সন্ধেবেলার মানুষ
পরদা উঠলে দেখা গেল মঞ্চ অন্ধকার। কয়েক মুহূর্ত যেতেই আমরা বুঝতে পারলাম এমনটা নাটকে ছিল না। উইংস-এর ওপাশে যাঁরা ছিলেন তাঁরা ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করলেন। কথাবার্তা যা ভেসে এল তাতে বুঝলাম বৈদ্যুতিক বিভ্রাট ঘটে গেছে।
আমরা উশখুশ করতেই একটা মোমবাতি দেখা গেল। ছোট্ট আলো সামলে যিনি মঞ্চে এলেন তাঁর বয়স আন্দাজ করা মুশকিল।
মুখেই আলো জমায় মোটামুটি বয়স্ক ঠেকছে। ভদ্রলোক এগিয়ে আসতে আধো-আলোয় মধ্যবিত্ত আসবাব দেখতে পেলাম।
উপস্থিত ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলারা, আপনারা আমার নমস্কার গ্রহণ করুন। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না সেটা বুঝতেই পারছেন। কথা তো অনেক কিছুরই থাকে না, হয়ে যায়, এবং হলে আমরা তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।
যা হোক, চুপচাপ বসে থেকে আসুন আপনাদের সঙ্গে আমি একটু আলাপ পরিচয় করে ফেলি। আমরা আজ যে নাটকটি করব সেটি আমার পরিবারের কয়েকজনকে নিয়েই। যেহেতু আমিই একমাত্র রোজগেরে মানুষ, তাই আমাকেই কর্তা বলা হয়। আমার নামে কার্ড এলে স্ত্রী নেমন্তন্ন খেতে যান। তাই এই নাটকের প্রধান চরিত্র হিসেবে আপনাদের সঙ্গে কথা বলার অধিকার আমার আছে।
ভদ্রলোক মোমবাতিটা একটা টেবিলে সযত্নে রাখলেন। আলো সরতেই বুঝলাম ওঁর বয়স পঞ্চাশের গায়ে। কথা বলার ধরন মন্দ নয়।
আমার নাম নিরাপদ মিত্র। একেবারে সাদাসাপটা নাম। আমি জীবনে কখনও কোনও পাপ করিনি। যাকে বলে অন্যায়, তা কখনও করিনি। মিথ্যে কথা বলিনি। এই কথাগুলো আপনাদের কানে সোনার পাথরবাটির মতো শোনাচ্ছে। কিন্তু এটাই সত্যি। আমি রাজ্য সরকারের একজন। কর্মচারী এবং এখন পর্যন্ত ঘুষ নিইনি। এই বাড়িটা আমার স্বর্গীয় পিতৃদেব কিনেছিলেন। গত কুড়ি বছরে হোয়াইট ওয়াশ করাতে পারিনি পয়সার অভাবে। খুব কষ্ট হচ্ছে সংসার চালাতে। এটা নতুন গল্প নয়। কিন্তু এ-বাড়িতে মনে হয় কষ্টটা আমি একাই করছি। আপনাদের এসব কথা বলছি জানলে বাড়িতে কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে। আমার বেশি কথা বলা বারণ।
আমরা চারজন এই বাড়িতে থাকি। আমার স্ত্রী নন্দিতা দাঁড়ান, নন্দিতার সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়ে দিই। পঁচিশ বছর আগে আমরা যখন বিয়ে করেছিলাম তখন ওর বয়স ছিল বাইশ। এই সাতচল্লিশে চেহারাটা খুব খারাপ রাখেনি। হ্যাঁ, আগে খুব ছিপছিপে ছিল, কথাবার্তায় মিষ্টত্ব ছিল। আমারই দোষে সেগুলো নষ্ট হয়েছে। তবে হ্যাঁ, ও যে দুটো বড়-বড় ছেলেমেয়ের মা, তা দেখলে বোঝা যায় না। ডাকি ওকে, নন্দিতা, নন্দিতা–!
কেন? ভেতর থেকে গলা ভেসে এল।
একটু এ ঘরে আসবে?
প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে উত্তর না পেয়ে নিরাপদ মিত্র আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, আমি অবশ্য সচরাচর এমন ডাকাডাকি করি না। অস্বস্তি হয়। আসলে ছেলে বা মেয়েকে যে গলায় ডাকি, স্ত্রী কে ডাকতে গেলেও তো সেই গলাতেই ডাকতে হয়। ভেবে দেখুন, ব্যাপারটা ঠিক নয়, আমার বাবা তোমাকে কোনওদিন নাম ধরেই ডাকেননি।
এই সময় সালোয়ার কামিজ পরা লম্বা গড়নের একজন ঘরে ঢুকল, ডাকছ কেন?
তোমাকে নয়, তোমার মাকে।
মা সেটাই জানতে চাইল। মেয়েটার উচ্চারণ খুব স্পষ্ট।
অ। তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
কাজ ছিল।
কাজ? ইউনিভার্সিটি ছুটি হয় চারটেয় আর রাত সাতটা পর্যন্ত কী কাজ করো?
রাত সাতটা নয়, সন্ধে সাতটা।
আমার প্রশ্নের এটা উত্তর নয়।
বললাম তো কাজ ছিল।
না, থাকতে পারে না। বিকেলবেলার পর তোমার বয়সি মেয়ের কোনও কাজ থাকতে পারে না। যদি দরকার হয়, সেই কাজ দিনেরবেলায় করবে।
কেন?
আমার চিন্তা হয়।
তোমার ছেলে রাত নটার আগে বাড়ি ফেরে না। তাকে একথা বলো না কেন?
আশ্চর্য! সে ছেলে, নিজের ব্যাপারটা সামলাতে পারে।
বাবা, তোমার ধারণা সন্ধে নামলেই কলকাতার রাস্তায় চিতাবাঘ আর হায়না ঘুরে বেড়ায়?
আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করতে চাই না।
না, তুমি আমাকে বোঝাও। সন্ধের পর রাস্তায়-হাজার হাজার মানুষ ঘুরে বেড়ায়। মেয়েরাও কাজের জন্যে বের হয়। তোমার কি মনে হয়, সেইসময় ছেলেরা আমাদের অসম্মান করবে?
করতে পারে।
এই ছেলেরা কারা? শ্যামল বা তোমার কারও ভাই অথবা বাবা?
নিরাপদ যেন স্তম্ভিত, তুমি কী বললে!
অবাক হয়ো না। কথাটা সত্যি। যারা মেয়েদের অসম্মান করে তারা আকাশ থেকে পৃথিবীতে নেমে আসে না। আর সেইসব জন্তুগুলো দিনেরবেলাতেও সক্রিয় থাকে। বাবা, আমরা এতকাল ভয় পেতাম আর তোমরা সেই ভয়টাকে হাওয়া করতে। কিন্তু এখন দিন বদলে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে তুমি অসুস্থ হলে আমাকেই ডাক্তার ডাকতে বেরুতে হবে, তাই না?
মেয়েটি বেরিয়ে গেল। নিরাপদ মিত্রকে বেশ বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। নিজেকে সামলে নিতেই বোকার মতো হাসলেন। হেসে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার মেয়ে নীপা।
অবশ্য অতবার-বাবা ডাক শুনে আমরা সম্পর্কটা বুঝেই গিয়েছিলাম, তাই এটা না বললেও ওঁর চলত। নিরাপদ মিত্র এক পা এগিয়ে এলেন, জানেন মশাই, আজকাল নিজের মেয়েকে ঠিকঠাক বুঝতে পারি না। এমন সব কথা বলে যে, যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা মুশকিল হয়ে পড়ে কিন্তু মানতে কষ্ট হয়। হ্যাঁ মানি, আজকালকার মেয়েরা আমাদের মা-মাসিমাদের মতো নয়, কিন্তু কাগজ খুললেই এত ধর্ষণের ঘটনা চোখে পড়ে যে, বাবা হিসেবে আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায়?বলুন! যাকগে, মেয়ের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিলাম কিন্তু যাঁকে ডেকেছি তিনি এখনও এলেন না। শৈশবে দেখেছি ঠাকুরদা বা বাবার কীরকম কন্ট্রোল ছিল ফ্যামিলির ওপর। মুখের কথা। খসামাত্র কাজ হয়ে যেত। মা বাবার অবাধ্য হয়েছেন এমন ঘটনার কথা ভাবতেই পারি না। আর আজকাল। আমিই একমাত্র আর্নিং মেম্বার কিন্তু আমাকেই তোয়াক্কা করে না। মা ভয় পেতেন দেখে আমরাও বাবাকে ভয় পেতাম। এখন ছেলেমেয়েরা মাকে দেখে শিখছে, কি করে বাবাকে অবজ্ঞা করা যায়।
ডাকছ কেন? আধা-অন্ধকারে এক মধ্যবয়সিনী প্রবেশ করলেন।
তোমার মেয়ে আমাকে পাঁচকথা শুনিয়ে গেল।
কেন খোঁচাতে যাও!
বাঃ, চমৎকার! রাত করে বাড়িতে ফিরবে আর বললেই দোষ!
কেন রাত হল জিজ্ঞাসা করেছ?
করেছি। বলল, কাজ ছিল। এটা কোনও উত্তর হল?
যখন সংসারের কোনও কাজ করবে না, তখন ওটাই উত্তর।
তার মানে? আমি সংসারের কাজ করি না।
কী করো? সকালে বাজারটা আর ইলেকট্রিক বিল জমা দেওয়া। টাকা এনে দিচ্ছ বলে সাপের পাঁচ-পা দেখেছ! নীপা এ ঘরে আসার আগেই তুমি ডেকেছিলে আমাকে!
নিরাপদ হাত ছুড়লেন, মনে নেই। এসব শোনার পর কিছু মনে থাকে না। এক-এক সময় মনে হয় তোমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিই। এটা কি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক?যখনই দেখা হয় তখনই দুরমুশ করছ। আমি যেন পাপোশ, দেখলেই পা ঘষছ।
হতে পারে। তোমার সম্পর্কে আমার কোনও আগ্রহ নেই। যা বোঝার তা একদিনে বুঝে। নিয়েছি। যার সম্পর্কে আগ্রহ নেই তার সঙ্গে প্রেম করা যায় না।
ও আচ্ছা। তা তো বলবে। পাবলিক তোমার কথা শুনছে। বুঝে যাচ্ছে তুমি কী চিজ।
চিজ! আমাকে তুমি চিজ বললে!
নয়তো কী? আমার সঙ্গে যখন কথা বলো তখন যেন ড্রাম বাজছে আর যতীন যখন আসে তখন মনে হয় জলতরঙ্গ!
যতীনবাবু হাসালে! ওই সিঁড়িঙ্গে লোকটা সম্পর্কে আমার আগ্রহ হবে? তুমি তো এর বেশি ভাবতেও জানো না। এইসময় কড়া নাড়ার আওয়াজ হতেই ভদ্রমহিলা দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
নিরাপদ মিত্র আমাদের দিকে তাকালেন, এইরকম এক মহিলার সঙ্গে আমাকে ঘর করতে হচ্ছে। আমি অভিযোগ করছি না, নন্দিতা, আমি ছাড়া আর সবার কাছে খুব ভালো। কিন্তু আমি আমার দোষটা বুঝতে পারি না। আমি অসৎ নই, মিথ্যে কথা বলি না, কখনও কোনও পাপ করিনি। লাস্ট দশ বছর নন্দিতা মেয়ের সঙ্গে শুচ্ছে। মাঝে-মাঝে ভাবি আমার সঙ্গে ওর বিয়ে না হলেই ভালো ছিল। ওর সঙ্গে প্রেম করার জন্যে পাড়ার একটি ছেলে ছটফট করত। বাবা-মায়ের ভয়ে তাকে প্রশ্রয় দিতে পারেনি। এ গল্প বিয়ের দু-বছর বাদে শুনেছিলাম। ছেলেটার নাম কী। যেন–পার্থ, পার্থ সান্যাল। পার্থর সঙ্গে বিয়ে হলে নন্দিতা সান্যাল হয়ে এখন নিউ জার্সিতে। থাকত। নন্দিতাই খবর এনেছে পার্থ এখন আমেরিকান শিল্পপতি। নিরাপদর জায়গায় পার্থ হতেই পারত। ভাবতেই কেমন লাগে! আচ্ছা, এই নিয়ে নন্দিতার মনে আপশোশ নেই তো! মুখে বলেনি কোনওদিন, কিন্তু–।
হঠাৎ ভেতর থেকে চিৎকার ভেসে এল, বাড়িতে ভূতের মতো বসে আছ। সমস্ত পাড়ায় আলো জ্বলছে। ফিউজটা গেছে, এটা চেঞ্জ করতে পারোনি!
সঙ্গে-সঙ্গে নন্দিতার গলা, কে করবে? যাঁর করার কথা তিনি তো ওই ঘরে দাঁড়িয়ে কাব্যি করছেন।
নিরাপদ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এইসময় দপ করে আলো জ্বলে উঠল। ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নিবিয়ে দিলেন তিনি। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার ছেলে ঘরে ফিরলেন। ছেলে না বলে অপোনেন্ট বলাই ভালো। ওর সঙ্গে আলাপটা আপনারা নিজেরাই করে নিন। ততক্ষণ আমি হাতমুখ ধুয়ে নিই।
নিরাপদ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আমরা চোখ বোলালাম। একটি অতি সাধারণ ড্রইং কাম ডাইনিং রুম। ঘরের দেওয়ালের চুন অনেক জায়গায় খসে-খসে গিয়েছে। একটা সস্তা টেবিল এবং চারটে চেয়ার দেখতে পাচ্ছি একপাশে। এদিকে তিনটে কাঠের চেয়ার মুখোমুখি। নন্দিতা ঘরে ঢুকলেন হাতে দুটো থালা নিয়ে। টেবিলে নামিয়ে রেখে গলা তুললেন, খাবার দিয়েছি! সঙ্গে-সঙ্গে নীপাকে দেখা গেল জলের জাগ এবং তিনটে গ্লাস নিয়ে ঢুকতে। ব্যস্ততা বাড়ল।
নন্দিতা কয়েকবার সম্ভবত রান্নাঘরেই গেলেন এবং তিনটে থালায় খাবার ছাড়াও একটা আলাদা পাত্র মাঝখানে রইল। নীপা একপাশে চেয়ার টেনে বসতেই ঘরে শ্যামল এল। মাঝারি লম্বা, ছিপছিপে সুদর্শন, কিন্তু একটু চোয়াড়ে ভঙ্গি আছে। পরনে গেঞ্জি পাজামা। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঈষৎ ঝুঁকে খাবারের থালার দিকে তাকাল। ওর মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল, ওঃ, সেই একঘেয়ে ব্যাপার।
নন্দিতা বললেন, বোস।
চেয়ার টেনে নিল শ্যামল, ধুস! এভাবে খাওয়া যায় না। একদিন একটু ভালো করে রাঁধতে পারো না?
নীপা বলল, ওই সয়াবিনের তরকারিটা আমাকে দিও না।
ছেলে নয়, মেয়ের দিকে তাকালেন নন্দিতা, কী দিয়ে খাবে?
ডাল দিয়েই হয়ে যাবে। নীপা হাত বাড়াল।
শ্যামল মায়ের দিকে ফিরল, আজ মাংস করতে বলেছিলাম না?
নন্দিতা হাসার চেষ্টা করলেন, মাংসের কেজি কত করে জানিস?
যতই হোক, লোকে তো খাচ্ছে, কারা খাচ্ছে, কীভাবে খাচ্ছে তা আমার জানার দরকার নেই।
তোর বাবা যে টাকা দেয় তা থেকে শেষদিকে মাংস কেনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। নন্দিতা। ঝাঁঝিয়ে উঠে দেখতে পেলেন নিরাপদ ঢুকছে। সেই গলায় তিনি বললেন, এসব কথা রোজ রোজ শুনতে আমার ভালো লাগে না। তুমি জবাবদিহি দাও!
নিরাপদ চেয়ার টেনে নিলেন। নন্দিতা বসলেন না। নিরাপদ বলেলেন, আমার যা রোজগার তাতে এর চেয়ে বেশি হয় না শ্যামল। তুই পাশটাশকরে চাকরি করলে ইচ্ছেমতো খেতে পারবি।
চাকরি যেন হাতের মোয়া, চাইলেই পাব! শ্যামল রুটি ছিঁড়ল।
নন্দিতা আরও বিরক্ত হলেন, এমনভাবে কথা বলছিস যখন, তখন কলেজে যাওয়াই বা কেন? তাতেও তো কিছু পয়সা বাঁচে।
শ্যামল মায়ের দিকে তাকাল, আশ্চর্য! তোমরা কেউ সত্যি কথা ফেস করতে চাও না কেন বলো তো? আজকাল যেখানে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেও চাকরি পেতে হিমসিম খেতে হচ্ছে, সেখানে আমার কোনও চান্স নেই, বুঝলে?
ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করার চেষ্টা করেছিস কখনও? নন্দিতা যেন বাগে পেলেন।
ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট ইচ্ছে করলেই করা যায় না, তার জন্যে প্রতিভা থাকা চাই। বাবা সেকেন্ড ক্লাশে বি. এ. পাশ করেছিল, তুমিও তাই। আমি গাছ থেকে প্রতিভা পেড়ে নেব?
শ্যামল কথাটা বলামাত্র নীপা উঠে গেল খাওয়া শেষ করে। নিরাপদ জিজ্ঞাসা করলেন, এ কী, ওর খাওয়া হয়ে গেল?
মাথা নাড়লেন নন্দিতা, আমাকে জিজ্ঞাসা কোরো না, পাগল হয়ে গেলাম। ওনার সয়াবিনের তরকারিতে গন্ধ লাগে। নবাব-কন্যা!
শ্যামল বলল, বাবা মোটেই নবাব নয়। সাধারণ মানুষও বলা যায় না।
নিরাপদ অবাক হলেন, আমি সাধারণ মানুষ নই!
না। এখন সাধারণ মানুষ শিখে গেছে বাঁচতে হলে কীভাবে অ্যাডজাস্ট করতে হয়। যে দুশো টাকা রোজগার করত সে তিনশো পাওয়ার চেষ্টা করে। তুমি যত সব প্রিমিটিভ আইডিয়া নিয়ে বাস করছ। জামা-কাপড়ের ইস্ত্রি নষ্ট হয়ে যাবে বাসে চড়লে, তাই দু-কিলোমিটার হেঁটে অফিসে যাও। আসলে রোজ দু-টাকা বাঁচাও। কিন্তু তোমার কলিগ শেয়ার ট্যাক্সিতে যায়, সে কীভাবে টাকা পায়?
যতীন ঘুষ নেয়।
তো কী হয়েছে?
তার মানে?তুই বলছিস কী?
আজকাল যখন এ-টু-জেড ঘুষ নিচ্ছে, তখন তুমি সৎ থেকে আমাদের এই সয়াবিন খাওয়াচ্ছ! সারা পৃথিবী আজ জেনে গিয়েছে ধরা পড়ে প্রমাণিত না-হওয়া পর্যন্ত ঘুষ অত্যন্ত স্বাভাবিক পদ্ধতি, যে পদ্ধতিতে মানুষ একটু সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে।
নিরাপদ স্ত্রীর দিকে তাকালেন, শুনছ, ও আমাকে ঘুষ নিতে বলছে?
নন্দিতা জবাব দিলেন না।
শ্যামল বলল, মানুষের ধ্যানধারণা চিরকাল এক জায়গায় আটকে থাকে না। আজ থেকে দুশো বছর আগে মেয়েরা পড়বে কেউ ভাবত না। পঞ্চাশ বছর আগে অফিসে চাকরি করার কথা চিন্তা করত না। এখন এ নিয়ে প্রশ্ন কেউ তোলে? এই যে মা, আচ্ছা, তোমার বয়স এখন কত বললো। তো? পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ হবে, তাই না?
নিরাপদ জিজ্ঞাসা করলেন, ওর বয়স নিয়ে তোর কী দরকার?
তোমার ঠাকুমা এমনকী তোমার মাকেও ওই বয়সে দেখেছ? কীভাবে শাড়ি পরত ওরা? দিদিমা দিদিমা টাইপ না? অথচ মাকে দ্যাখো; নীপার সঙ্গে কোনও ডিফারেন্স পাবে না। এটাই স্বাভাবিক। আর তুমি সেই কথামালা জপে যাচ্ছ।
নিরাপদ চুপচাপ খাচ্ছিলেন। এবার বললেন, দ্যাখো শ্যামল, এইসব কথা, যা তুমি বললে, তা আর আমার সামনে উচ্চারণ করো না। আমি যেভাবে এতদিন চালিয়েছি, বাকি কটা দিন সেইভাবেই চালাব। শৈশব থেকে তোমাদের যেভাবে বড় করেছি তাতে কষ্ট থাকলেও স্বস্তি ছিল, আনন্দ ছিল। আজ বড় হয়ে যদি তোমার মনে হয়, আমার আচরণের জন্যে তোমাদের কষ্ট হচ্ছে, তাহলে আমার কিছু করার নেই।
শ্যামল আর কথা বলল না। নন্দিতা চেয়ার টেনে নিঃশব্দে বসে পড়লেন। কয়েক সেকেন্ড যাওয়ার পর নন্দিতাই পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্যে বললেন, শ্যামল, তোর তো ফাইনাল ইয়ার এবার, ইউনিয়ন করা ছাড়।
খেতে-খেতে মুখ না তুলে শ্যামল জিজ্ঞাসা করল, চাকরি দেবে কে?
মানে! নন্দিতা অবাক।
তোমার কোনও ক্ষমতাবান দাদা, বাবা, ভাই আছে?
না। মাথা নাড়লেন নন্দিতা।
তোমার? নিরাপদর দিকে তাকাল শ্যামল।
আমাকে কেউ হেল্প করেনি কখনও।
কারণ তাঁরা সবাই অর্ডিনারি। আজকাল ইনফ্লুয়েন্সিয়াল সোর্স না থাকলে যে চাকরি পাওয়া যায় না, তা একটা শিশুও বোঝে। আমার কেউ নেই তাই আমি ইউনিয়ন করছি। নীচুতলার নেতাদের সঙ্গে ভাবসাব হয়ে গেছে। আর একটু ওপরে উঠলে সোর্সটা অনেক বড় হয়ে যাবে। কেউ ইউনিয়ন রাজনীতি বখে যাওয়ার জন্যে করে না, গুছিয়ে নেওয়ার গ্রাউন্ড-ওয়ার্ক এটা। উঠছি। শ্যামল খাওয়া সেরে উঠে দাঁড়াল, তোমার সঙ্গে আমার কোনওদিন বনবে না বাবা।
নিরাপদ বললেন, হয়তো!
কিন্তু আমি আমার কর্তব্য করে যাব।
ভালো। তবে না করলেও আমি দুঃখিত নই। তোমাদের বড় করা কর্তব্য, করেছি, কিন্তু তার বদলে আমার কোনও প্রত্যাশা নেই। যে যারটা বুঝে নিয়ে ভালো থাকলেই হল।
শ্যামল আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। নন্দিতা স্বামীর দিকে তাকালেন, কথাটা ভেবেচিন্তে বললে?
হ্যাঁ।
মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর তোমার হাতে কিছু থাকবে? রিটায়ারমেন্টের আর ক-বছর দেরি খেয়াল রাখো? তারপর যদি ছেলে না খাওয়ায়–।
তোমাকে খাওয়াবে?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই, একশোবার খাওয়াবে। কারণ তোমার মতো হাড়ে দুব্বো গজানো কথা ওদের সঙ্গে আমি বলি না। তখন দেখব তুমি কী করো! রাগত নন্দিতা থালা-গ্লাস তুলতে-তুলতে কথাগুলো বলে ওগুলো নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। নিরাপদর হাতে তখন জলের গ্লাসটা। তাঁর থালা ভেতরে চলে গিয়েছে। জলটা গলায় ঢেলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কয়েক পা এগিয়ে এলেন আমাদের সামনে, এই হল আমার সংসার। সবাই সবার মতো ভালো। তা এরকমটা চলে যেত। কিন্তু আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। আজ সকালে একটা পোস্টকার্ড পেয়েছি। ওটা এসেছে। কুচবিহার থেকে। যখন অফিসে বেরুচ্ছিলাম তখন পিওন আমার হাতে দিল। ওটা পাওয়ার পর আমি যাকে বলে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। কাউকে বলতে পারছি না। কী বলব? বললে তো অনেক কথা বলতে হয়। আমি মিথ্যে কথা বলি না। কিন্তু এই সত্যি কথাগুলো কেউ বিশ্বাস। করবে? ধ্যানধারণা বদলাচ্ছে। ঘেঁচু! মানুষ আদ্যিকালেও সন্দেহ করতে ভালোবাসত, এখনও বাসে। কিন্তু চেপে যাওয়ার উপায় নেই। সর্দি অথবা বসন্ত যেমন শরীর থেকে বের হবেই, এও তেমন। এখন যে চিঠি লিখে বারণ করব তার উপায় নেই। নিজের মুখে বললে অনেক কথা। বলতে হয়, তাই সন্ধেবেলায় পোস্টকার্ডটা আমাদের লেটার-বক্সে ফেলে এসেছি। ওরাই বাক্সটা খুলুক, দেখুক। তারপর যা হয় হবে।
মঞ্চ অন্ধকার হয়ে গেল। আবার আলো ফুটলে দেখলাম পেছনের জানলা খোলা। ওই একই ঘর। কিন্তু জানলার বাইরে সকালের কচি আলো। সময়টা সকাল বলেই মনে হচ্ছে। একটা পোস্টকার্ড পড়তে-পড়তে নীপা ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে উঠল, চিঠি এসেছে।
নন্দিতার গলা পাওয়া গেল, কার?
নীপা মন দিয়ে পড়তে লাগল। জবাব দিল না।
ঘুমঘুম চোখে শ্যামল ঘরে ঢুকল, কার চিঠি রে?
অদ্ভুত! নীপা বলল, মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না। মা, এ ঘরে এসো!
নন্দিতা ঢুকলেন। নীপা বলল, বাবার নামে চিঠি এসেছে।
কে লিখেছে?
কল্যাণী।
সে আবার কে?
কোথায় থাকে? কুচবিহার।
কুচবিহার!
ওখানে ওর কেউ থাকে বলে জানতাম না তো! কী লিখেছে? পড়!
নীপা পড়তে শুরু করল, শ্রীচরণকমলেষু, আশা করি ভালো আছ। দীর্ঘ তিরিশ বছর পর নিতান্ত বাধ্য হয়ে তোমাকে চিঠি লিখছি। অনেক কষ্টে তোমার ঠিকানা পেয়েছি। আশা করছি তুমি আমাকে ভুলে যাওনি। আমার একমাত্র মেয়ে মালবিকা অসুস্থ। এখানকার ডাক্তার রোগ ধরতে পারছে না। তারা কলকাতায় যেতে বলছে অথচ সেখানে আমার কোনও বলভরসা নেই। তাই। তোমার সাহায্য চাই। আমরা আগামী মঙ্গলবার তিস্তা-তোর্সায় রওনা হব। যদি তোমার আপত্তি থাকে তাহলে অবিলম্বে জানাও। প্রণাম নিও। ইতি কল্যাণী।
নন্দিতার মুখ থেকে শব্দ ছিটকে বের হল, কী আশ্চর্য! এখানে এসে উঠছে নাকি?
নীপা বলল, বাবার কাছে সাহায্য চেয়েছে।
শ্যামল বলল, আর লোক পেল না?বাবা কাকে চেনে?
নন্দিতা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন, কোথাকার কে, ফস করে লিখে দিল যে আসছে!
নীপা বলল, বাবার কোনও দূর-সম্পর্কের আত্মীয়া?
নন্দিতা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাত উলটে বললেন, কে জানে!
এই সময় বাজারের ব্যাগ হাতে নিরাপদ ঘরে ঢুকে বললেন, কাঁচালঙ্কা আবার আকাশছোঁয়া হয়ে গেল।
কল্যাণী কে? নন্দিতা প্রশ্নটা ছুড়ল।
কল্যাণী–!
চিঠিটা দে নীপা।
নীপা চিঠিটা এগিয়ে দিতে নিরাপদ সেটায় চোখ রাখলেন।
কল্যাণী বলে কাউকে চেনো না?
চিনতাম।
সে কে?
মালদায় থাকত। কুচবিহারে গিয়েছে জানতাম না। নিরাপদ বললেন, মালদার মোকদমপুরে আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত। আমি তখন কলেজে পড়ি, আর ও, কত হবে ক্লাশনাইন-টেন–। অবশ্য সেই কল্যাণী আর এই কল্যাণী এক কিনা বলতে পারব না।
নীপা বলল, লিখেছে তিরিশ বছর পরে চিঠি লিখছে, তাহলে এক হতেই পারে। বিয়ের পর মালদা থেকে কুচবিহার চলে গেছে।
হতে পারে। ওর বিয়ের আগেই আমরা কলকাতায় চলে আসি।
নন্দিতা আর পারছিলেন না, তোমার সঙ্গে কি সম্পর্ক ছিল?
সম্পর্ক? তখন আর কি সম্পর্ক হবে! আমার কাছে অঙ্ক করতে আসত।
তুমি ওকে পড়াতে?
টাকা নিতাম না, দেখিয়ে দিতাম।
কোনও সম্পর্ক না থাকলে এতদিন পরে এখানে এসে ওঠে?
এখানে ওঠার কথা তো লেখেনি।
আর কী লিখবে? শোনো, এখানে ওর ওঠা চলবে না। আজই লিখে দাও।
বেশ। কিন্তু–।
আবার কিন্তু কীসের!
যা লিখেছে তাতে তিস্তা-তোর্সায় আজই পৌঁছবার কথা। মঙ্গলবার রওনা হলে বুধবার, বুধবার তো আজই। চিঠি আসতে অনেক সময় লেগেছে।
সে কী! নন্দিতা আর্তনাদ করে উঠলেন, তাহলে কী হবে?
শ্যামল বলল, চেঁচাচ্ছ কেন?যদি আসে, চা খেতে দিও, ফ্রেশ হয়ে গেলে নিজেরাই বলবে কোথায় যাবে! আফটার অল বাবার পরিচিত।
তিস্তা-তোর্সা কখন আসে বাবা? নীপা জিজ্ঞাসা করল।
সকালে। নিরাপদ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
নীপা চোখ বড় করল, বাবা ট্রেনের টাইম পর্যন্ত জানে!
গার্লফ্রেন্ড আসছে তো! শ্যামল আস্তে করে বলল।
আসাচ্ছি! উঃ, পেটে-পেটে এত! এতবছর ঘর করছি, কখনও বলেনি। নন্দিতা গজগজ করতে করতে চলে গেলেন।
শ্যামল বলল, আমার না কেমন সন্দেহ হচ্ছে, বাবা পোস্টকার্ডটার খবর জানত!
হ্যাঁ রে! সিলমোহর না দেখেই সব বলে দিল–চিঠি আসতে সময় লেগেছে।
প্লাস তিস্তা-তোর্সার সময় আগে থেকে জানার কোনও কারণ নেই। ব্যাপারটা একটু গোলমেলে মনে হচ্ছে। একটা ট্যাক্সির শব্দ হল মনে হচ্ছে। দাঁড়া, দেখি।
মুখ ধুসনি, ভূতের মতো বাইরে যাচ্ছিস?তুই বাথরুমে যা, আমি দেখছি। ও হ্যাঁ, বাবার ঘরে একটা তোয়ালে আছে, ওটা বাথরুমে রেখে দে। গামছাগুলোর যা অবস্থা! নীপা ভাইকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল।
শ্যামল গালে হাত বোলাল, তারপর জানলায় গিয়ে দাঁড়াল, আই বাপ! তারপর উত্তেজিত গলায় ডাকল, মা, মা!
নন্দিতা এলেন, কী হল?
এসে গেছে!
সেকী!
হ্যাঁ, বেডিং নিয়ে এসেছে। তোমার বয়সি মহিলা। ফরসা, সঙ্গে একটা মেয়ে। দেখে অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে না।
মনে হচ্ছে না?
না। দিব্যি নীপার সঙ্গে কথা বলছে।
বলাচ্ছি!
মা, তুমি আবার ওদের সামনে রাগ কোরো না। আফটার অল দে আর কামিং ফ্রম কুচবিহার। নীপা সুটকেস নিয়েছে, ভদ্রমহিলা বেডিং।
তুই এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস?
বাথরুমে যাব। যাচ্ছি। শ্যামল হড়বড়িয়ে গেল ভেতরে।
নন্দিতা কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। হঠাৎ টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ছেঁড়া কাপড় তুলে টেবিল পরিষ্কার করতে লাগলেন, চেয়ারগুলো ঝাড়লেন। এবং তখনই নীপা সুটকেস হাতে। ঢুকল, মা!
বেডিং নিচে নামিয়ে কল্যাণী হাতজোড় করলেন, নমস্কার।
নন্দিতা প্রতি-নমস্কার করলেন। তাঁরই বয়সি হতে পারে কিন্তু ভারী চেহারা। মাথায় সিঁদুর নেই, লক্ষ করলেন। নীপা বলল, আমি বলেছি আমরা আজই চিঠি পেলাম।
কল্যাণী বললেন, শুনে খুব খারাপ লাগছে–।
না, ঠিকই আছে, বসুন। তোমার নাম কী?
সতেরো-আঠারোর মেয়েটি শান্ত গলায় জবাব দিল, মালবিকা।
ওরই চিকিৎসার জন্যে আসা। আপনাদের তো চেনার কথা নয়, যিনি চিনতেন তিনি এখন আমাকে দেখলে চিনতে পারবেন কিনা সন্দেহ হচ্ছে। অনেককাল আগের কথা তো?
বাবা চিনতে পেরেছেন। আপনি বাবার কাছে পড়তে যেতেন তো!
যাক, মনে আছে তাহলে!
মা, বাবা কোথায়? বাবা, বাবা! নীপা চেঁচাল।
নন্দিতা বললেন, বসুন।
এইসময় নিরাপদ ঘরে এলেন। তাঁর চোখেমুখে বিস্ময়। বিস্ময় কল্যাণীর মুখেও। প্রথম কথা বললেন কল্যাণীই, তুমি প্রায় একইরকম আছ নিরাপদদা।
একইরকম কি থাকা যায়, বয়স হচ্ছে না?
আমাকে চিনতে পারছ?
মুখ পালটায়নি, মোটা হয়েছ।
এই আমার মেয়ে। বাঁ-হাতে প্রণাম করা ঠিক নয়, তাই প্রণাম করতে পারছে না।
কেন, ডান হাতে কী হয়েছে?
ওই তো মুশকিল। ডাক্তাররা ধরতে পারছেনা। ডানহাত নাড়তেই পারছে না ও। যা করার বাঁ হাতে করতে হচ্ছে। অথচ ডানহাত একটুও অবশ হয়নি।
নীপা বলল, মালবিকা, তুমি আমার সঙ্গে এসো।
মালবিকা তার মায়ের দিকে তাকাল। কল্যাণী বললেন, নিরাপদদা, কলকাতায় আমার কোনও আত্মীয়স্বজন নেই। ওর চিকিৎসার জন্যে আমাকে কিছুদিন এখানে থাকতে হবে। একজন ভালো ডাক্তার আর থাকার ব্যবস্থা তুমি করে দাও।
আমি তো তেমন কাউকে– বিড়বিড় করলেন নিরাপদ।
ব্যবস্থা হয়ে যাবে। শ্যামলের গলা পাওয়া গেল। পরিষ্কার হয়ে সে ঘরে ঢুকল, আমাদের ইউনিয়নের একটি ছেলের বাবা নামকরা নার্ভের ডাক্তার, আপনি চিন্তা করবেন না। মা, এঁরা এখনও দাঁড়িয়ে আছেন, কীরে নীপা।
আপনার ছেলে? কল্যাণী নন্দিতার দিকে তাকালেন।
শ্যামলই জবাব দিল, হ্যাঁ। ও বড়, আমি ছোট। এবার বি.এ. দেব।
নন্দিতা কিছুই বলতে পারলেন না, তাঁর দীর্ঘশ্বাস পড়ল।
শ্যামল বলল, মা, ওনাকে নিয়ে যাও। কতদূর থেকে এসেছেন, ফ্রেশ হওয়ার দরকার।
কল্যাণী শ্যামলের দিকে তাকিয়েছিলেন। এবার নন্দিতার কাছে এলেন, আপনার ছেলে কিন্তু নিরাপদদার ধরনটা পায়নি, বরং মেয়ের সঙ্গে খুব মিল আছে। আচ্ছা বউদি, আমি এভাবে এসে পড়ায় আপনার তো কোনও অসুবিধে হয়নি?
ওমা! আমার অসুবিধে হবে কেন? আসুন। আসলে এখানে জায়গার বড় সমস্যা। সেই আদ্যিকালের বাড়িটাকে বাড়াবার কোনও চেষ্টা করেননি আপনার দাদা। নন্দিতা উঠলেন। কল্যাণীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যেতে-যেতে জিজ্ঞাসা করলেন, মালবিকার বাবা?
পাঁচ বছর।
ও! নন্দিতাকে সত্যি বিমর্ষ দেখাল। তিনি কল্যাণীকে নিয়ে চলে গেলেন।
শ্যামল বেডিংটাকে নিয়ে এল একপাশে। এইসময় নিরাপদ ঢুকলেন। ছেলেকে বেডিং সরাতে দেখলেন, তোর মাকে জিজ্ঞাসা কর বাজার থেকে কিছু আনতে হবে কিনা?
এই তো বাজার করে নিয়ে এলে!
হ্যাঁ, তবু মানে ওরা–।
হলে মা বলবে। শ্যামল বেরিয়ে গেল।
নিরাপদ চেয়ারে বসলেন। চোখ বন্ধ করলেন। নন্দিতা বললেন, বসে না থেকে বেরোও।
চমকে চোখ খুললেন নিরাপদ, মানে?
একটা মোটামুটি হোটেল খুঁজে এসো।
হোটেল? এ পাড়ায় হোটেল আছে নাকি?
যে পাড়ায় আছে, সেখানে যাও।
আমার অফিস?
খুঁজতে দেরি হলে যাবে না। সি-এল নেবে।
বেশ। কিন্তু ওরা দুটি মেয়ে হোটেলে থাকবে, ঠিক হবে?
বাঃ, চমৎকার! আমাকে যখন একা আড়িয়াদহে যেতে বলো, তখন এমন দুশ্চিন্তা হয় না। আমি কোনও কথা শুনতে চাই না, আজ বিকেলেই ওদের বিদায় করো।
আস্তে কথা বলো নন্দিতা!
তোমাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আমি যেন ভিলেনের মতো আচরণ করছি! নন্দিতা গলা নিচে নামালেন, আমি তোমাকে একবারও জিজ্ঞাসা করিনি, বিয়ের আগে কতটা প্রেম ছিল? সেই প্রেম স্বর্গে ছিল না মাটিতে নেমেছিল? বুক জ্বলে যাচ্ছে তবু জিজ্ঞাসা করিনি। কারণ কী জানো?
নিরাপদ নীরবে মাথা নেড়ে না বললেন।
ওই যে, আমি কখনও মিথ্যে বলি না, পাপ করি না–! ফস করে যদি সত্যি কথাটা বলে ফ্যালো তাহলে আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াব!
সত্যি কথা?
নইলে কোন জোরে এত বছর বাদে এখানে এসে ওঠে? তার ওপর স্বামী নেই, সোনায় সোহাগা।
স্বামী নেই মানে?
পাঁচ বছর আগে বিধবা হয়েছেন। তার আগে থেকেই স্কুলে পড়ান।
ও!
শুনে দুঃখু উথলে উঠছে?
যা-তা বকছ!
শোনো, আমার এখানে তিনটে ঘর। একটায় আমি আর নীপা শুই আর একটাতে তুমি আর শ্যামল। এই ঘরটায় কেউ শুতে পারে না–পারে?
এমনিতে পারার কথা নয়। রাত্তিরে আরশোলা বের হয়। ওদের আমি আমার শোওয়ার ঘরে ঢোকাতে পারব না।
আচ্ছা!
যাও, ওঠো, হোটেল খুঁজে এসো। যাও!
নিরাপদ উঠলেন এবংনীপা ঢুকল, মা, মেয়েটা খুব ভালো।
নিরাপদ মেয়ের দিকে তাকালেন।
ফার্স্ট ডিভিসনে পাশ করেছে। চমক্কার রবীন্দ্রসংগীত গায়। আমি অনেক বলতে একটি শোনাল। বেচারা ডান হাতটা একদম নাড়াতে পারে না। কথা বলে নিচু গলায়। খুব কষ্টে আছে।
আর কিছু? নন্দিতা জিজ্ঞাসা করলেন।
আহা, একটা ভালো মেয়েকে ভালো বলব না?
নিরাপদ বললেন, যাই?
শ্যামল এল ঘরে, কোথায় যাচ্ছ?
হোটেল খুঁজতে।
ইটস টু মাচ। অসুবিধে হলে আমাকে বলল, আমি গেস্টহাউস ঠিক করে দেব।
গেস্টহাউস? নিরাপদ অবাক।
হ্যাঁ। পার্টির লোকদের ওসব জানাশোনা আছে। খরচ কম হবে।
তাহলে তো হয়ে গেল।
মা, মালবিকাকে আজ যাতে ডাক্তার দেখানো যায় তার ব্যবস্থা করছি, বুঝলে?
নন্দিতা কোনও কথা না বলে ভেতরে চলে গেলেন। নিরাপদ বললেন, কী-যে সব হয়ে গেল বলো তো।
নীপা জিজ্ঞাসা করল, কী আবার হবে?
ওরা এল, তোদের মায়ের অসুবিধে হবে বুঝতে পারছি–।
মা প্রথম-প্রথম ওরকম করে, পরে ঠিক হয়ে যাবে। তোমার বন্ধু, বিপদে পড়েছে–।
বন্ধু?
বাঃ, একই পাড়ায় থাকতে, তোমার চেয়ে তো বেশি ছোট নয়।
আমাদের সময়ে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের বন্ধুত্ব হত না।
কেন?
বড়রা সেটা স্বাভাবিক চোখে দেখত না।
তাহলে মেলামেশা করলে কী বলা হত?
ভাইবোনের সম্পর্ক ভাবা হত।
উনি তোমাকে দাদা বলে চিঠি লিখেছেন, ওই নিয়েমেই? নীপা হাসল।
নিয়ম আবার কী, যখনকার যা চল।
শ্যামল হেসে ফেলল, সমবয়সি হলে?
কথাই হত না। হলে সেটা স্বাভাবিক বলে গণ্য করা হত না?
নীপা হাসল, তাহলে কল্যাণীপিসিকে তোমার গার্লফ্রেন্ড বলা যাচ্ছে না?
বললাম তো আমাদের সময় ওসবের রেওয়াজ ছিল না।
শ্যামল ঝাঁকিয়ে উঠল, তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন মান্ধাতার বাবার আমলের লোক! তিরিশ বছর আগে, মানে নাইনটিন সিক্সটিটু, উত্তমকুমার সুচিত্রা সেনের ছবি সুপারহিট, এই পথ যদি শেষ হয় গান গাওয়া হয়ে গেছে। গুল মারছ! আমি বেরুলাম। মালবিকার ডাক্তার ঠিক করে আসি।শ্যামল চলে গেল।
নীপা পাশে এসে দাঁড়াল, হ্যাঁ বাবা, ষাট-একষট্টিতে অপুর সংসার বেরিয়ে গেছে!
তো কী হয়েছে?
যুগটা প্রাচীন ছিল না।
ওটা সিনেমায়, জীবনে নয়। তখন সন্ধ্যার পর কোনও মেয়েকে ট্রামে দেখা যেত না।
তোমার কথা শুনলে মনে হচ্ছে সতীদাহ প্রথা যখন চালু ছিল, তার থেকে ওই সময়টা খুব বেশি এগোয়নি। নীপা চলে যাচ্ছিল। নিরাপদ তাকে ডাকলেন, শোন।
নীপা দাঁড়াল।
নিরাপদ বললেন, কখনও-কখনও এগোয় না। এই যেমন তোর মা। রামমোহনের সময় একজন মা যেভাবে রিঅ্যাক্ট করতেন, বিরানব্বইতে ইনি একইভাবে করছেন।
ছাই। মা ভয় পাচ্ছে খরচ কুলোতে পারবে না ভেবে। তুমি এক্সট্রা দেবে না। নীপা বেরিয়ে গেল। একটু চুপ করে বসে নিরাপদ পাঞ্জাবিটা খুলতে গিয়ে সামলে নিলেন কল্যাণীকে ঢুকতে দেখে। হাসার চেষ্টা করলেন।
তোমার অফিসের দেরি হচ্ছে না নিরাপদদা?
না, না।
বিশ্বাস করো কোনও উপায় ছিল না।
আরে ঠিক আছে।
তুমি কিন্তু বেশি পালটাওনি। শুধু চুল খসে গিয়েছে। কী সুন্দর কোঁকড়া চুল ছিল তোমার! ঢেউখেলানো, সামনে সিঙাড়া। আমরা উত্তমকুমার বলতাম, মনে আছে?
হুঁ।
সব চলে যায়। নিশ্বাস ফেললেন কল্যাণী, আমার কথা তোমার মনে ছিল?
নিরাপদ ঢোঁক গিললেন, ওই, মানে, ছেলেবেলার কথা মনে হলে–।
ব্যস?
আসলে সংসারের চাপে দম ফেলার উপায় নেই।
তোমার ছেলেমেয়েদুটি খুব ভালো। ওদের মা-ও।
মালবিকার বাবার কী হয়েছিল?
আট বছর শয্যাশায়ী ছিলেন। দু-বার স্ট্রোক হয়েছিল। তৃতীয়বারে চলে গেলেন।
ও। সব একাই সামলাতে হচ্ছে?
দোকা কোথায় পাব? মেয়েটার বিয়ে দেব ভাবছিলাম, তা দ্যাখো এই কাণ্ড। ওই মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে?
কী করে হল?
হঠাৎই।
নিরাদা, তোমার মনে আছে, তুমি আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলে?
চিঠি?
হ্যাঁ। আমি যেন মন দিয়ে পড়াশুনা করি, বাচাল না হই, পাড়ার যেসব ছেলে আমার সম্পর্কে আগ্রহী তাদের পাত্তা না দিই, এসব উপদেশ দিয়েছিলে। চিঠিটা আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। খুব রাগ হয়েছিল, তাও।
হ্যাঁ, তুমি খুব ছটফটে ছিল।
আর?
মাথায় গোবর ছিল। তিন-চারবার করে বোঝাতে হত।
আমি জানি নিরাদা, আমাকে দেখে তুমি খুশি হয়েছ। কিন্তু তুমি ভালো নেই।
যা বাজার, তাতে ভালো থাকা যায়! বড় চাকরি তো পেলাম না।
নিরাপদ উঠে দাঁড়ালেন। নীপা চায়ের দুটো কাপ নিয়ে এল, মালবিকা চা খায় তো?
মাঝে-মাঝে। কল্যাণী জবাব দিলেন।
মালবিকা, এ ঘরে এসো। নীপা চেঁচাল।
বাবাকে চা দেবে না?
বাবা এককাপ খেয়েছে, আর খাবে না। পিটপিটে আছে তো!
মালবিকা এল। নীপা বলল, নাও। তোমার চা।
মাথা নাড়ল মেয়েটি, লাজুক হাসল।
তাহলে কী খাবে?
কিছু না।
নিরাপদ বলললেন, ওকে মুড়ি এনে দে। আর চা বেশি হলে আমাকেই দিতে পারিস।
নীপা অবাক হয়ে বাবাকে কাপটা দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল।
চায়ে চুমুক দিয়ে নিরাপদ জিজ্ঞাসা করল, তুমি নাকি খুব ভালো গান গাও?
না, না। লজ্জা পেল মালবিকা।
শুনলাম। একদিন শুনতে হবে তোমার গান।
কল্যাণী বললেন, কুচবিহারে ও রবীন্দ্রসংগীতে প্রথম হয়েছে। এই হাতের ব্যাপারটা হওয়ার পরই সব থামাতে হচ্ছে!
নীপা এল একবাটি মুড়ি নিয়ে। টেবিলে রেখে ইশারা করল মালবিকাকে। কল্যাণী জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী পড়ো?
এম. এ. জি. আর. ই. দিয়েছি।
সেটা কী?
নিরাপদ জবাব দিলেন, পাগলামি। আমেরিকায় পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট পড়তে যাওয়ার জন্যে একটা পরীক্ষা দিতে হয়। ও জোর করে দিয়েছে।
জোর করে কেন?
আমাদের ঘরের মেয়ে কি আমেরিকায় পড়তে যেতে পারে?
ওরা পড়ার খরচ দেবে না?মানে স্কলারশিপ?
তা হয়তো দেবে। কিন্তু প্লেনের ভাড়া দেবে কে?
যদি পাশ করে তাহলে তোমার দেওয়া উচিত নিরাপদদা।
কল্যাণীর কথার শেষে নন্দিতা ঢুকলেন, কেন? এদেশে এম. এ. পড়া যায় না?
নীপা বলল, যায়। তারপর আর কিছু হয় না। আর ওদেশে পড়াশুনো করে কেউ বেকার বসে আছে এমন একটা উদাহরণ দেখাতে পারবে না।
নন্দিতা মাথা নাড়লেন, অদ্ভুত! দেখুন তো ভাই, ওই একা মেয়ে অদুরে যাবে? কোনওদিন একা বর্ধমানেও যায়নি। আমি তো প্রার্থনা করছি ও যেন পাশ না করে।
তা তো করবেই। মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু হয়।
কল্যাণী বলোলেন, অবশ্য খরচের দিকটাও দেখতে হবে।
খরচ? নীপা মুখ ফেরাল, আমার বিয়েতে বাবা খরচ করত না?
কল্যাণী মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, করতেই হবে।
সেটা না করে প্লেন ভাড়া দিয়ে দিক, অনেক কমে হয়ে যাবে।
অদ্ভুত কথা! তারপর বিয়ের সময় কী হবে? নন্দিতা চেঁচিয়ে উঠলেন।
সেটা আমি বুঝব। তোমাদের চিন্তা করতে হবে না।নীপা গম্ভীরমুখে বলল, মেয়েরা বড় হলে বিয়ে ছাড়া তোমরা চিন্তা করতে পারো না। যেন বিয়ে দিলেই কাঁধ থেকে বোঝা নামাতে পারলে। সেই বিয়ে ক্লিক না করলে তো জীবনটাই নষ্ট, তা ভাবতে চাও না। তা ছাড়া বিয়ে ছাড়া মেয়েদের অনেককিছু করার আছে, এটা বুঝতে চেষ্টা করো।
নন্দিতা রেগে গেলেন, ঠিক আছে, ও যদি পাশ করে, তাহলে প্লেন ভাড়া দিয়ে দিয়ে। তারপর কোনও প্রয়োজন হলে আমাদের কাছে এসো না।
কল্যাণী বললেন, ওদেশে যদি আত্মীয়স্বজন থাকে, তাহলে একা গেলে তেমন অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কেউ নেই?
নিরাপদ মাথা নাড়লেন, আমাদের ফ্যামিলির কেউ বিদেশে যায়নি।
নীপা বলল, আমার মামার বাড়ির দিকেও কেউ নেই। অথচ আমার বন্ধুদের কেউ-না-কেউ লন্ডনে অথবা নিউ ইয়র্কে থাকে।
নিউ ইয়র্ক। না, নিউ জার্সি– উচ্চারণ করেই থেমে গেলেন নিরাপদ।
নিউ জার্সি মানে? নীপা জিজ্ঞাসা করল।
ওটা আমেরিকার একটা জায়গার নাম।
সেটা জানি। সেখানে তোমার পরিচিত কেউ থাকেন?
আমার নয়। নিরাপদ ফাঁপরে পড়লেন, তোর মায়ের পাড়ার একজন থাকত, সে এখন ওখানে আছে। খুব বড় শিল্পপতি। নিরাপদ বলে ফেললেন।
আমার পাড়ার?কী যা-তা বলছ? নন্দিতা খেঁকিয়ে উঠলেন।
নিরাপদ স্ত্রী-র দিকে তাকালেন, তোমার এখন মনে নেই।
আশ্চর্য। আমার মনে নেই আর তুমি মনে রেখে বসে আছ! তুমি দেখেছ তাকে?
না। তুমি বলেছিলে।
আঃ, নামটা বলবে তো?
পার্থ। পার্থ সান্যাল। নিরাপদ স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করলেন।
অসম্ভব। শব্দটা ছিটকে এল নন্দিতার মুখ থেকে।
অসম্ভব কেন? নীপা জানতে চাইল।
ওঃ। তুমি, তুমি এখনও মনে করে রেখেছ? ওর ওখানে নীপা যাবে?
নিরাপদ মাথা নাড়লেন, যাবে বলিনি। কারও নাম মনে পড়ছিল না বলে ওর কথা মনে এল। তা ছাড়া, ভদ্রলোক তো আমাদের বয়সি। ওখানে এখন প্রতিষ্ঠিত।
আপনাদের আত্মীয়? কল্যাণী জানতে চাইলেন।
না, না। পাড়ায় থাকত। বাজে টাইপের ছেলে। মেয়েদের দেখলেই পেছনে লাগত। নন্দিতার গলায় একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ল।
ছেলে বলছেন! কল্যাণী একটু অবাক।
তিরিশ বছর আগে ছেলে ছিল, এখন প্রৌঢ়। নিরাপদ বললেন।
নীপা হেসে উঠল শব্দ করে, মা, তুমি একটা যাচ্ছেতাই! তিরিশ বছরে মানুষের সবকিছু পালটে যায়। ভদ্রলোক ওদেশে প্রতিষ্ঠিত, মানে কি বোঝো না?
নন্দিতা বলতে বাধ্য হলেন, এতগুলো বছর আমি যাকে জানি না, তার কাছে তুই যাবি! তার ঠিকানাও আমার জানা নেই।
ঠিকানা বের করতে অসুবিধে কী? আড়িয়াদহে নিশ্চয়ই ওঁর আত্মীয়স্বজন থাকেন, তাঁরাই বলে দেবেন। আমি ঠিকানা জোগাড় করে আনছি। তুমি একটা চিঠি লিখবে মা? প্লিজ। নীপা আবদার করল।
মরে গেলেও না।
এই সময় শ্যামল ঢুকল, গম্ভীর ব্যাপার মনে হচ্ছে।
নীপা বলল, দ্যাখ না শ্যামল, মায়ের ছেলেবেলার একজন যখন আমেরিকায় থাকে, একবারও বলেনি। আমি যদি পাশ করে ওখানে যাই, ভদ্রলোকের সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। মাকে বলছি একটা চিঠি লিখে ভূমিকা করে রাখতে, মা রাজি হচ্ছে না।
নো কমেন্টস। বাবাকে ওই ব্যাপারে কথা বলে অনেক জ্ঞান শুনেছি, আর ফারদার ভিক্টিম হতে চাই না। হ্যাঁ, পিসিমা আপনার ব্যবস্থা হয়েছে।
কল্যাণী জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল শ্যামল?
আজ বিকেলে ডক্টর এস. কে. সেন মালবিকাকে দেখবেন। ভদ্রলোকের এক মাস আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায় না, ম্যানেজ করেছি। আর আমার বন্ধুর বাবার একটা গেস্টহাউস আছে, সেখানে দিনকয়েক থাকতে পারবেন। খুব সামান্য চার্জ।
এখনই পাওয়া যাবে তো? কল্যাণী খুব খুশি।
ইচ্ছে হলে যেতে পারেন। শ্যামল যেন রাজ্যজয় করে এসেছে।
সে কী? এখনই যাবেন মানে? নন্দিতা প্রতিবাদ করলেন।
না, ও বলছে যখন–। কল্যাণী থতমত।
বলুক। এ বাড়িতে পা দিয়ে ভাত না খেয়ে যাওয়া চলবে না। আমার মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, বুঝলেন? নন্দিতা জোর গলায় বললেন।
পিসিমা থাকুন, কিন্তু আমি বিয়ে করবনামা। শুধু তুমি চিঠিটা লেখো।
সবাই হেসে উঠল। নন্দিতা রাগ করে ভেতরে চলে গেলেন। শুধু হাসলেন না নিরাপদ। তাঁকে চোর-চোর দেখাচ্ছিল।
*
এখন বিকেল। দৃশ্যান্তর হওয়ায় দেখা গেল সেই একই ঘর। নন্দিতা চুপচাপ বসে আছেন।
কোথাও কোনও শব্দ নেই। নিরাপদ প্রবেশ করলেন, গেস্টহাউসটা খারাপ নয়। শ্যামল আর নীপা ওখানেই থেকে গেল। পরে আসবে।
নন্দিতা কথা বললেন না। নিরাপদ এক-পা এগোলেন, কী হয়েছে?
এইভাবে নিজের গায়ের জ্বালা মেটালে?
মানে?
ছেলেমেয়ে, এমনকী ওই মহিলার সামনে অপমান করলে?
কী বলছ?
কী বলছি তা বুঝতে পারছ না, না? এতকাল ভাবতাম সরল গোবেচারা। ভুল ভাবতাম। পেটে পেটে তোমার এত ছিল? ছি!
নন্দিতা–?
তুমি আমাকে অপমান করেছ।
কীভাবে?
ওই মহিলাকে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে বলায় তুমি প্রতিশোধ নিলে পার্থর কথা তুলে। তুমি আমাকে সন্দেহ করো।
না।
নিশ্চয়ই করো। তিরিশ বছর ধরে তুমি আমার সঙ্গে অভিনয় করে এসেছ ভালোমানুষের, মনে মনে সন্দেহ করেছ। আজ সুযোগ বুঝে সেটা ব্যবহার করলে।
তুমি ভুল করছ।
ভুল?আমার মেয়েকে তুমি পার্থ সান্যালের সাহায্য নিতে পরামর্শ দিচ্ছ! তুমি জানো, পার্থকে
আমি কোনওদিন প্রশ্রয় দিইনি। সে যখন জানবে আমার মেয়ে তার কাছে যাচ্ছে তখন। ওঃ, আমি ভাবতেও পারি না। শোনো, তোমার সঙ্গে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
কী বলব!
ওই মহিলা আসায় তুমি খুশি হওনি? আমি তোমার কাঁটা?
দ্যাখো, তুমি তো প্রায়ই বলল আমার সম্পর্কে তোমার কোনও আগ্রহ নেই। দশ বছর তুমি এক বাড়িতে থেকেও আলাদা। তাহলে আমাকে নিয়ে এত জ্বলো কেন তুমি?
এর উত্তর আমি তোমাকে দেব না। উঃ, ছেলেমেয়েরা ভাবল তোমার মতো আমারও একজন বয়ফ্রেন্ড ছিল! বুড়ো বয়সে দাঁত পড়ে গেলে লোকে মাড়ি দিয়ে চিবোয়, তুমি সেই কাজটা করলে। নন্দিতা কান্না চাপতে-চাপতে বেরিয়ে গেলেন।
নিরাপদ তাঁর যাওয়া দেখলেন। তারপর থপথপে পায়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন, কী নাটক করার কথা ছিল, কী নাটক হয়ে গেল! নন্দিতা বলে গেল আমি ইচ্ছা করে ওকে অপমান। করেছি। ওকে সন্দেহ করি। আমি জানতাম না। এখন মনে হচ্ছে, হয়তো তাই। তাহলে আমি সত্যি কথা বলি, পাপ করিনি–এসব বলার কোনও মানে হয় না। নন্দিতা আমাকে ভালোবাসে না অথচ কাউকে ভালোবাসতে দেবে না। আমিও নন্দিতাকে ছেড়ে থাকতে পারব না, অসহ্য। হলেও। আচ্ছা ধরুন, না, খামোকা ধরতে যাবেন কেন, নিজের চোখেই দেখুন, আজ যে নাটকটা করার কথা ছিল, তাতেই অভিনয় করছি আমরা, তবে একটু ছোট করে নিতে হচ্ছে, অনেকটা সময় চলে গেছে তো! তবে তার আগে একটু বিরতি দেব। পাঁচ মিনিটের।
নিরাপদ ইঙ্গিত করতেই পরদা পড়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে সিগারেট খেতে-খেতে আমরা ঠিক করতে পারছিলাম না নিরাপদ পাপ করেছেন কিনা। বস্তুত সবাইকে আমাদের খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। নিরাপদ একটু ভালোমানুষ, ওরকম স্বামী হলে বিয়ের কিছুদিন বাদে স্ত্রী-রা একটু হম্বিতম্বি করবেনই। তবে পার্থ সান্যালের ব্যাপারটা তোলা নিয়ে আমরা দ্বিমত হলাম।
বিরতির পর মঞ্চটির কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না। নন্দিতা খাবারের ব্যবস্থা করছেন। সময়টা রাত। নীপা তাঁকে সাহায্য করছে। নন্দিতা বললেন, ওদের ডাক।
নীপা চেঁচাল, খাবার দেওয়া হয়েছে।
নিরাপদ ঢুকলেন। ধোপদুরস্ত। চেয়ার টেনে নিয়ে বললেন, শ্যামল কোথায়?
নন্দিতা মাথা নামিয়ে বললেন, এই ফিরল। বাথরুমে গিয়েছে।
রাত সাড়ে নটায় বাড়ি ফেরা তুমি অ্যালাউ করছনন্দিতা! দিস ইজ টু মাচ। কলেজে পড়া ছেলের এতখানি স্বাধীনতা আমি বরদাস্ত করব না।
বলি, কিন্তু শোনে না।
নিরাপদ মাথা নেড়ে চেয়ারে বসলেন, আমার ওষুধটা।
নীপা একটা কৌটো এগিয়ে দিলে তিনি সেটা থেকে ক্যাপসুল বের করে মুখে দিয়ে জল খেতেই শ্যামল ঢুকল, আজকের মেনু কী?
চিকেন কারি, রুটি, স্যালাড আর পায়েস।
কাল পুডিং কোরো তো। শ্যামল বলল।
বাপের পয়সায় পায়েস পুডিং প্যাঁদাচ্ছ অথচ কোনও কথা কানে যাচ্ছে না! নিরাপদ ছেলের দিকে তাকালেন।
তার মানে?
তোমাকে বলেছি এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকবে না।
ইউনিয়নের কাজে দেরি হয়ে যায়।
ওঃ। শোনো শ্যামল, এ-বাড়িতে থাকতে হলে তোমাকে ইউনিয়ন ছাড়তে হবে।
কেন?
কারণ আমি চাই না আমার ছেলে একটা হ্যাগার্ড হোক। ময়লা পাজামা-পাঞ্জাবি আর কাঁধে ব্যাগ। ভবিষ্যতের বারোটা বাজানোর পক্ষে যথেষ্ট।
তুমি বুর্জোয়াদের মতো কথা বলছ।
তাই? কোন সর্বহারা চিকেন কারি আর পায়েস খায়? নিরাপদ চেঁচিয়ে উঠলেন, তোমাদের সর্বহারার নেতার ছেলে তো ক্যাপিটালিস্ট!
এইসময় দর্শকরা উশখুশ করে উঠল। একজন চেঁচিয়ে উঠল, পারসোনাল অ্যাটাক হয়ে যাচ্ছে। নাটক বন্ধ করে দেব।
নিরাপদ আমাদের দিকে তাকালেন, তা আপনারা পারেন। হিটলার কিংবা মুসোলিনি ডিকটেটর ছিলেন। এখন একটা কমিটি সেই ভূমিকায় চলে গিয়েছে। কিন্তু ভাই আপনারাই তো হাসমিকে নায়ক করেছেন, খামোকা ভিলেন হবেন কেন? আমার ছেলে আমার পয়সায় বাউন্ডুলেপনা করলে তাকে বলার অধিকার আমার আছে। নিরাপদ ছেলের দিকে মুখ ফেরালেন, শ্যামল, তোমার নেতাদের চেহারা ছিয়াত্তরের আগে দেখেছি। সিঁড়িঙ্গে ছিল। এখন শাঁসে-জলে। দাদাদের নাম ভাইদের নামেই হয়। কোনওরকমে গ্র্যাজুয়েট হও, তোমার চাকরি হয়ে যাবে। ব্যবস্থা করে রেখেছি।
শ্যামল কথা বলল না। নীপা বলল, বাবা, জি আর ই পাশ করলে আমি আমেরিকায় যাব তো?
নন্দিতা বলললেন, অসম্ভব। ওসব চিন্তা মাথা থেকে ছাড়।
নীপা বলল, বাবা!
নিরাপদ বললেন, আগে পাশ করো তারপর দেখব।
নন্দিতা বললেন, তুমি ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছ! ওদেশে ও একা থাকবে?
একা কেন থাকবে? আমাদের বোস সাহেবের ভাই থাকেন নিউ ইয়র্কে। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে তার।
বাবা, তুমি গ্রেট।
খেতে-খেতে নিরাপদ বললেন, যতীন খুব ঝামেলায় পড়েছে।
নন্দিতা জিজ্ঞাসা করলেন, সে কী! কেন?
আরে রেখে-ঢেকে নে! চোখের পরদা বলে তো একটা কথা আছে! পার্টিদের ট্রাবল দিয়ে টাকা নিলে কমপ্লেন হবে না।
তোমার কিছু হবে না তো গো?
দূর! আমি অত বোকা নাকি!
শ্যামল উশখুশ করে বলল, বাবা, তুমি অন্যায় করেছ।
তা তো বলবেই। উপরির পয়সায় তুমি ফুটুনি করছ আর নিচ্ছি বলে আমার দোষ হয়ে গেল! তা ছাড়া আমি ঘুষ নিই না।
নাও না?
না। এটাকে ঘুষ বলে না। টিপস দেয়। ঘুষ নেয় বড়কর্তারা, মন্ত্রীরা। তারা দিনকে রাত আর। রাতকে দিন করে। সেই ক্ষমতা আমার নেই। মাংস দাও।
নন্দিতা মাংস দিলেন। নীপা বলল, মা আমি পায়েস খাব না।
কেন? নিরাপদ জানতে চাইলেন।
নন্দিতা বললেন, মিষ্টি খেলে ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে।
তোরা আজকাল কত কনসাস হয়ে গিয়েছিস। ওকে একটু ফল দিয়ো নন্দিতা।
আচ্ছা।
হঠাৎ নীপার মনে পড়ে গেল, ওই যাঃ!
কী হল? শ্যামল জিজ্ঞাসা করল।
একটা চিঠি এসেছে মায়ের নামে। দিতে ভুলে গিয়েছি।
কার চিঠি?
খুলিনি। দাঁড়াও আনছি। নীপা উঠে দাঁড়াল।
খাবি না?
আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে। নীপা বেরিয়ে গেল।
নিরাপদ জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাকে আবার কে চিঠি লিখল?
জানি না। হয়তো মেজমাসিমা টাকা চেয়েছেন।
দ্যাখো, দিতে-দিতে তো ফতুর হয়ে যাব। নিরাপদ ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, উপরি আছে বলে তোমার গা জ্বলে কিন্তু কত লোককে দিতে হয় তার খবর রাখো?ননসেন্স! শ্যামল, একটু প্র্যাকটিক্যাল হও।
নীপা ফিরে এল রঙিন খাম হাতে।
নন্দিতা বললেন, খুলে পড় না।
নীপা খামটা ছিঁড়ল। তারপর ওপরের দিকে তাকিয়ে বলল,ও মা, নিউ জার্সি থেকে লিখেছে। সুচরিতাসু, আশা করি ভালো আছ। আমাকে তোমার মনে রাখার কথা নয়। আড়িয়াদহে তোমাদের পাড়ায় আমি থাকতাম। তোমাদের বিয়ের সময় আমি বেকার ছিলাম। তারপর ঘটনাচক্রে আমেরিকায় আসি। এখন ব্যাবসাপত্তার করে আমি সচ্ছল। দেশে যাইনি আঠাশ বছর। সম্প্রতি আমার বোন-ভগ্নীপতি আমার কাছে বেড়াতে এসেছিল। তাদের কাছে তোমার ঠিকানা। পেলাম। আমি এই মাসে দেশে যাচ্ছি। সবার সঙ্গে দেখা করব। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। যদি আপত্তি থাকে তাহলে আড়িয়াদহের ঠিকানায় জানিয়ে দিয়ো। তরুণ বয়সে বিরক্ত করতাম বলে ক্ষমা চেয়ে আসব। আপত্তি থাকলে যাব না। আশা করি তোমার স্বামী অখুশি হবেন না। শুভেচ্ছাসহ, পার্থ সান্যাল।
লোকটা কে মা? শ্যামল জানতে চাইল।
বাজে লোক। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়তাম তখন রকে বসে খুব আওয়াজ দিত। গায়ে পড়ে কথা বলতে চাইত। আমি পাত্তা দিইনি।
নীপা হাসল, রকবাজ রোমিও?
ইয়ার্কি মারিস না। তুই লিখে দে আসার দরকার নেই।
নিরাপদ জিজ্ঞাসা করলেন, কেন?
বাঃ! চিনি না, জানি না, এখানে এসে কী করবে?
তুমি চেনোনা, তোমাকে চেনেন। আঠাশ বছর বিদেশে আছেন, দেশে এসে সবার সঙ্গে কথা বলতে তো ইচ্ছে করবেই।
নীপা বলল, তা ছাড়া নিউ জার্সিতে থাকেন, আমার উপকার হতে পারে। নন্দিতা চেঁচিয়ে উঠলেন, না। সে এ বাড়িতে আসবে না।
নীপা বলল, কেন? তুমি মিছিমিছি রাগ করছ।
নিরাপদ হাসলেন, নীপা ঠিকই বলছে।
নন্দিতা আচমকাই চলে গেলেন ঘর ছেড়ে, নিরাপদ বললেন, তোদের মা ভালো অভিনেত্রী নয়, বুঝলি।
শ্যামল বলল, মায়ের পরিচিত এবং মা আপত্তি করছে যখন, তখন ভদ্রলোকের আসা উচিত নয়। তোমরা যে-যাই বলো।
দৃশ্য পরিবর্তন হল। কথাটা ঠিক বলা হল না। ঘর এক রইল শুধু সময় পালটে গেল। এখন। সকাল। নিরাপদ খবরের কাগজ পড়ছিলেন, আর তখনই বেল বাজল। নিরাপদ চেঁচালেন, কে এল দ্যাখ।
শ্যামলের গলা পাওয়া গেল, নীপা দ্যাখ।
একটু বাদে নীপার গলা, কাকে চান?
নন্দিতা আছেন?
হ্যাঁ। উনি রান্না করছেন। আপনি?
তুমি নন্দিতার মেয়ে?
হ্যাঁ।
আমি পার্থ সান্যাল। আমেরিকা থেকে আসছি।
ও। আসুন-আসুন। আমরা আপনার চিঠি গতকাল পেয়েছি।
নীপা ঘরে ঢুকল এক চকচকে প্রৌঢ়কে নিয়ে, আমার বাবা। বাবা, ইনি পার্থ সান্যাল। নিরাপদ নমস্কার করলেন। ভদ্রলোক এগিয়ে এসে নিরাপদকে জড়িয়ে ধরলেন, অনেকদিন বাদে দেশে এলাম। আপনাদের বাড়িতে এসেছি বলে কিছু মনে করেননি তো?
নিরাপদ হাসলেন, না না, মনে করব কেন?
আমি পার্থ সান্যাল। কুইনসে থাকি। ব্যাবসা করি। আপনি?
আমি নিরাপদ মিত্র। সরকারি চাকরি করি। নিরাপদর গলামিনমিনে শোনাল।
নীপা বলল, বসুন।
পার্থ বললেন, দেশে তো আসাই হয় না। তুমি কী করো?
পড়ি। এম. এ. দিচ্ছি। জি আর ই দিয়েছি।
তাই? আমেরিকায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?
যদি সুযোগ পাই–।
আলবাত পাবে। আমি আছি ওখানে। আমার কাছে উঠবে। তোমরা কয় ভাই-বোন?
দুই ভাই-বোন। মা, মাগো, মা এদিকে এসো।
নন্দিতা এলেন। একপাশে জড়সড়ো হয়ে দাঁড়ালেন। পার্থ তাঁর দিকে অবাক চোখে তাকালেন, আমাকে চেনা যাচ্ছে?
মাথা নাড়লেন নন্দিতা, না।
আমার ভাই-ই চিনতে পারেনি। বলল, দাদা। তুই এত ফরসা, মোটা আর টাক করে ফেলেছিস মাথায় যে চেনা যায় না। তবে চেহারা দেখছি খুব একটা বদলায়নি। সামান্য মোটা, সেটা। স্বাভাবিক। তবে মেয়ে একদম মায়ের ধাত পেয়েছে।
আপনি তো আমার আগে ওকে দেখেছেন। নিরাপদ বললেন।
দূর মশাই, দূর থেকে দেখতাম। কথা বলার চান্স দিত নাকি! ওহো, তোমার নাম কী যেন?
নীপা।
হ্যাঁ নীপা, এই নাও। পার্থ সান্যাল অ্যাটাচি কেস খুললেন। একে-একে বিদেশি পারফিউম, আফটার শেভিং লোশন, চুল শুকোবার ব্লোয়ার বের করে টেবিলে রাখলেন, এসব তোমাদের জন্যে।
নীপা বলল, সব?
হ্যাঁ।
হঠাৎ নন্দিতা বললেন, না। ওগুলো আপনি ফিরিয়ে নিয়ে যান।
কেন? পার্থ সান্যাল অবাক।
আপনার সঙ্গে আমাদের তেমন কোনও সম্পর্ক নেই যে, ওগুলো নেওয়া যেতে পারে!
আমি কিন্তু একদম সরল মনে এনেছি। পার্থ সান্যাল বললেন।
ঠিকই করেছেন। নিরাপদ কথা বললেন, ভালোবেসে কেউ কিছু দিলে নিতে হয়।
থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার মিত্র। আজ আমাকে উঠতে হচ্ছে।
সে কী! চা খেয়ে যাবেন না? নিরাপদ জিজ্ঞাসা করলেন।
নাঃ। আমি কাল দিল্লি যাচ্ছি। ওখান থেকেই ফিরে যাব। আজ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। নীপা, আমার কার্ডটা রাখো। যদি ও-দেশে পড়তে যাও, একটা চিঠি আগেভাগে পোস্ট কোরো। তারপর তোমার সব দায়িত্ব আমার। পার্থ উঠলেন। কার্ডটা টেবিলে রাখলেন।
নিরাপদ বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভালো লাগল।
একই কথা আমিও বলছি। আচ্ছা আপনাদের ছেলেকে দেখলাম না।
নিরাপদ নীপাকে বললেন, শ্যামলকে এ ঘরে আসতে বলো।
নীপা চলে গেল। পার্থ সান্যাল একটু ইতস্তত করে বললেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা না করে পারছি না। আমার চিঠি পেয়ে অথবা আমি এ বাড়িতে আসায় আপনাদের মনে কোনও প্রশ্ন দেখা দেয়নি?
নন্দিতা অন্যদিকে মুখ ফেরালেন। নিরাপদ হাসলেন, না, না। আপনারা এক পাড়ায় থাকতেন, আলাপ-পরিচয় ছিল, এতকাল বাদে দেশে ফিরছেন, দেখা করতে আসাটা স্বাভাবিক ভদ্রতার মধ্যেই পড়ে, তাই না?
মাথা নাড়লেন পার্থ সান্যাল, না। আপনি ঠিক জানেন না।
বুঝলাম না।
নন্দিতার সঙ্গে আমার কখনও কথাবার্তাই হয়নি। আমি যে ওঁর নাম ধরে কথা বলছি, সেটা বয়সের অ্যাডভান্টেজ থেকে।
আচ্ছা!
আমার এখানে আসার কারণ এক ধরনের কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্যে।
কৃতজ্ঞতা?
নিরাপদ স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
হ্যাঁ। আমি খুব সাধারণ ছেলে ছিলাম। রকে আড্ডা মারতাম আর মেয়েদের দেখলে টিটকিরি মারতাম। ওইভাবে আর কিছুকাল চললে এদেশের আর একজন ব্যর্থ নাগরিক হওয়া ছাড়া। আমার কপালে অন্যকিছু ঘটত না। তা নন্দিতাকে দেখে ওর সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করল। যেচে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম, ও ঘৃণা বা অবজ্ঞায় মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। সেদিন ভীষণ অপমানিত বোধ করছিলাম। বুঝতে পারলাম আমাকে একজন ভালো মেয়ে কী চোখে দেখে। সঙ্গে-সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করলাম যে, আমাকে বড় হতে হবে। যোগ্য হতে হবেই। ওই ধাক্কা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতে-বেড়াতে শেষপর্যন্ত আমেরিকায় পৌঁছে দিল। তারপর আর পেছনে তাকাতে। হয়নি। আপনার স্ত্রী না জেনে আমার বিরাট উপকার করেছিল। জানি এভাবে আসা ঠিক নয়, তবু এসে পারলাম না।
আপনি কি একা এসেছেন? নিরাপদ জানতে চাইলেন।
হ্যাঁ। আমার বৃদ্ধা মা-ও আমার কাছেই আছেন। উনি আসতে চাইলেন না।
আপনার স্ত্রী?
কপালে নেই মশাই। এক বঙ্গললনাকে বিয়ে করেছিলাম, তিনি অকালে চলে গেলেন। পার্থ সান্যাল ম্লান হাসলেন। নীপা এবং শ্যামল ঢুকল।
নীপা বলল, ও আমার চেয়ে দু-বছরের ছোট। ওর নাম শ্যামল।
আচ্ছা! কী পড়ো তুমি?
কলেজে পড়ছি।
নীপা হাসল, বামপন্থী ইউনিয়ন করে।
আচ্ছা! এই যে বুশ সাহেব হারলেন। দেশজুড়ে নির্বাচন হল। ওই সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া দেশে নীরবে ব্যালট বাক্সে বিপ্লব হয়ে যায়, তোমরা কী বলে?
আমাদের কাছে বুশ বা ক্লিন্টন-এর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।
ঠিক। এখন পুথিবীতে যারা রাজনীতি করে তাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। সবাই কিছু। পাওয়ার জন্যে করে। আচ্ছা, চলি। নমস্কার মিস্টার মিত্র। নন্দিতা, নীপা এলাম। পার্থ সান্যাল হাসিমুখে বিদায় নিলেন।
শ্যামল বলল, এইসব জিনিস ওই লোকটা এনেছে? সে টেবিলের দিকে তাকিয়েছিল।
নীপা বলল, হ্যাঁ। লোকটা বলছিস কেন?
ঘুষ দিয়ে গেল।
নিরাপদ হঠাৎ থমকে উঠলেন, শ্যামল!
শ্যামল অবাক হয়ে তাকাল। নিরাপদ রাগত গলায় বললেন, একজন ভদ্রলোক ভালো মনে উপহার দিয়ে গেলেন আর তুমি তাকে ঘুষ বলছ?
কেউ এমনি-এমনি উপহার দেয় না।
তোমরা তাহলে এমনি-এমনি কিউবার জন্যে সাহায্য সংগ্রহ করছ না?
বাবা, দুটো ব্যাপার এক কোরো না। আমেরিকা যাকে এক্সপ্লয়েট করছে আমরা তার পাশে দাঁড়াচ্ছি। পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত মানুষ এখন এক প্ল্যাটফর্মে।
শ্যামল চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে থেকে নিরাপদ বললেন, আর কদিন পরে বুঝবে। সবে দাঁত গজালে খুব সুড়সুড় করে, নীপা, এগুলো ভেতরে নিয়ে যা।
আমি এই পারফিউমটা নিচ্ছি।
ঠিক আছে। শোন, ওই আফটার শেভ লোশনটা শ্যামলের টেবিলে রেখে দিবি। ঘাড় নেড়ে নীপা উপহারগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল।
ঘরে এখন নন্দিতা আর নিরাপদ। আমরা নন্দিতাকে চুপচাপ কাঁদতে দেখলাম। ওঁর পাশে এসে নিরাপদ সেটা বুঝতে পারলেন, একী! তুমি কাঁদছ?
নন্দিতা হঠাৎ স্বামীর হাত জড়িয়ে ধরলেন, আমার ভীষণ ঘেন্না করছে।
ঘেন্না?
ওই লোকটা আমাকে অপমান করে গেল।
কী যা-তা বলছ?
যাকে আমি অবজ্ঞা করতাম তার দান নিলে তোমরা?
আঃ, এভাবে ভাবছ কেন!
কিন্তু শ্যামল বলল, এমনি-এমনি কেউ কাউকে উপহার দেয় না। শোনো, তুমি আমাকে সন্দেহ করছ না তো? বিশ্বাস করো, ওর সঙ্গে আমি কখনও কথা বলিনি।
ইটস অলরাইট। তিরিশ বছর আগে তুমি কী করেছ, তাতে আমার বিন্দুমাত্র যায় আসে না। উনি আসায় আমাদের বরং উপকার হল।
তার মানে?
নীপার একটা চ্যানেল তৈরি হয়ে গেল। আর আমরা জানলাম তোমার একজন ভালো বন্ধু আছে। ইটস অলরাইট।
নন্দিতা উঠে দাঁড়ালেন, তুমি স্পষ্ট বলো, আমাকে বিশ্বাস করছ?
না করে উপায় আছে?
তার মানে?
সকাল-দুপুর-বিকেল কাটিয়ে দিয়েছি। এখন এই সন্ধেবেলোয় এসে তোমাকে অবিশ্বাস করলে আমি যে একা হয়ে যাব নন্দিতা। ছেলেমেয়েরা যে-যার মতো জীবন কাটাবে। রাত নেমে আসা। পর্যন্ত সময়টায় আমাদের একসঙ্গে থাকা দরকার। অবিশ্বাসে জ্বলেপুড়ে মরার চেয়ে বিশ্বাস করে ঠকাও ঢের ভালো, তাই না?
নন্দিতা অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন। তারপর মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। নিরাপদ তাঁর যাওয়া দেখলেন। এবার এগিয়ে এলেন মঞ্চের সামনে। হাতজোড় করে বললেন, ভদ্রজনেরা, এটা নাটক। সময়াভাবে ছোট করে নিয়েছি। এই নাটকে আমি সৎ নই, ঘুষ নিই, দাপটে থাকি। তবু নন্দিতা আমার কাছে জানতে চাইছে, আমি তাকে সন্দেহ করি কিনা! বিশ্বাস করুন, আমি নিজেই সেটা বুঝতে পারছি না। সৎ বা অসৎ যে-কোনও জীবনযাপনের পরে একটা সময় আসে, যখন পুরুষমানুষ একা হয়ে যায়। মেয়েরা হয় কিনা জানি না। তখন সবকিছু মানিয়ে নিতে হয়। মেনে নিতে হয়। শান্তি না হোক স্বস্তি হবে তাতে। এটুকুই বা কম কী! নিরাপদ ধীরে-ধীরে ভেতরে চলে গেলেন। পরদা পড়ল না, আলো জ্বলে উঠল।