প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

সম্পর্ক

সম্পর্ক

শিশু ও তার পিতা। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে, এই শহরের উপান্তে কাহিনির পটোত্তোলন। সেই শিশুটি এখন প্রৌঢ়।

একালের জীবনস্রোতের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। নিজেকে মেলাতে পারে না; যেন গ্রহান্তরের জীব। তাঁরই মুখে শোনা এই কাহিনি। ‘আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। মা মারা গেলেন। বাবা আর দ্বিতীয়বার সংসার করলেন না। কারণ সৎমা ছেলেটির যত্ন নাও করতে পারে। ছেলে আর এখন ছেলে নয়, ট্রাস্ট, গচ্ছিত সম্পত্তি। নিজের সুখের চেয়ে কর্তব্য পালনকেই মেনে নিয়ে নিজেই একাধারে হয়ে উঠলেন বাবা ও মা। মা-মরা একটি শিশুর কত ঝামেলা। অসুখ-বিসুখ, বায়না, মনখারাপ, বর্ণপরিচয়, দ্বিতীয়ভাগ, শিশুশিক্ষা। শিশু যখন বালক হল, তখন তার জগৎ মানেই পিতা। অসাধারণ তাঁর চরিত্র। যখন বন্ধু, তখন অমন বন্ধু আর দ্বিতীয় হয় না। যখন শাসক তখন তাঁর মতো কঠোর সৈন্যবাহিনীর মেজর-জেনারেলও হতে পারবেন না। চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রইল বহুমুখী এক ব্যক্তিত্ব। সকাল থেকে শয্যাগ্রহনের সময় পর্যন্ত শিশুটির দিন একেবারে রুটিনে বাঁধা। একালের শ্রেষ্ঠ আবাসিক বিদ্যালয়ের রুটিন, সে রুটিনের কাছে হার মেনে যাবে। পাশাপাশি চলেছে দুটি জীবন, শিশু চলেছে কৈশোরের দিকে, যুবক পিতা চলেছেন প্রৌঢ়ত্বের দিকে হাত ধরাধরি করে। সকালে তিনি ব্যায়ামাচার্য। সন্ধ্যায় তিনি সংগীতশিক্ষক। রাতে অধ্যাপক। শয্যায় তিনি গল্পকার মাতা। দেশ-বিদেশের গল্প শুনতে-শুনতে শিশুটি ঘুমিয়ে পড়ে পরম নিশ্চিন্তে পিতার বুকের কাছে। অনেক রাতে ঘুমের ঘোরে শুনতে পায় কে যেন এস্রাজ বাজাচ্ছে। চোখ মেলে দেখে সারা ঘর চাঁদের আলোয় ভাসছে। মেঝেতে ছোট্ট একটা কার্পেট বিছিয়ে, চন্দ্রালোকিত আকাশের দিকে তাকিয়ে তার পিতা এস্রাজ বাজাচ্ছেন। বুকের ভেতরটা যেন মুচড়ে যাচ্ছে! এস্রাজ বড় কান্নার বাজনা। শিশুটি নড়েও না চড়েও না, মশারির ভেতর থেকে আকাশের দিকে বড়-বড় চোখ মেলে শুয়ে থাকে। চাঁদের ওপর দিয়ে ভেসে চলে যায় সাদা-কালো মেঘ। হঠাৎ এস্রাজ থেমে যায়। সুরের পাখিরা সব উড়ে চলে যায়। শিশুটি উপুড় হয়ে, ঘাড় তুলে, কাঁদো-কাঁদো সুরে ডাকে—বাবা। দেশ রাগ শিশুটিকে মনে করিয়ে দিয়েছে তার মায়ের কথা। পিতা স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন, ছেলের ডাকে চমকে ওঠেন, ধরাধরা গলায় বলেন, ঘুম-ভেঙে গেল, বাবা! এরপর পিতা আর পুত্র জড়াজড়ি করে শুয়ে পড়েন। দুজনেই ভেতরে-ভেতরে ফুলছেন। একজনের মনে পড়ে গেছে মাকে, আর একজনের স্ত্রীকে। ওদিকে আকাশের গায়ে চাঁদ পিছলে যায়।

রবিবার বিকেলে একসঙ্গে তিন-চার মাইল ভ্রমণ ছিল বাঁধা নিয়ম। পিতা এত জোরে চলতেন যে তাল রাখার জন্য শিশুটিকে ছুটতে হত। পিতা মাঝে মাঝে থেমে পড়ে শিশুটিকে একটু জিরোবার অবকাশ দিতেন; দেখাবার মতো কিছু থাকলে দেখাতেন, বোঝাবার মতো কিছু থাকলে বোঝাতেন। ভ্রমণ আর শিক্ষা চলত একই সঙ্গে। পিতা শিশুটিকে ইংরেজি শেখাতেন। ব্যাকরণ শেখাতেন। গাছপালা চেনাতেন। বেড়াতে-বেড়াতে মুখে-মুখে অঙ্কও হয়ে যেত।

একদিন বাড়ির পাশের মাঠে বিশাল ফুটবল খেলা। পাড়ার শিল্ড ফাইনাল। সে যুগে পাড়ায়-পাড়ায় অসাধারণ ছেলে থাকত। যেমন লেখাপড়ায় তেমন হাতের কাজে, তেমনি উদ্ভাবন ক্ষমতায়। বিশ্বনাথ পেস্টবোর্ড কেটে, রাঙতা মুড়ে বড়, ছোট নানা মাপের সুন্দর সুন্দর শিল্ড তৈরি করেছে। মাঠের একপাশে বেলগাছ। বেলতলায় সাদা চাদর ঢাকা টেবিল। সেই টেবিলে শিল্ডগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ঘাসের উপর চুন ছড়িয়ে লেখা হয়েছে, অগ্রদূত শিল্ড ফাইনাল। মাঠের সেন্টারে চুনের বৃত্তের মাঝখানে নতুন একটি বল লাথি খাবার অপেক্ষায় সময় গুনছে। শিশুটির সামনে দুটি আকর্ষণ শিল্ড ফাইনাল, আর বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া। শেষে সে গুটিগুটি গিয়ে বাবাকে বলল, ‘আজ আমি একটু ফুটবল খেলা দেখব বাবা!’ পিতা একটু থমকে গেলেন। একা তো কখনও বেড়ানো হয়নি। বাজারে গেছেন সকালে, সেখানেও পিতা-পুত্র। নদীতে স্নান, সেখানেও দুজন। বিকেলে ভ্রমণ, সে তো এক পরমানন্দ! মনে রাখার মতো স্মৃতি। হেসে বললেন, ‘বেশ তো, আজ তাহলে তুমি খেলাই দ্যাখো।’

খেলা শেষ হল। যে-যার চলে গেল বাড়ি। বালকটি একা দাঁড়িয়ে মাঠে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। একটু আগে যে বেলতলায় সাজানো ছিল রাংতায় মোড়া শিল্ডের সারি, সেই বেলতলা শূন্য। আকাশে একই সঙ্গে ঘরে-ফেরা কাক এবং ঘর-ছাড়া বাদুড়। সেই বিশাল তারাটি ধীরে-ধীরে চোখ মেলতে শুরু করেছে পশ্চিম আকাশে। শূন্য মাঠে একা বালক। হঠাৎ তার মনটা হুহু করে উঠল। তিন মাইল দূরে সেই সুন্দর জলার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন তার বাবা। সম্পূর্ণ একা আজ। এক-এক করে উড়ে গেল সব বক। সেই পোড়ো বাড়িটার কোটর থেকে ডেকে উঠল এক-জোড়া পেঁচা। খেলার মাঠে একা শিশু মানস-নেত্রে দেখতে পাচ্ছে জলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একা পিতাকে। খেলার উত্তেজনা নেই। ফুটবল উঠে গেছে। ঘাসে-ঢাকা মাঠের অন্ধকার আনাচকানাচ থেকে বেরিয়ে আসছে রাতচরা প্রাণী। বালকটির মন ডুকরে উঠল তার বাবার জন্যে। কেন সে গেল না রোজকার মতো বাবার সঙ্গে। ছেলেটি দৌড়োতে শুরু করল। রাজপথ, গলিপথ পেরিয়ে সে যখন জলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল তখন রাত নেমেছে। পোড়ো বাড়ির গহ্বরে জমাট হয়ে উঠেছে অন্ধকার। জলার ধারে কেউ কোথাও নেই। তবু ছেলেটি বারে-বারে ডাকল। তীর থেকে কী একটা প্রাণী ঝপ করে উঠল। এক পাল শেয়াল।

সেদিনের শিশু আজকের প্রৌঢ় হা হা করে হেসে উঠে বললেন, বালক-মনের সেই শূন্যতাই আজ আমার সঙ্গী। কেউ কোথাও নেই। ডাক আছে, সাড়া নেই। সেদিন তার বাবাকে সেই জলার ধারে না পেয়ে ছেলেটি ভয়ে আতঙ্কে আবার দৌড়োতে শুরু করল। এইবার সে গেল ভুবনকাকার বাড়ি। বড় তবলিয়া। পিতার এস্রাজের সঙ্গে তিনি তবলা বাজাতেন। বালকটিকে দেখে ভুবনবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘এ কী, তুমি একা এই ভর সন্ধেবেলা কোথা থেকে এলে? এখানেও তার পিতাকে না পেয়ে বালকটি আর সামলাতে পারল না নিজেকে। ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল। ভুবনবাবু তখন বালকটিকে সঙ্গে করে পৌঁছে দিতে এলেন তার বাড়িতে। সেখানে তখন রবিবারের বিকেলের গানের আসর সাজানো—এস্রাজে ছড় টানতে-টানতে ছেলেটার পিতা বললেন, ‘এসো এসো ভুবন এসো’, তোমার অপেক্ষাতেই বসে আছি, ধরো তবলা।’

মিলিয়ে গেছে সেই আসর, পড়ে আছে আজও একপাশে হতশ্রী সেই তুঁতকাঠের এস্রাজ। তবলা জোড়া নিবার্ক দুই প্রাণী। চিরতরে চলে গেছেন সেদিনের সেইসব চরিত্র। আমার শিশুটিও আজ সাবালক; কিন্তু গড়ে ওঠেনি সেই সম্পর্ক। যে টানে শিশু ছোটে জলার ধারে, বুক-ফাটা আর্তনাদে চিৎকারে করে ওঠে—’তুমি কোথায়!’ একালের সব সম্পর্কই ফাঁকা।

1 Comment
Collapse Comments

KI OSADHARON

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *