শ্রীরামকৃষ্ণ বিজ্ঞানীও
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শুধুমাত্র সাধক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ঐতিহাসিক, মনস্তাত্ত্বিক, সমাজবিজ্ঞানী, সমাজসংস্কারক, অসাধারণ পর্যবেক্ষক, সংগঠক এবং ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। সভ্যতার উত্থান-পতনের সংবাদ তিনি রাখতেন। তিনি ছিলেন সর্বশাস্ত্রবিদ, পুরাণ, মঙ্গলকাব্য, গীতা, চণ্ডী, তন্ত্র, লোকসাহিত্য সবই তিনি পড়েছিলেন। পণ্ডিত শুধু পড়েন আর উগরে দেন। তাঁর নিজের অতুলনীয় উপমায়—পায়রার গলার মটরদানার মতো জ্ঞান গজগজ করে, হজম হয় না। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অলৌকিক পরিপাক-শক্তিতে সব হজম করেছিলেন। যার ফলে তিনি শুধু মহাসাধক নন, হয়ে উঠেছিলেন সর্বকালের সেরা একজন জ্ঞানী। তিনি শুধু নিজের কালকে নাড়া দিয়ে যাননি, নাড়িয়ে দিয়েছেন ভবিষ্যকালের চিন্তাধারাকে। এমন একজন সুষম, উদার, ফলিত চিন্তাবিদ ইতিহাসে খুব কমই এসেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল না কারো। আজো নেই। কারণ জাগতিক কোনকিছুর প্রত্যাশা ছিল না তাঁর। কোনকিছুর দাস ছিলেন না তিনি। তিনি ছিলেন প্রকৃত প্রভু। এমনকি ধর্মের দাসত্বও তিনি করেননি। কখনো বলেননি, আমার ঘড়িই ঠিক চলছে। মন্ত্রশিষ্য করেননি। মঠ, মিশন, আশ্রম তৈরি করিয়ে গেরুয়া ধারণ করে, গুরু হয়ে বসেননি। নিজের পদযুগল এগিয়ে দিয়ে বলেননি, প্রণাম কর, আমি ওমুক সম্প্রদায়ের গুরু মহামণ্ডলেশ্বর! বলছেন—নীরবে, সংগোপনে চেষ্টা কর একটিমাত্র বস্তুকে ধরার। বস্তুটি হলো সত্য। নিখিল বিশ্ব সে-সত্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে, ঘুরপাক খাচ্ছে চন্দ্র, সূর্য, তারা। রাম, রহিম, শিব, কৃষ্ণ, ব্রহ্মা, বিষ্ণু নিয়ে কাজিয়া করো না। ঈশ্বরের কোন রূপ নেই। জগৎকারিণী মহাশক্তির নাম ঈশ্বর। দূর থেকে দেখ সমুদ্রের জল নীল, কাছে যাও, কোন রঙ নেই। যত মত, তত পথ। পথের শেষে যাঁর দর্শন, তিনি তিনিই। তিনি কোন সম্প্রদায়ের নন। তাঁর কোন জাত নেই। ছাদে উঠা নিয়ে বিষয়। তা তুমি পাকা সিঁড়ি দিয়েও উঠতে পার; কাঠের সিঁড়ি দিয়েও উঠতে পার; বাঁশের সিঁড়ি দিয়েও উঠতে পার; আর দড়ি দিয়েও উঠতে পার। আবার একটি আছোলা বাঁশ দিয়েও উঠতে পার।
সত্য বিস্মৃত হয়ে যাঁরা ধর্ম নিয়ে লড়াই করেন, তাঁদের দিকে তাকিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : “যদি বল, ওদের ধর্মে অনেক ভুল, কুসংস্কার আছে; আমি বলি, তা থাকলেই বা, সকল ধর্মেই ভুল আছে। সব্বাই মনে করে আমার ঘড়িই ঠিক যাচ্ছে। ব্যাকুলতা থাকলেই হলো; তাঁর উপর ভালবাসা, টান থাকলেই হলো। তিনি যে অন্তর্যামী—অন্তরের টান, ব্যাকুলতা দেখতে পান। মনে কর, এক বাপের অনেকগুলি ছেলে, বড় ছেলেরা কেউ বাবা, কেউ পাপা—এইসব স্পষ্ট বলে তাঁকে ডাকে। আবার অতি শিশু ছোট ছেলে হদ্দ ‘বা’ কি ‘পা’ এই বলে ডাকে। যারা ‘বা’ কি ‘পা’ পর্যন্ত বলতে পারে—বাবা কি তাদের উপর রাগ করবেন? বাবা জানেন যে, ওরা আমাকেই ডাকছে তবে ভাল উচ্চারণ করতে পারে না। বাপের কাছে সব ছেলেই সমান।”
“আবার ভক্তেরা তাঁকেই নানা নামে ডাকছে; এক ব্যক্তিকেই ডাকছে। এক পুকুরের চারটি ঘাট। হিন্দুরা জল খাচ্ছে একঘাটে বলছে জল, মুসলমানেরা আরেক ঘাটে খাচ্ছে বলছে পানি। ইংরেজরা আরেক ঘাটে খাচ্ছে বলছে ওয়াটার; আবার অন্য লোক একঘাটে বলছে aqua, এক ঈশ্বর তাঁর নানা নাম।”
শ্রীরামকৃষ্ণ শুধু জ্ঞানী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী। আবার ল্যাটিন ভাষাও জানতেন। তা নাহলে aqua বলছেন কিভাবে। বিজ্ঞানী এই কারণে, শুধু বললে তো হবে না, শুধু পড়লে হবে না, শুধু কপচালে হবে না। দাঁড়ের চন্দনা খুব কপচায়, রাধেকৃষ্ণ, তবু বেড়ালে ভয়। গ্রন্থকে গ্রন্থি করলে হবে না। তিনি বলতেন, গ্রন্থ নয়, গ্রন্থি-গাঁট। বিবেক-বৈরাগ্যের সহিত বই না পড়লে পুস্তকপাঠে দাম্ভিকতা, অহঙ্কারের গাঁট বেড়ে যায় মাত্র। এ যেন কনফুসিয়াসের প্রতিধ্বনি—থিঙ্কিং উইদাউট রিডিং, রিডিং উইদাউট থিঙ্কিং, বোথ আর ইউসলেস। সব চিন্তাবিদই একই সত্যে উপনীত হন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন : “পাঁজিতে বিশ আড়া জল লেখা আছে কিন্তু পাঁজি নিংড়ালে এক ফোঁটাও বেরোয় না, তেমনি পুঁথিতে অনেক ধর্মকথা লেখা আছে—শুধু পড়লে ধর্ম হয় না—সাধন চাই।” সত্যকে সাধন দিয়ে যাচাই করে নিতে হবে বিজ্ঞানীর মতো। সব পথই সত্যধামে গেছে বললেই তো হবে না, করে দেখাতে হবে সাধনার পরীক্ষাগারে। তিনি বলছেন : “আমায় সব ধর্ম একবার করে নিতে হয়েছিল— হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান আবার শাক্ত, বৈষ্ণব, বেদান্ত—এসব পথ দিয়েও আসতে হয়েছে।” শেষে কি দেখলেন? “দেখলাম, সেই এক ঈশ্বর—তাঁর কাছেই সকলে আসছে—ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়ে।” সত্য এক। সত্য, দ্বাপর, ত্রেতা, কলি কোনকালেই সত্যের সংজ্ঞা পালটাবে না।
লালনের কথা—”ধর্ম-প্রভু জগন্নাথ। চায় না রে সে জাত-অজাত। ভক্তের অধীন সে। যত জাত বিচারী/দুরাচরী/যায় তারা সব দূর হয়ে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের মধ্যে একজাতের মানুষ খুঁজে পেয়েছিলেন—’বাবু- ক্লাস’। এই বাবুদের নিয়েই মহা সমস্যা। এঁদের হ্যাট, গ্যাট, ম্যাটে দেশ অশান্ত। ধর্ম আর রাজনীতি, রাজনীতি আর চাঁদির লড়াই কুরুক্ষেত্রের দরজা খুলে দিয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। জানতেন অস্তমিত শতাব্দীতে এমনটি হবে। তাই ভেকধারী ধর্মের জড় মেরে দিয়েছিলেন। মন্দিরে মাধবের প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন। ভোঁ ভোঁ শাঁক ফোঁকা চাননি। বলেছিলেন ক্ষুদ্র ‘আমি’টিকে মার। আমি গেলে ঘুচিবে জঞ্জাল। হাম নয় HIM। সেই বড় আমিই হলো ‘হিম’– তিনি সব মানুষের আকর। ধর্ম উপলব্ধির বস্তু। “‘নাক তেরে কেটে তাক’ বোল মুখে বলা সহজ, হাতে বাজানো কঠিন। সেইরকম ধর্মকথা বলা সোজা, কাজে করা বড় কঠিন।” ভিতরের বন্ধ্যা আমি ক্ষেত্রটিকে প্রেম-বারি সিঞ্চিত করে ভক্তির জল দিয়ে কর্ষণ কর, তবেই হবে কৃষ্ণ। তবেই দেখা যাবে বাসুদেব সর্বম্। সব তিনি। সব তিনি। সব তিনি! সব তাঁর! সব তাঁর! সব তাঁর! আনন্দ, আনন্দ, আনন্দ।