সাধ
যাবে?
আমি কী জানি? আমি কি থাকি এখানে?
আমিও কি চিরদিনের বাসিন্দা?
‘চিরদিন’, ‘সারাটা জীবন’ এইসব কথাগুলোতেই আমার অ্যালার্জি। জীবনেরই কোনো নিত্যতা নেই, তার—‘চিরজীবন’, ‘সারাটা জীবন’। আমার এক বন্ধু আছে—সৌম্য, যে এখন পুণেতে থাকে, কথায় কথায় বলে, সারাটা জীবন ধরে এই করলাম, তাই করলাম। আমি তখন তাকে বলি, তোর সারাটা জীবন তো সাতাশ বছরের।
ও কী বলে?
ও বলে, সাতাশটা বছরই বা কী কম? জন কিটস বা স্বামী বিবেকানন্দ কতদিন বেঁচেছিলেন? জীবনের দৈর্ঘ্য দিয়ে কোনোদিনই জীবনের পরিমাপ হয়নি—কখনো হবেও না। আমাদের পাড়ায় জীবনদাদুর মতো মরণজয়ী আটানব্বই বছরের খিটখিটে বুড়ো হয়ে, যা-কিছু সুন্দর তার সব কিছুর প্রতি ভুরু কুঁচকে চ্যবনপ্রাশের গুলি খেয়ে খকখক করে কাশতে কাশতে হাঁপানির টান তুলে বেঁচে থাকার চেয়ে টগবগে সাতাশের দুরন্ত ঘোড়ার মতো দুর্বার গতিতে ছুটে গিয়ে থমকে যাওয়াটা আমার কাছে অনেক শ্রেয়।
বাবা! তুই যেমন বাংলা বলছিস, কবিতা লিখিস না কেন? লুকিয়ে লুকিয়ে লিখছিস নাকি আজকাল? লিখলে, মহিলা কবিদের মধ্যে নাম করতে পারতিস।
মহিলা কবি আবার কী কথা? কবি, কবি। তুই মহিলা প্রজাপতি বা মহিলা শুয়োর বলিস?
জীবনানন্দ তো শূকরী বলেছিলেন।
হ্যাঁ, তা বলেছিলেন একটা বিশেষ কিছু বোঝাতে। এমনিতে এখন জেণ্ডারের দিন চলে গেছে। জেণ্ডার বায়াসের দিনও।
তা যা বলেছিস। চেহারায়, পোশাকে, চুলের ছাঁটে, কথাবার্তাতে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের তফাত তো এখন খুব একটা নেই। হয়তো মানসিকভাবেও নেই। তাই তো জেণ্ডারকে এখন এজেণ্ডা থেকে বাদ দেওয়ারই সময় এসেছে।
কবিতার কথাটা কিন্তু এড়িয়ে গেলি!
এড়াব কেন? আমি কবিতা যদি সত্যি লিখতাম, তবে তোদের বাংলা ব্যাণ্ডের কথার চেয়ে ভালোই লিখতাম।
খুব ভালো বলেছিস। আমাদের ব্যাণ্ডের জন্য কিছু গান লিখে দে-না।
গান ভালোবেসে গান বলছিস?
চন্দ্রবিন্দু। অনিন্দ্যদা দারুণ ছেলে। চোখদুটো কী সুন্দর, না? ও যদি চুপকির সঙ্গে প্রেম না করত, তবে আই উড হ্যাভ ডায়েড ফর হিম। দারুণ রোমান্টিক ছেলে!
হুঁ। সময়টা অনিন্দ্যদাদের দারুণ যাচ্ছে। একেবারে পিটিয়ে খেলছে। উইকেটের চার ধারে বাউণ্ডারি। আজ নাগপুর, কাল কাটোয়া, পরশু শান্তিনিকেতন—
তার পরই জোজো বলল, সময় বুঝলি পেঁচি, সময়টা একটা মস্ত ব্যাপার। জীবনে সময় ভালো না এলে, কিছুতেই কিছু হয় না।
বলেই হতাশার সঙ্গে সিগারেটের বাটটাকে ছুড়ে দিল।
যতি বলল, অ্যাই! আমাকে পেঁচি বলবি না।
জোজো হাসল। জোজো হাসলে যতির ভারি ভালো লাগে ওকে। বলল, জিশুখ্রিস্টের হাসি দেখিনি, জ্যোতি বসুর দেখেছি। তুই হাসিস কম কিন্তু হাসলে ভুবন মাত করে দিস।
কী উপমা! হেসে বলল জোজো। তার পর বলল, তোর মাথাতে আসেও কিছু।
জোজো মাথার ডান দিকে তর্জনী দিয়ে টোকা মেরে বলল, মানুষে মানুষে তফাত তো শুধু এই মাথাতেই। কোনো কোনো মানুষ এই মাথাতে গোবর বয়, কেউ কেউ অমৃত।
তার পর উঠে দাঁড়িয়ে মোটরসাইকেলের দিকে যেতে যেতে বলল, কাল যাবি কি না ফাইনাল কর। গেলে তোকে কিন্তু একাই যেতে হবে আমার সঙ্গে। তোর ওই হামবাগ মাথামোটা কাজিন হিমাংশুটাকে নিয়ে যাব না কিন্তু।
অমন করে বলিস না। আফটার অল আমি ওদের বাড়িতেই এসে উঠেছি আমলোরিতে। আমি ওদেরই অতিথি। আচ্ছা ও না গেলে, আমার বোন হাসিনী যেতে পারে। জোজো ডান পায়ের জগিং শু-টা দিয়ে মাটিতে পদাঘাত করে বলল, বাই নো মিনস। তোর হাসিনী আসলে কাঁদুনি। একটা রিয়াল পেঁচি।
সে তোকে খুব পছন্দ করে কিন্তু রে জোজো।
জানি তো। আর সেইজন্যই তো দূরে দূরে থাকি। তোর ওই কাজিনের প্রেমে পড়ার চেয়ে ডাম্পারের চাকার তলায় চাপা পড়ে মরা ভালো। শি লাইকস মি বাট আই হেইট হার। পুরো নর্দার্ন কোলফিল্ডস-এর এলাকা ধরেও বলতে পারি, তোর কাজিন হাসিনীর মতো স্পয়েল্ট, মিসডায়রেক্টেড এবং নেকি মেয়ে আর একজনও নেই। অসহ্য। অতখানি পথ মোটরসাইকেলের পিনিয়নে আমার পিঠ আর পেট জড়িয়ে ও বসে থাকলে অ্যাক্সিডেন্ট করব আমি।
যতি বলল, ওর সম্বন্ধে তোর এমন ধারণা, তা কি হাসিনী জানে?
সম্ভবত নয়। তাহলে নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলত না। ওকে একটু বুদ্ধি করে বুঝিয়ে দিস প্লিজ। আই কান্ট স্ট্যাণ্ড দ্য ভেরি সাইট অফ হার।
বলেই বলল, চল যাই এবারে। আয়, বোস এসে পেছনে।
তার পর একটু চুপ করে থেকে বলল, রাবণ-মারা গুম্ফা এখান থেকে বেশ অনেক দূর। তা ছাড়া, অনেকখানি পথ নির্জন এবং জঙ্গুলে। তোর মতো সুন্দরী যুবতীকে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে অতদূর যাওয়াটা রিস্কি হয়ে যায়। যা দিনকাল। সঙ্গে একজন পুরুষ বন্ধুকে নিতে পারলে ভালো হত, কিন্তু তোর সঙ্গে আমার অনেক জরুরি কথা ছিল যতি। খুব জরুরি। আমি সামনের একবছরের মধ্যে কলকাতা যেতে পারব না। তুইও তোর ছুটকিপিসির বাড়িতে আবার কবে আসতে পারবি এমন অনিশ্চিত …তাই।
কী এমন কথা যা, বলতে রাবণ-মারা গুম্ফাতে যেতে হবে, তা ছাড়া চলন্ত মোটরসাইকেলে না বসে তুই জরুরি কথা বলতে পারিস না? এখানে বললে কী হত? পুরুষমানুষ হিসেবে যদিও তুই আমার খুবই প্রিয় তবু ব্যাপারটা ভালো বুঝতে পারছি না আমি।
রাবণ-মারাতেই যে যেতে হবে তার কোনো মানে নেই। আমরা কাছাকাছি কোনো ফরেস্ট বাংলোতে যেতে পারি। কিন্তু তুই আর্কিটেক্ট—তোর পক্ষে রাবণ-মারা দেখা দরকার। যেতে-আসতে অনেকক্ষণ লাগবে। আমার বা তোরও একে অন্যকে যা বলার, তা বলার অনেক সময় পাওয়া যাবে। বৌদ্ধ গুম্ফা অথচ হিন্দুদেবীর মূর্তি আছে সেখানে। অন্য কোনো দেশ হলে হেরিটেজ করে রাখত। কিন্তু দেখে তোর কান্না পাবে এমন অবস্থাতে আছে তা।
মোটরসাইকেলে স্টার্ট করে আমলোরি জনপদের দিকে এগোল। চমৎকার চওড়া চওড়া রাস্তা, আলো ঝলমল করছে। দু-পাশের নানা কোয়ার্টার। কোয়ার্টারের নাম্বার দেখেই বাসিন্দার স্ট্যাটাস বলা যায়—কে কত বড়ো চাকরি করে। অনেক কোয়ার্টারের লাগোয়া ছোট্ট লন আছে, গ্যারেজে মারুতি গাড়ি। বাচ্চার ট্রাইসাইকেল। সুখী পরিবার যে, তা বাইরে থেকে বাড়ি দেখে, বাড়ির কোনো বাসিন্দা না দেখেই বলা যায়। বড়ো বড়ো নানা গাছের পাতার ছায়া পড়েছে মার্কারি ভেপারের বাদামি আলোর পথে। কোনো ফুলের গন্ধ ভাসছে। শিউলিই হবে হয়তো। এখন শরৎ। পুজোর আর বেশি দেরি নেই। সারাভারতবর্ষের মানুষ কাজ করে নর্দার্ন কোলফিল্ড-এর কোলিয়ারিতে। সারাভারতের ভাষা, সংস্কৃতি, গান, সাহিত্য এখানে চর্চিত হয়। হিন্দি, বাংলা, ওড়িয়া, গুজরাতি, তামিল, তেলেগু খবরের কাগজ আসে। ইংরেজি তো আসেই।
জোজোর মোটারসাইকেলের পেছনে ওর কোমর জড়িয়ে বসে যেতে যেতে হঠাৎই এক গাঢ় স্বপ্নে ডুবে যায় যতি। কে জানে, সে-স্বপ্ন সত্যি হবে কি না! কথায় বলে না, দেয়ার আর মেনি আ স্লিপস বিটউইন দ্য কাপ অ্যাণ্ড দ্য লিপস।
সুন্দর কতগুলো কোয়ার্টারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে যতি বলল, তুই এরকম কোয়ার্টার পাবি?
পাব, যদি বিয়ে করি। বিবাহিত মানুষদের জন্যে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট।
এমন কোয়ার্টার পেলেও তুই মোটরসাইকেলেই চাপবি?
বা:। তা কেন? তখন একটা সাদা মারুতি এইট হান্ড্রেড নেব। আমার বউয়ের শায়া শুকোবে লনে। সরু-কোমরের ঘেরের।
বাবা:! কী কল্পনা। শায়া দেখে শায়ার মালিকের কোমরের মাপ বুঝিস তুই?
বুঝি তো! না বোঝার কী? শায়ার ঘের দেখেই বোঝা যায়, শায়ার মালকিন তন্বী, না বিপুলা।
বাবা:। পারিস তুই। তার পর বলল, তোদের নর্দার্ন কোলফিল্ড-এ আর্কিটেক্টের প্রয়োজন নেই?
থাকবে না কেন? এত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার যখন আছেন, তখন আর্কিটেক্টও নিশ্চয়ই আছেন। সবসময়েই তো কনস্ট্রাকশন হচ্ছে। ম্যানেজমেন্টের বাংলোগুলো দেখলে চমকে যাবি। এক-একটা বাংলো এক-একরকমের। এম ডি, এফ ডি, এবং অন্যান্য ডিরেক্টরদের। সেসব সিঙ্গরাউলিতে। তা ছাড়া, প্রত্যেক এরিয়াতে একজন করে জি এম আছেন। তাঁদের বাংলোও সব দেখার মতো।
তোদের আর্কিটেক্টরা কেমন মাইনে পান?
জানি না। তবে খোঁজ নেব।
কেন? এখানে চাকরি করবি?
যদি কখনো এখানে আসি, থাকি, তবে কি এত কষ্ট করে পড়াশুনো করা বিদ্যা ভুলে যাব? যদি বিয়ে করি তাহলে স্বামীরও সাশ্রয় হবে। আজকাল সবাই দুজনে রোজগার করে। বিশেষ করে যতদিন না বাচ্চা হয়। বাচ্চা একটু বড়ো হয়ে গেলেও করে।
জোজো বলল, তুই যদি এখানে থাকতিস তবে কোন বাংলোটা পছন্দ করতিস—বলতে বলতে বাইকের গতি একেবারে কমিয়ে দিল জোজো।
যতি আঙুল দিয়ে দেখাল, ওইটাকে।
বা:। তোর টেস্ট তো খুব ভালো। ওইটা কানিকটার সাহেবের বাংলো। মারাঠি মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার। স্ত্রী ডাক্তার, জয়ন্ত-এর হাসপাতালে আছেন—গায়নাকলজিস্ট।
তার পর বলল, গাছগুলো তোর পছন্দ?
হুঁ। যতি বলল।
গাছ চিনিস?
সব চিনি না, কিছু কিছু কমন গাছ চিনি। যেমন কৃষ্ণচূড়া।
দেখ, গেটের দু-পাশে দুটো কৃষ্ণচূড়া। পেছনে জ্যাকারাণ্ডা। একটা বারোমেসে জবা আছে এই বাংলোতে—যত কালীভক্ত রোজ ফুল নিয়ে যায় পুজোর জন্যে। তবু ফুল ফুরোয় না—সারাবছরই ফোটে। পথের মোড়ে যে বড়োগাছটা দেখছিস, সেটা মহুয়া। চোত-বোশেখ মাসে যদি আসিস, তো গন্ধে ম-ম করবে পুরো তল্লাট। তখন আমের বোলের গন্ধ, কাঁঠালের মুচির গন্ধও ভাসবে হাওয়ায়। কোকিল আর পিউ কাঁহা ডাকবে—কে বলবে যে চারিদিকে কয়লা খাদান বেষ্টিত হয়ে আমরা বাস করি। আসলে যেখানেই নারী থাকে পুরুষের সঙ্গে, সেখানেই নীড় গড়ে ওঠে—শিশুর হাসি, ফুলের গন্ধ, পাখির ডাক—মনে হয় স্বর্গে আছি।
বাবা। তুই তো সুন্দর করে বললি।
তুই আমার কোমর জড়িয়ে বসে আছিস। আমার পেঁচি, তাই তো মুখ দিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বেরিয়ে এল। এমনিতে কি আর পারতাম?
যতি বলল, এরকম একটা বাংলো অথবা এই বাংলোটাতে যদি আমি থাকতাম, তবে শিউলি লাগাতাম আমি। অনেকগুলো শিউলি। কোথা থেকে গন্ধ আসছে রে?
চ্যাটার্জিদার বাড়ি থেকে। বউদিও তোর মতো শিউলির ভক্ত। পরশু রাতে আমাকে আর তোকে খেতে বলেছেন ওঁরা। দারুণ রাঁধেন। চ্যাটার্জিদা ভালো রবীন্দ্রসংগীত গান আর বউদি ছবি আঁকেন জলরঙে। সুন্দর আঁকেন।
আমি হলে বোগোনভোলিয়া লাগাতাম নানা রঙের। রঙে রঙে ভরিয়ে দিতাম বাংলোটাকে।
বেশ। তাই করিস।
আর কী করবি?
আর পাখি পুষব অনেকগুলো, বিভিন্ন রঙের।
কী পাখি?
লাভ বার্ডস।
বা:। পুষিস।
তবে শখ পূরণ কবে হবে?
তা তুই-ই জানিস। তুই তো পুরুষ। তোরাই তো সব কিছুর নিয়ন্তা। আমরা তো অনুসরণকারী—এখনও। তুই যখন ডিসিশন নিবি তখনই হবে। আমি আর কী বলব?
তার পর বলল, মা কিন্তু গোলমাল করছে, বুঝলি। বাবা মুখে কিছু বলে না, তবে মার মতে মত বলেই মনে হয়।
কী গোলমাল করছেন মাসিমা?
উঠতে বসতে বলছে, আর কতদিন ধিঙ্গি হয়ে থাকবি? আর্কিটেক্ট হলি, একজনকে পছন্দ করলি সে-ও স্বয়ম্ভর। তবে দেরি কীসের জন্যে? স্বামীর কর্মস্থলই মেয়েদের জায়গা। জোজো যেখানেই পোস্টেড থাকুক, সেখানেই তোর চলে যাওয়া উচিত। তার রোজগারই তো যথেষ্ট। তার ওপরে তুইও কিছু জুটিয়ে নিতে পারিস তো মন্দ কী? আমরা তো তোর রোজগারে খেতে চাই না। তুই জীবনে নোঙর ফেল, সুখী হ, আমরা নাতিপুতি দেখে আনন্দ করে যাই। তোদের কাছে আমাদের আর কী চাইবার আছে? ছেলেটা তো আমেরিকানই হয়ে গেল। এই এক দেশ হয়েছে। ডাইনি। টাকার আর অপার স্বাধীনতার লোভ দেখিয়ে এদেশের সব কৃতী ছেলে-মেয়েদেরই হাতছানি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে তোরা আরাম আর আনন্দকে গুলিয়ে ফেলেছিস। নিজের দেশে থাকার যে আনন্দ, তা বিদেশে কোথায়?
জোজো বলল, চল, আমার ওখানে এককাপ কফি খেয়ে যাবি। বসে বসে কথা হবে। আমার রামদীন দারুণ কফি বানায়। তোর মায়ের মতো, সেও ‘বিয়ে বিয়ে’ করে আমার মাথা খারাপ করে দিল। পুরোনো জেনারেশনের মানুষরা সবাই একরকম। বিয়েই যেন স্ত্রী-পুরুষের পরমগন্তব্য, সব মুশকিল আসান। তুই চলে আয় এখানে, আমরা কিছুদিন লিভ-টুগেদার করে দেখি।
না।
একেবারে এমফ্যাটিক না?
ইয়েস। আমি কনসার্ভেটিভ কোনো কোনো ব্যাপারে। বিয়ে একটা পূত-পবিত্র ব্যাপার। শুধু আমাদেরই নয়, আমাদের মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন কত মানুষের আশা জড়িয়ে আছে বিয়ের মধ্যে। সানাই, গায়ে হলুদ, উপোসি থাকা, উলু দিয়ে বরকে বরণ, ছেলেবেলা থেকে এসব একজন মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়ের স্বপ্ন। এসব বাদ দিয়ে স্বামীকে স্বীকার করা যায় না। ‘স্বামী’ শব্দটা যে কত কী বহন করে আনে একজন ভালো, পিয়োর মেয়ের মনে তা তোরা বুঝবি না।
তার পর বলল, তা ছাড়া তুই, এই নর্দার্ন কোলফিল্ডস-এর আমলোরিতে আসার পর থেকে, মায়ের মনে অন্য চিন্তাও জেগেছে।
কী চিন্তা? জোজো বাইকটা ওর কোয়ার্টারের সামনে পার্ক করিয়ে বলল।
চিন্তা, এখানেও তো রূপসি গুণবতী মেয়ে কম নেই, বিবাহযোগ্যা। আমার তো রূপগুণ তেমন নেই। যা আছে, তা অনেকেরই থাকে। আমার মতো প্রফেশলান কোয়ালিফিকেশনও অনেক মেয়েরই আছে। তুই এখানে একা থাকিস—অন্য কারো প্রেমে যদি পড়িস। যদি আমাকে ডিচ করিস। মায়ের মন তো, নানারকম চিন্তা তো হয়-ই। যাকে বলে, নাই—চিন্তা।
জোজো দরজার কলিং বেল টিপে হাসতে হাসতে বলল, মাসিমার অনুমান মিথ্যে নয়। পরশু এখানে একটা ফেস্ট আছে। সেখানে তোকে নিয়ে যাব। তখন দেখবি কত সুন্দরী, গুণবতী সব মেয়ে—জোজো! জোজো! করে মাছি পড়ার মতো পড়বে আমার ওপরে।
তবে?
তবে আর কী? দোষ তো এই পোড়াকপালে আমারই। কী যে দেখেছিলাম এই পেঁচির মধ্যে! বলেই বলল,
এ তো নহি তুমসা জঁহামে হাসিন নহিইস দিলকা কেয়া কঁরু কি বহলতা নেহি
মানে কী হল?
যতির গালে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে একটি টোকা মেরে জোজো বলল, মানে হল,
তোমার চেয়ে সুন্দরী এ-দুনিয়াতে আর কেউ নেই এমন তো নয়, কিন্তু করি কী? আমার হৃদয় যে অন্য কোথাও নড়ে না।
ফাজিল! বলে, একটা হালকা কিল মারল যতি ওর নরম হাতে জোজোর পিঠে।
২
সকালেই ওরা বেরিয়ে পড়েছিল সিধির পথে। সিধি আমলোরি থেকে বহু দূরে। সিধি অবধি যাবে না, যাওয়ার কোনো কারণও নেই। ইচ্ছে আছে গাড়োরিয়ার বনবাংলো অবধি যাবে। রাবণ-মারা গুম্ফা দেখে গাড়োরিয়ার ডান দিকে একটি ন্যাড়া পাহাড়ের মাথাতে তেলদা গ্রামের মানুষেরা একটি শংকর মূর্তি স্থাপন করেছে, সেখানে পুজো দিয়ে বাংলোতে ফিরে বিশ্রাম করে রোদ পড়লে ফিরে আসবে আমলোরি। যতি খুব ধার্মিক। মাসিমার কাছ থেকে এই গুণ পেয়েছে। জোজোর মাও পুজো-আচ্চা করেন। পশ্চিমবঙ্গে এখন পুজো-আচ্চা করাটা পৌত্তলিকতা, প্রাগৈতিহাসিকতা কিন্তু নমাজ পড়া বা মাথায় রুমাল দিয়ে ‘ইফতার’ পার্টি করাটা ফ্যাশনেবল। সরস্বতী বন্দনা হলে শিক্ষামন্ত্রী সভাস্থান ত্যাগ করেন ঘেন্নায়। জোজো বহুদিন কলকাতা ছাড়া কিন্তু নিজের রাজ্যের রাজধানীতে আধুনিকতা আর ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যেসব বাঁদরামো হচ্ছে এবং তা আপামর জনসাধারণ বিনা প্রতিবাদে মেনেও নিচ্ছে—এসব দেখে নানাকথা মনে আসে জোজোর। ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে বাবা-জ্যাঠা-কাকাদের ধর্মাচরণ করতে দেখেছে, তাই সেই বাতাবরণ ভালো লাগে যতির। নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতে এবং পুজোর অঞ্জলি দিতে, সরস্বতী পুজো করতে তার ভালো লাগে। যতিকে যে সে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে চেয়েছে তার পেছনে এ-ব্যাপারে মানসিকতার মিলটাও একটা বড়ো ব্যাপার।
আমলোরি থেকে ব্যয়বান, পারসোনা, খুটার এবং রাজমিলন হয়ে মারা। পাশে নতুন বড়ো বস্তি গড়ে উঠেছে নইনগর। পথে পড়ল কাচেন নদী, লাউয়া, নালা, গাড়রা নালা আর মারা থেকে ডুতালি নালা। মারা গুম্ফায় ভেতর থেকে অদৃশ্য ধারার জল বয়ে গিয়ে বাইরে নালার সৃষ্টি করেছে।
এইসব দেখতে দেখতে, বলতে বলতে চলেছে জোজো। আর যতি খুশিতে ডগমগ হয়ে কোমর জড়িয়ে বসে সব দেখছে। একটা ফেডেড জিনস আর হালকা বেগুনি-রঙা টপ পরেছে যতি। পনি-টেইল করেছে। ভালো পারফিউম মেখেছে। হাওয়ায় তার সুগন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
জোজোর নাকে তো বটেই, পথের দু-পাশেও।
‘রাবণ-মারা’ গুম্ফাটি কালো পাথরের টিলার ওপরে। সামনে জল জমে আছে, গতসপ্তাহের বৃষ্টিতে। এই গুম্ফা নাকি ভেতরে ভেতরে চলে গেছে দু-কিমি দূরের বিবাহমারা পাহাড় পর্যন্ত। এখান থেকে বিন্দুল চলে গেছে একটা পথ ঝিঙ্গা-ঝিরিয়া নালাকে পাশে রেখে। ভারি সুন্দর নালাটা। আর সুন্দরী মেয়ার নদী নির্জন জঙ্গলের মাঝে বাঁ-দিকে প্রহরীর মতো চলেছে।
খুটারের কাছে পথে কাজ হচ্ছে। রাস্তা খুঁড়েখাড়ে রেখেছে। জায়গাটা পার হতে অনেক সময় লাগল। তা ছাড়া লাল মাটিতে দুজনের গা-মাথা সব ভরে গেছে। ফেরার পথেও এখানে সময় নেবে অনেক।
রাবণ-মারা গুম্ফা প্রাচীন বৌদ্ধ গুম্ফা। যেমন দেখতে হয় তেমনই দেখতে, তবে খুবই ছোটো। দূর এবং নদীর অন্য পাড় থেকে দেবপ্রয়োগের কালো পাথরের চাতাল যেমন দেখায়, তেমনই দেখায়—এটা সেই বিরাট গুহার এপিটম আর কী! এই টিলাটা সামান্যই উঁচু।
সামনে ঢাকা বারান্দার মতো বা রিসেপশন বা লবির মতো। বাঁ-দিকে মা দুর্গার ষোলোভুজা মূর্তি আর ডান দিকে প্রলয়-নাচন নন্দী মহাদেব বা শংকরের মূর্তি। তার দু-পাশে ও পেছনে শয়নকক্ষ। দু-পাশের কক্ষ নীচুতে নামানো, প্রধান অংশের চেয়ে নীচুতে নামানো। বাইরে শিষ্য ও বিদ্যার্থীদের প্রকোষ্ঠ। তার পাশে প্রহরীদের প্রকোষ্ঠ। গভীর বনের মধ্যে বন্যপ্রাণী ছাড়াও ডাকাত ও তস্করের ভয়ও ছিল। সমস্ত গুম্ফাটাই হাজার স্কোয়ার ফিটের মধ্যে—যেন একটা মডার্ন ফ্ল্যাট।
সবই ভালো। কিন্তু কী করুণ দশা। যতি বলল।
সত্যি! আমাদের মতো আত্মবিস্তৃত জাতি বোধ হয় খুবই কম হয়। সব কিছু যে শুধু কালের প্রভাবেই নষ্ট হয়েছে তাই নয়, আমাদের অশিক্ষা ও অজ্ঞতাতেও নষ্ট হচ্ছে সব। এইসব গুম্ফা বা মন্দির ধ্বংসে ধর্মান্ধ বিধর্মীদের রোষের দরকার হয়নি, আমাদের অপার অশিক্ষাই যথেষ্ট হয়েছে—জোজো বলল, হতাশার সঙ্গে।
গুহা থেকে একটা বোঁটকা গন্ধ বেরোচ্ছে।
যতি বলল, বাঘের গায়ের গন্ধ?
জোজো বলল, না চামচিকের।
হেসে উঠল যতি—কীসের সঙ্গে কীসের তুলনা।
না, সত্যি। চামচিকের গায়ের গন্ধ এরকম অথচ কেন হয় তা কে জানে! বাদুড়-চামচিকে এরা তো ফলাহারী। গা দিয়ে মিষ্টি গন্ধ বেরোনো উচিত ছিল।
জোজো জানত না। ও যে-পথে এসেছে, সে-পথে গাড়োরিয়ার বাংলোতে যাওয়া যাবে না। সে-পথ ছেড়ে এসেছে অনেক পেছনে তা ছাড়া সেখান থেকে বহুদূরও।
কী করবে? চলো মারা ফরেস্ট বাংলোতেই বিশ্রাম নাও। চৌকিদার আমার চেনা।
আমাদের কিছু রেঁধে দেবে গরম গরম। কখনো-কখনো রেণুসাগর থেকে ট্রাকে করে মাছও চালান আসে। কপালে থাকলে টাটকা মাছভাজা, মুগের ডাল আর মাছের ঝোল খাওয়াব তোমাকে। তুমি একটু ফ্রেশও হয়ে নিতে পারবে বাথরুমে গিয়ে।
অত মাছ-টাছের দরকার নেই। চালে-ডালে খিচুড়ি করে দিতে বোলো, সঙ্গে ডিম-ভাজা থাকলে তো কথাই নেই, কি আলুভাজা।
চলো তো দেখা যাক। এই মারাতে একটা মস্ত হাট বসে। কবে তা মনে নেই। আজ বোধ হয় নয়, বসলে এতক্ষণে বোঝা যেত।
থাকো তো তুমি আর রামদীন। হাটে কী এমন কিনতে?
কেন? মাসিমার জন্য কিনতাম। যদি কেনার মতো পেতাম কিছু।
মারা বাংলোতে পৌঁছে ওরা বারান্দাতে চেয়ারে বসল। ছোট্ট বাংলো। পথ দিয়ে দেহাতি মানুষেরা আসছে-যাচ্ছে। বেশিই পায়ে হেঁটে, কেউ কেউ সাইকেলে। শরতের দুপুরের রোদ ঝকমক করছে গাছগাছালির পাতাতে। আকাশটা ঘন নীল। বাজপাখি উড়ছে চক্রাকারে মাথার ওপরে।
যতি বলল, ভালো লাগে না। আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে।
মানে? জোজো বলল।
মানে, আর ক-দিন? আর তো চার দিন আছি। তার পর দিনই ট্রেন ধরতে হবে। এদিকে পুজোর বেশি দেরি নেই। তুমি আসতে পারবে না পুজোর মধ্যে? একদিনের জন্যেও না? কোনোমতেই?
ইম্পসিবল। এখানে নতুন কনভেয়র বেল্ট চালু হবে। মিনিস্টার আসছেন দিল্লি থেকে। এম ডি-ও তো এখানেই আছেন।
তোমাদের হাই-ব্রাসের মধ্যে বাঙালি কেউ নেই?
আছেন তো। আগে তো এম ডিও বাঙালিই ছিলেন। উনি রিটায়ার করেছেন। এখন ফিন্যান্স ডিরেক্টর বাঙালি। দাসসাহেব। তাঁর বাড়িও কলকাতাতে কিন্তু তিনিও যেতে পারবেন না এবারের পুজোতে।
তার পর বলল, তোমাদের ক-দিন ছুটি? এম এন দস্তুর-এ?
আমি এখন কুলজিয়ানে জয়েন করেছি সে-খবরটা রাখো না?
সরি। জানতাম। মনে ছিল না।
সেখানেও চার দিন। তাও একটা রবিবার নষ্ট হল। আমি কি আর ছোটো খুকি? আমাদের আবার পুজো। তবুও নতুন শাড়ি পরি, সকালে স্নান করি, উপোস করি, অঞ্জলি দিই। নতুন তাঁতের শাড়ির গন্ধ, শ্যাম্পুর গন্ধ। পারফিউমের গন্ধে মনটা খুশি খুশি লাগে—যাঁদের ভালোবাসি, তাঁদের কথা মনে পড়ে যায়। বাবা-মা তো আছেই, দূর প্রবাসে থাকা গুড্ডুটার কথা মনে পড়ে, তোমার কথাও মনে পড়ে। আমার আর ভালো লাগে না।
জোজো বলল, এবার মাকে বলব, মাসিমাকে বলে তারিখ ঠিক করতে। আমার ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে। এই তো পুজো আসছে, যে-যার বউ কি গার্লফেণ্ডকে নিয়ে বেরোবে। একা একা ভীষণ ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স লাগে।
যতি হাসল। বলল, এতে ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের কী আছে? আর তো ক-টা দিনের ব্যাপার।
জোজো বলল, হবে নাকি এই মারা-র পাখিডাকা রোদ আর ছায়া ঝিলমিল বাংলোতে? তোমাকে তো আমি কোনো দিন নিরাবরণও দেখিনি। কিছু করা তো দূরের কথা!
যতি হাসল, বলল, এই যে, আস্ত আমি, পুরোটা আমি তো তোমারই। তোমারই জন্যে আমার সব। তুমি একদিন নিরাবরণ নিরাভরণ করে আমাকে দেখবে বলেই তো প্রথম কৈশোর থেকে অপেক্ষাতে আছি। কিন্তু আমরা শিক্ষিত, সংযমী, মূল্যবোধসম্পন্ন পরিবারের ছেলে-মেয়ে। এটুকু কষ্ট আর মাত্র ক-টা দিন আমাদের সহ্য করতেই হবে। আমার বুঝি কষ্ট নেই? সব কষ্ট কি তোমারই? ফুলশয্যার রাতে যা তুমি পাবে তা কি এই মারা বাংলোর কটকট শব্দ-করা কাঠের খাটে পাবে? আর ক-টা দিন ধৈর্য ধরো, প্লিজ—
ঠিক আছে—জোজো বলল, একটা সিগারেট ধরিয়ে।
যতির কথাই ফলল। মাছ-টাছ নয়, মুগের ডালের খিচুড়ি আর ডিমভাজা রাঁধছে চৌকিদার।
খাওয়া দাওয়ার পরে আধঘণ্টা ওরা বিশ্রাম নিল। জোজো বসে থাকল বারান্দার ইজিচেয়ারে,যতি গিয়ে বিছানাতে একটু হাত-পা ছড়াল।
বিশ্রামের পরে চৌকিদার চা-ও করে দিল। চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ল জোজো তার হবু বউকে নিয়ে। বিয়ে হয়ে গেলেই, ফোড়া ফেটে যাওয়ার মতো। যতদিন-না বিয়ে হচ্ছে, পাকা ফোড়াতে আঙুল বোলাবার মতো এক দারুণ সুখানুভূতি এখন দুজনেরই। এই অনুভূতির কথা যারা জানে, তারা জানে।
রোদের তেজ এখন নেই। শরতের স্নিগ্ধ উজ্জ্বল বিকেল—বনপথের মধ্যে দিয়ে গন্ধে জর্জর হাওয়াতে ভেসে চলেছে দুজনে। বেশ তাড়াতাড়িই এল অনেকখানি পথ। এত তাড়াতাড়ি আসবে ভাবেনি। যে-কোনা জায়গাতে যাওয়ার সময়ে সময় বেশি লাগেই। সাবধানে, পথ চিনে, অনেক সময় জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করেও যেতে হয়, তাই সময় বেশি লাগে। ফেরার সময় সেই সময়টা বেঁচে যায়।
ভূতালির কাছে সেই রাস্তার মেরামতির জায়গাতে গতি কমাতে হল। সাবধানে চালাচ্ছে এখানে জোজো। মেরামতি করা পথের প্রায় মাঝামাঝি চলে এসেছে। এমন সময় হঠাৎ একটা নালাতে পড়ে বাইকটা লাফিয়ে উঠল। একটা নালা কেটেছে মজুরেরা। যাওয়ার সময়ে নালাটা ছিল না। যতি ছিটকে গেল পেছন থেকে। তার পর পড়ল গিয়ে পথের ওপরে। তার মাথাটা লাগল গিয়ে একটা গোল বড়ো পাথরে। শাড়ি পরে থাকলে শাড়ি উঠে যেত কিন্তু জিনস পরে ছিল বলে সে-ঝামেলা কিছু হল না। একবার শুধু ‘উঃ’ শব্দ করেছিল যতি, তার পর আর শব্দ করেনি কোনো।
ওদের পেছনে পেছনে নর্দার্ন কোলফিল্ডস-এর একটা ট্রাক আসছিল। ট্রাকটা দাঁড়িয়ে পড়ল। তার পর লেবারারাই জোজোর বাইকটাকে ধরাধরি করে ট্রাকে তুলে যতিকেও তুলল জোজোর সঙ্গে। যতির দু-নাকের মধ্যে দিয়ে রক্তের ধারা বেরিয়ে এল চোখের জলের মতো। কষ বেয়ে থুতনির কাছে এসে থেমে গেল সামান্য রক্ত।
জোজো ডাকল, যতি! যতি!
যতি উত্তর দিল না। জোজোর যেন মনে হল, দিল।
ট্রাকের ড্রাইভার বলল, সিধা হাসপাতাল যা রহা হ্যায় সাব। এমার্জেন্সি।
হ্যাঁ ভাই—বলল জোজো।
মুহূর্তের মধ্যে কত কী ভাবনা মাথাতে ধেয়ে এল জোজোর। যতির মা-বাবার মুখ, নিজের মা-বাবার মুখ, যতির কাজিন হাসিনীর মুখ, ওর পরিচারক রামদীনের মুখ। রামদীন বলেছিল, কিসিসে মাং কর ইকঠো হেলমেট লে লিজিয়ে বাবু, বেগর হেলমেট ইতনা দূর যানা ঠিক নেহি হ্যায়।
হাসপাতালে এমার্জেন্সিতে যখন পৌঁছোল তখন দেখল জোজোর বন্ধু ডা. হরিশ গোয়েল ডিউটিতে আছে। বেডে শুইয়ে গোয়েল তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করল। তারপর জোজোর দিকে ফিরে রুক্ষ গলাতে বলল, হেলমেট নেহি থা?
জোজো অপরাধীর মতো মাথা নাড়ল।
ইউ আর রাসকেল ইয়ার। ইউ মার্ডাড দ্য ইয়ং লেডি।
জোজোর বুকের মধ্যে থেকে একটা চাপা বমির মতো ঠেলে উঠছিল।
গোয়েল বলল, তুম ঘর যাও। সামবডি উইল ড্রপ ইউ ইন মাই কার। পুলিশ কেস হোগা, পোস্টমর্টেম হোগা, উনকি রিলেশানসকো খবর দো।
গোয়েলের গাড়ি করে যখন জোজো যতির পিসিমার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল, তখন দেখল যে-বাড়িতে—কর্নার প্লটে যতি নানা-রঙা বোগোনভোলিয়া লাগাবে বলেছিল, তার সন্তান যে-লনে খেলবে ভেবেছিল, যেখানে সাদা মারুতি এইট হান্ড্রেড থাকবে ভেবেছিল সেই বাড়িটা পেরিয়ে গেল।
শরতের বিকেলের রোদে বাড়িটা ঝলমল করছিল।