1 of 2

সচকখে দেখা – মণি বর্মা

সচকখে দেখা – মণি বর্মা

সম্পাদকমশাই!

আপনাদের বাড়ি সেদিন বিজলি বাতির তার সারাতে গিয়ে শুনলুম আপনারা ভূত নিয়ে খুব তক্কাতক্কি করছেন। কাজের তাড়া ছিল বলে সেদিন কিছু বলিনি—আজ লিখছি মশাই, ভূত আমি দেখেছি। মেয়ে ভূত। অবিশ্যি দেখার সময় বুঝিনি। বুঝলে যে কী হত, সেটা, আপনারা কাগজ চালান—আপনারাই লোককে লিখে জানাবেন।

পেত্যয় হচ্ছে না? আমি দিব্বি গেলে বলছি মশাই, ভূত ছাড়া সে আর কিচ্ছু হতে পারে না। আর সেই বাবুমশায় যে কী করে তার পাশে বসেছিল! অ্যাদ্দিন পরে ভাবতেও গায়ে আমার কাঁটা দিয়ে উঠছে।

গল্পটা বণ্ণনা কচ্ছি—তবে লিখিয়ে নই তো, মশাই। ভুলচুক হলে শুধরে নেবেন। আপনারা হচ্ছেন শিক্ষিত, আর লেখাপড়ায় তো আমি ‘গয়া গঙ্গা গদাধর’। হবে কোত্থেকে! বারো বছর বয়েস থেকেই কাজে ঢুকিছি। হাতের কাজ। ইলেকটিরিক মিস্তিরির সাকরেদ। তাও কি হেথায়? সেই যার নাম গিরিডি—যেখানে আপনাদের মতো অনেক বাবু হাওয়া বদলাতে যান। না গিয়েই বা কী করতুম বলুন। একপাল ছেলেমেয়ে রেখে পিতা ঠাকুর তো চোখ বুজল। বিধবা মা আর ক’টা পেট ভরাবে? তবু তখন ছ’পয়সা দিলে একসের চাল মিলত।

অনেক দিন আগের কথা তো! গিরিডি তল্লাটে তখন সবেমাত্তর ইলেকটিরিক গ্যাছে। কিন্তু লোকের যে ডালভাতের মতন বিজলি বাতি ছাড়া চলবে না, আমার মনিব গণেশ শাঁপুই সেটা বুঝে ফেলে এক দোকান ফেঁদে বসেছিল। ঘুণ লোক মশাই! দোকানও দিন-দিন বাড়ে, শাঁপুইমশাইও গায়ে-গতরে বাড়ে। পেটটাই মোটা হয়ে গেল জয়ঢাকের মতন। চারদিকে কাজ। সেই দূর-দূর খনি পযযন্ত। না, না কয়লার খনি নয়—অভভরের।

আট বচ্ছর কেটে গ্যাচে তখন। আমি মশাই মিস্তিরি হয়েচি। দূর-দূরের কাজে শাঁপুইমশাই আমাকেই পাঠাতেন। আমারও খুব ভালো লাগত। বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, পাহাড়ি নদী পেরিয়ে নতুন-নতুন জায়গা দ্যাখা। আর তো কোনও নেশা কী আনন্দ ছিল না, মশাই। ওই যে আপনারা ভালোবাসার কথা বইয়েতে লেখেন, ওসব আমি বুঝতুম না। আর চর্চা করবার সময়ই বা কখন বলুন?

এমনি একবার ডাক এল কিশেনগাঁও থেকে। লালাজি আমার মনিবের পুরোনো খদ্দের। আট-দশ বচ্ছর আগে শাঁপুই মশাই-ই তার বাড়িতে বিজলির তার ফিট করে দেয়। তবে সত্যি কথা বলছি, মশাই, মনিব আমার লোক ভালো হলে কী হবে, মিস্তিরি হিসেবে কাঁচা। কিছুদিন ধরেই লালাজি পত্তর দিচ্ছিল তার বাড়ির লাইন সব খারাপ হয়ে গ্যাচে। টুকরো-টুকরো হয়ে ছিঁড়ে পড়চে। লোক পাঠিয়ে যেন সারিয়ে দেওয়া হয়। পরথম-পরথম বেশ নরম সুর। কিন্তু শাঁপুইমশাইয়ের গা যখন কিছুতেই ঘামল না, তখন গরম-গরম চিঠি আসতে লাগল। সারা বাড়িতেই নাকি আবার পিদিম আর কেরোসিন তেলের বাতি জ্বালাতে হচ্ছে। এমনি টানাপোড়েন কিছুদিন ধরেই চলছিল।

লালাজির নাম ওই পরথম শুনলুম। ওর নাকি ট্যাকসি কী যেন—ওই মটরগাড়ির না কীসের যেন ব্যবসা ছিল। বেশ মোটামুটি টাকাও নাকি করেচে। অবিশ্যি মটরগাড়ির কীরকমের ব্যবসা আমার ঠিক মনে নেই—ভাড়া দেওয়া-টেওয়া হবে আর কী। যাকগে, মনে পড়লে পরে লিখব।

কিশেনগাঁওয়ে আমি কেন গেলুম, সেইটেই বলি। একটা বড় কাজ ওখানে ক’দিন ধরেই হচ্ছিল। সেটা শেষ হলেই শাঁপুইমশাই-এর হুকুম হল আমার ওপর, লালাজির ওখানে যেতে। এক ঢিলে দুটো পাখি মারা, বুঝলেন না? কেপ্পন তো!

আমিও শাঁপুইমশাইকে বলে দিলুম বড় কাজটা শেষ করে যখন ফুরসত হবে, তখন লালাজির ওখানে যাব—তখন সনধেই বা কী, আর রাতদুকুরই বা কী! পষ্ট কথায় কষ্ট নেই মশাই।

লালাজিও লিখে পাঠাল, আমার যখন খুশি যেতে পারি। কাজটা হলেই হল। ভুগছে তো কম দিন নয় বেচারা!

কিশেনগাঁওয়ে বড় কাজটা যখন মিটল, তখন সনধে উতরে গ্যাচে। অ্যাকে হাড়-কাঁপানো শীত, তার ওপর ঝিরঝিরে বিষ্টি! বুঝুন ঠ্যালা! লালাজির ওখানেই বা কতক্ষণ লাগবে, কে জানে! শেষ হলেই আবার ফিরতে হবে গিরিডিতে। সেও তো অ্যাক পহরের পথ।

লালাজির বাড়িতে পৌঁচে দরজা ধাক্কাতে লাগলুম। বাড়ি বলব, না করবখানা? কোথাও ছিটেফোঁটা আলো নেই, লোকজনের সাড়াসব্দ নেই। দরজা-জানলা সব নিপ্পিস করে বন্ধ। চারদিকে ঝাঁকড়া-মাথা গাছগুলো হাওয়ায় উলুটিপালুটি খাচ্চিল। পেছনের খাড়া পাহাড়টাকে মনে হচ্চিল, মশাই, সেই যাত্তারায় দেখা বামন অবতার। বলিরাজা বাড়িখানার মাথায় পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে।

আপনারা লেখক বলেই তুলনাটা দিলুম। আমার তখন ঠিক সেইরকমই মনে লেগেছিল। আর সত্যি বলতে কী গা-টাও ছমছম করছিল।

কতকখন ধরে দোর ঠেলাঠেলি করেছিলুম, বলতে পারব না। হঠাৎ চুপিসাড়ে বেরিয়ে এল লালাজি। না মশাই, আগে ককখোনো দেখিনি। সেই পরথম দেখলুম, আর দেখেই ভিরমি যাই আর কী! ইয়া দশাশই চেহারা। মুখে পুরুষ্টু গোঁফ। চোখ দুটো অন্ধকারের ভেতরও যেন জ্বলছিল। হাতে একটা মিটমিটে কেরোসিন-বাতি। দোরটা একচিলতে ফাঁক করে জানতে চাইল আমি কে, কোত্থেকে আসছি, কী দরকার?

টাকা আছে বলেই বোধহয় অত ভয়। আমি গণেশ শাঁপুইয়ের কাছ থেকে মিস্তিরির কাজ করতে এসেছি শুনে তবে লালাজি সরে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকতে দিল। কিন্তু সত্যি বলচি, মশাই, না ঢুকলেই বোধহয় ভালো হত। ভেতরে পা দেবার সংগে-সংগে এমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে নাকে লাগল! আর কী কনকনে ঠান্ডা মশাই! যেন বরপের ঘর। এর চেয়ে বাইরে ঢের কম ঠান্ডা! সত্যি বলচি, আমার মনে হল বাড়ির সরবত্তর একটা পেরেতের নিশ্বাস বইচে।

একটা লন্ঠন নিয়ে আগেই রান্নাঘরের কাজ সারতে ঢুকলুম। যা ভেবেছিলুম। শাঁপুইমশাইয়ের কেরামতিতে বিজলির তারগুলো সব খসে-খসে পড়েচে। তবে সত্যি কথা বলতে সবটাই শাঁপুইমশাইয়ের কেরামতি নয়, বাড়িখানার কেরামতিও আছে। ড্যামপে চুনবালি সব খসে-খসে পড়েচে। নোনাধরা ইঁটগুনো সব দাঁত বার করে যেন হাসচে।

নতুন করে তার টানা ছাড়া উপায় নেই। দুগগা বলে তাই টানতে লাগলুম, আর আমার পেচনে লালাজি পরসব-বেদনা ওঠা মুরগির মতো ঘুরঘুর করতে লাগল।

হাত চালালুম, মশাই, যেন যন্তর। তাড়াতাড়ি ফিনিস করে আবার গিরিডি ফিরতে হবে তো! বললে বিশসাস করবেন না মশাই, একঘণ্টার মধ্যেই রান্নাঘর, সিঁড়ি, ওপরতলার যেখানে যা করবার সব করে ফেললুম। বাকি রইল শুধু বাইরের ঘরটা। লালাজিকে বললুম, ‘এবার ওটায় হাত দিতে হয়।’

‘বাইরের ঘরে।’ লালাজির গলাটা কেমন যেন বেলোটিং কাগজের মতন খসখসে হয়ে উঠল : ‘হ্যাঁ…তা…হাত দিতে হবে বইকি।’

তবু দাঁড়িয়ে রইল। মনে-মনে কী যেন ভাবতে লাগল। তাগাদা দিলুম ‘কই চলুন, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে…।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ…বাইরের ঘরটা…তা করতে তো হবেই…এসো, এইদিক দিয়ে এসো…।’

তার পেছন-পেছন চললুম। দরজার সামনে এসে কিন্তু লালাজি দাঁড়িয়ে পড়ে ফিরে তাকাল—যেন আমায় কিছু বলতে চায়। তারপরই বোধহয় মত বদলে শুধু দোরটা খুলে ধরল।

ঘরটা বেশ বড়ই। কিন্তু, মশাই, ভেতরে পা দিতেই এমন একটা ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এল যে, দম বন্ধ হয়ে যাই আর কী। কীসের মতন গন্ধ? বলতে পারব না, মশাই। কপ্পুরের সনগে রসুন ঘোষলে যেমন হয়, অনেকটা সেইরকম। মোটকথা গন্ধটা নাকে গেলেই পেটের নাড়িভুঁড়ি পাক দিয়ে ওঠে। আর সেই হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। সারা গায়ে কে যেন বরপের চাঁই চেপে ধরেচে। আচ্ছা, অত ঠান্ডা কেন বলুন তো? ইদিকে ঘরে ত ‘বড়সি’ জলা ছিল। বড়সি জানেন তো? মাটির গামলার মতন—বেহার দেশে শীতকালে তাতে আগুন করে, ঘর গরম রাখবার জন্যে। সেই বড়সির ওপর দিয়ে ঘরের ওদিকে তাকাতে গিয়েই বুকের রক্ত আমার হিম হয়ে গেল। ধুকপুকুনিটাও থেমে গেছল বুঝি। এমনটা হওয়ার যুকতি কিন্তু সত্যিকার ছিল না। হয়তো ভেবেছিনু বাড়িতে লালাজি ছাড়া দিতিয় পেরানি কেউ নেই। যতকক্ষন কাজ করেচি, আর কাউকে দেখিওনি, টুঁ শব্দটিও পাইনি। বললে না পেত্যয় যাবেন, মশাই, দেখলুম কী, বড়সির ওপাশে একজন মেয়েছেলে বসে। বলবেন তাতে আর বুকে ধাককা খাবার কী হল? ব্যাখখা করে বোঝাতে হবে? আপনারা তো লেখক, লোকের নাড়ি টিপে মনের খপর টের পান। আমারটাও এতকখন নিশ্চয় পেয়েচেন। সোজা কথায়, মেয়েছেলেটার দিকে নজর পড়তেই আমার মনে হল ঘরের হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা আর ঝাঁঝালো গন্ধ সব ওর জন্যেই।

বয়েস হবে তার লালাজির চেয়ে আট-দশ বছর কম। হাড় বের করা জিরজিরে চেহারা। পরনে কালো সাড়ি, কালো সেমিজ। হাত দুটো কোলের ওপর জড়ো করে, সোজা হয়ে একখানা গদি-আঁটা চেয়ারে বোসে। আবার হাঁসছিল, মশাই। না, আমায় দেখে নয়—আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। নাকের সোজা তাকিয়েছিল—তাকিয়েই রইল। নোড়ল না—ফিরল না—ইসপিকটি নট। কমজোরি আলোয় মুখখানা আমি, মশাই, ভালো করে ঠাওর করতে পারিনি, কিন্তু কেমন জানি মনে হল—হায় ভগবান, কী করে বোঝাব—সে আসলে মানুষ নয়। আমি হলপ করে বোলতে পারি তার গায়ে রক্ত-মাংসো নেই। নইলে অত রোগা মানুষ অত ফরসা হয়? রং-এর কী জেল্লা মশাই! সেই দেখেই তো বুকের মধ্যে আমার ধকাস করে উঠেছিল।

লালাজি আমার পেছন-পেছন ঘরে ঢুকেছিল। কাঁধের কাছে মুখ এনে চাপা-চাপা গলায় বলল, ‘আমার জরু হে—বউ।’

রকখে করো ভগবান! ঢিপঢিপে বুকে লালাজির বউয়ের দিকে তাকিয়ে নোমসকার করলুম। বললুম, ‘নমসতে ভৌজি!’

ভৌজি তেমনি কাঠ হয়ে বসে রইল। ফিরলও না, কথাও বলল না। সত্যি কথা বলছি, মশাই, তখন একটু ঘাবড়েই গেলুম। জিভটা যেন শুকিয়ে উঠল।

পেছনে দাঁড়িয়ে লালাজি হাসল কী কাঁদল জানি না। ঘোড়ার মতো হে-হে করে বলল, ‘কিছু মনে কোরো না, ছোকরা। আমার জরু…’ ঠেক খেয়ে গেল লালাজি। একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, ‘নাও—নাও—চট করে তোমার কাজ সেরে নাও।’

বলে মশাই লালাজি গিয়ে তার বউয়ের পাশটিতে বসল। কানের গোড়ায় মুখ এনে খুব চেঁচিয়ে বলল, ‘শুনচ গো! এ-ছোকরা হচ্চে ইলেকটিরিক মিস্তিরি। তার সারাতে এসেচে। আলো ঠিক হয়ে গেলে তবে তোমায় ভালো করে দেখতে পাব।’

আদরের হাসি হেসে উঠল লালাজি টেনে-টেনে। বউ কিন্তু নড়লও না চড়লও না। তেমনি নাকের ডগায় তাকিয়ে বসে রইল। তখুনি মশাই, সিকার করছি, গা-টা আমার সিরসির করে উঠল। বুকের ভেতরে ধানাই-পানাই হচ্ছিল। আমি ভিতু নই, মশাই। ওখানে তখন থাকলে আমি দিব্বি গেলে বলতে পারি, আপনাদেরও হত।

তবু কাজ তো করতে হবে। আর না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি হাত চালাতে লাগলুম, আর লালাজি ঠায় আমার দিকে তাকিয়ে রইল সনদেহের চোখে। পেছনে ফিরে থেকেও সেটা টের পাচ্ছিলুম। যদি ফিরি ওমনি টেনে-টেনে হাসবে। কী ঝকমারির কাজ মাইরি! নাকে সেই ভ্যাপসা, পচা গন্ধ—যেন গন্ধক পুড়িয়েচে। শীতে হাত-পা আড়ষ্ট। সেও সইছিল, মশাই, কিন্তু ওই যে মেয়েছেলেটা ঠায় একরকম করে বসে আছে—নট নড়ন-চড়ন। একটু যদি নড়ে বসত শুধু। কথা বলে কাজ নেই—হয়তো খোনা সুর বেরুবে। শুধু একটু নড়ে বসুক। আর সেই বিদঘুটে হাসিটা। বড়সির আগুনের আলোয় কেমন যেন…ইস! লালাজি যে কী করে পাশে বসে আছে!

বুকে হাত দিয়ে বলছি, মশাই, এক-একবার ইচ্ছে হচ্ছিল যন্তরপাতি ছুঁড়ে ফেলে ছুটটে পালাই—যেখানে হোক—শুধু এই ভুতুড়ে বাড়ি থেকে।

কাজ একসময় শেষ হয়ে গেল। অত শীতেও কপাল দিয়ে তখন দরদর করে ঘাম ঝরছে। লালাজিকে বললুম, ‘কাজ হয়ে গ্যাচে। অ্যাকবার সুইচ টিপে দেখি আলো ঠিক জলচে কি না, তারপর ছুটি।’

লালাজি যেন আঁতকে উঠল। হাঁ-হাঁ করে বলল, ‘না—না—আলো জালাতে হবে না। ও ঠিক আছে—আমি বলচি সব ঠিক আছে।’

‘আমাদের দসতুর মশাই অ্যাকবার জেলে দ্যাখা।’

‘বলচি দরকার নেই। তোমাকে আর মিসতিরিগিরি ফলাতে হবে না। সব ঠিক আছে—’ লালাজি ধমকাল, না কেঁদে ফেলল—বুঝতে পারলুম না, মশাই। আমার সামনে তার সে কী দাপাদাপি! তারপরই বউয়ের দিকে ফিরে চেঁচিয়ে বলল, ‘মিসতিরির কাজ শেষ হয়ে গ্যাচে গো। এবার যাবে ও।’ কথার পর সেই টেনে-টেনে হাসি।

বউয়ের সাড়াও নেই, সবদও নেই। আমি তখন, মশাই, যনতরপাতি থলিতে ভরে ফেলচি।

এবার লালাজি আমাকে বলল, ‘শাঁপুইকে বলো বিল পাঠিয়ে দিতে, টাকা দিয়ে দোব।’

কে কার কথা শোনে! সদর দোর খুলে তখন বাইরে পা বাড়িয়েচি। অ্যাকবার পেছনে ফিরে তাকালুম। মেয়েছেলেটা সেই জায়গাতেই বসে ঠিক তেমনিভাবে হাসচে মশাই। হাসি তো নয়, আমাকে ভেংচি কাটচে যেন।

তবু বলবেন ভূত নয়? বিসসাস হচ্ছে না?

তারপর কী হল? লিখচি মশাই।

ছুটটে তো রাসতায় বেরিয়ে পড়লুম। সেই বিষ্টি আর ঝাঁকড়া-মাথা গাছগুলোর মাতামাতি।

অন্ধকারে হোঁচট খেতে-খেতে তো ছুটলাম। কতকখন তা বলতে পারব না, মশাই। হঠাৎ একটা মাটির ঘরে দেখি—আলো জ্বলচে। ছোটটো একটা চায়ের দোকান। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে বললুম, ‘চা—চা দাও এক ভাঁড়।’

একটু পরে গাঁয়ের অ্যাকজন চাসিভুসি এসে ঢুকল। খোসগপ্পে লোক। কথায়-কথায় শুনলুম লালাজির বাড়ির কাচেই থাকে সে। আমার পেটটা যেন ফুলে উঠল মশাই। আর থাকতে পারলুম না। নিজের বেততানত সব খুলে বললুম তাকে। বিসেষ করে লালাজির বউয়ের কথা।

‘বউ!’ চাসি লোকটা বোয়াল মাছের মতো মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ধরা গলায় বলে, ‘লালাজির বউ! জরু?’

‘হ্যাঁ—হ্যাঁ। তাজজব বনে গ্যালে যে। লালাজি সাদি করতে পারে না? তবে তাজজব বউ বটে। নড়েও না—চড়েও না। মুখে আবার বাক্কি নেই।’

‘হে ভগবান! লালাজির বউ যে আটবরষ আগে মরে গ্যাচে।’

শুনেই বলব কী, মশাই, চুলগুলো আমার খাড়া হয়ে উঠল। আমতা-আমতা করতে লাগলুম, ‘তবে যে লালাজি বললে তার বউ…।’

‘ছিল—ছিল, ভেইয়া! লালাজি বহুৎ ভালোবাসত তাকে। জরুও ভালোবাসত বহুৎ। আমরা বলতুম—অ্যাকজোড়া কবুতর। কেউ কাউকে চোখের আড়াল করত না। তারপর বউ যেদিন মরে গ্যাল—কী বলব, ভেইয়া, লালাজির সেদিন কী অবস্থা…।’

আমার মুখে তখন আর বাক্যি ছিল না। চাসি লোকটা মাথা দোলাতে-দোলাতে বলতে লাগল, ‘বউ মরে যাবার পর লালাজি কেমন য্যান পাগলের মতন হয়ে গ্যাল। আমরা তো ভেইয়্যা মড়াকে শসানে নিয়ে যাওয়ার জন্যে লালাজির বাড়িতে হাজির। কিন্তু অবাক কানডো, ভেইয়া। লালাজি তার আগেই নিজের একখানা গাড়ি আনিয়ে মরা বউকে নিয়ে হাওয়া। তিনমাস আর তার পাততা নেই। তারপর একদিন বন্ধ গাড়ি করে লালাজি ফিরে এল। আর সেই থেকে ভেইয়া বাড়ি ছেড়ে আর অ্যাকদম বেরোয়নি।’

পড়ে রইল চায়ের ভাঁড়, মশাই। আমি আবার অন্ধকার রাস্তা ধরে ছুটলুম। ছুটব না? আমি যে লালাজির বউকে সচকখে দেখেছি—দুজনকে পাসাপাসি বসে থাকতে দেখেচি। কী করে জানি না—আট বচ্চর আগে যে বউ মারা গ্যাচে তার সনগে। সে-রাত্তিরে, মশাই, যদি আমায় দেখতেন…গা থেকে ঢিলে চামড়া যেন খুলে-খুলে পড়ছিল।

সেই ভূত দেখেছিলুম। তবে দ্যাখার আগে বুঝতে পারিনি। মুকখু লোক তো, মশাই। যা দেখিচি, তাই লিখলুম।

হ্যাঁ—হ্যাঁ—অ্যাকটা কথা মনে পড়চে। লালাজির ব্যবসার কথা। মটরগাড়ির কী নিয়ে যেন ছিল—লিখেচি না? ভাড়া খাটাতো। কী যেন বলে? হ্যাঁ—হ্যাঁ—ট্যাকসি। ঠিক—ট্যাকসি। যে-কাগজে লালাজি চিঠি লিখত—তাতে যেন ওইরকমই একটা নাম লেখা থাকত। ঠিক কী যেন?

দাঁড়ান—দাঁড়ান—মনে পড়েচে। ট্যাকসিডারমিস্ট।

দাঁত ভাংগা কথা মশাই—তাই তো মনে পড়ল।

ট্যাকসিডারমিস্ট।

কথাটার মানে কিন্তু আজও জানি না। আপনারা তো মশাই, লেখাপড়া জানা লোক—পণডিত। নিসচয় মানেটা জানেন। আপনাদের পাঠকরাও সবাই না হোক—অনেকেই জানে। আমাকে মশাই দয়া করে জানিয়ে দেবেন।

নোমসকার নেবেন।

ইতি—নিবেদক

স্রি হলধর দাশ

মাসিক রোমা

মার্চ, ১৯৬৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *