সাক্ষী
জেলা-কোর্টের দায়রা এজলাসে খুনের মামলা শেষ হইয়াছে। আসামী বেকসুর খালাস পাইয়াছে। আমরা যে-কয়জন কলিকাতার সাংবাদিক লোমহর্ষণ পরিস্থিতির খবর পাইয়া এখানে আসিয়াছিলাম, তাহাদের মধ্যে অন্য সকলেই ফিরিয়া গিয়াছে, কেবল আমি রহিয়া গিয়াছি। মামলার নিষ্পত্তি হইয়া গিয়াছে এবং আসামী সুবিচার পাইয়াছে তাহাতেও সন্দেহ নাই; তবু আমার মন সন্তুষ্ট হইতে পারে নাই। কোথায় যেন একটি গুরুতর প্রশ্ন অমীমাংসিত রহিয়া গিয়াছে।
শহরের ধনী এবং উচ্ছৃঙ্খল যুবক মোহিতমোহন রক্ষিত নিজের স্ত্রীকে হত্যা করিয়া ফেরারী হয়, তারপর ধরা পড়িয়া যায়। প্রত্যক্ষ প্রমাণ অবশ্য ছিল না, কেহ মোহিতকে খুন করিতে দেখে নাই; কিন্তু জোরালো circumstantial evidence ছিল। মোহিতের স্ত্রী অন্নপূর্ণা ছিল কটুভাষিণী খাণ্ডার মেয়ে; মোহিতের সহিত প্রায়ই তাহার ঝগড়া হইত। এমন কি মাঝে মাঝে মারপিটও যে হইত, পাড়াপড়শী তাহার সাক্ষী ছিল। মোহিত দায়রা-সোপর্দ হইল।
মামলা যখন সঙীন হইয়া উঠিয়াছে, মোহিতের প্রাণরক্ষার কোনও রাস্তাই নাই, এমন সময় কালীময় ঘোষ নামক এক স্থানীয় ভদ্রলোক স্বেচ্ছায় কোর্টের পক্ষ হইতে সাক্ষী দিলেন। তিনি বলিলেন, যে-রাত্রে এগারোটার সময় অন্নপূর্ণা খুন হয় সে-রাত্রে সওয়া দশটা হইতে প্রায় বারোটা পর্যন্ত মোহিত কালীময়ের গৃহে ছিল, মোহিত তাঁহার স্ত্রীর উপপতি। সওয়াল জবাবের পর সন্দেহ থাকে না যে কালীময় ঘোষ সত্য কথা বলিতেছেন। তাঁহার সাক্ষ্যের জোরে মোহিত মুক্তি পায়।
মফঃস্বলের মামলায় কলিকাতা হইতে সাংবাদিকেরা বড় একটা আসে না, স্থানীয় সংবাদদাতারাই খবর পাঠায়। এই মামলার শেষের দিকে আমরা টেলিফোনে খবর পাইয়া আসিয়া জুটিলাম। কাগজে খুব হৈ-হৈ হইল। তারপর মামলার নিষ্পত্তি হইলে সকলে ফিরিয়া গেল। আমি কেবল রহিয়া গেলাম।
পরদিন বৈকালে আন্দাজ পাঁচটার সময় আমি কালীময় ঘোষের বাড়িতে গেলাম। পাড়াটা নিরিবিলি, কয়েকঘর ভদ্র গৃহস্থের বাস। বাগান-ঘেরা একতলা ছোট ছোট বাড়িগুলি, সবগুলিই প্রায় এক ছাঁচের। কেবল একটা বাড়ি দ্বিতলের গর্বে মাথা উঁচু করিয়া আছে। সেটি মোহিত রক্ষিতের বাড়ি। কালীময়বাবুর বাড়ি হইতে মোহিত রক্ষিতের বাড়িটা ষাট-সত্তর গজ দূরে। আমরা এখানে আসিয়া প্রথমেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করিয়াছিলাম, স্থানটার প্ল্যান জানা ছিল।
কালীময় ঘোষের ছোট্ট বাগান পার হইয়া বাড়ির সামনে উপস্থিত হইলাম। বাড়িটা নির্জন মনে হইল। একা কালীময়বাবু সম্মুখের বারান্দায় মাদুরে বসিয়া বঁড়শিতে সুতা বাঁধিতেছেন। চারিদিকে মাছ-ধরার সরঞ্জাম, হুইলযুক্ত দুইটা ছিপ, মুগার সুতা, ময়ূরপুচ্ছের ফাৎনা ইত্যাদি।
কালীময়বাবুর বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ। দোহারা বলিষ্ঠ গোছের চেহারা, মাথার চুল ও গোঁফ ছোট করিয়া ছাঁটা। খাটো ধুতির উপর ময়লা সোয়েটার পরিয়া তিনি বসিয়া আছেন; যে বয়সে মানুষ নিজের দৈহিক পারিপাট্য সম্বন্ধে উদাসীন হইয়া পড়ে সেই বয়স। আমাকে দেখিয়া হাঁটুর উপর একটু কাপড় টানিয়া দিয়া ভ্ৰূ তুলিলেন, ‘আপনি?’
কালীময়বাবুকে আমি ইতিপূর্বে আদালতে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দেখিয়াছি। তাঁহার বাহ্য আচার ব্যবহার ও প্রকৃতি সম্বন্ধে আমার মনে বেশ স্পষ্ট ধারণা আছে, কিন্তু তাঁহার চরিত্র-চিত্র অঙ্কিত করা সহজ নয়। লোকটি ভদ্ৰশ্রেণীর, জাতিতে কায়স্থ, অভাবগ্রস্ত নয়, সচ্ছল অবস্থার মানুষ; অশিক্ষিত নয়, বি-এ বি-এল; তবু তাঁহার কথায় ও আচার ব্যবহারে কোথাও যেন একটু চাষাড়ে ভাব আছে। চাষাড়ে কথাটা হয়তো ঠিক হইল না, শহুরে পালিশের অভাব বলিলে ভাল হয়। পাড়াগাঁয়ের চণ্ডীমণ্ডপে তাঁহাকে বেমানান মনে হইবে না, কিন্তু কলিকাতার মার্জিত সমাজের কোনও ড্রয়িংরুমে তাঁহাকে ছাড়িয়া দিলে তিনি হংসমধ্যে বকের ন্যায় প্রতীয়মান হইবেন তাহাতে সন্দেহ নাই।
আমি নিজের পরিচয় দিলাম, তারপর তাঁহার কাছে গিয়া মাদুরের প্রান্তে বসিলাম। তিনি একবার রুক্ষ চোখে আমার পানে চাহিলেন; বলিলেন, ‘সব তো চুকে-বুকে গেছে। আবার কেন?’
আমি বলিলাম, ‘না না, আমি সাংবাদিক হিসেবে আপনার কাছে আসিনি। নিতান্তই ব্যক্তিগত কৌতূহল; আপনার মতো চরিত্রবল আজকালকার দিনে দেখা যায় না। একটা দুশ্চরিত্র লম্পটের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে আপনি—’
তোয়াজে কাজ হইল না, তিনি দৃঢ়ভাবে বাধা দিয়া বলিলেন, ‘ওসব কথা ছাড়ান দিন। কি জানতে চান?’
সঙ্কুচিত প্রশ্ন করিলাম, ‘আপনার স্ত্রী—?’
‘সে পালিয়েছে’—কালীময়বাবু আবার বঁড়শি বাঁধিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
‘সেকি! কোথায়? কার সঙ্গে?’
‘জানি না। খোঁজ করিনি।’
কিছুক্ষণ নীরবে তাঁহার বঁড়শি-বাঁধা দেখিলাম। একটি মুগার সুতায় দু’টি বঁড়শি বাঁধিতেছেন। বর্ধমানের ভাল বঁড়শি। বঁড়শি বাঁধিবার বিশেষ কায়দা আছে, যেমন তেমন করিয়া বাঁধা চলে না। প্রথমে একটি বঁড়শিকে সুতার এক ধারে বাঁধিয়া দুই পাশের সুতা পাকাইয়া এক করিতে হয়। তারপর অন্য বঁড়শি সুতার অন্য প্রান্তে অনুরূপ প্রথায় বাঁধিতে হয়। দুইটি বঁড়শি পাশাপাশি ঝুলিতে থাকে।
‘আপনি ছিপে মাছ ধরতে ভালবাসেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘রাত্রে মাছ ধরেন কেন?’
‘মজা আছে। দিনে মাছ-ধরার চেয়ে ঢের বেশি মজা। কারবাইডের সাইকেল-ল্যাম্প জ্বেলে জলের ওপর আলো ফেললে মাছ আসে।’
‘আজ রাত্রে মাছ ধরতে যাবেন নাকি?’
‘না, আজ আর হবে না।’
‘আপনার বাড়িতে এখন কে কে আছে?’
‘কেউ নেই, আমি একা। নিজে রেঁধে খাচ্ছি।’
কিছুক্ষণ বঁড়শি-বাঁধা দেখিয়া বলিলাম, ‘আচ্ছা, মোহিত রক্ষিত তার স্ত্রীকে খুন করেনি তা যেন প্রমাণ হল, কিন্তু কে খুন করেছিল তা তো জানা গেল না।’
কালীময় আমার পানে একটি অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, ‘আপনি আইনের কিছু জানেন না দেখছি। কে খুন করেছে এ-মামলায় তা জানবার দরকার নেই, মোহিত রক্ষিত খুন করেনি প্রমাণ হলেই যথেষ্ট।’
‘তবু, কে খুন করেছে জানা দরকার তো।’
‘সে ভাবনা পুলিসের।’
‘তা বটে। তবু—’
বঁড়শি-বাঁধা শেষ হইলে কালীময় সুতা তুলিয়া ধরিয়া নিরীক্ষণ করিতে করিতে যেন অন্যমনস্ক ভাবেই প্রশ্ন করিলেন, ‘আপনি মদ খান?’
‘মদ!’
‘হ্যাঁ—মদ। হুইস্কি ব্রান্ডি জিন। খান?’
সত্য কথা বলিলাম, ‘পরের পয়সায় পেলে খাই।’
‘তবে আসুন।’
কালীময় আমাকে বাড়ির ভিতর বসিবার ঘরে লইয়া গেলেন।
কালীময়ের মনের মধ্যে অনেক কথা জমা হইয়া ছিল। সে রাত্রে আমরা দু’জনে মুখোমুখি বসিয়া একটি বোতল হুইস্কি সাবাড় করিয়াছিলাম। সেই সঙ্গে তাঁহার মুখে যে বৃত্তান্ত শুনিয়াছিলাম তাহার সহিত আদালতে প্রদত্ত এজেহার মিলাইয়া একটা গোটা কাহিনী খাড়া করা যাইতে পারে। তাঁহার পলাতকা স্ত্রী দামিনীর একটি ফটোও দেখিয়াছিলাম। এমন কিছু আহা-মরি চেহারা নয়, কিন্তু বয়স কুড়ি-বাইশ; শরীরের বাঁধুনি আছে এবং চোখে আছে কপট ভালমানুষী।
কালীময় এই জেলারই লোক। ছেলেবেলায় পাড়াগাঁয়ে ছিলেন, তারপর শহরে আসিয়া লেখাপড়া শিখিয়াছেন, উকিল হইয়াছেন; গ্রামের জমিজমা বিক্রয় করিয়া শহরে বাড়ি কিনিয়া বাস করিতেছেন। ওকালতিতে তাঁহার পসার বেশী নয়; জরীপের কাজ করিয়া অল্পস্বল্প রোজগার হয়। হাতে কিছু নগদ টাকা আছে, লগ্নি কারবারেও মন্দ উপার্জন হয় না। মোটের উপর সচ্ছল অবস্থা। প্রায় বিশ বছর শহরে আছেন। শহরের সকলের সঙ্গে পরিচয় আছে, কিন্তু বেশী ঘনিষ্ঠতা কাহারও সঙ্গে নাই। যে-ব্যক্তি একাধারে উকিল এবং মহাজন, তাহার সঙ্গে কাহারও বেশী ঘনিষ্ঠতা বোধ হয় সম্ভব নয়।
কালীময়ের প্রথমপক্ষের স্ত্রী রুগ্না ছিলেন, বিবাহিত জীবনের প্রায় পনেরটা বছর নিরবচ্ছিন্ন শয্যাগত থাকিয়া নিঃসন্তান অবস্থায় স্বর্গারোহণ করেন। কালীময়ের বয়স তখন চল্লিশ পার হইয়া গিয়াছে; পুনর্বার বিবাহ করিবার জন্য তিনি বিশেষ উৎসুক ছিলেন না, পুন্নাম-নরকের ভয়ও তাঁহার ছিল না। কিন্তু কালীময়ের এক দূর-সম্পর্কের বোন ছিল, তাহার বিবাহ হইয়াছিল অন্য জেলায়; কালীময় বিপত্নীক হইয়াছেন শুনিয়া সে আসিয়া দাদাকে ধরিয়া বসিল—তাহার স্বামীর এক দূর-সম্পর্কের ভগিনী আছে, মেয়েটি অনাথা, তাহাকে উদ্ধার করিতে হইবে। রূপবতী গুণবতী কন্যা, নেহাত অনাথা বলিয়াই দূর-সম্পর্কের ভায়ের গলায় পড়িয়াছে।
শেষ পর্যন্ত কালীময় দামিনীকে বিবাহ করিলেন। দামিনী সাধারণ বিচারে দেখিতে-শুনিতে ভালই, রূপ যত না থাক, চটক আছে। গুণের পরিচয় ক্রমে প্রকাশ পাইল। সংসারের কাজ জানিলেও সেদিকে স্পৃহা নাই। ভালমানুষের মতো ঘরে থাকে বটে, কিন্তু মন বাহিরের দিকে। ঘরের কাজ ফেলিয়া বিছানায় শুইয়া রোমাঞ্চকর উপন্যাস পড়িতে ভালবাসে, সাজ-গোজের দিকে নজর বেশী, সিনেমা দেখার দিকে প্রচণ্ড লোভ।
প্রথমে কালীময় কিছু দেখিতে পান নাই। ক্রমে নব-পরিচয়ের ঘোলা জল পরিষ্কার হইতে লাগিল। কিন্তু নৃতন বৌয়ের যে দোষগুলি তিনি দেখিতে পাইলেন সেগুলি তাঁহার মারাত্মক মনে হইল না। দামিনী সাধারণ মেয়ে, এইরূপ সাধারণ মেয়ের সাধারণ দোষগুণ লইয়া সংসারসুদ্ধ লোক ঘর করিতেছে। কালীময় বিশেষ উদ্বিগ্ন হইলেন না।
বছরখানেক কাটিয়া গেল। কালীময় ধীরে ধীরে উপলব্ধি করিলেন, দামিনী সাধারণ মেয়ে নয়। সে অত্যন্ত স্বার্থপর, অন্যের সুখ-সুবিধা সামর্থ্যের কথা সে ভাবে না। তাহার একটা প্রচ্ছন্ন জীবন আছে; তাহার অতীত-জীবনে কোনও গুপ্ত-রহস্য আছে। সে অত্যন্ত সরল নিরীহ মুখ লইয়া অনর্গল মিথ্যা কথা বলে। সে লুকাইয়া লুকাইয়া কাহাকে চিঠি লেখে।
একদিন একটা সামান্য ঘটনা ঘটিল। কালীময়ের বাড়ির ঠিক সামনে রাস্তার ধারে একটা ডাক-বাক্স আছে; দুপুরবেলা কালীময় একটা দলিল লইবার জন্য কোর্ট হইতে বাড়ি ফিরিতেছিলেন। পথঘাট শূন্য, মোড় ঘুরিয়া নিজের রাস্তায় পড়িয়া তিনি দেখিতে পাইলেন, দামিনী টুক্ করিয়া ফটকের বাহিরে আসিয়া একখানা খামের চিঠি ডাকে ফেলিয়া আবার সুট্ করিয়া বাড়িতে ফিরিয়া গেল।
কালীময় গৃহে প্রবেশ করিয়া দামিনীকে বলিলেন, ‘আজ দুপুরে ঘুমোওনি দেখছি। কাকে চিঠি লিখলে?’
সরল বিস্ময়ে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া দামিনী বলিল, ‘চিঠি! কৈ, আমি লিখিনি তো!’
কালীময়ের ধোঁকা লাগিল। তবে কি তিনিই ভুল দেখিয়াছেন! তিনি আর কিছু বলিলেন না, দলিল লইয়া আদালতে ফিরিয়া গেলেন। কিন্তু তাঁহার মনটা অনিশ্চয়ের সংশয়ে প্রশ্নসঙ্কুল হইয়া উঠিল।
দুই তিন দিন পরে কালীময়ের দূর-সম্পর্কের সেই ভগিনীপতি আসিয়া উপস্থিত হইলেন; যাঁহার গৃহে দামিনী থাকিত ইনি তিনিই। বয়সে কালীময়ের চেয়ে ছোট, শক্ত-সমর্থ চেহারা, চোখে শিকারী বিড়ালের সতর্কতা। বলিলেন, ‘কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই।’
তিনি কালীময়ের গৃহেই রহিলেন; কালীময় তাঁহাকে যথেষ্ট আদর যত্ন করিলেন। দুই দিন ও এক রাত্রি কালীময়ের গৃহে কাটাইয়া অতিথি বিদায় লইলেন। কিন্তু তিনি কী কাজে আসিয়াছিলেন তাহা ঠিক বোঝা গেল না, কারণ এখানে আসিয়া তিনি একবারও গৃহের বাহির হন নাই। কালীময় অবশ্য যথারীতি দুপুরবেলা কোর্টে গিয়াছেন।
অতঃপর তিনি মাঝে মাঝে আসেন, দু’একদিন থাকিয়া চলিয়া যান। কালীময় সন্দিগ্ধ প্রকৃতির লোক নন, কিন্তু তাঁর মনেও খট্কা লাগে। লোকটি সম্পর্কে দামিনীর ভাই, অথচ তাহাদের সম্পর্কটা ঠিক যেন স্বাভাবিক নয়। কালীময়ের সম্মুখে তাহারা এমন সঙ্কুচিত হইয়া থাকে কেন? কোথায় যেন কিছু গলদ আছে।
যাহোক, এইভাবে আরও বছরখানেক কাটিয়া গেল। কালীময় দিনের বেলা কোর্টে যান, সন্ধ্যার পর একটু হুইস্কি পান করেন। এ অভ্যাস তাঁহার আগে ছিল না, সম্প্রতি হইয়াছে। তাঁহার ভারি মাছ-ধরার শখ, আগে হপ্তায় অন্তত একবার চৌধুরীদের পুকুরে রাত্রিকালে মাছ ধরিতে যাইতেন, এখন আর অত বেশী যাওয়া হয় না; তবুও মাঝে মাঝে যান। জরীপের কাজ পড়িলে দুই তিন দিনের জন্য বাহিরে যাইতে হয়। তখন দামিনী বাড়িতে একলা থাকে। একলা থাকিতে তাহার ভয় নাই।
কালীময়ের বাড়িতে বেশী লোকের আসা-যাওয়া নাই, যাহারা আসে, কাজের দায়ে আসে; কদাচিৎ দু’একজন মক্কেল, কখনও খাতক টাকা ধার লইতে বা শোধ দিতে আসে। পড়শীদের সঙ্গে কালীময়ের নামমাত্র পরিচয়, কেবল মোহিত রক্ষিতের সহিত একটু ব্যবহারিক ঘনিষ্ঠতা আছে।
মোহিত রক্ষিত ফুর্তিবাজ ছোকরা। সুদর্শন চেহারা, মিষ্ট আচার ব্যবহার; কিন্তু প্রচণ্ড জুয়াড়ী। বন্ধুদের পাল্লায় পড়িয়া মাঝে মাঝে মাদকদ্রব্য সেবন করে কিন্তু নেশাখোর নয়। প্রকাশ্যে চরিত্রদোষ ছিল না, কারণ ঘরে ছিল খাণ্ডার বৌ। এই মোহিত রক্ষিত মাঝে-মধ্যে আসিত কালীময়ের কাছে টাকা ধার লইতে। তাহার পিতা তাহার জন্য যথেষ্ট সম্পত্তি রাখিয়া গিয়াছিলেন, কিন্তু নগদ টাকা এমনভাবে বাঁধিয়া দিয়া গিয়াছিলেন যে, প্রতি মাসে একটা বাঁধা বরাদ্দের বেশী সে হাতে পাইত না। তাই মাসের শেষের দিকে হঠাৎ টাকার ঘাট্তি হইলে মোহিত কালীময়ের নিকট রিস্ট-ওয়াচ বা আংটি বাঁধা রাখিয়া, কখনও বা শুধু হাতেই টাকা ধার লইত। আবার হাতে টাকা আসিলেই ঋণ শোধ করিয়া দিত। কালীময় মোহিতকে মনে মনে পছন্দ করিতেন, কারণ সে জুয়াড়ী হইলেও মহাজনকে ফাঁকি দিবার চেষ্টা করিত না।
একবার কালীময় জরীপের কাজে দু’ তিন দিনের জন্য গ্রামাঞ্চলে গিয়াছিলেন, ফিরিয়া আসিয়া দামিনীকে দেখিয়া তাঁহার মস্তিষ্কে সন্দেহের আগুন জ্বলিয়া উঠিল। দামিনী ভাল মেয়ে নয়, নষ্ট মেয়ে। তাহার গুপ্ত নাগর আছে। সে লুকাইয়া ব্যভিচার করে।
সন্দেহ বস্তুটা যে সকল আণুবীক্ষণিক প্রমাণের উপর নির্ভর করে সে-প্রমাণ কাহাকেও দেখানো যায় না, এমন কি নিজের কাছেও তাহারা খুব স্পষ্ট নয়। তবুও এজাতীয় সন্দেহের হাত ছাড়ানো যায় না। কালীময় মাথার মধ্যে তুষের আগুন জ্বালিয়া ভাবিতে পেগিলেন— দামিনী বিবাহের আগে হইতেই দুশ্চরিত্রা…এই জন্যই তাঁহার দূর-সম্পর্কীয়া ভগিনী তাহাকে তাড়াতাড়ি বিদায় করিয়াছিল…ভগিনীপতির সঙ্গে নটঘট…লোকটা ঐজন্যই আসে…তাহারা সম্পর্কে ভাই-বোন, কিন্তু যাহারা নষ্ট-দুশ্চরিত্র তাহাদের কি সম্পর্ক জ্ঞান থাকে?…শুধু তাই নয়, এখানেও দামিনীর গুপ্ত-প্রণয়ী আছে…কে সে? বাড়িতে তো সে-রকম কেহ আসে না…তাঁহার অনুপস্থিতি-কালে কাহার যাতায়াত আছে? কে সে?
কালীময় স্থির করিলেন, কেবল সন্দেহের তুষানলে দগ্ধ হইয়া লাভ নাই, ধরিতে হইবে। হাতে-নাতে ধরিয়া তারপর নষ্ট স্ত্রীলোকটাকে দূর করিয়া দিবেন। কেলেঙ্কারী হইবে, শহরে কান পাতা যাইবে না—তা হোক।
শনিবার বিকালে আদালত হইতে ফিরিয়া জলযোগ করিতে করিতে কালীময় বলিলেন, ‘আজ রাত্তিরে মাছ ধরতে যাব।’ তাঁহার বাহ্য ব্যবহার দেখিয়া মনের কথা অনুমান করা যায় না।
দামিনীর চোখের মধ্যে ঝিলিক খেলিয়া গেল। সে তৎক্ষণাৎ চোখের উপর পল্লবের আবরণ নামাইয়া বলিল, ‘ও। —তাহলে তোমার রাত্তিরের খাবার তৈরি করি। ফিরতে কি রাত হবে?’
কালীময় বলিলেন, ‘যেমন হয়, একটা-দেড়টা।’
রাত্রি সাড়ে আটটার পর কালীময় বাহির হইলেন। একটি চটের থলিতে মাছ-ধরার সরঞ্জাম; চার, টোপ, ভাজা খোল ও মেথির গুঁড়া, একটি কারবাইডের সাইকেল-ল্যাম্প। সেই সঙ্গে একটি দেড় ফুট লম্বা লোহার ডাণ্ডা। রাত্রে মাছ ধরিতে গেলে এই ডাণ্ডাটি তাঁহার সঙ্গে থাকে। নির্জন স্থানে একাকী রাত্রি-যাপন, আত্মরক্ষার একটা অস্ত্র সঙ্গে থাকা ভাল।
এক হাতে ছিপ, অন্য হাতে থলি লইয়া কালীময় বাহির হইলেন। তিনি ফটক পার না হওয়া পর্যন্ত দামিনী দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। বাড়িতে আর কেহ নাই; ঠিকা ঝি দিনের বেলা কাজ করিয়া দিয়া চলিয়া গিয়াছে, আবার কাল সকালে আসিয়া রাত্রির এঁটো বাসন মাজিবে।
কালীময়ের বাড়ির সম্মুখের রাস্তাটির দুইটি মুখ; একটি বাজারের দিকে, অন্যটি শহরের বাহিরে গিয়াছে। কালীময় বাহিরের রাস্তা ধরিলেন। চৌধুরীদের বাগানবাড়িটা শহরের দুই মাইল বাহিরে। প্রকাণ্ড পুকুর, পুকুরে খল্সে পুঁটি হইতে বড় বড় রুই কাৎলা মৃগেল চিতল সব মাছই আছে। চৌধুরীরা কালেভদ্রে বাগানবাড়িতে আমোদ করিতে যান; একটা মালী বাগানবাড়ির তত্ত্বাবধান করে। চৌধুরীরা বড় জমিদার; কালীময় তাঁহাদের এস্টেটের একজন উকিল। পুকুরে মাছ ধরিবার ঢালাও হুকুম আছে।
কিছুদূর চলিবার পর মোহিত রক্ষিতের বাড়ির কাছাকাছি মোহিতের সঙ্গে তাঁহার দেখা হইয়া গেল। সে বলিল, ‘এই যে ঘোষ মশাই! আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম।’
কালীময় দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘কি ব্যাপার?’
‘কিছু টাকার দরকার পড়েছিল।’
‘কত?’
‘শ’ দুই।’
‘তা এখন তো হবে না, কাল সকালে এস।’
‘তাই যাব। কোথায় চলেছেন? চৌধুরীদের পুকুরে?’
‘হ্যাঁ।’
‘বেশ আছেন!’ একটু হাসিয়া মোহিত চলিয়া গেল। নিজের বাড়িতে ফিরিয়া গেল না, শহরে কোনও জুয়ার আড্ডায় গেল।
মোহিতের বাড়ির সম্মুখ দিয়া যাইবার সময় কালীময় শুনিতে পাইলেন বাড়ির ভিতর হইতে কাংস্যকণ্ঠের তীক্ষ স্বর আসিতেছে— ‘বাড়িতে মন বসে না, দিনরাত শুধু জুয়া আর জুয়া! লক্ষ্মীছাড়ার দশা!…বাপ যা রেখে গেছে সব ছারে গোল্লায় দিয়ে তবে নিশ্চিন্দি হবে…’
চলিতে চলিতে কালীময় ভাবিতে লাগিলেন—মোহিতের বৌ সুন্দরী এবং যুবতী; কিন্তু কী গলা! কী মেজাজ! দুনিয়ায় বিবাহ করিয়া কেহ সুখী হইয়াছে কি? তিনি নিজে দুইবার বিবাহ করিয়াছেন; প্রথমটি চিররুগ্না, দ্বিতীয়টি ভ্রষ্টা। মানুষ বিবাহ করে কেন?
রাস্তাটা আরও আধ মাইল গিয়া মিউনিসিপাল এলাকার শেষ প্রান্তে পৌঁছিয়াছে, অতঃপর আর আলোকস্তম্ভ নাই। এইখানে পৌঁছিয়া কালীময় একটি গাছের তলায় উপস্থিত হইলেন। রাত্রিকালে এ রাস্তায় লোকচলাচল খুবই কম, তবু কালীময় গাছের পিছনদিকে গিয়া ছিপটি গাছের গুঁড়িতে হেলাইয়া দিলেন; থলিটি মাটিতে রাখিয়া নিজে একটি উন্নত শিকড়ের উপর উপবেশন করিলেন। এখানে বসিলে রাস্তা দিয়া মোটর-গাড়ি যাইলেও তাহার হেড-লাইটের আলোয় তাঁহাকে দেখা যাইবে না।
পকেট হইতে সিগারেট বাহির করিয়া কালীময় ধরাইলেন; ধরাইবার সময় দেশলাইয়ের আলোতে হাতঘড়িটা দেখিয়া লইলেন। ন’টা বাজিয়া পাঁচ মিনিট।
আজ সিগারেট বড় শীঘ্র শেষ হইয়া গেল। তিনি আর একটা সিগারেট ধরাইলেন। সেটা শেষ হইলে আর একটা…
দশটা বাজিলে কালীময় পায়ের জুতা খুলিয়া ফেলিলেন; জুতাজোড়া গাছের স্কন্ধে তুলিয়া রাখিলেন, শিয়াল-কুকুরে লইয়া না যায়। তারপর থলি হইতে লোহার ডাণ্ডাটি লইয়া থলিও গাছের একটি গোঁজের মতো ডালে ঝুলাইয়া দিলেন। ছিপটি যেমন ছিল তেমনি রহিল। কালীময় লোহার ডাণ্ডাটি দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিয়া নিঃশব্দে ফিরিয়া চলিলেন। রাস্তায় জনমানব নাই।
নিজের পাড়ায় যখন ফিরিলেন তখন পাড়া নিষুতি; সব বাড়িতে আলো নিভিয়া গিয়াছে, কেবল মোহিতের বাড়ির একটা ঘরে আলো জ্বলিতেছে।
কালীময়ের নিজের বাড়িও অন্ধকার, কোথাও সাড়াশব্দ নাই। তিনি চোরের মতো প্রবেশ করিলেন। বাড়ির প্রবেশদ্বার দুইটি— একটি সামনে, একটি পিছনে। কালীময় অনুভব করিয়া দেখিলেন, দুইটি দ্বারই ভিতর হইতে বন্ধ। তিনি তখন নিঃশব্দপদে শয়নঘরের জানালার বাহিরে গিয়া দাঁড়াইলেন। জানালার একটি কপাট অল্প খোলা রহিয়াছে; ঘরের ভিতর অন্ধকার। কান পাতিয়া থাকিলে ফিসফিস গলার আওয়াজ শোনা যায়। কিছুক্ষণ কান পাতিয়া শুনিবার পর কালীময় কণ্ঠস্বর দু’টি চিনিতে পারিলেন— একটি তাঁহার স্ত্রী দামিনীর, অপরটি তাঁহার খাতক মোহিত রক্ষিতের।
পরদিন সকালবেলা পাড়ায় হুলস্থুল কাণ্ড। মোহিত রক্ষিত নিজের স্ত্রীকে খুন করিয়া ফেরারী হইয়াছে। বাড়িতে পুলিস আসিয়াছে।
মোহিতের বাড়ির বাঁ পাশে গোপাল নিয়োগীর বাড়ি, ডান পাশে থাকেন প্রতাপ চন্দ। দুজনেই প্রৌঢ় ব্যক্তি; তাঁহারা পুলিসের কাছে এজেহার দিলেন। মোহিত এবং অন্নপূর্ণার কলহ দৈনন্দিন ব্যাপার। কাল রাত্রি আন্দাজ এগারোটার সময় তাঁহারা মোহিতের বাড়ি হইতে অন্নপূর্ণার চিৎকার ও গালিগালাজের শব্দ শুনিতে পান। মোহিত কোনও দিনই চেঁচাইয়া ঝগড়া করে না, কালও তাহার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শোনা যায় নাই। হঠাৎ অন্নপূর্ণা— ‘মেরে ফেললে’ ‘মেরে ফেললে’ বলিয়া দুই তিন বার চিৎকার করিয়াই চুপ করিল। ব্যাপার এতটা চরমে আগে কখনও ওঠে নাই। কিন্তু দাম্পত্য কলহে বাহিরের লোকের হস্তক্ষেপ করিতে যাওয়া মূঢ়তা, তাই গোপাল নিয়োগী এবং প্রতাপ চন্দ অত রাত্রে আর বাড়ির বাহির হন নাই। বিশেষত অন্নপূর্ণা যখন হঠাৎ চুপ করিয়া গেল তখন তাঁহারা ভাবিয়াছিলেন মোহিত বৌকে পিটাইয়া শায়েস্তা করিয়াছে। সে যে বৌকে খুন করিতে পারে এ সম্ভাবনা তাহাদের মাথায় আসে নাই। সারারাত্রি মৃতদেহ খোলা বাড়িতে পড়িয়া ছিল, সকালবেলা ঝি আসিয়া আবিষ্কার করিয়াছে। ঝিয়ের চেঁচামেচিতে গোপালবাবু ও প্রতাপবাবু এ বাড়িতে আসিয়াছেন এবং মৃতদেহ দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়াছেন।
কালীময় মোহিতের বাড়িতে গেলেন। পাড়ায় এমন একটা কাণ্ড হইয়া গেল, সকলেই গিয়াছে, তিনি না গেলে খারাপ দেখায়। পুলিস দারোগা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনি কিছু জানেন?’
এজেহার দিবার ইচ্ছা কালীময়ের ছিল না, তিনি ইতস্তত করিয়া বলিলেন, ‘কখন—এই ব্যাপার ঘটেছে?’
দারোগা গোপাল নিয়োগী ও প্রতাপ চন্দকে দেখাইয়া বলিলেন, ‘এঁদের কথা থেকে মনে হয় রাত্রি আন্দাজ এগারোটার সময় খুন হয়েছে। অন্য সাক্ষী নেই, বাড়িতে ঝি-চাকর কেউ থাকত না।’
কালীময় বলিলেন, ‘এগারোটার কথা জানি না, আমি চৌধুরীদের পুকুরে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। কিন্তু রাত্রি আন্দাজ সাড়ে আটটার সময় মোহিতের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।’
দারোগা বলিলেন, ‘তাই নাকি! কোথায় দেখা হয়েছিল?’
কালীময় গতরাত্রে মোহিতের সহিত পথে সাক্ষাতের বিবরণ বলিলেন। শুনিয়া দারোগা কহিলেন, ‘হুঁ। আর একটা জোরালো মোটিভ পাওয়া যাচ্ছে। মৃত মহিলার গলায় দশ-বারো ভরি ওজনের সোনার হার ছিল, খুনী সেটা নিয়ে গেছে। —মোহিত রক্ষিত আপনার কাছে টাকা ধার নিতে যাচ্ছিল, কিন্তু আপনার কাছে ধার না পেয়ে শুধু-হাতেই জুয়ার আড্ডায় গিয়েছিল। সেখানে বোধ হয় আমল পায়নি, তাই বৌয়ের গলার হার নিতে এসেছিল। তারপর—’
দারোগা পাড়ার আরও অনেককে প্রশ্ন করিলেন, কিন্তু নূতন কোনও তথ্য পাওয়া গেল না। মোহিত জুয়াড়ী ছিল, দলে পড়িয়া মাঝে মাঝে মদ খাইত, কিন্তু মোটের উপর মানুষ মন্দ ছিল না; অন্নপূর্ণার সহ্যগুণ ছিল না, মুখের রাশ ছিল না, সামান্য কারণে ঝগড়া বাধাইয়া পাড়া মাথায় করিত—এই তথ্যগুলিই সকলের মুখে প্রকাশ পাইল।
তদন্ত শেষ করিয়া দারোগা লাশ লইয়া চলিয়া গেলেন। পলাতক মোহিত রক্ষিতের নামে পুলিসের হুলিয়া বাহির হইল।
গতরাত্রে প্রায় একটার সময় কালীময় মাছ ধরিয়া বাড়ি ফিরিয়াছিলেন। দামিনী ঘুমচোখে আসিয়া দোর খুলিয়া দিয়াছিল, জড়িতস্বরে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ‘মাছ পেলে?’
কালীময় সংক্ষেপে বলিয়াছিলেন, ‘না।’
আর কোনও কথা হয় নাই। দামিনী গিয়া আবার শয়ন করিয়াছিল; কালীময় হাত মুখ ধুইয়া তাহার পাশে শয়ন করিয়াছিলেন। দামিনী কয়েকবার আড়মোড়া ভাঙিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, কালীময় সারারাত্রি জাগিয়া ছিলেন।
সকালবেলা দু’জনের মধ্যে লুকোচুরি খেলা আরম্ভ হইল। বাহির-বাড়িতে খুনের খবর পাইয়া কালীময় অন্দরে আসিলেন; দামিনীকে বলিলেন, ‘কাল রাত্রে মোহিত রক্ষিত বৌকে খুন করে পালিয়েছে।’
দামিনী চা তৈরি করিতেছিল, তাহার মুখখানা হঠাৎ শুকাইয়া শীর্ণ হইয়া গেল, সে চকিত-ভয়ার্ত চক্ষু একবার তুলিয়া তৎক্ষণাৎ নত করিয়া ফেলিল। কালীময় বলিলেন, ‘মোহিতকে তুমি দেখেছ নিশ্চয়। আমার কাছে আসত টাকা ধার করতে।’
দামিনী চোখ তুলিল না, জড়াইয়া জড়াইয়া বলিল, ‘কি জানি—মনে পড়ছে না—’
চা পান করিয়া কালীময় ঘটনাস্থলে গেলেন। সেখান হইতে ফিরিতে বেলা প্রায় দুপুর হইল। বাড়ি আসিয়া তিনি দামিনীকে বলিলেন, ‘কাল রাত্তির এগারোটার সময় মোহিত তার বৌকে খুন করেছে।’
দামিনীর চোখে ঝিলিক খেলিয়া গেল। সে অন্যদিকে চোখ ফিরাইয়া বলিল, ‘তাই নাকি?’ কথাটা অত্যন্ত নীরস ও অর্থহীন শুনাইল। মনের স্পর্শহীন নিষ্প্রাণ বাঁধা বুলি।
পরদিন সোমবার। মোহিতের হুলিয়া শহরের বাহিরেও জারি হইয়া গিয়াছে, কিন্তু মোহিত এখনও ধরা পড়ে নাই।
শহর হইতে তিন স্টেশন দূরে বড় জংশন। সোমবার সন্ধ্যাবেলা পুলিসের জমাদার অভয় শিকদার জংশনের সদর প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করিতেছিল। সে একরাত্রির জন্য ছুটি লইয়া ধুতি-পাঞ্জাবি পরিয়া শ্বশুরবাড়ি যাইতেছে। তাহার বয়স সাতাশ-আটাশ, প্রথম পুত্রসন্তান জন্মিয়াছে; তাই পুত্রমুখ দর্শনের জন্য সে একরাত্রির ছুটি পাইয়াছে। তাহার শ্বশুরবাড়ি বেশী দূরে নয়, ট্রেনে ঘণ্টা তিনেকের রাস্তা। কিন্তু জংশন পর্যন্ত আসিয়া সে আটকাইয়া গিয়াছে; ওদিকের ট্রেনের কি গোলযোগ হইয়াছে, আড়াই ঘন্টা লেট।
অভয় শিকদার অধীরভাবে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করিতেছে। সময় যেন কাটিতে চায় না। সে স্টেশনের পরিচিত মালবাবু ও চেকারদের সঙ্গে গল্প করিয়াছে; স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যে ছোট পুলিস-থানা আছে সেখানে বসিয়া আড্ডা দিয়াছে, পলাতক খুনী আসামী মোহিত রক্ষিত সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছে…আসামীকে সে চেনে, কিন্তু এখন আর তাহাকে কোথায় পাওয়া যাইবে? সে এতক্ষণে হিল্লী-দিল্লী মক্কা-মদিনা পার হইয়া গিয়াছে।…কাল আবার শেষরাত্রেই ট্রেনে চড়িয়া ফিরিতে হইবে। দারোগাবাবু বলিয়া দিয়াছেন, পুত্রমুখ-দর্শনে আত্মহারা হইয়া দেরি করিলে চলিবে না, ভোরবেলায় যথাসময়ে ডিউটিতে আসা চাই।
প্ল্যাটফর্মে অন্য গাড়ি আসিতেছে যাইতেছে, যাত্রীরা উঠিতেছে নামিতেছে; একটা ট্রেন চলিয়া গেলে কিছুক্ষণের জন্য প্ল্যাটফর্ম খালি হইয়া যাইতেছে। ক্রমে স্টেশনের আলোগুলি জ্বলিয়া উঠিল। এতক্ষণে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছিয়া যাইবার কথা। দুত্তোর!
অভয় ক্লান্তভাবে একজন চেকারকে গিয়া বলিল, ‘আর কত দেরি দাদা? গাড়ি আসছে?’
চেকার বলিলেন, ‘আসছে, আসছে, আর মিনিট কুড়ি। —তারপর, মিষ্টি খাওয়াচ্ছ কবে?’
অভয় হুঁ-হুঁ করিয়া হাসিয়া বলিল, ‘সব হবে দাদা, আগে ছেলেটাকে দেখে আসি। আপাতত এই একটা চলুক।’ বলিয়া সিগারেটের প্যাকেট বাহির করিয়া দিল।
চেকার সিগারেট লইয়া প্রস্থান করিলে অভয় অনুভব করিল তাহার ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছে। সম্ভবত মিষ্টি খাওয়ানোর কথায় ক্ষুধার কথা মনে পড়িয়া গিয়াছে। সে থার্ডক্লাস যাত্রীদের বিশ্রাম-মণ্ডপের দিকে চলিল, সেখানে খাবার ও চায়ের স্টল আছে।
মণ্ডপের প্রকাণ্ড চত্বরে দুই-চারিজন যাত্রী, কেহ শুইয়া কেহ বসিয়া সময় কাটাইতেছে; ইলেকট্রিক বাতির আলোতে অন্ধকার দূর হইয়াছে বটে, কিন্তু আবছায়া কাটে নাই। চায়ের স্টলে উজ্জ্বল আলো আছে। অভয় স্টলে গিয়া চা ও বিস্কুট চাহিল।
স্টলের সামনে কেবল একজন লোক দাঁড়াইয়া চা খাইতেছিল; মাথায় বর্মী ভঙ্গিতে রুমাল বাঁধা, মুখে দু’তিন দিনের দাড়ি। অভয় স্টলে আসিলে সে একটু সরিয়া গিয়া তাহার দিকে পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া চা খাইতে লাগিল।
অভয় প্রথমে তাহাকে লক্ষ্য করে নাই; বিস্কুট সহযাগে চা খাইতে খাইতে সে একসময় লোকটার মুখের পাশ দেখিতে পাইল। গালে গভীর কালির দাগের মত দাড়ি সত্ত্বেও অভয় চিনিতে পারিল; হাতে চায়ের পেয়ালাটা একবার পিরিচের উপর নাচিয়া উঠিল। তারপর ক্ষণেকের জন্য সে নিশ্চল হইয়া গেল।
মাথার মধ্যে প্ল্যান ঠিক করিতে করিতে অভয় চা শেষ করিল, স্টলওয়ালাকে পয়সা দিয়া অলসকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, পানের দোকানটা কোন দিকে?
স্টলওয়ালা বলিল, ‘পান-সিগ্রেট আপনি প্ল্যাটফর্মে পাবেন—হকারের কাছে।’
যেন কোনই তাড়া নাই এমনি মন্থরপদে অভয় প্ল্যাটফর্মে ফিরিয়া গেল। তারপর ছুটিতে ছুটিতে থানার ঘরে প্রবেশ করিল।
পাঁচ মিনিট পরে সে আবার চায়ের স্টলে ফিরিয়া আসিল। মাথায় রুমাল-বাঁধা লোকটা চা শেষ করিয়া দোকানদারকে পয়সা দিতেছে। অভয় তাহার পিছনে গিয়া দাঁড়াইল।
সে ফিরিতেই অভয়ের সহিত তাহার চোখাচোখি হইল। সে অভয়কে চিনিল না, পাশ কাটাইয়া যাইবার চেষ্টা করিল। ইতিমধ্যে দুই দিক হইতে পুলিসের পোশাক-পরা দুইজন লোক অগ্রসর হইয়া আসিতেছে।
অভয় বলিল, ‘তোমার নাম মোহিত রক্ষিত। তুমি ফেরারী আসামী।’
মোহিত ক্ষণকালের জন্য স্তম্ভিত হইয়া গেল, তারপর ভড়কানো ঘোড়ার মতো পালাইবার চেষ্টা করিল। কিন্তু পালাইতে পারিল না, তিন দিক হইতে তিন জন তাহাকে চাপিয়া ধরিল।
থানার ঘরে লইয়া গিয়া মোহিতকে সার্চ করা হইল। তাহার কাছে তাহার মৃত স্ত্রীর সোনার হার এবং কয়েক গণ্ডা পয়সা পাওয়া গেল। নগদ টাকার অভাবে সে বেশীদূর পালাইতে পারে নাই।
সে-রাত্রে অভয়ের পুত্রমুখ দর্শন হইল না, গাড়ি আসিয়া চলিয়া গেল। অভয় মোহিতের হাতে হাতকড়া পরাইয়া দুইজন কনেস্টবল সঙ্গে শহরে ফিরিয়া চলিল।
মোহিতের মামলা কমিটিং কোর্ট পার হইয়া দায়রা আদালতে উঠিল। মোহিতের পক্ষে একজন নামজাদা ফৌজদারী উকিল নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তাঁহার সঙ্গে দুই তিন জন জুনিয়র। সরকারের পক্ষে ছিলেন স্থানীয় প্রবীণ পাবলিক প্রসিকিউটার। কালীময় যদিও কোনও পক্ষেই নিযুক্ত হন নাই, তবু তিনি বরাবর কোর্টে হাজির ছিলেন, অন্য আরও অনেক জুনিয়র উকিল উপস্থিত ছিল। তা ছাড়া শহরের কৌতুহলী জনসাধারণ ভিড় করিয়া মজা দেখিতে আসিয়াছিল।
আসামীর কাঠগড়ায় মোহিত রক্ষিত একমাথা রুক্ষ চুল ও একমুখ দাড়ি লইয়া নতনেত্রে দাঁড়াইয়া ছিল।
হাকিম রামরাখাল সেন আসিয়া বিচারকের সামনে উপবিষ্ট হইলে মামলা আরম্ভ হইল। রামরাখাল সেন কড়া মেজাজের বিচারপতি, তাঁহার এজলাসে উকিলেরা বৃথা বাক্যব্যয় বা চেঁচামেচি করিতে সাহস করে না। জুরীনির্বাচন সম্পন্ন হইলে সরকারী উকিল সংক্ষেপে মামলা বয়ান করিলেন—
মোহিত রক্ষিত উচ্ছৃঙ্খল যুবক, জুয়া এবং আনুষঙ্গিক নানাপ্রকার কদাচারে পৈতৃক পয়সা ওড়ানোই তাহার একমাত্র কাজ ছিল। তাহার সতীসাধ্বী স্ত্রী অন্নপূর্ণা তাহাকে সৎপথে আনিবার চেষ্টা করিত, কিন্তু পারিয়া উঠিত না। এই লইয়া স্বামী-স্ত্রীতে প্রায়ই বচসা হইত। নিজের রুচি ও প্রবৃত্তি অনুযায়ী কার্যে বাধা পাইয়া মোহিত স্ত্রীর প্রতি অতিশয় বিদ্বেষভাবাপন্ন হইয়া উঠিয়াছিল।
গত ২৭শে সেপ্টেম্বর শনিবার স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ চরমে উঠিল। মোহিতের জুয়া খেলিবার প্রবৃত্তি চাগাড় দিয়াছিল, অথচ মাসের শেষে তাহার হাতে টাকা ছিল না। সে প্রথমে টাকা ধার করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু ধার না পাইয়া স্ত্রীর গলার হার বন্ধক দিয়া টাকা সংগ্রহ করিবার মতলব করিল। রাত্রি সাড়ে দশটার পর সে গৃহে ফিরিয়া স্ত্রীর নিকট হার চাহিল। অন্নপূর্ণা হার দিতে অস্বীকার করিল। তখন মোহিত স্ত্রীর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করিয়া তাহাকে খুন করিল এবং তাহার গলা হইতে হার খুলিয়া লইয়া ফেরারী হইল।
দুই দিন পরে সোমবার সন্ধ্যায় রেলওয়ে জংশনে পুলিস মোহিতকে গ্রেপ্তার করে। তাহার সঙ্গে তখনও তাহার মৃত স্ত্রীর হার ছিল। সেই হার পুলিস কর্তৃক কেমিক্যাল-অ্যানালিস্টের কাছে প্রেরিত হয়। তার পরীক্ষার ফলে জানা গিয়াছে তাহাতে রক্ত লাগিয়া ছিল, এবং সেই রক্ত মোহিতের স্ত্রীর রক্ত; অন্তত একই গ্রুপের রক্ত। ডাক্তারিতে যাহাকে AB গ্রুপের রক্ত বলে, সেই রক্ত।
খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী অবশ্য নাই, কিন্তু সব প্রমাণ মিলাইয়া অনিবার্যভাবে প্রতিপন্ন করা যায় যে, মোহিত নিজের স্ত্রীকে খুন করিয়াছে, এ বিষয়ে reasonable doubt-এর অবকাশ নাই।
আসামীকে প্রশ্ন করা হইল, তুমি দোষী কি নির্দোষ? মোহিত হাতজোড় করিয়া হাকিমকে বলিল, ‘হুজুর, আমি মহাপাপী। কিন্তু আমি আমার স্ত্রীকে খুন করিনি।’ বলিয়া অসহায়ভাবে কাঁদিতে লাগিল।
আসামী পক্ষের উকিল বলিলেন, ‘হুজুর, আমার মক্কেল বেকসুর, তাহার বিরুদ্ধে সাক্ষী-সাবুদ কিছুই নাই। সরকারী উকিল আগে নিজের কেস প্রমাণ করুন; আসামীর সাফাই এখন উহ্য রহিল, প্রয়োজন হইলে পরে হুজুরে দাখিল করিব।’
অতঃপর একে একে সাক্ষীরা আসিয়া জবানবন্দি দিতে লাগিল। অনেক সাক্ষী। গোপাল নিয়োগী এবং প্রতাপ চন্দ সাক্ষ্য দিলেন। কালীময়েরও সাক্ষ্য দিবার কথা, কিন্তু তিনি পূর্বেই পাবলিক প্রসিকিউটারের কাছে গিয়া নিজেকে ছাড়াইয়া লইয়াছিলেন। তিনি উকিল, তাঁহার যে তেজারতির কারবার আছে একথা প্রকাশ্য আদালতে প্রচার হইলে তাঁহার নিন্দা হইবে। পাবলিক প্রসিকিউটার বলিয়াছিলেন, ‘আপনাকে না হলেও চলে যাবে। দু’জন মাড়োয়ারী সাক্ষী আছে, তাদের দিয়ে কাজ চালিয়ে নেব।’
প্রথম দিন তিন চার জন সাক্ষীর এজেহার হইল। মোহিতের উকিল দীর্ঘকাল জেরা করিয়াও সাক্ষীদের টলাইতে পারিলেন না। সেদিনের মতো মোকদ্দমা শেষ হইলে মোহিতকে আবার লক্-আপে লইয়া যাওয়া হইল। সে জামানত পায় নাই।
আদালত হইতে ফিরিয়া কালীময় হাত মুখ ধুইয়া জলযোগ করিতে বসিলেন। ঘরে তিনি আর দামিনী ছাড়া আর কেহ নাই। দামিনী খাঁচায় ধরা-পড়া ইঁদুরের মতো ঘরের এদিক হইতে ওদিক ছটফট করিয়া বেড়াইতেছে, বাহির হইবার পথ খুঁজিয়া পাইতেছে না। সে জানে আজ হইতে মোহিতের মোকদ্দমা আরম্ভ।
কালীময় জলযোগ করিতে করিতে বলিলেন, ‘আজ দায়রা এজলাসে লোকে লোকারণ্য, তিল ফেলবার জায়গা ছিল না। সবাই মোহিতের মোকদ্দমা শুনতে এসেছে।’
দামিনী কথা বলিল না, তাহার অস্থিরতা যেন আর একটু বাড়িয়া গেল।
কালীময় আবার বলিলেন, ‘মোহিত বলল, সে মহাপাপী, কিন্তু বৌকে খুন করেনি।…হয়তো সত্যি কথাই বলেছে, হয়তো যে সময় তার বৌ খুন হয় সে সময়ে সে অন্য কোথাও ছিল। কিন্তু প্রমাণ করবে কি করে?’
দামিনীর ছটফটানি আরও বাড়িয়া গেল, কিন্তু মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না।
কালীময় দামিনীর মুখের পানে চোখ তুলিয়া বলিলেন, ‘মোহিত যদি প্রমাণ করতে না পারে যে, খুনের সময় অন্য কোথাও ছিল, তাহলে বোধহয় তার ফাঁসি হবে। রামরাখালবাবু বড় কড়া হাকিম—’
দামিনী হঠাৎ ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, যেন খাঁচার ইঁদুর পথ খুঁজিয়া পাইয়াছে।
পরদিন মোহিতের বিচারে আরও সাক্ষী আসিল। সরকারী ডাক্তার শব-ব্যবচ্ছেদের রিপোর্ট দিলেন; মাথায় ভারী ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে অন্নপূর্ণার মৃত্যু ঘটিয়াছে; মৃত্যুর সময় মধ্য-রাত্রির কাছাকাছি। অন্নপূর্ণার রক্ত AB গ্রুপের। AB গ্রুপের রক্ত খুবই বিরল, শতকরা তিনজনের মধ্যে পাওয়া যায়। অতঃপর পুলিসের যে দারোগা তদন্তের ভার পাইয়াছিলেন তিনি সাক্ষী দিলেন। দুই জন মাড়োয়ারী সাক্ষী দিল; খুনের রাত্রে আন্দাজ নটার সময় মোহিত তাহাদের কাছে টাকা ধার লইতে গিয়াছিল; কিন্তু তাহারা জানিত মোহিত জুয়াড়ী, তাই শুধু-হাতে টাকা ধার দেয় নাই, বলিয়াছিল, বন্ধকী দ্রব্য পাইলে টাকা ধার দিতে পারে। মোহিত চলিয়া গিয়াছিল, আর ফিরিয়া আসে নাই।
সাক্ষীদের জেরা শেষ করিতে করিতে দ্বিতীয় দিনের শুনানী শেষ হইল। সাক্ষীরা অটল রহিল।
তৃতীয় দিনের সাক্ষীরা ভাল করিয়া মোহিতের গলায় ফাঁসির দড়ি পরাইল। প্রথমে অভয় শিকদার আসিয়া মোহিতকে গ্রেপ্তার করিবার ইতিহাস বলিল, গ্রেপ্তারের সময় মোহিত পালাইবার চেষ্টা করিয়াছিল তাহাও উল্লেখ করিল। জংশন স্টেশনের পুলিস দারোগা মোহিতের বাড়ি সার্চ করিয়া সোনার হার পাইয়াছিলেন তাহা প্রকাশ করিলেন; সোনার হারে রক্ত-চিহ্ন লক্ষ্য করিয়া তিনি উহা খামে ভরিয়া তদন্তের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীর কাছে পাঠাইয়া দেন। হারটি একজিবিট রূপে কোর্টে দাখিল করা হইল।
অতঃপর আসিলেন সরকারী রাসায়নিক পরীক্ষক। তিনি বলিলেন, হারে যে-রক্ত লাগিয়াছিল তাহা তিনি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন; উহা মানুষের রক্ত এবং AB গ্রুপের রক্ত। শব-ব্যবচ্ছেদক ডাক্তারের সাক্ষ্যের সহিত মিলাইয়া কাহারও সন্দেহ রহিল না যে, মোহিত রক্ষিত রক্তাক্তদেহা মৃতা স্ত্রীর গলা হইতে হার খুলিয়া লইয়াছিল। এবং সে যদি খুন না করিয়া থাকে তবে ফেরারী হইল কেন? Reasonable doubt-এর কোনও অবকাশ নাই।
পাবলিক প্রসিকিউটার হাকিমকে বলিলেন, ‘হুজুর, আমার সাক্ষী শেষ হয়েছে, এবার আসামী-পক্ষ সাফাই পেশ করতে পারেন।’
আসামীর উকিল উঠিয়া বলিলেন, ‘হুজুর, সরকারী উকিল নিঃসংশয়ে প্রমাণ করতে পারেননি যে আসামী খুন করেছে। যাহোক, আজ আর সময় নেই। কাল আমি সাফাই সাক্ষী দাখিল করব। তারা প্রমাণ করবে যে খুনের রাত্রে আসামী অন্যত্র ছিল।’
আসামীর কাঠগড়ায় মোহিত একবার ভীত-ব্যাকুল চক্ষে চারিদিকে চাহিল, যেন চিৎকার করিয়া কিছু বলিতে চাহিল, তারপর দু’হাতে মুখ ঢাকিল।
উকিল কিরূপ সাফাই সাক্ষী দিবেন তাহা সে জানিত না। উকিল মোহিতের কাছে সত্য কথা জানিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু বিফল হইয়া নিজেই সাক্ষীর ব্যবস্থা করিয়াছিলেন।
সে-রাত্রে শয়নের পূর্বে কালীময় আলমারি হইতে হুইস্কির বোতল বাহির করিলেন। গেলাসে হুইস্কি ঢালিয়া তাহাতে জল মিশাইয়া গেলাস হাতে বিছানার পাশে আসিয়া বসিলেন। দামিনী শয়নের পূর্বে আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া মুখে ক্রীম মাখিতেছিল।
কালীময় বলিলেন, ‘মোহিতকে দেখে দুঃখ হয়। কী যেন বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। মোকদ্দমার অবস্থা ভাল নয়, বোধকরি ওর ফাঁসি হবে।’
দামিনী কালীময়ের দিকে মুখ ফিরাইল না, দু’হাতের আঙুল দিয়া মুখে ক্রীম ঘষিতে লাগিল।
কালীময় গেলাসে চুমুক দিয়া বলিলেন, ‘আমার কি মনে হয় জানো? এর মধ্যে স্ত্রীলোক-ঘটিত ব্যাপার আছে। মোহিতের সঙ্গে বোধ হয় কোনও কুলবধূর নটঘট ছিল। যে-রাত্রে খুন হয় সে-রাত্রে মোহিত তার কাছে গিয়েছিল, কিন্তু সে-কথা এখন বলতে পারছে না। এমন অনেক অপরাধ আছে। যা স্বীকার করার চেয়ে ফাঁসি যাওয়াও ভাল।’
দামিনী আলো নিভাইয়া দিয়া বিছানায় প্রবেশ করিল। কালীময় অন্ধকারে হুইস্কির গেলাস শেষ করিয়া শয়ন করিলেন। লেপের মধ্যে দামিনীর হাতে তাঁর হাত ঠেকিল; দামিনীর হাত বরফের মতো ঠাণ্ডা।
কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া কালীময় বলিলেন, ‘মোহিত লুচ্চা-লম্পট হোক, ওর মনটা ভদ্র। যার সঙ্গে ওর পিরিত তার কিন্তু উচিত এগিয়ে আসা, সকলের সামনে দাঁড়িয়ে বলা—মোহিত খুনের রাত্রে কোথায় ছিল। নিন্দে হবে, কলঙ্ক হবে; তবু একটা নির্দোষ মানুষের প্রাণ তো বাঁচবে। উচিত কিনা তুমিই বল।’
দামিনী লেপের ভিতর হইতে ফোঁস করিয়া উঠিল, ‘আমি কি জানি!’ মোহিতের মোকদ্দমা সম্বন্ধে এই সে প্রথম কথা বলিল।
কালীময়ের ইচ্ছা হইল শয্যা হইতে উঠিয়া গিয়া বাহিরের ঘরের চৌকির উপর রাত্রি যাপন করেন। কিন্তু—
সতীসাধ্বী স্ত্রী অপেক্ষা নষ্ট-স্ত্রীলোকের চৌম্বক-শক্তি আরও প্রবল।
চতুর্থ দিন মোহিতের উকিল আদালতে তিনটি সাফাই সাক্ষী পেশ করিলেন। সাক্ষী তিনটিকে দেখিলেই চেনা যায়, নাম-কাটা সেপাই। ভদ্রসন্তান হইলেও ইহারা সমাজের যে স্তরে বাস করে তাহাকে সমাজের অধমাঙ্গ বলা চলে। নেশা, জুয়া এবং সর্ববিধ অসাধুতা তাহাদের মুখে পোস্ট-অফিসের শিলমোহরের মতো কালো ছাপ মারিয়া দিয়াছে।
তাহারা একে একে আসিয়া সাক্ষ্য দিল যে, খুনের রাত্রে তাহারা তিনজনে মোহিতের সঙ্গে রাত্রি সাড়ে ন’টা হইতে একটা পর্যন্ত ব্রিজ খেলিয়াছিল। ব্রিজ খেলা জুয়া নয়, game of skill, সুতরাং জুয়াখেলা সম্বন্ধেও তাহার নিপাপ। শহরে একটি সিনেমা-মন্দির আছে, তাহারই সংলগ্ন একটি কুঠুরিতে বসিয়া তাহারা ব্রিজ খেলিয়াছিল। সিনেমা-মন্দিরের অ্যাসিস্টান্ট পুরোহিত তাহাদের বন্ধু, তাই উক্ত কুঠুরিতে বসিয়া তাহারা প্রায়ই তাস-পাশা খেলে। সেদিন রাত্রি একটার সময় মোহিত উঠিয়া বাড়ি চলিয়া যায়। তারপর কী ঘটিয়াছে তাহারা জানে না।
ইহাদের সাক্ষ্য ধোপে টিকিল না, পাবলিক প্রসিকিউটারের জেরায় ভাঙিয়া পড়িল। দেখা গেল, ব্রিজ খেলায় হরতন বড় কি চিড়িতন বড় তাহা তাহারা জানে না; সিনেমায় সেদিন কোন ছবি প্রদর্শিত হইতেছিল তাহাও তাহারা স্মরণ করিতে পারিল না। একজন সাক্ষী বলিয়া ফেলিল, সেদিনটা শুক্রবার ছিল কি শনিবার ছিল তাহা তাহার ঠিক স্মরণ নাই।
তিনটি সাক্ষীর এজেহার শেষ হইতে অপরাহ্ণ গড়াইয়া গেল। হাকিম রামরাখালবাবুর ললাটে ভ্রূকুটি জমা হইতেছিল, তিনি আসামীর উকিলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এরকম সাক্ষী আপনার আর ক’টি আছে?’
উকিল অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, ‘আজ্ঞে, আমার কেস ক্লোজ করলাম, আর সাক্ষী দেব না।’
‘ভাল।’ হাকিম একবার দেয়াল-ঘড়ির দিকে দৃক্পাত করিলেন, ‘এবার তাহলে আরগুমেন্ট শুরু করুন।’
—‘হুজুর!’
আসামীর উকিল বহস্ আরম্ভ করিবার পূর্বে কাগজপত্র নাড়াচাড়া করিতে করিতে জুনিয়রদের সঙ্গে নিম্নস্বরে কথা বলিতেছেন, এমন সময় কালীময় কোর্টের পিছনদিকের একটি বেঞ্চি হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘হুজুর, আমার কিছু বক্তব্য আছে। আমি এই মোকদ্দমায় কোর্টের পক্ষ থেকে সাক্ষী দিতে চাই।’
হাকিম চকিত ভ্রুভঙ্গি করিয়া মুখ তুলিলেন।
কালীময় কোর্টের সামনে আসিয়া সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠিলেন; হাকিমকে বলিলেন, ‘হুজুর, আমি একজন উকিল, এই শহরের বাসিন্দা, আসামীর প্রতিবেশী। মামলা সম্বন্ধে আমি কিছু জানি, হুজুরে তা পেশ করবার অনুমতি দেওয়া হোক।’
হাকিম কিয়ৎকাল স্থিরচক্ষে কালীময়কে নিরীক্ষণ করিলেন, তারপর ঘাড় নাড়িলেন।
কালীময়কে হলফ পড়ানো হইল। তিনি হাকিমের দিকে ফিরিয়া ধীর মন্থর কণ্ঠে বলিতে আরম্ভ করিলেন, ‘হুজুর, এই মামলার গোড়া থেকে আমি কোর্টে হাজির আছি, সব সাক্ষীর জবানবন্দি শুনেছি। সরকারী উকিল সাক্ষী-সাবুদ দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে গত ২৭ শে সেপ্টেম্বর রাত্রি আন্দাজ এগারোটার সময় মোহিত রক্ষিত তার স্ত্রী অন্নপূর্ণাকে খুন করেছে। হুজুর, অন্নপূর্ণাকে কে খুন করেছে আমি জানি না, কিন্তু আমি হলফ নিয়ে বলতে পারি সে-রাত্রে এগারোটার সময় মোহিত তার নিজের বাড়িতে ছিল না।’
কালীময় একটু থামিলেন। হাকিম গভীর ভ্রুকুটি করিয়া প্রশ্ন করিলেন, ‘কোথায় ছিল?’
কালীময় বলিলেন, ‘আমার বাড়িতে, হুজুর।’
হাকিম রামরাখালবাবুর অধরোষ্ঠ বিদ্রূপে বক্র হইয়া উঠিল, তিনি বলিলেন, ‘রাত্রি এগারোটার সময় আসামী আপনার বাড়িতে কি করছিল? আপনার সঙ্গে তাস খেলছিল?’
কালীময় ঈষৎ গাঢ়স্বরে বলিলেন, ‘না হুজুর, আমি বাড়িতে ছিলাম না।’
হাকিম ভ্ৰু তুলিলেন, ‘তবে?’
মাথা হেঁট করিয়া কালীময় বলিলেন, ‘আমি বাড়ি নেই জানতো বলেই মোহিত আমার বাড়িতে গিয়েছিল। মোহিত আমার স্ত্রীর উপপতি।’
কোর্ট-ঘরের মাথার উপর বজ্রপাত হইলেও এমন লোমহর্ষণ পরিস্থিতির উদ্ভব হইত না। কোর্টে উপস্থিত লোকগুলি যেন ক্ষণকালের জন্য অসাড় হইয়া গেল, তারপর পিছনদিকের ভিড়ের মধ্যে একটা চাপা কলরব উঠিল। হাকিম রামরাখালবাবুর কষায়িত নেত্রপাতে আবার তৎক্ষণাৎ কক্ষ নীরব হইল বটে, কিন্তু সকলের উত্তেজিত চক্ষু পর্যায়ক্রমে একবার কালীময়ের ও একবার আসামী মোহিত রক্ষিতের পানে ফিরিতে লাগিল। মোহিত কালীময়কে কাঠগড়ায় উঠিতে দেখিয়া কাঠ হইয়া গিয়াছিল, এখন দু’হাতে মুখ ঢাকিয়া বসিয়া রহিল।
রামরাখালবাবু সাক্ষীর দিকে ফিরিলেন, ‘আপনি বলছেন আপনি বাড়ি ছিলেন না।’
‘আজ্ঞে না, আমি রাত্রি আন্দাজ সাড়ে আটটার সময় চৌধুরীদের পুকুরে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম।’
‘হুঁ। তাহলে আপনি জানলেন কি করে যে আসামী আপনার বাড়িতে গিয়েছিল?’
‘আজ্ঞে, আমি আবার ফিরে এসেছিলাম। আমি দ্বিতীয়পক্ষে বিবাহ করেছি। কিছুদিন থেকে আমার সন্দেহ হয়েছিল যে আমার স্ত্রীর চালচলন ভাল নয়। তাই সেদিন যাচাই করবার জন্যে মাছ ধরার ছল করে বেরিয়েছিলাম।’
হাকিম কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, তারপর কড়া সুরে বলিলেন, ‘এতদিন একথা বলেননি কেন?’
কালীময় বলিলেন, ‘লজ্জায় বলতে পারিনি, হুজুর। নিজের স্ত্রীর কলঙ্কের কথা কে প্রকাশ করতে চায়? তা ছাড়া, মোহিত আমার বন্ধু নয়, আমার শত্রু, তাকে বাঁচাবার কোনও দায় আমার নেই। কিন্তু যখন দেখলাম তার ফাঁসির সম্ভাবনা অনিবার্য হয়ে পড়েছে তখন আর থাকতে পারলাম না। যত বড় পাপীই হোক, সে খুন করেনি।’
এই সময় মোহিত চাপা গলায় কাঁদিয়া উঠিল।
সরকারী উকিল উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘হুজুর, আমি সাক্ষীকে জেরা করতে চাই।’
হাকিম বলিলেন, ‘অবশ্য। কিন্তু আজ আর সময় নেই। কাল সকালে সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হবে।’
সেদিন কোর্ট উঠিল।
সন্ধ্যার সময় কালীময় গৃহে ফিরিলেন। মফঃস্বলের শহরে পরের কেচ্ছা হাওয়ার আগে ছোটে। কালীময় বাড়ি ফিরিয়া দেখিলেন, শয়নঘরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ। তিনি কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিলেন, কিন্তু দামিনী বাহির হইল না।
কালীময় বাহিরের ঘরে চৌকির উপর শয়ন করিয়া রাত্রি যাপন করিলেন।
আদালতের ভিড় প্রথম দিনের ভিড়কেও ছাড়াইয়া গিয়াছে; বিচার-গৃহ ছাপাইয়া, বারান্দা ছাপাইয়া উদ্বেল জনতা মাঠের উপর ছড়াইয়া পড়িয়াছে। আমরা কলিকাতার কয়েকজন সাংবাদিক রাত্রে খবর পাইয়া আসিয়া জুটিয়াছি এবং বিচারকক্ষে স্থান করিয়া লইয়াছি।
আসামীর কাঠগড়ায় মোহিতকে দেখা যাইতেছে না, সে কাঠগড়ার খাঁচার মেঝেয় বসিয়া সর্বজনের চক্ষু হইতে নিজেকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছে।
কালীময়ের জবানবন্দি আরম্ভ হইল। তিনি নূতন কিছু বলিলেন না, পূর্বে যাহা বলিয়াছিলেন তাহাই বিস্তারিত করিয়া বলিলেন।
মোহিতের উকিল অপ্রত্যাশিত সাক্ষী পাইয়া ভরাডুবি হইতে রক্ষা পাইয়াছিলেন, তিনি কালীময়কে জেরা করিলেন না। পাবলিক প্রসিকিউটার ডালকুত্তার মত কালীময়কে আক্রমণ করিলেন, সমধর্মী উকিল বলিয়া রেয়াৎ করিলেন না। কিন্তু তাঁহার জেরা ব্যর্থ হইল, কালীময়কে তিনি টলাইতে পারিলেন না।
সওয়াল জবাবের কিয়দংশ নিম্নে দিলাম। —
প্রশ্ন : কতদিন হল আপনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছেন?
উত্তর : বছর দুই হল।
প্রশ্ন : কবে আপনি জানতে পারলেন যে আপনার স্ত্রীর চালচলন ভাল নয়?
উত্তর : জানতে পারিনি, সন্দেহ করেছিলাম।
প্রশ্ন : কবে সন্দেহ করেছিলেন?
উত্তর : এই ঘটনার দু’চার দিন আগে।
প্রশ্ন : কী দেখে সন্দেহ হয়েছিল?
উত্তর : চালচলন দেখে।
প্রশ্ন : স্ত্রীকে এ বিষয়ে কিছু বলেছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : কেন বলেননি?
কালীময় জিজ্ঞাসুভাবে হাকিমের দিকে চাহিলেন। হাকিম বলিলেন, ‘প্রশ্ন অবান্তর। অন্য প্রশ্ন করুন।’
প্রশ্ন : আপনি বলেছেন সে-রাত্রে নিজের শোবার ঘরের জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতেছিলেন। ক’টা থেকে ক’টা পর্যন্ত আড়ি পেতেছিলেন?
উত্তর : আন্দাজ সওয়া দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত।
প্রশ্ন : এই পৌনে দু’ঘণ্টা আপনি চুপটি করে জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন?
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : ঘর অন্ধকার ছিল, কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : কিন্তু ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন?
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : ওরা বেশ জোরে জোরে কথা বলছিল?
উত্তর : না, চুপি চুপি কথা বলছিল।
প্রশ্ন : চুপিচুপি কথা বলা সত্ত্বেও আপনি আসামীর গলা চিনতে পারলেন?
উত্তর : শুধু গলা শুনে নয়, ওদের কথা থেকেও বুঝতে পেরেছিলাম।
প্রশ্ন : কী কথা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন?
উত্তর : আসামী একবার বলেছিল— ‘মোহিত রক্ষিত ভদ্রলোকের ছেলে, প্রাণ গেলেও ভদ্রমহিলার কলঙ্ক হতে দেবে না; মোহিত রক্ষিতের মুখ থেকে একথা কেউ জানতে পারবে না।’
প্রশ্ন : আর কি কি কথা শুনেছিলেন?
কালীময় চক্ষু নত করিয়া নীরব রহিলেন। হাকিম উকিলকে বলিলেন, ‘অন্য প্রশ্ন করুন।’
প্রশ্ন : যাক। আপনি যখন জানতে পারলেন যে আপনার স্ত্রী ব্যভিচারিণী, তখন আপনার রক্ত গরম হয়ে ওঠেনি? রাগ হয়নি?
উত্তর : হয়েছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে ভয়ও হয়েছিল।
প্রশ্ন : ভয় কিসের?
উত্তর : রাগের মাথায় ইচ্ছে হয়েছিল দোর ভেঙে ঢুকে দু’জনকেই ঠ্যাঙাই। কিন্তু ভয় হল, আমি একা, ওরা দু’জন— ওরা যদি আমায় খুন করে?
প্রশ্ন : তাই ফিরে গিয়ে মাছ ধরতে লাগলেন?
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : (ঘৃণাভরে) আপনি মানুষ না কেঁচো!
কালীময় নীরব রহিলেন। হাকিম কড়া স্বরে সরকারী উকিলকে বলিলেন, ‘আপনি বার বার Evidence Act-এর বাইরে যাচ্ছেন। এসব প্রশ্ন অবান্তর এবং অসঙ্গত। আপনার যদি আর কোনও প্রশ্ন না থাকে, আপনি বসে পড়ুন।’
‘আর একটা প্রশ্ন, হুজুর’—সরকারী উকিল সাক্ষীর দিকে ফিরিলেন।
প্রশ্ন : আপনার স্ত্রী এখনও আপনার বাড়িতেই আছে?
উত্তর : আজ সকাল পর্যন্ত ছিল।
প্রশ্ন : এই ব্যাপারের পর তার সঙ্গে আপনার সম্বন্ধ কী রকম?
হাকিম আবার ধমক দিয়া উঠিলেন— ‘অসঙ্গত—অবান্তর। কেসের সঙ্গে প্রশ্নের কোনও সম্বন্ধ নেই।’
কালীময় হাকিমের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘হুজুর, প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার আপত্তি নেই।— আমি প্রৌঢ়, যুবতীকে বিবাহ করা আমার উচিত হয়নি। তাই যখন স্ত্রীর স্বভাব-চরিত্রের কথা জানতে পারলাম তখন মনে মনে স্থির করেছিলাম, কোনও রকম হাঙ্গামা না করে চুপিচুপি ওকে ত্যাগ করব। কিন্তু মাঝখান থেকে এই খুনের মামলা এসে সব গণ্ডগোল করে দিল।’
সরকারী উকিল একবার হাকিমের মুখ দেখিলেন, একবার জুরীদের মুখ দেখিলেন; তাঁদের মনের ভাব বুঝিতে তাঁহার বিলম্ব হইল না। মামলার হাল একেবারে উল্টাইয়া গিয়াছে। তিনি আর প্রশ্ন না করিয়া বসিয়া পড়িলেন।
ইতিমধ্যে মোহিতের উকিল গিয়া মোহিতের সঙ্গে কথা বলিয়া আসিয়াছিলেন, তিনি উঠিয়া বলিলেন, ‘হুজুর, এবার আসামী নিজের মুখে তার statement দেবে।’
কোর্টের সকলে শিরদাঁড়া খাড়া করিয়া বসিল।
মোহিত ধীরে ধীরে কাঠগড়ায় উঠিয়া দাঁড়াইল। দাড়ি গোঁফ ও রুক্ষ চুলের ভিতর হইতে তাহার মুখখানা দেখিয়া মনে হয়, সে একটা পাগলা ভিখারী। কাঁদিয়া কাঁদিয়া চোখদুটা জবাফুলের মতো লাল। সে হাতজোড় করিয়া ভগ্নস্বরে বলিতে আরম্ভ করিল, ‘ধর্মাবতার, আমি মহাপাপী, ফাঁসিই আমার উপযুক্ত শাস্তি। কিন্তু আমি আমার স্ত্রীকে খুন করিনি। কালীময়বাবু যা বলেছেন তার একবর্ণও মিথ্যে নয়। তিনি যদি এসব কথা না বলতেন তাহলে আমিও চুপ করে থাকতাম। কিন্তু এখন চুপ করে থাকার কোনও সার্থকতা নেই।
‘সে-রাত্রে আন্দাজ বারোটার সময় আমি নিজের বাড়িতে ফিরে যাই। গিয়ে দেখলাম, সদর দরজা খোলা, সামনের ঘরে আলো জ্বলছে, আমার স্ত্রী অন্নপূর্ণা মেঝেয় মরে পড়ে আছে। আমি ভয়ে দিশাহারা হয়ে গেলাম। ভাবলাম আমাকেই সবাই খুনী বলে সন্দেহ করবে; অন্নপূর্ণার সঙ্গে আমার সদ্ভাব নেই, একথা সবাই জানে। প্রাণ বাঁচাবার একমাত্র উপায় পালিয়ে যাওয়া।
‘কিন্তু আমার পকেটে মাত্র দু’তিন টাকা আছে, দু’তিন টাকায় কতদূর পালাতে পারব? আমি অন্নপূর্ণার গলা থেকে হার খুলে নিয়ে পালালাম। তাতে যে রক্ত লেগে আছে তা জানতে পারিনি।
‘সেই রাত্রেই জংশনে পৌঁছুলাম। কিন্তু সেখান থেকে দূর-দেশে যেতে হলে টাকা চাই। জংশনে কাউকে চিনি না, কার কাছে হার বিক্রি করব? রবিবার সারাদিন জংশনে লুকিয়ে রইলাম, কিন্তু হার বিক্রি করার সাহস হল না। ভয় হল, হার বিক্রি করতে গেলেই ধরা পড়ে যাব।
‘সোমবার দিনটাও জংশনে কাটল। তারপর সন্ধ্যেবেলা ধরা পড়ে গেলাম। হুজুর, এই আমার বয়ান। আমি যদি একটি মিথ্যেকথা বলে থাকি, আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়।’
রুদ্ধশ্বাস বিচারগৃহে আসামীর উকিল ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘হুজুর, এর পর আমি আর একটা কথাও বলতে চাই না। সরকারী উকিল তাঁর ভাষণ দিতে পারেন।’
সরকারী উকিল দীর্ঘ ভাষণ দিলেন। ভাষণ শেষ হইবার আগেই লাঞ্চের বিরাম আসিল, বিরামের পর তিনি আবার ভাষণ চালাইলেন। কালীময় যে মিথ্যা-সাক্ষী, নিজের নাক কাটিয়া পরের যাত্রাভঙ্গ করিতেছেন, এই কথা তিনি বার বার জুরীকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন। তাঁহার কথা কিন্তু কাহারও মনে স্থান পাইল না; তাঁহার বক্তৃতা শেষ হইলে হাকিম জুরীদের মামলার মোদ্দাকথা বুঝাইয়া দিলেন। জুরী উঠিয়া গিয়া পাঁচ মিনিট নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করিলেন, তারপর ফিরিয়া আসিয়া রায় দিলেন— আসামী নির্দোষ।
হুইস্কির বোতলটি নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছিল, তলায় মাত্র দুই আঙুল পরিমাণ তরল দ্রব্য ছিল। রাত্রি দশটা বাজিতে বেশী দেরি নাই। কালীময়বাবুর বসিবার ঘরে বোতল মাঝখানে রাখিয়া আমরা দু’জনে মুখোমুখি বসিয়া আছি। আমার মাথার মধ্যে রুমঝুম নূপুর বাজিতেছে, কিন্তু, বুদ্ধিটা পরিষ্কার আছে। কালীময় রক্তাভ নেত্রে মদের বোতলটার দিকে চাহিয়া আছেন।
আমি বলিলাম, ‘তার পর?’
কালীময় বোতল হইতে চক্ষু সরাইলেন না, বলিলেন, ‘কাল কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখলাম দামিনী পালিয়েছে। কোথায় গেছে জানি না। হয়তো দূর সম্পর্কের ভায়ের কাছেই ফিরে গেছে।’
‘আর মোহিত?’
‘সে আছে। কাল রাত্রে এসেছিল, পায়ে ধরে মাপ চেয়ে গেল।’
কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না। আমার মাথার মধ্যে রুমঝুম শব্দের সঙ্গে একটা বেতালা চিন্তা ঘুরিতেছে। শেষে বলিলাম, ‘একটা প্রশ্নর কিন্তু ফয়সালা হল না।’
কালীময় আমার পানে রক্তাক্ত চোখ তুলিলেন।
বলিলাম, ‘অন্নপূর্ণাকে খুন করল কে?’
কালীময় নির্নিমেষ আমার পানে চাহিয়া রহিলেন।
বলিলাম, ‘আপনি সে-রাত্রে লোহার ডাণ্ডা নিয়ে আড়ি পাততে এসেছিলেন। আদালতে লোহার ডাণ্ডার কথা কিন্তু বলেননি।’
কালীময় আরও কিছুক্ষণ আমাকে স্থিরনেত্রে নিরীক্ষণ করিলেন, ‘তোমার বিশ্বাস আমি অন্নপূর্ণাকে খুন করেছি!’
বলিলাম, ‘বিশ্বাস নয়, সন্দেহ। আপনি পৌনে দু’ঘণ্টা জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন, একথা মেনে নেওয়া শক্ত। আপনি কেঁচো নয়, মানুষ।’
হঠাৎ কালীময় হুইস্কির বোতলটা ধরিয়া নিজের গেলাসের মধ্যে উজাড় করিয়া দিলেন। তাহাতে জল মিশাইলেন না, নিরম্বু তরল আগুন গলায় ঢালিয়া দিলেন। আমি অপেক্ষা করিয়া রহিলাম।
তিনি বলিলেন, ‘হ্যাঁ, অন্নপূর্ণাকে আমি খুন করেছিলাম। তোমাকে বলছি, কিন্তু তুমি যদি অন্য কাউকে বল, আমি অস্বীকার করব। আমার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই।’
আমার মাথার মধ্যে বেতালা চিন্তাটা এবার তালে নাচিয়া উঠিল। প্রশ্ন করিলাম, ‘অন্নপূর্ণাকে খুন করলেন কেন? সে তো কোনও অপরাধ করেনি।’
কালীময় বলিলেন, ‘তাকে খুন করবার মতলব ছিল না। নিজের ঘরের ব্যাপার দেখে মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল। আমি গিয়েছিলাম প্রতিশোধ নিতে।’
‘প্রতিশোধ নিতে!’
‘হ্যাঁ। মোহিত আমার মুখে চুনকালি দিয়েছে, তাই আমি গিয়েছিলাম তার গালে চুনকালি দিতে। কিন্তু অন্নপূর্ণা অন্য জাতের মেয়ে, সে দামিনী নয়। আমার মতলব যখন সে বুঝতে পারল তখন আমার কোঁচা চেপে ধরে বললো, ‘তবে রে হাড়-হাবাতে অলপ্পেয়ে মিনসে, তোর মনে এত ময়লা! দাঁড়া তোর পিণ্ডি চট্কাচ্ছি!’ এই বলে সে আমার কোঁচা ধরে প্রাণপণে চেঁচাতে লাগল— ‘মেরে ফেললে! মেরে ফেললে!’—তখন আর আমার উপায় রইল না, এখনি চিৎকার শুনে পাড়াপড়শী এসে পড়বে। হাতে লোহার ডাণ্ডা ছিলই—’
অনেকক্ষণ নীরবে কাটিয়া গেল। শেষে আমি উঠিবার উপক্রম করিলাম; বলিলাম, ‘আচ্ছা, রাত হয়ে গেছে, আজ তাহলে উঠি।’
কালীময় চকিতে চোখ তুলিলেন, তাঁহার মুখ হইতে স্মৃতির গ্লানি মুহূর্তে মুছিয়া গেল। তিনি বলিলেন, ‘এত রাত্রে কোথায় যাবে? আজ এখানেই থেকে যাও। খিদে পেয়েছে? দেখি রান্নাঘরে কিছু আছে কিনা।’
১১ কার্তিক ১৩৬৫