2 of 2

সবজি-বাগানের গল্প – শঙ্খদীপ সেন

সবজি-বাগানের গল্প – শঙ্খদীপ সেন

বাড়িওয়ালা আজ উকিলের চিঠি পাঠিয়েছেন। কী করব আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। দু-বছর আগে বললেও হয়তো আমি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে পারতাম এ-বাড়ি, কিন্তু এখন আর তা সম্ভব না। এই দু-বছরে আমি ভাড়া বাড়িয়েছি ছ’বার, কিন্তু কিছুতেই সন্তুষ্ট হচ্ছেন না ভদ্রলোক। এবার বোধহয় উনি কোর্টে যাবেন, আমি আবার কোর্ট, পুলিশ—এসব একেবারেই পছন্দ করি না। কী দরকার, কী খুঁড়তে কী বেরিয়ে পড়বে। শেষপর্যন্ত সারাজীবন আপশোস করে মরতে হবে একটুখানি ভুলের জন্যে।

আজ ভদ্রলোক ভুলে গেছেন, কী অবস্থায় উনি আমায় বাড়ি গছিয়েছিলেন। বাড়িটা ছিল ভুতুড়ে, ভাড়াটে জুটত না, জুটলেও টিকত না সে-ভাড়াটে। আমি বাড়িটা নিয়েছিলাম খানিকটা ঝোঁকের মাথায়। আসলে পুরোনো জমিদার-বাড়ির ওপর এমনিতেই আমার একটু মোহ আছে। তার ওপর শহরের এত কাছে থাকার সুযোগ, তাও আবার নামমাত্র ভাড়ায়।

বাড়ির চেয়েও বাগানের ওপর ভদ্রলোকের লোভ বেশি। আমার সবজি-খামার দেখে উনি বেশ ঈর্ষাতুর হয়ে পড়েছেন। এমন লোভনীয় বাঁধা আয়ের পথ সামনে দেখতে পেলে অবশ্য ঈর্ষা হওয়ারই কথা। জনান্তিকে একটা কথা বলে রাখি যে-আমলে আমার বইয়ের চার-পাঁচটা মুদ্রণ দেখতে-দেখতে শেষ হয়ে যেত, তখনও আমি মাসে এত রোজগার করতে পারিনি। তারপর একদিন লেখা ছেড়ে বাগান নিয়ে মেতে উঠলাম। লেখা ছেড়ে দেওয়ার কারণও অবশ্য লুকিয়ে আছে এই বাগানেরই গভীরে।

এ-বাগানের মাটি আমি নিজে হাতে তৈরি করেছি। তাই এত সহজে আমি আমার দাবি ছেড়ে দিচ্ছি না। যখন এসেছিলাম, তখন এই সমস্ত জমি নিষ্ফলা হয়ে পড়ে থাকত। মহেশপ্রসাদ এ-বাগানের পেছনে কম খাটেনি, কিন্তু ওর সমস্ত পরিশ্রম বিফলে গেছে। তারপর যেদিন আমি বাগানের পেছনে লাগলাম (বরং বলা উচিত, লাগতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম সেদিন), তার কিছুদিন পর থেকেই বাগান আমায় দু-হাত ভরে সবজি উপহার দিয়ে আসছে।

বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের কাছ থেকে আমি এই জমিটুকু কিনে নেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিলাম। কিন্তু উনি এমন লোভে পড়ে গেছেন, কিছুতেই হাতছাড়া করবেন না এ-জমি। একটা কথা উনি জানেন না, ওঁর হাতে পড়লে আবার এ-জমি নিষ্ফলা হয়ে যাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। কারণ, বাগানে নতুন করে সার দেওয়ার সময় হয়ে এল। তাই এই মুহূর্তে আমার ঠিক কী করা উচিত, কিছুতেই বুঝতে পারছি না। বাড়িওয়ালার সঙ্গে জলদি একটা মীমাংসা করে ফেলা দরকার। কারণ, এমন চমৎকার সুযোগ আমি দ্বিতীয়বার পাব না।

টেলিফোনটা বেজে উঠল। নিশ্চয়ই লোপার ফোন। কালও ঠিক এইসময় ও আমায় ফোন করেছিল। ও বোধহয় কয়েকদিনের মধ্যেই আসবে আমার বাড়ি, গতকাল তো সেইরকমই আভাস দিল। লোপার একটা অদ্ভুত খেয়াল আছে। হঠাৎ এক-একদিন ও কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে চলে আসে আমার কাছে। আমরা একসঙ্গে মিলে একটা গোটা নিরুদ্দিষ্ট দিন কাটাই। তারপর সন্ধ্যা নেমে এলে কিছু রমণীয় স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে একসময় ও বাড়ি ফিরে যায়।

মহেশও ক’দিন থেকে ছুটি চাইছে—ওকে একটা দিনের জন্যে ছুটি দিয়ে দেব ভাবছি।

কিন্তু লোপা কবে আসবে? আর কাউকে না জানাক, আমাকে নিশ্চয়ই ও আগে থাকতেই আভাস দেবে কবে আসছে! সেদিন রাতে ও আর বাড়ি ফিরবে না, শুরু হবে ওর নিরুদ্দিষ্ট জীবন। ঠিক যেমন করে শুরু করেছিল হরিশ সান্যাল আর লিলিয়ান পার্কার। আর কেউ না জানুক, আমি জানি ওরা এখন বেশ আরামেই আছে। লোপাও ভালো থাকবে, আমি নিশ্চিত।

শহর ছাড়িয়ে এক নিরিবিলি রাস্তার ধারে আমার বাড়ি। চারপাশে কয়েক ফার্লংয়ের মধ্যে আর কোনও বাড়ি চোখে পড়ে না। এককালে নাকি এটা কোনও এক জমিদারের বাগানবাড়ি ছিল। তারপর ভুতুড়ে বাড়ি বলে একরকম পরিত্যক্ত হয়েই পড়ে ছিল অনেকদিন। কিছুদিন আগে এক ভদ্রলোক এটা নামমাত্র দামে কিনে সারিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন, কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারেননি। তারপর বেশ কিছু ভাড়াটের হাতবদল হয়ে অবশেষে এটা আমার দখলে এসেছে (বলাই বাহুল্য, প্রায় বিনা ভাড়ায়!)। আমি তো এখানে দিব্যি আছি। কোনও গোলমাল নেই, উপদ্রব নেই, অথচ শহরের এত কাছে। মিনিট-সাতেক হাঁটলেই বড়রাস্তা, সেখান থেকে বাসে চেপে মাত্র আধঘণ্টায় শহর ছুঁয়ে ফিরে আসা যায়।

একা থাকি, লিখে যা আসে দিব্যি চলে যায়। কিন্তু সময় দিন-দিনই খারাপের দিকে যাচ্ছে। এভাবে আর বেশিদিন চলবে না। ব্যাঙ্কের ভাঁড়ার তো ফুরিয়ে এল বলে!

হঠাৎ সশব্দে টেলিফোনটা বেজে ওঠে। রিসিভারটা তুলে নিতেই গম্ভীর একটা যান্ত্রিক স্বর শুনতে পেলাম ‘মিস্টার জয়দীপ সেনবর্মা?’

‘হ্যাঁ, কথা বলছি।’

‘শুনুন, মিস্টার সেনবর্মা, আমি সোমনাথ সেলস এম্পোরিয়াম থেকে শর্মা কথা বলছি। গত সপ্তাহে আপনি আমার দোকানে যে-চেকটা দিয়েছিলেন, আপনার ব্যাঙ্ক সেটা ডিসঅনার করেছে। আপনি জেনে-শুনে…।’

‘আমি দুঃখিত, মিস্টার শর্মা। আসল ব্যাপারটা হল, গত শনিবার আমার অ্যাকাউন্টে একটা ড্রাফট জমা পড়েছে। সেটা ক্যাশ হতে অন্তত দুটো দিন তো সময় লাগবেই। আপনি এত তাড়াতাড়ি চেকটা ভাঙাবেন আমি বুঝতে পারিনি। তাহলে ব্যাপারটা আপনাকে জানিয়ে রাখতাম।’

‘আপনি আজ বিকেলে আসুন আমার দোকানে!’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!’

হতভাগা হালদারবাবুটা পেমেন্ট নিয়ে এত ঘোরাল!

টেলিফোনটা আমি বসার ঘরে রেখেছি। ঘরটা প্রকাণ্ড। জমিদার-বাড়ির কিছু-কিছু নিদর্শন এখনও এ-ঘরে রয়ে গেছে। পশ্চিমদিকের দেওয়াল জুড়ে বেশ কিছু প্রাচীন অস্ত্রের সম্ভার : ঢাল, তলোয়ার, বর্শা—সবগুলোই লোহার তৈরি। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পুরোনো ভারী এই অস্ত্রগুলোতে এককণাও মরচের স্পর্শ লাগেনি। দেওয়ালের ওপরদিকটা জুড়ে আছে একটা বিশাল দেওয়াল-ঘড়ি। রাতের নিস্তব্ধ প্রহরে এটার গম্ভীর ঘণ্টাধ্বনি শুনে এখনও আমার বুকের ভেতরটায় হঠাৎ এক-এক সময় কেমন যেন থমথম করে ওঠে। এইসব প্রাচীন আসবাবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমি ঘরটাকে সম্পূর্ণ আমার মনের মতো করে সাজিয়েছি। মেঝেতে কার্পেট, একটা সোফা-সেট, দেওয়ালের পূর্বদিকটা জুড়ে আছে একটা দেওয়াল-আলমারি। আলমারিতে কিছু প্রাচীন মূর্তি আর আমার বাছাই করা কিছু বইয়ের সংগ্রহ। বইগুলো যে-আমলের, তখন আমার বইয়ের পাঁচ-ছ’টা মুদ্রণ হেসে-খেলে শেষ হয়ে যেত। আমার কাছে এখন এগুলোর মর্যাদা মূল্যবান প্রাচীন কিউরিয়োর সমান।

লেখার কাজে আমার বেশ কিছু বাতিক আছে। বেশি রাতে লিখতে পারি না, ক্লান্তিতে দু-চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। ভোরবেলা উঠে লিখতে বসলেই কেমন যেন অস্থির বোধ করি মনে-মনে, গুছিয়ে দু-লাইনও লিখতে পারি না। মনস্থির করে লেখা শুরু করতে-করতে বেলা গড়িয়ে যায়। সবাই যাকে বলে অফিস আওয়ার্স, আমার কাজের সময়ও মাত্র সেইটুকুই। তাই এ-সময়টাতে কেউ বিরক্ত করতে এলে স্বাভাবিক কারণেই অসম্ভব চটে যাই মনে-মনে।

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই এ-লেখাটা আমায় শেষ করতে হবে। প্রকাশকের মুখের চেহারা দেখে বেশ বুঝতে পারছি, এটাই হয়তো আমার শেষ বই। তাই এ-লেখার প্রতিটি লাইন এখন আমার কাছে মূল্যবান। সুচিন্তিত প্রয়াসের সঙ্গে আমি প্রত্যেকটি শব্দ বাছাই করে বাক্য গড়ছি। এ-বইটা বাজারে না চললে আমি একদম ডুবে যাব, আর কোনওদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না।

‘…লোকটা উন্মত্তের মতো ছুটতে শুরু করেছে। গোধূলির নির্জন আঁধারের ছায়া নেমে এসেছে পাহাড়ি বনাঞ্চল ঘিরে। গুলিবিদ্ধ বাঁ-কাঁধটা ক্রমাগত জ্বলছে একটা…।’

সদর দরজার বেল বেজে উঠল। মহেশপ্রসাদ। মহেশ আজ আসতে বেশ দেরি করে ফেলল। যাক, তবু একটু চা পাওয়া যাবে। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। মহেশ নয়, অপরিচিত এক ভদ্রলোক। আমার জিজ্ঞাসু চাউনির উত্তরে তিনি জানালেন, ‘আপনার মিটার রিডিংটা…।’

‘আসুন।’

সদর দরজা পেরিয়ে একটা মস্ত উঠোন। উঠোন পার হয়ে বসার ঘরে ঢোকার মুখে মিটারটা দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে। ভদ্রলোক এগিয়ে যেতে-যেতে আলাপ জমাবার সুরে বলে ওঠেন, ‘অক্টোবর শেষ হতে চলল, তবু দেখুন, বৃষ্টি থামার নাম নেই। কোনও মানে হয়?’

শব্দটা কানে এসে যেতেই আমি অস্ফুট স্বরে বলে উঠি, ‘বাঁ-কাঁধটা ক্রমাগত জ্বলছে একটা অগ্নিকুণ্ডের মতো।’

‘কী বললেন?’

‘কিছু মনে করবেন না, আমার একটা বিশেষ জরুরি কাজ আছে।’

আহত দৃষ্টিতে চকিতে একবার আমার মুখের দিকে চেয়ে ভদ্রলোক মিটারের দিকে এগিয়ে গেলেন।

বসার ঘর, তারপর আরও দুটো ঘর পেরিয়ে অবশেষে বাড়ির শেষপ্রান্তে আমার কাজের ঘর। চেয়ারে বসে দ্রুত হাতে কলমটা তুলে নিই।

কিছুক্ষণ পর মহেশ এল। বৃদ্ধ মহেশের ওপর আমার বাড়ির সমস্ত কর্তৃত্ব আমি ন্যস্ত করেছি। বয়সের ভারে লোকটা ঈষৎ নুয়ে পড়েছে, তা ছাড়া কানেও বেশ কম শোনে। ধীর কিন্তু বিশ্বস্ত হাতে মহেশ আমার ঘর ঝাড়ে, কাপড় কাচে, রান্না করে রাখে। তারপর সন্ধ্য হওয়ার মুখে এই মন্থর লোকটাই হঠাৎ কেমন যেন করিৎকর্মা হয়ে ওঠে—চোখে-মুখে একটা অস্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ ফুটিয়ে ত্রস্তপায়ে বিদায় নেয় আমার কাছ থেকে। তবু শেষপর্যন্ত একমাত্র মহেশই টিকে থাকতে পারল আমার কাছে, এই আতঙ্কময় ভৌতিক প্রাসাদে।

আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে মহেশ চায়ের কাপ এগিয়ে দেয় আমার দিকে। চা-টা মন-মতো হলে আমার লেখার মেজাজ খুলে যায়। কিন্তু এ যেন পয়সা ছুড়ে হেড-টেল খেলার মতো, কোনওদিনই নিশ্চিত করে বলা যাবে না কী পড়বে। কাপটা তুলে মুখে ছোঁয়াতেই মুখ বিকৃত হয়ে ওঠে আমার।

‘মহেশ, এটা কী হয়েছে?’ আমি বিকৃত স্বরে হাঁক পাড়ি।

‘আজ্ঞে মেঘলা ছিল, বেলা বুঝতে পারি নাই।’ ওর দু-গাল জুড়ে প্রশস্ত হাসি নিঃশব্দে উপছে পড়ছে।

বললাম, ‘চা-টা একবার গলায় ঢেলে দেখো।’

‘আজ্ঞে?’

‘নাঃ, মেজাজটাই নষ্ট হল!’

‘কষ্ট? সেই বুকের কষ্টটা আবার?’

মহেশ ওর কাজ ফেলে উঠে আসে। অন্তত আধঘণ্টা ধরে ও এখন আমায় বিস্তারিত করে বোঝাতে থাকবে, কেমন করে আমি অযত্নে আর অবহেলায় মাত্র পঁয়ত্রিশেই শরীরটা নষ্ট করে ফেললাম।

‘…লোকটার পিছু-পিছু ধাওয়া করে আসছে ক্লান্তিহীন এক অশ্বক্ষুরধ্বনি। বন্য প্রতিহিংসা বুকে নিয়ে ওরা লোকটাকে ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে ফেলতে চায়…।’

টেলিফোনটা বাজতে শুরু করেছে কিছুক্ষণ থেকে। আমি লিখে যেতে থাকি, ‘…ওদের নিষ্ঠুরতা ইতিহাসের—ইতিহাসের…।’

আমি মরিয়া হয়ে শব্দ খুঁজে হয়রান হই মনে-মনে। টেলিফোনটা একটানা বেজে চলেছে। অবশেষে মহেশও অধৈর্য হয়ে হাঁক পাড়তে শুরু করে। বিরক্ত হয়ে আমি কলমটা ছুড়ে ফেলে দিই টেবিলে।

‘কে, দীপ?’

‘ও, লোপা তুমি! কী খবর বলো?…ভালো আছ তো? এক সপ্তাহ তোমার কোনও খবর নেই।’

‘ওদের নিষ্ঠুরতা ইতিহাসের সমস্ত নৃশংস আচরণকে লজ্জা দেবে।’—বাক্যটা মাথায় আসতেই আমি অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম।

‘কী বললে, কী দেবে?’

‘শোনো লোপা, আমি একটা মানসিক ভারসাম্যের খেলা খেলছি। একদিকে আমি একা, অন্যদিকে তোমরা সবাই। খেলাটায় আমায় জিততেই হবে।’

একটা উচ্চকিত সুরেলা হাসি আমার রিসিভার বেয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল : ‘তুমি একটা পাগল!…আমার জন্মদিনের কথা মনে আছে তো?’

‘সে তো কাল!’

‘গতবারের মতো এবারেও ভুলে যেয়ো না কিন্তু!’

‘শোনো লোপা, আমার কাজের সময়টুকুতে তুমি কিন্তু ফোন করবে না কথা দিয়েছিলে।’

ক্ষণিকের জন্যে নিস্তব্ধতা নেমে এল আমার ঘরে।

‘ঠিক আছে, আর কোনওদিন করব না।’ লোপার উজ্জ্বল কণ্ঠস্বর ম্রিয়মান হয়ে এসেছে।

‘লোপা, তুমি কী করছিলে বলো!’

‘দিন-দিন তুমি পালটে যাচ্ছ। ঠিক আছে, কাল তুমি আসতে না পারলে, এখনই আমায় জানিয়ে দাও।’

‘শোনো লোপা, তোমার জন্মদিনে আমি নিশ্চয়ই যেতে চাই। কিন্তু আমাকে বইটাও শেষ করতে হবে। তুমি তো জানো, লেখাই আমার পেশা। এটা ঠিকমতো না চললে আমার খাবার জুটবে না।’ গলার স্বরে একটা শুকনো গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুললাম আমি।

‘তুমি…তুমি একটা—।’ ওর চোখজোড়া বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে, আমি এখান থেকেই বুঝতে পারছি।

‘লোপা!’

‘আমি আর কোনওদিন তোমার মুখ দেখতে চাই না!’

তার মানে, আমার কালকের দিনটাও গেল। কাল সারাটা দিন চলে যাবে ওর রাগ ভাঙাতে। লোপাটা চিরদিনই একটু বেশি সেন্টিমেন্টাল। বয়স বাড়লেও ওর স্বভাব একটুও পালটাল না।

‘…লোকটা এতক্ষণে বুঝতে পারছে, গোটা ব্যাপারটাই ছিল সাজানো। সুনিপুণ কৌশলে ফাঁদ পেতেছিল ওরা, কিন্তু সাহস আর বুদ্ধিমত্তার খেলায় কোনওদিনই কেউ ওকে হারাতে পারেনি। আজও তাই…।’

মহেশ আবার হাঁক পাড়তে শুরু করেছে। অর্থাৎ, ও এখন বাজারে যাবে। এবার আমি উঠে সদর দরজা বন্ধ না করা পর্যন্ত ও কিছুতেই নড়বে না, এ আমি ভালো করেই জানি।

আজ মঙ্গলবারের সকালটা সম্পূর্ণ নষ্ট হল। সাতবার টেলিফোনের ডাকে সাড়া দিতে হল…দরজা খুলে দিতে উঠলাম অন্তত দশ-বারোবার। এ ছাড়াও আমার মহেশপ্রসাদ রয়েছে হাতের কাছেই। মহেশ কানে কম শোনে ঠিকই, সেজন্যে আমি ওকে খুব একটা দোষ দিই না। কিন্তু অতিরিক্ত কথা বলে ও সেই অভাবটুকু পূরণ করে নিতে চায়। সবকিছুর ফলশ্রুতি হিসাবে সারা সকালে আমার লেখা এগোল মাত্র একপৃষ্ঠা। আমি কোনওদিনই খুব একটা তাড়াতাড়ি লিখতে পারিনি, কিন্তু তাই বলে সারাদিনে একপৃষ্ঠা! এ ভাবাই যায় না।

দুপুরে সোমনাথ সেলস এম্পোরিয়াম থেকে ঘুরে এলাম। বাড়ি ফিরে গুছিয়ে লিখতে বসতে-বসতে সন্ধ্যা হয়ে এল, মহেশ ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে ওর সারাদিনের কাজ সেরে।

‘…পাহাড়ি অরণ্যে বৃষ্টির ঢল নেমেছে। চারদিকে জমাট আঁধার। লোকটা ক্রমশ ঘন অরণ্যে ঢুকে পড়তে থাকে। সেই দুরন্ত অশ্বক্ষুরধ্বনি…।’

দরজায় বেল বেজে উঠল।

‘…এতক্ষণে স্তিমিত হয়ে এসেছে। অরণ্যের গভীরতা যতই বাড়ছে, অশ্বচালনাও ততই কঠিন হয়ে পড়ছে ক্রমশ…।’

দরজার বেলটা বেজে যেতে থাকে একঘেয়ে শব্দ তুলে।

‘…একটা গাছতলায় বসে পড়ল লোকটা। এই অন্ধকারের আড়ালে ও একটু বিশ্রাম করে নিতে চায়। ওর বুকটা হাপরের মতো ওঠা-নামা করছে।’

অবিরাম শব্দে বেল বেজে চলেছে। আমি মরিয়া হয়ে লিখে যাই—।

‘…চকিতে অন্ধকার ফুঁড়ে একটা আলোর বর্শা ঘুরে গেল ওর মাথার ওপর দিয়ে। অর্থাৎ—।’

অর্থাৎ, হতচ্ছাড়া বেলটায় সাড়া দিতেই হল। দরজার ওপাশে আমার জন্যে একজোড়া বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। হরিশ সান্যাল (অবশ্য ও নিজেকে পরিচয় দেয় হ্যারি স্যানিয়েল বলে) আর ওর সঙ্গে একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভদ্রমহিলা। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ওদের মোটরবাইকটা।

সান্যাল এককালে আমার কলেজের বন্ধু ছিল। বন্ধু বলাটা ভুল হল, আমি কোনওদিনই ওকে ঠিক সহ্য করতে পারতাম না। অল্পবয়সে ও নাকি একবার স্টেটসে ছিল কয়েক মাস। সেই কয়েক মাসের ছাপকে ও চিরজীবনের মতো সঙ্গী করে নিয়েছে। সবসময় নিজেকে ও একটা কেতাদুরস্ত মোড়কে মুড়ে রাখে। মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট করতে ওর মতো কুশলী আমি দুটি দেখিনি। একটা উন্নাসিক নিস্পৃহতায় নিজেকে সবসময় আড়াল করে রেখেছে সবার থেকে। ফলে কারও সঙ্গেই ওর বিশেষ অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠেনি।

মেয়েটিও আমার চেনা। কোথায় যেন একবার আলাপ হয়েছিল, সম্ভবত সান্যালই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। শুধু এইটুকু মনে পড়ছে, ওর গলার স্বরটা অসম্ভব রকমের সরু অথচ সুরেলা। ঠিক তারার পঞ্চমে সুর বেঁধে গান গাওয়ার মতো। বিরক্তিতে মাথা ধরে যায় অল্পক্ষণেই।

‘জয়, কী খবর তোর?’ সান্যাল হাত বাড়িয়ে দিল।

‘আপনাকে বিরক্ত করলাম না তো?’ মেয়েটি মাথা ঝাঁকিয়ে খানিকটা ঘনিষ্ঠ স্বরে জানতে চায়।

হ্যাঁ, করলেন।…প্রায় বলে ফেলেছিলাম। সামলে নিয়ে বলি, ‘আসুন, ভেতরে আসুন।’

ওরা দুজন হাত-ধরাধরি করে আমার দরজার এপাশে পা রাখে।

‘দাঁড়া, একটু কফি করি।’

‘হ্যাভেনট গট আ ড্রিঙ্ক, ওল্ড বয়?’

‘হ্যারি, তুই তো জানিস, ড্রিঙ্কস-ফ্রিঙ্কস আমার পোষায় না। ব্র্যান্ডি আছে, চলবে?’

‘নাইস ফর দ্য ওয়েদার।’

গত সপ্তাহে কিনেছিলাম এই মস্ত বোতলটা। ডাক্তারের পরামর্শমতো আমায় রোজ একটুখানি করে ব্র্যান্ডি খেতে হয় নিয়মমতো। দুটো গ্লাসে পানীয় ঢালতে-ঢালতে সান্যালকে বললাম, ‘তোরা বোস, আমি একটু আসছি।’

‘…অর্থাৎ শত্রু এসে পড়েছে নাগালের মধ্যে। আতঙ্কে হিম হয়ে লোকটা গাছের আড়ালে মিশে যেতে চাইল। কিন্তু লোকটাকে ওরা খুঁজে বার করবেই। তিনটি শক্তিশালী টর্চ অন্ধকারময় ওকে খুঁজে ফিরতে থাকে…।’

‘জয়, শোন।’

আমি ততক্ষণে বসার ঘরের দরজা পেরিয়ে গেছিলাম, সান্যালের ডাকে ফিরে দাঁড়াতে হল।

‘তুই কি দিন-রাতই লিখিস? আমাদের একা ফেলে…।’

‘লেখা নয়, এমনি একটু ও-ঘরে যাচ্ছিলাম।’

‘য়্যু মাস্ট হ্যাভ আ ড্রিঙ্ক উইথ আস।’

সান্যাল ততক্ষণে সোফা ছেড়ে উঠে এসে আমায় ধরে টানতে শুরু করেছে। ওর মুখে বেশ গন্ধ। কিছুক্ষণ আগে সদর দরজাটা খুলে ধরতেই এ-গন্ধটা আমার নাকে এসে ধাক্কা মেরেছিল, মেয়েটির মুখ থেকেও একই গন্ধ ভেসে আসছিল। ওদের গলার স্বর, পদক্ষেপ, সবই তাই কেমন যেন শিথিল।

বাধ্য হয়ে আমাকে ফিরে আসতে হল। এই মুহূর্তে ওর যখন গোঁ চেপেছে, তখন থামাতে যাওয়া বৃথা।

গ্লাসে পানীয় ঢালতে-ঢালতে আমি মেয়েটিকে বললাম, ‘আপনার নাম তো ল্যুইসি?’

‘লিলি, লিলিয়ান পার্কার। লিলি টু মাই ফ্রেন্ডস!’ বিশৃঙ্খল স্বরে মেয়েটি বলে ওঠে।

আমি নিঃশব্দে ওর দিকে গ্লাসটা এগিয়ে দিই।

‘আপনার লেখা এখন কেমন চলছে?’

‘চলে যাচ্ছে একরকম।’ আমি নিস্পৃহ স্বরে জবাব দিলাম।

‘সেই তো খ্যাপাটে মঙ্গলবাসীদের নিয়ে গল্প, তাই না জয়!’

কথা বলতে-বলতে এক চুমুকে মস্ত একঢোক পানীয় গিলে ফেলে সান্যাল। আমি বিরক্তি ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি ওর দিকে।

‘লিলি তোকে কিছু বলেছে?’

‘কী বলবে?’

‘আমাদের কথা। বলেনি এখনও?’

প্রথম থেকেই ওদের ওপর আমার বিন্দু-বিন্দু বিতৃষ্ণা জমা হচ্ছিল। নিরুৎসাহের দৃষ্টি মেলে আমি চেয়ে থাকি ওদের দিকে। সান্যাল মস্ত একঢোক পানীয় আত্মসাৎ করে ফেলে এক চুমুকে, কম্পিত হাত বাড়িয়ে লিলিয়ানের বাঁ-হাতটি টেনে নেয় কোলের ওপর। ওদের কারও মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই।

‘লিলির হাজব্যান্ড একটা ব্রুট, আ লাউসি বিস্ট!’ হঠাৎ সোফায় গা এলিয়ে দেয় সান্যাল। চোখ বুজে নেশাগ্রস্তের মতো বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘লিলি, মাই ডার্লিং, আই লাভ য়্যু।’

‘আমরা তাই পালাচ্ছি।’ লিলিয়ানের নির্লজ্জ নিরাসক্ত জবাব ভেসে আসে।

হঠাৎ সচকিত হয়ে সোফায় উঠে বসল সান্যাল, ‘ইয়েস, উই আর ইলোপিং, দিস ভেরি ডে। নোংরা জানোয়ারটা লিলির লাইফ হেল করে দিয়েছে।…আমরা অনেক দূরে চলে যাব—ফার অ্যাওয়ে ফ্রম দ্যাট ফিলদি বাস্টার্ড।’ আবার সোফায় মাথা এলিয়ে দেয় সান্যাল, হাত বাড়িয়ে টেনে নেয় লিলিয়ানকে। বিজড়িত স্বরে বলতে থাকে, ‘লিলি, ডার্লিং! আই মাস্ট প্রেজেন্ট য়্যু আ হেলদি হিউম্যান লাইফ।’

ঘরে আমার অস্তিত্ব ভুলে যেতে ওদের সময় লাগে না।

এই হল ওদের হেলদি হিউম্যান লাইফ, চোখের সামনেই জীবন্ত দৃষ্টান্ত ভাসছে। বিরক্তি আর বিতৃষ্ণায় আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। এদিকে লেখাটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ঝুলে আছে।

‘আমি একটু আসছি।’ সোফা ছেড়ে আবার আমি উঠে পড়লাম।

‘…লোকটা হঠাৎ ছুটতে শুরু করল। এখানে বসে থাকলে লোকগুলো ওকে ধরে ফেলবেই। একরাশ অস্পষ্ট পদশব্দ ওকে ধাওয়া করে আসছে। ওদের কাছে রয়েছে শক্তিশালী টর্চ, পিস্তলে গুলি থাকাও অস্বাভাবিক নয়। লোকটা আলো আর গুলি এড়াতে এঁকেবেঁকে ছুটতে শুরু করে। পায়ের শব্দ ক্রমশ নিকটবর্তী হয়ে আসছে, লোকটাকে ওরা এইবার ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে ফেলবে।

হঠাৎ পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় লোকটার, ঝাঁকুনি দিয়ে ওর শরীরটা বেগে নীচে নেমে যেতে থাকে। খাদ। একটা আর্ত চিৎকার…।’

‘য়্যু আর গোয়িন টু হেলপ আস, ওন্ট য়্যু?’ লিলিয়ান সোফা ছেড়ে উঠে এসে আমার হাত জড়িয়ে ধরল হঠাৎ।

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’ বিরক্তি চেপে আবার সোফায় এসে বসলাম।

‘জয়, দিনের আলোয় আমরা কোথায় যাব? তাই তোর কাছে এসে পড়লাম। অন্ধকার নেমে গেলে আমরা কোনও দূরপাল্লার বাসে চেপে পালিয়ে যাব।’

বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে অনেকক্ষণ। ইচ্ছে হল, জানলার বাইরে আঙুল তুলে ওদের দেখিয়ে দিই, কিন্তু ওরা এখন দেখেও দেখবে না, আমি নিশ্চিত।

‘তোর বাইকটা কী দোষ করল? ওটায় চেপেই তো পালাতে পারতিস!’

‘দে উইল গেট আস, য়্যু ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড? লিলির হাজব্যান্ড পুলিশে খবর দেবেই—অ্যান্ড দে হ্যাভ গট রেডিয়ো লিঙ্ক বিটুইন দেম। ওরা আমার বাইকটাকে রাস্তাতেই ধরে ফেলবে। আই মিন দ্য রোড প্যাট্রল।’ জড়িত স্বরে সান্যাল ঝিমোতে-ঝিমোতে আমায় জানাল।

স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, ও এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক নেই—বেশ খানিকটা মত্ত, বেসামাল হয়ে পড়েছে।

‘তুই ভুলে যাচ্ছিস, সান্যাল, এটা ইংরেজি ছবি নয়, ভারতবর্ষ!’ তিক্ত গলায় আমি ওকে ধমক দিয়ে উঠি।

‘আফটার অল, খোলা গাড়ি, সবাই দেখতে পাবে। তাই ভাবলাম…।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই সান্যালের প্রমত্ত দেহটা শ্লথভাবে এলিয়ে পড়ে সোফার আরামদায়ক গদিতে।

লিলিয়ান নির্জীব হাতে ওকে সামান্য ঠেলা দেয় : ‘হ্যারি ডিয়ার, ঘুমিয়ে পোড়ো না। সব কথা ওকে খুলে বলো, সো দ্যাট হি ক্যান হেলপ আস।’

‘কথা বলব? কী কথা?…আই লাভ য়্যু লিলি ডার্লিং, হোয়াই ডোন্ট য়্যু কাম ক্লোজ?’

সান্যালের সন্ধানী ডানহাতখানি লিলিয়ানের শিথিল শরীরময় কী যেন খুঁজে ফেরে।

‘…একটা আর্ত চিৎকার ওর পাশ দিয়ে চকিতে নীচে নেমে গেল। হঠাৎ শরীরে কীসের স্পর্শ লাগতেই পড়তে-পড়তেও মুহূর্তে ওর হাত দু-খানি তৎপর হয়ে ওঠে। সঙ্গে-সঙ্গে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওর পড়ন্ত শরীরখানি থমকে যায়। ওর শক্ত দুই মুঠিতে আটকে গেছে ততোধিক শক্ত কিছু পাহাড়ি চারাগাছ। পায়ের নীচে অতল খাদ, মাথার ওপর সীমাহীন কালো আকাশ, এভাবে ও কতক্ষণ ঝুলে থাকতে পারবে…?’

কিন্তু তারপর? এই মুহূর্তে আমি গুছিয়ে চিন্তা করতে পারছি না। একটা অস্পষ্ট আক্রোশ আমাকে কুরে-কুরে খেতে থাকে।

এইসব তথাকথিত উঁচু মহলের মানুষগুলো এক জীব! অপরের স্ত্রীকে নিয়ে পালাবে, তাও রীতিমতো মত্ত হয়ে! ঘোর কেটে গেলে বোধহয় পালাবার কথাটাই ভুলে যাবে ওরা।

ওদের দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে আমি ভাবছিলাম আমার ভবিষ্যতের কথা, আজকের সারাদিনটির কথা।

সকালে লেখা শুরু করার মুখেই সেই মিটার-রিডার লোকটা এসে গোলমাল শুরু করল। তারপর একঘণ্টার মধ্যেই লোপার ফোন পেলাম দু-দুবার। কাজের সময় ফোন করার জন্য মাপ চেয়ে, ও আরও একবার ফোন করেছিল—তাও সেই কাজের সময়ের মধ্যেই। তারপর ধোপা আসতে মহেশপ্রসাদ তুমুল হইচই বাধিয়ে দিল, কাপড়ের হিসেবে নাকি কীসব গোলমাল হয়েছে। পুজোর চাঁদার আশায় হানা দিল চার-পাঁচটি দল। এইভাবে একের পর এক বিপত্তি আসতেই লাগল সারাটা সকাল। সবার ওপরে রয়েছে আমার মহেশপ্রসাদ, ওর অনুযোগ আর অভিযোগের শেষ নেই। সারা সকালে লিখলাম মাত্র একপৃষ্ঠা।

চোখের সামনে ঘুরছিল আমার প্রকাশকদের মুখগুলো। দেখা হলেই আজকাল ওরা হঠাৎ খুব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। (অথচ মাত্র ক’বছর আগেও আমার এই বাড়িতেই ওরা ছুটোছুটি করেছে নিয়মিত)। গতকাল বিকেলে গেছিলাম হালদারবাবুর (বর্তমানে আমার একমাত্র প্রকাশক) ওখানে। লোকটা কেমন করুণার দৃষ্টিতে চেয়ে-চেয়ে দ্যাখে আজকাল আমায়। (অথচ নোংরা আর নিচু চরিত্রের এই লোকটাকে কোনওদিনই আমি সহ্য করতে পারতাম না।)

সন্ধ্যায় লেখা শুরু করলাম। মাত্র চার লাইন না লিখতেই এই হতভাগা…হতচ্ছাড়াগুলো এসে উপস্থিত হল।

বিশ্বাস ছিল, আমার এই শেষ লেখাটা ঠিক লেগে যাবে, আবার আমি ফিরে আসতে পারব লেখার জগতে। কিন্তু এভাবে চললে দেখছি লেখাটাই শেষ হবে না। এদিকে ব্যাঙ্কের ভাঁড়ার তো প্রায় নিঃশেষ। এই লেখাটা সময়ের মধ্যে শেষ না হলে প্রকাশই করতে পারব না, টাকার তো প্রশ্নই নেই।

একটা বিজাতীয় আক্রোশ নিয়ে অমি ওদের দিকে চেয়েছিলাম। মাতাল দুটো পশুর মতো এ-ওর গায়ে ঢলে পড়েছে।

লিলিয়ান হঠাৎ সামান্য নড়েচড়ে বসে, ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে দেওয়ালের দিকে চোখ তুলে চায়।

‘হ্যারি ডিয়ার, আমার ভয় করছে। ওই দেখো, ওই বর্শার ফলাটা কেমন যেন নড়ছে দেওয়ালে একটা সাপের মতো পাক খাচ্ছে এঁকেবেঁকে। ও গড, নো—।’

দেওয়ালে ঝোলানো স্থির বর্শার ফলাটার দিকে চাইতেই হঠাৎ একঝলক রক্ত উঠে যায় আমার মস্তিষ্কে, হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ওঠে। চকিত সঙ্কল্প মাথায় নিয়ে আমি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই।

বেল বেজে উঠতেই দরজা খুলে ধরলাম। আগন্তুক ইন্সপেক্টর সোম আমার চেনা লোক।

‘আপনাকে একটুখানি বিরক্ত করতে এলাম।’

‘আমার সৌভাগ্য। আসুন।’

বসার ঘরে সোফায় বসতে-বসতে ইন্সপেক্টর সোম জানতে চাইলেন, ‘হরিশ সান্যালকে আপনি চেনেন?’

‘হ্যাঁ, আলাপ আছে সামান্য।’

‘আচ্ছা, মাস-দেড়েক আগে উনি কি আপনার বাড়ি এসেছিলেন কোনওদিন?’

‘হ্যাঁ, এসেছিল। ওর সঙ্গে সেদিন এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভদ্রমহিলাও ছিলেন।’

‘ভদ্রমহিলা? তার নাম কি মিসেস লিলিয়ান পার্কার?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু কেন?’

‘শুনুন, ব্যাপার হল, মিস্টার সান্যাল এই ভদ্রমহিলাকে ইলোপ করেছেন। মিস্টার পার্কারের অভিযোগের উত্তরে আমরা অনুসন্ধান করে একটি চোরাই মোটরবাইক উদ্ধার করেছি। বাইকটি মিস্টার সান্যালের। আপনার বাড়ির কাছাকাছি বাসস্টপের পাশে এক ঝোপের আড়ালে ওটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। সেখান থেকে ওটা চুরি যায় এবং তারপর দু-তিন হাত বদল হয়ে শেষপর্যন্ত গত সপ্তায় ওটা আমাদের দখলে এসেছে। যাই হোক, এ-ব্যাপারে আপনি কী জানেন, আমায় খুলে বলুন।’

‘আপনি হয়তো সান্যালের বদনামের কথা শুনে থাকবেন।’

‘হ্যাঁ, মাত্রাতিরিক্ত ড্রিঙ্ক করতেন ভদ্রলোক।’

‘সেদিনও প্রায় মত্ত অবস্থায় ওরা আমার বাড়ি এসে উঠেছিল। কথায়-কথায় ও আমার কাছে জানতে চাইল, এখানকার হাইওয়ে দিয়ে কোন-কোন বাস কোথায় যায়। প্রশ্নটায় সামান্য খটকা লাগলেও আমি ওটাকে মাতালের প্রলাপ বলে হেসে উড়িয়ে দিই। তারপর ঘণ্টাখানেক এলোমেলো গল্প করে ওরা চলে গেল। আমি লেখার কাজে ব্যস্ত থাকায়, ওদের নিয়ে আর একদমই মাথা ঘামাইনি।’

ইন্সপেক্টর সোম চেনা লোক হলেও আমার বাড়ি উনি এই প্রথম এলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা নানান গল্পে মেতে উঠলাম। সোম আমায় জানালেন, মিস্টার পার্কার নাকি শুধুমাত্র নিয়মরক্ষার খাতিরে পুলিশে একটা খবর পাঠিয়েছিলেন। ফলে অনুসন্ধানের কাজটাও উনি নিয়মরক্ষার মতো করেই সারছেন। গল্প করতে-করতে হঠাৎ ওঁর চোখ পড়ে যায় দেওয়ালে ঝোলানো লোহার অস্ত্রগুলোর দিকে।

‘আপনার অ্যান্টিক কালেকশানের ঝোঁক আছে দেখছি। ওগুলো কতদিনের পুরোনো?’

আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। দেওয়ালে বর্শার ফলাটা কি হঠাৎ একটু নড়ে উঠল?

অপ্রতিভ বিজড়িত স্বরে আমি জানাই, ‘একশো বছর।’

‘অদ্ভুত তো! লোহার জিনিসগুলোতে এতটুকু মরচে ধরেনি।’ কথা বলতে-বলতে ইন্সপেক্টর দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেলেন ‘আরে, এটা কী? এই বর্শার ফলাটা দেখুন। এটার ডগার বাঁ-দিকটায় একরাশ মরচে—কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে। এর অর্থ কী?’

ইন্সপেক্টরের গলার স্বরে কি সন্দেহ? আমার বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে…গলা শুকিয়ে আসছে। আমার দিকে চেয়ে উনি অমন করে কী দেখছেন? ঘরে এতসব জিনিস থাকতেও বেছে-বেছে ওই বর্শার ফলাটার দিকেই ওঁর নজর গেল! (অথচ ওখানেই তো আরও সাত-আটটা অস্ত্র রয়েছে!) ইন্সপেক্টর আমায় খেলাচ্ছেন না তো?

বর্শার ফলাটা যেন নড়ছে দেওয়ালে, সাপের মতো পাক খাচ্ছে এঁকেবেঁকে। আমি কি ভুল দেখছি? ঘোলাটে চোখ মেলে আচ্ছন্নের মতো ওটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকি।

‘সাবধান!’ ইন্সপেক্টর সোম আমায় সজোরে ধাক্কা মারলেন।

আমার বাঁ-কাঁধ আর ইন্সপেক্টরের ডান কবজি আহত করে ফলাটা চকিতে ছিটকে পড়ল মেঝেতে। চোখের সামনে ফিনকি দিয়ে একটা রক্তস্রোত ছিটিয়ে পড়ছে চারদিকে। রক্ত-লাল এ-স্রোতটা আমার চেনা।

জ্ঞান ফিরে পেতে ইন্সপেক্টর জানালেন, অস্ত্রটা উনি হাতে নিয়ে দেখবেন বলে দেওয়াল থেকে খুলতে গেছিলেন, হঠাৎ কীভাবে ওটা হাত থেকে ছিটকে খসে পড়েছে।

তিনমাস কেটে গেছে, সেই লেখাটা আর শেষ হল না। অলস প্রহরগুলো এমন শ্লথভাবে কেটে যায়। নির্জীব বাঁ-হাতটা বয়ে আমি প্রাসাদময় ঘুরে বেড়াই সময়ে-অসময়ে। বসার ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাই মহেশপ্রসাদ বাগানে কাজ করছে একমনে। মহেশের সবজি-বাগানের খুব শখ। আমার নিষ্ফলা জমি ওকে এতদিন একটানা ঠকিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন আর ওর কোনও ক্ষোভ নেই। বাগানের অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবান সবজিগুলো দেখে মনে হয়, ওগুলো সব জীবন্ত—মাটি থেকে জৈব রস টেনে নড়ে-চড়ে কেমন বেড়ে ওঠে ওরা।

বসার ঘরের দেওয়ালে লোহার অস্ত্রগুলোর মাঝখানে একটা ফ্যাকাশে লম্বাটে দাগ স্থির হয়ে আছে। মহেশ জানে না, আমার জমির নীচে শুয়ে একটা ভারী লোহার বর্শার ফলা। সার হিসাবে ওটার কোনওই মূল্য নেই, তবে রক্তসারের স্পর্শ পেয়ে ওটার চারদিক কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে, ফলার তীক্ষ্ন ডগাটার চারপাশে জমে উঠেছে একরাশ মরচে।

মাসিক রোমাঞ্চ

মে, ১৯৮২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *