রেস করে নিয়েছে। ছবির দাগের ওপর পেন্সিলের দৃঢ় আঁচড় তখনও তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। লাইব্রেরিয়ান বললেন, এ-বই কেউ কখনও নেয় না, তবে সম্প্রতি ওই সাহেবটি এসব বই ঘাঁটাঘাঁটি করে গেছেন। তখনই সন্দেহ হল এ কি তবে হার্ডিরই কাজ? আর সিংহ-শিকার করতে গেলে শুধু তার থাবা আর নখ নিয়েই যত গবেষণা, এর মানে কী? ব্যাপারটার মীমাংসায় সাহায্য করল আমাদের বাজিরাও। হার্ডিসাহেব অকেজো ভেবে যে নকশাটা ওকে দিয়ে দিয়েছিলেন সেটাই ছিল ওই বই-এর টেস করা ছবি। তাই নকশাটা চেয়ে এনে বই-এর ছবির ওপর ফেলে দেখলাম আমার অনুমানই ঠিক।
‘এখন কথা হচ্ছে, থাবার ছবি নিয়ে হার্ডি কী করবে? নিশ্চয়ই একটি নিখুঁত মাপের নকল থাবা তৈরি করার মতলব ছিল তার। থাবা দিয়ে পেছন থেকে মাথার খুলিতে আচমকা মারতে পারলে কুমারবাহাদুরকে আর উঠতে হবে না। এখন, এরকম থাবা তৈরি করতে গেলে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে কোনও লাঠির ডগায় থাবাটি আটকে নেওয়া। পাঁচটা নখের বদলে পাঁচটা মাপসই মোটা-মোটা লম্বা পেরেক মুখটা ঈষৎ বেঁকিয়ে নিয়ে যদি কোনও ভারী জিনিসের মধ্যে আটকে নেওয়া যায় তাহলেই কাজ হাসিল করা যেতে পারে। ”ভারী” বলছি এইজন্যে যে, সিংহের থাবার যে-প্রচণ্ড জোর তা আনতে হলে খুব ভারী কোনও জিনিস ছাড়া হতে পারে না। ভারী বলতে প্রথমেই মনে আসে লোহা। কিন্তু লোহার মধ্যে পেরেক বসানো একটু কষ্টকর। তার চাইতে সীসের মধ্যে পেরেক আটকানো অনেক সহজ—কারণ, সীসে খুব অল্প আঁচেই গলে যায়। তা ছাড়া লোহার তুলনায় সীসে ভারীও অনেক বেশি।
‘সীসের দোকান থেকে হঠাৎ সীসের মতো একতাল সাধারণের অ-দরকারি জিনিস কিনতে গেলে পাছে কেউ সন্দেহ করে এজন্যে হার্ডিসাহেব পরামর্শ দিল—সীসেয় মোড়া চায়ের প্যাকেট কিনে তার থেকে সীসেটা বের করে নিতে। এক-একটা মোড়কে আর কতটা সীসে থাকে—তাই অনেকগুলো প্যাকেটই কিনতে হল। তারপর সেই সীসের তাল গালিয়ে একটা ডাণ্ডার আগায় লাগিয়ে তার মধ্যে পেরেকগুলো বসিয়ে দেওয়া হল—ঠিক যেমন সিংহের থাবায় নখগুলো বসানো থাকে। পেরেকের ছুঁচলো মুখগুলো রইল বাইরের দিকে। পাছে আবার কেউ সন্দেহ করে তাই বাড়ির লোকদের বোঝানো হল গলফ খেলার স্টিক তৈরি করা হচ্ছে। স্টিক রাখার জন্যে যে-কেস বা চোঙা, সেটা আর কিছু নয়, বন্দুকের নল। কারণ ওই নকল থাবা হাতে করে তো আর শিকারে যাওয়া চলে না। তাই একটা বন্দুক থেকে কলকবজা বের করে নিয়ে ভেতরটা ফাঁপা করে নেওয়া হল, আর তারই মধ্যে পুরে দেওয়া হল লাঠির আগায় লাগানো নকল থাবা।
‘তার পরের ব্যাপার তো জানেনই। কুমারবাহাদুরকে শিকারে নেওয়ার নাম করে কী করে দল-ছাড়া করে জঙ্গলের ভিতর নিয়ে যাওয়া হয়, এবং আচমকা মাথার নীচে নকল থাবা দিয়ে আঘাত করা হয় সে তো বুঝতেই পারছেন। ভাগ্যিস কুমারবাহাদুর পাগড়িটা খুলতে রাজি হননি, নইলে ওরা পাগড়ির বদলে ক্যাপ পরে নেওয়ার জন্যেও কম পীড়াপীড়ি করেনি। আমার মনে হয়, ওই পাগড়ির জন্যেই উনি বেঁচে গেছেন। মাথায় পাগড়ি থাকায় আঘাতটা মাথার খুলিতে লাগতে পারেনি, পড়েছে ঘাড়ের ওপর, আর জোরটাও খানিকটা প্রতিহত হয়েছে। অবশ্য তাতেও কুমারবাহাদুরকে অজ্ঞান হয়ে পড়তে হয়েছিল। উনি মারা যাবেন না এ হয়তো ওরা ভাবতে পারেনি। যে-জায়গাটায় ঘটনাটা ঘটেছে সেটা আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি। জঙ্গল হলেও সেখানে লোকের চলাচল আছে, সেখানে সহসা সিংহের আবির্ভাব বিশ্বাসযোগ্য নয়। তা ছাড়া দলের কেউ সিংহ চোখে দেখা দূরের কথা, কোনও আওয়াজ শোনেনি বা পায়ের দাগও দেখেনি!
‘সব কিছুই আমার কাছে তাই রহস্যময় মনে হচ্ছিল। তারপর কুমারবাহাদুর একটু সুস্থ হলে যখন তাঁর নিজের মুখে ঘটনাটা শুনলাম, তখন সন্দেহ গাঢ় হল। অনুমান সত্যি কি না জানবার জন্যে তথ্য খুঁজতে লাগলাম। ঘটনাচক্রে একটির পর একটি সবই মিলে যেতে লাগল। শেষটায় স্থির সিদ্ধান্তে আসবার পর রাজাবাহাদুরকে গিয়ে সব বললাম। তারপর দেখতেই পাচ্ছেন, পুলিশ খানাতল্লাশি করে সব কিছু বের করে ফেলেছে। আসামীরাও ধরা পড়ে দোষ স্বীকার করেছে। কিন্তু আর বাজে কথা নয়, চলুন, একবার কুমারবাহাদুরের সঙ্গে দেখা করে আসি। বউরানি নিজের হাতে চা করে খাওয়াবেন বলেছেন। আপনাকেও নিয়ে যাওয়ার হুকুম আছে।’
অন্তরালে
পুজো সংখ্যা, ১৯৬৫