সাপ
বাপ্পা তার বাবার সঙ্গে এই বাগানে এল। সে, তার বাবা আর রেনি।
শরৎকাল এখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। বাগানের ফুল, ঘাসের রং আর রোদের তাপ থেকে তার আন্দাজ পাওয়া যায়। যে ঘাসগুলো বর্ষার জলে ঘন সবুজ হয়ে উঠেছিল তা এখন নিষ্প্রভ। এই রোদ, ঘাস আর ফুলের রং–সব কিছুই যেন স্তিমিত, নিঃশেষপ্রায়। আর এখন না-দুপুর না বিকেলের সময়টাতে সব কিছুই খুব নিস্তব্ধ। এই শব্দহীনতা যেন সরু সুতোয় ঝোলানো কোনও ভারী জিনিসের মতো দুলছিল। যেন একটু নাড়া পেলেই সুতো ছিড়বে, হরিণের মতো ত্রস্ত পায়ে নিঃশব্দ সময়টা পালাবে।
বাপ্পা জানে যে ইচ্ছে করলেই এই নিঃশব্দতাকে সে ছিঁড়ে দিতে পারে না। একেবারেই যে শব্দ নেই তা নয়। বাগানের নিষ্প্রভ চারাগাছগুলোর দীর্ঘ ছায়া পড়েছে ঘাসে। সেই আলোছায়ায় কয়েকটা মৌমাছি উড়ছিল। তাদের উড়বার শব্দ ঘড়ির শব্দের মতো একটানা, একঘেয়ে। সেই শব্দটাকে শব্দ বলে মনে হচ্ছিল না বাপ্পার।
এখন এই বাগানে লাল কাঁকরের রাস্তার ওপর বাবার হাত ধরে বেড়াতে তার বিশ্রী লাগছিল। রোজই লাগে। কেমন নিস্তেজ অবসন্ন বিকেল। যাই–যাই ভাব। এক্ষুনি আলোটুকু যাবে। অন্ধকার হয়ে আসবে একটু পরেই।
হাঁটতে-হাঁটতে বাপ্পা পথের পাশে সাজানো ত্রিভুজের মতো উঁচু হয়ে থাকা ইটগুলোকে দেখছিল। এক দুই করে গুনে যাচ্ছিল ইটগুলোকে। রেনি মাটি শুকতে–শুকতে এগিয়ে যাচ্ছিল। গেটের কাছে রেনি একবার থমকে দাঁড়াল। ফিরে তাকাল। এমনিভাবে ফিরে তাকালে রেনীর লম্বা সরু শরীরটা ধনুকের মতো সুন্দর একটা বাঁক নেয়। চাবুকের মতো সরু লেজটা আছড়ে পড়ছে পিঠের ওপর।
এবার একটা কিছু বলতে পেরে বাপ্পা বেঁচে গেল। বলল , ‘বাবা ওই দ্যাখো!’
–কী! বাবার গলাটা খুব গম্ভীর।
আঙুল উঁচু করে রেনিকে দেখিয়ে বলল বাপ্পা, ‘ওই দ্যাখো রেনি পালাচ্ছে।’
বাবার ভ্রূ দুটো জোড়া লাগল। ‘কোথায় পালাচ্ছে! ও তো গেটের ভিতরেই রয়েছে।’
–ও পালাবার পথ খুঁজছে। আর পালিয়ে গিয়ে ও যা–তা খেয়ে আসে। বাড়িতে এসে বমি করে।
সে ভেবেছিল এবার বাবা তার হাতটা ছেড়ে দিয়ে রেনিকে গিয়ে ধরবে। বকলশটা ধরে টানতে-টানতে বাবুর্চিখানার খালি ঘরটাতে নিয়ে বেঁধে রাখবে রেনিকে। সেই ফাঁকে বাপ্পা এক ছুটে গেটটা খুলে বেরিয়ে যাবে, দুই লাফে রাস্তা পার হয়ে ওপাশে শেখ-এর বাড়িতে পৌঁছে যাবে। সমশের হয় এখন মাটি কোপাচ্ছে নয়তো মুরগিকে দানা দিচ্ছে। যে অবস্থাতেই থাক, তার ঘাড়টা ধরে কাছে টেনে এনে বলবে, ‘রাত্রিতে আমার পড়ার ঘরে আসিস। দুজনে লুডো খেলব।’
কিন্তু বাবা কিছুই বলল না। তার বাঁ-হাতটা যেভাবে বাবার প্রকাণ্ড মুঠোটার মধ্যে ধরা ছিল সে ভাবেই রইল। তেমনিভাবেই আস্তে-আস্তে সে তার বাবার পাশে-পাশে হাঁটতে লাগল। বাবার পায়ের রবারের চটির কোনও শব্দ হচ্ছে না।
হাঁটতে-হাঁটতে তারা গেটের কাছে আসে। আবার ফিরে যেতে থাকে বারান্দার সিঁড়িটার কাছে। বাপ্পার পায়ের রবারের ‘সোল’ওয়ালা শ্য’টার কোনও শব্দ নেই।
কেমন যেন হাঁফ ধরল বাপ্পার। বলতে ইচ্ছে করল, ‘বাবা আমি আর পারছি না।’ বাবার মুঠোয় ধরা তার হাতটা ঘামছে। ঘামতে–ঘামতে কজিটা যেন গলে যাচ্ছে তার।
রোজই তাকে তার বাবার সঙ্গে এই বাগানে আসতে হয়। এমন দিন খুব কমই গেছে যেদিন সে বাবার সঙ্গে এই বাগানে আসেনি। বারান্দা পেরিয়ে চারটে সিঁড়ি ভেঙে লাল কাঁকরের পথ। পুরানো, চেনা পথ, চেনা বাগান, মরা–মরা গাছ, ঘাস। জানলা দিয়ে তাকিয়ে–তাকিয়ে এই দৃশ্যকে সে সারাদিন দেখে। বিকেলেও আবার এখানেই আসতে হয়। কখনও-কখনও গেট পেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে প্রকাণ্ড উদোম মাঠটার মধ্যে বাবার সঙ্গে গিয়েছে সে। সেই মাঠটার মধ্যে অনেকটা চলে গেলে তাদের বাড়িটাকে খুব সুন্দর ছোট্ট একটা ছবির বাড়ির মতো দেখায়। ওই মাঠটার মধ্যে খুব ছুটে বেড়াতে ইচ্ছে করে বাপ্পার। কিন্তু একা তার এই বাড়ির কম্পাউন্ডের বাইরে যাওয়া বারণ। সে একা-একা কখনও কোথাও যেতে পারে না।
এক সময়ে তার বাবা দাঁড়িয়ে পড়ল। নীচু হয়ে রাস্তার পাশে ডালিয়া গাছটাকে দেখতে লাগল।
বাবা গাছটা দেখছে। বাপ্পা দাঁড়িয়ে রইল। শুকনো ডালিয়া গাছটা কুঁকড়ে ছোট্ট হয়ে গেছে। গাছটা মরেই গেছে। অস্ফুট স্বরে বাবা বলল , ‘আহা মরেই গেল গাছটা! রাখা গেল না।’
বাবা গাছটাকে দেখতে লাগল। বাপ্পা জানে এখন অনেকক্ষণ ধরে বাবা গাছটাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখবে। আর ততক্ষণ তার কজিটা বাবার মুঠোর মধ্যে ধরা থাকবে।
এখন, এইবার কবজিটা ব্যথা করে বাপ্পার। কেমন যেন অস্বস্তি। কতক্ষণ যে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে! ওই একঘেয়ে মরা গাছটা বাবা এখন কতক্ষণ ধরে দেখবে কে জানে!
বাপ্পা সিঁড়িগুলোর দিকে তাকাল। ছোট্ট খোলা বারান্দায় এখন রোদ। ঢাকা–না-দেওয়া রং চটে যাওয়া কয়েকটা চেয়ার–টেবিল এলোমেলোভাবে রেখে দেওয়া। রাত্রিবেলা অন্ধকারে বারান্দায় আসতে গেলে প্রায়ই কেউ-না-কেউ ওই চেয়ার টেবিলগুলোর সঙ্গে ধাক্কা খায়। কেন যে ওগুলোকে সাজিয়ে রাখা হয় না,বাপ্পা ভাবে। বারান্দায় দুটো দরজা হাট করে খোলা। এখন বাগানের রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরগুলো অন্ধকার মনে হচ্ছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। দুটো দরজা। একটা ড্রয়িংরুমের, অন্যটা শোওয়ার ঘরের। ঘরে আলো জ্বললে এখান থেকেই স্পষ্ট মাকে দেখতে পেত বাপ্পা।
কম্পাউডের ওপাশে মরা আমগাছটার ডালে বসে অনেকগুলো কাক। বিচ্ছিরি কালো অনেকগুলো কাক মরা আমগাছটার ডালে। অনেক–অনেকগুলো। ক’টা? বাপ্পা গুনতে চাইল। এক, দুই, তিন, চার…
কিন্তু চেষ্টা করেও অন্যমনস্ক হতে পারল না সে! বাবার মুঠোয় ধরে থাকা বাঁ-হাতের কবজিটা এখন প্রায় অবশ। ইচ্ছে করে খুব জোরের সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় কিংবা চিৎকার করে বলে, ‘আমার হাতটা ছেড়ে দাও তুমি।’
কিন্তু বাপ্পা কখনও তা বলে না। লিকলিকে সরু কালো একটা চাবুক আছে বাবার। বাড়ির পেছন দিকে কম্পাউন্ডের শেষে খালি বাবুর্চিখানার দেওয়ালে টাঙানো থাকে চাবুকটা। ঘরটা রেনির, চাবুকটাও রেনির জন্যেই। মাঝে-মাঝে যখন কথা শুনতে চায় না রেনি, ডাকলেও কাছে। আছে না তখন বাপ্পা দেখেছে বাবা রেনির গলার বকলশটা ধরে হিড়হিড় করে টানতে-টানতে নিয়ে যাচ্ছে বাবুর্চিখানার দিকে। তারপর দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। তারা কেউ কাছে থাকলে বাবা বলে, ‘তোমরা কেউ এসো না এদিকে।’ তারা কেউ কাছে যায় না কিন্তু এত দূর থেকেও চাবুকের শিক–শিক শব্দটা সে শুনেছে। বাসনপত্র মেঝেতে ফেলে দিলে যেমন হয় তেমনি কর্কশ বিকট একটা চিৎকার করে রেনি কাঁদতে থাকে।
তখন বাপ্পাও কাঁদতে থাকে ভিতরে ভিতরে। তার সমস্ত শরীরটা কাঠ হয়ে থাকে। ‘গেটটা ডিঙিয়ে অনেক দূরে চলে যেতে-যেতে চিৎকার করে বলে : ‘আমি কক্ষনো–কক্ষনো এখানে থাকব না।’
ফিরে-ফিরে বাঁ-হাতের কজিটাকেই মনে পড়ল বাপ্পার। কজিটা অবশ হয়ে–হয়ে এখন ছিঁড়ে যেতে চাইছে। বাবানীচু হয়ে গাছের গোড়া দেখছে। সে এক-পাও নড়তে পারছে না। বাপ্পা জানে বাবা তাকে যেভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে সেভাবেই তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কখনও সে
বাবার অবাধ্য হয় না। অবাধ্য হওয়ার কথা মনে হলেই চাবুকে বাতাস কাটবার সেই অদ্ভুত শব্দটা তার কানের কাছে বাজতে থাকে। বুকের ভিতরটা ছলাৎছলাৎ করতে থাকে। আর সে তখন খুব শান্ত হয়ে যায়। খুব শান্ত হয়ে থাকে বলেই মাঝে-মাঝে বাবা দুই হাতের মধ্যে তার মাথাটা চেপে ধরে বলে–’কখনও তুমি আবার অবাধ্য হও না, তাই না! এই তো আমি চাই। খুব শান্ত, সংযত, ভদ্র হতে চেষ্টা করো।’
.
‘কচু! কচু’ বাপ্পা মনে-মনে বলল : ‘মোটেই আমি শান্ত হতে চাই না, মোটেই না।’ পা দুটো ঝিনঝিন করছে বাপ্পার। সেঁও পিঁপড়ে কামড়ানোর মতো একটা যন্ত্রণা হাঁটুর কাছে, গোঁড়ালিতে। বাঁ-হাতটা এখন অবশ। কী ব্যথা হাতটায়। আঙুলগুলো আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না।
বাপ্পা এখন রেনিকে দেখছিল। রেনি পথ থেকে নেমে বাগানের উত্তরে কোণটার কাছে চলে গেছে। একটা গঙ্গাফড়িং রেনির নাকের ডগায় উড়ছে। আর সেই ফড়িংটাকে তাড়া করে ঝোঁপঝাড়গুলোর ভিতর দিয়ে এঁকে–এঁকে বেঁকে সরে যাচ্ছে।
ফড়িংটাকে ধরবার জন্যে রেনি লাফিয়ে ওঠে। বাপ্পা তাকিয়ে থাকে। রেনির লম্বা শরীরটা বাতাসে ঢেউ খেয়ে নিঃশব্দে মাটির ওপর পড়ে। ফড়িংটা এক ঝটকায় অনেকটা ওপরে উঠে গেছে।
রেনি লাফিয়ে ওঠে আবার। ফড়িংটা উড়তে–উড়তে উত্তর কোণ থেকে বাগানের বেড়ার কাছে কেয়া ঝোঁপটার পাশে সরে যাচ্ছে।
রেনি লাফাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে সরে যাচ্ছে। ডিগবাজি খাওয়ার মতো ভঙ্গি করে মাটির ওপর গড়াগড়ি দিচ্ছে।
ফড়িংটা লাফিয়ে উঠল। ফড়িংটা যেন রেনির সঙ্গে খেলছে। বাপ্পা তার পা দুটো সামান্য নাড়ল। ডান পা–টা বাড়িয়ে দিল। জুতোর ‘হিলটা’ পথের কর্কশ কাঁকরের ওপর ঘষতে লাগল আস্তে-আস্তে! খুব মৃদু সাইকেলের ‘চেন’ ছাড়বার মতো কিরকির কিরকির একটা শব্দ হতে লাগল।
বাপ্পা পা–টা জোরে চেপে ধরে পথের ওপর। জুতোটা ঘষতে থাকে। জুতোর তলায় মিহি ফুরফুরে কাঁকরগুলো গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। বাপ্পার ইচ্ছে করছিল কাঁকরের ওপর ঘষে–ঘষে হিলটা ক্ষয় করে ফেলে তারপর জুতোজোড়া পা থেকে খুলে টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
রেনি এখন কেয়া ঝোঁপটার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ফড়িংটা ওর মাথার অনেকটা ওপরে। রেনি ফড়িংটাকে দেখছে। পাতা ঝরে যাওয়া বিশ্রী শুকনো কুচ্ছিত বাগানটার সঙ্গে রেনির গায়ের বাদামি রংটা মিশে আছে।
রেনি পিছনের পা দুটো ভাঙল। ল্যাজটা নামালো। সামনের পায়ে অল্প একটু ভাঁজ। এক্ষুনি। লাফ দেবে রেনি!
ফড়িংটা দূরে সরে যাচ্ছে।
রেনি লাফ দেবে।
জুতোর ‘হিলটা মাটিতে জোরে–জোরে ঠোকে বাপ্পা।
‘আঃ বাপ্পা,’ বাবা সোজা হয়ে দাঁড়াল, ‘এক মিনিট–এক মিনিটও তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারো না!’
তার হাতটা ধরে একটা ঝাঁকুনি দেয় বাবা। বাপ্পা টাল খেয়ে পড়ে যেতে-যেতে বাবার হাতটা চেপে ধরে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল।
–কী হয়েছে? জুতোটা ঘষছিলে কেন? বাবা খুব জোর গলায় বলে।
রেগে গেলে বাবা এভাবেই চিৎকার করে। অবাধ্য রেনিকে বাবা এভাবেই চেঁচিয়ে ডাকে। বাবার দুটো চোয়াল শক্ত হয়ে ঢিপির মতো উঁচু হয়।
অস্পষ্টভাবে চাবুকে বাতাস কাটবার একটা শব্দ বাপ্পার কানের কাছে বাজতে থাকে।
–একটা কাঁকর আমার জুতোর মধ্যে ঢুকে গেছে।
–কাঁকর! বাবার জ দুটো জোড়া লাগে।
এবার বাবা তার হাতটা ছেড়ে দেয়।
–কাঁকরটা বের করে ফেলো।
বাপ্পা নীচু হয়ে হাঁটু ভেঙে লাল কাঁকর ছড়ানো পথের ওপর বসে জুতোটা খুলতে যাচ্ছিল।
বাবা একটা হাত তার দিকে বাড়িয়ে দেয়, ‘অসভ্য, নোংরা, জানোয়ার কোথাকার।’ বাবা বলে। বাড়ানো হাতটা দিয়ে তার ঘাড়ের কাছে শার্টের কলারটা ধরে তাকে আবার দাঁড় করিয়ে দিল বাবা।
–ধুলোর ওপর বসতে তোমার ঘেন্না হল না। দাঁতে–দাঁত চেপে বাবা বলে, ‘অসভ্য। ছোটলোকদের ছেলের সঙ্গে মিশলে এরকমই হয়।’
আপন মনে মাথা নাড়ে বাবা, ‘নাঃ, তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তোমার ওপর আমার কোনও আশাই নেই। তুমি নষ্ট হয়ে যাবে, একদম নষ্ট হয়ে যাবে।’
বাপ্পা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এখন সে বাবাকে দেখছিল না। বাবার কথাও শুনছিল না। সে দেখতে পেল ফড়িংটা কেয়া ঝোঁপের পাশ দিয়ে উড়ে কম্পাউন্ডের বেড়ার ওপর দিয়ে বাইরে চলে গেল। রেনি দৌড়ে বেড়াটার ধারে গেল।
রেনি এখন বাইরে যাওয়ার একটা পথ খুঁজছে।
বাপ্পা তাকিয়েই রইল।
রেনি অস্পষ্ট শব্দ করল। বাবা ফিরে তাকাল।
রেনি এদিক-ওদিক ছুটে একটা পথ খুঁজছে। বাপ্পা তাকিয়ে রইল।
বাবা ডাকল, ‘রেনি।’ চোখের পলক না ফেলতেই তারের আর মেহেদি পাতার বেড়ার ভিতরে ছোট একটা গর্তের মধ্যে রেনির বাদামি লম্বা শরীরটা ঢুকে গেল।
রেনি এখন ওপাশে।
বাবা ডাকল, ‘রে–ই–নি–ই–ই।’
ছোট একটা নিশ্বাস ফেলল বাপ্পা। এতক্ষণ ধরে যে এইটেই চাইছিল।
বাবার আঙুলগুলো পাক খেল, জোঁকের মতো জড়িয়ে গেল। বাবার মুখটা লাল। চোয়ালের ওপর দুটো ঢিপি।
বাবা গেটের কাছে এগিয়ে গেল।
আবার ডাকল, ‘রেই–নি–ই–ই।’
শব্দটা শিস দেওয়ার শব্দের মতো তীব্রতর হল। তারপর অনেকগুলো তিরের মতো বাতাস চিরে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু রেনি ফিরল না। রেনির বাদামি রঙের হিলহিলে লম্বা শরীরটা দুলতে দুলতে দূরে চলে যেতে লাগল।
বাবা ‘গেটটা খুলে বাপ্পার দিকে ফিরল, ‘তুমি এখানেই থেকো। বাড়ির বাইরে যাবে না।’ বাপ্পা মাথা নাড়ল।
বাবা গেটটা বন্ধ করে রাস্তা পার হয়। জোরে–জোরে হাঁটতে থাকে মাঠটার মধ্যে। রেনি এখন ছুটছে। সহজে ধরা দেবে না রেনি–বাপ্পা জানে।
বাপ্পা মাঠটার দিকে একবার তাকাল, তারপর শুকনো ঘাসফুলের বেড়া ডিঙিয়ে এক দৌড়ে বাড়ির পিছন দিকটায় চলে এল। এখানে গাছগুলো বড়-বড়। একবার সমশেরের বাড়ি গেলে হয় –ভাবল বাপ্পা। কিন্তু সামনের দিকে গেট পেরোতে গেলে খোলা মাঠ থেকে বাবা তাকে দেখে ফেলতে পারে।
ভাবতে-ভাবতে জামগাছটার তলায় চলে এল বাপ্পা। খুব নির্জন এদিকটা। কেউ নেই। কম্পাউন্ডের পাশ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার চলে গেছে।
বাঁ-হাতটা কবজির কাছে এখনও লাল। যেন কোনও সাড় নেই হাতে। হাতটা পুরোপুরি অবশ হয়ে গেছে কি না দেখবার জন্যই বাপ্পা বাঁ-হাত দিয়ে একটা নুড়ি কুড়িয়ে নেয়। চারদিকে তাকায় বাপ্পা। কেউ নেই।
সবচেয়ে কাছে যে টেলিগ্রাফের পোস্টটা ছিল বাপ্পা সেটার দিকে নুড়িটা ছুঁড়ে মারে। নুড়িটা অনেক দূর দিয়ে চলে গেল।
বাঁ-হাতের কজিটাতে তেমন জোর পাচ্ছে না সে। সে আর সমশের প্রায়ই এইখানে দাঁড়িয়ে ওই পোস্টটার গায়ে ঢিল মারে। সমশেরের চেয়ে আমি ভালো পারি’–এই ভেবে যেখানে জামগাছের তলায় নুড়িগুলো জড়ো করে দেখত তারা সেদিকে এগোয়।
নুড়ি তোলবার জন্যে হাত বাড়ায় বাপ্পা।
গাছের তলায় ঘাসগুলো লম্বা, ঘন সবুজ। নুড়িগুলো একপাশে জড়ো করা। বাপ্পা নীচু হতে গিয়ে ঝুঁকতেই দেখতে পেল জড়ো করা নুড়িগুলোর পাশে ঘাসগুলো সরু একটা রেখার মতো দুপাশে সরে যাচ্ছে। ‘সাপ’ বাপ্পা ফিসফিস করে বলল ,–’সাপ। একটা সাপ।’ তার প্রসারিত হাতটা ঠান্ডা।
বাপ্পা স্থির হয়ে থাকে। খুব স্বচ্ছন্দ গতিতে কালো সাপটা এগিয়ে এসে পাথরগুলোর কাছে থামল। চওড়া মস্ত বড় ফণাটা ভেসে উঠল ঘাসের ওপর। আবার ডুব দিল।
বাপ্পা পিছিয়ে আসবার জন্য একটা পা আলগা করল।
সমস্ত শরীরে ঢেউ তুলে, যেন তেল মাখানো কোনও জায়গার ওপর চলছে এমনি পিচ্ছিল গতিতে সাপটা সেই পাথরের স্কুপের ওপর উঠল। চকচকে আঁশগুলোর ওপর হলদে রঙের আলপনা।
বাপ্পা পেছন দিকে একটা প্রকাণ্ড লাফ দিল। ঠিক লাফ নয়, যেন কেউ তাকে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
মাটির ওপর পড়ে গেল বাপ্পা। সাপটা এখনও পাথরগুলোর ওপর মুখ তুলে। সেই মুখ থেকে পেট পর্যন্ত ছাই–রঙা।
হামাগুড়ি দিয়ে বাপ্পা সরে যেতে থাকে। খুব তাড়াতাড়ি সরে আসবার জন্যেই মাটিতে ছোট্ট পাথরের টুকরো আর বালিতে তার হাঁটু আর হাতের তেলোছড়ে যেতে থাকে।
অনেকটা দূর চলে এসে বাপ্পা সোজা হয়ে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে আবার দৌড় দিয়ে আরও খানিকটা পিছিয়ে এল বাপ্পা। খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে বাপ্পার। দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বুকের ভিতর ছলাৎছলাৎ রক্তের শব্দ শোনে।
সাপটা ফণা তুলেছিল। ফণাটা তুলে যেন তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই অল্প-অল্প পিছিয়ে যেতে থাকে সাপটা। ফণাটাকে দুলিয়ে ঝাঁকানি দিয়ে–দিয়ে সাপটা পিছিয়ে যেতে থাকে।
এবার বাপ্পা হাসে। সাপটা ভয় পেয়েছে।
একটা ঢিল তুলে নিয়ে বাপ্পা হাতটা দোলাতে থাকে। সাপটাকে আরও ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য বলে–’এই হ্যাট–হ্যাট। যাঃ’–
সাপটা একটু করে পেছোয়।
বাপ্পা একটু করে এগোয়।
সাপটা মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে থাকে। ঘাসের ওপর তেমনি আঁকাবাঁকা সরু রেখা উঠল।
বাপ্পা এগোতে থাকে।
বাবুর্চিখানার সামনে ছোট্ট বাঁধানো চত্বরটায় আবার মুখ তোলে সাপটা।
–হ্যাট, হ্যাট। যাঃ—
ধীরে-ধীরে চত্বরটা পেরিয়ে যায় সাপটা। মজা লাগে বাপ্পার। কেন যেন হাসি পায়।
সাপটা এগোচ্ছে।
বাবুর্চিখানার দরজাটা খোলা। সাপটা একবার মাথা তোলে।
–হ্যাট, হাট–বাপ্পা বলে। এখন বুকের ভিতর সেই ছলাৎছলাৎ শব্দটা নেই। কেমন যেন উত্তেজনা বোধ করে বাপ্পা। তার কান দুটো গরম এখন।
পকেটে হাত গুঁজে বাপ্পা দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে দেখতে পায় সাপটা আস্তে-আস্তে বাবুর্চিখানার চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে।
এবার ফিরে আসে বাপ্পা। ফিরে সামনের বাগানের দিকে চলতে থাকে। পা দুটো ঝিনঝিন করছে হাঁটুর কাছে ছড়ে যাওয়া জায়গাটা লাল পুঁতির দানার মতো রক্ত জমে আছে। হাতের তেলো দুটো জ্বলছে। এতক্ষণ এই ছড়ে যাওয়া জায়গাগুলো টের পাচ্ছিল না বাপ্পা। এখন তার চলতে কষ্ট হচ্ছে। হাঁটু দুটোয় ব্যথা, হাতের তেলোয় জ্বলুনি।
সামনের বাগানের গেটটার কাছে এসে দাঁড়াল সে। অনেক দূরে মস্ত উদোম খোলা মাঠটার ওপর বাবাকে দেখতে পায় বাপ্পা। মস্ত বড় আকাশ আর ভোলা উদোম মাঠটার মাঝখানে বাবাকে ছোট্ট মতো দেখায়। বাবা রেনির গলার বকলশটা ধরে তাকে টেনে নিয়ে আসছে।
বাবা খুব কাছ এসে পড়ার আগেই বাপ্পা গাঁদা গাছগুলোর কাছে এসে দাঁড়ায়। গাঁদা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে হাঁটুর ওপর ঘষতে থাকে।
গেটের কাছে বাবার গলা শোনা যায় : ‘অবাধ্য–অবাধ্য কুকুর! চাবুক দিয়ে শায়েস্তা করতে হয় তোমাকে।’ বাবা বাগানের মধ্যে দিয়ে রেনিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে।
–বাপ্পা, বাপ্পা–আ। বাবা ডাকে।
বাপ্পা দৌড়ে বাবার কাছে চলে আসে।
বাবা তার দিকে তাকায়। বাবার চোয়ালের ঢিপি দুটো এখন উঁচু। মুখটা লাল টক–টক করছে।
–কোথায় ছিলে তুমি এতক্ষণ? বাবা বলে।
–এখানেই।
তার হাঁটুর দিকে তাকায় বাবা। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে ‘ওগুলো কী? অ্যাাঁ। কেটে গেল কেমন করে?’
–আমি পড়ে গিয়েছিলাম।
বাবা আর কিছু বলে না। শুধু কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার রেনিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। বাবা এখন পেছন দিকের বাগানে যাবে।
বাবা, আমি কি আসব? বাপ্পা চেঁচিয়ে জিগ্যেস করে।
বাবা তার কথা শুনতে পায় না। রেনিকে বকতে–বকতে বাবা এগিয়ে যাচ্ছে। এবং তারপর বাবা আর রেনি বাড়ির পিছন দিকটায় চলে যায়।
নির্জন শুকনো ম্যাড়ম্যাড়ে বাগানটায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে বাপ্পা। সাপটা–সাপটা–ও ঘরেই আছে–ভাবে বাপ্পা। তার বাবা এখন ও ঘরেই যাবে।
–বাবা–প্রাণপণে চেঁচিয়ে ডাকে বাপ্পা, তারপর ছুটতে শুরু করে। বুকের ভিতরে ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা শুনতে পায় সে। ‘বাবা’–প্রাণপণে ছুটতে থাকে বাপ্পা। ছুটে এসে জামগাছটার তলায় দাঁড়ায়। বাবুর্চিখানার চত্বরে বাবা আর রেনি। বাবা রেনিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। রেনি যাবে না। রেনি চারটে পা ছড়িয়ে দিয়ে জেদি ছেলের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। বাবার মুখটা ভয়ঙ্কর লাল। চোয়ালের টিপি দুটো খুব উঁচু।
–বাবা প্রায় ফিসফিস করে বলে বাপ্পা। বাবা রেনিকে দরজার কাছে নিয়ে গেল। বাবা তাকে দেখতে পেল, চেঁচিয়ে বলল –’বাপ্পা, এখন এখানে এসো না, চলে যাও।’
তবু বাপ্পা দাঁড়িয়ে থাকে। তার পা দুটো থরথর করে কাঁপে। ঠোঁট দুটো শুকনো, গলাটা শুকনো। প্রাণপণে চেঁচাতে ইচ্ছে করল বাপ্পার। সে বলতে চাইল–’বাবা, বাবা গো, ও-ঘরে একটা সাপ। মস্ত বড় ভয়ঙ্কর একটা সাপ; এখন ও-ঘরে তুমি যেও না, যেও না।’ কিন্তু সে বলল না। ভাবল–’থাক। দেখাই যাক কী হয়।’
‘একটা ভীষণ মজা হবে এক্ষুনি। কী মজা–সাপটা ও-ঘরে আর বাবাও এখন ও-ঘরে।’ ভাবে বাপ্পা। তার সমস্ত শরীরটা উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে।
বাবা ভিতর থেকে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। সেই ‘দড়াম’ শব্দটা বাপ্পাকে যেন ধাক্কা দিল। তার প্রায় অবশ হাঁটু দুটো ভেঙে সে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। জামগাছটার গুড়িতে নিজের হাতটাকে চেপে ধরে সে। ‘আমি বলে দিইনি, বলে দিইনি, ও-ঘরে কী আছে। আমি বলে দিইনি, বলে দিইনি–বলিনি’–যন্ত্রের মতো বাপ্পা এই কথাটাই বারবার বলতে লাগল। চাবুকের কি শিক শব্দটা শুনতে পেল সে। বাসনপত্রের কর্কশ শব্দের মতো শব্দ করে রেনি কান্না শুরু করল।
বাপ্পা কাঠ।
চাবুকের শব্দটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। রেনির কান্নাও।
‘বাবা’ চিৎকার করল, বাপ্পা, ‘বাবা, বাবা গো। বাবা, বাবা’–প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল বাপ্পা। লম্বা ঘাসগুলোয় তার পা আটকে যাচ্ছিল। পড়তে–পড়তেও ছুটতে লাগল বাপ্পা। বাঁধানো চত্বরটা পার হয়ে দরজার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে, ‘বাবা, বাবা। আমি বাপ্পা।’
‘বাপ্পা’–বাবার গলা শোনা গেল। স্থির গম্ভীর গলা, ‘বাপ্পা, এ-ঘরে একটা মস্ত বড় বিষাক্ত সাপ।’
–তুমি দরজাটা খুলে বেরিয়ে এসো বাবা। বেরিয়ে এসো।
–আমি বেরিয়ে যেতে পারছি না বাপ্পা। সাপটা দরজার কাছেই। আমি দরজাটা খুলতে পারছি না। নিস্তেজ গলায় বাবা বলে।
–তুমি বেরিয়ে এসো বাবা। বেরিয়ে এসো। শুধু একথাটুকুই বলতে পারল বাপ্পা, ‘তুমি বেরিয়ে এসো।’
–’আঃ বাপ্পা, আমি কেমন করে বেরোব–’ দরজার ওপাশে যেন অনেক দূর থেকে বাবার গলা শোনা গেল, ‘এ-ঘরে কিছুই নেই! তুমি আমাকে একটা কিছু দাও। একটা লাঠি কিংবা ওই ধরনের কিছু।’
বাপ্পা ছুটে জানালাটার কাছে এল। কাচভাঙা ছোট্ট জানালাটার ওপর উপুড় হয়ে পড়ল প্রায়। ‘বাবা মরে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে’–বাপ্পা বলে।
ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। বাপ্পা চোখ বড়-বড় করে তাকাল।
–কোথায় তুমি বাবা? কাঁদতে থাকে বাপ্পা!
–এই যে বাপ্পা। বাবা সিমেন্টের তৈরি বেদির মতো উনুনটার কাছ থেকে জানালার দিকে তাকাল। বাবার চোখ দুটো বড়-বড়। বাবা ভয় পেয়েছে।
–বাপ্পা দেখতে পায় উনুনটার ওপরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রেনি। বাবার হাতের চাবুকটা স্থির। বাবা এতটুকু নড়ছে না।
–বাপ্পা, আমি নড়তে পারছি না। তুমি দাঁড়িয়ে থেকো না। একটা কিছু এনে আমার হাতে দাও। বাবার গলাটা কাঁপছে।
সাপটা দরজার কাছে। সমস্ত শরীরটা দুটো বাঁক খেয়ে গোল হয়ে রয়েছে। ফণাটা উঁচু করে আস্তে-আস্তে দুলছে সাপটা। ফণাটা এত উঁচুতে যে সেটা অনায়াসে তার বাবার বুকের কাছে বোধহয় ছোবল দিতে পারে। বাবা পিছন দিকে হাত বাড়িয়ে কিছু খুঁজছে। সেই হাতদুটো থরথর করে কাঁপে। বাপ্পা দেখে।
‘বাপ্পা।’ বাবা স্থির দৃষ্টিতে সাপটাকে দেখছে।
সাপটা একটু ঝাঁকানি দিয়ে পিছু হটে গেল। মাথাটা পিছন দিকে হেলাল।
‘বাপ্পা দাঁড়িয়ে থেকো না,’ বাবা চাপা গলায় বলে।
সাপটা চাবুকের মতো ছিটতে লাফিয়ে পড়ল সামনের দিকে। বাবা ডান দিকে সরে গেল। সরতে গিয়ে উনুনটার ওপর টাল খেয়ে পড়ে গেল বাবা। সাপটা সরে যাওয়ার আগেই বাবা হামাগুড়ি দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
রেনির দাঁতগুলো বিশ্রীভাবে বেরিয়ে এল। ঘ্যাক করে একটা অদ্ভুত শব্দ করে রেনি। দেয়ালের দিকে সরে যায়। তারপর সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে গোঁ–গোঁ করতে থাকে। সাপটা একটা দোল খেয়ে সোজা হয়। আবার দরজার দিকে সরে যেতে থাকে। বাবার কপালের কাছে। দুটো শিরা জোঁকের মতো ফুলে আছে। চোখ দুটো বড়-বড়। ‘বাপ্পা, দাঁড়িয়ে থেকো না’ বাবা বলে। চকচকে আঁশ আর হলদে ডোরাকাটা সাপটা তার বাবার দিকে ফেরে। উঁচু ফণাটা দুলতে থাকে।
বাপ্পা চোখ বোজে, ‘আমি নড়তে পারছি না বাবা, নড়তে পারছি না। আমার হাত-পা গুলো অবশ।’ বাপ্পা ফিসফিস করে বলে। জানলার কাছে থেকে সরে আসে বাপ্পা। দাঁতে–দাঁত চাপে। কোমরটা অবশ। দুটো হাত মুঠো পাকিয়ে ছুটতে শুরু করে বাপ্পা। ‘একটা লাঠি–একটা লাঠি একটা লাঠি’ বাপ্পা যন্ত্রের মতো বলতে থাকে। আর ছুটতে থাকে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার।
বাপ্পা দেখে ছুটে বাগানটা পার হতে অনেক সময় লেগে যাবে। বাড়ির ভিতর থেকে লাঠি আনতে। বাপ্পা থেমে বাঁ-দিকে ছোটে। কিন্তু কোথাও একটা লাঠি নেই। কিছু খুঁজে পায় না বাপ্পা। জিওল গাছটার তলায় এসে দাঁড়ায় বাপ্পা। এখন হাঁফাতে-হাঁফাতে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিমগাছটার সঙ্গে ঠেস দিয়ে একটা মস্ত বড় ঘুণে ধরা বাঁশ দাঁড় করানো। বাপ্পা এক লাফে নিমগাছটার কাছে চলে আসে।
বাঁশটা নিয়ে আবার জানলার কাছে আসে বাপ্পা। বাবা এখন উনুনটার ওপর দাঁড়িয়ে। রেনি গোঁ–গোঁ করে দেওয়ালের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। উঃ বাপ্পা’–বাবা চিষ্কার করে বলে–’বাঁশ দিয়ে কী হবে? বাঁশ নয়। একটা লাঠি এনে দাও। তাড়াতাড়ি বাপ্পা। তাড়াতাড়ি।’ বাঁশটা ফেলে দিয়ে বাপ্পা পা বাড়ায়। কিন্তু পা অবশ। একদম নড়তে পারছে না সে। তার বুক মাথা গলা জুড়ে একটা কল চলবার মতো শব্দ। সাপটা পিছলে–পিছলে এগিয়ে আসে। ফণাটা বাতাসে দুলে চাবুকের শব্দ করে।
‘বাপ্পা, দেরি কোরো না, দেরি কোরো না।’ বাবা বলে। অস্পষ্টভাবে বাপ্পা দেখতে পায় বাবা রেনির বকলশটা চেপে ধরে ঠেলে রেনিকে সামনে এগিয়ে দিচ্ছে।
অন্ধের মতো বাপ্পা পা বাড়ায়। তার গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। চোখে কিছু দেখছে সে। চোখ দুটো জলে ভরা। বাড়াতে গিয়ে বাপ্পা পড়ে যেতে থাকে। ‘সাপ, সাপ, সা–আ–প’ চিৎকার করতে-করতে বাপ্পা ছোটে। কোথায় ছুটে যাচ্ছে বুঝতে পারবার আগেই চত্বরটার ওপর তার ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরটা টলে পড়ে যেতে থাকে।
.
যখন অনেক বড় হয়েছিল বাপ্পা তখন সে তার ছেলেমেয়েদের কাছে কিংবা নাতি–নাতনিদের কাছে ফিরে-ফিরে এই গল্পটাই বলত। কিন্তু যখন বলত বাপ্পা, তখন গল্পটার কোনও-কোনও অংশকে সে ঢাকা দিত। ঢাকা দিত তার কারণ, এই স্মৃতির কোনও-কোনও অংশকে সে বুঝতে পারত না। এই বুঝতে না পারা অংশগুলো ছিল ছোট্ট–ছোট্ট, অস্পষ্ট, অন্ধকার গর্তের মতো। এই গর্তে কী আছে, কোন অদ্ভুত রহস্য তা বাপ্পা বুঝতে পারত না। তাই গল্পটা বলতে-বলতে মাঝে মাঝে থামত সে। অনেক কিছুই তো আমরা ঢাকা দিই, ঢাকতে চাই–ভাবত বাপ্পা। ভাবতে ভাবতে অদ্ভুতভাবে একটু হাসত সে। বুকের ভিতরে ছলাৎছলাৎ রক্তের শব্দ শুনত। তীব্র একটা উত্তেজনাকে অনুভব করত দেহের ভিতরে। তারপর থেমে–থাকা গল্পটাকে শুরু করবার জন্য মনে-মনে প্রস্তুত হত। মনে-মনেই সেই অদ্ভুত রহস্যময় অন্ধকার গর্তগুলোকে লাফ দিয়ে পেরিয়ে আসত বাপ্পা।