1 of 2

সাপের হাঁচি – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

সাপের হাঁচি – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

পরীক্ষা দিয়ে সুশান্ত তার মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। পাড়াগাঁয়ে মামার বাড়ি, কিন্তু কলকাতা থেকে বেশি দূর নয়। ডায়মন্ড-হারবার লাইনে রেলে চড়লে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেখানে পৌঁছানো যায়।

সকালবেলা প্রায় সাড়ে আটটার সময় সেখানে উপস্থিত হয়ে সুশান্ত দেখল, মামার বাড়িতে হই-হই কাণ্ড বেধে গেছে! মামা বেশ ভারিক্কি লোক, বয়েস হয়েছে। কিন্তু তাঁর মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। তিনি কখনও দু-হাতে নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছেন, কখনও ভীষণ চিৎকার করে গাঁ-সুদ্ধ লোককে গালাগাল দিচ্ছেন। ওদিকে বাড়ির ভিতরে মামিমা গলা ছেড়ে কান্না শুরু করে দিয়েছেন। তাঁর গলার আওয়াজ যদিও খুব উঁচুতে উঠছে, তবু তিনি যে কী বলছেন তা একবর্ণও বোঝা যাচ্ছে না।

মামা যদিও গ্রামের মধ্যে বেশ বর্ধিষ্ণু লোক, তবু তাঁর বাড়ি মাঠ-কোঠার—খড়ের চাল। এ-অঞ্চলে পাকাবাড়ির বড় একটা রেওয়াজ নেই। চণ্ডীমণ্ডপে মামাকে ঘিরে অনেক লোক বসেছিল, সুশান্ত সেখানে গিয়ে মামাকে প্রণাম করে বলল, ‘কী হয়েছে মামা?’

মামা মাথা থেকে একমুঠি চুল ছিঁড়ে ফেলে বললেন, ‘আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে রে বাবা! ওই শালা নিধের কাজ। এ আর কেউ নয়। নিধে আজ দেড় মাস হল জেল থেকে বেরিয়েছে। বেটা দাগী চোর! ও ছাড়া আর কারও কাজ নয়।’

সুশান্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু হয়েছে কী? নিধে কী?’

মামা গর্জে উঠলেন, ‘নিধে? শালা চোর, ডাকাত, বোম্বেটে। দত্তদের বাড়িতে সিঁধ কেটে আড়াই বছর জেলে গিয়েছিল। এবার তাকে ফাঁসি দিয়ে তবে আমি ছাড়ব।’

মামার কাছে কোনও খবর পাওয়া যাবে না বুঝে সুশান্ত বাড়ির ভেতর গেল। সামনেই তার দশ বছরের মামাতো বোন কালীকে দেখে বলল, ‘কী হয়েছে রে কালী?’

কালী অমনি কেঁদে ফেলে বলল, ‘ও দাদা, আমার টায়রা আর হার—ইঁ—হঁ—ইঁ—।’

সুশান্ত তাকে অনেক প্রশ্ন করল কিন্তু ইঁ-ইঁ-ইঁ ছাড়া আর কোনও কথাই বের করতে পারল না। তখন হতাশ হয়ে মামিমার কাছে গিয়ে বলল, ‘মামিমা, তোমাদের কী হয়েছে আমাকে বলবে কি?’

মামিমার কান্না একটু থেমেছিল—আবার আরম্ভ হয়ে গেল। তারপর তিনি সুশান্তকে পাশের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ওই দ্যাখ বাবা, কাল রাত্তিরে চোরে সিঁধ কেটে আমাদের সমস্ত গয়নাগাঁটি চুরি করে নিয়ে গেছে।’

কালী বলল, ‘আমার টায়রা আর হার। ইঁ—ইঁ—ইঁ—।’

সুশান্ত দেখল, সত্যই দেওয়ালে মাটি কেটে একটা গর্ত তৈরি করা হয়েছে। বেশ বড় গর্ত। একটা জোয়ান লোক অনায়াসে তার ভেতর দিয়ে ঢুকতে পারে। ঘরের জিনিসপত্র ঠিকই আছে, কেবল যে-বাক্সটার মধ্যে গহনা থাকত তার ডালা ভাঙা। ভেতরে কিছু নেই।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গম্ভীর মুখে সুশান্ত দালানে বসল। মামিমা চোখ মুছতে-মুছতে তাকে মুড়ি আর নারিকেল-নাড়ু এনে খেতে দিলেন।

খেতে-খেতে সুশান্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘কখন তোমরা জানতে পারলে?’

মামিমা বললেন, ‘অনেক রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে শুনতে পেলুম, পাশের ঘরে খুটখুট শব্দ হচ্ছে। প্রথমটা ভাবলুম, বুঝি ইঁদুর ধরবার জন্য বেড়াল ঢুকেছে। কিন্তু তারপরই মনে হল, দরজায় তো তালা লাগানো, জানলাও ভেতর থেকে বন্ধ—বেড়াল ঢুকবে কী করে? তখন তোর মামাকে গা ঠেলে তুললুম। তিনি উঠে তালা খুলে দেখলেন, চোর গয়নার সিন্দুক ভেঙে সমস্ত গয়না নিয়ে পালিয়েছে।’

‘কত টাকার গয়না ছিল?’

‘তা আমার আর কালীর মিলিয়ে আড়াই হাজার টাকার।’ বলে মামিমা ঘন-ঘন চোখ মুছতে লাগলেন।

‘তারপর?’

‘তারপর তোর মামা চেঁচামেচি করে পাড়ার লোক জড়ো করলেন। সকলেই বলল, এ নিধি হাজরার কাজ। তার মতন পাকা চোর এ-অঞ্চলে আর-একটি নেই। এই সেদিন আড়াই বছর জেল খেটে বেরিয়েছে।’

সুশান্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘নিধি হাজরা লোকটা করে কী? খেতখামার আছে?’

মামিমা পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, গাঁ-সুদ্ধ লোকের নাড়ির খবর জানতেন, বললেন, ‘দু-বিঘে জমি আছে বাবা, কিন্তু সে-জমি চাষও করে না, কিছুই না—এমনি পড়ে থাকে। নিধে কাজকর্ম করে না, কেবল খিড়কির পুকুরে ছিপ ফেলে বসে-বসে মাছ ধরে। অথচ পয়সারও কখনও অভাব হয় না। এই তো, জেল থেকে ফিরেই নতুন মাঠ-কোঠা তুলেছে। কোথা থেকে পয়সা পেল ভগবানই জানেন।’

সুশান্ত ভাবতে-ভাবতে বলল, ‘হুঁ। তারপর কাল রাত্রে আর কী হল?’

মামিমা বললেন, ‘তারপর পুরুষেরা বাইরে কী করলেন তা তো জানিনে বাবা। ওই পেল্লাদকে জিজ্ঞাসা কর। ও বরাবর ওঁদের সঙ্গে ছিল।’

পেল্লাদ বাড়ির চাকর। সে এতক্ষণ খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে ছিল। বলল, ‘রাত্তিরেই সকলে মিলে ঠিক করলেন, নিধের বাড়িতে গিয়ে দেখা যাক, সে বাড়ি আছে কি না। লন্ঠন জ্বেলে লাঠিসোঁটা নিয়ে সকলে নিধের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিতে লাগলেন। নিধে চোখ মুছতে-মুছতে বেরিয়ে এল, যেন ঘুমুচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করল, ”কী হয়েছে ঠাকুরমশায়রা? এত রাত্রে গোলমাল কীসের?”

‘নিধে ভয়ানক ধূর্ত সকলেই জানে। তাই তার কথায় কান না দিয়ে বাড়ির চারিদিকে খুঁজতে আরম্ভ করলেন। আদাড়-বাদাড়, ঘর-দোর সমস্ত আতি-পাতি করে খোঁজা হল, কিন্তু কোথাও গয়না পাওয়া গেল না। নিধে দাওয়ায় বসে ভুড়ুক-ভুড়ুক তামাক খেতে লাগল।’

সুশান্ত হেসে বলল, ‘ভারী শয়তান তো! তারপর?’

পেল্লাদ বলল, ‘কর্তা তখন আমাকে থানায় পাঠালেন। দারোগাবাবুকে খবর দেওয়ার জন্যে। থানা এখান থেকে আড়াই ক্রোশ পথ। ভোর রাত্তিরে গিয়ে দারোগাবাবুকে তুললুম। তিনি সব শুনে বললেন, আজ সকালে আসবেন।’

সুশান্ত মুড়ি চিবোতে-চিবোতে বসে শুনছিল। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা মামিমা, গয়না ছাড়া আর কিছু চুরি যায়নি?

মামিমা কেবল মাথা নাড়লেন। কালী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘হ্যাঁ দাদা, আমার টিয়াপাখির খাঁচাটাও চোরে চুরি করে নিয়ে গেছে।’

সুশান্ত আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘খাঁচা!’

কালী বলল, ‘হ্যাঁ, আমার টিয়াপাখিটা মরে গিয়েছিল। তাই তার লোহার খাঁচাটা ওই ঘরে রেখে দিয়েছিলুম। সেটাও চোরে নিয়ে গেছে।’

সুশান্ত ভুরু কুঁচকে বসে ভাবতে লাগল। তাই তো! এ তো বড় আশ্চর্য চুরি! যে-চোর সোনার গয়না চুরি করবার জন্যে সিঁধ কেটেছে, সে একটা তুচ্ছ লোহার খাঁচা চুরি করে কেন?

এই সময় বাইরে একটা গোলমাল এবং মামার হাঁকাহাঁকি, ‘ওরে পান নিয়ে আয়—তামাক নিয়ে আয়,’ শোনা গেল।

পেল্লাদ বলল, ‘ওই বুঝি দারোগাবাবু এলেন।’ বলে তাড়াতাড়ি উঠে গেল।

সুশান্ত শহরের ছেলে। তাই পাড়াগাঁয়ে দারোগাবাবুদের কীরকম খাতির তা সে জানত না। সে-ও তাড়াতাড়ি মুড়ি খাওয়া শেষ করে বাইরে গিয়ে হাজির হল।

বাইরে চণ্ডীমণ্ডপে ফরাসের ওপর বসে দারোগাবাবু তখন তামাক টানছেন। একজন কনস্টেবল আর গাঁয়ের দুজন চৌকিদার নীচে একটু দূরে উবু হয়ে বসে আছে। চৌকিদারেরা খাতির করে কনস্টেবলকে খইনি টিপে দিচ্ছে।

দারোগাবাবুর বয়েস হয়েছে। মুখ দেখলেই বোধ হয় বেশ বিচক্ষণ লোক। তিনি চোখ বুজে তামাক টানতে-টানতে সমস্ত শুনলেন। তারপর বললেন, ‘হুঁ। এ নিধে হাজরার কাজ বলেই মনে হচ্ছে। সে ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। কারণ, এ-তল্লাটে আর যত সিঁধেল চোর আছে, সবাইকে আমি হাজতে পুরেছি। নিধেটা পরিপক্ক শয়তান—মিটমিটে ডান—।’ চৌকিদারদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাঁরে, তোরা তো গ্রাম পাহারা দিস। কাল নিধিকে দুপুররাত্রে ঘর থেকে বেরুতে দেখেছিস?’

চৌকিদারেরা হাতজোড় করে বলল, ‘আজ্ঞে না, হুজুর।’

দারোগাবাবু তখন বললেন, ‘আচ্ছা চলুন, নিধের ঘরখানা তল্লাশ করে দেখা যাক। সে দাগী আসামী। তার ঘর যখন ইচ্ছে খানাতল্লাশ করা যেতে পারে। সে যখন গাঁ থেকে বেরোয়নি তখন চোরাই মাল তার বাড়িতেই আছে।’

মামা বললেন, ‘কিন্তু তার বাড়ি কাল রাত্তিরেই আমরা খুব ভালো করে খুঁজেছি।’

দারোগাবাবু হেসে বললেন, ‘মুখুজ্জেমশায়, আপনাদের খোঁজা আর আমাদের খোঁজার অনেক তফাত। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে, জানেন তো? চলুন।’

দারোগাবাবুর সঙ্গে অনেকে চললেন। সুশান্তও গেল। নিধিরাম হাজরার বাড়ি মিনিটদশেকের রাস্তা। যেতে-যেতে সুশান্ত ভাবতে লাগল কেবল সেই খাঁচাটার কথা। ভারী আশ্চর্য ব্যাপার তো! চোর খাঁচা চুরি করল কেন? পাখি পুষবে বলে? দূর!

তবে? ভাবতে-ভাবতে সুশান্তর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল, ঠিক তো! খাঁচা চুরি করবার উদ্দেশ্য আর কিছু নয়—গয়নাগুলো একসঙ্গে তার মধ্যে পুরে কোথাও লুকিয়ে রাখবে। কিন্তু কোথায় লুকিয়ে রাখবে? গাছের ডালে কিংবা চালের বাতায় টাঙিয়ে রাখলে তো আর চলবে না। তা হলে যে দেশসুদ্ধ লোক দেখতে পাবে! তবে? একটা লোহার খাঁচা কোথায় লুকিয়ে রাখলে কেউ দেখতে পাবে না?

নিধে হাজরার বাড়িতে নিধে ছাড়া আর কেউ ছিল না। দারোগাবাবু দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলেন। কিন্তু নিধের দেখা নেই। অনেকক্ষণ দোর ঠেলাঠেলি আর হাঁকাহাঁকির পর নিধে এসে দোর খুলে দিয়ে সামনে দারোগাবাবুকে দেখে ভক্তিভরে প্রণাম করে বললে, ‘আসতে আজ্ঞে হোক, হুজুর মশাই।’

দারোগাবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলি রে হতভাগা? কী করছিলি?’

নিধে হাতজোড় করে বলল, ‘আজ্ঞে কর্তা, খিড়কির পুকুরে মাছ ধরছিলুম।’

নিধের চেহারাটি বেঁটেখাটো, তেল চুকচুকে কষ্টিপাথরের মতো রং। মুখে শেয়ালের মতন ধূর্ততা মাখানো। দারোগাবাবু তাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘ব্যাটা, জেল থেকে বেরিয়েই আবার আরম্ভ করেছিস? এবার পাকা দশটি বছর ঘানি টানতে হবে, তা জানিস?’

নিধে মিটমিট করে চেয়ে বলল, ‘কর্তা, আমি কিছু জানি না, মা কালীর দিব্যি। কাল রাতে ঘরে দোর দিয়ে ঘুমুচ্ছিলুম। দাদাঠাকুর দেশসুদ্ধ লোক নিয়ে এসে ঘরে হানা দিলেন। গরিব মানুষ। কারও সাতেও থাকি না, পাঁচেও থাকি না—আমারই ওপর এত জুলুম কেন বলুন দেখি? সবাই মিলে ঘর-দোর ওলট-পালট করে দিয়ে চলে গেলেন। এখন আবার হুজুর এসেছেন। বেশ, আপনিও খানাতল্লাশ করুন। যদি আমার বাড়ি থেকে কিছু পাওয়া যায় তখন আমাকে কড়াক্বর করে বেঁধে নিয়ে যাবেন।’

‘খানাতল্লাশ করব বলেই তো এসেছি।’ এই বলে দারোগাবাবু ভেতরে ঢুকলেন। মামা, সুশান্ত আর দুজন সাক্ষী তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে গেল। কনস্টেবল দোরগোড়ায় পাহারায় রইল। পাড়ার লোকেরা বাইরে জটলা পাকাতে লাগল।

দারোগাবাবু নিধের বাড়ির গোয়াল থেকে আরম্ভ করে রান্নাঘর পর্যন্ত তন্নতন্ন করে খুঁজতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু সুশান্তর তাতে মন উঠল না, তার কেবলই মনে হতে লাগল, এখানে নেই, এখানে নেই।

একটা ঘরে অনেক ভাঙাচোরা পুরোনো জিনিস রাখা ছিল। সেই ঘরে ঢুকে সুশান্ত দেখল, একটা পাখির খাঁচা পড়ে রয়েছে। বাঁশের খাঁচাটা হাতে তুলে নিয়ে সুশান্ত দেখল, সেটা বেশ ভালো অবস্থাতেই রয়েছে—ভেঙেচুরে যায়নি। তার মনে বড় ধোঁকা লাগল। নিধের ঘরেই যখন খাঁচা রয়েছে, তখন সে অনর্থক খাঁচা চুরি করতে গেল কেন?

তারপর বিদ্যুতের মতো এক নিমেষে সে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে নিল! আরে! এটা যে কঞ্চির খাঁচা। এতে কাজ চলবে কী করে?

আবিষ্কারের উত্তেজনায় তার বুকের ভেতর ঢিবঢিব করতে লাগল। কিন্তু সে কাউকে কিছু বলল না। দারোগাবাবু তখন নিধেকে দিয়ে উঠানের একটা কোণ কোদাল দিয়ে খোঁড়াচ্ছিলেন। অন্যদিকে তাঁর লক্ষ ছিল না। সুশান্ত এই ফাঁকে চুপিচুপি খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

সামনেই খিড়কির পুকুর। পুকুরটি ছোট্ট, কিন্তু খুব গভীর, কালো জল দেখেই বোঝা যায়। জলের ধারে-ধারে বাবলার ডাল ফেলা আছে, যাতে চোরে জাল ফেলে মাছ চুরি করতে না পারে। সুশান্ত দেখল, ঘাট থেকে ছিপ ফেলা রয়েছে, ফাতনাটি পুকুরের প্রায় মাঝখানে উঁচু হয়ে আছে। নিথর জলে ঢেউ নেই, একটা মাছও ঘাই মারছে না।

এদিক-ওদিক চেয়ে সুশান্ত ছিপটি তুলে নিল। ছিপের সুতোর ডগাটি, যেখানে বঁড়শি বাঁধা থাকে, হাতে তুলে নিয়ে বেশ ভালো করে দেখল। তার মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল। সে আবার ছিপটি যেমন ছিল তেমনি ভাবে রেখে আস্তে-আস্তে ফিরে এল।

সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে সে পেল্লাদকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘পেল্লাদ, দুটো বঁড়শি জোগাড় করতে পারিস?’

পেল্লাদ বলল, ‘পারি দাদাবাবু, বাড়িতেই আছে।’

‘তবে যা, চট করে নিয়ে আয়।’

পেল্লাদ চলে গেল। সুশান্ত বাড়ির ভেতর ফিরে গিয়ে দেখল—দারোগাবাবু হতাশ হয়ে দাওয়ার ওপর বসে পড়েছেন। মামারও মুখ শুকনো। কেবল নিধের চোখ-মুখ দিয়ে যেন একটা আনন্দের জ্যোতি বেরুচ্ছে।

দারোগাবাবু বললেন, ‘নিধে, এখনও মাল বের করে দে, তোকে অল্পে ছেড়ে দেব!’

নিধে বলল, ‘হুজুর মা-বাপ, ইচ্ছে করলে মারতে পারেন, কাটতে পারেন। আমি কিছু জানি না।’

দারোগাবাবু আর কী করবেন, চুপ করে রইলেন। নিধের বিরুদ্ধে প্রমাণও তো কিছু নেই যে, তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবেন।

তখন সুশান্ত আস্তে-আস্তে বলল, ‘আমি জানি নিধে চোরাই মাল কোথায় লুকিয়ে রেখেছে।’

মামা লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘সে কী! তুই জানলি কী করে?’

সুশান্ত সে-কথার উত্তর না দিয়ে নিধেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘নিধিরাম, তোমার খিড়কির পুকুরে মাছ আছে?’

নিধিরাম বলল, ‘আছে দাদাঠাকুর। ছোট মাছ—পুঁটি, বেলে, ন্যাটা—এই সব!’

সুশান্ত বলল, ‘তুমি যে সবসময় পুকুরে বসে মাছ ধরো, কী দিয়ে মাছ ধরো?’

‘আজ্ঞে, ছিপ দিয়ে ধরি, দাদাঠাকুর।’

সুশান্ত একটু হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘ছিপ দিয়ে? বঁড়শি থাকে তো?’

নিধের মুখ এতটুকু হয়ে গেল। চোখে ভয়ের ছায়া পড়ল। সে আমতা-আমতা করে বলল, ‘আজ্ঞে—তা—তা—থাকে বইকি।’

এই সময় পেল্লাদ দুটো সুতোয় বাঁধা বঁড়শি এনে সুশান্তর হাতে দিতেই সে বলল, ‘দারোগাবাবু, একটা মজা দেখবেন তো আসুন। কিন্তু তার আগে নিধিরামের হাতে হাতকড়া দিলে ভালো হয়।’

সুশান্তর কথাবার্তা শুনে সকলে অবাক হয়ে গিয়েছিল। সতেরো বছর বয়সের ছেলের মাথায় যে এত বুদ্ধি থাকতে পারে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। দারোগাবাবু কনস্টেবলকে ডেকে নিধিরামকে দড়ি দিয়ে বাঁধবার হুকুম দিলেন। তারপর সুশান্ত সকলকে নিয়ে খিড়কির ঘাটে গেল।

জল থেকে ছিপ তুলে নিয়ে সুশান্ত সকলকে দেখিয়ে বলল, ‘এই দেখুন, নিধিরাম কেমন মজার মাছ ধরে—বঁড়শি নেই। শুধু একটু রাংতা।’

সকলে অবাক। দারোগাবাবু বললেন, ‘তাই তো।’

সুশান্ত বলল, ‘নিধিরাম ভারী চালাক। পাছে কেউ সন্দেহ করে তাই পুকুরে ছিপ ফেলে রেখেছে। ছোট্ট পুকুর, তলায় যদি কিছু থাকে বঁড়শিতে আটকে উঠে আসবে। কিন্তু ছিপে যে বঁড়শি নেই, তা তো আর কেউ জানে না। তাই সবাই ভাবে পুকুরে কিছু নেই। থাকলে ছিপে উঠে আসত। কী বলো নিধিরাম, ঠিক কি না?’

নিধিরাম নির্বাক। তার মুখে আর কথাটি নেই।

সুশান্ত বলল, ‘এবার দেখুন, কী করে সত্যিকারের মাছ ধরতে হয়’—এই বলে বঁড়শি দুটো ছিপের সুতোয় বেঁধে জলে ফেলল। বঁড়শি তলিয়ে গেল।

তারপর টান মারতেই বঁড়শি একটা ভারী জিনিসে আটকাল। সুশান্ত সাবধানে সুতো ধরে টানতে-টানতে বলল, ‘কীসে আটকেছে বলুন দেখি! বুঝতে পারেননি? খাঁচা! কালীর টিয়াপাখির খাঁচা। পুঁটলি বেঁধে জলে ফেললে পাছে কাপড় পচে নিয়ে গয়নাগুলো হারিয়ে যায়, তাই লোহার খাঁচার ব্যবস্থা। কতদিনে পুকুর থেকে চোরাই মাল তোলবার সুবিধে হবে তা তো নিধিরাম জানত না।’

সুতো ধরে টানতে-টানতে শেষে সত্যি-সত্যিই একটা লোহার খাঁচা বঁড়শিতে লেগে উঠে এল। মামা ছুটে গিয়ে খাঁচার মধ্যে হাত পুরে ভেতর থেকে সব জিনিস বের করলেন। দেখা গেল, মামিমা আর কালীর সমস্ত গয়নাই সেখানে রয়েছে। একটিও খোয়া যায়নি।

মামা আহ্লাদে আটখানা হয়ে সুশান্তকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ছেলে নয়, হীরের টুকরো। এমন বুদ্ধি কেউ দেখেছ? আর হবেই না বা কেন? মামার ভাগনে তো! কথায় বলে, নরাণাং

মাতুলক্রমঃ—।’

দারোগাবাবুও খুশি হয়ে সুশান্তর পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘খাসা ছেলে! চমৎকার ছেলে! বেঁচে থাকো বাবা। আশীর্বাদ করি দারোগা হও।’

মাসিক রোমাঞ্চ

পুজো সংখ্যা, ১৯৬৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *