সাধক বড়মামা
জানি না, যাচ্ছি কোথায়! গাড়ি সাঁই সাঁই ছুটছে। সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে আছেন জগন্নাথবাবু। মনে হয় কোনও ভগ্নপ্রসাদ দেখতে যাওয়া হচ্ছে। দিনটা খুব ব্রাইট। চাঁপাফুলের মতো শেষ দুপুরের রোদ। আমরা বড় রাস্তা থেকে বাঁ দিকের একটা ছোট রাস্তায় ঢুকলুম। বেশ বুঝতে পারছি, রাস্তাটা ঢালু হতে হতে ক্রমশই নীচের দিকে নামছে। লোকালয় কমে আসছে। এ-পাশে, ও-পাশে একটা দুটো নির্জন বাগান বাড়ি। কেউ থাকে না। অতীত লেগে আছে শ্যাওলার গায়ে। একটা বাড়ির একেবারে ওপরের ছাদের আলসেতে জরাজীর্ণ একটা কাশ্মীরী কার্পেট ঝুলছে। কে কবে রোদে দিয়ে চলে গেছে। সে আর ফিরে আসেনি।
জগন্নাথকাকু বললেন, এসব লিটিগেটেডে প্রপার্টি। কেসে ফেঁসে আছে। কত খুনখারাবি! ভাই ভাইয়ের বুকে গুলি হাঁকড়ে দিলে। ছেলে বাপের মাতায় শাবল চালিয়ে দিলে। স্ত্রী স্বামীকে বিষ খাইয়ে দিলে। একেই বলে বিষয় বিষ! এইসব ভালো, ভালো প্রপার্টি পড়েই থাকবে। মামলা করতে করতে মরে যাবে, মামলাটা কিন্তু বেঁচে থাকবে।
রাস্তাটা শেষ হয়ে গেল হঠাৎ। বেশ সুন্দর একটা মাঠ। একেবারে নির্জন। অনেকটা নীচে গঙ্গা একা একা বইছে। একঝাঁক শালিক পাখি মহা কলরবে চান করছে। কত কথা। মাঝে মাঝে জেট-প্লেনের মতো টিয়ার ঝাঁক তীব্রবেগে উড়ে যাচ্ছে।
বাঁ দিকে বাড়িটা। বেশ বোঝা যায়, তৈরি হয়েছিল বিলিতি প্ল্যানে। মাথার ওপরে গম্বুজটা একপাশে কাত। যতদূর মনে হয় ঝড়ের কাজ। বিশাল গেট কোনও সময় ছিল। এখন আর নেই। দাঁড়িয়ে আছে দুটো ভাঙা পিলার। মাঠের ওপর অস্পষ্ট একজোড়া রেল লাইন। জায়গায় জায়গায় আছে, জায়গায় জায়গায় নেই।
জগন্নাথকাকু বললেন, রেল লাইন নয়, কামানের লাইন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বাড়িটা হয়েছিল মিলিটারি বেস। গঙ্গার ধারে কামান বসিয়েছিল।
একসময় মোরাম বিছানো, কেয়ারি করা সুন্দর একটা পথ ছিল বোঝা যায়। এখন কিছুই নেই। শুধু আগাছা। দু’পাশে বাগান ছিল। ফোয়ারা ছিল। ভালো, ভালো স্ট্যাচু ছিল। সে-সব চুরি হয়ে গেছে। পড়ে আছে ভাঙা বেদি। মার্বেল সব খুলে নিয়ে গেছে। বুনো লতা, ঝুপড়ি গাছ, ঝরা পাতা। কেমন কেন ধোঁয়া ধোঁয়া, রহস্যময়। ঝোপের মধ্যে বিশাল বড় একটা কুবো পাখি ডাকছে। নিলামের হাতুড়ির শব্দের মতো।
আমার ভীষণ ভয় করছে। বড়মামার খুব আনন্দ। জগন্নাথকাকুকে বললেন, একটা রাত কাটালে কেমন হয়!
দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়িটা কাঠ বলেই টিকে আছে। রেলিং ভেঙে পড়ে আছে, কাত হয়ে এক পাশে। ক্যানভাসে আঁকা একটা অয়েল পেন্টিং বেঁকে ঝুলছে। ছবিটা কী বোঝার উপায় নেই।
সিঁড়িতে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ। ভেঙে না পড়ে! দোতলায় বিশাল একটা হলঘর। ঢুকেই চমকে উঠেছি। একেবারে নতুন একটা সোফা। সব পুরনো রঝরঝরে, সোফাটা নতুন। বাদামি রং। নিখুঁত সাহেবি পোশাক পরে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। একেবারে বনেদি চেহারা। আমরা বিব্রত। বিনা অনুমতিতে এসে পড়েছি। বড়মামা তাঁর সেই ভুবন ভোলানো বিখ্যাত হাসি হেসে বললেন, একসকিউজ মি স্যার!
কেউ নেই। সোফা একটা রয়েছে। সত্তর বছরের পুরনো। সবভাঙা। সাত পুরু ধুলো, ঝুল। কোথায় সেই সাহেব? আমরা তিনজনে প্রায় জড়াজড়ি। কিছু বলার চেষ্টা করছি। শব্দ বেরোচ্ছে না। গঙ্গার দিক থেকে অকারণে উন্মাদ একটা ঝটকা বাতাস এল। ধোঁয়ার মতো ধুলো উড়ল। কোথাও অদ্ভুত একটা শব্দ হল—ক্যাঁচ।
পরক্ষণেই আমরা বাইরে। গঙ্গার ওপারে সূর্য অস্ত নামছে। চারপাশ লাল লাল। রোজই হয় তো এই ভাবেই সূর্য অস্ত যায়, আমার মনে হল, কেমন যেন! আকাশে আগুন লেগে গেছে। কোথাও একটু বসা দরকার। গঙ্গার ধারের মাঠে একটা কালো কুকুর ঘুরছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, কালো কুকুর কেন!
আমরা বসলুম। বড়মামা বললেন, তিনজনেই দেখলুম। দেখাটা মিথ্যে নয়। আমি ভূত, প্রেত, ব্রহ্মদৈত্য বিশ্বাস করি না। রাত হলে কথা ছিল না, দুপুর বেলা ভূত!
জগন্নাথবাবু বললেন, কোনও মানুষকে বলা যাবে না। বলবে, গাঁজা খেয়েছে।
একটা নৌকো ভিড়ল। ঢালু পাড়ে বেয়ে মধ্যবয়সি একজন মানুষ অক্লেশে উঠে এলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কোথা থেকে?
বড়মামা পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনি কি এখানে থাকেন?
থাকি না, রোজ আসি।
ওই গম্বুজ বাড়িটা সম্পর্কে কিছু জানেন?
ওখানে শেষ যিনি ছিলেন, তাঁর নাম ব্যারিস্টার বি. মিত্র। পাককা সাহেব। চাকরের হাতে খুন হয়েছিলেন। এখনো তিনি আছেন ওই বাড়িতে।
আপনি কি করেন?
আমি সিকিউরিটির লোক। ওই দিকের একটা বাড়িতে এক বৃদ্ধ থাকেন, আমি সারা রাত পাহারা দি।
বাঃ বাঃ খুব ভালো কাজ। আপনি বলশালী। —বড়মামা বললেন।
একটা কোমরের কাছ থেকে একটা রিভলবার বের করে বললেন, এই আমার বল।
বড়মামা বললেন, কটা মরেছে?
একটাও না। মানুষ মারা অত সহজ নয়।
লোকটি হন হন করে পুব দিকে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ বসে থেকে আমরাও গাড়িতে উঠলুম। বিরাট বড় সূর্য পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে। মেটে সিঁদুরের মতো রঙ। গাড়ি খুব ধীরে চলছে। বাঁকের পর বাঁক। বড়মামাই চালাচ্ছেন। আমি সামনে। জগন্নাথকাকু পেছনে।
বড়মামা বললেন, চলুন, বিজয়বাবুর সঙ্গে দেখা করে যাই।
কে বিজয়বাবু?
বিখ্যাত মানুষ। ভূত নিয়ে রিসার্চ করেন।
আবার ভূত?
হচ্ছে যখন ভালো করে হয়ে যাক।
গাড়ি গড়গড় করে যাচ্ছে। এক জায়গায় চা, তেলেভাজা খাওয়া হল। জগন্নাথ কাকুর সেই এক দুশ্চিন্তা—অম্বল। বড়মামা বললেন, আমি দম্বল দিয়ে দোবো। একটা অতি প্রাচীন বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। ভাত খুব সেদ্ধ হলে যেমন ডেলা পাকিয়ে যায়, বাড়িটার ইটও সেইরকম ডেলা পাকিয়ে গেছে। জানলা, দরজা সব শুকিয়ে খটখটে। সদর দরজা খোলাই ছিল। পঁচিশ পাওয়ারের আলোয় যতটা দেখা যায়। অনেক দূরে একটা উঠোন। একটা ঘরে চড়া আলো জ্বলছে। সেই আলোর পিচকিরি যেখানে এসে পড়েছে, সেখানে একটা হাড়িকাঠ। আলো জ্বলছে মায়ের মন্দিরে। মা কালী। মায়ের অমন মূর্তি কোথাও দেখি নি। মায়ের গায়ের রঙ দুধের মতো সাদা, আর মহাদেব কুচকুচে কালো। মায়ের সামনে আসনে বসে আছেন জবরদস্ত এক সাধক। মাথায় জটা। দাড়ি ঝুলে আছে বুকে। হৃষ্টপুষ্ট। এতখানি ভুঁড়ি। ঠিক যেন মহাদেব। আমরা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলুম। তিনি হাত তুলে বললেন, উল্লুক হয়ে যেয়ো না। ডাক্তার! তুমি অনেকদিন পরে এলে!
আমার কথা আর বলবেন না। আমি ক্রমশই উল্লুক হয়ে যাচ্ছি। আপনার কাছে ছুটে আসার কারণ, আজ দুপুরে আমরা তিনজনে ভূত দেখেছি।
ভূত পরে হবে, আগে বোসো।
আমরা ধুপ ধুপ করে বসে পড়লুম। তিনি বললেন, ভূত আবার কি? ভূত বলে কিছু নেই। তোমরা একটা অন্য ডাইমেনসানে চলে গিয়েছিলে।
কি করে গেলুম?
যাবে কেন? তোমাদের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল। এটা কী রকম জান—খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলো ঢোকার মতো। চাকার মতো দুনিয়া ঘুরছে! একটাকে কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে আর একটা। ওই কাটার বিন্দুতে দাঁড়ালে, এটাও দেখা যায়, ওটাও দেখা যায়। এ-জগৎ থেকে পা তুলে ওই জগতে ফেলা। অনেক রহস্য বাবা! সাধন ছাড়া জানা যায় না।
বড়মামা বললেন, কতবার বললুম, একটু সাধন দিন। করে দেখি। দিলেন না।
সময় হয়নি।
এই তো মনটা খারাপ করে দিলেন।
ডাক্তার! তুমিও তো সাধক! তোমার এক ধারা, আমার আর এক ধারা। পৃথিবীতে সকলেই সাধক। কেউ গুটোচ্ছে, কেউ ছাড়ছে।
সেটা কী রকম?
ঘুড়ি আর লাটাই। একই লাটাই, সুতো আর ঘুড়ি। দু-ধরনের প্যাঁচখেলা। কেউ ছেড়ে খেলছে, কেউ টেনে খেলছে। কেউ নিজেকে গুটোচ্ছে, তখন কেবল আমি, আমার। কেউ নিজেকে ছেড়ে যাচ্ছে। আকাশ, আরও আকাশ। আমি বলে কিছুই আর থাকছে না। ডাক্তার! তোমার তো আমি, আমি নেই। তোমার চেয়ে বড় সাধক কোথায় মিলবে? আমিটাই তো ভূত।
বড়মামা বললেন, কী যে আমার প্রশংসা করেন আপনি! এইবার আমি সব ছেড়ে আপনার কাছে চলে আসব।
ডাক্তার! এ-জন্মটাও বৃথা গেল। শিবকে সাদা করতে হবে। ওই সাদা তুলে কালীর গায়ে লাগিয়ে মাকে কালী করতে হবে। এ হল আত্মা-সাধনা।
এলো চুল, লম্বা চেহারার এক মহিলা এলেন। বড় বড় চোখ। ভীষণ দীপ্তি। কারো সঙ্গেকোনো কথা না বলে মন্দিরে মায়ের সামনে আসনে বসে পড়লেন। পেছনে কালো চুলের ঢেউ। এইবার পুজো-আরতি শুরু হবে। আমার মনটা কেমন যেন করছে। কোথায় যেন চলে যাচ্ছি ভেসে ভেসে!