সংকট মঙ্গলবারের কথা
এক দেশে লক্ষপতি নামে এক সওদাগর ছিলেন। তিনি বারো বৎসর বাণিজ্যে গিয়েছেন, বাড়ি ফেরেন না, কোনো সংবাদও দেন না। বুড়ো মা, বউ কেঁদে-কেটে আকুল। কেউ বলে কারও ছলায় পড়েছে, কেউ বলে সে আর বেঁচে নেই। এই সব কথা শুনে, তাদের প্রাণ আরও আকুল হল। একদিন পাড়ার একজন গিন্নি বললে, ‘দেখো দিদি! তোমার বউকে অগ্রহায়ণ মাসের শুল্কপক্ষের মঙ্গলবারে সংকট মঙ্গলবারের ব্রত করাও। তোমার ছেলে নিশ্চয় বাড়ি ফিরে আসবে; কিন্তু এ ব্রত একলা হয় না, বিধবাকে নিয়েও হয় না। এক কাজ করো, আমার বউটিরও যখন ছেলে হয়নি তখন ওরা দুজনে এই ব্রত করুক।’ সওদাগরের মা বললেন, ‘বেশ তো, তাই করুক।’ তখন দুই বউ মিলে একসঙ্গে মঙ্গলবারে আটগাছি দূর্বা, আটটি আতপ চাউল, রেশমি কাপড় দিয়ে অর্ঘ্য তৈরি করলেন। তাঁরা দুজনে নিজের নিজের হাঁটুর ভেতর হাত গলিয়ে, কুটনো, বাটনা করে, রান্না করলেন। পুজোর শেষে দুজনেই হাঁটুর ভেতর হাত গলিয়ে, আহারে বসলেন। প্রতিবেশী গিন্নি বললেন, ‘‘তোমরা খেতে খেতে কথা কয়ো না। যখন খাওয়া হয়ে যাবে, তখন দুজনই দুজনকে জিজ্ঞাসা করবে, ‘সংকট হতে উঠি?’ তখন দুজনেই দুজনকে বলবে, ‘উঠ’।’ এই কথা বলে গিন্নি বাড়ি চলে গেলেন।
তারপর দুই বউ একমনে সংকট মঙ্গলচন্ডীকে স্মরণ করছেন আর খাচ্ছেন, আর এক একবার নিজেদের সংকটের অবস্থা ভাবছেন, এমন সময় ঘাটে দামামার ধ্বনি হল। দাসী যেমন বলেছে, ‘ওই গো গিন্নি মা! দাদাবাবু বুঝি পাটন থেকে বাড়ি ফিরে এলেন,’ অমনি দুজনেই উঠে পড়লেন। ব্রতের নিয়ম কিছুই পালন হল না। গিন্নি বউ নিয়ে পাঁচ এয়ো নিয়ে ঘাটে ডিঙি বরণ করতে গেলেন। দাসী এঁটো পরিষ্কার করতে গিয়ে সওদাগরের স্ত্রীর পাতের দইমাখা ভাতগুলি খেয়ে ফেললে। সওদাগর বাড়ি এসে আর নিজের স্ত্রীকে চিনতে পারলেন না। হিরার বালা, মুক্তার মালা যা-কিছু এনেছিলেন, সব দাসীকে পরিয়ে দিলেন। বউয়ের সঙ্গে আর কথাও কন না। শাশুড়ি দেখলেন এ আবার কী হল। পাড়ার সেই ব্রাহ্মণীগিন্নিকে সব কথা বলে, তাঁর পায়ে জড়িয়েধরে কাঁদতে লাগলেন। ব্রাহ্মণী বললেন, ‘চুপ করো দিদি, কেঁদো না। তোমার ছেলে যখন ঘরে এসেছে, তখন ওর জন্যে আর ভাবনা নেই। সেদিন বউ তাড়াতাড়ি উঠে পড়াতে, দাসী পাতের শেষভাত খেয়েছে, তাই দাসীর ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছে। কী করবে দিদি! পৌষ মাসটা যাক। এ ব্রত মাঘ মাসে করলেও হয়।’
তখন গিন্নির কথা শুনে তারা আবার মাঘ মাসে শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে মঙ্গলচন্ডীর পুজো করে সংকট মঙ্গলবার করলেন। সেবার আর কাকেও এঁটো ছুঁতে দিলেন না। যে-যার পাতা নিজে নিজে ভাসালেন, যে-যার এঁটো নিজে নিজে পরিষ্কার করলেন। সওদাগরের স্ত্রী এঁটো পরিষ্কার করছেন, আর বলছেন:
হাতের কঙ্কণ বেচে কিনলাম দাসী,
দাসী হল রাজমহিষী;
আমি হলাম দাসীর দাসী।।
সওদাগর শুনতে পেয়ে বউয়ের হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন। বউয়ের মুখে সবকথা শুনে মা মঙ্গলচন্ডীর কৃপায় তাঁর ভ্রম দূর হল। তখন সেই বউকে নিয়ে সওদাগর ঘরকন্না করতে লাগলেন। ব্রাহ্মণীর বউয়েরও যথাকালে ছেলে হল। কিছুদিন পরে সওদাগরের ছেলে-মেয়ে হল। সকলে সুখে-স্বাচ্ছন্দে কাল কাটাতে লাগলেন। এঁদের সুখ দেখে পাড়ার সকলে এই ব্রত করতে লাগলেন। ক্রমে দেশ-বিদেশে সংকট মঙ্গলবারের ব্রতকথা প্রচার হল। সেই থেকে সকলেই এই সংকট মঙ্গলচন্ডীর ব্রত করতে লাগল।
সংকট মঙ্গলবারের ব্রতকথা সমাপ্ত।