2 of 3

সাপলুডোর সিঁড়ি

সাপলুডোর সিঁড়ি

এটা কি আগে এখানে ছিল, না ছিল না? একটা বেঁটে মতন গম্বুজ, তার সব দিকই নানারকম পোস্টারে মোড়া, একটা বড় ফিল্মের পোস্টারে এক যুবতি দু-চোখ দিয়ে হাসছে।

এক পাশে ছিল ধানখেত, আর জলা, রাস্তার অন্যপাশে দোকানপাট। হ্যাঁ, স্পষ্ট মনে আছে। অতনুর, ধানখেতের পাশে যে-অগভীর জলাভূমি, সেখানে গামছা দিয়ে মাছ ধরত কয়েকটি কিশোর, মাছ বিশেষ পাওয়া যেত না, ঝাঁপাঝাঁপি, কাদা মাখামাখিই সার, কখনও হয়তো পাওয়া যেত কিছু কুচো চিংড়ি, বেলে আর পুঁটি। একদিন অতনু দুটো খলসে মাছ পেয়েছিল। সব মিলিয়ে এতই কম যে, নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যায় না, তাই এক-একদিন এক-একজন সবটা, কম হোক বা বেশি হোক যার ভাগ্যে যেমন আছে। খলসে মাছের কথা বিশেষভাবে মনে থাকার কারণ, কই মাছের গরিব আত্মীয় হলেও এই মাছের গায়ে রামধনু রঙের ঝিলিক থাকত। সেই মাছদুটো রান্না করার বদলে একটা কাচের বয়েমে জল ঢেলে তার মধ্যে। রেখে দিয়েছিল অতনু। তিন দিনের বেশি বাঁচেনি। কই-মাগুর জাতীয় মাছ মরে গেলে খেতে নেই বলে মা ছোটো খলসে দুটো ফেলে দিয়েছিলেন। এই গল্প অতনু যাকেই বলতে গেছে, সবাই তাকে শুনিয়ে দিয়েছে যে, খলসে মাছ এখন আর পাওয়াই যায় না, খলসে এখন বিলুপ্ত প্রজাতি।

সেই ধান খেত আর জলাভূমিও অদৃশ্য। এখন সেখানে সার-সার এক ধরনের বাড়ি, চারতলা, মেটে রঙের, মনে হয় কোনও বড় সংস্থার কর্মচারীদের কোয়ার্টার্স। অদৃশ্য হওয়াই তো স্বাভাবিক, সীতারামপুর নামে পুর হলেও একসময় তো গ্রামই ছিল, এখন শহর হতে চলেছে, শহরের এত ধার ঘেঁষে কি ধানখেত থাকে নাকি? অতনুদের ছেলেবেলায় এখানে রেলস্টেশন ছিল, চার মাইল হেঁটে চকবাজারে যেতে হত। এখন স্টেশন হয়েছে বলেই ধাঁধাঁ করে বদলে যাচ্ছে গ্রাম।

পরিবর্তনগুলো ঠিক-ঠিক মিলিয়ে নিতে পারে না অতনু। অনেক দিনের ব্যবধান, সতেরো বছরে সে সীতারামপুর ছেড়েছিল, এখন তার বয়েস বেয়াল্লিশ। কিন্তু মাঝখানে কি সে আর কখনও আসেনি, তা তো নয়, বেশ কয়েকবার ঘুরে গেছে। কিন্তু স্মৃতির এমনই কারসাজি, কৈশোরের ছবিগুলি এখনও জ্বলজ্বল করে, মাঝখানে অনেক দিনের শূন্যতা। অবশ্য মাঝখানে এসে সে আগে দু-তিন দিনের বেশি থাকেনি, ভালো করে চারপাশটা তাকিয়ে দেখেনি।

শেষ এসেছিল সাত বছর আগে, মায়ের মৃত্যুর সময়। তখন আবার অতনুর ওদিকেও খুব। ব্যস্ততা। একটা প্রমোশন নিয়ে দর কষাকষি চলছিল, তবু মা বলে কথা, আসতেই হয়, শেষ দেখাও হয়নি, শুধুশ্রাদ্ধের জন্য তিনদিন। মাতৃশোকের চেয়ে মন বেশি অস্থির ছিল চাকরির জন্য, তখন এখান থেকে আফ্রিকায় টেলিফোন করারও সুবিধে ছিল না।

খালধারে একটা ছিল ভূতের বাড়ি। কৈশোরেরও আগে, বাল্যস্মৃতিতে একটা গা-ছমছমে ভাব। বেশ বড় তিনতলা বাড়ি, দেয়ালে-দেয়ালে বট-অশথ গাছ গজিয়ে গিয়েছিল, ভূত ছাড়াও সাপ খোপেরও অভাব ছিল না! আসলে হয়তো কোনও শরিকি গণ্ডগোলে পরিত্যক্ত বাড়ি, কোনও সমৃদ্ধ মুসলমানের সম্পত্তিও হতে পারে, দেশভাগের পর চলে গিয়েছিল ওপারে, এখনও ওখানে কাছাকাছি মুসলমানদের একটি পল্লি আছে। এখন সেই ভূতের বাড়ির জায়গায় একটি ঝকঝকে রিসর্ট, প্রচুর আলো ঝলমল করে, শহরের লোকেরা এখানে ছুটি কাটাতে আসে। ওরকম ভূতের বাড়ি আরও নানা জায়গায় ছিল, সবই হয়ে গেছে নিশ্চিহ্ন, হবেই তো, এরই নাম উন্নতি।

তবে, এই রিসর্টের দিকে তাকিয়ে এখনও অতনু কল্পনায় সেই ভূতের বাড়িটা দেখতে পায়। তার মনে হয়, গ্রামে-ট্রামে ওরকম দু-একটা হানাবাড়ি থাকা বোধহয় উপকারীই ছিল, ওই সব বাড়িতে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ভয় ভাঙার ট্রেনিং হত আস্তে-আস্তে। অতনুরা প্রথম-প্রথম ওই। বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াত, একটা কিছু আওয়াজ শুনলেই দৌড়ে পালাত ভয়ে। একটু বয়েস বাড়লে সাহস করে পা দিয়েছিল বাগানে, বাড়িটার কাছ ঘেঁষত না, বাড়িটার মধ্যে সত্যি সত্যি মাঝে-মাঝে উৎকট শব্দ হত, কেউ-কেউ নাকি আগাগোড়া কালো সিল্কের বোরখায় ঢাকা এক মহিলাকে ধীরপায়ে দোতলার বারান্দায় হাঁটতে দেখেছে, কয়েক মুহূর্ত মাত্র, তারপরই তিনি মিলিয়ে যেতেন হাওয়ায়। উনি রাবেয়া বেগম, মারা গেছেন সাতাশ বছর আগে।

কী করে যেন হঠাৎ একদিন ভয় ভেঙে গেল। মধ্য কৈশোরে চার-পাঁচজন বন্ধুর সঙ্গে অতনু উঠে গিয়েছিল দোতলায়। গাঢ় দুপুরে, যখন চারপাশে কোনও শব্দ থাকে না, সে-সময় ভূতেরা এসে পেছন থেকে ঠেলা মারে। কই কিছুই তো হল না, কোনও ঘরেই দরজা-জানলা নেই, চতুর্দিকে প্রচুর ভাঙা কাচ ছড়ানো, আর ধুলোতে কিছু-কিছু পায়ের ছাপ, ভূতেরা পায়ের ছাপ ফেলতে পারে কি না, তা ঠিক জানা ছিল না তখন। অনেক পায়রার বাসা ছিল।

সে দিনটার কথা খুব ভালোই মনে আছে অতনুর। কারণ সেদিন সে শুধু ভূতের বাড়ি জয় করেনি। সেইদিনই জীবনে প্রথম সে সিগারেট খায়, তার বন্ধু রতন শিখিয়েছিল। সিগারেট টানার মতো অমন নিরিবিলি জায়গা আর পাওয়া যাবে কোথায়? লেবুপাতা চিবিয়ে বাড়ি ফিরলেও কী করে যেন ধরা পড়ে গিয়েছিল মায়ের কাছে। মা কি কোনও শাস্তি দিয়েছিলেন? মায়ের দেওয়া শাস্তি কোনও মানুষই মনে রাখে না। বাবা চুলের মুঠি ধরে মাথাটা দেয়ালে ঠুকে দিতেন, সেটা মনে আছে।

সেই দিনটায় তাদের দলে একটা মেয়েই ছিল না? কী যেন নাম তার, চিনু, চিনু, সে একটা গেছে মেয়ে, তাকে নেওয়া হবে না, তবু এসেছিল জোর করে। রোগা-প্যাংলা চেহারা, সেই তেরো চোদ্দো বছর বয়েসে তাকে মেয়ে বলেই মনে হত না, বুকেও বোধহয় ঢেউ খেলেনি, হাফ-প্যান্ট আর শার্ট পরে থাকত। সিগারেট টানার সময় সেও জেদ ধরেছিল, আমায় দাও, আমিও খাব, আমিও খাব, কিন্তু তাকে দেওয়া হয়নি, কে যেন একটা চড় মেরেছিল তাকে। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই মেয়েটা!

এবারে তিন সপ্তাহের ছুটিতে এসেছে অতনু। সীতারামপুরে তার আর কোনও আকর্ষণ নেই, এখানে কয়েকটা দিন নষ্ট করার কোনও মানে হয় না, হঠাৎ মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল, এসেছে সেই নস্টালজিয়ায়। আসার পরই মনটা পালাই-পালাই করছে।

যৌথ পরিবার ছিল একসময়, তারপর অনেক ভাগ হয়েছে, মায়ের মৃত্যুর পর তার দাদা এসে নিজেদের অংশটা বিক্রি করে দিয়ে যায় এক কাকাকে। সেই কাকা অতনুর বাবার বৈমাত্রেয় ভাই, ছোটোবেলায় খুব ভালোবাসতেন অতনুকে। সেই স্মৃতিতে এখানে আসা, কাকার পরিবার বেশ খাতির-যত্ন করছে তাকে, তবু অতনুর অস্বস্তি কাটছে না। কাকা বুড়ো হয়ে গেছেন, অসুখের কথা ছাড়া আর কোনও কথা জানেন না। দুই খুড়তুতো ভাইকেই অচেনা মনে হয়, দুই ভাইয়ের স্ত্রী খুব ঝগড়া করে। কিছু চাষের জমি আছে, তার থেকে উপার্জন অনিশ্চিত, বাজারে একটা। জামা-কাপড়ের দোকানের সিকি ভাগ মালিকানা, সে আয়ও যথেষ্ট নয়।

মা যে-ঘরটায় থাকতেন, সে ঘরটা এখন বৈঠকখানা। কয়েকটা ছেঁড়া-ছেঁড়া বেতের চেয়ার, একটা তক্তাপোশ আর একটা টিভি। মায়ের কোনও চিহ্নই নেই। খুড়তুতো ভাইয়ের দুই স্ত্রীর মধ্যে একজন নিঃসন্তান, অন্যজনের তিনটি ছেলেমেয়ে। নিঃসন্তান মহিলারই দাপট বেশি। ছেলেমেয়ে তিনটির বয়েস নয়, বারো, চোদ্দো, মেয়েটিই বড়। অতনুর আর বিয়ে-থা করা হয়নি। ছোট ছেলেমেয়েদের সে ভালোবাসে। ওদের সঙ্গেই তার বেশি সময় কাটে। মাঝে-মাঝে অতনু মনে মনে ওদের সঙ্গে তুলনা করে তার বাল্য-কৈশোর বয়েসের। তখন এখানে প্রচুর ফাঁকা জায়গা ছিল, কিছু-কিছু বাগান আর পুকুর ছিল, অতনু তার বন্ধুদের সঙ্গে হুটোপুটি করে বেড়াত, বাঁদরের মতন লাফালাফি করত অন্যদের বাগানের গাছে, ফল-পাকুড় খেয়েছে, লাঠির বাড়িও খেয়েছে। সন্ধের পরেও দেরি করে বাড়ি ফিরলে বকুনি খেয়েছে বাবার কাছে। এখন তার খুড়তুতো। ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, বাড়িতে কিছুক্ষণ পড়তে বসে, আর বাকি সব সময়টা টিভি দেখে। বাড়ির বাইরে কোথাও যায় না, খেলতেও যায় না, তাই তারা লক্ষ্মী ছেলেমেয়ে। অতনু বুঝতে পারে, এরা হয়তো সারাজীবন এই গ্রামেই থাকবে, আর কোথাও যাবে না।

অতনুকেও ওদের সঙ্গে টিভি দেখতে হয়। অতনু খানিকটা কৌতূহল নিয়েই টিভির অনুষ্ঠানগুলো, বিশেষত বিজ্ঞাপন দেখে। কোনও দেশের অনেকখানি সমাজের ছবি বিজ্ঞাপন। দেখলেই বোঝা যায়। এখানকার বিজ্ঞাপন দেখে সে প্রায় হতবাক। মনে হয় যেন ইন্ডিয়া নামের দেশটা পুরোপুরি ওয়েস্টার্নাইজড হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়েদের কী সব চোখ-ঝলসানো পোশাক, কতরকম গাড়ি, কমপিউটারের দারুণ কেরামতি, আর কত টাকা খরচ হয় এক একটা বিজ্ঞাপনে! এসব দেখে হাসে অতনু! দূরে থাকলেও সে তো মোটামুটি খবর রাখে দেশের ইন্টারনেটেও পড়া যায় কলকাতার খবরের কাগজ।

টিভি-তে অনেকগুলো বাংলা চ্যানেল, তাতে সিনেমা দেখায়, আরও হরেক সিরিয়াল-কাহিনি, বিদেশের মতন। এসব একটা সিনেমারও সে নাম শোনেনি, এখনকার অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও সে চেনে না। উত্তমকুমার চলে গেছেন, সে জানে, কিন্তু বসন্ত চৌধুরী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষ, অরুন্ধতী, অনুপ, এঁরা কেউ নেই! পুরোনোদের মধ্যে রয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আর একালের একজন নায়িকাকে কেন যেন তার চেনা-চেনা মনে হয়, যদিও তার একটা ফিল্মও সে আগে দেখেনি, অথচ কোথায় তাকে দেখেছে, তা মনে করতে পারছে না।

এই সীতারামপুরেও অতনুর পুরোনো কালের চেনা অনেকেই নেই। তার স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে। চার-পাঁচজন এখানকার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে চলে গেছে কলকাতায় বা বিদেশে। আর যারা রয়ে গেছে, তারা রাজনীতির কচকচি বেশ ভালোই বোঝে। কিন্তু অন্য কোনও বিষয়ে তারা প্রায় কিছুই খবর রাখে না। আফ্রিকা সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ। যাদের সঙ্গে তুই-তুই সম্পর্ক ছিল, তারা এখন তাকে তুমি বলে। এদের সবারই বিশ্বাস, বিদেশে যারাই থাকে, তারা সবাই খুব বড়লোক। এনআরআই-রা অনেক টাকা পকেটে নিয়ে দেশে বেড়াতে আসে।

অবশ্য এনআরআই বলতে ইউরোপ-আমেরিকার অনাবাসীদের কথাই সবাই ভাবে। তারা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী বা বড়-বড় বিদ্বান। অতনু এর কোনওটাই নয়। ছোটোবেলায় সে ভেবেছিল, ডাক্তার হবে। এখানে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ার পর সে গিয়েছিল চকবাজারের। হাইস্কুলে। রেজাল্ট মোটামুটি ভালোই ছিল, কলকাতায় গিয়ে ডাক্তারি পড়া যেত অনায়াসেই, থাকতে হবে হস্টেলে। সব যখন প্রায় ঠিকঠাক, তখন একদিন রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর তার বাবা একটা সিগারেট ধরিয়ে টানছেন বারান্দায় বসে, হঠাৎ প্রবল ভাবে কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেলেন মেঝেতে, বুকে ছুরি বিদ্ধ মানুষের মতন গড়াতে-গড়াতে আর্তনাদ করতে লাগলেন। একজন ডাক্তারকে ধরে আনা হয়েছিল দু-ঘণ্টা বাদে, ততক্ষণে বাবার সব শ্বাসপ্রশ্বাস খরচ হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে শেষ হয়ে গেল অতনুর ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন।

দাদা তখন রেশনিং অফিসে কেরানির চাকরি পেয়ে বর্ধমানে পোস্টেড, ছোট বোনের বিয়ে হয়নি। অতনু পড়াশোনা বন্ধ করে এক বছর পড়ে রইল এখানে। তার পরেও থেকে যেতে পারত গ্রামের অন্য ছেলেদের মতন, সেই ষোলো বছর বয়েসেই সংসারের অনটন দেখে চেষ্টা করছিল। টুকটাক উপার্জনের। বাবা অনেক ধার রেখে গেছেন। কিছুদিন সে আরও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে হাঁস মুরগির ডিম কিনে এনে সাপ্লাই দিত বাজারের কাছের দুটো ভাতের হোটেলে। শুধু মা দুঃখ করে বলতেন, তোর আর পড়াশোনা হবে না রে তনু! আমার গয়না বিক্রি করে দেব, তুই তবু পড়। কখানাই বা গয়না মায়ের, তা বিক্রি করে শহরে গিয়ে বেশিদিন পড়াশোনা চালানো যায় না। তা ছাড়া ছোট বোনের বিয়ের সময় গয়নাগুলো লাগবে না?

মায়ের বড় ভাই থাকতেন পুনায়। তিনি সেখানে স্কুলশিক্ষিক। তিনি প্রস্তাব দিলেন, অতনুকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলে তিনি ওর পড়াশোনার দায়িত্ব নেবেন। অতনু চলে গেল পুনায়। এ সবই যেন সাপলুডোর ওঠা-নামা।

সংসারে আর একটি খাওয়ার পেট বৃদ্ধি পাওয়ায় বড় মামিমা প্রথম থেকেই অতনুকে পছন্দ করেননি। তাঁকে খুব দোষ দেওয়া যায় না, তাঁদেরও অভাবের সংসার আর বড়মামাও খানিকটা আলাভোলা মানুষ। তিনি অতনুকে ডাক্তারি পড়াতে পারেননি, তবে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন হোটেল ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে। সেখান থেকে পাস করার পরই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে সে চাকরি পেয়ে যায় আফ্রিকার কিনিয়ায়। সীতারামপুর গ্রামের একটি ছেলে চাকরি করতে যাবে কিনিয়ার হোটেলে! নিয়তির নির্বন্ধ।

আফ্রিকা থেকে মাকে নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছে অতনু। তখনই ছোট বোনের বিয়ে হয়। দাদা। বাড়ির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখেনি। আফ্রিকায় অতনুর চাকরি নিয়ে অনেক ঝঞ্চাট হয়েছে বেশ কয়েক বছর। ওখানে হোটেল ম্যানেজমেন্টে ইন্ডিয়ান ট্রেনিং-এর চেয়ে সুইজারল্যান্ডের ট্রেনিং সার্টিফিকেটের কদর অনেক বেশি। কিনিয়ার ট্যুরিজম ও হোটেল ম্যানেজমেন্টে অনেক সুইস কাজ করে। তাদের সঙ্গে রেষারেষিতে অতনুর পদোন্নতি আটকে যায় বারবার। একবার তার কর্মস্থান-হোটেলটা বিক্রি হয়ে যায়, নতুন মালিকরা প্রথমে তাকে রাখতেই চায়নি, রাখলেও। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের পদ তাকে দিতে চায়নি, সেই সময়েই মা মারা যান।

মাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে চেয়েছিল অতনু। মা রাজি হননি। শুধু বলতেন, আফ্রিকা, ওরে। বাবা! না না, ওখানে গিয়ে থাকতে পারব না। মা ভাবতেন, শুধু নেংটি পরা, বর্শা হাতে দুর্ধর্ষ। ধরনের মানুষরাই সেখানে ঘুরে বেড়ায়। মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারেনি অতনু যে নাইরোবি খুবই আধুনিক শহর, সেখানকার মেথররাও প্যান্ট-শার্ট ও জুতো পরে।

মা না হয় স্বল্পশিক্ষিত মহিলা, ওরকম ধারণা থাকতেই পারে, কিন্তু এখানকার অনেক শিক্ষিত ভদ্রলোকেরও তো আধুনিক আফ্রিকা সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার নয়। যতবার সে দেশে এসেছে, প্রতিবারই কেউ-না-কেউ বলেছে, তুমি আফ্রিকায় পড়ে আছ কেন, বিলেত-আমেরিকায় চলে যেতে পারলে না? ওসব দেশে তো হোটেল অনেক বেশি। এবারেও একজন বলেছে। কলকাতাতেও অনেক নতুন-নতুন হোটেল খুলছে, তুমি এখানে কাজ পাও কি না দেখোনা! গত পাঁচ বছর ধরে অতনু নাইরোবির যে-হোটেলে কাজ করছে, সেটাই কলকাতার গ্র্যান্ড বা তাজ এর চেয়ে অনেক বড়। সেখানকার কাজে সে বেশ খুশি। একটি বেলজিয়ান মেয়ের সঙ্গে সহবাস করে।

কলকাতা শহরটা অনেকটা বদলেছে ঠিকই। এয়ারপোর্ট থেকে আসবার যে-নতুন রাস্তাটা হয়েছে, সে রাস্তার পাশে-পাশে নতুন-নতুন প্রাসাদ দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেছে। তার মনে হয়, কলকাতার চেয়ে সে নাইরোবি শহর অনেক বেশি চেনে। কলকাতায় তো সে কখনও থাকেনি।

এবারে অবশ্য সে একটা ভালো জায়গা পেয়েছে।

রাজেশ আগরওয়াল নামে মাড়োয়ারি ভদ্রলোকের ব্যাবসা আছে কিনিয়া আর তানজানিয়ায়। তিনি নাইরোবিতে প্রায়ই যান এবং প্রতিবারই রয়াল ক্রাউন হোটেলে ওঠেন। ভদ্রলোক বাংলা বলেন মাতৃভাষার মতন। মেন্টেন্যান্স ম্যানেজারের নাম অতনু ঘোষ দেখেই তিনি তার সঙ্গে আলাপ করেছেন। মাঝে-মাঝে সন্ধেবেলা গল্প হয়েছে অনেকক্ষণ। অতনু নিজের কোয়ার্টার্সে তাঁকে নেমন্তন্ন করেও খাইয়েছে, তিনিও অতনুকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন কলকাতায়। তাঁর নিজের বাড়িতে নয়, আগরওয়ালদের একটি ননফেরাস মেটালের কারখানা আছে টালিগঞ্জ অঞ্চলে, সেই কারখানা-সংলগ্ন চমক্কার গেস্ট হাউসে অতনুর থাকার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, দেয়াল-ঘেরা এলাকাটি, রয়েছে সুসজ্জিত বাগান, একটি গাড়িও বরাদ্দ করা আছে তার জন্য।

অতনু অবশ্য মেট্রো ট্রেনে যাতায়াত করে বেশনতুনত্ব বোধ করে। কলকাতা শহরের মাটির তলা দিয়ে ট্রেন চলে, এ খবর তার না জানার কথা নয়, যদিও আগে কখনও স্বচক্ষে দেখেনি, তাই প্রথম দিনে সেই ট্রেনে ওঠা, যেন মনে হয়েছিল আবিষ্কারের মতন।

রাত আটটা-নটায় ট্রেন থেকে নামলে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মেয়েকে দেখা যায়। তাদের স্বাস্থ্য এত খারাপ কেন? ভালো করে সাজতেও জানে না। যে শহরের বার নারীদের অবস্থা করুণ, সে শহরের নৈতিক স্বাস্থ্যও খারাপ হয়, অর্থাৎ অনেক সুখী সংসারের মধ্যেই নৈতিকতার পতন হয়েছে। সত্যি কি তাই? জাগতিক উন্নতি আর নৈতিকতার পতন পাশাপাশি চলে! এই শহর থেকেই সবচেয়ে বেশি কিশোরি ও যুবতি পাচার হয়ে যায় বাইরে, খবরের কাগজেই ছাপা হয়। সে সব মেয়েদের জায়গা হয় না এই উন্নতির মধ্যে!

ভালো পেনের ব্যবহার তো উঠেই গেছে। এখন সবাই সস্তার পেন দিয়ে লেখালেখি করে। অতনুর বাবার পকেট থেকে একটা শেফার্স পেন চুরি গিয়েছিল লোকাল ট্রেনে। সে জন্য বাবা দুঃখ করেছিলেন অনেকদিন। এখন সেই সব পেন-পকেটমাররা বেকার, সাত-আট টাকার ডট পেন মেরে কোনও লাভ হয় না। মেট্রো সিনেমার সামনে একজন সিঁড়িঙ্গে চেহারার প্রৌঢ় সেই পেন বিক্রি করতে এসেছিল অতনুকে। হোটেলে যারা কাজ করে, তাদের কাছে এই পেন যে কত গণ্ডা থাকে, তার ঠিক নেই। সীতারামপুরে বিলি করার জন্য অতনু তার হোটেলের নাম লেখা এই ধরনের পেন এনেছিল পাঁচ ডজন।

লোকটিকে দেখে অতনু চমকে উঠে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।

সে চিনতে পেরেছে। কিন্তু সেটা জানানো ঠিক নয়। এই লোকটি তাদের সীতারামপুরের স্কুলের ইন্দুভূষণ স্যারের ছেলে বিশ্বনাথ, অতনুর সহপাঠী। অথচ এর মধ্যেই এত বুড়োটে চেহারা হয়ে গেছে। দারিদ্র্য আয়ু হরণ করে নেয়, স্বাস্থ্য, শরীরের জ্যোতি, সবই খেয়ে নেয়। অতনুর এখনও অটুট চেহারা, গায়ের রং কালো হলেও অনেকে তাকে সুপুরুষই বলে। বিশ্বনাথ ইস্কুল মাস্টারের ছেলে, অথচ তার এই পরিণতি! জুয়া খেলে, না নেশা করে? উন্নতির দৌড়ে সে পা মেলাতে পারেনি!

মস্ত বড় হোর্ডিং-এ বাংলা ফিল্মের এক নায়িকার মুখ দেখে তার খটকা লাগে। কোথায় একে দেখেছে? কোনও ফিল্মে নয়।

কলকাতার সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে রাজেশ আগরওয়ালের বেশ যোগাযোগ আছে। তাঁর অনেক ব্যাবসা, তা ছাড়াও ফিল্ম প্রোডিউস করে। এতগুলো ব্যাবসার কথা মাথায় রাখেন কী করে? এত টাকা নিয়েই বা কী পরমার্থ হবে!

মাঝে-মাঝেই তিনি পাঁচতারা হোটেলে পার্টি দেন। একটা শহরের, যাঁদের বলে গ্লটারেট্টি, তাঁরা অনেকেই আসেন, কিছু-কিছু রাজনীতির লোকও। সার্থকভাবে ব্যাবসা চালাতে গেলে টেবিলের তলা দিয়েও কিছু-কিছু আদান-প্রদান করতে হয়। সবাই জানে। তবু, এ জিনিসটা চাপা দেওয়ার জন্য মাঝে-মাঝে সংস্কৃতির অনুষ্ঠানের আয়োজন করা বেশ সুবিধেজনক। বাঙালিদের ধারণা, যারা সংস্কৃতি ভালোবাসে, তারা উচ্চ মার্গের মানুষ। তারা কখনও কোনও নোংরা ব্যাপারে জড়াতে পারে না।

রাজেশ আগরওয়াল অতি সজ্জন ও বিনয়ী ব্যক্তি। হয়তো সত্যিই তিনি সংস্কৃতি-প্রেমিক। পার্টিতে ঢোকার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে হাতজোড় করে তিনি নিজে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানান, অনেককেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে নাম ধরে চেনেন। ভদ্রতাবশত তিনি অতনুকেও আজকের পার্টিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

হোটেল সংলগ্ন বিস্তৃত লনে পার্টি। সবুজ ঘাস ঘিরে চেয়ার, অতিথি অন্তত পঞ্চাশজন তো হবেই। মাঝখানে একটা অস্থায়ী মঞ্চে একটি মেয়ে গান গাইছে। আজকাল গায়িকাদের খুব স্বল্প পোশাক পরাই রীতি। সারা গা ঢেকে গান আজকাল পুজোর অনুষ্ঠানেও চলে না। গরম দেশ, তবু এর মধ্যে অনেক পুরুষেরই অঙ্গে কোট আর টাই। আর মেয়েদের শরীরের অনেকটাই খোলামেলা। এত লোক হলে, ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে আড্ডা হয়। দু-চারজন মদের গেলাস হাতে ঘুরে-ঘুরে অনেকের সঙ্গে আলাপ করে। আর বেশির ভাগ অতিথি বসে থাকে একই চেয়ারে।

অতনু এখানে একজনকেও চেনে না। সে গ্রামের ছেলে, কলকাতায় কখনও পাত্তা পায়নি। তারপর পুনা থেকে চলে গেছে ধাদ্ধারা গোবিন্দপুরের চেয়েও অনেক দূরে কালো মানুষদের দেশে। এই ধরনের পার্টিতে এলে সে জানে একা-একা বেশি মদ খেয়ে নিতে হয়। আর দেখতে হয় অন্যদের। হোটেল ম্যানেজমেন্টের ট্রেনিং থেকে সে জানে। মদ খেয়ে কখনও বেচাল হতে নেই, একটা সময়ে মদের গেলাস শুধু হাতে ধরে রাখলেও চুমুক দেওয়ার বদলে মাঝে-মাঝে। ফেলে দিতে হয় মাটিতে।

অতনু নিজে থেকে কারও সঙ্গে আলাপ করে না, তবে অচেনা কেউ কথা বলতে এলে সে গুটিয়ে থাকে না। একটা কিছু হাসি-ঠাট্টার প্রসঙ্গ খুঁজে নেয়।

পার্শ্ববর্তী পাঁচ-ছজনের দলের একজন সুবেশা তরুণী তার দিকে ঝুঁকে বলল, আপনার সঙ্গে আমাদের আলাপ নেই। আমার নাম সুদর্শনা রায় গুপ্ত, আমি একজন সাংবাদিক।

অতনু নিজের নাম জানিয়ে বলল, গ্ল্যাড টু মিট ইউ, আপনি কোন কাগজের?

সুদর্শনা নিজের কাগজের একটা কার্ড দিয়ে বলল, আপনি কোথায়?

অতনু বলল, আমি থাকি আফ্রিকায়। কয়েকদিনের জন্য এসেছি।

আফ্রিকা শুনেই একজন পুরুষ গলা বাড়িয়ে বলল, আপনি আফ্রিকায় থাকেন? কোথায়?

এই ধরনের বাঙালি আড্ডায় কথা জমাবার জন্য অতনুর একটা বাঁধা রসিকতা আছে।

সে বলল, আমি থাকি কিনিয়ার নাইরোবি শহরে। রবীন্দ্রনাথ এই শহর নিয়ে গান লিখেছেন, আপনারা জানেন?

এবার অনেকগুলি কৌতূহলী মুখ কাছে ঝুঁকে আসে। একজন বলল, রবীন্দ্রনাথ আফ্রিকা নিয়ে একটা বড় কবিতা লিখেছেন জানি। কিন্তু নাইরোবি নিয়ে–

অতনু বলল, রবীন্দ্রনাথ নিজের নাম নিয়ে অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন। তাই রবির সঙ্গে কবি, ছবি, হবি এই সব মিল দিয়েছেন, মিল খুঁজতে-খুঁজতে একবার নাইরোবিও পৌঁছে গেছেন একটা গানে। সেই গানটা হল, সকালবেলার আলোয় বাজে, বিদায় ব্যথার ভৈরবী/আন বাঁশি তোর, আর কবি…এরপর একটা লাইন হল, নাই যদি রোস নাই রবি, সেদিন নাইরবি…

সবাই কলহাস্যমুখর হয়।

আর কিছু বলার আগেই একটা গুঞ্জন ও কিছু লোকের ব্যস্ততা দেখা যায় প্রবেশ মুখে। বিশিষ্ট কোনও অতিথি এসেছেন।

রাজেশ আগরওয়াল হাতজোড় করে ও কোমর ঝুঁকিয়ে সেই অতিথিকে নিয়ে আসছেন, অতিথি একজন মহিলা। সাদা সিল্কের শাড়ি পরা, তা থেকে ঝিলিক মারছে অনেক জরির চুমকি, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, পালিশ করা মুখ, খুব গ্ল্যামারের ছড়াছড়ি।

অতনু সাংবাদিকটিকে জিগ্যেস করল, ইনি কে?

সে বলল, সে কী! আমাকে বলেছেন, বলেছেন, আর কাউকে বলবেন না। লোকে আপনাকে গেঁয়ো ভূত ভাববে। সুরশ্রী মিত্র, বাংলা ফিল্মের সবচেয়ে নামি নায়িকা, মুম্বই থেকেও ডাক এসেছে, চলে গেল বলে।

আর একবার তাকিয়ে দেখে বুঝল। কয়েক দিন আগেই টিভি-র কোনও ফিল্মে সে এই নায়িকাটিকে দেখেছে, গ্রাম্য মেয়ের ভূমিকায় সাজপোশাক ছিল অন্য রকম? কেন ওকে একটু চেনা-চেনা লাগছিল তার কারণটাও বোঝা গেল, সীতারামপুরের গোল গম্বুজটার গায়ে ফিল্মের পোস্টারে এরই মুখের ছবি ছিল, যাতায়াতের পথে সে অনেকবার দেখেছে।

একটু বাদে রাজেশ আগরওয়াল তাঁর এই প্রাইজড পজেশানটি সকলকে ভালো করে দেখাবার জন্য নিয়ে এলেন প্রতিটি চেয়ারের সামনে। জনে-জনে হাত তুলে নমস্কার করছে। উত্তরে মিষ্টি হাসি বিলোচ্ছেন নায়িকাটি।

অতনুর কাছে এসে সে একটু থমকে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল নির্নিমেষে! তার পর অস্ফুট গলায় বলল, তনুদা?

অতনুরও আর চিনতে দেরি হল না, সেও সঙ্গে-সঙ্গে বলল, চিনু! তাই না? নায়িকা জিগ্যেস করল, তুমি এখানে কোথা থেকে এলে? তুমি তো হারিয়ে গিয়েছিলে।

অতনু বলল, এসেছি এক জঙ্গলের দেশ থেকে।

দৃশ্যটি একটু বেশি নাটকীয়। তাই বেশিক্ষণ টানা যায় না। অভ্যেসমতন অতনুকেও একটু হাসি উপহার দিয়ে এগিয়ে গেল নায়িকা অন্যদের দিকে।

এই সেই দস্যি মেয়ে চিনু, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। সেই যে রূপকথার গল্পে আছে, একটা ব্যাং একদিন হঠাৎ রাজপুত্র হয়ে গেল। এ যেন ঠিক তার উলটো। সেদিনের সেই রোগা প্যাংলা মেয়েটা আজকের এই রূপসি!

মহিলা সাংবাদিকটি জিগ্যেস করল, আপনি একে পার্সোনালি চেনেন বুঝি?

অতনু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, সে অনেক ছেলেবেলায়।

সে বুঝিয়ে দিল যে, এই বিষয়ে সে আলোচনা চালাতে উৎসাহী নয়। সে চুমুক দিল গেলাসে।

একটু পরেই এক যুবক এসে অতনুকে বলল, আপনাকে একবার ওদিকে ডাকছে।

আলোর বৃত্ত থেকে একটু বাইরে। আধো-অন্ধকারে একটা চেয়ারে বসে আছেনায়িকা। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন।

অতনুকে দেখে সে অন্যদের বলল, এই, এখানে একটা চেয়ার দাও। আর তোমরা একটু যাও, ওঁর সঙ্গে আমার কথা আছে।

অতনু বসবাস পর একটু ঝুঁকে এসে তার একটা হাত ধরে নায়িকা সম্পূর্ণ অভিনয়হীন গলায় বলল, তনুদা, তোমাকে কতদিন পর দেখলাম। আগরওয়ালজি বললেন, তুমি এখন আফ্রিকায় থাকো।

অতনু বলল, হ্যাঁ। চিনু, তুই কবে সিনেমার নায়িকা হয়েছিস? শুনলাম তোর খুব নাম, এসব আমি কিছুই জানি না। তোর ভালো নামও তো আমি জানতাম না।

চিনু বলল, কেন, তোমাদের ওখানে বাংলা ফিল্ম যায় না?

অতনু বলল, কী জানি। হিন্দি ফিল্ম কখনও-সখনও প্রাইভেটলি দেখানো হয় শুনেছি। তাও আমার দেখা হয় না। তুই হিন্দিতেও করেছিস।

করেছি দু-একটা। সব বাঙালিই আমাকে চেনে, একমাত্র তুমি ছাড়া।

তারপর একটু দুষ্টুমির হাসি দিয়ে সে আবার বলল, কিংবা, একমাত্র তুমি আমাকে যেভাবে চেন, সেভাবে এখন আর কেউ চেনে না।

তুই কী করে নায়িকা হয়ে গেলি রে? চেহারাটাও বদলে গেছে।

ওসব কথা ছাড়ো। হয়ে গেছি কোনওরকমে। তুমি কেমন আছ, বলো। বিয়ে করেছ?

ভালোই আছি রে। না বিয়ে করিনি। তবে একজন বিদেশিনি মেয়ের সঙ্গে ভাব আছে। তুই?

আমার একটা বিয়ে ভেঙে গেছে। আর একটা, নাঃ, এখনও কিছু ঠিক নেই।

তুই আমাকে দেখে চিনলি কী করে? আমি তো তোকে চিনতে পারিনি, শুধু একটু-একটু মনে হচ্ছিল, তোর নাকটা শুধু…

হ্যাঁ, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আমাকে বলে নাকেশ্বরী। তোমার চেহারা তো প্রায় একই রকম আছে। পুরুষরা বিশেষ বদলায় না। আমাদের তো মেক-আপ টেক-আপ দিয়ে…

অতনু একটা সিগারেট ধরাল।

চিনু বলল, তুমি এখনও সিগারেট খাও? অনেকেই তো…আমিও ফিল্ম লাইনে এসে প্রথম-প্রথম খুব খেতাম, এখন একদম ছেড়ে দিয়েছি, অন্তত সাত বছর, দাও, তোমার থেকে একটা টান দিই।

সিগারেটটা হাতে নিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল চিনু।

অতনু জিগ্যেস করল, তুই আর সীতারামপুরে যাস?

চিনু বলল, নাঃ, ওখানে তো ছিল আমার মামাবাড়ি। প্রায়ই যেতাম একসময়, আমাদের বাড়ি ছিল ব্যারাকপুরে। তারপর বাবা বদলি হয়ে গেলেন নর্থ বেঙ্গলের মালবাজারে।

অতনু বলল, ও হ্যাঁ, মামাবাড়ি। ওঁরা আর কেউ নেই শুনেছি। তোর একটা ফিল্ম কয়েকদিন আগে দেখলাম টিভি-তে। নামটা বোধহয় আশালতা, তাই না?

হ্যাঁ।

তাতে তুই একটা গ্রামের মেয়ে, ডুরে শাড়ি পরা, একটা সিনে আছে, তুই একটা পুকুর থেকে ডুব দিয়ে উঠে এলি…হ্যাঁরে চিনু, তুই ওরকম কোমর দুলিয়ে হাঁটা কোথায় শিখলি রে? গ্রামের মেয়েরা কি ওইভাবে হাঁটে?

তুমি কী যে বল তনুদা? সিনেমা করতে গেলে কত কী শিখতে হয়। গ্রামের মেয়েরা ওইভাবে হাঁটে না, ওসব মেক বিলিভ, অধিকাংশ সিনেমাই তো রূপকথা, তাই না?

তুই নাচ জানিস?

মাঝে-মাঝে নাচতে হয়, কিন্তু তাকে না বলে না।

একজন যুবক হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, মিস, আপনাকে ওদিকে আসতে বলছেন আগরওয়ালজি। সবাই আপনাকে চাইছে।

চিনু রুক্ষ গলায় বলল, একটু পরে যাচ্ছি, এখন ডিস্টার্ব কোরো না।

ছেলেটি ফিরে যাওয়ার পর চিনু বলল, একটু নিরিবিলিতে যে তোমার সঙ্গে গল্প করব, তার উপায় নেই। তুমি কতদিন আছ?

অতনু বলল, পরশু ফিরে যাব।

চিনু বলল, এই রে, এই দুদিন আমার টানা শুটিং। আউটডোর। তুমি আসবে, ডায়মন্ডহারবারে? না থাক, শুটিং-এর সময় আমি তোমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে পারব না। তোমারও বোরিং লাগবে।

অতনু বলল, শুটিং দেখা আমার পোষাবে না।

আবার একজন যুবক দৌড়ে এসে বলল, মিস, আপনার নাম অ্যানাউন্স করা হয়ে গেছে, আপনাকে একবার সেন্টার স্টেজে দাঁড়াতে হবে।

চিনু বলল, ঠিক আছে। যাচ্ছি।

উঠে দাঁড়িয়ে সে অনেকটা আপন মনে বলল, নায়িকা-টায়িকা হতে গেলে অনেক কিছু মূল্য দিতে হয়, সে তুমি বুঝবে না। অতনু মনে-মনে ভাবল, না বোঝার কী আছে? সব দেশেই তো এক।

চিনু আবার বলল, যে-কোনও লাইনেই ওপরে উঠতে গেলে কিছু-না-কিছু মূল্য দিতে হয়ই, তাই না? আমাদের ফিল্ম লাইনেও…কোনও ইনহিবিশন রাখলে চলে না। যাই। তোমার সঙ্গে আবার কখনও দেখা হবে কি না জানি না। তবু একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। বলব?

বল!

তনুদা, তোমার সেই দিনটার কথা মনে আছে? সেই ভূতুড়ে বাড়িটায়…

মনে থাকবে না কেন? তোর যে মনে আছে, সেটাই আশ্চর্যের।

তনুদা, জীবনে আমি অনেক অভিজ্ঞতা পার হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সেদিন, আমি যে-তীব্র আনন্দ পেয়েছিলাম, তার কোনও তুলনা হয় না। তোমাকে দেখে…সে রকম আর কখনও…চলি, ওরা আর থাকতে দেবে না।

হঠাৎ কি চিনুর গলায় কান্না এসে গেল? মুখ নীচু করে সে দ্রুত পায়ে চলে গেল আলোর বৃত্তের দিকে।

অতনু আরও কিছুক্ষণ বসে রইল সেখানেই।

সেই বট-অশখের ফাটল ধরানো পোড়ো বাড়ি। গা-ছমছমে দুপুর। সিগারেট খেতে চেয়েছিল চিনু, একদিন অতনুকে ধরে ঝুলোঝুলি, তাই বন্ধুদের বাদ দিয়ে শুধু চিনুকে নিয়ে এক দুপুরে চুপি-চুপি সেই বাড়িতে গিয়েছিল অতনু।

সিগারেটে প্রথম টান দিয়েই কাশতে শুরু করেছিল চিনু, তার পিঠে ছোট-ছোট চাপড় মেরে দিচ্ছিল অতনু, তারপর কী যেন হল, পর-পর পাঁচটা চুমু খেয়েছিল সে। চিনু অবাক হয়নি, প্রথমবারের পর, পাখির বাচ্চা যেমন পাখি-মায়ের সামনে ঠোঁট ফাঁক করে থাকে, সেইভাবে চিনু। এগিয়ে দিয়েছিল ঠোঁট।

তাদের দুজনেরই সেই প্রথম অভিজ্ঞতা।

তারপর নদী দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেছে, সেই বাড়িটা আর নেই, চিনু কত বদলে গেছে। অনেক কিছুই বদলে গেছে, তবু চিনু যে আজ বলল, সেরকম তীব্রতা সে আর জীবনে পায়নি, তার চোখে জল এসে গেল…এই স্মৃতি নিয়েই ফিরে যাবে অতনু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *