গ্রন্থভূক্ত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ)
গান
অগ্রন্থিত কবিতা
গল্প
চলচ্চিত্র কাহিনী ও চিত্রনাট্য
সম্পাদকীয়, গদ্য ও বক্তৃতা
সাক্ষাৎকার
1 of 2

সাক্ষাৎকার-২

সাক্ষাৎকার-২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি এলাকায়, অনিয়মিত ক’দিন আড্ডা দেওয়ার পর হঠাৎ একদিন ঢাকার বাইরের কোচ ধরেন তিনি। দিন কয়েক পর আবার ফিরে আসা; কাঁধে পরিচিত বিশেষ আকারের ব্যাগ, শ্মশ্রুশোভিত মুখ : তিনি হচ্ছেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। এ সবের পরও তিনি কবিতা লিখছেন এবং লিখে যাবেন। তার এক দশকের কাব্যচর্চার ফসল গ্রথিত হয়েছে দু’টো কাব্যগ্রন্থে : ‘উপদ্রুত উপকূল’ এবং ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’। রুদ্র’র কাছে কিছু প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ‘চিত্রবাংলা’র পক্ষ থেকে।

রাজনীতি, অভিনয় কিম্বা ব্যবসা না করে আপনি কবিতা লেখেন কেন?

রুদ্র : কিছু না-ভেবেই শুরু করেছিলাম। পরে কিছু দূর এগোনোর পর বুঝতে পারলাম এ ক্ষেত্রটাতে আমি ভালো করতে পারবো। নিজের সাথে চেনা-পরিচয়ের ব্যাপারটা থেকে বুঝেছি এটাই আমার জায়গা।

আপনার এক দশকের কাব্যচর্চার মাঝখানে আপনার কবিতার বিশেষ কোনো দিক পরিবর্তনের ব্যাপারে আপনি কি সচেতন?

রুদ্র : হ্যাঁ। ‘উপদ্রুত উপকূলে’ প্রধানত ছিল গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসার যন্ত্রনা এবং নগরজীবনের ক্ষোভ। ভাষার দিক থেকে আধুনিক কবিতার চালু ভাষাই ছিল ওটাতে। জাতিসত্তাকে জানার আত্ম-অন্বেষনের প্রয়োজন এবং সাথে সাথে গ্রামজীবনের স্বপ্ন ব্যর্থতা ইত্যাদি এসেছে দ্বিতীয় গ্রন্থে। ভাষা ছিল আঞ্চলিক শব্দের মিশাল। আর বর্তমানে ‘মানুষের মানচিত্রে’ একেবারে গ্রামের অন্ধকার জীবনের ছবি, দীর্ঘকালের বংশপরম্পরায় যে ব্যর্থতা, ক্ষোভ, গ্লানি, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট আঁকার চেষ্টা করছি।

আপনার কবিতা পাঠকরা কেন পড়বেন?

রুদ্র : বোধহয় কয়েকটা কারনে। প্রথমত একটা কথা আছে, মানুষ তার স্বপ্ন বা স্মৃতিকে অন্য একটি আয়নায় প্রতিফলিত দেখতে চায়, সে আয়নাটি অন্য একটি মানুষের আয়না। দ্বিতীয়ত যে স্বপ্নের প্রস্তুতি মানুষের মধ্যে বেড়ে উঠছে বা যে স্মৃতির কষ্ট তাকে অন্তরে ক্লান্ত করে কিম্বা তাকে উদাসিন করে, তার ছবিগুলোই সে কবিতায় পায়। এ কারনেই হয়তো মানুষ আমার কবিতা পড়বে।

কিভাবে আপনি কবিতার সংজ্ঞা দেবেন?

রুদ্র : কবিতার সংজ্ঞা দেয়া খুব কঠিন। যে লেখাটি সমকালের স্মৃতি বা স্বপ্নকে তুলে আনতে সক্ষম এবং একই সাথে সমকালকে অতিক্রমের যোগ্যতা রাখে তাকেই বোধহয় কবিতা বলা যেতে পারে। অবশ্য তা হবে কবিতার অন্যান্য ব্যাকরনের শর্ত সাপেক্ষে।

বাংলা কবিতা প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে সক্ষম, এরকম কোনো সম্ভবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না কেন?

রুদ্র : আমার মনে হয় দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সমাজ-পরিবর্তনের পক্ষে যে লেখাপড়া তার হার খুব বেশি নয় আমাদের দেশে। সে কারনে অন্য পক্ষটিকে পত্র-পত্রিকা বা বইপত্রের মাধ্যমে বেশি দেখা যাচ্ছে। আর এ কারনেই বলা যাবে না যে সমাজ- পরিবর্তনের পক্ষে কোনো কাজ হচ্ছে না।

সাহিত্যের জ্বালানি হচ্ছে রাজনীতি। আমরা যারা লিখছি, ঠিক একইভাবে পাশাপাশি কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ড আমাদের নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফাঁকা বুলির রাজনীতি, আপোসের রাজনীতি চলছে। রাজনীতি এবং সাহিত্য সমান্তরাল চলতে শুরু না করলে বড় ধরনের কোনো সাহিত্যের নিদর্শন আশা করা যায় না।

পশ্চিমবঙ্গের কবিতাকে কি বাংলাদেশের কবিতার সমকক্ষ মনে করেন?

রুদ্র : করি না। ওদের কবিতা আমার কাছে বানানো মনে হয়, যার সাথে খুব বেশি মাটির স্পর্শ নেই। তার উপর পশ্চিমের প্রভাবও ওদের বেশি। স্বাদের ক্ষেত্রে কাঁচা ও স্বতন্ত্র আমাদের কবিতা এবং বিশেষত এই মাটির প্রতি বিশ্বস্ত।

রাজনৈতিক কবিতা বলে কিছু আছে সেটা স্বীকার করেন?

রুদ্র : রাজনৈতিক কবিতা বোলে আলাদা কোনো কবিতা নেই। কারন রাজনীতি বহির্ভূত নয় কিছুই। যেমন প্রেমের কবিতা বোলে আলাদা কিছুই নেই।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জসীম উদ্দীনের কবিতা বাদ দিয়ে তাঁদের উত্তরসূরী কবিরা বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রায়ই অপরিচিত। এর জন্য কবিদের অক্ষমতাকে দায়ী করবেন?

রুদ্র : এর দুটো কারন রয়েছে। তিরিশের কবিতা হঠাৎ কোরে লম্বা লাফের মাধ্যমে আধুনিকের নামে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করেছে। রবীন্দ্রনাথকে জয় করতে গিয়ে এঁরা আশ্রয় নিয়েছেন পশ্চিমি সাহিত্যের। আধুনিক সাহিত্যের নামে এঁরা অনেক কিছুই চাপিয়ে দিয়েছেন যা আমাদের সমাজ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আরেকটি কারন হলো তথাকথিত শিক্ষিতের সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক কম। উচ্চ শিক্ষিতদের অনেকেই সাহিত্য পড়েন না। আবার উচ্চ শিক্ষিত নন এমন অনেকেই সাহিত্যের পাঠক।

যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের শতকরা পঁচাশিজন লোক শিক্ষিত না হবে, ততদিন দেশে সাহিত্যচর্চার কোনো দরকার নেই, এ প্রসঙ্গে আপনার মন্তব্য কি?

রুদ্র : তাহলে জীবনযাপনই ছেড়ে দিতে হয়। কারন, যদি বলি এদেশের পঁচাশি জন দরিদ্র-পীড়িত বিত্তশালী জীবনযাপন না করলে বেঁচে থাকার অর্থ কী? শতকরা পঁচাশি জন বিত্তশালী জীবনযাপন শুরু করলেই আমাদের বেঁচে থাকাটা সার্থক হয়। সাহিত্য ব্যাপারটাও ঠিক তেমনি।

আপনার নিজের সম্পর্কে কখনো নিজে মূল্যায়ন করেছেন কি?

রুদ্র : মূল্যায়ন সার্বক্ষনিক। এক মুহূর্ত আগের আমাকে পরমুহূর্তে এড়ানোর চেষ্টা করেছি। এখানে আমার স্থান বা আমার বিচার করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। যদি এ- মুহূর্তে থেমে যেতে পারতাম বা মৃত্যুর পর কোনোভাবে মতামত জানাতে পারতাম, তাহলে সম্ভব ছিল।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ফারুক মঈনউদ্দীন
চিত্রবাংলা, ঢাকা, ২ মে ১৯৮২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *