প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

সাবধান

সাবধান

ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন এদের থেকে খুব সাবধান, যেমন, ‘প্রথম বড় মানুষ। টাকা, লোকজন অনেক, মনে করলেই অনিষ্ট করতে পারে; তাদের কাছে সাবধানে কথা কইতে হয়, হয়তো হাঁ বলে সায় দিয়ে যেতে হয়।’ খাঁটি কথা। আর একজন সন্তও এই কথা বলে গেছেন, ‘বইঠকে বইঠকে হাঁ জি হাঁ জি করতে রহিয়ো।’ প্রতিবাদ করেছ কী অকারণ ঝামেলায় জড়িয়ে মরেছ। তা বড় মানুষ মানে কর্মস্থলের বড়কর্তা। তিনি হলেন গিয়ে অন্নদাতা। তাঁর কৃপাতেই আমাদের লপচপানি। বউয়ের টাঙাইল শাড়ি, ছেলের ইংলিশ এডুকেশান, খানায় মুরগির ঠ্যাং, চোখে গগলস, পরনে চোস্ত পাজামা পাঞ্জাবি। তাঁর ঘরে যখন সভা বসে তখন মনের নোটিশ বোর্ডের দিকে একবার তাকাতেই হয়—সাবধান, বড় মানুষ, প্রভূত ক্ষমতা রে ভাই! এক টুসকিতে তোমার হাঁড়ি শিকেতে তুলে দিতে পারেন, পায়ের তলা থেকে সরিয়ে নিতে পারেন তোমার বিচরণ ভূমি। তিনি যা বলেন তাই সত্য। হাঁ জি, হাঁ হাঁ জি। কে না জানে তস্মিন তুষ্টে জগৎ তুষ্ট। তিনি সন্তুষ্ট হলে জগতের কল্যাণ। আমার জগৎ তো আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নয়। বড় জগৎ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার জগৎ আমার পরিবারটুকু। সেই পরিবারের কল্যাণে মাসের শেষে এক গোছা কারেন্সি নোট চাই। বড়কর্তার তালে তাল দিতে পারলে কেয়াবাত! ফ্যামিলিতে ঝাড়লন্ঠন জ্বলবে। মেয়ের বিয়েতে জোড়া সানাই বাজবে। জীবিকাই তো আমাদের ডিস্কো-ড্যান্স। তালে লয়ে নাচতে হবে। বড়কর্তা পোঁ ধরবেন, আর আমরা নেচে যাব, মিস্টার ঘোষ, মিস্টার বোস, মিস্টার মিত্তির। কেউ বুঝতে পারে না এক এক সময় আমরা কেমন অক্লেশে বাঁদরের ভূমিকায় নেমে আসি। তিনি খেলান আর আমরা খেলি। তিনি মনে করেন—বা:, ওই বাঁদরটা বেশ ভালো নাচে, দাও ওটাকে প্রমোশন দিয়ে। সেই বাঁদরটা অমনি ম্যানেজার হয়ে গেল। গোছায়-গোছা যোগ হল। মানে নোটের গোছায়। পরিবারে সুখ বাড়ল। আর একজন বিদ্যের জাহাজ। সে ওই বড় মানুষটির প্রতিবাদ করেছিল, ‘আজ্ঞে না, আপনি যা বলেছেন, তা আমি মানতে রাজি নই। আপনি জানেন না। বড় কর্তার মুখ একটু লালচে হয়েই, কালো হয়ে গেল। তিনি একবার হাঁ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন। সেই বিশ্বরূপ দর্শন হল প্রভুর মুখগহ্বরে। দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে কর্মচারী আর তাদের পরিবারকে তিনি চিউইংগামের মতো চিবোতে লাগলেন। চোয়ালের হাড় বারকয়েক উঁচুনীচু হল। বোঝা গেল কি হতে চলেছে সেই অবোধ প্রতিবাদকারীর। ধীরে-ধীরে তাকে ‘অফ’ করে দেওয়া হবে। তখন ঘর ছেড়ে তার বারান্দায় অবস্থান। মর্ডান ম্যানেজমেন্টের ভাষায় একে বলে ‘করিডর সার্ভিস’। হয় ছাড়পত্র দিয়ে মানপত্র নিয়ে মানে মানে বিদেয় হও, নয় তো বসে-বসে অপমান হজম করো। প্রভু, আমরা কলম ব্যবহার করি কলম হিসেবে, আপনার কলম হল ‘বেয়নেট’। এক খোঁচায় বিদ্যের জাহাজ ভরাডুবি। বিদ্যের জাহাজ যদি সংসার অর্ণব পাড়ি দিতে না পারে, অমন জাহাজের কি প্রয়োজন! তাই প্রভু, আর কিছু চাই না, তোমার কৃপার রাঙঝাল একটু দাও, ফুটোফাটা বন্ধ করে অন্তত একটু ভেসে থাকি। থেকে-থেকে ভোঁ মারি। বেঁচে থাকার ভোঁ।

সংসারে স্ত্রীরা খুব বড় মানুষ। সেখানেও হাঁ জি, হাঁ জি চালাতে না পারলে অস্তিত্ব বিপন্ন। তুমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র। স্ত্রী যদি বলে ‘তোমার মতো গর্দভ দুনিয়ায় দুটো নেই।’ ‘ঠিক বলেছ ম্যাডাম’। পরেরটা উহ্য, ‘তা না হলে তোমার কাছে ধরা দি।’ ফ্রয়েডকে প্রশ্ন করা হল, ‘আপনি তো মানবমনস্তত্বের একজন দিগগজ পণ্ডিত, আপনার সঙ্গে আপনার স্ত্রীর কোনওদিন মনোমালিন্য হয়েছিল?’ ফ্রয়েড বললেন, ‘জীবনে একদিন শোওয়ার ঘরের মাথার কাছে একটা জানলা খোলা নিয়ে। স্ত্রী বললেন খুলব, আমি বলি, খুলো না, মাথায় ঠান্ডা লেগে যাবে। মাঝরাতে হাতাহাতি হয় আর কি। শেষে বাঁচিয়ে দিল একটা টুপি।’ ‘টুপি?’

‘হ্যাঁ, যে টুপি মানুষ অন্যকে পরায় সে টুপি নয়, সত্যকারের একটা উলের টুপি। টুপিটা মাথায় পরে সুখে নিদ্রা।’

‘তা আপনার সুখী দাম্পত্য জীবনের রহস্যটা কী?’

‘অতি সহজ, হাঁ জি হাঁ জি করতে রহিয়ো।’

ঠাকুর রামকৃষ্ণের পরবর্তী সাবধান বাণী—কুকুর। কুকুর হইতে সাবধান। যখন কুকুর তেড়ে আসে কি ঘেউঘেউ করে, তখন দাঁড়িয়ে মুখের আওয়াজ করে তাকে ঠান্ডা করতে হয়। তারপর ষাঁড়। গুঁতুতে এলে, তাকেও মুখের আওয়াজ করে ঠান্ডা করতে হয়। তারপর মাতাল। যদি রাগিয়ে দাও, তাহলে বলবে তোর চৌদ্দ পুরুষ, তোর হেনতেন, বলে গালাগালি দেবে। তাকে বলতে হয়, কি খুড়ো কেমন আছ? তাহলে খুব খুশি হবে, তোমার কাছে বসে তামাক খাবে।’

সাবধান! কাদের থেকে সাবধান—বড় মানুষ, কুকুর, ষাঁড় আর মাতাল। সব একগোত্রের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *