2 of 2

সাপ – শিশির বিশ্বাস

সাপ – শিশির বিশ্বাস

হিস—হিস।

একজন মানুষের মুখে শব্দটা শুনে প্রথম দিন প্রায় চমকে উঠেছিলাম। পরে বুঝেছিলাম, সুমন্তবাবুর ওটা মুদ্রাদোষ। উত্তেজিত হয়ে উঠলে জিভটা তালুতে ঠেকিয়ে ওই অদ্ভুত শব্দটা বের করেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে অনেক দিন আগেই আলাপ হওয়া উচিত ছিল। বলতে গেলে উনিই আমার নিকটতম প্রতিবেশী। আমার বাড়ির ঠিক পুব দিকে মস্ত একটা বাগান। বাগানের একপাশে পুরোনো নোনা-ধরা ইটের একটা ভাঙাচোরা বাড়ি। ওইরকম একটা পোড়ো বাড়িতে যে কোনও মানুষ বাস করতে পারে, ভাবতেই পারিনি। নতুন জায়গা যদিও, প্রায় মাস-দুই হল এসেছি। সেদিন সনাতন এসে জানাল, বাবু, সামনের বাড়িতে এক ভদ্রলোক থাকেন। প্রায় বারই হন না ঘর থেকে। সেদিন আমার সামনে পড়তেই কেমন ছুটে পালিয়ে গেলেন।

শুনে সত্যি অবাক হয়েছিলাম। তারপর তক্কে-তক্কে রইলাম। ভদ্রলোককে পেলেই যেচে আলাপ করব। কয়েকদিনের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সফল হলাম।

ভদ্রলোক সত্যিই অসামাজিক। বয়েস হয়েছে। বোধহয় বেশ কয়েক দিন স্নান করেননি। সারা গায়ে খড়ি ফুটেছে। কেমন একটা ঝিমুনি ভাব। কথা বললেন খুব কম। প্রায় সারাক্ষণই হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। অদ্ভুত পলকহীন দৃষ্টি। বেশ বিরক্ত হয়েই ফিরে এলাম।

এর দিন কয়েক পরের কথা। সেদিন সকালে বাইরের ঘরে বসে চা খাচ্ছি, এমন সময় সুমন্তবাবু এসে হাজির। দেখে চমকে উঠলাম। ঝকঝকে উজ্জ্বল চেহারা। ক’দিনে বয়েস যেন অনেকখানি কমে গেছে। প্রথমে তো ভেবেছিলাম, ইনি বোধহয় অন্য কেউ। কিন্তু ভুল ভাঙল। উনি প্রথমেই সেদিনের ব্যবহারের জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। বললেন, সেদিনের জন্যে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আসলে আমি একটু অসামাজিক। তার ওপর ক’দিন ধরে শরীরটা মোটেই ভালো যাচ্ছিল না। তা, হ্যাঁ মশাই, আপনি এই বাড়িটা হঠাৎ কিনে নিলেন নাকি?

মাথা নেড়ে বললাম, না, তেমন কিছু নয়। মাস কয়েকের জন্যে ভাড়া নিয়েছি। ছোটখাটো একটা ব্যবসা রয়েছে, সেই দরকারেই এখানে আসা।

ও তাই বলুন।—সুমন্তবাবুর গলার স্বর কতকটা যেন আশ্বস্ত হওয়ার মতো শোনাল, আমি ভাবলাম বুঝি কিনে নিয়েছেন বাড়িটা। তা যাই বলুন, আপনার সাঙ্গো-পাঙ্গগুলো কিন্তু মোটেই সুবিধের নয়। কেমন বিচ্ছিরি স্বভাবের।

সামান্য হেসে বললাম, কেন বলুন তো! ওদের তো নেহাত ভালোমানুষ বলেই জানি। ঝোপেঝাড়ে সাপ ধরে বেড়ায়। ওদের কাছ থেকে সেগুলো নিয়ে আমি কলকাতায় চালান দিই। কলকাতার অনেকগুলো ল্যাবরেটরিতে সাপ জোগান দিতে হয় আমাকে।

হাঁ করে আমার কথা শুনছিলেন সুমন্তবাবু। উজ্জ্বল চোখদুটো ক্রমশ বড়-বড় হয়ে উঠছিল। হঠাৎ হো-হো করে বিশ্রীভাবে হেসে উঠলেন। হাসতে-হাসতেই বললেন, বলেন কী মশাই! সাপ ধরবেন, তার জন্যে এই ছোটনাগপুরে এসেছেন!

একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন, এসে কিছু ভুল করেছি নাকি? গ্রামে সাপ মিলবে না তো মিলবে কোথায় বলুন দেখি?

শুনে উনি হাসি থামিয়ে হাঁ করে খানিক তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর বললেন, হ্যাঁ, তা বটে। তবে কী জানেন, এখানে নেহাত ছোটখাটো সাপের দেখাই পাবেন বেশি। জাঁদরেল সাপের কথা যদি বলেন, তবে তা ওই শহরেই। আমি অনেকদিন ছিলাম কিনা! কী বলব মশাই, বিরাট-বিরাট সাপ সেসব—পাইথন, কিং কোব্রা, ভাইপার। তাদের অনেকে আবার জাতভাইদেরও ধরে খায়। শেষটায় থাকতে না পেরে পালিয়ে এলাম। এখন দিব্যি আছি এখানে।—বলতে-বলতে হঠাৎ কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা, আজ তবে আসি, স্যার।

আমায় কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই উনি দুম করে চলে গেলেন। প্রায় সেই মুহূর্তেই সনাতন ঘরে ঢুকে যে-সংবাদটা দিল, তাতে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে, সুমন্তবাবুর ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গেলাম।

সামান্য হাঁপানির টান থাকার জন্যে দু-বেলা ছাগলের দুধ না হলে চলে না আমার। এখানে এসেই তাই ভালো জাতের একটা পাটনাই দুধেল ছাগল কিনেছিলাম। সেই ছাগলটাকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। সনাতন গোড়ায় খবরটা দেয়নি আমাকে। ভেবেছিল, দড়ি ছিঁড়ে এদিক-ওদিক কোথাও গেছে। কিন্তু খোঁজাই সার হয়েছে।

ছাগলটাকে তারপর আর পাইনি। লোকজন লাগিয়ে খোঁজাখুঁজি নেহাত কম হয়নি। কিন্তু কোনও হদিশই করা গেল না। তাই সেদিন সকালেই সনাতনকে পাঠিয়েছিলাম মাইল-দশেক দূরে একটা হাটে—নতুন একটা দুধেল ছাগলের খোঁজে।

সনাতন বাড়ি নেই। দুপুরে তাই একাই বেরিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে পাহাড়ের গায়ে পাতলা জঙ্গল। সাপখোপে ভরতি। প্রায় রোজই সনাতনকে নিয়ে এখানে আসি। সনাতন ওস্তাদ সাপুড়ে। দিন কয়েক আগে বেশ বড় জাতের চন্দ্রবোড়া ধরেছে এখান থেকে।

জঙ্গলে আপনমনে ঘোরাঘুরি করছি, হঠাৎ পাশের একটা ঝোপের ভেতর থেকে হিস-হিস শব্দ কানে আসতেই সতর্ক হয়ে উঠলাম, সাপ!

মুহূর্তে পাশ ফিরেই কিন্তু একদম বোকা বনে গেলাম। ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে সুমন্তবাবু। জামায়, মাথার চুলে, দু-একটা শুকনো পাতা লেগে রয়েছে। বোঝা যায়, ঝোপের ভেতরেই ছিলেন এতক্ষণ। বেরিয়ে এসেছেন। আমায় তাকাতে দেখে হো-হো করে হেসে উঠলেন : কী মশাই, সাপ খুঁজে বেড়াচ্ছেন বুঝি?

অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, খুব বোকা বানিয়ে দিলেন, মশাই, যা হোক। কিন্তু ওই ঝোপের মধ্যে একা-একা করছিলেন কী? জায়গাটা তো সাপখোপের রাজ্যি।

হাসালেন মশাই! পঁচিশ বছর আছি এখানে। আমায় সাপের ভয় দেখাচ্ছেন! আপনাকে সেদিন বললাম না, সাপ দু-চারটে এদিকে পাবেন বটে, তবে তারা নেহাতই গাঁইয়া। মানুষের ধারে-কাছে মাড়ায় না। আমি তো কতদিন রাত্তিরে গরমের সময়, ওই যে বড় পাথরটা দেখছেন, ওটার ওপর শুয়ে থাকি। বেশ আরাম।

শুনে প্রায় আঁতকে উঠলাম : বলেন কী, মশাই! রাত্তিরে ওই পাথরটা তো সাপের আড্ডা বিশেষ। চারপাশে সাপের বিষ্ঠা কত দেখেছেন!—বলতে-বলতে একটু বুঝি অন্যমনস্ক হয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি, সুমস্তবাবু অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। পলকহীন উজ্জ্বল দুই চোখের তারা মড়ার মতো স্থির। সেই অদ্ভুত দৃষ্টি হঠাৎ কেমন যেন আচ্ছন্ন করে ফেলল আমাকে। বোধহয় আর-একটু হলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম। হঠাৎ এক কাণ্ড হয়ে গেল।

আমার হাতে ছিল বড় একটা ফ্লাস্ক ভরতি কার্বলিক অ্যাসিড। সনাতন নেই বলেই আজ ওটা সঙ্গে নিয়েছিলাম। হাতটা অবশ হয়ে আসতে ফ্লাস্কটা সশব্দে হাত থেকে পড়ে ফেটে গেল। খানিকটা অ্যাসিড ছিটকে উঠল।

মুহূর্তে প্রায় যেন লাফিয়ে উঠলেন সুমন্তবাবু। কুঁকড়ে গেল দেহটা। কাপড়ে নাকটা চেপে ধরে বললেন, চলি, স্যার। বেশি সূর্যের আলো আমার মোটেই সহ্য হয় না। সেই কারণে বাইরে বেরোই না বিশেষ।

প্রায় ছুটতে-ছুটতে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।

এ ক’দিন সুমন্তবাবুকে নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাইনি। কিন্তু আজকের ব্যাপারটার পর সত্যিই বেশ ভাবনায় পড়ে গেলাম। রাত্তিরে বিছানায় শুয়েও দুপুরের ব্যাপারটা মাথা থেকে নামাতে পারছিলাম না। পুরো ঘটনাটাই তখন আমার কাছে একটা হেঁয়ালির মতন।

রাত্তির তখন ক’টা হবে ঠিক খেয়াল নেই। সমানে এপাশ-ওপাশ করতে-করতে বুঝি একটু তন্দ্রাভাব এসেছে, হঠাৎ একটা চাপা শব্দে সেটা কেটে গেল। একটু কান পাততেই শুনতে পেলাম, বাইরে নতুন আসা ছাগলটা ঘন-ঘন পা ঠুকছে। ছাগলটা সনাতন আজ বিকেলেই কিনে এনেছে। চট করে উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। সন্তর্পণে জানলা দিয়ে তাকালাম। প্রথমটা কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু একটু বাদেই নজরে পড়ল, গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে পলকহীন দুটো জ্বলজ্বলে চোখ ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে।

আর দেরি করলাম না। অন্ধকারেই হাতড়ে ড্রয়ার থেকে পিস্তলটা বার করে গুলি চালালাম। সঙ্গে-সঙ্গে দপ করে নিভে গেল চোখদুটো। দুপদাপ একটা শব্দ। কিছুই আর দেখতে পাওয়া গেল না। সনাতনকে তুলে তৎক্ষণাৎ বাইরে এলাম। কিন্তু কিছুই নজরে পড়ল না। খোঁয়াড়ে বাঁধা ছাগলটা তখনও থরথর করে কাঁপছে। গায়ের লোম খাড়া। সন্দেহ হল, কোনও বুনো জানোয়ার এসেছিল। ছাগলটাকে ভেতরে নিয়ে এসে শুতে গেলাম।

দিনকয়েক পরের কথা। সেদিন সকালে সনাতন উত্তেজিতভাবে ডাকতে বাইরে এসে দেখি, সুমন্তবাবুর পোড়ো বাড়িটার ওপর অনেকগুলো শকুন উড়ছে। বেশ নিচু দিয়ে। গত সন্ধে থেকে একটা পচা গন্ধ নাকে আসছিল। ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক। এদিকে ক’দিন ধরেই সুমন্তবাবুর দেখা নেই। অন্তত একটু খোঁজ নেওয়া উচিত। অতঃপর কিছু লোকজন নিয়ে পোড়ো বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

নীচতলায় শোওয়ার ঘর একটা। গন্ধটা সেখান থেকেই আসছে। এগিয়ে গিয়ে দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। চৌকাঠে পা ফেলেই চমকে উঠলাম। ভেতরে একধারে মস্ত একটা সেকেলে খাট। খাটের পায়া, ঘরের কোণ বড়-বড় সাপের খোসায় ভরতি। ঘরটিতে যে কোনওদিন মানুষ বাস করেছে তার চিহ্নমাত্র নেই। মস্ত বড় একটা পাইথন সেই খাটের ওপর মরে পড়ে আছে। ঘাড়ের একটু নীচে গুলির দাগ।

পায়ে-পায়ে ঢুকে পড়লাম ঘরের মধ্যে। আর তখনই নজরে পড়ল সাপের চোখদুটো। পলকহীন মরা চাউনি। জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। দৃষ্টিটা খুব পরিচিত। মুহূর্তে ছুটে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।

মাসিক রোমাঞ্চ

ফেব্রুয়ারি-মার্চ, ১৯৮২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *