2 of 3

সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকার

কোনও বৃদ্ধা বাঙালিনী যে এমন সাহেবি কায়দায় চোস্ত হতে পারেন আদিত্যের বাবার রাঙামামিমাকে না দেখলে বিশ্বাস করাই দায়। সধবা অবস্থায় দেখেছিল আদিত্য লালপাড় গরদের শাড়ি, কপালে ফুল-মুন সাইজের সিদুরের ফোঁটা অথচ তার চালচলন যেকোনও মেমসাহেবকে লজ্জা দিতে পারে। তার ছুরি কাঁটা চালানো দেখলে তাকে অনায়াসে মহিলা সব্যসাচী বলা যায়। বাবার রাঙামামা তখন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ইঞ্জিনিয়র, তাঁর সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরতে হত মাধুরীদিদিমা অর্থাৎ বাবার ওই রাঙামামিমাকে। একবার এক ডাকবাংলোয় কী ভীষণ আরশোলা, আর আরশোলা মানেই, সব মেয়েদের যা হয়ে থাকে মাধুরীদিদিমারও তাই; ঝাকে ঝাকে আরশোলা উড়ছে, বসছে। আর ঘরের এককোণায় দরজার হুড়কো হাতে দিদিমা শশব্যস্ত। হুড়কোতে তেমন জুত হল না, রাতে শোবার সময় খাবার টেবিলের ছুরিকাটা নিয়ে শুলেন, তারপর সারারাত চলল নিপুণহাতে ছুরিকাঁটা, পরদিন সকালে আদিত্যের বাবার রাঙামামা মানে মাধুরীদিদিমার স্বামী গুনে দেখেছিলেন রাতে ছুরির আঘাতে খণ্ডিত হয়েছে একশো সাতাশটা আর কাটায় বিদ্ধ হয়েছে তিনশো এগারোটা আরশোলা, খাটের নীচে মরে ছড়িয়ে রয়েছে।

সেই মাধুরীদিদিমার ওখানে গিয়ে উঠল আদিত্য। একেবারে বাক্স-বিছানা নিয়ে। সোনাপিসিমা বলে দিয়েছিল, চাকরি না পেলে বাড়ি ছাড়বি না কিছুতেই, রাঙামামিমা এত লোককে কাজ জুটিয়ে দিলেন আর তোকে দিতে পারবেন না! একেবারে ঘাড়ে চেপে বসবি, কত সাহেবসুবো ওর হাতের মুঠোর মধ্যে, কাজ নিয়ে তবে বাড়ি ছাড়বি।

 আদিত্য তাই করল, চলে এলাম দিদিমা, তোমার এখানে।

 ভালই করেছিস,কানের কাছের পাকা চুলগুলোয় কী একটা লালরঙের বিলিতি তেল ব্রাশ দিয়ে মাখাতে মাখাতে দিদিমা বললেন, টমিটা মরে যাওয়ার পর থেকে কী যে মনমরা হয়ে আছি। তোর বাবা থাকতে তবু এক-আধটু খোঁজখবর নিত, তোরা ভুলেও এদিকে মাড়াস না।

টমির উল্লেখে আদিত্য একটু আহত হল, টমি কুকুরের নাম। শুধু সেই জন্যে নয়; ছোটবেলায় যখন আদিত্য একবার বাবার সঙ্গে বিজয়ার প্রণাম করতে এসেছিল, এই কুকুরটা তার হাঁটুর ওপর এমন কামড়ে দিয়েছিল যে এখনও দুটো দাঁতের ছাপ স্পষ্ট হয়ে রয়েছে। হাঁটুর ওপরে সেই জায়গাটায় হাত বোলাতে বোলাতে আদিত্য তেরো বছর আগে মরে যাওয়া লোম উঠে যাওয়া কানে ঘা-ধরা একটা পাজি খ্যাক খ্যাক বিলিতি কুকুরের শোকে মুখে যতটা করুণ ভাব আনা উচিত তার চেয়ে কিছু বেশিই ফুটিয়ে তুলল।

মাধুরীদিদিমা বোধহয় খুশিই হলেন, বেয়ারাকে ডেকে বললেন, আদিত্যর জিনিসপত্র পশ্চিমমুখো ঘরটাতে রাখবি, অ্যাডেন সাহেব এলে তো ওই ঘরের জানলা দুটোর মুখোমুখি থাকতেন। তারপরে এতকাল টমি থাকল, সেবার বর্ষাকালে কী একটা পোকার অত্যাচারে জামগাছ তিনটেই শুকিয়ে মরে গেল আর টমিটাও বাঁচল না।

এবার আদিত্যের মুখে তিনটে জামগাছের শাক যোগ করতে হল টমিকুকুরের শোকের সঙ্গে। তারপর যেন কোনও শোকযাত্রায় যোগদান করেছে এই রকম ভঙ্গিতে বেয়ারার পিছু পিছু উঠে গেল দোতলায় তার জন্যে নির্দিষ্ট ঘরের দিকে।

রাতে খাওয়ার টেবিলে মাধুরীদিদিমাকে কথাটা বলল আদিত্য, একটু আমতা আমতা করেই বললে, দিদিমা, আজ পাকা দেড় বছর পাশ করার পর বসে আছি, তোমার তো এত সাহেবসুবোর সঙ্গে ভাবসাব, একটা কিছু কাজ-টাজ জুটবে না আমার?

আমার কি আর সেদিন আছে রে? আদিত্যর দাদু যখন বেঁচেছিল, অ্যাডেন সাহেব প্রত্যেক ইয়ারে এ বাড়িতে আসত, আমাকে দেখলেই বলত সুইটি, আর টমিকে বলত লেজি চ্যাপ। টমিকে তো ও-ই দেশ থেকে এনে দিয়েছিল। নটিংহামে ওর দেশের বাড়ির বারান্দায় তোলা টমির মাকে কোলে নিয়ে ওর মায়ের ছবি এখনও আমার গরম কাপড়ের বাক্সে রয়েছে। পোকায় কেটে দিচ্ছে বলে ন্যাপথলিন দিয়ে রেখে দিয়েছি। ভাদ্রমাসে একবার করে রৌদ্রে দিই। তুই দেখবি? মাধুরীদিদিমা উঠে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন, মিনিট পনেরো পরে একটা কাঁচখোলা ফ্রেমে ফটোটা নিয়ে এলেন। এখন আর ফটো বলা উচিত নয়, পুরোটাই উঠে গেছে। দিদিমা আঙুল দিয়ে বোঝালেন, এইখানে টমির মায়ের ফটো ছিল, এই যে অল্প একটু বাঁকানো মতো দেখছ এইটা ওর লেজ আর এই অ্যাডেনের মায়ের কাঁধের বাঁ দিকটা দেখা যাচ্ছে।

ও। তাই তো?উৎসাহের ভাব নিয়ে আদিত্য খুব মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখল। কিন্তু চাকরির কথাটা?

দিন সাতেক এইভাবে চলল। যখনই কাজের কথা ওঠে, টমি কুকুর আর অ্যাডেন সাহেব এসে পড়ে। নিঃসন্তান বিধবার আর কীই বা বলবার থাকতে পারে। আদিত্য যেন অর্ধেক হয়ে পড়ল। বাবার মামাবাড়িতে কতদিন বেকার বসে থাকা যায়?

একদিন দিদিমা বললেন, কাজ পাওয়া কি সোজা? এলি না অ্যাডেন সাহেবের আমলে, তোকে খাঁটি বিলিতি কোম্পানিতে ঢুকিয়ে দিতাম। পার্থ, তোর বাবার মাসতুতো ভাই, জেনারেল ম্যানেজার হয়ে রিটায়ার করল গতবার। অ্যাডেন সাহেবকে বলে আমিই তো ঢুকিয়েছিলাম।

 আদিত্য মনে মনে ভাবে, একটা কুকুর কতদিন বাঁচে। তেরো বছর আগে যে কুকুরটা মরে গেছে, সেটাকে যে-সাহেব দিয়েছিলেন, যে-সাহেব তার পার্থকাকাকে চাকরিতে ঢুকিয়েছিলেন, সেই সাহেবের আমলে মাধুরীদিদিমার কাছে থাকতে গেলে তাকে সোজা প্যারাম্বুলেটার চড়ে কাজে আসতে হত।

আমি নিজের পায়ে দাঁড়ানো শেখবার আগেই অ্যাডেন সাহেব কিন্তু বিদায় নিয়েছেন দিদিমা। আদিত্য বিনীতভাবে জানায়।

মাধুরীদিদিমা একটু করুণ হেসে বললেন, সেসব কি আজকের কথা নাকি। সে বছরই, অ্যাডেন সাহেব যেবার শেষবার হোমে চলে গেলেন, টমিটা ডাক-পিওন ভেবে একটা বিটের সেপাইকে কামড়ে দিয়ে আমাদের কী গোলমালে ফেলেছিল! ভাগ্যিস তোর দাদু তখন বেঁচে!

এর মধ্যে মাধুরীদিদিমা একটা পরামর্শ দিলেন আদিত্যকে, আদি, শোন, একটা খাকি হাফপ্যান্ট, জামা আর সাদা ক্যানভাসের সু কিনে আন। আমাদের এই আলিপুর থেকে গড়ের মাঠ কতটুকুই বা দূর, আর্লি মর্নিং-এ উঠে চলে যাবি, তারপর ওই প্যান্ট আর সু পরে ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে দৌড়োবি।

কেন দিদিমা, আমার স্বাস্থ্য তো ভালই। আর অত ভোরে ঘুম থেকে ওঠা বাবা আমার কর্ম নয়, এত কষ্ট আমার সইবে না। আদিত্য আপত্তি জানায়।

কষ্ট না করলে তো চাকরি হবে না আদি। জানিস, মরার আগের দিন পর্যন্ত টমি, যত দূরই ছুঁড়ে দিই না কেন, দৌড়ে আমার হাতে বল তুলে এনে দিয়েছে।

আদিত্য এখন আর টমির প্রসঙ্গ তুলনায় আহত হয় না কিন্তু ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে দৌড়ালে কি চাকরি হবে?

তা হবে না কেন? কত লোক তো এভাবেই কাজ পেল, সকালে ওখানে কত লাটবেলাট, রাজা, জমিদার মর্নিং ওয়াক করতে যায় তারা দেখবে এডুকেটেড ইয়ং বেঙ্গলি হেলথের ওপর নজর দিচ্ছে, তাদেরও নজর পড়বে তোর ওপর চাই কি তোর কপাল খুলে যেতে পারে। দিদিমা খুব বিশ্বাসের সঙ্গেই কথাগুলো বলেন।

রাজা জমিদার কবে দেশছাড়া হয়ে গেছে, আর লাটবেলাটও নেই, থাকলেও তারা আর গড়ের মাঠে মর্নিং ওয়াক করে না। আজকাল ওখানে যত বাজে লোক যায়, তারা আমাকে বড়জোর ভূষিমালের গোডাউন ক্লার্কের চাকরি দিতে পারে, একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে আদিত্য বলে, তা পেলেও হয়, কিন্তু তাও পাওয়া যাবে না ওদের কাছ থেকে।

মাধুরীদিদিমা অবুঝ নন, কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে বললেন, ঠিকই বলেছিস সেদিন কি আর আছে রে আদিত্য, অ্যাডেন সাহেবও চলে গেলেন, আর দেশটা বাজে লোকে ভরে গেল, টমিটা পর্যন্ত মরে গেল। আদিত্যের ভাগ্য আজ প্রসন্ন বলতে হবে, মাধুরীদিদিমা কী ভেবে একটু পরে উঠলেন, তারপর ময়লা, মলাট ছেঁড়া একটা পুরনো ডায়েরি এনে আদিত্যকে দিলেন। আদিত্য দেখল সেটা চুয়াল্লিশ সালের একটা ডায়েরি, অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া কালিতে কিছু কিছু ঠিকানা আর ফোন নম্বর লেখা। অর্ধেক রাস্তার নাম এখন পালটে গেছে, আর বি বি, পি কে, এসব ফোন নম্বরই বা কোথায়? মাধুরীদিদিমা বলেন, ঠিকানাগুলো পড়ে যা তো আদি।

কষ্ট করে, অনুমান করে কয়েকটা ঠিকানা পড়ল আদিত্য। মাধুরীদিদিমা শোনেন আর বলেন, ফুলটন সাহেবও তো মরে গেছে, বাপু! কী বললি, এম কে বসু, ওরা তো বাড়ি পালটেছে, এখন। আর ভবানীপুরের বাড়িতেই নেই, নতুন ঠিকানা নেই? না? ফ্রেমজিসাহেব, সে তো কানপুর চলে গেছে শুনেছি। কী নাম পড়লি, গোপাল গাঙ্গুলি, চিনতে তো পারছি না, ওটা কী, ও ভরদ্বাজ দাস, সোমসাহেবের ভাগ্নে বোধহয়। কী ঠিকানা? আচ্ছা দাগ দিয়ে রাখ তো।

এইরকম ভাবে ছয়টা ঠিকানায় দাগ পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে পোস্টকার্ড আনিয়ে প্রত্যেককে চিঠি দিলেন দিদিমা। কী লিখলেন কী জানি। একটা চিঠিরও উত্তর এল না, ঠিকানাই কি ঠিক আছে, আদিত্য আশা প্রায় ছেড়ে দিল। সেই সময়ে একদিন এক উর্দিপরা বেয়ারা এসে চিঠি দিয়ে গেল, কে এক ডাবলু. লালওয়ানি চিঠি দিয়েছে, তার বাবাকে লেখা চিঠি সে পেয়েছে, তার বাবা আজ প্রায় পনেরো বছর গত হয়েছেন, কিন্তু মাধুরীদিদিমাকে সে চেনে, ছোটবেলায় তার কথা অনেক শুনেছে, দেখেওছে দু-একবার। এ বাড়িতে একবার এসেওছিল মায়ের সঙ্গে। মাধুরীদিদিমার যদি কোনও কাজ তাকে দিয়ে হয় সে খুব খুশি হয়েই করবে।

 মাধুরীদিদিমা চিঠিটা পড়ে একটু আনমনা হয়ে বসে রইলেন। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, তাহলে ও হল ঝুমেলার ছেলে। ঝুমেলার তো এই সেদিন বিয়ে হল, কী সুন্দরী ছিল ঝুমেলা, সব হিরের গয়না বেনারসি ছাড়া পরত না, তার ছেলে এত বড় হয়েছে! আদিত্যের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তুই ওর সঙ্গে গিয়ে একদিন আমার নাম করে দেখা করে আয়।

আদিত্য বলল, তার চেয়ে তুমি ব্যাপারটা লিখে জানাও, তারপরে আমি যাই, প্রথমেই হুট করে যাওয়াটা ঠিক হবে না।

আবার চিঠি গেল, এবার খুব তাড়াতাড়ি উত্তর এল। আশাতীত উত্তর, আমাদের এখানে দু-একদিনের মধ্যেই কিছু নতুন লোক নেওয়া হবে, তোমার নাতিকে দরখাস্ত পাঠাতে বল। সঙ্গে সঙ্গে দরখাস্ত; আর প্রিপেড টেলিগ্রামের মতো ইন্টারভিউ লেটার এসে গেল আদিত্যের।

বেশ বড় সাহেবি ফার্মের ঝকঝকে বন্ড কাগজে সুন্দর করে ছাপানো প্যাডে সাক্ষাৎকারের জন্য বিনীত অনুরোধ। আদিত্য যাকে বলে আহ্লাদিত হয়ে উঠল।

কিন্তু বাদ সাধলেন মাধুরীদিদিমা, তোর স্যুট আছে তো আদি?

স্যুট পাব কোথায় দিদিমা, দুটো প্যান্ট আছে। দেখছই তো।

আদিত্যের কথা শুনে মাধুরীদিদিমা যেন চমকে উঠলেন, এই প্যান্ট পরে ইন্টারভিউ হয় নাকি! সাহেবদের কোম্পানি, ঢুকতেই দেবে না খালিগায়ে।

খালিগায়ে কেন, শার্ট গায়ে দেব তো। আদিত্য বলে।

কোট না থাকলে ওই খালিগায়ে হল। তোর তো টাই-ও নেই। মাধুরীদিদিমা উঠে পাশের ঘরে গেলেন, অনেকক্ষণ ধরে খুটখাট কী সব শব্দ হতে লাগল। তারপর একটা কোঁচকানো ইস্তিরি ভাঙা কোট-প্যান্ট হয়তো হবে আর একটা পোকায় খাওয়া লাল পদ্ম আঁকা নেকটাই নিয়ে ফিরলেন। তোর দাদুর জিনিস, র‍্যাঙ্কেন থেকে তৈরি সব, দ্যাখ তো তোর লাগে নাকি?

এগুলো গরমের নাকি? আদিত্য হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করে।

তাতে কী? দু ঘণ্টার তো মাত্র ব্যাপার, যাবি আর ফিরে এসে ছেড়ে ফেলবি।

ভাদ্র মাসের দুপুরে গরম স্যুট পরে দেখতে হাঁদা লাগে কি না। ঠিক লাগল না, তবে কী আর করা যাবে, দেখাই যাক না, একবার কাচিয়ে নিতে হবে, হাতে আর তিনদিন সময় আছে, আর টাই, টাই তো কখনওই ব্যবহার করেনি আদিত্য, একবার চেষ্টা করেছিল। কেমন গলা বন্ধ হয়ে আসে। টাই-ও পরতে হবে নাকি?

স্যুট পরবি, টাই পরবি না, কুকুরে কামড়িয়ে দেবে যে। যা তোক মাধুরীদিদিমার কথামতো চলতে হবে, স্যুটটা কাঁচতে দিয়ে এল, আর্জেন্ট, সাত টাকা লাগবে আর সেই সঙ্গে সস্তা একটা তিন। টাকা দামের টাই কিনে নিয়ে এল চৌরঙ্গির ফুটপাথ থেকে।

ঝুলটা একটু কম, পিঠের কাছটা একটু বেশি ভোলা, হাতা দুটো একটু টানাটানা, পুরানো ডবল ব্রেস্ট ছয় বোতামের কোট আর মাজার কাছে একটু আঁটসাঁট প্যান্ট, শেষ বর্ষার গরমে ঘেমে নেয়ে উঠল আদিত্য গরম স্যুট পরে। টাই বাঁধা ব্যাপারটা যে এত জটিল, এত রহস্যকর সেটাও আবিষ্কৃত হতে সময় লাগল না। মাধুরীদিদিমা সামনে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ করে দেখছিলেন, আদিত্যের কাজকারবার দেখে একটু ঠোঁট টিপে হেসে তারপর টাইটা নিজের হাতেই বেঁধে দিলেন। খুব যত্ন নিয়ে বেশ শক্ত করে বেঁধে দিলেন, এবার আয়নায় নিজেকে দ্যাখ। ঘামতে ঘামতে নিজেকে দেখল আদিত্য, তা মোটামুটি ভালই দেখাচ্ছে। আয়নায় নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে একটু সলজ্জ হাসল আদিত্য। মাধুরীদিদিমা চিবুকে একটা আলতো করে চুমু দিয়ে বললেন, দুর্গা, দুর্গা। আদিত্য বেরিয়ে পড়ল।

লিফটে করে ছয়তলার ওপরে একটা ওয়েটিং রুমে আর পাঁচজন বসে। আদিত্যও গিয়ে বসল। বহু ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি না পেয়ে পেয়ে খুব পাকাঁপোক্ত হয়ে গেছে আদিত্য। তবু এখনও বুক। কাঁপে, তারপরে সাহেবি ফার্মে ইন্টারভিউ এই প্রথম। ওঃ যাঃ, আজকের কাগজ তো দেখে আসা হয়নি এত গোলমালের মধ্যে। যদি এরা আজকের খবর-টবর কিছু জিজ্ঞাসা করে, আর তাই তো করবে, তা ছাড়া কী করতে পারে? আদিত্য ভাবতে ভাবতে ঘামতে ঘামতে ভাবতে থাকে।

হঠাৎ সামনের ভদ্রলোক তার ব্যাগ খুলে একটা খবরের কাগজ বার করে পড়তে লাগল। চাইব, চাওয়া কি উচিত হবে। সাহেব কোম্পানির ইন্টারভিউতে নাকি সব সময়েইনজর রাখে, এই ওয়েটিং রুমেও রাখছে কিনা, যাকগে ভদ্রলোক যে পাতাটা পড়ছেন তারই উলটোপাতাটা তার সামনে, সেটা খুব মন দিয়ে পড়তে লাগল। কতটুকু বা পড়া গেল, যেটুকু অংশে চোখ ফেলতে পারল সেটুকুই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার পড়ে মুখস্থ হয়ে গেল। ভদ্রলোক পাতাটা ওলটাতে যাচ্ছিলেন, আদিত্য পরের পাতাটার জন্যে বুভুক্ষুর মতো অপেক্ষা করছে, এমন সময় ডাক পড়ল, প্রথমেই আদিত্যকে ডাকল। আমাকেই প্রথমে কেন, বোধ হয় বর্ণানুক্রমিক সাজিয়েছে, ভাবতে ভাবতে আদিত্য উঠল।

এখানে আবার ইংরেজিতে বাক্যালাপ করতে হবে, কতক্ষণ, কে জানে? মনে মনে কয়েকটা ইংরেজি বাক্য রচনা করতে করতে ধীর পদক্ষেপে আদিত্য বেয়ারার পিছু পিছু এগিয়ে গেল। কী প্রশ্ন করবে, ইংরেজি ব্যাপারটা এত খটমটে, তা ছাড়া এই গরম স্যুট, এই ভাদ্রমাস, এই দম বন্ধ হয়ে আসা টাইয়ের নট, আদিত্য জীবনে কোনওদিন, সারাজীবনে একসঙ্গে এত ঘেমেছে কিনা। সন্দেহ।

বিরাট গোলটেবিলের ওপাশে চারজন কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক। একজন খুব অল্প বয়েসি, আদিত্যরই সমবয়েসি হবে, বেশ সুন্দর দেখতে হবে, ওই বোধহয় লালওয়ানি হবে, রুমাল দিয়ে কপাল মোছা ভব্যতা হবে কিনা স্থির করতে না পেরে কোটের হাতা দিয়ে কপাল, গলা মুছতে মুছতে আদিত্য বসল। প্রাথমিক বাক্যালাপ, নাম ঠিকানা, একটু জড়িয়ে জড়িয়ে উত্তরগুলো দিল।

কিন্তু দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে, টাইয়ের বাঁধনটা মাধুরীদিদিমা বড় শক্ত করে দিয়েছে, নাকি এই রকমই হয়, তারই অনভ্যাস, আর গরম স্যুট আর ইংরেজি বাক্যালাপ, কী কী কারণে গায়ে ফোঁসকা পড়ে, কবে শীতের রাত্রিতে শুধু একটা আদ্দির পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে সে হি হি করে কেঁপেছিল, আবোল তাবোল ভাবনা জুটতে লাগল, ইন্টারভিউ দিতে এসে এত অন্যমনস্ক আদিত্য আগে কখনওই হয়নি।

হঠাৎ আদিত্য শুনতে পেল সেই অমোঘ জিজ্ঞাসা, আজকের খবরের কাগজটা পড়েছেন?

একটু ইতস্তত করে তারপর প্রায় তোতলাতে তোতলাতে আদিত্য জানাল, হ, এই পড়া হয়েছে আর কি!

আজকের ইম্পর্টান্ট নিউজ কী? আদিত্যের দম বন্ধ হয়ে আসছে, বা কনুইয়ে একটা ফোঁসকা বোধহয় এই মাত্র পড়ল, সোজা হয়ে বসে মরিয়ার মতো তাকাল, তারপর একটু থেমে স্থির গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, পুরুলিয়ার ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পরিত্যক্ত একটা কুয়োর মধ্যে একটা গোরু পড়ে গিয়েছিল। বারো ঘণ্টা পরে দমকলের লোকেরা গোরুটাকে তুলেছে।

ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন আরেকজনের কানে ফিসফিস করে কী বলল। যিনি ভারিক্কি গোছের মুখ করে মাঝামাঝি বসেছিলেন, তিনি বোধহয় চেয়ারম্যন কিংবা ওই রকম কিছু, তিনি হাতের পাইপের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, ইন্টারেস্টিং! শুধু অল্পবয়সি যুবকটি, নিশ্চয়ই লালওয়ানি, গম্ভীর মুখে বলল, দ্যাটস রাইট। এনিথিং মোর?

 উত্তর তেহরানে বন্যার জল পাঁচ সেন্টিমিটার নেমে গেছে। এখন আর বিশেষ কোনও আশঙ্কার কারণ নেই। আদিত্য যথেষ্ট গাম্ভীর্যের সঙ্গে জানাল।

আবার দুজন সদস্য কানাকানি করল, চেয়ারম্যান বললেন, ফানি। লালওয়ানি বলল, চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়েই বলল, আমি সকালবেলা উঠে সব কাগজ প্রথম পাতার দিন তারিখ থেকে শেষ পাতার সম্পাদকের নাম পর্যন্ত পড়ি। এসব সংবাদ আজকের কাগজে অবশ্য বেরিয়েছে। তারপর আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলল, এসব খবর আপনি ইম্পর্টান্ট মনে করছেন কেন? অর্থনৈতিক ব্যাপারে আজ কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবর নেই?

 আদিত্য যেন হাতে চাঁদ পেল, আজ্ঞে হ্যাঁ, তা আছে। বোম্বের শেয়ার বাজারে বরাকর কোলস-এর প্রেফারেন্স শেয়ারের দাম ছাব্বিশ পয়সা পড়ে গেছে। ইউ. পি. সরকার বারো বছর মেয়াদি লগ্নিশেয়ার ছিয়ানব্বই টাকা তেইশ পয়সা করে বাজারে ছাড়বেন সামনের সোমবার। সংবাদটা জানিয়ে আদিত্য একবার নেকটাইয়ের ওখানটায় হাত বোলাল; গলা দিয়ে ভাল স্বর বেরোচ্ছে না, দম বন্ধ হয়ে আসছে, ফাস আটকে মারা পড়বে নাকি শেষে, তা ছাড়া পিঠে বোধহয় ফোঁসকার একটা একজিবিশন বসল, কিন্তু একবার জানানো দরকার ওই সাতের পাতা মানে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাতা আর তারই আশে-পাশের দু-একটা খুচরো খবর, খবরের কাগজের শুধু এইটুকু পড়ে আসবার সুযোগ পেয়েছে সে।

বোর্ডের মেম্বাররা যেন সবাই একটু অবাক হয়ে গেছেন, এমনকী লালওয়ানি পর্যন্ত। লালওয়ানিকে একবার আলাদা পেলে কথাটা বোঝানো যেত, অন্তত টাইয়ের গিটটা খুলিয়ে নেয়া যেত, উঃ, এ যে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, কোটটা খুলে ফেললে কী হয়, নেকটাইয়ের নটটা, নেকটাইয়ের নট কী করে খোলে!

আদিত্য বোর্ডের মেম্বারদের মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারল তার আর কোনও আশা নেই। কিন্তু টাইয়ের নটটা খুলতে পারলে, দম আটকে না গেলে, সে হয়তো এদের ব্যাপার বোঝাতে পারত। নটটার নীচের দিকে হাত দিয়ে আদিত্য একটা টান দিল। আরও একটু বসে গেল যেন, তাহলে কি চাকরি জোটাতে এসে দমবন্ধ হয়ে মারা যাব? জোরে টাইটা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল আদিত্য, আর এবার সত্যিই ফাস আটকাল, একেবারে মরণফাস, চোখ দুটো বেরিয়ে আসছে লাল টকটকে, ঘাড়ের পিছনটা টনটন করে উঠল, আদিত্য লাফিয়ে উঠে পড়ল চেয়ার থেকে। কোটটা খুলে ফেলল একটানে কিন্তু টাই, যত টানে আরও আটকে যায়। এতে বিহ্বল ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যেরা ঘাবড়ে গিয়ে ক্রিং ক্রিং করে কলিংবেল বাজালেন। দুজন বেয়ারা ছুটে এল।

আদিত্য গোঙাতে গোঙাতে বলল, এবার আর ইংরেজি নয়, সোজা বাংলায় মাতৃভাষায়, পাগল-টাগল কিছুনই স্যার, নেকটাই স্যার, গরম স্যুট স্যার, ভাদ্রমাস স্যার, বেয়ারাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, কেয়া দেখতা হায়, গলামে ফঁস লাগ গিয়া, টাই খুলনে জানতা? বেয়ারারা হতবাক, আদিত্য এবার বোর্ডের মেম্বারদের বলল, আপনাদের নিশ্চয়ই মাধুরীদিদিমা টাই বেঁধে দেয়নি, এর মধ্যে কেউ যদি বাঙালি থাকেন, কেউ যদি আমার কথা এক বর্ণও বুঝে থাকেন দয়া করে প্রাণ রক্ষা করুন।

কেউ বাঙালি ছিল কি না বলা কঠিন তবে একজন ব্যাপারটা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি উঠে এসে প্রায় জাদুকরের মতো টাইটা সামান্য চেষ্টায় খুলে ফেললেন, আদিত্য প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার–এইবার ইংরেজিটা অল্প অল্প ফিরে এসেছে, লাইফ আগে, এ গ্লাস অফ ওয়াটার প্লিজ।

এক গ্লাস জল এল, কিন্তু তার আগেই পাশের দরজা দিয়ে বাথরুমে ঢুকে আঁজলাভরে প্রাণের। সাধে দুই মগ জল খেয়ে নিয়েছে আদিত্য। এইবার ফিরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, আমাকে কি আর কোনও প্রশ্ন করবেন?

না, আর কোনও প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন করলেও উত্তর নয়, টাই পরে চাকরি করা হবে না। অসম্ভব।

এক সপ্তাহ পরে মাধুরীদিদিমা পার্শেলে একটা গরম স্যুট ফেরত পেলেন আর আদিত্যের জামাকাপড় সব রয়ে গেল তার ওখানে। তা থাকুক, অ্যাডেন সাহেব চলে গেল, তিনটে জাপানি পাম গাছ মরে গেল, টমি কুকুর মরে গেল আর দু-চারটে পাজামা পাঞ্জাবি, জীবনে কত কীই তো জুটল না।

কিন্তু দোতলার পশ্চিমমুখে ওই ঘরটা বড় ভাল ছিল, বড় খোলামেলা। আর চিবুকে আলতো চুমো, মাধুরীদিদিমা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *