সাইকেল

সাইকেল

তুমুল বর্ষা। চারা রুইবার সময় আসতে-না-আসতেই যেন ভাদ্রর শেষের মতো এক হাঁটু জল মাঠে। গত বছর খরা গেল। এবারে অতিবর্ষণ! মানুষকে আর বাঁচতে দেবে না।

শালোপাড়া গ্রামটা ছোটোই। বেশ বেশিই ছোটো। কাছেই অবশ্য আছে, হুকলিঝাড়। বিরাট ব্যাপার সেখানে। বড়ো বড়ো আড়তদার। চারদিকে শয়ে শয়ে মাইল ধানখেত আর রাইস মিল। এফ সি আই-এর গোডাউন। ট্রেনের স্টেশন। ওই হুকলিঝাড়ের সঙ্গেই শালোপাড়ার নাড়ি বাঁধা। এখানের লাউটা, কুমড়োটা, মাগুরটা-সিঙিটা, সেই সবই গিয়ে জড়ো হয় শনিবারের হুকলিঝাড়ের হাটে। বদ্দমানে বড়োমানষিরা ছুটিছাটার দিন হলেই গাড়ি নে চলে আসে ফিসটি করতে, ঘুরতে ফিরতে, মালোপাড়ার নির্জনে। এঁটেল মাটির বর্ডার দেওয়া পিচ-এর রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে সন্ধ্যের মুখে জোড়ায় জোড়ায় বসে থাকে বড়োলোকের ব্যাটাবিটিরা, ছিন-ছিনারি দেখে। কেউ কেউ বোতল খুলে ঢুকচুক খায়।

রাত আটটা হয়ে গেল। এখনও যমুনা ঘরে এল না।

কেতো বালিশের তলাতে রাখা ঘড়িটা দেখল। তার বিয়ের সময় সেনবাবুদের খামারের ম্যানেজারবাবু এটা দেছলেন। এইচ এম টি ঘড়ি একটা। কোতোর জীবনের সব চেয়ে দামি সম্পত্তি। যখের ধনের মতো আগলে রাখে ও সব সময় এই ঘড়িটাকে।

যমুনা গেসল তার বাপেরবাড়িতে নবীনপুরে। গেসল, পরশু! আজ বিকেল বিকেল যমুনার দাদা তাকে পৌঁছে দে গেছে। এতক্ষণে তো কাজকম্মি সেরে খাওয়া-দাওয়া করে ঘরে আসা উচিত। বাইশ বছরের কেতোর ধৈর্য ধরে না। বিছানায় শুয়ে ছটফট ছটফট করে। নতুন জল-পাওয়া মাঠে ব্যাং ডাকে ঘ্যাঙর ঘ্যাং। গাছে গাছে সবুজ তারা টায়রার মতো জোনাকির ফুল দোলে। মাটির ঘরের ছোট্ট জানলা দিয়ে এসব দেকে-টেকে সময় কাটাবার উপায় খোঁজে কেতো। দুস শালা! তবু, সময় কি কাটে? নতুন বউকে দিয়ে এত কী কাজ করায় বাবা আর পুঁটিদি তা তারাই জানে! মোটে ছ-মাস বিয়ে হয়েছে কেতোর।

কেতোর মনে পড়ে, হাবা বলেছিল একদিন। পাঠশালা তো আজকাল নেই। প্রাইমারি স্কুলে যখন পড়ত ওরা, তখন হাবাকে একদিন মাস্টের জিগগেস করেছিল, বলো তো বাবা হাবা, বিহুলতা শব্দের মানেটা কী?

হাবা অনেকক্ষণ হাবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পরই মাস্টের বলেছিল যাঃ বাবা। এ যে দেখছি বিবিই পালিয়ে যাবে! গা গরম করতে করতে, বিবিই পালাবে।

তিন্নী ঝোলাটি নিয়ে এল, ঝোলাটি কাঁধে তুলে চাঁদের আলোতে ভেসে যাওয়া টুংরি-টোলির ইউক্যালিপটাস গাছের সারির মধ্যের কাঁচা পথ বেয়ে আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগল পলাশ। সোয়া কি মি দূরের মোড়ে পৌঁছে ট্যাক্সি বা রিকশা ধরবে।

কিছুটা গিয়ে একবার পিছন ফিরে হাত নাড়ল কুসুমের পলাশ। ইস পলাশের বুকের মধ্যেটা যদি দেখতে পারত কুসুম।

তার চোখদু-টিও!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *