1 of 2

সবুজ আলো – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সবুজ আলো – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যেরকম পথে ঘাটে হিপিদের দেখা যায়, লম্বা লম্বা চুলওয়ালা ছেলে ও মেয়ে, অনেক সময় খালি পা, নোংরা পোশাক, সেই রকমই এক যুবক-যুবতীকে আমি দেখেছিলাম। কিছুই অবাক হইনি।

ওরা পার্ক স্ট্রীটে চৌরঙ্গীর মোড়ে দাঁড়িয়েছিল, দুজনেরই পোশাক এক রকম, প্যান্ট ও শার্ট, সোনালী রঙের চুল, হালকা নীল চোখের মণি, দুধে-আলতা রং, অন্য হিপিদের মতন এরা তেমন নোংরা নয়, যদিও পোশাক ছেঁড়াখোঁড়া।

ওরা চুপ করে দাঁড়িয়ে পরস্পরের মধ্যে নিচু গলায় কথা বলছিল। আমি দু-এক পলক ওদের দিকে তাকিয়েছিলাম, ওরা এতই রূপবান যে না তাকিয়ে পারা যায় না। দুজনেরই মুখে অপরূপ সারল্য মাখানো।

আমি ভাবলাম, ওরা তো বেশ ভালোই আছে। চাকরি বাকরি কিংবা টাকা পয়সা উপার্জন কিংবা ঘর সংসার নিয়ে থাকাই এই পৃথিবীর নিয়ম। এ নিয়ম বড্ড পুরোন হয়ে গেছে। ওরা যদি সে নিয়ম না মানে, তাহলে বুঝতে হবে ওরা অন্যরকম সুখ চাইছে।

অধিকাংশ হিপিই এক রকম চেহারার হয়, এবং সাহেব-মেমেদের মুখ একবার মাত্র দেখে মনে রাখাও যায় না। সুতরাং ওদেরও মনে রাখার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু আমি ঘাম মুবার জন্য যেই পকেট থেকে রুমাল বার করতে গেছি, অমনি ঝনঝন করে কয়েকটা খুচরো পয়সা রাস্তায় পড়ে গেল। কয়েকটা গড়িয়ে গেল ওদের পায়ের কাছে।

আমি নিচু হয়ে পয়সা তুলতে গেলাম। ছেলেমেয়ে দুটিও পয়সা কুড়িয়ে আমার হাতে দিল। আমি হেসে বললাম, থ্যাঙ্ক য়ু।

ওরা দুজনে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর কি বলল আমি বুঝতে পারলাম না। বোধ হয় ওদের ভাষা ইংরেজী নয়। জার্মান, ফরাশী, ডাচ ছেলেমেয়েরাও তো হিপি হয়।

আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না। হাঁটতে লাগলাম ধর্মতলার দিকে। ওরা সেখানেই রইল দাঁড়য়ে। মেয়েটির হাসি আমার এতই সুন্দর লেগেছিল যে আমি দু-একবার ওদের দিকে ফিরে ফিরে না তাকিয়ে পারিনি। বেশিবার তাকানো আবার অভদ্রতা।

এটা একটা সামান্য ঘটনা। মনে রাখবার মতন কিছু নয়। আমি মনেও রাখিনি।

এর কয়েক দিন পর আমি বেনারস গিয়েছিলাম। বেনারস তো একেবারে হিপিদের রাজত্ব। রাস্তায়, বিশেষত গঙ্গার ধারে শত শত হিপিদের যখন তখন দেখা যায়। এদের মধ্যে যদিও সেই দুজন হিপিকে হঠাৎ একদিন দেখি, আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আমি কিন্তু ওদের দুজনকে অত ভিড়ের মধ্যেও চিনতে পেরেছিলাম। সেই মেয়েটির হাসি দেখেই চিনলাম। হাসিটা আমার চোখে লেগেছিল। মেয়েটির শরীরটা এত সুন্দর এবং মুখখানা এত লাবণ্যময় যে সিনেমায় নামলে দারুণ নাম করতে পারত। তার বদলে একটা পাতলা জামা প্যান্ট পরে গঙ্গার ধারে শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছে।

এর দুদিন পরে বেনারসে একটা ছোটখাটো দাঙ্গা লাগার উপক্রম হল। একদল লোক লাঠিসোটা, এমন কি খোলা তলোয়ার হাতে রাস্তায় নেমে পড়ল। তারা সব হিপিদের তাড়াবে। কয়েকজন হিপিকে মারধোরও করল খুব, তবে ঠিক সময় পুলিশ এসে পড়ায় বেশিদূর গড়াল না। অনেক গ্রেপ্তার হল, লোকগুলো নাকি অধিকাংশই গুণ্ডা শ্রেণীর।

হিপিদের ওপর ওদের অত রাগের কারণটা পরে জানতে পারলাম।

বেনারসে আমি উঠেছিলাম আমার বন্ধু প্রশান্তর বাড়িতে। আমার বন্ধুর স্ত্রী গীতি যাকে বলে সরকারী গেজেট। রোজ সকাল বেলা বাজার করতে গিয়ে গীতি যাবতীয় ব্বর সংগ্রহ করে আনে।

গীতি আমাদের একটি লোমহর্ষক কাহিনী শোনাল।

বেনারসের আশেপাশে এখনো অনেক ছোটখাটো রাজা ও জমিদার রয়ে গেছে, যারা প্রায় মধ্যযুগীয় কায়দায় জীবন কাটায়। তারা নিজস্ব গুণ্ডা পোষে, অনেক সময় লোকজনকে খুন করে মৃতদেহ গায়েব করে দেয়, নানা জায়গা থেকে স্ত্রীলোকও ধরে আনে।

হিপিদের মধ্যে অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে বলে অনেক সময় এই সব রাজা ও জমিদাররা গুণ্ডা দিয়ে হিপি মেয়েও লুঠ করে। আগেকার দিনে কোন মেমসাহেবকে ভোগ করার কথা তারা ভাবতেও পারত না। এখন অনেক সুযোগ। বেনারসে এত হিপি মেয়ে গিসগিস করছে; তার মধ্যে দু-একজন হারিয়ে গেল কি না গেল কে খোঁজ রাখে।

সেই রকমই একটা ঘটনা ঘটেছিল গতকাল। একজোড়া হিপি ছেলেমেয়ে রাত্তিরবেলা একটা সরু গলি দিয়ে যাচ্ছিল, এই সময় তিনজন গুণ্ডা তাদের অনুসরণ করে। গুণ্ডাদের সঙ্গে লাঠি ও ছুরি ছিল।

গলিটা ছিল কানাগলি। এক জায়গায় শেষ হয়ে গেছে, সামনে দেয়াল। হিপি ছেলে ও মেয়েটি বুঝতে পেরেছিল, তাদের পেছনে গুণ্ডা লেগেছে। কিন্তু রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের আর পালাবার উপায় নেই, তাই পেছনে ফিরল।

সঙ্গে সঙ্গে গুণ্ডা তিনজন ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটির ওপর। মেয়েটি কিন্তু একটুও ভয় পায়নি। সে চিৎকার করে কি যেন বলল ছেলেটিকে।

ছেলেটি একজন গুণ্ডাকে টেনে তুলল। তারপর সে গুণ্ডাটির দুটি হাত ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলে। ছিঁড়ে ফেলে মানে শরীর থেকে একেবারে ছিঁড়ে আলাদা করে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপরে সে গুণ্ডাটার চোখ দুটো খুবলে নেয়।

গল্পের মাঝখানে বাধা দিয়ে আমি বললুম, গীতি, বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে না!

গীতি তার সুন্দর মুখে দারুণ বিস্ময় ফুটিয়ে বলল, আপনি বিশ্বাস করছেন না? সবাই একথা শুনেছে!

—তারা কি করে জানল। ওখানে কি আর কেউ উপস্থিত ছিল। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি যেন পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলে!

—এসব কথা ঠিক জানা যায়, বুঝলেন। পরে সেই ডেডবডিটা অনেকে দেখেছে!

—বাকি গুণ্ডা দুজন কি করল?

—তারা সে বীভৎস দৃশ্য দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল।

মানুষের হাত টেনে ছিঁড়ে ফেলা একটা অমানুষিক কাজ। হিপিরা সাধারণত নিরীহ হয়। ওদের কাছে অস্ত্র থাকে না। তাছাড়া গাঁজা-ভাং খেয়ে খেয়ে শরীরেও জোর থাকে না বিশেষ। তবে, জুড়ো আর ক্যারাটি নামে কয়েক রকম যুযুৎসু আছে, যাতে একজন ছোটখাটো মানুষও বিশাল চেহারার লোককে ঢিট করে দিতে পারে। কিন্তু হাত ছিঁড়ে ফেলা অসম্ভব।

আমরা এই বিষয় নিয়েই আলোচনা করছিলুম, এমন সময় প্রশান্তর বন্ধু তুষার এল।

তুষার সব শুনে নিল, গল্পটার অনেকখানি অংশ সত্যি। গতকাল রাত্রে কাশীর একটা সরু গলিতে একজন কুখ্যাত গুণ্ডার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তার একটা হাত কাটা অবস্থায় পড়েছিল পাশে। চোখ দুটোও গেলে দেওয়া হয়েছে।

তুষারের মামা এখানকার পুলিশের একজন হোমরা চোমরা অফিসার। তিনি দিয়েছেন এ খবর। ব্যাপারটার মধ্যে বেশ রহস্য আছে।

মারা গেছে একজন কুখ্যাত গুণ্ডা—সে একটা মেয়েকে চুরি করতে গিয়েছিল—সুতরাং সে যোগ্য শাস্তিই পেয়েছে বলা যায়। কিন্তু দেখা গেল, বেনারসে অধিকাংশ লোকই হঠাৎ ক্ষেপে গেল হিপিদের ওপরে। দাবী উঠল, সব হিপিকে তাড়িয়ে দেওয়ার। থাইল্যান্ড কিংবা শ্রীলঙ্কায় যে রকম করা হয়েছে। গুণ্ডারা বেনারসে চিরকালই ছিল এবং থাকবে, তাদের ঘাঁটাবার কোন মানে হয় না।

শিক্ষিত লোকেরা বলতে লাগল, হিপিদের মধ্যে সি-আই এর দালাল এবং নানারকম স্পাই মিশে থাকে। ওদের এরকম যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা দেওয়া যায় না। কথাটার মধ্যে হয়তো কিছু সত্যি থাকতেও পারে। তবে, হিপিদের মধ্যে যে অন্য অনেক কিছু মিশে থাকে, তার প্রমাণ আমি পেলাম কয়েকদিন পরে।

বেনারসে ওই ঘটনা শুনে আমার বারবার মনে হচ্ছিল, আমি যে হিপি যুগলকে চিনি এই ব্যাপারটা বোধ হয় তাদের নিয়েই। অবশ্য এর কোন ভিত্তি নেই। হাজার হাজার হিপি রয়েছে। তবে হিপিদের মধ্যে অনেক সুন্দর মেয়ে থাকলেও ওই মেয়েটির মতন অত সুন্দর আর কাউকে দেখিনি।

শুনলাম অনেক হিপি বেনারস ছেড়ে চলে গেছে। নিশ্চয়ই ওদের স্বর্গহান নেপালে আরও ভিড় বাড়বে।

প্রশান্তর ফিয়াট গাড়িটা গ্যারেজ থেকে মেরামত হয়ে আবার পরই ও বললে, চল, কাছাকাছি কোন জায়গা থেকে ঘুরে আসি।

বেনারসে আমি বেশ কয়েকবার এসেছি, অনেক কিছুই দেখা। শুধু চুনারে আমার যাওয়া হয়নি। তাই ঠিক হল, চুনারে যাওয়া হবে।

কথা ছিল, সকালে গিয়ে সন্ধের আগে ফিরে আসা। কিন্তু চুনারের দুর্গের ওপরের গেস্ট হাউসটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমি ভারতের বহু জায়গায় গেস্ট হাউসে থেকেছি, কিন্তু এমন সুন্দর জায়গা দেখিনি প্রায় বলতে গেলে।

পাহাড় কেটে বসানো হয়েছে দুর্গ, সেই দুর্গে এক সময় যেটা ছিল দরবার, এখন সেটাই জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। বিশাল বিশাল সুসজ্জিত ঘর। সামনে সুন্দর সাজানো চাতাল, অনেক নিচে গঙ্গা। গঙ্গা এখানে একটা বাঁক নিয়েছে। সন্ধের আধো অন্ধকারে মনে হল ঠিক যেন বাঁকা চাঁদ।

আমি গীতি আর প্রশান্তকে বললাম, এসো, আজ রাতটা এখানেই থেকে যাই।

গীতি বলল, দারুণ জায়গা। আমারও থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সঙ্গে জিনিসপত্র যে কিছু আনিনি।

প্রশান্তরও থাকার খুব ইচ্ছে, কিন্তু কাল সকালেই ওর অফিসের ব্যাপারে একটা জরুরী অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

তখন ঠিক হল, আমি একাই ওখানে থেকে যাব। প্রশান্ত আর গীতি আজ ফিরে যাবে, আবার ফিরে আসবে কাল বিকেলে। তারপর তিন চার দিন থাকা হবে।

গেস্ট হাউসের ঘর দুটোই ফাঁকা ছিল, সুতরাং রিজার্ভেশন পেতে কোন অসুবিধে হল না।

যাবার সময় গীতি আমায় বলল, সুনীলদা, আপনার একা একা এখানে ভয় করবে না তো!

আমি বলালম, যাঃ, ভয় আবার কি!

প্রশান্ত হাসতে হাসতে বলল, এখানে রাজা মহারাজাদের আমলে এত যুদ্ধ চলেছে, কত খুন জখম হয়েছে, তাদের ভূত-টূত থাকতে পারে!

আমি বললাম, ভূতরাও মিলিটারিদের ভয় পায়!

দুর্গটার এক অংশ এখন মিলিটারিদের দখলে। একদিকে একটা মন্দিরে আছে আর এই গেস্ট হাউস শুধু জনসাধারণের জন্য।

আমি এক জামা কাপড়ে রয়ে গেলাম সেখানে। প্রশান্ত আর গীতি চলে যাবার পর আমি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সামনের চত্বরটায় বসে গঙ্গা দেখতে লাগলাম। সন্ধের পর আর বাইরের লোকদের এখানে আসতে দেওয়া হয় না। জায়গাটা এখন খুবই নির্জন। অনেকদিন এমন নির্জনতা উপভোগ করার সুযোগ পাইনি।

—সাব!

আমি চমকে উঠেছিলাম। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, ডাকবাংলোর চৌকিদার।

সে জিজ্ঞেস করল, রাত্তিরে আমার জন্য খাবার বানাতে হবে কিনা!

তাই তো, নির্জনতা নিয়ে কবিত্ব করতে গিয়ে আমি খাবার কথাই ভুলে গিয়েছিলাম! কথাটা ভাবতেই আমার খিদে পেয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম, খাবার কি পাওয়া যাবে?

সবচেয়ে সুখাদ্য এবং সহজে রান্না করা যায়, অথাৎ ভাত আর মুরগীর মাংস, তারও ব্যবস্থা আছে। আমি সেটারই অর্ডার দিলাম। এবং বললাম, খুব জলদি বানাতে।

আপশোষ হতে লাগল, কেন একটা হুইস্কি বা ব্র্যাণ্ডির বোতল সঙ্গে আনিনি, তাহলে এই নির্জনতা আরও ভালভাবে উপভোগ করা যেত।

চৌকিদারকে কথাটা জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করছিল। তারপর লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। সে বলল, এনে দিতে পারে, তবে অনেকটা সময় লাগবে। পাহাড়ের নিচে বাজারে যেতে হবে কিনা।

আমি তাকে পাঁচ টাকা বকশিস দিয়ে বললাম, যাও, তাই নিয়ে এসো।

চৌকিদার চলে যাবার পর জায়গাটা আরো বেশি নির্জন মনে হতে লাগল। একটা জিনিস লক্ষ্য করে আমি অবাক হয়ে গেলাম। চারপাশে এত সৌন্দর্য, মাথার ওপরে বিশাল আকাশ নিচেও বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়, গঙ্গার রূপও এখানে অসামান্য, চমৎকার হওয়া দিচ্ছে—তবু একা থাকার জন্য আমি এসব তেমন ভাবে উপভোগ করতে পারছি না। আমার একটু ভয় ভয় করছে। ঠিক ভূতের ভয় নয়, বরং চোর ডাকাতের ভয়ই বেশি। চৌকিদারকে না পাঠালেই হত। আমাকে এখানে একা পেয়ে কেউ যদি খুন করে টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে যায়? আমার কাছে মাত্র শ’দেড়েক টাকা রয়েছে যদিও, কিন্তু এদেশে পাঁচ দশ টাকার জন্যও অনেক সময় মানুষ খুন হয়।

হঠাৎ মনে হল, ঠাণ্ডা হাওয়ার জন্য আমার একটু শীত শীত করছে। আসলে এটা একটা অজুহাত। বাইরে একা বসে থাকতে আমার গা-ছমছম কছিল। ঘরের মধ্যে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বেশ নরম গদী। খুব আরামের।

একটুক্ষণ বাদেই আমি বাইরে কার যেন গলার আওয়াজ শুনলাম। দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, চত্বরের একেবারে শেষ প্রান্তে গঙ্গার দিকে দুজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিজেদের মধ্যে গল্প করছে মনে হয়।

সিগারেট ধরিয়ে আমি বাইরে এলাম। অল্প চাঁদের আলোয় দেখলাম, একজন সাহেব ও মেম। রাত্রে সাধারণত কাউকে আসতে দেওয়া হয় না। তবে সাহেব ও মেমদের জন্য সব সময়েই অনেক বেশি সুযোগ থাকে। কিংবা হয়তো ওদের আগে থেকে ঘর রিজার্ভ করা ছিল।

একটু এগিয়ে এসে আমি দারুণ চমকে উঠলাম। সেই দুজন হিপি যুবক-যুবতী। এদের একবার আমি দেখেছি কলকাতার পার্ক স্ট্রীটে, একবার কাশীতে, আবার এখন চুনারে। আমি যেখানে যাচ্ছি, এরা কি সেখানেই যাচ্ছে?

নিজের মনকে বোঝালাম, হয়তো ব্যাপারট কাকতালীয় যোগাযোগ। হঠাৎ এরকম মিলে যেতেই পারে। বেনারস থেকে হিপিরা বিতাড়িত হচ্ছে বলেই বোধ হয় ওরা দুজন চুনারে এসেছে। অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ওরা যখন আমার প্রতিবেশী, তখন ওদের সঙ্গে আলাপ করা যেতে পারে।

এগিয়ে গিয়ে বললাম, হ্যালো!

ওরা একটু চমকে ঘুরে দাঁড়াল। ওরা নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল হয়ে ছিল। মেয়েটির দিকেই আমার প্রথম চোখ পড়েছিল। মেয়েটির মুখে সেই রকম হাসি নেই। বরং একটা রাগের ভাব। আমাকে কিছু না বলে দুর্বোধ্য কি একটা ভাষায় কিছু বলল ছেলেটিকে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম ওরা ইংরাজী জানে না।

আমি ছেলেটির দিকে তাকালাম, ভারতবর্ষে যখন ঘুরহে তখন কিছু একটা সুবোধ্য ভাষা তো জানবে। বোধ হয় হিন্দী জানে। তাই আমি বললাম, আপলোগ….

ছেলেটি আমায় কিছু বলতে দিল না। দুর্বোধ্য একটা শব্দ করে আমার দিকে তাকালে। আমার শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল। ছেলেটির দু-চোখ দিয়ে সবুজ রঙের আলো বেরোচ্ছে। দুটো সবুজ আলোর রেখা এসে ভেদ করলে আমার মুখ। সে রকম ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমি কখনো দেখিনি।

ছেলেটি এগিয়ে এসে আমার একটা হাত ধরল। কি অসম্ভব গরম তার হাত। একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর হলেও মানুষের দেহে অতখানি উত্তাপ থাকে না।

স্বীকার করতে একটুও লজ্জা নেই, আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেও পারলাম না। সমস্ত শরীর দিয়ে বুঝতে পারলাম, এরা সাধারণ মানুষ নয়।

আমার মনে পড়ে গেল কাশীর সেই গুণ্ডটার হাত ছিঁড়ে যাওয়ার এবং চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। আমি এক হাতে চোখ ঢেকে চিৎকার করে বললাম, আমায় ছেড়ে দিন! দয়া করে ছেড়ে দিন। আমার কোন খারাপ মতলব নেই।

আমি সেখানে অজ্ঞান হয়ে অনেকক্ষণ পড়েছিলাম। চৌকিদারটা ফিরে এসে আমাকে ওই অবস্থায় দেখতে পেয়ে মাথায় জলের ছিটে দেয়। চোখ মেলেও প্রথমে আমার মনে হয়েছিল, আমি মরেই গেছি। তারপর দেখলাম, নিজের দুটো হাত ও দুটো চোখ অক্ষত আছে কিনা। সবই ঠিক আছে। সেই ছেলেটি ও মেয়েটি সেখানে নেই। তাদের কেউ দেখেনি। চৌকিদার জোর দিয়ে বলল, রাত্তিরে এখানে কারোর আসার হুকুম নেই।

আমি আজ ভূতে বিশ্বাস করি না। আমার দৃঢ় ধারণা, ওরা ভূত টুত নয়—অন্য কিছু। আমাদের জানা জগতের বাইরের কোন অস্তিত্ব। বন্ধুরা অবশ্য সব শুনে বলে, পুরো ব্যাপারটাই আমার চোখের ভুল। নির্জন জায়গায় সম্পূর্ণ একলা থাকলে ওই রকম নাকি হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *