প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

সবারে বাস রে ভালো

সবারে বাস রে ভালো

সবারে বাস রে ভালো। কোনওরকমে একটু ভালোবাসতে পারলে সব সমস্যার সমাধান। সেই কোন ছেলেবেলায় পড়েছিলুম সুকুমার রায়ের লেখা, ‘এই দুনিয়ার সকল ভালো/আসল ভালো নকল ভালো/সস্তা ভালো দামীও ভালো/তুমিও ভালো আমিও ভালো।’

তীর্থের কাকের মতো বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে হঠাৎ এই প্রেমোদয়। গুণগুণ করে গান ধরলাম, আমি প্রেমের ভিখারি প্রেম বিলোই নদিয়ায়। বাদুড়-ঝোলা একটা বাস এসেছিল, ধরতেও গিয়েছিলাম, তলপেটে গুঁতো খেয়ে ফিরে এসেছি। ফিরে এসে মনুষ্যজাতির প্রতি ঘৃণায় মচকে পড়েছিলাম। বর্তমানে প্রেমোদয়ে একটু চাঙ্গা হয়েছি। ‘সোজাও ভালো বাঁকাও ভালো/কাঁসিও ভালো ঢাকও ভালো/টিকিও ভালো টাকও ভালো/ঠেলার গাড়ি ঠেলতে ভালো।’ যে দামড়া তলপেটে কনুই চার্জ করে আমাকে আউটলাইন করে পাদানিতে ঝুলে পড়ল সে-ও ভালো। জগাই-মাধাইকে প্রেম বিলোতে চলেছেন নিত্যানন্দ। জগাই মারলে কলসির কানা। নিত্যানন্দের কপাল কেটে রক্তারক্তি। তিনি গান ধরলেন, মেরেছ, বেশ করেছ।

বাস আসছে, সেই এক চেহারা। আমার চারপাশে এতক্ষণ যাঁরা উদাস মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের মুখের চেহারায় একটা নৃশংস ভাব জেগে উঠল। হাতের মুঠো শক্ত হল, চোয়াল দৃঢ় হল। আমার কিছুই হল না। আমার ভেতর ভালোবাসার উদয় হয়েছে। ‘খাস্তা লুচি বেলতে ভালো/গিটকিরি গান শুনতে ভালো/শিমূল তুলো ধুনতে ভালো/ঠান্ডা জলে নাইতে ভালো।’

বাস তখনও থামেনি, উচ্চিংড়ির মতো লম্ভ-ঝম্ভ শুরু হয়ে গেছে। সুভদ্র বঙ্গসন্তানদের প্রাত্যাহিক ব্যায়াম। এই প্রক্রিয়ায় ছেলে বাপকে, বাপ ছেলেকে লেঙ্গি মারতে পারে। গীতার কর্মযোগ, ফলাফল পার্থসারথির পদে নিবেদিত। বাপ ছেলেকে ছেতরে দিচ্ছে দেখে চেনা একজন বললে, ‘করেন কী, করেন কী, ও যে সুষমার সন্তান।’ ‘কে সুষমা?’

‘আপনার স্ত্রী। আপনার স্ত্রীর ছেলেকে গুঁতোচ্ছেন?’

‘প্রেমে আর রণে সব অ্যালাউড’ বলে সুষমার স্বামী বকনা বাছুরের মতো গুঁতিয়ে ঢুকে গেলেন ভেতরে। তাঁর চটি খেতে-খেতে আমি পেছনে। আমার কোমর জাপটে ধরে ভেতরে প্রেমের আসরে ঢোকার চেষ্টা করছে ইস্কুলগামী এক কিশোর। তার পেছনে এক মহিলা। শাড়িতে পা জড়িয়ে গেছে। সেই অবস্থায় ঝুলন্ত বীর কন্ডাক্টর তাঁর বগলের তলা দিয়ে হাত চালিয়ে ব্যাগের মতো হিঁচড়ে ফুটবোর্ডে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। অমন কায়দা মহিলার স্বামী করলে গালাগাল খেতেন। মহিলার কাতুকুতু লাগত। কন্ডাক্টর দেবতার সমান। নির্লিঙ্গ এক চিৎকার। ওঠার সময় আমার পশ্চাদ্দেশে হাঁটু দিয়ে ঝেড়েছিল। কিছু মনে করিনি। মেরেছ, বেশ করেছ, আয় আয় প্রেম নিবি আয়। আয়রে জগাই, আয়রে মাধাই। আমি রাইকিশোরী, বংশীধারী হয়ে দু-সার মানুষের মাঝখানে অতি কষ্টে দাঁড়িয়েছি। সুঠাম বাঁকা শ্যাম। বেকায়দার বকও বলা চলে। যতবার আর একটা পা নামিয়ে দ্বিপদ হতে চাইছি আমার সামনে ঠেসে থাকা মহিলা খ্যানখ্যানে গলায় বলছেন, ‘পা মাড়াচ্ছেন কেন? অসভ্য!’ অতএব এক পায়ে দাঁড়ানোই সাব্যস্ত। পেছন থেকে কনুইয়ের গোঁজ মেরে আমার ঘাড় সমেত মাথাটা সামনের মহিলার খোঁপা নামক ভীমরুলের চাকে ঠেসে ধরার চেষ্টা করছেন। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি মাথা সোজা রাখার। একেই বলে ক্যালিসথেনিকস ফিজিওথেরাপি। স্পন্ডিলোসিস হলে অনেক অর্থ ব্যয়ে ফিজিওথেরাপিস্টের দ্বারা চিকিৎসা করাতে হয়। মাঝের সারিটা যেন টাগ-অফ-ওয়ারের লাইনের মতো। বাস থামলেই হড়হড়িয়ে সামনে ঝুঁকছে। ছাড়লেই পেছনে। ভদ্রমহিলা যখন আমার বুক চপে ধরছেন, আমি বলছি, অবশ্যই মনে-মনে আহা মরি যদি সে-ও ভালো। আর আমি যখন তাঁকে চেপে ধরছি, তিনি বলছেন সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করুন। আমার তখন প্রেমোদয় অবস্থা, কী ভালোই যে লাগছে। আমার ঘাড়ে প্রেম, কাঁধে প্রেম, বুকে প্রেম, পিঠে প্রেম, দুপাশে প্রেম। প্রেমের কবলে যেন সজ্ঞানে মাতৃজঠরে অবস্থান। মাঝে-মাঝেই পেটাতরের সুবাসে সেই চলমান প্রেমযান মাতোয়ারা হয়ে উঠছে। পথের যা হাল তাতে বাস যেন গিলেকরা পাঞ্জাবির মতো চলেছে। দু হাত খুচুক ব্রেক। গায়ে-গায়ে দলাদলি পায়ে পায়ে লড়ালড়ি। এক বিহারী বন্ধু নাল লাগানো জুতো মেরে পা মাড়িয়ে বলছে—’গরিব আদমি বাবু। মাফ কর দিজিয়ে গা।’ এমন সময় প্রেমাবশে আমি সামনের মহিলার কাঁধে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলুম। মহিলা মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘জুতিয়ে—।’ আর বলা হল না। দুজনেই অবাক। আমার স্ত্রী। আমি বললুম, ‘তুমি?’ সে বললে, ‘তুমি!’ বাকি পথটুকু তুমি আর আমি শুধু, জীবন দোলায় দুলে গেলুম।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *