সন্ন্যাস

সন্ন্যাস

সংবাদপত্রের ব্যক্তিগত স্তম্ভে একটি বিজ্ঞাপন দেখিলাম—বাবা, মা মারা গিয়াছেন। আপনি এবার ফিরিয়া আসুন।

শ্রীরামধন ঘোষ। ফুলগ্রাম। বাঁকুড়া।

সংবাদপত্রের এই স্তম্ভটি আমার প্রিয়। রোজই পড়ি। ছেলে ম্যাট্রিক ফেল করিয়া পলায়ন করিয়াছে, পিতা বিজ্ঞাপন দিতেছেন—ফিরিয়া এস, বেশী মারিব না। এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রায়ই বাহির হয়। কিন্তু পুত্র পিতাকে অভয় জানাইয়া ফিরিয়া আসিতে বলিতেছেন, ইহা সম্পূর্ণ নূতন। আমার কল্পনা উত্তেজিত হইয়া উঠিল।

দেখিলাম, হিমালয়ের সানুদেশে গিরিগুহার সম্মুখে পাঁচজন সন্ন্যাসী বসিয়া আছেন; মাঝখানে ধুনী জ্বলিতেছে। সন্ন্যাসীদের চেহারা তপঃকৃশ, মাথা হইতে বটগাছের ঝুরির মতো জটা নামিয়াছে। তাঁহারা মিটিমিটি চক্ষে নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার ন্যায় অবস্থান করিতেছেন।

কিন্তু দেহ যতই নিষ্কম্প হোক, আজ তাঁহাদের মন চঞ্চল। ধ্যানধারণায় চিত্ত সমাহিত হইতেছে না। কারণ, গাঁজা ফুরাইয়া গিয়াছে।

গুহা হইতে কয়েক ক্রোশ দূরে একটি ক্ষুদ্র শহর আছে, একজন সন্ন্যাসী সেখানে গাঁজা আনিতে গিয়াছেন। বাকি পাঁচজন কান খাড়া করিয়া অপেক্ষা করিতেছেন।

দীর্ঘকাল কাটিবার পর অদূরে নিম্নাভিমুখে নুড়ি গড়াইয়া পড়ার শব্দ হইল। কেহ আসিতেছে। একজন সন্ন্যাসী উঠিয়া উঁকি মারিয়া দেখিয়া আসিলেন। তাঁহার মুখে হাসির আভাস দেখিয়া অন্য সন্ন্যাসীরা বুঝিলেন গাঁজা আসিতেছে।

অবিলম্বে ষষ্ঠ সন্ন্যাসী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঝুলি হইতে একটি পুরুষ্টু কাগজের মোড়ক বাহির করিতেই অপেক্ষমান সন্ন্যাসীরা বিদ্যুদ্বেগে নিজ নিজ ঝুলি হইতে গাঁজার কলিকা বাহির করিলেন। দেখিতে দেখিতে গঞ্জিকার ধূমগন্ধে হিমালয়ের সানুদেশ আমোদিত হইয়া উঠিল।

গাঁজার কলিকা নিঃশেষিত হইলে সন্ন্যাসীরা আবার ভব্যিযুক্ত হইয়া যোগাসনে বসিলেন। মুখমণ্ডল প্রসন্ন, মন কূটস্থ চৈতন্যের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করিতেছে।

একটি সন্ন্যাসীর কিন্তু চিত্ত স্থির হইল না। গাঁজার মোড়ক খবরের কাগজের ছিন্নাংশটা অদূরে পড়িয়া ছিল, তাঁহার মন বারবার সেইদিকে উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিল। সন্ন্যাসী যখন গৃহস্থাশ্রমে ছিলেন, তখন লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন।

কিছুক্ষণ উসখুস করিবার পর তিনি উঠিলেন, কাগজের টুকরাটি কুড়াইয়া লইয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিলেন। কাগজে সংবাদ কিছু নাই, কেবল বিজ্ঞাপন। সন্ন্যাসী তাহাতেই তন্ময় হইয়া গেলেন।

তারপর হঠাৎ একটি বিপুল হর্ষধ্বনি করিয়া তিনি লাফাইয়া উঠিলেন। অন্য সন্ন্যাসীদের চট্‌কা ভাঙিয়া গেল। তাঁহারা বিরক্ত চক্ষু তুলিয়া সন্ন্যাসীর পানে চাহিলেন।

সন্ন্যাসী তখন খবরের কাগজটি পতাকার মতো ঊর্ধ্বে নাড়িতে নাড়িতে নৃত্য করিতেছেন।

একজন প্রশ্ন করিলেন, ‘কি হল?’

সন্ন্যাসী ক্ষণেকের জন্য নৃত্য সম্বরণ করিয়া বলিলেন, ‘মরেছে! মরছে! লাইন ক্লিয়ার!’ বলিয়া আবার নাচিতে লাগিলেন।

‘কে মরেছে?’

‘বৌ! খাণ্ডার রণচণ্ডী মরেছে। আমি চললাম, ঘরে ফিরে চললাম!’

সন্ন্যাসী নাচিতে নাচিতে অদৃশ্য হইলেন। কাগজখানা পড়িয়া রহিল।

অন্য পাঁচজন সন্ন্যাসী স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিলেন। ধীরে ধীরে সকলের মুখে বিষাদের ছায়া পড়িল।

একজন হাত বাড়াইয়া কাগজটি তুলিয়া লইলেন, আগাগোড়া পড়িলেন। কিন্তু তাঁহার নৃত্য করিবার মতো কোনও বিজ্ঞাপনই তাহাতে নাই।

একে একে সকলেই কাগজটি দেখিলেন। সমবেত নাসিকা হইতে দীর্ঘশ্বাস বাহির হইল। তারপর তাঁহারা আর এক দফা গাঁজা চড়াইলেন।

সন্ন্যাসীদের সন্ন্যাসগ্রহণের মূলতত্ত্ব গুহায় নিহিত। এ বিষয়ে পরিসংখ্যান রচনা করা প্রয়োজন। দেশে যে সাধু-সন্ন্যাসী বাড়িয়াই চলিয়াছে, ইহার কারণ কি?

২৭ অগ্রহায়ণ ১৩৫৯

1 Comment
Collapse Comments

গল্পটা আরো বাড়িতে পারিতো, তাহাতে হয়তো গল্পটি পূর্ণতা পাইতো এবং অতি মনোজ্ঞ একটি গল্পের স্বাদ পাওয়া যাইতো, পড়িলে মনে হয় গল্পটি অসম্পূর্ণ। যাহাই হউক উনি তো আর ইহজগতে নেই, তাই বিলাপ বৃথা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *