সব ফেলে দাও, সব ছেড়ে দাও, উঠে এস
সব ফেলে দাও।
ঘর-সংসার, বিষয়-সম্পত্তি, টাকাপয়সা – আসক্তির যাবতীয় খেলনা। দুহাতে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলে যা যা। যেসব জিনিসের পাওয়া আর না পাওয়ায় তোমার আকাঙ্ক্ষা টাপুর-টুপুর করত মাছধরার ফাতনার মতো। সব ফেলে দাও।
সব ছেড়ে দাও।
পরিবার-পরিজন, প্রিয়-অপ্রিয়, অভ্যাস, সংস্কার। যাদের নিয়ে বাঁচার অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়েছিলে, সব ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও তোমার সব পছন্দ, সব অপছন্দ। ফিরে তাকিও না।
উঠে এস!
পরিকীর্ণ জীবন থেকে উঠে এস। তোমার সময় হয়ে গেছে। বন্দরের বন্ধনকাল শেষ হয়ে গেছে। এসেছে আদেশ। খেয়া প্রস্তুত জীবনপারাবারের তীরে। উঠে এস। প্রবাসে ছিলে স্ববাসে চল।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ এই মানসিক ব্যায়ামটি আমাদের রোজ একবার করে করতে বলেছেন। মৃত্যুরূপী মা যেন এসে বলছেন, ‘সব ফেলে দাও।’ শিশুর হাত থেকে সব পড়ে গেল। ধুলোবালি, পুতুল, নুড়ি। উঠে দাঁড়াল সে। ‘সব ছেড়ে দাও।’ সঙ্গিসাথীদের দিকে করুণ চোখে তাকান। মা ডাকছেন। যাচ্ছি ভাই। ‘উঠে এস।’ তোমার ঐ মোহের খেলাঘর থেকে উঠে এস। চেতনায় উঠে এস। তলা দিয়ে বয়ে যাক সংসারের ফেনিল স্রোত।
আরবের অজ্ঞাত এক জ্ঞানী সন্ন্যাসী বলেছেন : “This world and the other world are like the two wives of one and the same husband if you please one, you make the other envious.” (এপার আর ওপার, জীবন ও মৃত্যু একই স্বামীর দুই স্ত্রী। জীবনকে তুষ্ট করলে মৃত্যু অসন্তুষ্ট। দুটিকেই সমান খাতির করতে হবে।)
মারোয়াড়ি ভক্ত প্রশ্ন করছেন : “মহারাজ, মরলে কি হয়?”
ঠাকুর মরতে বলছেন না। মরলে তো মরেই গেলে। তাহলে আর পেলে কি! মৃত্যু তো তোমাকে শেখাবে। জীবন শেখাবে। আষ্টেপৃষ্ঠে সংসার জড়িয়ে, ‘বাবা রে, মা রে, গেল গেল রে, উঃ রে, আঃ রে’ করতে করতে হয় অম্বলে, নয় ক্যান্সারে অথবা সেরিব্রালে, শেষে পোড়াই যন্ত্রে পঁয়তাল্লিশ মিনিটে দেড় কেজি ছাইয়ের একটি পলিপ্যাক! ওরই মধ্যে যত পরিচয়, বংশলতিকা, ডিগ্রী- ডিপ্লোমা, স্ট্যাটাস, অফিসের উচ্চপদ, যাবতীয় লব্বাই-চব্বাই। ফুঃ, উড়ে গেলেন ঘোষ, বোস, মিত্তির, লাহিড়ি, সান্যাল। খুব বড় কেউকেটা হলে কোথাও একটা স্মরণসভা। সাতটা লোক, সত্তরটা চেয়ার। ঘণ্টাখানেক কথার মারপ্যাঁচ। এক মিনিট নীরবতা। কোন এক স্মরণসভায় নবিস এক সভাপতি দশ মিনিট নীরবতা ঘোষণা করলেন। সভায় গুঞ্জন-এ নিশ্চয় স্কুলমাস্টার। ছাত্র ভেবে পড়া না পারার শাস্তি দিলেন। কানে কানে কথা। ‘অ্যামেন্ড’ করে এক মিনিট হলো। কত বড় লোক হে! দশ মিনিট দাঁড়াতে হবে! গান্ধী, নেহরুও তো এক মিনিট। স্ট্যান্ডার্ড রেট। ভগবান মারা গেলে দশ মিনিট ভাবা যেতে পারে। তবে দয়ালু তিনি, মরে আমাদের মারবেন না।
সংসারে যতদিন থাকা, আখ-মাড়াই কলে ছিবড়ে হওয়া। মরে গেলে সকলের একটু দুঃখ হলো। কেউ বললে, সাধু ছিল; কেউ বললে শয়তান। পরিবারের ঘণ্টাখানেক ফ্যাসফোঁস। মাসখানেক আনমনা। ঠাকুর বলছেন, অতঃপর! শোক মসৃণ। চুলে তেল, আয়নার সামনে উপবেশন, নিবিষ্ট হয়ে চুল ফেরান, তাম্বুল চর্বণেও আপত্তি নেই। সেজেগুজে বড় পুত্তুরের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে ছুটলেন। দেনা-পাওনার ফিরিস্তি।
মৃত্যুচিন্তার বিশুদ্ধ আগুনে ‘কাঁচা আমি’টাকে রোজ পোড়াও। বিবেক- বৈরাগ্যের হাতুড়ি দিয়ে পেটাও। ‘পাকা আমি’ তৈরি কর। ‘বদ্ধ আমি’কে ‘মুক্ত’ কর। রোজ খাঁচা খুলে তাকে একবার উড়তে দাও অনন্ত আকাশে। আমার বউ, আমার ছেলে, আমার নাতি, আমার নাতনি। আহা! কামিনী-কাঞ্চনে কত সুখ সংসার কত ভরসার জায়গা! তিলে তিলে মারছে, তাও কত আনন্দ! কত নির্ভয়ের জায়গা! And the clock strikes twelve. তারার আকাশ, ছায়াপথ, শিয়রে ছায়া ছায়া মানুষ, ঝাপসা একটা বোতল, ধমনীতে বিন্দু বিন্দু নুনজল, ডুকরে কেঁদে উঠল প্রাণের কুসুম পরিবার—”ওগো! তুমি তো চললে, আমার কি করে গেলে?” সে-কথার উত্তর পরে, এ কি অপচয়ের দৃশ্য! দেউলে করে দেবে নাকি! প্রদীপটাতে বেশি সলতে, “তেল পুড়ে যাবে যে, সলতে কমিয়ে দাও।” একালে প্রদীপ নেই, বিদ্যুৎ। খাবি খাচ্ছে, আর বলছে : “এত আলো কেন জ্বলছে! গত মাসে সাতশ টাকার বিল এসেছিল।” এইটাই হয়তো হলো শেষকথা। আত্মা ‘সাতশ, সাতশ’ করতে করতে উড়ে গেল আকাশে।
মরতে হবেই। সব ফেলতে হবে, ছাড়তে হবে। অনিত্য থেকে নিত্যতে যেতে হবে। কোথায় যাব, কি আছে সেখানে সেসব পরের কথা। আগের কৃষ্ণা, আমি আজ আছি, কাল নেই। ঠাকুর বলছেন, জীবন একটা বিকার। ভিতরে বিকার। গান গেয়ে বলছেন—”একি বিকার শঙ্করী! কৃপা চরণতরী পেলে ধন্বন্তরি।” আরেকটু স্পষ্ট করছেন—”বিকার বইকি। দেখ না, সংসারীরা কোঁদল করে। কি লয়ে যে কোঁদল করে তার ঠিক নাই। কোঁদল কেমন! তোর অমুক হোক, তোর অমুক করি। কত চেঁচামেচি, কত গালাগাল!”
মহেন্দ্রনাথ আরেকটি কথা যোগ করলেন—”অবিদ্যার সংসার দাবানলতুল্য।”
লোকে টাকা টাকা করে মরে। হাওলা, গাওলা শেষপর্যন্ত তিহার জেলে পাকাপাকি বসবাস। এটা একালের। সেকালের চিত্র ঠাকুর দেখাচ্ছেন—”দেখ না, টাকা থাকলেই বা কি হবে! জয়গোপাল সেন (ঠাকুরের ব্রাহ্মভক্তদের মধ্যে জয়গোপাল সেন ছিলেন অন্যতম। কলকাতার মাথাঘষা গলিতে তাঁর গৃহে ঠাকুর মাঝেমধ্যে যেতেন, ধর্মালোচনা হতো।), অত টাকা আছে, কিন্তু দুঃখ করে, ছেলেরা তেমন মানে না।”
কিছু পাওয়া, কিছু না পাওয়া, অনেক পাওয়া অথচ একটা এমন কিছু না পাওয়া যার ফলে সমস্তটাই না পাওয়া—এই হলো সংসারচক্র। কেউ ঢোকে, কেউ ঢোকে না। বাইরে থেকে মজা দেখে চলে যায়। ঠাকুর বলছেন, তাদের শুদ্ধ সংস্কার। বলছেন : “এখানে অনেক ছোকরা আসে, কিন্তু কেউ কেউ ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল। তারা সংস্কার নিয়ে এসেছে। সেসব ছোকরা বিবাহের কথায়, অ্যাঁ, অ্যাঁ করে! বিবাহের কথা মনেই করে না।” আবার অন্যরকমও আছে। ঠাকুর মজা করে বলছেন : “অন্য ছোকরারা কি করে বেড়াচ্ছে! কিসে টাকা হয়—বাড়ি, গাড়ি, পোশাক, তারপর বিবাহ—এইজন্য ব্যস্ত হয়ে বেড়ায়। বিবাহ করবে—আগে কেমন মেয়ে খোঁজ নেয়। আবার সুন্দর কিনা, নিজে দেখতে যায়।
ঠাকুর যে উভয় ধরনের জন্যই এসেছিলেন। কলের বাইরে যারা, তাদের জন্য অকুণ্ঠ অকৃত্রিম ভালবাসা। বলছেন : “একজন আমায় বড় নিন্দে করে। কেবল বলে, ছোকরাদের ভালবাসি। যাদের সংস্কার আছে—শুদ্ধ আত্মা, ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল, টাকা, শরীরের সুখ এসবের দিকে মন নাই—তাদেরই আমি ভালবাসি। আর যারা সংস্কারদোষে সাধ করে কলে পড়ে গেছে, তাদের পরিণতির কথা ভেবে পথ বলে দি।”
একদিন হাজরামশাইকে বলছেন : “তুমি যখন জপ একদিন কচ্ছিলে- বাহ্যে থেকে এসে বললাম, মা, একি হীনবুদ্ধি, এখানে এসে মালা নিয়ে জপ কচ্ছে! যে এখানে আসবে তার একেবারে চৈতন্য হবে। তার মালা জপ অত করতে হবে না। তুমি কলকাতায় যাও না—দেখবে হাজার হাজার মালা জপ্ করছে-খানকি পর্যন্ত।”
মালা জপ আর নোট গোনা—দুইই এক হয়ে যায় যদি ভাব না আসে। এমনি না আসে, রোজ একবার করে মৃত্যুকে শিয়রে বসাও। চিতার আগুন হলো জ্ঞানাগ্নি। মানুষের মোহভঞ্জনের কড়া দাওয়াই। ঠাকুর ব্রাহ্মভক্তদের বলছেন, সংসার অনিত্য; আর সর্বদা মৃত্যুস্মরণ করা উচিত। পরের কথা গানে প্ৰকাশ করছেন—
“ভেবে দেখ মন কেউ কারু নয়, মিছে ভ্রম ভূমণ্ডলে।
ভুল না দক্ষিণাকালী বদ্ধ হয়ে মায়াজালে।।
দিন দুই-তিনের জন্য ভবে কর্তা বলে সবাই মানে।
সেই কর্তারে দেবে ফেলে, কালাকালের কর্তা এলে।।
যার জন্য মর ভেবে, সে কি তোমার সঙ্গে যাবে।
সেই প্রেয়সী দিবে ছড়া, অমঙ্গল হবে বলে।।”
বলছেন : “ডুব দাও, উপরে ভাসলে কি হবে? দিন কতক নির্জনে, সব ছেড়ে, ষোল আনা মন দিয়ে তাঁকে ডাক।”
জীবনের জন্য মৃত্যুসাধনা, আবার মৃত্যুর জন্যও মৃত্যুসাধনা। বৌদ্ধরা এই দর্শনেই বিশ্বাসী। এইটাই তাঁদের ধর্ম—মিলারেপা বললেন—”My religion is to live—and die—without regret.” বৌদ্ধরা দেখছেন এইভাবে—”Life and death are seen as one whole, where death is the beginning of another chapter of life. Death is a mirror in which the entire meaning of life is reflected.” বৌদ্ধদের আক্ষেপ—”Most people die unprepared for death, as they have lived, unprepared for life.”
ঠাকুরেরও সেই একই শিক্ষা—মৃত্যুর দর্পণে জীবন দেখ, জীবনযন্ত্রণা থাকবে না। আবার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও, পরের বার তো আসতে হবে। ভরতরাজা মৃত্যুর সময় হরিণ ভেবেছিলেন, জন্মালেন হরিণ হয়ে। যদু মল্লিকের মাকে বলছেন : “যখন মৃত্যু আসবে তখন সেই সংসারচিন্তাই আসবে। পরিবার, ছেলেমেয়ের চিন্তা—উইল করবার চিন্তা—এইসব আসবে; ভগবানের চিন্তা আসবে না। উপায় তাঁর নামজপ, নামকীর্তন অভ্যাস করা। এই অভ্যাস যদি থাকে, মৃত্যুসময় তাঁরই নাম মুখে আসবে।”