সাধনবাবুর সন্দেহ
সাধনবাবু একদিন সন্ধ্যাবেলা কাজ থেকে ফিরে তাঁর ঘরে ঢুকে দেখলেন মেঝেতে একটা বিঘতখানেক লম্বা সরু গাছের ডাল পড়ে আছে। সাধনবাবু পিটপিটে স্বভাবের মানুষ। ঘরে যা সামান্য আসবাবু আছে—খাট, আলমারি, আলনা, জলের কুঁজো রাখার টুল—তার কোনটাতে এক কণা ধুলো তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, ফুলকারি করা টেবিল ক্লথ—সবই তক্তকে হওয়া চাই। এতে ধোপার খরচটা বাড়ে, কিন্তু সেটা সাধনবাবু গা করেন না। আজ ঘরে ঢুকেই গাছের ডাল দেখে তাঁর নাক কুঁচকে গেল।
‘পচা!’
চাকর পচা মনিবের ডাকে এসে হাজির।
‘বাবু, ডাকছিলেন?’
‘কেন, তোর কি সন্দেহ হচ্ছে?’
‘না বাবু, তা হবে কেন?’
‘মেঝেতে গাছের ডাল পড়ে কেন?’
‘তা তো জানি না বাবু। কাক-চড়ুইয়ে এনে ফেলেছে বোধহয়।’
‘কেন, ফেলবে কেন? কাক-চড়ুই ত ডাল আনবে বাসা বাঁধার জন্য। সে ডাল মাটিতে ফেলবে কেন? ঝাড়ু দেবার সময় লক্ষ করিসনি এটা? নাকি ঝাড়ুই দিসনি?’
‘ঝাড়ু আমি রোজ দিই বাবু। যখন দিই তখন এ-ডাল ছিল না।’
‘ঠিক বলছিস?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, বাবু।’
‘তাজ্জব ব্যাপার তো!’
পরদিন সকালে আপিস যাবার আগে একটা চড়ুইকে তাঁর জানালায় বসতে দেখে সাধনবাবুর সন্দেহ হল ইনিই বাসা বাঁধার ফিকির খুঁজছেন। কিন্তু কোথায়? ঘরের মধ্যে জায়গা কোথায়? ঘুলঘুলিতে কি? তাই হবে।
তিনতলা ফ্ল্যাটবাড়ির সাতখানা ঘরের মধ্যে তাঁর ঘরের দিকেই চড়ুই-এর দৃষ্টি কেন এই নিয়েও সাধনবাবুর মনে খট্কা লাগল। এমন কিছু আছে কি তাঁর ঘরে যা পাখিদের অ্যাট্রাক্ট করতে পারে?
অনেক ভেবে সাধনবাবুর সন্দেহ হল—ওই যে নতুন কবরেজী তেলটা তিনি ব্যবহার করছেন—যেটা দোতলার শখের কবিরাজ নীলমণিবাবুর মতে খুস্কির মহৌষধ—সেটার উগ্র গন্ধই হয়ত পাখিদের টেনে আনছে। সেই সঙ্গে এমনও সন্দেহ হল যে এটা হয়ত নীলমণিবাবুর ফিচলেমি, সাধনবাবুর ঘরটাকে একটা পক্ষিনিবাসে পরিণত করার মতলবে তিনি এই তেলের গুণগান করছেন।…
আসলে সতেরর-দুই মির্জাপুর স্ট্রীটের এই ফ্ল্যাটবাড়ির সকলেই সাধনবাবুর সন্দেহ বাতিকের কথা জানেন, এবং আড়ালে এই নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন। আজ কী কী সন্দেহের উদয় হল আপনার মনে?’—এ জাতীয় প্রশ্ন দিনের শেষে সাধনবাবুকে প্রায়ই শুনতে হয়।
শুধু প্রশ্ন নয়, অন্যভাবেও তাঁকে নিয়ে লেগ-পুলিং চলে। একতলার নবেন্দু চাটুজ্যের ঘরে সন্ধ্যায় তিন-তাসের আড্ডা বসে। সাধনবাবু তাতে নিয়মিত যোগদান করেন। সেদিন যেতে নবেন্দুবাবু তাঁকে একটা দলা পাকানো কাগজ দেখিয়ে বললেন, ‘দেখুন ত মশাই, এ থেকে কিছু সন্দেহ হয় কিনা। এটা জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে গেছে।’
আসলে কাগজটা নবেন্দুবাবুরই মেয়ে মিনির অঙ্কের খাতার একটা ছেঁড়া পাতা। সাধনবাবু কাগজটাকে খুলে সেটার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বললেন, ‘এটা তো সংখ্যা দিয়ে লেখা কোনো সাংকেতিক ভাষা বলে মনে হচ্ছে।’
নবেন্দবাবু কিছু না বলে চুপটি করে চেয়ে রইলেন সাধনবাবুর দিকে।
‘কিন্তু এটার তো মনে করা দরকার’, বললেন সাধনবাবু। ‘ধরুন এটা যদি কোনো হুমকি হয়, তাহলে…’
সংকেতের পাঠোদ্ধার হয়নি অবশ্য। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়; কথা হল, এই কাগজের দলা থেকে সাধনবাবুর সন্দেহ কোন কোন দিকে যেতে পারে সেইটে দেখা। সাধনবাবু বিশ্বাস করেন যে গোটা কলকাতা শহরটাই হল ঠক জুয়াচোর ফন্দিবাজ মিথ্যেবাদীর ডিপো। কারুর উপর ভরসা নেই, কাউকে বিশ্বাস করা চলে না। এই অবস্থায় একমাত্র সন্দেহই মানুষকে সামলে চলতে সাহায্য করতে পারে।
এই সাধনবাবুই একদিন আপিস থেকে এসে ঘরে ঢুকে তাঁর টেবিলের উপর একটা বেশ বড় চার-চৌকো কাগজের মোড়ক দেখতে পেলেন। তাঁর প্রথমেই সন্দেহ হল সেটা ভুল করে তাঁর ঘরে চলে এসেছে। এহেন মোড়ক তাঁকে কে পাঠাবে? তিনি ত এমন কোনো পার্সেল প্রত্যাশা করেননি!
কাছে গিয়ে যখন দেখলেন যে মোড়কের উপর তাঁর নাম নেই, তখন সন্দেহটা আরো পাকা হল।
‘এটা কে এনে রাখল রে?’ চাকর পচাকে ডেকে জিগ্যেস করলেন সাধনবাবু।
‘আজ্ঞে একজন লোক ধনঞ্জয়ের হাতে দিয়ে গেছে দুপুরে এসে। আপনার নাম করে বলেছে আপনারই জিনিস।’
ধনঞ্জয় একতলার ষোড়শীবাবুর চাকর।
‘কী আছে এতে, কে পাঠিয়েছে, সে সব কিছু বলেছে?’
‘আজ্ঞে তা ত বলেনি।’
‘বোঝো!’
সাধনবাবু কাঁধের চাদরটা আলনায় রেখে খাটে বসলেন। রীতিমতো বড় মোড়ক। প্রায় একটা পাঁচ নম্বর ফটবল ঢুকে যায় ভিতরে। অথচ কে পাঠিয়েছে জানার কোনো উপায় নেই।
সাধনবাবু খাট থেকে উঠে এগিয়ে গিয়ে মোড়কটা হাতে তুললেন। বেশ ভারী। কমপক্ষে পাঁচ কিলো।
সাধনবাবু মনে করতে চেষ্টা করলেন শেষ কবে তিনি এই জাতীয় মোড়ক পেয়েছেন। হ্যাঁ, বছর তিনেক আগে খড়দায় তাঁর এক মাসীমা থাকতেন, তিনি পাঠিয়েছিলেন আমসত্ত্ব। তার মাস ছয়েকের মধ্যেই সেই মাসীমার মৃত্যু হয়। আজ সাধনবাবুর নিকট আত্মীয় বলতে আর কেউই অবশিষ্ট নেই। পার্সেল কেন, চিঠিও তিনি মাসে দু-একটার বেশি পান না। এই মোড়কের সঙ্গে একটা চিঠি থাকা অস্বাভাবিক হত না, কিন্তু তাও নেই।
কিম্বা হয়ত ছিল। সাধনবাবুর সন্দেহ হল ধনঞ্জয়ের অসাবধানতা হেতু সেটি খোয়া গেছে।
একবার ধনঞ্জয়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
তাকে ডেকে পাঠানো অনুচিত হবে মনে করে সাধনবাবু নিজেই নিচে গেলেন। ধনঞ্জয় উঠোনে বসে হামানদিস্তায় কী যেন ছেঁচছিল, সাধনবাবুর ডাকে উঠে এল।
‘ইয়ে, আজ তোমার হাতে কেউ একটা পার্সেল দিয়ে গেস্ল আমার নাম করে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘সঙ্গে চিঠি ছিল?’
‘কই না ত।’
‘কোত্থেকে আসছে সেটা বলেছিল?’
‘মদন না কী জানি একটা নাম বললেন।’
‘মদন?’
‘তাইত বললেন।’
মদন নামে কাউকে চেনেন বলে মনে করতে পারলেন না সাধনবাবু। কী বলতে কী বলছে লোকটা কে জানে। ধনঞ্জয় যে একটি গবেট সে সন্দেহ অনেকদিনই করেছেন সাধনবাবু।
‘চিঠিপত্তর কাগজটাগজ কিছু, ছিল না সঙ্গে?’
‘একটা কাগজ ছিল, তাতে বাবু সই করে দিলেন।’
‘কে, ষোড়শীবাবু?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
কিন্তু ষোড়শীবাবুকে জিগ্যেস করেও কোনো ফল হল না। একটা চিরকুটে তিনি সাধনবাবুর হয়ে সই করে দিয়েছেন বটে, কিন্তু সেটা কোথা থেকে এসেছিল খেয়াল করেননি।
সাধনবাবু, আবার নিজের ঘরে ফিরে এলেন। কার্তিক মাসের সন্ধ্যা, শীতটা এর মধ্যে বেশ অনুভব করা যাচ্ছে। সামনে কালীপুজো, তার তোড়জোড় যে চলছে সেটা মাঝে মাঝে বোমা-পটকার—
‘দুম্!’
পাড়াতেই একটা বোমা ফেটেছে। আর সেই মুহূর্তে খাটে বসা সাধনবাবুর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল।
টাইম-বোমা!
ওই মোড়কের মধ্যে টাইম-বোমা নেই ত, যেটা নির্দিষ্ট সময়ে ফেটে তাঁর ইহজগতের লীলা সাঙ্গ করে দেবে?
এই টাইম-বোমার কথা ইদানীং খুব শোনা যাচ্ছে। সারা বিশ্বের সন্ত্রাসবাদীদের এটা একটা প্রধান অস্ত্র।
কিন্তু তাঁকে বোমা পাঠাবে কে, কেন?
প্রশ্নটা মনে আসতেই সাধনবাবু উপলদ্ধি করলেন যে ব্যবসায়ী হওয়ার ফলে তাঁর শত্রুর অভাব নেই। কনট্রাক্ট পাবার জন্য তোষামোদ ধরাধরি তাঁকেও করতে হয়, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীদেরও করতে হয়। যদি তিনি পেয়ে যান সে কনট্রাক্ট, তাহলে অন্যেরা হয়ে যায় তাঁর শত্রু। এ তো হামেশাই হচ্ছে।
‘পচা!’
ডাকটা দিয়েই বুঝতে পারলেন যে তাঁর গলা দিয়ে পরিষ্কার আওয়াজ বেরোচ্ছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
কিন্তু তাও পচা হাজির।
‘বাবু, ডাকলেন?’
‘ইয়ে—’
কিন্তু কাজটা কি ভালো হবে? সাধনবাবু ভেবেছিলেন পচাকে বলবেন পার্সেলে কান লাগিয়ে দেখতে টিক্টিক্ শব্দ শোনা যাচ্ছে কিনা। টাইম-বোমার সঙ্গে কলকব্জা লাগানো থাকে, সেটা টিক্টিক্ শব্দে চলে। সেই টিক্টিক্-ই একটা পূর্বনির্ধারিত বিশেষ মুহূর্তে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে পরিণত হয়।
পচা যখন কান লাগাবে, তখনই যদি বোমাটা—
সাধনবাবু আর ভাবতে পারলেন না। এদিকে পচা বাবুর আদেশের জন্য দাঁড়িয়ে আছে; সাধনবাবুকে বলতেই হল যে তিনি ভুল করে ডেকেছিলেন, তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই।
এই রাতটা সাধনবাবু ভুলবেন না কোনোদিন। অসুখ বিসুখে রাত্রে ঘুম হয় না এটা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু চরম আতঙ্কে এই শীতকালে ঘর্মাক্ত অবস্থায় সারারাত ঠায় বিছানায় বসে কাটানোর অভিজ্ঞতা তাঁর এই প্রথম।
কিন্তু সকাল পর্যন্ত যখন বোমা ফাটল না, তখন কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে সাধনবাবু স্থির করলেন যে আজই সন্ধ্যায় মোড়কটা খুলে দেখতে হবে তার মধ্যে কী আছে। তাঁর নিজেরও মনে হয়েছে যে তাঁর সন্দেহটা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সন্ধ্যাবেলা এমন একটা ঘটনা ঘটল যে সাধনবাবুর আর মোড়ক খোলা হল না।
অনেক লোক আছে যারা খবরের কাগজের আদ্যোপান্ত না পড়ে পারে না। সাধনবাবু এই দলে পড়েন না। প্রথম এবং মাঝের পাতার খবরগুলোর শিরোনামায় চোখ বুলিয়েই তাঁর কাগজ পড়া হয়ে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাই উত্তর কলকাতায় খুনের খবরটা তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। আপিস থেকে ফিরে একতলায় নবেন্দু চাটুজ্যের ঘরে একটা বড় রকম দাপাদাপি চলছে শুনে কারণ জিগ্যেস করে তিনি ঘটনাটা জানতে পারলেন।
পটুয়াটোলা লেনে খুন, হত ব্যক্তির নাম শিবদাস মৌলিক। কথাটা শুনেই সাধনবাবুর একটা সুপ্ত স্মৃতি খোঁচা খেয়ে জেগে উঠল।
এক মৌলিককে তিনি চিনতেন খুব ভালো করে। তার প্রথম নাম শিবদাস কি? হতেও পারে। সাধনবাবু তখন থাকতেন ওই পটুয়াটোলা লেনেই। মৌলিক ছিল তাঁর প্রতিবেশী। তিন-তাসের আড্ডা বসত মৌলিকের ঘরে রোজ সন্ধ্যায়। মৌলিককে কেন জানি মৌলিক বলেই ডাকত সবাই। আরো দুজন ছিলেন আড্ডায়। সুখেন দত্ত আর মধুসূদন মাইতি। এই দ্বিতীয় ব্যক্তিটির মতো সাংঘাতিক চরিত্র সাধনবাবু আর দেখেননি। তাসের খেলায় সে যে জুয়াচুরির রাজা সে সন্দেহ সাধনবাবুর গোড়া থেকেই হয়েছিল। শেষে বাধ্য হয়ে একদিন সন্দেহটা প্রকাশ করতে হল। এতে মধু মাইতির প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ভয়াবহ। তার পকেটে সব সময়ই যে একটি চাকু অবস্থান করে সেটা সেদিনই জানতে পেরে ছিলেন সাধনবাবু। তিনি প্রাণে বেঁচেছিলেন মৌলিক আর সুখেন দত্তর জন্য। ব্যবসায় উন্নতির পর সাধনবাবু পটুয়াটোলা লেনের খোলার ঘর ছেড়ে চলে আসেন মির্জাপুর স্ট্রীটের এই ফ্ল্যাটে। আর সেই থেকেই মৌলিক এণ্ড কোম্পানির সঙ্গে তাঁর যোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাসের নেশাটা তিনি ছাড়াতে পারেননি, আর সেই সঙ্গে তাঁর সন্দেহ বাতিকটাও। কিন্তু অন্য দিক দিয়ে পরিবর্তন হয়েছিল বিস্তর। পোশাকে পারিপাট্য, বিড়ি ছেড়ে উইল্স সিগারেট ধরা, নীলামের দোকান থেকে মাঝে মাঝে শখের জিনিস কিনে এনে ঘর সাজানো—পেন্টিং, ফুলদানি, বাহারের অ্যাশট্রে—এ সবই গত পাঁচ-সাত বছরের ঘটনা।
এই খুনের ঘটনার শিবদাস মৌলিক যদি সেই মৌলিক হয়, তাহলে খুনী যে মধু মাইতি সে বিষয়ে সাধনবাবুর কোনো সন্দেহ নেই।
‘খুনটা কী ভাবে হল?’ সাধনবাবু জিগ্যেস করলেন।
‘নৃশংস,’ বললেন নবেন্দু চাটুজ্যে। ‘লাশ সনাক্ত করার কোনো উপায় ছিল না। পকেটে একটা ডায়রি থেকে নাম জেনেছে।’
‘কেন, কেন? সনাক্ত করার উপায় ছিল না কেন?’
‘ধড় আছে, মুড়ো নেই। সনাক্ত করবে কি করে?’
‘মুড়ো নেই মানে?’
‘মুণ্ডু ঘ্যাচাং!’ জোড়া হাত মাথার উপর তুলে আবার ঝটিতি নামিয়ে এনে খাঁড়ার কোপের অভিনয় করে বুঝিয়ে দিলেন নবেন্দু চাটুজ্যে। ‘খুনী যে কোথায় সরিয়ে রেখেছে মুণ্ডু সেটা এখনো জানা যায়নি।’
‘খুনী কে সেটা জানা গেছে?’
‘তিন-তাসের বৈঠক বসত এই মৌলিকের ঘরে। তাদেরই একজন বলে সন্দেহ করছে পুলিশ।’
সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠতে উঠতে সাধনবাবু অনুভব করলেন যে তাঁর মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সেদিনের ঘটনা চোখের সামনে জলজ্যান্ত দেখতে পাচ্ছেন তিনি—যেদিন তিনি মধু মাইতিকে জোচ্চুরির অপবাদ দিয়েছিলেন। চাকুর আক্রমণ থেকে তিনি রেহাই পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার বেশ কিছুক্ষণ পর অবধি মধু মাইতির দৃষ্টি তাঁর উপর অগ্নিবর্ষণ করেছিল সেটা মনে আছে। আর মনে আছে মধুর একটি উক্তি—‘আমায় চেন না তুমি, সাধন মজুমদার!—আজ পার পেলে, কিন্তু এর বদলা আমি নোব, সে আজই হোক, আর দশ বছর পরেই হোক।
রক্ত-জল-করা শাসানি। সাধনবাবু ভেবেছিলেন পটুয়াটোলা লেন থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন, কিন্তু—
কিন্তু ওই মোড়ক যদি মধু মাইতি দিয়ে গিয়ে থাকে? মদন!—ধনঞ্জয় বলেছিল মদন। ধনঞ্জয় যে কানে খাটো সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই। মধু আর মদনে খুব বেশি পার্থক্য আছে কি? মোটেই না। মধু অথবা মধুর লোকই রেখে গেছে ওই পার্সেল, আর সেটা যাতে সত্যিই তাঁর হাতে পৌঁছায় তাই চিরকুটে সই করিয়ে নিয়েছে।
ওই মোড়কের ভিতরে রয়েছে শিবদাস মৌলিকের মাথা!
এই সন্দেহ সিঁড়ির মাথা থেকে তাঁর ঘরের দরজার দুরত্বটুকু পেরোবার মধ্যে দৃঢ় ভাবে সাধনবাবুর মনে গেঁথে গেল। দরজা থেকেই দেখা যায় টেবিলের উপর ফলদানিটার পাশে রাখা মোড়কটাকে। মোড়কের ওজন এবং আয়তন দুইই এখন স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিচ্ছে তার ভিতরে কী আছে।
বাবু দোরগোড়ায় এসে থেমে গেছেন দেখে পচা কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখছিল; সাধনবাবু প্রচণ্ড মনের জোর প্রয়োগ করে বিহ্বল ভাবটা কাটিয়ে চাকরকে চা আনতে বললেন।
‘আর, ইয়ে, আজ কেউ এসেছিল? আমার খোঁজ করতে?’
‘কই না ত।’
‘হুঁ।’
সাধনবাবু, অবশ্য সন্দেহ করেছিলেন পুলিশ হয়ত এরই মধ্যে হানা দিয়ে গেছে। তাঁর ঘরে খুন হওয়া ব্যক্তির মুণ্ডু পেলে তাঁর যে কী দশা হবে সেটা ভাবতে তাঁর আরেক দফা ঘাম ছুটে গেল।
গরম চা পেটে পড়তে সামান্য বল যেন ফিরে এল মনে। যাক্—অন্তত টাইম বোমা ত নয়।
কিন্তু এও ঠিক যে এই মুণ্ডুসমেত মোড়কটিকে সামনে রেখে যদি তাঁকে সারা রাত জেগে বসে থাকতে হয় তাহলে তিনি পাগল হয়ে যাবেন।
ঘুমের বড়িতে ঘুম হল ঠিকই, কিন্তু দুঃস্বপ্ন থেকে রেহাই পাওয়া গেল না। একবার দেখলেন মুণ্ডুহীন মৌলিকের সঙ্গে বসে তিন-তাস খেলছেন তিনি, আরেকবার দেখলেন মৌলিকের ধড়বিহীন মুণ্ডু তাঁকে এসে বলছে, ‘দাদা,—ওই বাক্সে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে। দয়া করে মুক্তি দিন আমায়।’
বড়ি খাওয়া সত্ত্বেও চিরকালের অভ্যাস মতো সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেল সাধনবাবুর। হয়ত ব্রাহ্ম মুহূর্তের গুণেই সংকট মোচনের একটা উপায় সাধনবাবুর মনে উদিত হল।
মুণ্ডু যখন তাঁর কাছে পাচার করা হয়েছে, তখন সে-মুণ্ডু অন্যত্র চালান দিতে বাধাটা কোথায়? তাঁর ঘর থেকে জিনিসটাকে বিদায় করতে পারলেই ত নিশ্চিন্তি।
ভোর থাকতেই অন্য কাজ সারার আগে বাজারের থলিতে মোড়কটা ভরে নিয়ে সাধনবাবু বেরিয়ে পড়লেন। প্যাকিংটা ভালোই হয়েছে বলতে হবে, কারণ ভিতরে রক্ত চুঁইয়ে থাকলেও তার বিন্দুমাত্র বাক্স ভেদ করে বাইরের কাগজে ছোপ ফেলেনি।
বাসে উঠে কালীঘাট পৌঁছাতে লাগল পঁচিশ মিনিট। তারপর পায়ে হেঁটে আদিগঙ্গায় পৌঁছে একটি অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি জায়গা বেছে নিয়ে হাতের মোড়কটাকে সবেগে ছুঁড়ে ফেললেন নদীর মাঝখানে।
ঝপাৎ —ডুবুস্!
মোড়ক নিশ্চিহ্ন, সাধনবাবু নিশ্চিন্ত।
বাড়ি ফিরতে লাগল পঁয়ত্রিশ মিনিট। সদর দরজা দিয়ে যখন ঢুকছেন তিনি, তখন ষোড়শীবাবুর দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে সাতটা বাজছে।
আর সেই ঘড়ির শব্দ শুনেই সাধনবাবু মুহূর্তে চোখে অন্ধকার দেখলেন।
একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেছে তাঁর। কদিন থেকেই বার বার সন্দেহ হয়েছে তিনি যেন কী একটা ভুলে যাচ্ছেন। পঞ্চাশের পর এ জিনিসটা হয়। একথা নীলমণিবাবুকে বলতে তিনি নিয়মিত ব্রাহ্মীশাক খেতে বলেছিলেন।
আজ আধ ঘণ্টা আগেই বেরিয়ে পড়তে হল সাধনবাবুকে, কারণ যাবার পথে একটা কাজ সেরে যেতে হবে।
রাসেল স্ট্রীটে নীলামের দোকান মডার্ন এক্সচেঞ্জে ঢুকতেই একগাল হেসে এগিয়ে এলেন মালিক তুলসীবাবু।
‘টেবিল ক্লকটা চলছে ত?’
‘ওটা পাঠিয়েছিলেন আপনি?’
‘বা রে, আমি ত বলেইছিলাম পাঠিয়ে দেব। সেটা পৌঁছায়নি আপনার হাতে?’
‘হ্যাঁ, মানে, ইয়ে—’
‘আপনি পাঁচশো টাকা আগাম দিয়ে গেলেন, এত পছন্দ আপনার, আপনি পুরোন খদ্দের—কথা দিয়ে কথা রাখব না?’
‘তা তো বটেই, তা তো বটেই—’
‘দেখবেন ফার্স্ট ক্লাস টাইম রাখবে ও ঘড়ি। নামকরা ফরাসী কোম্পানি তো! জিনিসটা জলের দরে পেয়ে গেছেন। ভেরি লাকি!’
তুলসীবাবু, অন্য খদ্দেরের দিকে এগিয়ে যেতে সাধনবাবু দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন। জলের দরের ঘড়ি জলেই গেল!
ভালো বদলা নিয়েছে মধু মাইতি তাতে সন্দেহ নেই। আর ‘মডার্ন’কেই যে ‘মদন’ শুনেছে ধনঞ্জয় তাতেও কোনো সন্দেহ আছে কি?