প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

সাংসারিক প্রশ্নোত্তর

সাংসারিক প্রশ্নোত্তর

কবাবু আপনার চিঠি পেলাম। আপনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, তাই আপনাকে ক-বাবু বলেই সম্বোধন করছি। আপনি লিখছেন, সংসার চালানো ক্রমশই এক দু:সাধ্য ব্যাপার হয়ে উঠছে। বাজনার চেয়ে খাজনা বেশি। যা মাইনে পাই, তিনদিনেই খেল খতম হয়ে যায়। বাকি মাস কী ভাবে চলে, গড নোজ। মুদি মেরে দেয় শ’তিনেক। দুধ খেয়ে দেয় শ’দেড়েক। ঘরওয়ালিরা একালে বসন্তের ফুস বায়ু। ঘর থেকে ঘরে ফুরফুরিয়ে চলেন, পরদা দুলিয়ে, ফলে কাজের লোকে কানটি মলে শ’খানেক নিয়ে যায়। এজুকেশানে শ’দুয়েক যায়। ইলেকট্রিক বিল মুখ কালো করে দেয়। বিলের অবস্থা হাইপার টেনশানের রুগির মতো। এ মাসে নর্মাল, তো পরের মাসে অ্যাবনর্মাল। সব দিয়ে থুয়ে হাতে হ্যারিকেন। নিজের জন্যে, লোকলৌকিকতার জন্যে, সামান্য আমোদপ্রমোদের জন্যে কিছুই থাকে না। রবিবার বাড়িতে অসংখ্য ব্যক্তির আনাগোনা চলে। ক্ষেপে-ক্ষেপে চা, জলখাবার, কী ভাবে যে কী করি? কেমন করে সামাল দি? প্রতিমাসেই হয় বিয়ে, না হয় অন্নপ্রাসন, না হয় জন্মদিন, না হয় বিবাহ বার্ষিকী। আজকাল জলখাবারের খরচ কী ভাবে বাড়ছে দেখেছেন? প্রধান আহারের চেয়ে বেশি। অফিসে টিফিন করতে পাঁচ টাকার মতো লাগে, যদি ঠিক মতো করতে হয়! পঞ্চাশ পয়সার মুড়ি আর পচা বাদাম শব-যাত্রার খই ছড়াবার মতো। এতখানি জালার মতো একটা পেটের এক কোণে পড়ে থাকে, ছিঁচকে চোর যেভাবে হাজতের এক কোণে গুটিসুঁটি মেরে বসে থাকে অনেকটা সেই ভাবে। কী করা যায় মশাই! একটা পথ বাতলাতে পারেন? কাট ইওর কোট, চিরকাল সেই এক নীতিবাক্য শুনে এলুম। কী করে কাটা যায়? কোট তো আর মেয়েদের কাঁচুলি নয়। আধছটাক কাপড়ে কোট হবে? মামার বাড়ি!

ক-বাবু, সাধ্যমতো আপনাকে কয়েকটি টোটকা বাতলে যাই। দুধের খরচ আপনি সহজেই কমাতে পারেন। দুধহীন সাদা জলে যা আছে তা হল, দুধের সান্ত্বনা। দুধের বদলে, আপনি দুধের উৎস, সোর্সের দিকে চলে যান। অনেকটা ভাগীরথীর উৎস সন্ধানের মতো ব্যাপার। দুধ কী থেকে হয়? মানে গরুর বাঁটে দুধ আসে কোথা থেকে? গরুর খাদ্য থেকে। গরুর খাদ্য কী? খড়, ঘাস, খোল, ভুসি থেকে। সুতরাং দুধ না খেয়ে, দুধ যা থেকে হয়, সেই জিনিস খাবার অভ্যাস করুন। নেতারা বারবার বলছেন, আর কতবার বলবেন, ফুড হ্যাবিট পালটান। খড় খান, ঘাস খান, খোল ভুসি খান। অল্প অল্প করে অভ্যাস করুন। কে বলেছে আপনি সায়েব? অফিসে যারা আপনাকে সায়েব বলে, তারা আপনাকে বলে না। বলে আপনার চেয়ারকে। আপনার স্ত্রী আপনাকে কোনওদিন সায়েব বলেছে? যেদিন বলবে, সেদিন সত্যিই আপনি সায়েব হবেন। মনে মনে তিনি সময়-সময় যা বলেন, শুনলে আপনি দু:খ পাবেন। চতুস্পদের সঙ্গেই তিনি আপনাকে তুলনা করেন। সিংহ নয়, বাঘ নয়। আর এক ধাপ নীচে। ভাবছেন, হরিণ, জিরাফ, জেব্রা? আজ্ঞে তাও নয়। একেবারেই গোয়ালের জীব। বড় কত্তারা, নেতারাও তাই ভাবেন। নেকটাই পরা হাম্বা। আপনার বড় বড় বোলচালকে লোকে কি বলে, হামবড়াই! তবে! সকালে চোখ বুজিয়ে, স্ত্রীর মধুর বাক্যালাপ শুনতে-শুনতে কাঁঠালপাতাও চিবোতে পারেন। ছাগলের দুধের উৎস কাঁঠাল পাতা। গাধার দুধ স্তন দুগ্ধের সমান। গাধা কী খায়, আমার জানা নেই তাই। মার খায়, স্বচক্ষে দেখেছি। দেখুন, লজিক ইজ লজিক। খাদ্যাভাস বদলাতে লজ্জা কীসের? সায়েবি কায়দায়, ডিম্ব, টোস্ট, মাছ, মাংস, জ্যাম, জেলি, রোস্ট, কাবাব, কে খেতে বলেছে। দুধ, ঘি, রামরাজত্বে ছিল, বৈদিক যুগে ছিল দুধের পেছনে টাকা ঢালা মানে, জলের পেছনে ঢালা। মানুষের বর্তমান আচার আচরণের দিকে তাকালে দেখবেন, দ্বিপদ হলেও আমরা চতুষ্পদ। ছাগলের মতো পালে-পালে ছুটছি, রাস্তায় গরুর মতো গুঁতোচ্ছি, গাধার মতো সারা জীবন বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি। গাধা ঘোড়ার মিকশচারও পাওয়া যাবে। এক আঁটি খড় এনে জানালায় বেঁধে রাখবেন। সময় পেলেই চোখ বুজিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে ডগা ধরে চিবোবেন। মনে-মনে বলবেন, আমি মানুষ নয়, ছোটদা নয়, বড়দা নয়, আমি একটা বকনা বাছুর। ঢেঁকুর তুলে দেখবেন। যেই শুনবেন কেউ বলছে, ‘এইরে, অ, বউমা বাছুর খুলে গেল?’ অমনি লাফিয়ে উঠবেন, আমি সিদ্ধ হয়ে গেছি, সিদ্ধ পুরুষ নই, সিদ্ধ বাছুর। গরু হওয়ার কত সুবিধে, একবার ভেবে দেখেছেন? খাদ্যাভ্যাসের ফলে দেহটিও যদি গরুর আকার পেয়ে যায়, মার দিয়া কেল্লা। গুরুরা আর অত্যাচার করতে পারবে না। আজ চাঁদা দাও, কাল ভোট দাও, মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে দাও। সুন্দর লম্বা একটা ন্যাজ পাবেন। মশা, মাছি তাড়াতে পারবেন, আরও ফ্রিলি গুঁতোগুঁতি করতে পারবেন। গরুদের বউভাত নেই, অন্নপ্রাশন নেই, জন্মদিন নেই। কোনও রকম দুশ্চিন্তা নেই। বাত নেই, চোরা অম্বল নেই। চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যা নেই। কখনও কোনও চিন্তিত গরু দেখেছেন? দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষের চেয়ে, চিন্তাহীন গরু হওয়া ভালো নয় কি? নিজের স্ত্রীকেই জিগ্যেস করুন। তা ছাড়া শেষের সে দিনেও তাঁকে কিছু দিয়ে যেতে পারবেন। সারা জীবন, মানুষ হয়ে কষ্ট ছাড়া কিছুই তো দিতে পারবেন না। যাওয়ার সময় তবু বলতে পারবেন—একশো জোড়া জুতোর সম্ভাবনা ফেলে রেখে গেলুম ডার্লিং। দাম জানো! বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বানালে, একশো ইনটু একশো। তা ছাড়া কেজিদশেক বোন মিল। শ্রাদ্ধেরও প্রয়োজন নেই। ভেবে দেখুন, কী করবেন? চোখ বাঁধা কলুর বলদ খেতাব তো পেয়েইছেন। আর একটু এগোবেন, না ওই খেতাবধারী হয়ে বসে থাকবেন? এগোনোই তো মানুষের ধর্ম! তবে?

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *