সতী – 1742-57 – ষষ্ঠ পর্ব

সতী – 1742-57 – ষষ্ঠ পর্ব

কাজী সাহেব বলেছিলেন, মানুষের দুনিয়ায় যতটুকু বেহেস্তী মুবারকী আর যতখানি দোজখী-ইব্‌লিসি, সবটাই আমাদের যৌথ দায়িত্বে—‘অর্ধেক তার রচিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’ হিসাবটা নিশ্চয় আঠারো শতকেও প্রযোজ্য। কিন্তু পর্দার আড়াল থেকে যে পাপীয়সীরা পাপাত্মাদের কুপরামর্শ জুগিয়েছে, নরকের পথে টেনে নিয়ে গেছে, ইতিহাস তাদের কথা লিখে রাখেনি। অপরপক্ষে যাঁরা মহাত্মাদের অনুপ্রাণিত করেছেন অথবা জনহিতার্থে নিজেরাই নিবেদিতপ্রাণা, তাঁদের সকলের কথাও আমরা জানি না। ইতিহাসকেই বা দোষ দিই কোন হিসাবে? ভাবীজীরা সেযুগে ছিলেন পর্দানসীন, বৌঠাকরুণেরা অবগুণ্ঠনবতী। জাহ্নবীর জলোচ্ছ্বাসের মতো যাঁরা দিগন্তব্যাপী পলিমাটির গেরুয়া আশীর্বাদ ছড়িয়ে গেছেন সেইসব রানী ভবানীদের কথা আলাদা, না হলে ইতিহাস তার পর্বতপ্রতিম নথীপত্রের মধ্যে কোন্ প্রান্তে বর্জাইস হরফে জনৈকা মহিমময়ীর কথা সলজ্জে লিখে রেখেছে কে তার হদিস পাবে? আজকের দিনে লাখে একজনও কি খুঁজে পেত সন্ন্যাসী বিদ্রোহের আমলে ঐতিহাসিক চরিত্র ভবানী পাঠকের এক ঐতিহাসিক শিষ্যা ঐ নামে বাস্তবেই আবির্ভূতা হয়েছিলেন ‘পরিত্রাণায় সাধুনাম বিনাশায়চ দুষ্কৃতাম্’? সহজ সরল পথে ইতিহাস ঘেঁটে কেউ দেবী চৌধুরানীকে খুঁজে পেত না, যদি না সাহিত্যসম্রাট কথাসাহিত্যের বঙ্কিমপথে দীপশিখাটি জ্বালিয়ে যেতেন। গবেষক ব্রজেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতন্দ্র সাধনা ব্যতিরেকে আমরা সন্ধান পেতাম না অষ্টাদশ শতাব্দীর দুই মহিলা বিদ্যালঙ্কারের।

তোমাদের ইতিহাস পড়ানোর বায়না নিয়ে আমি কাগজ-কলম নিয়ে বসিনি বাপু। তবু হটী বিদ্যালঙ্কারের আবির্ভাবের পূর্বযুগের দু-একটি ‘কাব্যে উপেক্ষিতার’ কথা না বলেও প্রাণটা শান্ত হচ্ছে না। একজনের কথা বলি। কিন্তু নাম বললেও কি চিনতে পারবে তাঁকে?

: শরফ উন্নিসা।

ঘসেটি বেগমকে তোমরা চেন। না চিনবে কেন? বাপের দেহাবসানে হারেমের অন্তরালে থেকে নবাবী করার নূরজাহাঁনী খোয়াবে সে গড়েছিল মতিঝিল, বেতনভুক সৈন্যদল মোতায়েন করেছিল অবৈধ প্রেমের নায়কের সহায়তায়। চেন আমিনা বেগম সাহেবাকেও, সিরাজজননীরূপে। কিন্তু শরফ উন্নিসার নাম তোমরা শোননি। অথচ তিনি ছিলেন সে-আমলে মার্কিন-কেতায় সুবে বংগাল-মুলকের : দ্য ফার্স্ট লেডি!

তিনি ছিলেন আলিবর্দী খাঁ মহব্বত জঙ-বাহাদুরের অদ্বিতীয়া বেগমসাহেবা আশ্চর্য মহিলা। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়ের ভাষায়:

আলিবর্দীকে মুর্শিদাবাদের বা বাঙ্গলার আকবর বলিয়া নির্দেশ করা যাইতে পারে। মুর্শিদাবাদ নবাবদিগের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমানের প্রতি সম্প্ৰীতি দেখাইয়া মহাবিপ্লবমধ্যেও শান্তভাবে প্রজাপালন করিতে তাঁহার ন্যায় আর কেহই সমর্থ হয় নাই। তাঁহার প্রভু পূর্ববর্তী নবাব সুজাউদ্দীন এই হিন্দু-মুসলমানের প্রতি সম্প্রীতির সূচনা করিয়া যান এবং আলিবর্দী তাহা সম্পূর্ণরূপে পরিণত করেন। সেই কর্মবীর আলিবর্দী খাঁর রাজনৈতিক জীবন তাঁহার প্রিয়তমা মহিষীর সহায়তায় পূর্ণতালাভ করিয়াছিল বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। আলিবর্দীর উচ্ছৃঙ্খল সংসার যেমন এই মহিলার তর্জনীতাড়নের অধীন ছিল, সেইরূপ বিপ্লবসাগরে নিমগ্ন সমগ্র বঙ্গদেশের শাসনও তাঁহারই পরামর্শানুসারে চালিত হইত। জ্ঞান, ঔদার্য, পরহিতেচ্ছা ও অন্যান্য সদ্‌গুণে তিনি রমণীগণের মধ্যে অতুলনীয়া ছিলেন। রাজ্যের যাবতীয় হিতকর কার্য তাঁহারই পরামর্শের উপর নির্ভর করিত।[১]

[১. মুর্শিদাবাদ কাহিনী, নিখিলনাথ রায়, পুঁথিপত্র, 1943, পৃঃ79.]

সুলতানা রিজিয়ার মতো তিনি সিংহাসনে আসীন হতে চাননি, নূরজাহাঁ বা ঘসেটি বেগমের মতো নেপথ্য থেকে কলকাঠি নেড়ে বিলাসবৈভবে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হতে চাননি। লোকচক্ষুর অন্তরালে যথার্থ মহারানীর ভূমিকা পালন করে গেছিলেন। নিখিলনাথ তো অনেক পরে (1898) ইতিহাস ঘেঁটে এ-কথা লিখেছেন, সমকালীন বিপক্ষ-শিবিরের লোক কী লিখে গেছে?

এবার শোনাই ইংরাজ ঐতিহাসিক ‘হলওয়েল’-এর জবানীতে। নবাব সরকারের সব কিছুকেই তিনি কালিমালিপ্ত করতে বদ্ধপরিকর। লক্ষণীয়, উদ্ধৃত-অংশেও মহিলার স্বামীকে ‘নবাব’ বা ‘আলিবর্দী’ নামে উল্লেখ না করে ক্যাপিটাল U-ব্যবহার করে বলা হয়েছে Usurper.

বেগম সাহেবার প্রসঙ্গে হলওয়েল লিখছেন :

A woman whose wisdom, magnanimity, benevolence and every amiable quality, reflected high honour on her sex and station. She much influenced the Usurper’s councils, and was ever consulted by him in every material movement in the state, except when sangninary and treacherous measures were judged necessary, which he knew she would oppose as she ever condemned them when prepetrated, however successful-predicting always that such politics would end in the ruin of the family. [১]

[১. Interesting Historical Events, Holwell, Pt. I, Chap. II. pp. 170-71.]

অর্থাৎ হলওয়েল-সাহেবের মতে এই সর্বগুণান্বিতা মহিমময়ী বেগমের পরামর্শে ‘পরস্বাপহারক’ রাজকার্যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলি করতেন। কেবলমাত্র রক্তাক্ত ষড়যন্ত্র অথবা অন্যায় রাজনৈতিক চক্রান্তর পরিকল্পনাগুলি বেগমসাহেবাকে জানানো হতো না। তিনি তা কোনকালেই অনুমোদন করতেন না। বলতেন, এই জাতীয় অন্যায় রাজনীতি অন্তিমে শুধু রাজপরিবারের সর্বনাশই ডেকে আনে।

আলিবর্দীর শাসনকালে সবচেয়ে বড় জাতের ‘রক্তাক্ত ষড়যন্ত্রের কাহিনীটাই প্রথমে শোনাই। বেগমসাহেবার অগোচরে ঘটনাটা ঘটেছিল, কারণ তিনি কিছুতেই সেটা সমর্থন করতেন না। সমকালীন ঐতিহাসিকের দল এ-জন্য আলিবর্দীকে যথেষ্ট ভর্ৎসনা করেছেন। যাঁরা করেননি, তাঁদের সেজন্য ভর্ৎসিত হতে হয়েছে।।[২]

[২. “Golam Hossein, the Mohamedan historian, has no words of blame for this atrocity.” H. Beveridge C. S. [এবং “মনকরার শিবির আলিবর্দীর কলঙ্কস্তম্ভে পরিণত হইল; কিন্তু মুসলমান ইতিহাস-লেখক তাহার জন্য একবারও আলিবর্দীর নিন্দা করিলেন না।”—সিরাজদ্দৌলা, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, পূঃ 30.]

মসনদে উঠে বসার দিন থেকে আলিবর্দী বহিঃশত্রুর আক্রমণে বিব্রত। দীর্ঘ পনের বছর বৃহত্তর বঙ্গের প্রজাসাধারণকে রক্ষা করতে এই বঙ্গাধিপ মুক্ত তরবারি হস্তে অশ্বপৃষ্ঠে ছোটাছুটি করেছেন বটে, কিন্তু একদিনের তরেও ‘নবাবী’ করার সুযোগ পাননি। একপত্নিক, হারেমে উপপত্নী নেই, কোন রকম উচ্ছৃঙ্খলতাই বরদাস্ত করেন না, কিন্তু হতভাগ্য ‘নবাব’-এর কি দুদণ্ড শান্তিতে নিদ্রা যাবার অধিকারটুকুও থাকবে না?

নবাব আলিবর্দী সিংহাসনে আরোহণ করে দেখলেন পূর্ব জমানা থেকেই দক্ষিণবঙ্গের মানুষজন মধ্য-বাঙ্গলার উর্বর ভূখণ্ডে ক্রমাগত চলে আসছে। হেতু, সুন্দরবন-অঞ্চলে পর্তুগীজ হার্মাদ আর আরাকান প্রদেশের মগ ডাকাতেরা ঐ সব গ্রামে বৎসরান্তিক লুটতরাজ করে যায়! নবাব মগ-ফিরিঙ্গি দমনে মন দিলেন। নবাব সরকার থেকে ঢাকাপ্রদেশে প্রায় পৌনে আট শতটি রণতরী সর্বদা প্রস্তুত থাকত। এই রক্ষীবাহিনীর জন্য ‘জায়গীর নৌয়ারা’ মহালের সম্পূর্ণ রাজস্ব ব্যয় করার বন্দোবস্ত হল। এই ব্যবস্থা করতে করতেই পশ্চিম থেকে এসে উপস্থিত হল আর এক নতুন জাতের উপদ্রব : বর্গী।[৩]

[৩. ‘বর্গী’ শব্দটা মারাঠী, অর্থ মহারাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর সর্বনিম্ন শ্রেণীর সৈনিক, যাদের না আছে নিজস্ব অশ্ব, না অস্ত্র। যখন যে বাহিনীতে যোগ দেয় তখন সেখান থেকে তা যোগান দেওয়া হয়। এর বিপরীতার্থবোধক শব্দটি ‘সিলাদার’, অর্থাৎ যার নিজস্ব অশ্ব ও তরবারি আছে। যে বাহিনীতে ‘তলব’ এবং লুটের হিস্যা লাভের সম্ভাবনা বেশি, সিলাদাররা ইচ্ছামতো সেই বাহিনীতে যোগ দেয়।]

প্রথম বর্গীর হাঙ্গামা বেয়াল্লিশ-সালে, আলিবর্দীর রাজত্ব শুরুর তৃতীয় বর্ষে। দ্বিতীয় আক্রমণ পরের বছর বসন্তকালে। আগেই বলেছি, আলিবর্দী ‘চৌথ’ দিতে অস্বীকার করেছিলেন; কিন্তু তখন ব্যাপারটার বিশ্লেষণ করিনি। আলিবর্দী যখন দিল্লীশ্বরের বশ্যতা মানছেন তখন তাঁর আদেশ অমান্য করছেন কী হেতুতে? আলিবর্দীর যুক্তিটা যথেষ্ট জোরালো।

মুগল বাদশাহ মারাঠা-প্রধানের কাছে রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ বা ‘চৌথ’ দিতে স্বীকৃত হয়েছিলেন। বলাবাহুল্য বাধ্য হয়ে। কিন্তু প্রতিশ্রুতিটা দিয়েছিলেন কাকে? মহারাষ্ট্র দলনায়ক রাজা সাহুকে। রাজা সাহু তারপর নাগপুরের সেনানায়ক রঘুজী ভোঁসলেকে বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার চৌথ আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে স্বয়ং দিল্লীর মুগল বাদশাহ—কী কারণে বোঝা মুশকিল (সম্ভবত কিছু নগদ প্রাপ্তিযোগের বিনিময়ে)—পেশোয়া বালাজী রাওকে অনুরোধ করলেন রঘুজীকে চৌথ আদায় থেকে বিরত করতে। পেশোয়া বালাজী রাও আর রঘুজী ভোসলে দুজন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী—মারাঠা শক্তির সর্বময় কর্তা হওয়ার আশায় প্রতিযোগিতা করে চলেছেন। ভাস্কর পণ্ডিত হচ্ছেন ঐ রঘুজীর দক্ষিণহস্ত। তিনি চৌথ আদায় করতে এলেনই লুট করতে করতে। রাজা সাহুর প্রাপ্য রাজস্বের এক- চতুর্থাংশ কোন্ মহারাষ্ট্রীয় সেনানায়ক সংগ্রহ করবেন সেটা যতক্ষণ না স্থিরীকৃত হচ্ছে ততক্ষণ নবাব আলিবর্দী কী করে চৌথ দেন? ওদিকে ভাস্কর তার অত্যাচার চালিয়েই যাচ্ছে। সেবার আলিবর্দী মহাষ্টমীর দিন অতর্কিত আক্রমণে ভাস্করকে পলায়নে বাধ্য করেন।

পরবৎসর (1743) ভাস্কর পুনরায় ফিরে এলেন। কিন্তু তাঁর পিছন পিছন এসে হাজির পেশোয়া বালাজী রাও! আলিবর্দীকে বিশেষ কিছু করতে হল না। ষাঁড়ের শত্রু বাঘে খেল। বালাজী রাওয়ের বৃহত্তর সৈন্যবাহিনীর কাছে তাড়া খেয়ে ভাস্কর পণ্ডিত নাগপুরের দিকে পালিয়ে গেলেন। যথারীতি প্রতিরোধহীন গ্রাম গুলি লুণ্ঠন করতে করতে।

পেশোয়া বালাজী রাও আর আলিবর্দী মিলিত হলেন ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে ‘চৌরিয়াগাছী’ গ্রামে। পেশোয়া আলিবর্দীকে সাহু-রাজার ফরমান দেখালেন, ‘চৌথ’ আদায়ের অধিকারী তিনিই। নবাব স্বীকৃত হলেন সাহু-রাজার প্রাপ্য তাঁকে দিতে। উপরন্তু সৈন্যবাহিনীর খরচ বাবদ বাড়তি বাইশ লক্ষ তঙ্কা খেসারত দিতে।

বিভিন্ন জমিদারবর্গের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নবাব এই অর্থ কোনক্রমে মিটিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে দেশে ফিরলেন। ঠিক নিশ্চিন্ত হয়ে নয়; কারণ বর্গীর নতুন হাঙ্গামা আশঙ্কা করে তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে এবং ধনদৌলত ইতিপূর্বেই মুর্শিদাবাদ থেকে স্থানান্তরিত করেছিলেন—গোদাগাড়িতে, পদ্মা ও মহানন্দার সঙ্গমস্থলে, যেখানে অশ্বারোহী সৈন্যদের মহড়া নিতে পারবে নবাবের নৌবাহিনী।

এই বছরেই কলকাতার ইংরেজ বণিকেরা ‘মারাঠা-ডিচ’ খনন করে।

নয় মাস নিরুপদ্রবে কাটল। তেতাল্লিশের শ্রাবণ থেকে চুয়াল্লিশ সালের বৈশাখ পর্যন্ত তারপরই শোনা গেল, ভাস্কর পণ্ডিত পুনরায় ফিরে আসছে উড়িষ্যা ও মেদিনীপুরের পথে—তৃতীয় বার! শোনা গেল, ভাস্কর নাকি রাগে অগ্নিশর্মা! তার প্রভু রঘুজী ভোঁসলের প্রতিদ্বন্দ্বী ঐ বালাজী হতচ্ছাড়া বাইশ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছে শুনে রাগ তো হতেই পারে। আগের বছর জগৎশেঠের গদি লুট করে কিছু জুটেছিল; কিন্তু এবার নিরন্ন গ্রামবাসীদের পর্ণকুটির লুট করে ভাস্কর সে তুলনায় কী বা পেয়েছে?

আলিবর্দী দ্রুতগতি সংবাদবহ মারফৎ পেশোয়াকে হস্তক্ষেপ করতে অনুরোধ করলেন। পরিবর্তে পেশোয়া বালাজী রাও একটি বিচিত্র সংবাদ পেশ করলেন :

ইতিমধ্যে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মারাঠা সর্দার রঘুজী ও বালাজী নাকি তাঁদের প্রভু রাজা-সাহুর দরবারে হাজির হয়েছিলেন; এবং রাজা-সাহু দুই দস্যুসর্দারকে খুশি করে সহজ ফয়শালা বাংলে দিয়েছেন : দুজনেই চৌথ আদায় করতে পারবেন। পেশোয়া বালাজীর ভাগে সাহাবাদ জেলা সমেত পাটনা ও উত্তর বিহার; আর রঘুজীর ভাগে উড়িষ্যা ও বঙ্গদেশ। উল্লেখ করা বাহুল্য, ঐ দুই বাহিনী যখন নিজ নিজ অংশের হিস্যা বুঝে নিতে আসবেন তখন পথপ্রান্তের অরক্ষিত জনপদগুলি লুণ্ঠন করতে করতে আসবেন! তা তো বটেই!

এই চরম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েই বৃদ্ধ নবাব—তখন তাঁর বয়স আটষট্টি—ঐ ষড়যন্ত্রের আয়োজন করলেন। এ ছাড়া তাঁর গত্যন্তর ছিল না।

ভাস্কর তাঁর বাইশজন সেনানায়ক সহ এসে ঘাঁটি গেড়েছেন সেই দাঁইহাটিতে, যেখানে বছর-দেড়েক আগে দুর্গাপূজা অসমাপ্ত রেখে তাঁকে প্রাণ নিয়ে পালাতে হয়েছিল। সেখানে এসে ভাস্কর পণ্ডিতের সঙ্গে সাক্ষাত করলেন নবাবের দুই বিশ্বস্ত দূত, মুস্তাফা খাঁ আর দেওয়ান জানকীরাম। জানালেন, নবাব ভাস্করের সঙ্গে পৃথকভাবে সন্ধি করতে ইচ্ছুক। শর্তগুলো স্থির করতে পণ্ডিতজী যেন রাজধানীর কাছে মনকরা-ময়দানে শুভাগমন করেন।

ভাস্কর সন্দিগ্ধ! কিন্তু মুস্তাফা খাঁ কোরাণ স্পর্শ করে আর জানকীরাম তামা-তুলসী-গঙ্গাজল হাতে দিব্যি গেলে বললেন এর মধ্যে কোনও কারসাজি নেই। ভাস্কর স্বীকৃত হলেন, কিন্তু জানালেন সব কয়জন বর্গী সেনানায়কই তার সঙ্গে সন্ধিমণ্ডপে যাবেন। বিশ হাজার সৈন্যও সঙ্গ যাবে।

চুয়াল্লিশ সালের মার্চ মাসের শেষ দিন। মনকরা-ময়দানে পড়েছে অতি প্রকাণ্ড এক তাঁবু। ভাস্করের মনে বেশ কিছুটা সন্দেহ ছিলই। তাই বাইশজন সর্দারের মধ্যে একুশজন (একমাত্র রঘুজী গায়কোয়াড় অসুস্থতার কারণে সঙ্গী হতে পারেননি, এবং তাই প্রাণে বেঁচে যান) সর্দার ও বিশ হাজার বর্গী সৈন্য নিয়ে ময়দানে এসে উপস্থিত।

তাঁবুটি উপবৃত্তের আকারে। অতি প্রকাণ্ড। আধুনিককালের সার্কাসের তাঁবু যেন। তবে সেটি বিচিত্র কায়দায় নির্মিত। ডল্ কানাতের। অর্থাৎ তাতে দু-দুটি পর্দার আচ্ছাদন। তার ফাঁক-ফোকরে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে সর্বাঙ্গে বর্ম সেঁটে লুকিয়ে আছে নবাবের শতখানেক বাছা-বাছা যোদ্ধা। ভাস্কর সসৈন্য অগ্রসর হয়ে তাঁবুর কাছাকাছি এলেন। বিশ হাজার অশ্বারোহী বর্গী সৈন্যকে পঞ্চাশ-হস্ত পরিমাণ ভূমির দূরত্বে অপেক্ষা করতে বলে একুশজন সর্দারসহ অশ্বপৃষ্ঠে অগ্রসর হয়ে এলেন তাঁবুর প্রবেশদ্বারের দিকে। মুস্তাফা খাঁ আর দেওয়ান জানকীরাম তাঁবুর বাহিরে এসে আভূমি নত হয়ে আগন্তুক অতিথিকে কুর্নিশ করলেন।

ভাস্কর সন্দিগ্ধ; বার-কতক প্রবেশদ্বারের সমুখে অশ্বকে টহল দিয়ে ভিতরটা ভাল করে দেখে নিলেন। না! আশঙ্কার কিছু নাই! দূর-প্রান্তে আরাম-কেদারায় অর্ধশায়িত বৃদ্ধ নবাব, তাঁর হাতে আলবোলার নল। পাশে কয়েকজন প্রবীণ আমীর ওমরাহ। দুদিকে দুই নিশানধারী—ওদেরই একজন বোধকরি নবাবের দেহরক্ষী। ঐ আটদশজন নবাবপক্ষের মানুষ ভিন্ন বিশাল তাঁবুটি জনশূন্য।

বর্গী-সর্দারেরা দলপতির ইঙ্গিতে অশ্ব থেকে অবতরণ করলেন। নবাবের খিদমদারেরা এগিয়ে এসে অশ্বগুলির লাগাম ধরল। অতঃপর একুশজন সেনাপতিসহ দুর্ধর্ষ মহারাষ্ট্রীয় কালান্তক যম ভাস্কররাম পন্থ ধীরপদে অগ্রসর হতে থাকেন বিপরীতপ্রান্তে অর্ধশয়ান অসহায় বৃদ্ধটির দিকে। যাকে তোমরা আজকাল বল—‘মরাল-চরণ-ক্ষেপভঙ্গিমা’য় : ‘গুজ্-স্টেপ’-এ

তাঁরা যখন উপবৃত্তাকার পটমণ্ডপের মাঝামাঝি উপস্থিত তখন অন্তরীক্ষ থেকে ধ্বনিত হল তূর্য-নিনাদ।

এ কী ভোজবাজি! তূর্যধ্বনি কানাতের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসার আগেই দু পর্দা তাঁবুর ভিতরের কানাটা উঠে গেল। মুহূর্তমধ্যে মঞ্চসজ্জার আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে! ভাস্কর দেখলেন, তাঁর চতুর্দিকে শতখানেক সশস্ত্র ঘাতক। তাদের সর্বাঙ্গে বর্মের আচ্ছাদন, হাতে নাঙ্গা তলোয়ার! পর মুহূর্তেই তারা বিদ্যুৎবেগে ধেয়ে এল। মারাঠা সর্দারেরা সকলে তরবারি কোষমুক্ত করার সময়টুকুও পেলেন না। চোখের পলক ফেলার আগেই তাঁবুর ভিতরে বাইশটি ছিন্নশির বর্গীনায়কের মৃতদেহ।

পঞ্চাশ হস্ত পরিমাণ ভূমির দূরত্বে বিশ-হাজার অশ্বারোহী বর্গী সৈন্য। নাগপুর থেকে বিনা বাধায় লুট করতে করতে এসেছে এই গাঙ্গেয় মোহনায় শান্তিপ্রিয় কৃষিজীবীদের দেশে। ইচ্ছা মতো লুট করেছে গ্রাম, গঞ্জ, জনপদ, নগর; আগুন ধরিয়েছে পাকা ধানের ক্ষেতে, পর্ণকুটিরে। বেছে বেছে তুলে এনেছে যৌবনবতী অসহায়াদের। শুধু গণধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, পৈশাচিক উল্লাসে তরোয়ালের কোপে কেটে নিয়ে গেছে তাদের মাতৃত্বের যুগল অমৃত-ভাণ্ডার!

ওরা জানে, সন্ধির শর্ত নিয়ে অনেক দরাদরি হবে। দু-পক্ষই দড়াদড়িতে ঢিল দেবেন, টান দেবেন। সময় লাগবে। তাই ওরা অবতরণ করেছে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে। কেউ জমিয়ে বসেছে ঘাসের উপর, কেউ অর্ধশয়ান, কেউবা খইনি ডল্‌ছে। আচমকা তূর্যধ্বনি শুনে চমকে ওদিক পানে একবার তাকিয়েছিল,—ডবল-কানাতের জন্য বাইরে থেকে কিছুই দেখা যায়নি। ওরা বুঝে নিল—ঐ তূর্যধ্বনি আর কিছু নয়, আগন্তুক মহান অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাতে।

আসল ঘটনাটা কী, তারা বুঝল যখন অন্তরীক্ষ থেকে ছুটে আসতে শুরু করল কামানের গোলা!

নেতৃত্বহীন বর্গী সৈন্যদলের অতি অল্পসংখ্যকই সেবার নাগপুরে ফিরে যেতে পেরেছিল। জঙ্গল-মহাল পর্যন্ত নবাবের অশ্বারোহী বন্দুকধারীরা ওদের পশ্চাদ্ধাবন করেছিল, অগ্নিদগ্ধ পাকাধানের ক্ষেতে এবার ধর্ষিতা নারীর চোখ থেকে নয়, অশ্বপৃষ্ঠ থেকে টপ্‌-টপ্ করে ঝরে পড়েছিল মারাঠা বর্গী! বস্তুত এই ঘটনার পর নাগপুরের রঘুজী ভোঁসলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আসর থেকে চিরতরে নেমে গেলেন।

মারাঠাদের সঙ্গে আলিবর্দী চূড়ান্ত সন্ধি করেন 1751 সালে। কিন্তু তখন মারাঠা দস্যুদলের সর্দার—না বালাজী, না রঘুজী! বস্তুত সে সন্ধিপত্রে বাঙ্গলার পক্ষে স্বাক্ষর করেন পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ আলিবর্দী এবং মারাঠা-পক্ষে একজন মুসলমান সেনানায়ক : মীর হাবিব। সে না হিন্দু, না মারাঠা!

কিন্তু সে-সব তো ইতিহাসের কথা। কথাসাহিত্যের খাতিরে আমরা যদি ধরে নিই—মুহূর্তমধ্যে ঐ গণহত্যা সংগঠিত হয়নি, তাহলে কল্পনা করতে পারি ভাস্কর পণ্ডিত বৃদ্ধ আলিবর্দীকে তিরস্কার করে হয়তো বলতো : রে নরাধন! পাপিষ্ঠ! এই কি যোদ্ধার প্রতি যোদ্ধার আচরণ! নরকের ভয় নেই তোর?

আলিবর্দী আরাম-কেদারায় সোজা হয়ে বসতেন, আলবোলার নলটি সরিয়ে রেখে বলতেন, শত শত গ্রামের সহস্র সহস্র অসহায় নরনারীকে যখন পৈশাচিক উল্লাসে হত্যা করেছিলি তখন তোর দোজখের ভয় হয়নি? আমি তো বেহেস্তে যাব রে! তোদের মতো বাইশটি নরকের কীটকে হত্যা করে আমি তো বাইশ হাজার ঔরতের ইজ্জৎ রক্ষা করেছি!

.

পরস্বাপহারকের বৃত্তি গ্রহণ করে সংসারযাত্রা নির্বাহের আয়োজন করেছিল দস্যু রত্নাকর। তার বাপ-মা-স্ত্রী-পুত্র জানত, কী-ভাবে সংসার চলছে। কিন্তু পাপের হিস্যা নেবার প্রশ্ন যখন উঠল তখন কেউই রাজী হয়নি। আলিবর্দী এ ষড়যন্ত্রের কথা পরিবারবর্গের কাছে সম্পূর্ণ গোপন রেখেছিলেন। তিন মেয়ে, তিন জামাই, এক পত্নী এবং নাবালকদের কথা বাদ দিলে একমাত্র দাদুভাই—চতুর্দশবর্ষীয় সিরাজ—কেউই কিছু জানত না! তাই বলে পাপের ষোল আনা হিস্যা কী করে বৃদ্ধের স্কন্ধে চাপাই? দু-আনা অংশ তো নিতে হবে মুস্তাফা খাঁ আর জানকীরামকে! পাপের ভাগ তো তারাও পেল।

দেওয়ান জানকীরাম রাত পোহালে হয়ে গেল ‘রাজা’ জানকীরাম। তার পুত্র দুর্লভরামকে করা হল কটকের শাসনকর্তা। আফগান সর্দার গোলাম মুস্তাফা খাঁকে দেওয়া হল নগদ অর্থ। তাছাড়া পাঁচ-হাজারী মনসবদারের পদ থেকে তাকে উন্নীত করা হল চৌদ্দ-হাজার সৈনিকের সৈনাপত্যে! কিন্তু মুস্তাফা তাতে খুশি নয়। সে দাবী করল বিহার প্রদেশের সুবেদারী। আলিবর্দী তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন—তা কেমন করে সম্ভব? সেখানে বর্তমান সুবেদার হচ্ছে জৈনুদ্দীন আহমেদ, নবাবের দামাদ (সিরাজদ্দৌলার পিতৃদেব)। তাকে তো বিনা অপরাধে পদচ্যুত করা চলে না। তাছাড়া গোলাম মোস্তাফা খাঁ চরিত্রগতভাবে যোদ্ধা, শাসক নয়—এটাই আলিবর্দীর ধারণা। ফলে, কালে হয়তো তাকে প্রধান সিপাহ সালার করা যেতে পারে, কিন্তু শাসকের দায়িত্ব দেওয়া চলে না। মুস্তাফা ক্ষুব্ধ হল। পদত্যাগ করল। আলিবর্দী বললেন, তোমার পুরস্কারের নগদ অর্থ এবং সৈন্যদলের বাকি বকেয়া মিটিয়ে নিয়ে তুমি চলে যেতে পার।[১] যে-কোন দিন আবার ফিরেও আসতে পার। আমার দুয়ার চিরকাল তোমার জন্য উন্মুক্ত।

[১. “Mustafa began to threaten him. An armed conflict in the capital seemed imminent; but Alivardi seduced some of the other Afgan captains and even a few of the lieutenants of Mustafa. The general at last resigned the Nawab’s service, and left Murshidabad with his own contingent in February 1745, on his dues being paid in full.” The History of Bengal, Vol II, Muslim Period, Edited by Sir Jadunath Sarkar, The University of Dacca, Ramna, Dacca, 1948 (3rd impression: Aug’76, P. 462).]

ন্যায়, ধর্ম, ইমান, ইনসাফের প্রসঙ্গ তুলেছিলে না তোমরা? এবার শোন : টাকা-কড়ির হিস্যা বুঝে নিয়ে মুস্তাফা খাঁ সোজা গিয়ে হাজির হল রঘুজী ভোঁসলের দরবারে। তাকে আমন্ত্রণ জানালো বাঙ্গলা লুট করতে। রঘুজী আক্রমণ করল উড়িষ্যা। কটক অধিকার করে বন্দী করল জানকীরামের পুত্র দুর্লভরামকে। আর মুস্তাফা স্বয়ং আক্রমণ করল পাটনা। আলিবর্দী ছুটে এলেন মুর্শিদাবাদ থেকে। কোনক্রমে রক্ষা পেল পাটনা। মুস্তাফা খাঁ পালিয়ে গেল চুনারের দিকে।

আটচল্লিশ সালের প্রথম দিকে শুধু বাংলা নয়, গোটা ভারতের ভাগ্যেই দেখা দিল এক অভিশাপ। দিগ্বিজয়ী নাদির শাহর উত্তরাধিকারী আহমদ শাহ্ দুরানী আক্রমণ করল পাঞ্জাব আর দিল্লী। এই সুযোগে নবাব আলিবর্দীর প্রাক্তন আফগান সর্দারেরা—গোলাম মোস্তাফা, সমশের খাঁ, সর্দার খাঁ প্রভৃতি সম্মিলিতভাবে পাটনা আক্রমণ করে বসল। রঘুজী ভোসলের কিছু মারাঠা সৈন্যও এই আক্রমণে অংশ নেয়। সিরাজদ্দৌলার পিতা সুবেদার জৈনউদ্দীন আহমেদ সম্মুখ যুদ্ধে একপক্ষকে প্রতিহত করেন। মোস্তাফা খাঁ প্রথমে হত হয়। অন্যান্য সর্দারেরা তাতে হতোদ্যম হয়ে পড়ে। জৈনুদ্দীন তখন সেই বিদ্রোহী আফগান সর্দারদের সঙ্গে সন্ধির শর্ত বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী হন। ঠিক যেভাবে ভাস্কর সন্ধি-মণ্ডপে নিহত হন, সেইভাবেই অতর্কিত আক্রমণে সন্ধির মণ্ডপে জৈনুদ্দীনের শিরশ্ছেদ করা হল। আফগান সর্দারেরা সদ্যোবিধবা আমিনা বেগম ও তার সন্তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে উন্মুক্ত শকটে পাটনা শহর পরিক্রমা করায়। জৈনুদ্দীনের পিতা, অর্থাৎ আলিবর্দীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হাজী আহমেদকে অশেষ যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করে।

ঐতিহাসিক নিখিলনাথ বলছেন :

নবাব এই সংবাদশ্রবণে হৃদয়ে এতদূর আঘাতপ্রাপ্ত হন যে, আফগানদিগের দমনে কী উপায় করিবেন কিছুই স্থির করিতে পারেন নাই। তিনি নিজের প্রাণাপেক্ষা প্রিয় জামাতা জৈনুদ্দীনের ও জ্যেষ্ঠভ্রাতার তাদৃশ শোচনীয় পরিণামে অত্যন্ত ব্যথিত হইয়া পড়িলেন। স্নেহপুতলী কন্যা, দৌহিত্র ও দৌহিত্রীদিগের নির্যাতন ও অবমাননায় নবাব স্ত্রীলোকের ন্যায় কাতর হইলেন।[১]

[১. মর্শিদাবাদ কাহিনী/নিখিলনাথ রায়/পূঃ 82।]

আমিনা-বেগমের দুই পুত্র ও এক কন্যার উল্লেখ পেয়েছি। জ্যেষ্ঠপুত্র সিরাজদ্দৌলা মায়ের কাছে পাটনায় থাকত না। নবাব ঐ আদরের দাদুভাইকে সর্বদা কাছে কাছে রাখতেন। গোলাম হুসেন সালিমের ‘রিয়াজ-উস্-সালাতিন’ পাঠে, অন্তত আবদুস সালামকৃত তার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে জেনেছি—‘নবাব সম্পূর্ণ হতোদ্যম হয়ে পড়েন। শিশুর মতো ক্রন্দন করতে থাকেন। এই সময়ে তাঁকে উজ্জীবিত করেছিলেন বেগমসারাহ্। তাঁরই প্ররোচনায় নবাব প্রতিশোধে বদ্ধপরিকর হন।’

সমস্ত প্রাসাদ যখন শোকে মুহ্যমান তখন এই পলিতকেশা বৃদ্ধা হারেম থেকে বার হয়ে এলেন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত রূপসজ্জায়। যেন মুক্তকেশী পাঞ্চালী! ঘটোৎকচ অথবা অভিমন্যু বধের পর পাণ্ডব শিবিরে নেমে আসা চরম হতাশার মুহূর্তে যেন জ্বলন্ত যাজ্ঞসেনী!

আলিবর্দী থমকে গেলেন। ধর্মপত্নীর তীব্র ভর্ৎসনায় সম্বিত ফিরে পেলেন যেন। মনে পড়ল—ঐ বৃদ্ধার পাঁজর-সর্বস্ব বুকেও তো শেলটা একইভাবে বিদ্ধ হয়েছে! তবু তো সে ভেঙে পড়েনি! উৎসাহ জোগাচ্ছে স্বামীকে, নাতিকে! ক্ষাত্রতেজে জ্বলে উঠলেন আলিবর্দী সমস্ত সেনানায়ককে একত্র করে বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধ রণহুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। সব সেনাপতি নবাবের পদতলে তরবারি রেখে আমৃত্যু সংগ্রামের জন্য প্রতিজ্ঞা করলেন। অক্ষয়কুমার এখানে লিখেছেন, “সিরাজদ্দৌলা বালক হইলেও এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় অতিমাত্র ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। পিতা ও পিতামহ উভয়েই শত্ৰুহস্তে নিহত, মাতা বন্দিনী, সিরাজদ্দৌলা নীরবে এই সকল সংবাদ সহ্য করিতে পারিলেন না। অসিহস্তে মাতামহের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সিরাজ বালক হইলেও বীর বালক। নবাব তাহাকে লইয়া যাত্রা করিলেন।”[১]

[১. সিরাজদ্দৌলা/অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়/ পৃ. 34]

অঙ্কের হিসাবে সিরাজের বয়স তখন আঠারো। কেন যে তাকে মহাপণ্ডিত বারে বারে ‘বালক’; বলেছেন জানি না। সে যাই হোক, আলিবর্দী মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করলেন সেই ‘লীপ-ইয়ার’-এর বাড়তি দিনটায় : 29.2.1748 তারিখে। ভাগলপুরের কাছাকাছি নয়া মারাঠা-নায়ক মীর হাবিবের সৈন্যদলকে পর্যুদস্ত করলেন মার্চের মাঝামাঝি। এ যুদ্ধে অসীম কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন সিরাজ। গঙ্গার দক্ষিণতীরে পাটনা শহরের ছাব্বিশ মাইল পুবে রানীসরাইয়ের ময়দানে সংযুক্ত আফগান ও মহারাষ্ট্রীয় বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করলেন ষোলই এপ্রিল। এখানেও সিরাজদ্দৌলা যুদ্ধক্ষেত্রে অপরিসীম বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তারপর ওঁরা উপনীত হলেন পাটনায়। দখল করলেন দুর্গ। ভূগর্ভস্থ অন্ধ কারাগার থেকে আমিনা-বেগম আর নাতি-নাতনিদের উদ্ধার করতে যখন ছুটে গেলেন বৃদ্ধ নবাব, তখনো তাঁর পাঁজর-ঘেঁষে হাজির ছিল আঠারো বছরের জওয়ান নাতি!

দুর্ভাগ্য সেই বাংলার শেষ নবাবের। আজও আফিংখোর বুড়ো ইতিহাস বলে চলেছে, ‘না হল তার যুদ্ধবিদ্যা শেখা, না হল তার রাজকার্য চালানোর কোনও জ্ঞানগম্যি।’

বাহাত্তুরে বুড়োর এই ‘ভীমরথী’র কথাটা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছে ইতিহাস। কিন্তু সেই মিলিত আফগান-মারাঠা শক্তির বিরুদ্ধে নাতি-দাদুর অবিশ্বাস্য যুদ্ধজয়ের নেপথ্যে এক বাষট্টি বছরের বুড়ি দিদার নথ-নাড়া আর মুখঝামটার অনুপানটুকুর কথা ইতিহাস লিখে রাখতে ভুলেছে। আফিংখোর বুড়ো ইতিহাসেরও ঐ এক চিরকেলে ভীমরথী! যার যা পাওনা তা ন্যায্য হিস্যায় ভাগ-বাটোয়ারা করতে তার ভুল হয়ে যায় : কত নারী দিল মাথার সিঁদুর লেখা নাই ইতিহাসে।

সিরাজের কুকীর্তির কথা আর কী বলব? বেহুদ্দো এ কেতাবের কলেবর কয়েক ফর্মা বৃদ্ধি পেয়ে যাবে। কী দরকার? সে-সব তো তোমরা জানই :

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঔদ্ধত্য-লাম্পট্য-কাণ্ডজ্ঞানের অভাব যেন আরো বেড়ে যেতে লাগল। বুনো স্বভাব যেন আরও বন্য হতে চলল। না হল তাঁর যুদ্ধবিদ্যা শেখা, না হল তাঁর রাজকার্য চালানোর কোনো জ্ঞানগম্যি। এক কাব্যকাহিনী ছাড়া আর কিছুতে তো সিরাজদ্দৌলাকে কোনক্রমে শহীদ বানাতে পারা যাচ্ছে না। কী হিন্দু, কী মুসলমান, কী ইংরেজ, কী ফ্রেঞ্চ, কী ডাচ্ একজনও কেউ তাঁকে একটা ভালো সার্টিফিকেট দিয়ে যাননি।[২]

[২. পলাশীর যুদ্ধ/তপনমোহন চট্টোপাধ্যায় / চতুর্থ মুদ্রণ/পূঃ 103.]

এরপর আমাদের সমকালীন লেখক দুটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন কাশিমবাজার ফরাসি-কুঠির অধ্যক্ষ জাঁ ল-সাহেবের স্মৃতিচারণ থেকে। প্রথমটায় এক নবাবী-খেলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে :

বর্ষাকালে যখন ভাগীরথী জলে-জলে টৈটুম্বুর হয়ে দুকূল উপছে পড়ছে তখন সিরাজদৌল্লা তাঁর অনুচরদের মারফত কৌশলে যাত্রীদের খেয়াপারের নৌকাগুলিকে উল্টিয়ে দিয়ে মজা দেখতেন। যাত্রীরা যখন প্রাণের দায়ে চীৎকার করত আর তারপর নিরুপায় হয়ে হাত-পা ছুঁড়ে এক-এক করে জলে ডুবে মরত তখন তাই দেখে সিরাজদৌল্লা আমোদ পেতেন।[১]

ফরাসী লেখকের স্মৃতিচারণ অবলম্বনে তপনমোহন আরও জানিয়েছেন,

কোন সুন্দরী হিন্দু-স্ত্রীলোক গঙ্গাস্নানে নেমেছেন দেখলেই সিরাজদৌল্লার চরেরা তখুনি গিয়ে তাঁকে সেই সংবাদ জানাত। তারপর সেই স্ত্রীলোক একেবারে নিখোঁজ। তাঁর আত্মীয়- স্বজনেরা কেউ আর কস্মিনকালেও তার সন্ধান পেতেন না।[২]

[১. ও ২. ঐ। মূল তথ্য: Memoire sur I’ Empire Mogul, by Jean Law, ed. by Martineau (Paris, 1913).]  

স্বীকার্য, মস্যুয়ে জাঁ ল ইংরাজের বিপক্ষদলের লোক। কিন্তু তাঁর প্রত্যক্ষ জ্ঞান কাশিমবাজারে বসে হওয়া সম্ভবপর নয়। তথ্য সংগ্রহ করেছেন কোন সূত্র থেকে? নবাবের পক্ষে তখন কেউ নেই। পরেও নেই। এইসব জনশ্রুতির অন্য কোনও সূত্র থেকে সমর্থনও নেই। সিরাজ যে বয়ঃসন্ধি কাল থেকেই দাদুর অতি আদরে অতিরিক্ত মদ্যপান ও নারীসঙ্গ করত এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। হিন্দু রাজা-রাজড়া এবং মুসলমান আমীর ওমরাহরা নিজ নিজ নানান স্বার্থে সিরাজকে সরিয়ে অন্য কোনও উত্তরাধিকারীকে আলিবর্দীর পর গদীতে বসাতে চেয়েছিলেন। পুত্র-সন্তানহীন নবাবের জ্যেষ্ঠ দৌহিত্রই যে গদীর হকদার এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। ফলে সকলেই উঠে পড়ে লেগেছিলেন সিরাজের দুর্নাম রটাতে। যাতে সবাই সিরাজের সিংহাসন লাভে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সিরাজ নিজেই মদ্যপ ও দুশ্চরিত্র; ফলে তার কাম-বিকারের চিত্রগুলি আরও বীভৎস করে পরিবেশিত হতে থাকে। শোনা যেতে থাকে, সিরাজের এক বিলাস—গর্ভিণী নারীর নিম্নোদর বিদীর্ণ করে সন্তানদের বার করে দেখা![৩] শোনা গেল, রানী ভবানীর বিধবা কন্যা তারা দেবীকে বজরার ছাদ থেকে দেখতে পেয়ে সিরাজ না কি ক্ষেপে ওঠেন। পাইক পাঠিয়ে তারাহরণের প্রচেষ্টা করেন! জগৎ শেঠের এক কুলবধূকে একবার স্বচক্ষে দেখবার জন্যও নাকি সিরাজ ক্ষেপে ওঠেন!

[৩. ‘সিরাজদ্দৌলার সমসাময়িক ইংরাজ এবং মুসলমান ইতিহাস লেখকগণ তাঁহার জীবনকালে যে-সকল ইতিহাস লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তাহার মধ্যে তাঁহার অনেক কুকীর্তির উল্লেখ আছে; কিন্তু গর্ভবিদারণ, নৌকাসহিত ভাগীরথীগর্ভে নরনারী-নিমজ্জন প্রভৃতি অদ্ভুত অত্যাচারের কোনও উল্লেখ নাই! বলাবাহুল্য যে, ইহার অধিকাংশ‍ই নিছক রটনা।’—সিরাজদ্দৌলা/অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়/পূঃ 59.]

যুবরাজ সিরাজ মদ্যপ, ইন্দ্রিয়াসক্ত—একশ বার! কিন্তু নবাব সিরাজ?

একটা কথা বলিয়া রাখি, বাঙ্গলার ইতিহাসে সিংহাসনে আরোহণের পরেও সিরাজকে যে ঘোরতর মদ্যপায়ী বলিয়া বর্ণনা করা হয়, ইহা সম্পূর্ণ অমূলক। যৌবনারম্ভে সিরাজ মদ্যপান করিতেন বটে কিন্তু আলিবর্দী মৃত্যুশয্যায় সিরাজকে কোরান স্পর্শ করাইয়া ভবিষ্যতে মদ্যপান না করিতে প্রতিজ্ঞা করাইয়াছিলেন এবং সিরাজ যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন মাতামহের সেই হিতকর অনুরোধ রক্ষা করিতে ত্রুটি করেন নাই।[১] তাই অবাক হয়ে যাই যখন 1953 সালে প্রকাশিত ‘পলাশীর যুদ্ধ’ গ্রন্থে তপনমোহন বললেন, তিনি নবাব সিরাজের স্বপক্ষে কারও কোনও সার্টিফিকেট খুঁজে পাননি, নবীন সেনের কবিতা ব্যতিরেকে।

[১. মুর্শিদাবাদ কাহিনী/নিখিলনাথ রায়/পৃঃ 115.]

নিখিলনাথ হিন্দু এবং তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীতে রচনা করেছেন মুর্শিদাবাদ কাহিনী। কিন্তু তথ্যসূত্রের ইঙ্গিতও তো তিনি দিয়ে গেছেন :

I have before mentional Siraj Dowla, as giving to hard-drinking; but Allyverde, in his last illness, foreseeing the ill consequences of his excess, obliged him to swear on the Koran, never more to touch any intoxicating liquor; which he ever after strictly observed (“An Enquiry into our National Conduct to Other Countries”, Chap II, p.. 32)

লেখক ইংরাজ ঐতিহাসিক। পাছে নিখিলনাথকে ঐতিহাসিকেরা অবিশ্বাস করেন, তাই সক্ষেদে তিনি গত শতাব্দীতে লিখেছিলেন :

“ইহা একজন ইংরেজের কথা, দেশীয়ের নহে।”

হায় নবাব সিরাজ! আজও তোমার বরাতে একটা ‘গুড-কন্ডাক্টের’ সার্টিফিকেট জোগাড় হল না ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে।

তবে হ্যাঁ, সিরাজের একটি বিশেষ অপকীর্তির কথা আলোচনা না করে প্রসঙ্গান্তরে যেতে পারছিনা। একটি অসমাপ্ত হত্যা-মামলার তদন্ত!

ইতিহাস কী-ভাবে পাঠককে বিভ্রান্ত করতে পারে এটি তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইতিহাস যাঁরা লেখেন তাঁরা যদি রচনার পূর্বকাল থেকেই একটি বদ্ধ-ধারণার বশবর্তী হয়ে কলম নিয়ে বসেন তাহলে সেটা হয়ে পড়ে আরও বিড়ম্বনার।

সিরাজের এই অপকীর্তিটার বিবরণ তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের জবানীতেই শোনাই :

সম্ভ্রান্ত লোকেরা সিরাজের নাম শুনলেই আতঙ্কে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। কার যে কখন তাঁর হাতে মাথা কাটা যায় এই ভয়ে তাঁদের কারো রাত্রে ঘুম হয় না। একদিন প্রকাশ্য রাজপথেই হোসেন কুলী খাঁ বলে একজন আমীর লোককে সিরাজউদ্দৌলা খুন করলেন। হোসেন কুলী খাঁর সঙ্গে তাঁর বড় মাসী ঘসেটী বেগমের গুপ্ত-প্রণয় ছিল ব’লে লোকে সন্দেহ করত। ঘসেটী বেগমের এ-বিষয়ে বড়ই দুর্নাম। আত্মীয়-স্বজনের কাছে সিরাজ তাই দোহাই পাড়লেন। দেখা যায় যে-দোষটা নিজের খুব বেশী, সে দোষটা অপরের চরিত্রে দেখলে লোকে আর সেটাকে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আসলে অন্য একটা কারণ ছিল। সকলের কাছে হোসেন কুলী খাঁর প্রতিপত্তি দিন দিন যেরকম বেড়ে উঠছিল তাতে সিরাজউদ্দৌলার মনে তাঁর সম্বন্ধে খুবই ভয় ঢুকে গিয়েছিল। আর বেশি বেড়ে ওঠবার আগেই তাঁকে এ-জগৎ থেকে সরিয়ে দেওয়াটা সিরাজউদ্দৌলা অনেক আগে থেকেই স্থির করেছিলেন। তাই প্রকাশ্যে সাফাই গেয়ে বলে বেড়ালেন হোসেন কুলী খাঁ-ই তাঁকে খুন করবার জন্য সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছেন।[১]

[১. পলাশীর যুদ্ধ/তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়/চতুর্থ মুদ্রণ/পৃ: 105]

দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিলাম, 1953 সালে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থটি থেকে, শুধু দেখাতে যে, আমরা কী-ভাবে পণ্ডিতদের দ্বারা বিভ্রান্ত হই! এ গ্রন্থ প্রকাশের পঞ্চাশ বছর আগে নিখিলনাথ যে অরণ্যরোদন করেছেন তা ব্যর্থ:

ঐতিহাসিকেরা একটি ঘটনার জন্য সিরাজকে যৎপরোনাস্তি নিন্দা করিয়া থাকেন। কিন্তু তাহার কারণটি জানিতে পারিলে কেহই সিরাজকে তজ্জন্য বিশেষরূপে দায়ী করিবেন না বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। ঐতিহাসিকগণ… মনের আবেগে সিরাজকে নিন্দা করিয়া গিয়াছেন, কিন্তু তাহার মূল অনুসন্ধান করিয়া দেখেন নাই। … কারণটি সেই নৃশংস হত্যা অপেক্ষা কোন অংশে অল্প গুরুতর নহে। আলিবর্দী খাঁ ও তাঁহার বেগমের ন্যায় মহিলা যে-সংসারের কর্তা ও কর্ত্রীস্বরূপ ছিলেন, দুঃখের বিষয়, সেই সংসারে ব্যভিচার ও পাপ প্রবেশ করিয়া, তাঁহাদের হৃদয়ে সর্বদা সহস্র বৃশ্চিকদংশনের যন্ত্রণা প্রদান করিত। লিতে দুঃখ ও লজ্জা বোধ হয় যে, আলিবর্দী খাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা ঘসেটী ও কনিষ্ঠা কন্যা আমিনা উভয়েই আপনাদিগের পবিত্র চরিত্র রক্ষা করিতে পারেন নাই। ঘসেটি অনেকদিন হইতে পাপপথে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। জৈনুদ্দীনের (সিরাজের পিতা) মৃত্যুর পর তাঁহার স্ত্রী আমিনাও ভগিনীর পথের অনুসরণ করেন। এই আমিনাই সিরাজের মাতা। দুই ভগিনীই হোসেনকুলী খাঁর প্রণয়ভাগিনী হইয়া উঠেন। …কিন্তু…আমিনা স্বামীর মৃত্যুর পর মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হইলে হোসেনকুলী খাঁ তাহার সহিত গুপ্তপ্রণয় স্থাপন করেন। …কন্যাগণের কুপথগমনের কথা জ্ঞাত হওয়া অবধি নবাব-বেগম তাহা নিবারণের জন্য অশেষরূপে চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। ক্রমে যখন তাঁহাদের গুপ্তপ্রণয় কথা লইয়া সমস্ত মুর্শিদাবাদে আন্দোলন উপস্থিত হইল, তখন নবাব-বেগম আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। বিশেষতঃ তাঁহার কনিষ্ঠা কন্যা পূর্বে সচ্চরিত্রা থাকিয়া এক্ষণে অধঃপাতের দিকে যাইতেছে দেখিয়া এবং হোসেনকুলী খাঁকেই সেই অধঃপতনের কারণ জানিয়া তিনি তাহার প্রতিবিধানে যত্নবতী হইলেন। সিরাজ স্বীয় জননীর কলঙ্কের কথা শুনিয়া…[২]

[২. মুর্শিদাবাদ কাহিনী/নিখিলনাথ রায় / পৃ: 84]

কী বলবেন এরপর?

সমকালীন ইংরাজ ও মুসলমান ঐতিহাসিকদের মানসিকতা প্রণিধানযোগ্য। একটা দেশে বাণিজ্য করতে এসে শাসনদণ্ড ছিনিয়ে নিতে হলে এছাড়া উপায় কী? ন্যায্যশাসককে বঞ্চিত করতে যদি তার সেনাপতিকে ঘুষ খাওয়াতে হয়, তখন ইতিহাসে লেখার প্রয়োজন হয় : -‘গিলি-গিলি হোকাস-পোকাস!’ সমকালীন হিন্দু-মুসলমান রাজা-রাজড়া এবং আমর-ওমরাহরাও তাঁদের বিশ্বাসঘাতকতার কৈফিয়ৎ হিসাবে—দেশী শাসককে পিছন থেকে ছুরি মেরে বিদেশীকে ডেকে আনার যৌক্তিকতা হিসাবে—সিরাজ চরিত্র নানাভাবে কলঙ্কিত করেছেন। এটুকু সহজেই বোধগম্য। কিন্তু বিংশশতাব্দীর ইতিহাস লেখকের এমন মানসিকতা হল কেন? বিশ্বাস করা কঠিন যে, তপনমোহনবাবু ‘পলাশীর যুদ্ধ’ রচনার পূর্বে নিখিলনাথের ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ পড়েননি। এ যেন ‘গিবন’ না পড়ে রোম-সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন সম্বন্ধে একখানা নয়া-কেতাব লেখার প্রচেষ্টা। বেশ, না-হয় তর্কের খাতিরে তাও ধরে নেওয়া গেল। কিন্তু তপনমোহন তো ক্রমাগত ‘মুতাক্ষরীন’-গ্রন্থের ইংরাজি অনুবাদ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এই তথ্যটি সেই ইংরাজি অনুবাদেও[১] তো বিস্তারিতভাবে বর্ণিত! তাহলে?

[১. Mutaqherin, Vol. I., p. 647.]

তবু তপনমোহন বুঝে উঠতে পারেন না- কেন সিরাজ বলে বেড়ালো যে, হোসেনকুলী খাঁই তাকে খুন করতে চায়! তা না বলে হতভাগ্য সিরাজ কী বলে বেড়াবে—”ওগো, তোমরা ভুল শুনেছ! শোন, বুঝিয়ে বলি! বড়মাসী নয়। হোসেনকুলী ছিল আমার বিধবা মায়ের গুপ্তপ্রণয়ী। তাই দিদার হুকুমে…”

আচ্ছা, আবার না হয় ধরে নিই—মুতাক্ষরিনের প্রথমখণ্ডের ঐ 647 নম্বর পৃষ্ঠাটি তপনমোহনের নজর এড়িয়ে গেছে; কিন্তু সেই বাইশ বছরের বাইশ-সেরী ওজনের বাঈজীর ঐতিহাসিক উক্তিটা? সমকালীন ভারতের সে নাকি ছিল শ্রেষ্ঠা সুন্দরী। সেটা শোনা কথা কিন্তু সে যে সবচেয়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর রেকর্ড করে গেল। আর সবচেয়ে বড় কথা : মৃত্যুমুহূর্তে তার মুখের পেশীতে কোথাও কুঞ্চনরেখা দেখা যায়নি!

নারীর প্রেম যে বাজারের পণ্য নয়, তার দেহটাই কেনা-বেচা করা যায়, এই তত্ত্বটার একটা জ্বলন্ত প্রমাণ রেখে মৃত্যুঞ্জয়ী হল মেয়েটি। তার মৃত্যুমুহূর্তে কেউ উপস্থিত ছিল না, কোন সাক্ষী নেই। সে ছিল পালঙ্কে শুয়ে। পায়ের কাছে জড়ো করা ছিল স্তূপাকার জরোয়া গহনা। আমার তো মনে হয় মৃত্যুমুহূর্তে এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবার আগে সে শেষ কথা যেটা বলে গেছে আপনমনেই, তাঃ আমি মৃত্যু চেয়ে বড়!

সেই ফৈজী ফয়জান-এর বিস্মরণের-অতীত ঐতিহাসিক—উভয় অর্থেই ঐতিহাসিক—উক্তিটা ইতিহাস ঘেঁটে জেনে নেবার সৌভাগ্যও কি হয়নি তপনমোহনের?

ফৈজী ফয়জান ছিল দিল্লীর নটী। অতি বিখ্যাত নর্তকী। রূপের খ্যাতিই বেশি। “মুর্শিদাবাদে এইরূপ প্রবাদ প্রচলিত ছিল যে, তৎকালে ফৈজীর ন্যায় সুন্দরী সমগ্র ভারতবর্ষ দ্বিতীয় কেহই ছিল না।” তার ওজন মাত্র বাইশ সের। সিরাজ এই অদ্বিতীয়া রূপবতীর কথা শুনে মোহিত হয়ে যায়। তখন সে নবাবজাদা। এক লক্ষ মুদ্রা ব্যয়ে ফৈজী বাইজীকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসে। হারেমজাত করে।

অর্থমূলে কেনা সখের ঠুনকো জিনিস। মালিকানা ক্রেতার। হক্কের ধন। কিন্তু ঐ যে এক বেয়াড়া দেবতা আছেন না, যাঁকে ভস্ম করেও পরে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন মহাদেব, তিনি এসব সহজ হিসাব মানতে নারাজ। মুর্শিদাবাদে এসে ফৈজী প্রেমে পড়ল এক আশ্চর্য যুবকের—বলিষ্ঠ, সুগঠিততনু, অপূর্ব সুন্দর তার রূপ : সৈয়দ মহম্মদ খাঁ। লোকটা সিরাজের ভগ্নিপতী। অন্তঃপুরে তার অবাধ যাতায়াত।

সিরাজের গুপ্তচর সর্বত্র। খবর পেল। বিশ্বাস হল না। তবে তক্কে তক্কে থাকল। তারপর একদিন হাতেনাতে ধরে ফেলল দুজনকে। সৈয়দ মহম্মদ পালিয়ে বাঁচে। সিরাজ তার পশ্চাদ্ধাবন করল না। নিজের ভগিনীপতি! তাকে তো আর কোল করা যাবে না! সমস্ত আক্রোশটা গিয়ে পড়ল ঐ কসবির উপর। তরবারি কোষমুক্ত করে সিরাজ চাপাগলা হিস্হিসিয়ে ওঠেঃ ওরা তাহলে ঠিকই বলে! বেশ্যা কোথাকার!

খোলা তলোয়ারের সামনে দাঁড়িয়েও মেয়েটি ভয় পেল না! মাথা খাড়া রেখেই বললে, সে কী নবাবজাদা! লাখটাকা দিয়ে রণ্ডিবাজার থেকে যখন আমাকে কিনে এনেছিলেন তখন ও কথাটা জানতেন না? ও-গালাগালে আমার সরম হবে কেন? কথাটা বরং আপনার মাকে বলে দেখবেন—সত্যি হলেও দেখবেন, তিনি তা সইতে পারবেন না!

সিরাজ বজ্রাহত হয়ে গেল! ধীরে ধীরে কোষবদ্ধ করল তরবারি। তাহলে সেদিন দিদা যেকথা বলেছিল তা তো মিথ্যা নয়! গোটা মুর্শিদাবাদ এ-কথা জানে!

ধীরপদে গৃহত্যাগ করল সিরাজ। কোন আঘাত না করে। পরেও কেউ ঐ সিরাজ-জননীর লাঞ্ছনাকারিণীকে স্পর্শ করেনি। শুধু সিরাজের আদেশে মীর মুন্সি এসে সেই ঘরের জানলা-দরজাগুলি পাকা ইটের গাঁথনিতে বন্ধ করে দিয়ে গেল। ফৈজী টু শব্দটি করেনি। দু চোখ মেলে দেখেছে রাজমিস্ত্রি আর মজুরদের গাঁথনির কাজ! কথা বলেনি, কিন্তু একে-একে তার গা থেকে খুলে ফেলেছিল বহুমূল্য হীরে-জহরৎ-বসানো অলঙ্কার। ভয়ে কণ্ঠ রোধ হয়ে এল মীর-মুন্সির। এ আচরণের তো একটাই অর্থ! ঐ বহুমূল্য অলঙ্কারগুলি হস্তান্তর করে মেয়েটি প্রাণ- ভিক্ষা চাইবে—কিন্তু কার কাছে? মীর মুন্সি, প্রহরী না নবাবজাদা!

আশ্চর্য! কারও কাছেই সে প্রাণ-ভিক্ষা চাইল না। শুধু শেষ ইটখানা বসিয়ে যখন কনিক দিয়ে ঠুকতে গেল—ভুলও হতে পারে—মীর মুন্সির মনে হয়েছিল ঐ বাইশ বছরের মেয়েটির কণ্ঠ থেকে অস্ফুটে উচ্চারিত হয়েছিল একটি মাত্র শব্দ : আল্লাহ্!

অনেক-অনেকদিন পরে প্রাচীর ভেঙে সে গৃহে প্রবেশ করেছিল রাজপ্রহরী। দেখে, পালঙ্কে শায়িত অবস্থায় এক নারীর কঙ্কাল! তার পায়ের কাছে স্তূপাকার করে রাখা আছে মণি-মাণিক্যে গাঁথা নানান অলঙ্কার—নবাবজাদার প্রণয়োপহার! মৃত্যুপথযাত্রিণী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত! ফৈজী ফয়জানের ধিক্কার কেন ‘ঐতিহাসিক’, জান? এ তিরস্কার ফৈজী করেনি নবাবজাদাকে! বিশ্ববারাঙ্গনার তরফে পুরুষশাসিত মনুষ্যসমাজের বিরুদ্ধে এ ধিক্কার! জান দিয়ে ফৈজী ফয়জান বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল; নারীর প্রেম অর্থমূল্যে কেনাবেচার বেসাতি নয়!

নবীন সেন থেকে শচীন সেনগুপ্ত কেউই দাবী করেননি যে, সিরাজউদ্দৌলা ছিল ধোওয়া তুলসী পাতাটি! কিন্তু ‘ডেভিল’কে কেন বঞ্চিত করা হচ্ছে তার ‘ডিউ’ থেকে? দাদুর মৃত্যুর আগে আর পরে সিরাজ যে ভিন্ন চরিত্র এটা ইতিহাস আর কবে মেনে নেবে? জাঁ ভালজাঁ লোকটা তো সেই জন্যই ‘মিজারেল্’! কারণ দুনিয়া মেনে নিতে পারেনি যে, বিশপের বাতিদান চুরি করার আগে আর পরের মানুষ দুটো ভিন্ন ব্যক্তি!

পলাশীর যুদ্ধের পর দু শ’ বছর তো কেটে গেছে। বিজয়ী লর্ড ক্লাইভ আত্মহত্যা করে মুক্তি পেল, ‘ইম্পিড্’ হল ওয়ারেন হেস্টিংস. মীরজাফর দীর্ঘদিন যন্ত্রণাদায়ক কুষ্ঠরোগে ভুগে প্রাণ দিল আত্মীয়-বন্ধুদের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে। ব্যভিচারিণী ঘসেটী-আমিনা দু-বোনের হল যৌথ সলিল-সমাধি! মীরন মরল বজ্রাঘাতে। সকলের সব পাপের তামাম শুদ্! মায় জেতা-সাম্রাজ্যটা ‘কুইট’ করে ইংরেজ এই তো সেদিন ফিরে গেছে তাদের নিজের দেশে। বাকি আছে একমাত্র ঐ : লা মিজারেবল্।

এখনো পণ্ডিতেরা তাকে কবর থেকে টেনে তুলে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বলেন : সবুর কর! তোমার বিচারটা বাকি আছে হে! হোসেনকুলী হত্যা মামলা!

এখনো ঐতিহাসিকেরা মেনে নিতে পারেননি অক্ষয়ুকমার মৈত্রেয়র গবেষণাগ্রন্থের একেবারে শেষ পংক্তিটি :

“Sherajaddaulah was more unfortunate than wicked!”

.

বড় অভাগা ঐ দিদাও–বেগম শরফ উন্নিসা!

না. দ্রুপদনন্দিনী যাজ্ঞসেনীর মতো নাথবতী অনাথবৎ নয় সে; পাঁচ-ভাতারি আতান্তরিতে ভুগতে হয়নি তাকে। ওদিকে প্রজাপালনের অজুহাতে একমাত্র বেগমকে বনে পাঠারে এমন খসম্-এর ঘরও করতে হয়নি তাকে। তবে শেষ জীবনে নানা দিক থেকে মৃত্যু এসে তছনছ করে দিল তার সোনার সংসার। তৃতীয়বার কন্যাসন্তান জন্মানোর পর ওর জোয়ান খসমকে বলেছিল, ‘আমার নসিবে নেই গা, তুমি আর একটা নিকে কর!’ ওর স্বামী কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল; বলেছিল, ‘ছাওয়াল নিয়ে কী করব গো? মসনদ কাকে দিয়ে যাব সে চিন্তা তো নেই! দিন আনি দিন খাই—মেয়েরাই বুড়ো বয়সে দেখভাল করবে।’

তখন ওর স্বামী, মীর্জা মহম্মদ আলী দিল্লী থেকে বাঙলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর কাছে চাকুরির সন্ধানে এসে সদ্য প্রত্যাখ্যাত হয়ে কটকে গিয়ে যাহোক একটা নোকরি জুটিয়ে নিয়েছে। সঙ্গে তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা হাজী আহমদ। সেখানে সে নায়েব সুবার দরবারে পারিষদ আর কিছুদিন পরে একটি জেলার ফৌজদার হয়। তার পরেই কিসমতের খেল হল শুরু। দুই ভাইয়ের বুদ্ধিতে মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর সুজাউদ্দীন উঠে বসলেন বাঙলার মসনদে। নবাব সুজাউদ্দীন খুশি হয়ে মীর্জা মহম্মদ আলীকে আলিবর্দী’ উপাধি দিয়ে রাজমহলের ফৌজদার করে দেন। সুজাউদ্দীনের মৃত্যুর পরে সরফরাজ খাঁ মসনদে বসলে, দুইভাই বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। 1740 সালে গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজকে হারিয়ে বাঙলার গদীতে উঠে বসেন শরফ উন্‌নিসার খসম একটা জবরদস্ত উপাধি নিয়ে : ‘সুজা-উল-মুলক-হেসামুদ্দৌলা মহব্বৎ জঙ বাহাদুর’।

তখনো কিন্তু শরফ-উন্নিসা তার খসমকে রাজী করাতে পারেনি। তখন অবশ্য আলিবর্দীর বয়স চৌষট্টি, বেগম-সাহেবার চুয়ান্ন। আলিবর্দী বলেছিলেন, চিন্তার কী আছে? দাদুভাই তো সে সমস্যার সমাধান করেই রেখেছে!

আলিবর্দী যখন মসনদে বসেন, তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ দৌহিত্রের বয়স দশ।

তিন মেয়েরই ততদিনে বিয়ে হয়ে গেছে ওঁর ভাসুরের তিন ছেলের সাথে।

বেগম সাহেবা সর্বক্ষণ তাঁর স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও! হয়তো সম্মুখ যুদ্ধে নয়, কিন্তু সমরক্ষেত্রের অদূরে মূল-শিবিরে অপেক্ষা করতেন, যাতে দিনান্তে স্বামীসেবা থেকে একটি দিনও বঞ্চিত না হতে হয়।

একবার এক কাণ্ড হল। বর্গীদের সঙ্গে নবাবের লড়াই চলছে। বর্গীনায়ক খবর পেল স্বয়ং বেগম-সাহেবা মাইল দশেক দূরে নবাবের মূল-শিবিরে অবস্থান করছেন। ওরা বুদ্ধি খাটালো—কোনক্রমে যদি বেগম-সাহেবাকে বন্দিনী করা যায় তাহলে নবাবকে কব্জা করা যাবে। বর্গীনায়ক একদল দক্ষ সেনা নিয়ে রণস্থল এড়িয়ে এগিয়ে চলল নবাবের অস্থায়ী ছাউনির দিকে। বর্গী নায়কের এই উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলেন নবাবের একজন সেনানায়ক, ওমর খাঁ। তিনি তরিৎগতি তাঁর পুত্রকে পাঠিয়ে দিলেন বেগম সাহেবাকে স্থানান্তরিত করতে। সৌভাগ্যক্রমে বেগমের হেপাজতে ছিল একটি প্রকাণ্ড রণহস্তী—‘লণ্ডা’ তার নাম। বেগম একাকী পলায়ন করতে অস্বীকৃতা হলেন। তখন ওমর খাঁর পুত্র মোসাহেব খাঁ বেগম সাহেবাকে হাওদায় উঠিয়ে স্বয়ং হস্তী পরিচালিত করে ঐ প্রকাণ্ড রণহস্তীর মারফতেই মারাঠা অশ্বারোহীদলকে পর্যুদস্ত করেন।[১]

[১. রিয়াজ-উস্-সালাতিন, পৃ: 339.]

নবাব আলিবর্দী খাঁর রাজত্বের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা এইরূপে নবাব-বেগমের সহিত গাঢ়ভাবে বিজড়িত রহিয়াছে। পত্নীর এই অসাধারণ প্রতিভার জন্য আলিবর্দী খাঁ রাজধানী হইতে তাঁহার অনুপস্থিতি কালে অনেক সময়ে বেগমের প্রতি রাজকার্যের দায়িত্ব প্রদান করিতেন। তজ্জন্য তিনি বাদশাহ-দরবার হইতে বিশেষ আদেশ লইয়াছিলেন।[২]

[২. মুর্শিদাবাদ কাহিনী/নিখিলনাথ রায়/গৃ: 85.]

আলিবর্দীর মৃত্যুসময় বেগম সাহেবার বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি। তার পূর্বেই তাঁর তিন কন্যা বিধবা হয়েছে। বড় মেয়ে ঘসেটী-বেগমের নিজের কোন সন্তান ছিল না। সিরাজের ছোট ভাই আক্রামউল্লাকে তিনি পুষ্যি নিয়েছিলেন। আলিবর্দীর পর ঐ আক্রামকে শিখণ্ডী করে পর্দানশীন অবস্থায় বাঙলা শাসনের স্বপ্ন দেখছিলেন ঘসেটী। দুর্ভাগ্যক্রমে আক্রাম বসন্ত-রোগে বেমক্কা মারা গেল। তার শোকে কিছু দিনের মধ্যেই ঘসেটীর স্বামী নোয়াজিশ খাঁও মারা গেলেন; তাব দু-মাস যেতে না যেতে মেজো মেয়ে হল বিধবা। বছর না ঘুরতে বেগম-সাহেবা নিজেই বিধবা হয়ে গেলেন।

চৌদ্দমাস নবাবী করে সিরাজ ফৌত হল পলাশী-প্রান্তরে যৌথ বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে। নিখিলনাথ সক্ষেদে লিখছেন—

যে বেগমের পরামর্শে নবাব আলিবর্দী খাঁ সমস্ত রাজনৈতিক কার্য সম্পন্ন করিতেন এবং যাঁহার পরামর্শবলে নবাব আলিবর্দী খাঁর আদর্শ-শাসনে বঙ্গের প্রজাগণ বিঘ্নরাশির মধ্যেও শক্তিলাভ করিতে সমর্থ হইয়াছিল, যে অতুলনীয় রমণীরত্নকে দেশীয় ও বিদেশীগণ মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করিতেন, তাঁহারই অগ্নে ও সংসারে প্রতিপালিত হইয়া মীরজাফরের পুত্র ‘ছোট-নবাব’ মীরন তাঁহার প্রতি যেরূপ অত্যাচার করিয়াছিলেন, তাহা স্মরণ করিতে গেলে, দুঃখে ও ঘৃণায় হৃদয় অভিভূত হইয়া পড়ে। আলিবর্দীর বেগম ও তাঁহার কন্যাদ্বয় ঘসেটী ও আমিনা এবং সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে অযথা কষ্ট প্রদান করিয়া বন্দীভাবে রাখা হয়। বন্দী অবস্থায় তাঁহারা চূড়ান্ত যন্ত্রণা ভোগ করিলে, তাঁহাদিগকে মুর্শিদাবাদ হইতে ঢাকায় নির্বাসিত করা হইল।[১]

[১. মুর্শিদাবাদ কাহিনী/নিখিলনাথ রায়/পৃ: 87.]

ঢাকায় তাঁদের অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় বাস করতে হয়েছিল। মীরন ঐ সময় ঢাকার নায়েব যেশারৎ খাঁকে নির্দেশ পাঠায় ঐ মহিলাবৃন্দকে গোপনে হত, করতে। যেশারৎ এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে স্বীকৃত না হওয়ায় মীরন তার একজন বিশ্বস্থ প্রিয়পাত্রকে মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। তারই বন্দোবস্তে ঘসেটী আর আমিনা বেগমকে নৌকা থেকে নদীতে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়। নবাব আলিবর্দীর বেগম ও সকন্যা নবাব সিরাজের বেগম নিতান্ত ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়ে যান।[২]

[২. Holwell’s India Tracts, pp-40-42, as also Vansittart’s Narrative, Vol. I., p. 153.]

পরে দুই জমানার দুই ফার্স্ট-লেডি ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে ফিরে আসার সৌজন্যলাভ করেন লর্ড ক্লাইভের হস্তক্ষেপের ফলে।[৩]

[৩. ‘Sharaf-un-nisa and Lutf-un-nisa, and the latter’s young daughter escaped the violent watery grave which ended the sorrows of Ghasiti and Amina. They were released through the exertions of Lord Clive, the Governor of Bengal and came back to Murshidabad.” Begams of Bengal, Brajendranath Banerji, pp. 36.]

একটি সূত্রে দেখছি 1765 সালেও শরফ-উন্নিসা জীবিত ছিলেন। তাহলে তাঁর বয়স তখন ঊন-আশি। আর কোনও খবর পাইনি। বছর দশেক আগে শিল্পী ইন্দ্রদুগার, শিল্পী রথীন মৈত্র এবং শিল্পরসিক দ্বিজেন্দ্র মৈত্রের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলাম। নবাব আলিবর্দীর সমাধির নিচের দিকে একটি সমাধি দেখিয়ে স্থানীয় রক্ষক বলেছিল সেটি আলিবর্দী-মহিষীর কবর। উর্দু-হরফে কী লেখা ছিল পড়তে পারিনি, তবে তথ্যটা মেনে নিতে অসুবিধা হয়নি। এমন সতীসাধ্বীর ঠাঁই আর কোথায় হতে পারে? তার একটি স্কেচও করে এনেছিলাম মনে আছে।

এ বিশাল উপন্যাসটি যে কয়েকটি পর্বে বিভক্ত করেছি তার পৃথক পৃথক নামকরণও করা গেছে। বর্তমান পর্বের নাম : ‘সতী”। সে প্রসঙ্গে তো এখনো আসা হয়নি। মুর্শিদাবাদ ছেড়ে এবার আমাদের ত্রিবেণী যাবার সময় হয়েছে, তাই মুর্শিদাবাদের ‘সতী’-র কাহিনীটা। এবার সেরে নেওয়া উচিত।

ঋষি গৌতম সত্যকামকে বলেছিলেন, ‘তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত।’ পাণ্ডবাজ মহাবীর কর্ণও বলেছিলেন মানুষের জন্ম দৈবায়ত্ত, শুধু কর্মেই তার অধিকার। আমরা মুর্শিদাবাদের যে মহিমময়ীর কথা এবার আলোচনা করব সে সেই অর্থেই : ‘সতী’!

তার পিতৃপরিচয় নেই, হয়তো পতিতালয়েই তার জন্ম; মৃত স্বামীর মাথা কোলে নিয়ে জীবন্তে অগ্নিশুদ্ধও হয়নি মেয়েটি। তার সম্বন্ধে নানা গুজব। না! তাকে নিয়ে গল্প ফাঁদব না। ইতিহাস হাড়ে ঠিক যেটুকু পেয়েছি—নিরপেক্ষ তথ্যসন্ধানীর মতো, শুধু সেটুটুই তোমাদের কাছে পেশ করব। কারণ তাকে নিয়ে অনেকেই অনেক ছবি এঁকেছেন—নবীন সেন-এর পলাশীর যুদ্ধ’, ডি.এল. রায়ের ‘বঙ্গে বর্গী’, শচীন সেনগুপ্তের সিরাজদ্দৌলা’য় তা হয়েছে সর্বত্রই স্বনামে নয় অবশ্য। তবে নারীচরিত্রগুলি তারই জীবনের উপাদানে গঠিত। আমি সিরাজের বেগম-এর কথা বলছি লুৎফ-উন্‌নিসা।

সিরাজের কয়জন স্ত্রী তা নিয়ে নানামুনির নানামত। নথীপত্র ঘেঁটে আমাদের মনে হয়েছে আইনসম্মতভাবে দাদুর মতো নাতিও ‘একপত্নিক’! মৌলভী ডেকে কলমা পড়ে একবারই সিরাজ বিবাহ করেছিলেন। আলিবর্দীর ইচ্ছা ছিল তাঁর দাদা হাজী আহম্মদের দৌহিত্রী, অর্থাৎ আতাউল্লা খাঁর কন্যার সঙ্গে দাদুভাই-এর সাদীর এন্তেজাম করবেন। কিন্তু আল্লারসুলের মর্জি তা নয়। বয়ঃপ্রাপ্ত হবার আগেই হতভাগিনী ফৌত হল। তখন বাধ্য হয়ে আলিবর্দী তাঁর বিশিষ্ট অমাত্য মির্জা ইরাজ খাঁর কন্যা ওমজাৎ উন-নিসার সঙ্গে সিরাজের সাদী দেন। এই বিবাহ মহা সমারোহে সম্পন্ন হয়। তিন দিন ধরে মুর্শিদাবাদে আতসবাতি পুড়তে থাকে। মুতাক্ষরীণে সে বিবাহ-উৎসব বিস্তারিতরূপে বর্ণিত। সমকালীন ইতিহাসে সিরাজের দ্বিতীয়বার আনুষ্ঠানিক বিবাহের কোনও বিবরণ পাইনি। আন্দাজ হয়, দুজনে প্রায় সমবয়সী ছিলেন। বিবাহকালে তাঁদের বয়স চৌদ্দ-পনের। ওমজাৎ-উন্-নিসার সন্তানাদি কী হয়েছিল তার হক-হদিস পাইনি, কিন্তু তিনি যে নিঃসন্তানা ছিলেন না, তার একটি প্রমাণ পেয়েছি। কারণ ইংরাজ-সরকারের দৃষ্টিতে তিনিই সিরাজের আইনসম্মত বেগম—সবচেয়ে বেশি মাসোহারা পাওয়ার হদারণী। Board of Revenue-এর Proceeding-এ 1780 খ্রীষ্টাব্দে দেখছি লেখা আছে “Miscellaneous Indend― Jageer, Jessore. Application from Umdat-ul Nissa Begam, daughter of Mirza or Nabab Muhomed Ariffee Kawn or Eratch Khan, and widow of Seroje-ul-dowlah, for continuance to her the jageers on the applicant’s claim with a list of the family including the daughters of the Nabab for the support of …”

এই সূত্র থেকেই অনুমান করছি, ওমদাৎ উন-নিসার গর্ভে সিরাজের দু-একটি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছিল। ওমদাদের সমাধি খোসবাগে আছে।

এই ‘আইনসম্মত ধর্মপত্নী ব্যতিরেকে সিরাজের পর্যায়ক্রম শয্যা-সঙ্গিনী হিসাবে আরও তিনটি রমণীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তার ভিতর অর্থমূল্যে ক্রীত ফৈজী ফয়জানের কথা ইতিপূর্বেই বলেছি। বাকি রইল দুজন। অনেকের সন্দেহ ঐ দুইজন এক এবং অভিন্ন। আমরা দুই তরফের যুক্তিই বিচার করে দেখব। একজন লুৎফ উন-নিসা, অপরজন মোহনলালের ভগিনী। বেভারিজ তো ভুল করে লুৎফ উন-নেসা এবং ওমদাৎ উন্-নেসাকেই অভিন্ন বলে ধরে নিয়েছিলেন। নিখিলনাথ যুক্তি দিয়ে সে ভ্রান্তি অপনোদন করেছেন (পৃঃ 118-19 ) কিন্তু মোহনলালের ভাগনী আর লুৎফ-উন্নিসা যে পৃথক এটা প্রমাণিত হয়নি।

নিখিলনাথ বলছেন, মূল সায়র মুতাক্ষরীনে লুৎফ উন্নেসাকে সিরাজের জারিয়া বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। (মূল মৃতাক্ষরীন ১৮১ পৃঃ)। জারিয়া শব্দে ক্রীতদাসী বুঝায়; কিন্তু জারিয়াগণ নিতান্ত হীনভাবের দাসী নহে। তাহারা যে সংসারে প্রবিষ্ট হয়, তাহার মধ্যে কেহ ইচ্ছা করিলে তাহাদিগকে ভার্যারূপে গ্রহণ করিতে পারেন। মুতাক্ষরীনের ইংরেজী অনুবাদক জারিয়াকে Bond maid বলিয়া অনুবাদ করিয়াছেন, —(Mutaqherin Eng. Trans., Vol I., p. 614).

এই তথ্যসূত্র অনুসারে লুৎফ উন্নেসা বাল্যে অথবা কিশোরী বয়সে ক্রীতদাসীরূপে নবাব আলিবর্দীর হারেমে প্রবেশ করে। আন্দাজে মনে হয়, সিরাজের চেয়ে বয়সে সে বছর চার-পাঁচের ছোট। সুতরাং লুৎফ-উনেসা যখন রাজান্তঃপুরে বয়ঃসন্ধি অতিক্রমণে পূর্ণ যুবতী হয়ে ওঠে তার পূর্বেই সিরাজ বিবাহিত, হয়তো ফৈজী-ফয়জান নিহত! লুৎফও অসামান্যা সুন্দরী। ফৈজীর মৃত্যুতে সিরাজের হৃদয়ও তখন শূন্য! আবার নিখিলনাথের ঐতিহাসিক অনুসন্ধিৎসা ও গবেষণার শরণাপন্ন হতে হল—

লুৎফ উন্নেসার প্রতি সিরাজের অধিকতর ভালবাসার আর একটি কারণ ছিল। সিরাজ কোন একটি রমণীর সৌন্দর্যতরঙ্গে একবার আপনাকে ভাসাইয়াছিলেন। রূপে পাগল হইয়া যাহাকে তিনি হৃদয়ে স্থান দান করেন, সে কিন্তু ঘোর বিশ্বাসঘাতকতায় তাঁহার হৃদয় ভাঙ্গিয়া দেয়। এই রমণীর নাম ফৈজী ফয়জান … ফৈজীর বিশ্বাসঘাতকতায় রমণীজাতির উপর সিরাজের আন্তরিক ঘৃণা উপস্থিত হয়। কিন্তু তিনি যখন লুৎফ উন্নেসার হৃদয় পরীক্ষা করিতে লাগিলেন, তখন দেখিলেন যে, সে হৃদয় অটল! তাহার প্রবাহ কেবল একই দিকে প্রবাহিত হয়। ফৈজীর হৃদয় যেরূপ পৈশাচিক, লুৎফ উন্নেসার হৃদয় তদোধিক পবিত্র; তাই লুৎফ উন্নেসার প্রতি তাঁহার অগাধ ভালবাসা দেখিতে পাওয়া যায় এবং তিনিই সিরাজের প্রিয়তমা মহিষী বলিয়া ইতিহাসে উল্লিখিত হইয়া থাকেন। (পৃঃ 116-18)

আমরা কিন্তু এখানে নিখিলনাথের সঙ্গে একমত হতে পারছি না। না! কী কারণে লুৎফ সিরাজের প্রিয়তমা মহিষী হয়ে উঠেছিলেন সে বিষয়ে মহাপণ্ডিতের বিশ্লেষণে আমাদের আপত্তি নেই; কিন্তু প্রসঙ্গত তিনি ফৈজী ফয়জানের বিষয়ে যে বিশেষণ ও মন্তব্য আরোপ করেছেন সেখানেই আমাদের আপত্তি তবে নিখিলনাথকেও পুরোপুরি দায়ী করা যায় না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে দাঁড়িয়ে—তাঁর ঐ কথা মনে হতে পারে বটে। ওটা কালের দোষ!

কিন্তু আজ এই নারী প্রগতির যুগে আমরা কী দেখছি? ফৈজী কেন বিশ্বাসহন্তা? যে হেতু সিরাজ তার পূর্বতন মালিককে লক্ষ তঙ্কা দাম মিটিয়ে দিয়েছিল, তাই? নাকি উপপত্নীকে দামী-দামী অলঙ্কার কিনে দিয়েছিল বলে? শরফ-উন্‌নেসা যদি আলিবর্দীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতেন তাহলে সে-কথা উঠতে পারত, কারণ নবাব আলিবর্দী সমস্ত জীবনভর দ্বিতীয় কোনও রমণীকে বক্ষে ধারণ করেননি। কিন্তু সিরাজ? একাধিক পোষা পাখি ছিল তার। লাখটাকা খরচ ১৮শ শতাব্দী করে আরও একটা ময়না পুষেছিল সে; ময়নাও প্রতিরাত্রে যথারীতি ‘রাধাকৃষ্ণ’ বুলি কপচেছে; সাচ্চা কৃষ্ণভক্তি সিরাজ আশা করে কোন দাবীতে? না, ফৈজীর হৃদয়ের ভালবাসা ‘পৈশাচিক’ ছিল না!

অর্থমূল্যে যে নবাবজাদা তার দেহটা কিনেছে তাকে দেহ দিতেতো সে কার্পন্যে করেনি; কিন্তু যে মুগ্ধ-ভ্রমর ওর নারী-হৃদয়টিকে বিনামূল্যে কিনে নিয়েছিল তার প্রতি তো সে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। প্রেমের অমর্যাদা করে প্রাণভয়ে ক্ষমাভিক্ষা চায়নি একবারও! মাথা খাড়া রেখে মৃত্যুবরণ করেছিল!

না, নিখিলনাথদাদু, আমরা জানি : অর্থমূল্যে নারী-দেহ আজও বিক্রীত হয়, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস : নারীর সাচ্চা প্রেম আনমোলমোতি, কোন যুগেই তা ‘বিক্রীত’ও হয় না, ‘বিকৃত’ও হয় না!

.

লুৎফ-এর কথায় ফিরে আসি।

আমাদের অনুমান, এটা ওর পিতৃদত্ত নাম নয়। কেন? কারণ ‘লুৎফ’ মানে প্রেম; ‘উন্‌ বোঝায় সেরা-মাত্রা; superlative degree. আর ‘নেসা’ হচ্ছে পত্নী। ফলে ‘লুৎফ-উন্‌ন্নেসা’ অর্থে ‘প্রিয়তমা পত্নী’। ইতিহাস সিরাজের এই প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনীকে সর্বত্র, বলেছে লুৎফ-উন্‌নেসা’। শুধু ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে সে ‘আলেয়া’

‘নাম’ হচ্ছে ‘রূপের’ সংজ্ঞা। কী দার্শনিকদের ‘দর্শনে’, কী চক্ষুষ্মানদের ‘দর্শনে’। কিন্তু ‘নাম’ বলতে আরও একটা জিনিস তো বোঝায়! যেটা সদ্যোজাত লাভ করে—বাপ-মা-দাদু-দিদা, নেহাৎ সমকালীন কবি-সাহিত্যিকের কাছ থেকে। আমাদের ধারণা, সিরাজের এই ‘প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনী’র সেই অর্থে নামটা ছিল না : ‘লুৎফ উন্নেসা’।

স্বীকার করি, এর পশ্চাতে কোনও ঐতিহাসিক তথ্য আমরা দাখিল করতে পারছি না। সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয়, এটা সিরাজের দেওয়া আদরের ডাক, যা ইতিহাস মেনে নিয়েছে। সদ্যোজাত সন্তানের নাম কি কেউ দেয়ঃ প্রেয়সী?

তাহলে কী দাঁড়ালো?

সিরাজের ঐ প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনীর পিতৃদত্ত নামটা পাওয়া যাচ্ছে না।

আশ্চর্যের কথা, মোহনলালের ভগিনীর নামটাও ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! না তার পিতৃদত্ত নাম, প্ৰাকবিবাহ সংজ্ঞা, না সিরাজ-হারেমে প্রবেশ করার পর!

দ্বিতীয়ত মোহনলাল যে স্বীয় ভগিনীকে সিরাজকে উপহার দিয়েছিলেন, নিখিলনাথের বিশ্বাস “ইহা ইংরেজী অনুবাদকের কথা। আমরা মূল মুতাক্ষরীণে তাহার কোন উল্লেখ দেখিতে পাই না।”[১] ইংরেজী অনুবাদে পাচ্ছি “This Mohonlal had made present of his sister to Seradjeddoulah which sister was a true Indian beauty; small and delicate. Nothing is more common amongst Indians, when they want to give an idea of surpassing beauty, than to say when she ate paan you might have seen through her skin the coloured liquid run down her throat and she was so delicate, as to weigh only twenty-two seers (or about fifty lbs averdupois), which, by the by, was, they say, the weight of that beloved girl, which Seradj-eddoulah ordered to be immured alive.”[২]

[১. নিখিলনাথ, পৃ 117.

২. Muaqnerin, Vol I, Note P: 717.]

মুতাক্ষরীনের সাতশ সতের পাতায় মোহনলালের ভগিনীর এই রূপ বর্ণনার পাশাপাশি এবার পাঠ কর ছয়শ’ চৌদ্দ পৃষ্ঠায় ফৈজী ফয়জানের রূপবর্ণনা :

She was, says the amorous chronicle of that capital, complete Indian beauty of that right golden hue, so much coveted all over that region, and of that delicacy of person, which weighs only two and twenty seers, or about fifty pounds averdupois; a small delicate woman with a cool retract being the summum bonum of an Indian. This last girl, Faizy, had been a knecheni (dance-girl) at Delhi, from where her attendance had been supplicated (and this. was the expression used), at the court of Moorshoodabad, the request being accompanied by no less than a draught of one lac of rupees”[৩]

[৩. Mutaqherin, Vol. I. Note, p. 614.]

এই দুটি বর্ণনা লক্ষ্য করে নিখিলনাথ বলছেন,

মুতাক্ষরীনের অনুবাদকের মতে ফৈজী ও মোহনলালের ভগিনী স্বতন্ত্র বলিয়া বোধ হয়। কিন্তু দুইজনের রূপবর্ণনা ও কৃশাঙ্গত্ব একই হওয়ায় দুই জনকে অভিন্ন মনে করা নিতান্ত অসঙ্গত নহে। কেবল রূপবর্ণনা ও কৃশাঙ্গের কথা হইলে আমরা যথেষ্ঠ মনে করিতাম না। কিন্তু দুই জনেরই ওজন যখন বাইশ সের বলিয়া উল্লিখিত, তখন সেই ধারণা আরও প্রবল হইয়া উঠে। কৃশাঙ্গত্ব ভারতবর্ষে সৌন্দর্যের পরিচায়ক বটে, কিন্তু ঠিক ‘বাইশ সের’ ওজন যে প্রতিটি নারীর সৌন্দর্যের লক্ষণ, তাহা তো কখনো শুনা যায় নাই।

কথাটা ভাবার!

তাছাড়া আরও একটা কথা। ওমদাদ-উন্নেসার কবর আছে, লুৎফ উন্নেসার কবর আছে। দুজনেই সিরাজের মৃত্যুকালে জীবিতা। ফৈজী ফয়জানের মৃত্যু সিরাজের জীবিতকালে। কিন্তু মোহনলালের ভগিনী? তার আদিও নেই অন্তও নেই—আছে যৌবনকালের উপস্থিতিটুকু! তাও নামহারা!

তোমরা আমাকে একটা পরামর্শ দেবে, দিদিভাইয়ের দল? গপ্পোটা যদি এইভাবে ফাঁদি?

মোহনলাল একজন বঙ্গজ কায়স্থ। বাড়ি পুরুলিয়া, বীরভূম অঞ্চলে। সে যখন কিশোর তখন তার ছোট বোনটিকে বর্গী দস্যুরা হরণ করে নিয়ে যায়, কিশোরী কিম্বা বালিকা বয়সেই। লাঞ্ছিতা মেয়েটি কোনক্রমে গ্রামে ফিরে আসে; কিন্তু সমাজ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাতা হয়। মোহনলাল ক্ষোভে দুঃখে গ্রাম ত্যাগ করে চলে যায় মুর্শিদাবাদে, নাম লেখায় নবাবী ফৌজে। (এ পর্যন্ত নাট্যকার ডি. এল. রায় আমাদের স্বপক্ষে।) খবর পায় না, হাত-ফিরি হতে হতে তার অসামান্য রূপবতী ভগিনীটি গিয়ে উপনীত হয়েছে দিল্লীর রণ্ডি-বাজারে। সিরাজের হারেমে তাকে আবিষ্কার করে স্তম্ভিত হয়ে যায়। অর্থাৎ ফৈজী ফয়জানই মোহনলালের ভগিনী। এক ঢিলে আমরা তাহলে তিন-তিনটে সমস্যা-পাখিকে মেরেছি: কেন মোহনলাল ভগিনীর নাম পাওয়া যাচ্ছে না, কেন তার শেষ পরিণতি জানা যাচ্ছে না, কেন সিরাজ মোহনলালের ভগিনীকে উপপত্নী করে রাখা সত্ত্বেও মোহনলাল পলাশীর যুদ্ধে সিরাজপক্ষে অটল ছিলেন। কিন্তু না! একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে! ফৈজী ফয়জানের ঐ অমানুষিক হত্যার পরেও কি মোহনলালের আনুগত্য অটুট থাকতে পারে?

তার চেয়ে বরং সহজতর হবে দ্বিতীয় বিকল্প মতটা মেনে নেওয়া :

বেভারিজের মতে লুৎফউন্নেসা হিন্দুরমণী—মোহনলালের ভগিনী। মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের দেওয়ান ফজলে রাব্বী খাঁ বাহাদুরেরও এই মত। মুতাক্ষরীনে কিন্তু লুৎফ উন্নিসা জারিয়া অর্থাৎ ক্রীতদাসী বলিয়া অভিহিত—’রিয়াজুস্ সালাতীন’ নামক গ্রন্থে মোহনলালকে কায়স্থ বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে। তাহা হইতে তিনি বাঙ্গালী ছিলেন কিনা বুঝা যায় না।

এতক্ষণে সমাধানে পৌঁছানো গেছে। আমাদের ইকোয়েশানটা হচ্ছে লুৎফা= মোহনলালের ভগিনী। হ্যাঁ, সে ক্রীতদাসী তো বটেই! দস্যুদ্বারা অপহৃত এবং সমাজ দ্বারা প্রত্যাখ্যাতা হওয়ায়। এতক্ষণে মোহনলালের ভগ্নীর নাম, তার অন্তিম গতি সব জানা গেছে। নিজ ভগিনীকে সিরাজের উপপত্নীরূপে দেখা সত্ত্বেও কোন্ দুয়ে হেতুতে মোহনলাল আজীবন সিরাজ-পক্ষে লড়াই করে গেল তাও বোঝা যাচ্ছে! আমার হাতে সময় নেই, এই ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্লটটা তোমাদের উপহার দিলাম। দেখ কিছু খাড়া করতে পার কিনা!

সিরাজের এই প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনী সূর্যমুখী ফুলের মতো সর্বক্ষণ একমুখী। উদয়াচলে সিরাজ যখন ফৈজীর প্রেমে বার্লাক-রক্তিম, তখন ঐ সূর্যমুখী ছিল কুঁড়ি। সিরাজ যখন যৌবনের মধ্যগগনে তখন তার চোখ ধাঁধিয়ে গেছিল দ্বিপ্রহরের মার্তণ্ডতেজে। তারপর যখন সেই দিনমণি ঢলে পড়লেন পশ্চিম গগনে, একে-একে সব সুদিনের বন্ধু তাঁকে ত্যাগ করে গেল—সেই যখন পলাশীর প্রান্তর থেকে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর আলির বক্ষবিদ্ধ খঞ্জরখানা চেপে ধরে মানসিক রক্তক্ষরণে অসুস্থ নবাব ফিরে এলেন মুর্শিদাবাদে, তখনো সে তাঁর পাশে।

কোন কোন বিশ্বাসী বন্ধুর কথায় সিরাজ একবার নগররক্ষা করিতে ইচ্ছা করিলেন।

আবার বিশ্বাসঘাতকেরা পরামর্শ দিল পলায়ন কর, নতুবা তোমার নিস্তার নাই।

সিরাজ অনন্যোপায় হইয়া তাঁহার অনুগমন করিবার জন্য অনেককেই অনুরোধ করিলেন।… কেহই তাঁর সেই কাতরোক্তিতে কর্ণপাত করিল না। এমন কি তাঁহার শ্বশুর পর্যন্ত তাঁহার সহিত একপদ গমন করিতে স্বীকৃত হইলেন না।[১]

[১. মুর্শিদাবাদ কাহিনী/নিখিলনাথ রায়/পৃ: 122.]

গভীর রাত্রে সিরাজ একাকী রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। সঙ্গে শুধুমাত্র তাঁর দীর্ঘ তরবারি—দাদু-সাহেবের দেওয়া উপহার। তখন সেই ঘনান্ধকারে কে-যেন নবাবের হাতখানি চেপে ধরল। সিরাজ দেখলেন লুৎফা। ক্রোড়ে নিদ্রাগত চার বছরের শিশুকন্যা উম্মৎ জহুরা!

নৌকাযোগে ওঁরা রাজমহলের কাছাকাছি পৌঁছান। বস্তুত তিন দিন তিন রাত্রি ওঁরা অভুক্ত ছিলেন। ঐ সময়ে ঘাটে নৌকা লাগিয়ে সিরাজ স্থানীয় দোকান থেকে কিছু চাল-ডাল-নুন কিনে আনতে যান। লুৎফা নদীতীরে ইটের সাহায্যে একটি উনান বানিয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন। দানাশাহ নামে এক ফকির নবাবকে চিনে ফেলে। গোপনে মীরজাফরের জামাতাকে খবর পাঠায়। সিরাজ সপরিবারে ধৃত হন। মুর্শিদাবাদে নীত হওয়ার পর মীরনের আদেশে মহম্মদী বেগ সিরাজের শিরশ্ছেদ করে। নবাব নাকি মৃত্যু-মুহূর্তে ঐ মহম্মদী বেগ-এর কাছে একটি অন্তিম আর্জি পেশ করেছিলেন অজু করে শেষবারের মতো নামাজ পড়ার অনুমতি। মহম্মদী বেগ নবাবের এ আর্জি খারিজ করে খড়্গাঘাত করে!

তারিখটা: দোশরা জুলাই, 1757.

পরদিন একটি হাতির পিঠে সিরাজের মৃতদেহ চড়িয়ে সমস্ত মুর্শিদাবাদ শহরটা পরিক্রমা করানো হয়। মীরন না মীরজাফর কার হুকুমে জানা যায় না, উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট। সিরাজ-সমর্থকেরা স্বচক্ষে দেখে নিক লোকটা ফৌত হয়েছে।

হাতি চলেছে। চলতে চলতে এক জায়গায় এসে থেমে গেল। তিন বছর আগে ঠিক এইখানেই সিরাজ হোসেন কুলী খাঁকে খুন করিয়েছিলেন। লোকে সভয়ে তাকিয়ে দেখল, সিরাজের দেহ থেকে দু-ফোটা রক্ত গড়িয়ে এসে সেইখানকার মাটিতে পড়ল।[১]

[১. পলাশীর যুদ্ধ/তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়/পৃঃ 184.]

গজায়ুর্বেদ-সংহিতায় বলা হয়েছে হাতির স্মৃতিশক্তি বিস্ময়কর। তিন বছর পরে রাজপথের সেই চিহ্নিত স্থানটি চিনে নেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব নয়, যদি ধরে নিই হোসেন কুলীর সঙ্গে তার দোস্তি ছিল। কিন্তু মৃত্যুর চব্বিশ ঘণ্টা পরে মৃতদেহ থেকে দু-ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে একথা চরক- সুশ্রুত কি কোথাও বলেছেন?

.

তারপর হাতিটাকে নিয়ে যাওয়া হল সিরাজের বাড়ির সমুখে। তিন বিধবাকে দৃশ্যটা দেখাতে—লুৎফ-উন্‌নেসা, আমিনা-বেগম আর আলিবর্দী-মহিষী বৃদ্ধ শরফ-উন্‌নেসা। শেষোক্তের অন্নেই মীরন প্রতিপালিত। স্ত্রী, মা, আর দিদা। এদের মধ্যে কে আর্তনাদ করেছিলেন, কে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, কে বে—পর্দা হয়ে পড়েন তার ঠিক হিসেব ইতিহাসে লেখা নেই। অতঃপর সিরাজের মৃতদেহটা বাজারে চকের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল।

মীর্জা জৈন-উল-আবেদীন নামে এক ওম্রাহ সাহস করে এগিয়ে এলেন। নিজ ব্যয়ে প্রাক্তন নবাবের দেহটা প্রাক্তনতর নবাবের সমাধির পাশে গোর দেবার ব্যবস্থা করলেন। খুশবাগে, দাদু আর নাতি পাশাপাশি এতদিনে নিশ্চিন্ত হয়ে পশ্চিমদিকে মুখ করে শুয়ে আছেন। বর্গী অথবা বিশ্বাসঘাতক সেনাপতির কব্জার বাইরে।

মীরজাফর হল নয়া-নবাব। ক্লাইভের হুকুমে চলতে হত বলে লোকে আড়ালে তাকে যে খেতাবটা দিয়েছিল সেটাও ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রেখেছে : ক্লাইভের গাধা! সে মসনদে চড়ে বসার পর ‘ছোট-নবাবসাব’—মীরন, লুৎফ উন্নিসার কাছে দূতী প্রেরণ করে, নিকার বিনীত প্রস্তাব। শোনা যায়, লুৎফ উন্নেসা অকুতোভয়ে দূতীকে জানায়, তোমার মালিককে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বল, চিরটাকাল যে হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে কাটিয়েছে সে কি আজ গাধার বাচ্চার পিঠে চাপতে পারে? ছিঃ!

মীরনের ক্ষমতা ছিল, না লুৎফ-এর ঘরের জানলা-দরজাগুলো পাকা ইট গেঁথে বন্ধ করে দেবার; কারণ তার বাপের গদী ততক্ষণে টলমল করতে শুরু করেছে। অনেক অনেক ঘুষের টাকা দেওয়া যে বাকি!

এরপর মৃত্যুকাল পর্যন্ত (1790) লুৎফ-উন্‌ন্নেসা বেগম সাহেবা প্রতিদিন সন্ধ্যায় সিরাজের কবরের উপর একটি করে চিরাগ জ্বালিয়ে যেতেন, ক্লাইভের হস্তক্ষেপে ঢাকা থেকে যখন মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন অতি বৃদ্ধা দিদি-শাশুরীর সাথে। 1782 সালে একত্রিশে আগস্ট তারিখে ফর্স্টার নামে একজন ইংরেজের লেখা একটি চিঠি আবিষ্কৃত হয়েছে; তিনি বিলাতে তাঁর স্ত্রীকে লিখছেন[১], সন্ধ্যাবেলা তিনি প্রাক্তন নবাবের সমাধি দেখতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গিয়েছিলেন; দূর থেকে নজরে পড়ে পর্দানসীন এক বৃদ্ধা আর একটি যুবতী চিরাগ হাতে ঐ সমাধির দিকে অগ্রসর হয়ে আসছেন। তাদের জীর্ণ, ধূলিমলিন বোর্খা! তাঁরা কে তা উনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।

[১. Journey from Bengal to England, Forster p. 10.]

এর সাত বছর পরে গোলাম মোস্তাফা এক সন্ধ্যায দৃশ্যটা দেখতে পান, 1789 খৃষ্টাব্দে। সেদিন লুৎফা ছিলেন একলা। দূর থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর নজরে পড়ে—সিরাজের জীর্ণ-সমাধি-প্রস্তরের উপর জনৈকা বিধবা লুটিয়ে পড়ে কাঁদছেন।[২]

[২. Mutaqherin, Vol I, p. 643.]

বাল বিখারকে টুটি কবরোপ্যে
জব কোই মেহেজবীন রোহতি হ্যয়
মুঝকো অখসর খয়াল আতা হ্যয় :
মৌৎ কিৎনি হাসিন হোতি হ্যয়![৩]

[৩. ‘বিকীর্ণমুজা’ অবস্থায় ভাঙা কবরের উপর/যখন কোন বিধবা লুটিয়ে পড়ে কাঁদে / আমার তখন অকস্মাৎ মনে হয় : আহা! মৃত্যু কী সুন্দর!]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *