সন্দেহজনক ব্যাপার

সন্দেহজনক ব্যাপার

মন্মথ নামক যুবককে প্রেমিক বলিব কিংবা কুচক্রী হত্যাকারী বলিব, তাহা ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না। সে পুঁটু ওরফে তমাললতা দেবীর প্রেমে পড়িয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই; উপরন্তু পুঁটুর পিতামহ রামদয়ালবাবু যে মন্মথর হাতে পড়িয়াই প্রাণ হারাইয়াছিলেন তাহা এক প্রকার স্বতঃসিদ্ধ। মোটিভ অর্থাৎ দুরভিসন্ধি যে তাহার পুরামাত্রায় ছিল তাহাও এখন প্রমাণ হইয়া গিয়াছে। পুঁটুর সহিত সে বিবাহের সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক করিয়া ফেলিয়াছে।

এরূপ অবস্থায় পাঠক যদি পুলিসে খবর দেন তাহা হইলে অন্তত আমার দিক হইতে কোনও আপত্তি হইবে না।

মন্মথ যে আদর্শ বাঙালী যুবক নয় তাহার প্রমাণ—সে কুড়ি বছর বয়স হইতে শেয়ার মার্কেটে বেচা-কেনা করিয়া টাকা উপার্জন করিতে আরম্ভ করিয়াছিল; এবং পঁচিশ বৎসর বয়স হইতে না হইতেই স্বাবলম্বী, ফন্দিবাজ ও মানবচরিত্রে অভিজ্ঞ হইয়া উঠিয়াছিল; আমরা সকলেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাহার অসাধ্য কাজ নাই। সুতরাং মধ্যমনারায়ণ-ঘটিত ব্যাপারটা তাহার স্বেচ্ছাকৃত কি না তাহা লইয়া কোনও প্রশ্নই উঠিতে পারে না।

আসামী পক্ষের উকিল হয়তো প্রমাণ করিবার চেটা করিবে যে মন্মথ ভ্রমক্রমে এই কার্য করিয়াছিল, কিন্তু আসামীর উকিলের কথা কতদুর বিশ্বাসযোগ্য তাহা আমরা সকলেই জানি।

যাহোক, এখন মামলার হাল বয়ান করা দরকার।

রামদয়ালবাবুর বয়স হইয়াছিল পঁয়ষট্টি বৎসর এবং তাঁহার টাকা ছিল পঁয়ষট্টি লাখ। কথাটা অবিশ্বাস্য—তবু সত্য। তাঁহার পঞ্চাশ বৎসর বয়ঃক্রমকালে, পুঁটু ব্যতীত আর সকল আত্মীয়-স্বজন পুত্র-পৌঁত্র মরিয়া গিয়াছিল। এই সকল পুত্র-পৌঁত্র যে তাঁহার সহিত বেইমানি করিবার উদ্দেশ্যেই মরিয়া গিয়াছে তাহা বুঝিতে পারিয়া রামদয়াল অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিলেন এবং উহাদের মজা দেখাইবার জন্যই প্রাণপণে শেয়ার মার্কেটে টাকা উড়াইতে লাগিয়া গিয়াছিলেন। টাকা কিন্তু উড়িল না; ফলে গত পনের বছরের মধ্যে পঁয়ষট্টি লাখ টাকা তাঁহার ব্যাঙ্কে সঞ্চিত হইয়াছিল।

কিন্তু বাঙালী হইয়া এত টাকা রোজগার করিলে ভগবান তাহা সহ্য করিতে পারেন না; রামদয়ালকে আপাদমস্তক রোগে ধরিয়াছিল। অর্থাৎ তাঁহার পায়ে ধরিয়াছিল বাত, এবং মস্তকে রক্তের চাপ বাড়িয়া মাথা ঘুরিতে আরম্ভ করিয়াছিল। তা ছাড়া চোখেও ছানি পড়িয়াছিল, ভাল দেখিতে পাইতেন না।

রামদয়াল সাবেক লোক, কবিরাজী চিকিৎসা করাইতেছিলেন। মস্তকের রক্তচাপ কমাইবার জন্য সুশীতল মধ্যমনারায়ণ তৈল সর্বদা মস্তকে মাখিতেন। পদদ্বয়ের বাত-বেতনা অপনোদনের জন্য মহাতেজস্কর মহামাস তৈল বিমর্দিত করাইতেন, এবং দুই চক্ষুতে ভেষজগুণাক্রান্ত কোনও বৃক্ষের রস দিয়া চক্ষু বন্ধনপূর্বক ধৃতরাষ্ট্র সাজিয়া বসিয়া থাকিতেন। তাঁহার সর্বাঙ্গ হইতে গন্ধগোকুলের ন্যায় সুরভি নির্গত হইতে থাকিত।

একদা প্রাতঃকালে রামদয়াল নিজ বৈঠকখানায় বসিয়া শটকা টানিতেছিলেন, এমন সময় মন্মথ সেখানে গিয়া উপস্থিত হইল। অধিক বাক্যব্যয় না করিয়া সে কাজের কথা পাড়িল। ধৃতরাষ্ট্ররূপী রামদয়ালকে বলিল, শুনেছি আপনার কাছে এক হাজার গিরি-গোবর্ধন শেয়ার আছে। বেচে ফেলুন, আমি এক টাকা প্রিমিয়াম্ দিয়ে কিনে নিতে রাজী আছি।

রামদয়াল বলিলেন, তুমি কে হে বাপু?

আমার নাম মন্মথ মজুমদার। যদি সৎপরামর্শ চান, এই বেলা গিরি-গোবর্ধন বেচে ফেলুন; নইলে আপনারই বুকে চেপে বসবে।

রামদয়াল হাঁকিলেন, পরশুরাম!

ভিতর দিকের পর্দা সরাইয়া একটি তরুণীর মুখ দেখা গেল; পুঁটু বলিল, কি বলছ দাদু? পরশুরাম কবিরাজের বাড়ি গেছে।

রামদয়াল বলিলেন, বেশ, তুমিই এসো। এই বেয়াদব লোকটাকে কান ধরে বার করে দাও।

পুঁটু ঘরে প্রবেশ করিল; মন্মথ ও পুঁটুর দৃষ্টিবিনিময় হইল। মন্মথ একটু হাসিল, পুঁটু একটু লাল হইল।

মন্মথ খাটো গলায় পুঁটুকে বলিল, এই যে কান–ধরুন।

পুঁটু লজ্জা পাইয়া চুপি চুপি বলিল, দাদু রেগেছেন। এখনই ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যাবে। আপনি যান।

রামদয়াল জিজ্ঞাসা করিলেন, কান ধরেছ?

পুঁটু হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ধরেছি।

রামদয়াল বলিলেন, বেশ, এবার বার করে দাও। ফের যদি এ বাড়িতে মাথা গলায়, জুতো-পেটা করব।

পুঁটু ও মন্মথ পাশাপাশি বাহিরের দিকে প্রস্থান করিল। মন্মথর মুখ কৌতুকে চটুল, পুঁটুর গাল দুইটি লজ্জায় অরুণাভ।

বাহিরে আসিয়া মন্মথ জিজ্ঞাসা করিল, আপনার নাম কি?

পুঁটু বলিল, পুঁ—মানে তমাললতা।

মন্মথ বলিল, আজ বিকেলবেলা আমি আসব। গিরি-গোবর্ধন বিক্রি করে ফেলা যে একান্ত দরকার, এ কথা আপনাকে বুঝিয়ে দেব।

অতঃপর পাদুকা-প্রহারের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া মন্মথ প্রত্যহ সকাল-বিকাল রামদয়ালের বাড়িতে যাতায়াত করিতে লাগিল।

এই ভাবে মাসাধিক কাল কাটিয়া গেল। রামদয়াল চক্ষে ফেট্টা বাঁধিয়া মস্তকে ঠাণ্ডা তৈল ও পদদ্বয়ে গরম তৈল মালিশ করাইতে লাগিলেন। তাঁহার পারিবারিক জীবনে ও পুঁটুর অন্তলোকে যে গুরুতর জটিলতার সৃষ্টি হইয়াছে তাহা জানিতেও পারিলেন না।

একদিন মন্মথ পুঁটুকে বলিল, পুঁটু, গিরি-গোবর্ধন শেয়ার আমার চাই; কারণ তোমাকে বিয়ে করা আমার একান্ত প্রয়োজন।

পুঁটু নড়িয়া-চড়িয়া বসিল, দাঁত দিয়া ঠোঁট কামড়াইল, তারপর বলিল, দাদু তোমার নাম শুনলে জ্বলে যান।

মন্মথ বলিল, এর একটা বিহিত করা দরকার। তোমাকে বিয়ে করা এবং গিরি-গোবর্ধন শেয়ার হস্তগত করা আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।

পুঁটু বলিল, হনুমানপুরের রাজবাড়িতে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

মন্মথ বলিল, হনুমানপুরকে কলা দেখাব। এসো, দুজনে ষড়যন্ত্র করি।

তখন উভয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইল।

.

পরশুরাম নামক ভৃত্য রামদয়ালবাবুর মস্তকে ও পদদ্বয়ে তৈল মালিশ করিত। সে হঠাৎ এক মাসের ছুটি লইয়া রুগ্ণা স্ত্রীকে দেখিতে দেশে চলিয়া গেল। তাহার স্থানে যে ভৃত্য নিযুক্ত করিয়া গেল, তাহার নাম নসীরাম। নসীরামের অপর নাম মন্মথ।

নসীরাম অত্যন্ত মনোযোগসহকারে রামদয়ালকে তৈল মর্দন করিতে লাগিল। রামদয়াল সর্বদা চোখে ফেট্টা বাঁধিয়া থাকিতেন না; মাঝে মাঝে খুলিতেন। নসীরামের চেহারা দেখিয়া তাঁহার পছন্দ হইল। ছোকরা লেখাপড়াও কিছু জানে; তাহাকে দিয়া তিনি শেয়ার মার্কেটের রিপোর্ট পড়াইয়া শুনিতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নসীরাম আসা অবধি গিরি-গোবর্ধন শেয়ারের দাম দিন দিন পড়িয়া যাইতেছে। মন্মথ মজুমদার নামক বেয়াদব ছোকরার কান ধরিয়া তাড়াইয়া দেওয়ার জন্য তিনি অনুতাপ বোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু তিনি একগুঁয়ে লোক, শেয়ার বিক্রির কথা মুখে উচ্চারণ করিলেন না।

ওদিকে হনুমানপুরের রাজবাড়িতে পুঁটুর বিবাহের কথা অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছিল। কিন্তু হঠাৎ চিঠিপত্রের আদান-প্রদান একেবারে থামিয়া গেল। ইহার কারণ, রামদয়াল নসীরামকে চিঠি ডাকে ফেলিবার জন্য দিতেন, নসীরাম তৎক্ষণাৎ তাহা ছিঁড়িয়া ফেলিত, এবং হনুমানপুর হইতে যে সব পত্র আসিত পুঁটু তাহা নির্বিকারচিত্তে আত্মসাৎ করিত।

কিন্তু তবু হনুমানপুরকে ঠেকাইয়া রাখা গেল না। পঁয়ষট্টি লাখ টাকা রাজারাজড়ার পক্ষেও সামান্য নয়, বিশেষত যদি রাজার সমস্ত রাজত্ব মহাজনের কাছে বন্ধক থাকে।

একদিন হনুমানপুরের এক দৃত উপস্থিত হইল। সে জানাইল যে, রামদয়ালের পত্রাদি না পাইয়া মর্মাহত রাজা স্বয়ং কলিকাতায় আসিতেছেন; কল্যই কথাবার্তা পাকা করিয়া ফেলিতে চান। পত্রাদির ব্যাপার শুনিয়া রামদয়াল নসীরামের উপর অতিশয় সন্দিহান হইয়া উঠিলেন।

কিন্তু সেইদিনই দ্বিপ্রহরে তাঁহার সমস্ত সন্দেহ ভঞ্জন হইয়া গেল।

পুঁটু রামদয়ালের বুকের উপর কাঁদিয়া পড়িয়া বলিল, দাদু, আমি—আমি হনুমানপুরে বিয়ে করব।

রামদয়াল বলিলেন, কী!

পুঁটু ফুঁপাইতে ফুপাইতে বলিল, আমি নসীরামকে বিয়ে করব।

শুনিবামাত্র রামদয়ালের মাথায় রক্ত চড়িয়া গেল। তিনি একটি হুংকার ছাড়িয়া ডাকিলেন, নসীরাম!

নসীরাম নিকটেই ছিল, বলিল, আজ্ঞে, আমার নাম মন্মথ।

রামদয়াল আর দ্বিরুক্তি না করিয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন।

নসীরাম ছুটিয়া গিয়া শিশি হইতে রামদয়ালের মাথায় তৈল ঢালিতে আরম্ভ করিল। পুঁটু কি করিবে ভাবিয়া না পাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে তাঁহার পায়ে অন্য শিশির তৈল মালিশ করিতে লাগিল। 

কবিরাজ আসিয়া দেখিলেন, অবস্থা সাংঘাতিক! ঔষধ উল্টা-পাল্টা হইয়া গিয়াছে; অর্থাৎ পায়ে মধ্যমনারায়ণ ও মাথায় মহামাস মালিশ চলিতেছে।

এই সাংঘাতিক চিকিৎসা-বিভ্রাটের ফলে রামদয়াল সেই রাত্রেই পরলোক যাত্রা করিলেন।

.

পরদিন হনুমানপুর উপস্থিত হইলে নসীরাম সবিনয়ে তাঁহাকে বলিল, আপনি আসবেন শুনে রামদয়ালবাবু মারা গেছেন। এখন আপনি রাজত্বে ফিরে যেতে পারেন।

শ্রাদ্ধ শেষ হইলে মন্মথ পুঁটুকে সান্ত্বনা দিয়া বলিল, পুঁটু, দুঃখ করো না, ভগবান যা করেন ভালর জন্যে। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো আমাদের দুজনকেই খুন করতেন; কিংবা আমাকে খুন করে তোমাকে হনুমানপুরের সঙ্গে বিয়ে দিতেন। সেটা কি ভাল হত? এদিকে দেখছ তো, গিরি-গোবর্ধনের শেয়ার চড়চড় করে উঠছে। এখন অশৌচটা কেটে গেলেই…

মন্মথকে পুলিসে দেওয়া যাইতে পারে কি না আপনারাই বিচার করিয়া দেখুন। আর কিছু নয়, সে গিরি-গোবর্ধনের নাম করিয়া পঁয়ষট্টি লাখ টাকা মারিয়া দিবে ইহাই অসহ্য বোধ হইতেছে।

১৩ মাঘ ১৩৪৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *