ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

শ্রীরামকৃষ্ণের বৃন্দাবন

শ্রীরামকৃষ্ণের বৃন্দাবন

 আমাদের ঈশ্বর-ভাবনায় চিরকালের একটা ভ্রান্তি আছে। আমরা মনে করি, ভগবান যার সহায় তার জাগতিক দু:খ কষ্ট বিপদআপদ কিছু থাকবে না। এই ভুল ভাঙাতেই ভগবান এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের দেহ ধারণ করে দরিদ্র ব্রাহ্মণের ঘরে, জাগতিক অর্থে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত এক পরিবারে। পরে বোঝা গিয়েছিল, শ্রীরামকৃষ্ণ আর কেউ নন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ।

।। ১৮৮৫ সাল, ২২ ফেব্রুয়ারি ।।

দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের শেষ জন্মোৎসব। গিরিশচন্দ্র ঠাকুরকে বলছেন, ‘আপনার সব কার্য শ্রীকৃষ্ণের মতো, শ্রীকৃষ্ণ যেমন যশোদার কাছে ঢং করতেন।’

ঠাকুরের পরোক্ষ সমর্থন, ‘হাঁ, শ্রীকৃষ্ণ যে অবতার। নরলীলায় ওইরূপ হয়। এদিকে গোবর্ধনগিরি ধারণ করেছিলেন, আর নন্দের কাছে দেখাচ্ছেন, পিঁড়ে বয়ে নিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে।’

গিরিশচন্দ্রের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সুগভীর বিশ্বাসদৃঢ় মন্তব্য—’বুঝেছি, আপনাকে এখন বুঝেছি।’

এবারে ভগবান কেন দরিদ্র ব্রাহ্মণের পর্ণকুটিরে? ঠাকুরের একদিনের এই কথায় উত্তর আছে হয় তো! ঠাকুর বলছেন, ‘যে অকিঞ্চন, যে দীন, তার ভক্তি ঈশ্বরের প্রিয় জিনিস। খোল মাখানো জাব যেমন গরুর প্রিয়। দুর্যোধন অত টাকা অত ঐশ্বর্য দেখাতে লাগল কিন্তু তার বাটীতে ঠাকুর গেলেন না। তিনি বিদুরের বাটী গেলেন। তিনি ভক্তবৎসল, বৎসের পাছে যেমন গাভী ধায় সেইরূপ তিনি ভক্তের পাছে পাছে যান।’

মধুমাসে ভক্ত ব্রাহ্মণ, কামারপুকুরের ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় পদব্রজে গয়াধামে এসেছেন। মধুমাস অর্থাৎ চৈত্রমাসে গয়াক্ষেত্রে পিতৃপুরুষদের নামে পিণ্ডোৎসর্গ করলে তাঁদের অক্ষয় পরিতৃপ্তি হয়। সে-কাজ সমাধা হয়েছে। বড়ই পরিতৃপ্ত তিনি। একদিন রাতে স্বপ্ন দেখছেন, শ্রীমন্দিরে গদাধরের শ্রীপাদপদ্মের সামনে আবার পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে পিণ্ডপ্রদান করছেন আর তাঁরা যেন দিব্য জ্যোতির্ময় শরীরে তা সানন্দে গ্রহণ করে তাঁকে আর্শীবাদ করছেন। বহুকাল পরে তাঁদের দর্শন পেয়ে ক্ষুদিরাম আত্মসংবরণ করতে পারছেন না। তিনি কাঁদছেন আর সকলের পাদস্পর্শ করে প্রণাম করছেন। পরক্ষণেই ওই একই স্বপ্নে দেখছেন, অদৃষ্টপূর্ব দিব্য জ্যোতিতে মন্দির উদ্ভাসিত। পিতৃপুরুষগণ সসম্ভ্রমে, সংযতভাবে দুপাশে করজোড়ে দণ্ডায়মান, সামনে বিচিত্র সিংহাসনে অদ্ভুত এক পুরুষ সুখাসীন। তাঁরা সেই দেবতার উপাসনা করছেন সেই দেবতা নবদুর্বাদলশ্যাম, জ্যোতিমণ্ডিততনু। ক্ষুদিরাম দেখছেন, তিনি স্নিগ্ধপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে দেখছেন। ইঙ্গিতে কাছে ডাকছেন। যন্ত্রচালিতের মতো ক্ষুদিরাম এগোচ্ছেন দেব-সিংহাসনের দিকে। দণ্ডবৎ প্রণামান্তে স্তবপাঠ করছেন ক্ষুদিরাম জোড়হস্তে :

 উদ্যৎকোটিদিবাকরাভমনিশং শঙ্খং গদাং পঙ্কজং

 চক্রং বিভ্রতমিন্দিরাবসুমতীসংশোভিপার্শ্বদ্বয়ম।

 কোটীরাঙ্গদহারকুণ্ডলধরং পীতাম্বরং কৌস্তভো-

 দ্দীপ্তং বিশ্বধরং স্ববক্ষসি লসৎশ্রীবৎসচিহ্নং ভজে।

 শ্রীনাথং শ্রীধরং শ্রীশং মঙ্গলং মঙ্গলায়ুধম।।

 দামোদরং দমোপেতং কেশবং কেশিসূদনম।

 বরেণ্যং বরদং বিষ্ণুং মানদং বসুদেবজম।।

স্তববন্দনায় দিব্যপুরুষ প্রসন্ন পরিতুষ্ট। বীণানিস্যন্দি মধুর স্বরে বলছেন, ‘ক্ষুদিরাম, তোমার ভক্তিতে পরম প্রসন্ন হয়েছি, পুত্ররূপে তোমার গৃহে অবতীর্ণ হয়ে আমি তোমার সেবা গ্রহণ করব।’

আতঙ্কিত ক্ষুদিরাম কাতরকন্ঠে বলছেন, ‘না না প্রভু, আমার অমন সৌভাগ্যের প্রয়োজন নেই। কৃপা করে আপনি আমাকে দর্শনদান করেছেন, সেই যে আমার পক্ষে যথেষ্ট প্রভু! সত্য সত্য পুত্র হয়ে এলে, দরিদ্র আমি, আমি কি আপনার সেবা করতে পারব!’

ক্ষুদিরাম অঝোরে কাঁদছেন। জোড় হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। শরীর থরথর করে কাঁপছে। ক্ষুদিরামের করুণ বচনে দিব্যপুরুষ আরও প্রসন্ন হয়ে বললেন, ‘ভয় নাই, ক্ষুদিরাম, তুমি যা দেবে, তাতেই আমার তৃপ্তি, আমার অভিলাষ পূর্ণ করতে আপত্তি কোরো না।’

 সেবার এসেছিলেন দেবকীর গর্ভে কংসের কারাগারে। এবার এলেন চন্দ্রমণির গর্ভে ক্ষুদিরামের ভক্তির কারাগারে। গদাধর একই আধারে রাম ও কৃষ্ণ, শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর সন্ন্যাস গুরুও সেই কথাই বলেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ যখন তাঁর লীলা প্রকাশ করলেন, তখন একদিন গান গেয়ে ভক্তির মহিমা প্রকাশ করছেন,

 আমি মুক্তি দিতে কাতর নই।

 শুদ্ধাভক্তি দিতে কাতর হই।

 আমার ভক্তি যেবা পায়, তারে কেবা পায়,

 সে যে সেবা পায় হয়ে ত্রিলোকজয়ী।।

শ্রীকৃষ্ণ চন্দ্রাবলীকে বলছেন,

 শুন চন্দ্রাবলী ভক্তির কথা কই,

 মুক্তি মিলে কভু ভক্তি মিলে কই।

 শোনো চন্দ্রাবলী, এক এক করে শোনো,

 ভক্তির কারণে পাতাল ভবনে,

 বলির দ্বারে আমি দ্বারী হয়ে রই।

 শুদ্ধাভক্তি এক আছে বৃন্দাবনে,

 গোপ-গোপী বিনে অন্যে নাহি জানে।

 ভক্তির কারণে নন্দের ভবনে,

 পিতাজ্ঞানে নন্দের বাধা মাথায় বই।

মথুরবাবুর সঙ্গে মথুরায় এসেছেন। ধ্রুবঘাটে দাঁড়িয়ে আছেন। অতীত ভেসে আসছে। নিজেরই অতীত। দেখছেন, বসুদেব যমুনা পার হয়ে যাচ্ছেন। কোলে ধরে আছেন কৃষ্ণকে। সামনে পথপ্রদর্শক সেই শৃগালটি। জন্মাষ্টমীর বিদ্যুৎচকিত সেই দুর্যোগ রাত্রি। বসুদেব যমুনা পার হচ্ছেন।

বৃন্দাবনে আসামাত্রই এমন ভাবাবেশ এল, এক পা-ও হাঁটতে পারছেন না। মথুরবাবু পালকির ব্যবস্থা করে দিলেন। সঙ্গে সদাসর্বদা হৃদয়রাম। মাঝে মাঝে ভাবাবেশে উন্মত্ত হয়ে পালকি থেকে লাফিয়ে পড়ার উপক্রম করলেই হৃদয় জড়িয়ে ধরে থাকতেন। মথুরবাবুর সেবার কী অপূর্ব ব্যবস্থা! একশো পঞ্চাশ টাকার মতো সিকি আর দোআনি হৃদয়ের কাছে দিয়ে রেখেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সাধুবৈষ্ণব দেখলেই হৃদয়কে বলতেন, ওরে কিছু দে, কিছু দে। একদিন গিরিগোবর্ধন দেখে এমনই উন্মত হলেন, যিনি এক পা হাঁটতে পারেন না, তাঁর শরীরে এমন বল এল, সমস্ত বেশভুষা ত্যাগ করে, একেবারে গিরিরাজের মাথায় চড়ে বসলেন। পাণ্ডারা গিয়ে নামিয়ে আনলেন। গিরিগোবর্ধন যে তাঁরই। একদা ধারণ করেছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ যে কুরুক্ষেত্রের গভীর ব্যাখ্যা দিতে এসেছিলেন। কুরুক্ষেত্র বলতে আমরা বুঝি একটি ভৌগলিক অবস্থান। কুরুপাণ্ডবের রণক্ষেত্র। মহারাজ কুরু এই স্থান কর্ষণ করে যজ্ঞ করেছিলেন। করেছিলেন এই কারণে, যে ব্যক্তি এই স্থানে দেহত্যাগ করবেন তিনি স্বর্গলাভ করবেন। সাধারণের মহা উপকারের জন্যেই এই যজ্ঞ। দুটি শব্দ পাওয়া গেল, কর্ষণ আর যজ্ঞ। একটি ফলও পাওয়া গেল, স্বর্গলাভ। আরও একটি জিনিস পাওয়া যাচ্ছে, সেটি হল কুরুক্ষেত্রী যোগ। সূর্যের উদয় হতে পরদিন সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যদি তিন তিথি, তিন নক্ষত্র এবং তিন যোগের স্পর্শ হয়, তবেই কুরুক্ষেত্রী যোগ হয়। এই যোগে তিন একটি সংখ্যা। এই তিনে আমরা কি পাচ্ছি—সত্ব, রজ: তম:। এটি একটি যোগ। দ্বিতীয়, জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম। আর একটি সাংঘাতিক ‘তিন’ হল, ঈড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্মা। যার মূলে মূলাধার। যার আরোহণ পথ ধরে গেলে ষটচক্র পার হয়ে সহস্রার। সেইখানেই স্তব্ধ হয়ে আছে সমাধি।

শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, সাধন সমর। সমরটা, কেমন, রজো দিয়ে তমোকে মার, সত্ব দিয়ে রজোকে কাবু কর, তারপর চলে যাও, তিনগুণের পারে, ত্রিগুণাতীত হও। বললেন, জ্ঞানের পথ ধরে ভক্তিকে আন। জ্ঞান কী? ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু। মানবজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য—ঈশ্বরলাভ। ওইটিই কেল্লা। দুর্যোধন, দু:শাসনাদি ষড়রিপুর সঙ্গে লড়াই কর। জ্ঞান তূণ দিয়ে সব কেটে ফেল। বিচারের ছুরি হাতে তুলে নাও। বিদ্যামায়ার আশ্রয়ে অবিদ্যামায়াকে শেষ করে দাও। পাণ্ডব পক্ষে থাক। পাণ্ডবরা পাঁচ। তাঁরাই শ্রীকৃষ্ণকে সখা হিসেবে পেয়েছিলেন। কৃষ্ণকে পেতে হলে পাঁচুটি ভাব আশ্রয় করতে হবে, শান্ত দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর।

শ্রীরামকৃষ্ণ স্পষ্ট করছেন আরও—

সখ্য অর্থাৎ বন্ধুর ভাব, এসো, এসো কাছে এসে বসো। শ্রীদামাদি কৃষ্ণকে কখন এঁটো ফল খাওয়াচ্ছে, কখনও ঘাড়ে চড়ছে।

বাৎসল্য—যশোদা কৃষ্ণ খাবে বলে ননী হাতে করে বেড়াতেন।

মধুর—যেমন শ্রীমতীর। স্ত্রীরও মধুরভাব। এভাবের ভেতর সকল ভাব—শান্ত, দাস্য সখ্য বাৎসল্য। শান্ত, দাস্য, সখ্য আর বাৎসল্য মধুর রস হরি। শান্ত রসের উদয় কখন হয়, যখন তত্বজ্ঞান আসে। পেছনে পেছনে আসে বৈরাগ্য। সঙ্গী কে? শান্ত ভাব। গভীর ভালোবাসা এলে কী হয়—সালোক্য। সাযুজ্য। সামীপ্যে। গোপীরা প্রেমোন্মত্ত হয়ে বলতে লাগল, ‘আমিই কৃষ্ণ।’

ঠাকুর বোঝাচ্ছেন, ‘অব্যভিচারিণী ভাক্তি যার অপর নাম নিষ্ঠাভক্তি—যেমন, একডেলে গাছ, সোজা উঠেছে। ব্যাভিচারিণী ভক্তি, যেমন পাঁচডেলে গাছ। গোপীদের এমন নিষ্ঠা যে, বৃন্দাবনের মোহনচূড়া পীতধড়া পরা রাখালকৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু ভালোবাসবে না। মথুরায় যখন রাজবেশ, পাগড়ি মাথায় কৃষ্ণকে দর্শন করলে, তখন তারা ঘোমটা দিলে। আর বললে ইনি আবার কে? এঁর সঙ্গে আলাপ করে আমরা কি দ্বিচারিণী হব?’

শ্রীরামকৃষ্ণ রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে গেছেন। রামবাবু বাড়ি তৈরি করেছেন, সিমুলিয়ায় মধু রায়ের গলিতে। বৈশাখী পুর্ণিমায় ফুলদোলের দিন আনুষ্ঠানিক গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে রামবাবু ঠাকুরকে নিয়ে গেছেন। অপূর্ব এক ভক্ত সমাবেশ। প্রভু এসেছেন। শ্রীমদভাগবত শোনাবার আয়োজন করেছেন রামবাবু। উঠোনটি ছোট্ট। আয়োজন কিন্তু ভারী পরিপাটি। বেদি তৈরি হয়েছে। বসেছেন কথক ঠাকুর। হরিশচন্দ্রের কথা হচ্ছে। সেই কথা শেষ হওয়ার পর উদ্ধব সংবাদ।

উদ্ধব বৃন্দাবনে এসেছেন। রাখাল আর ব্রজগোপীরা খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। শ্রীকৃষ্ণসখা উদ্ধব এসেছেন মথুরা থেকে। কেন এসেছেন? উদ্ধব বৃষ্ণিকুলের শ্রেষ্ঠ মন্ত্রী। বৃষ্ণি অর্থাৎ যদুবংশে। যদুবংশের শ্রেষ্ঠ মন্ত্রী বৃহস্পতির শিষ্য অতি বুদ্ধিমান। শ্রীকৃষ্ণ একদিন নির্জনে প্রিয় বন্ধু উদ্ধবের হাত ধরে বললেন, সখা! তুমি একবার ব্রজে যাও। নন্দ-যশোদা তাহলে খুশি হবেন। আর গোপীরা! শুনেছি তারা আমার বিরহে বড়ই কষ্টে আছে। তারা যে আমাগতমনপ্রাণ—তা ** মৎপ্রাণা মদর্থে ত্যাক্তদৈহিকা:। আমার জন্যেই সমস্ত দেহ-স্বার্থ ত্যাগ করেছে। আমি তাদের প্রিয়তম আত্মা। সাধন-ভজন নয়, তারা ** দিয়ে আমাকে পেয়েছে। যে ত্যক্তলোকধর্মাশ্চ মদর্থে তান ভর্ম্যহম। যারা আমার জন্যে লোকধর্ম বিসর্জন দিয়েছে, আমি তাদের পালন করি। তুমি একবার যাও উদ্ধব। আমি যে তাদের বলে এসেছিলাম, আবার আসব। সেই আশাতেই তারা কোনওরকমে বেঁচে আছে।

রথ প্রস্তুত হল। উদ্ধব রথে আরোহণ করলেন। নন্দব্রজে যখন পৌঁছোলেন তখন সূর্য্য অস্ত যাচ্ছে। রথ থেকে নেমে নন্দালয়ের দিকে এগোচ্ছেন। আহা রাতে বৃন্দাবনের কী শোভা। গোপীরা গোদোহন করছেন। রাম ও কৃষ্ণের গুণগাথা গাইছেন। ঘরে ঘরে দীপ। ধুপের গন্ধে বাতাস আমোদিত। দুয়ারগুলি মাল্যশোভিত।

নন্দ শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় সখা উদ্ধবকে কৃষ্ণতুল্য অর্চনা করলেন। উত্তম খাদ্যাদি গ্রহণ ও কিছুক্ষণ শয়নের পর উদ্ধব যখন পথশ্রমের শাস্তি কাটিয়ে উঠলেন, তখন নন্দ বাসুদেবের কুশল প্রশ্ন করলেন। সকলেই বেশ আছেন ভালো আছেন শুনে বললেন, উদ্ধব, গোবিন্দ আমাদের স্বরণ করেন? এই ব্রজধামে তাঁর সুন্দর মুখখানি কি তার একবার দর্শন করা যায় না? কৃষ্ণের নানা লীলার কথা বলতে বলতে নন্দ আর যশোদা কাঁদছেন।

দুজনকে শান্ত করার জন্যে উদ্ধব সুন্দর সুন্দর কথা বলছেন। নন্দ আমাদের জীবন ধন্য। সেই পরমপুরুষ নারায়ণকে তোমরা পালন করেছ। পরমাভক্তি লাভ করেছ। তিনি হয়তো শীঘ্রই ব্রজে আসবেন, তবে একটা কথা জেনে রাখো নন্দ—কাঠের মধ্যে যেমন আগুন লুকিয়ে থাকে সেই রকম তিনিও সকল মানুষের ভেতরেই আছেন। তিনি তো সকলের! তোমরা আমার আমার করে দু:খ পাচ্ছ। শোনো নন্দ, অহংকার মানুষকে সত্য চিনতে দেয় না, জানতে দেয় না। কী রকম জানো—কুমোরের চাকা তোমরা দেখেছ। যখন বাঁইবাঁই করে ঘোরে তখন চাকাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মনে হবে, চাকাটা না মাটিটাই ঘুরছে। ‘আমিই কর্তা’ এই যে অহংকার, এই অহংকার মানুষকে সত্য, দর্শন, সত্য বুঝতে দেয় না। তিনি যেমন তোমাদের, সেইরকম তিনি সর্ব জীবেরই পুত্র পিতা মাতা সখা সুহৃদ। তাঁর * প্রিয় অপ্রিয় উত্তম অধম সমান অসমান মাতা পিতা স্ত্রী পুত্র আত্মীয় পর দেহ জন্ম কর্ম কিছুই নেই। দেহধারণ, জন্মগ্রহণ তাঁর কাছে কখনও খেলা আবার কখনও সাধুগণের পরিত্রাণের জন্যে তিনি * যোনিতেই দেহধারণ করেন,

 ন মাতা ন পিতা ন ভার্ষা ন সুতাদয়:।

 নাত্মীয়ো ন পরশ্চাপি ন দেহো জন্ম এব চ।।

 না চাস্য কর্ম বা লোকে সদসন্মিশ্রযোনিষু।

 ক্রীড়ার্থ: সোহপি সাধুনাং পরিত্রাণায় কল্পতে।

শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনছেন। এ কার কথা। দুচোখে অশ্রুধারা। ভক্তরা অবাক হয়ে তাঁকে দেখছেন। ঠাকুর কথক ঠাকুরকে বলছেন, ‘আপনি ওই কথাটি বলো না, থোলো থোলো কৃষ্ণ।’

কথক ঠাকুর অবাক হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখছেন। ভগবানই যেন ভগবত শুনছেন। তিনি অতি বিনয়ের সঙ্গে বলছেন ‘প্রভু আপনিই বলুন।’

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, ‘কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন—’তুমি আমাকে * বলছ, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই—দেখবে এসো।’ অর্জুন* সঙ্গে গেলেন। খানিক দূরে গিয়ে অর্জুনকে বললেন, ‘অর্জুন কী বলছ?’ অর্জুন বললেন, ‘সখা! বিশাল একটি গাছ। কালো কালো থোলো থোলো ঝুলছে।’ শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হাসতে হাসতে, ‘আর একটু কাছে গিয়ে দ্যাখো। ওগুলো কালো জাম নয়।’ অর্জুন কাছে গিয়ে অবাক হয়ে দেখছেন, যাকে কালো জাম ভেবেছিলাম সেগুলো কালো জাম নয়, থোলো থোলো কৃষ্ণ ফলে রয়েছে। অর্জুন অবাক হয়ে সখাকে দেখছেন। কৃষ্ণ অর্জুনের পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘দেখলে? আমার মতো কত কৃষ্ণ ফলে রয়েছে। থোলো থোলো কৃষ্ণ।’

ঠাকুর অল্পক্ষণ নীরব থেকে বললেন, ‘কবীর দাস শ্রীকৃষ্ণের কথায় বলেছিল, তুমি গোপীদের হাততালিতে বানর নাচ নেচেছিলে, তোমার কথা আর কী বলব! শোনো কথাটা হল, এই, ভগবানের দিকে যত এগোবে উপাধি ততই কম দেখতে পাবে। ভক্ত প্রথমে দর্শন করলে দশভুজা। আরও এগিয়ে গিয়ে দেখলে ষড়ভুজ। আরও এগিয়ে গিয়ে দেখছে দ্বিভুজ গোপাল। যত এগোচ্ছে ঐশ্বর্য কমে যাচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সখা হয়ে কাঁধে হাত রেখে। আরও এগোও, আরও এগোও। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ চলছে। শ্রীমুখের গীতা এগোচ্ছে—বিষাদ থেকে সাংখ্য। কোথায় আছে, কী করছ! কে তুমি? আমিই বা কে? পূর্বে আমি কখনও ছিলাম না, তুমি কখনও ছিলে না, এমন নয়। এটা সত্য নয়। এই দেহধারণের পূর্বে আমরা সকলেই নিত্য আত্মরূপে ছিলাম। এই দেহত্যাগের পরেও যে আমরা কেউ থাকব না, তাও নয়। বর্তমানে দেহ আছে বটে, কিন্তু আমরা নিত্য আত্মস্বরূপ, ভবিষ্যতে দেহ যদি না-ও থাকে আমরা নিত্য আত্মরূপে থাকব। আমি মাঝে মাঝে এদের বলি, মনে করো সূর্য আর দশটি জলপূর্ণ ঘট রয়েছে, প্রত্যেক ঘটে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। প্রথমে দেখা যাচ্ছে, একটি সূর্য ও দশটি প্রতিবিম্ব সূর্য। যদি ন’টা ঘট ভেঙে দেওয়া যায়, তাহলে বাকি থাকে একটি সূর্য ও একটি প্রতিবিম্ব সূর্য।

এক-একটি ঘট যেন এক-একটি জীব। প্রতিবিম্ব সূর্য ধরে ধরে সত্য সূর্যের কাছে যাওয়া যায়। জীবাত্মা থেকে পরমাত্মায় পৌঁছোনো যায়। জীব যদি সাধন-ভজন করে তাহলে পরমাত্মা দর্শন করতে পারে। কী রকম, শেষের ঘটটি ভেঙে দাও। ভেঙে দিলে কী আছে মুখে বলা যায় না।’

ঠাকুর ভাবস্থ নির্বাক। হঠাৎ বললেন, ‘সাংখ্য যোগের ওই জায়গাটি বলো না, যাবানর্থ উদপানে….’

কথক ঠাকুর বললেন, ‘আজ্ঞে,

 যাবানর্থ উদপানে সর্বত: সংপ্লুতোদকে।

 তাবান সর্বেষু বেদেষু ব্রাহ্মণস্য বিজানত:।।

প্লাবনে মাঠ ঘাট সব ভেসে যায় যখন, যখন কোনটা কূপ, ক্ষুদ্র জলাশয় কোনটি বোঝারই দরকার থাকে না, প্লাবনে র জলে ঘট ডোবালেই জলভরা ঘট।’

ঠাকুর বললেন, ‘এই দ্যাখো, ব্রহ্মকে জানলে, পূর্ণজ্ঞান হলে দেখা যাবে, সেই জ্ঞানে সব জ্ঞান তলিয়ে আছে। আমি বলি, মনুষ্যজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ঈশ্বরলাভ করা। মানুষকে বাঁচতে হলে কাজ করতে হবে অবশ্যই। তবে, কাজের জন্য বাঁচতে আসিনি। ঈশ্বরলাভের জন্যেই জীবন। সব কাজ তোমার কাজ। তোমাকে পাওয়া ছাড়া আর আমার কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই। দ্যাখো, ঈশ্বরকে পেতে চাওয়াও এক আকাঙ্খা, শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সেটিও ত্যাগ করো। এটি হল জ্ঞানের কথা, চরম জ্ঞানের কথা। বেদান্ত বিচার করে দেখাচ্ছেন, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। তোমরা বিচারের একটা গল্প শোনো—’এক রাজার সামনে একজন ভেলকি দেখাতে এসেছিল। একটু সরে যাওয়ার পর রাজা দেখলে, একজন সওয়ার আসছে। ঘোড়ার ওপর চড়ে, খুব সাজগোজ—হাতে অস্ত্রশস্ত্র। সভাসুদ্ধ লোক আর রাজা বিচার কচ্ছে, এর ভেতর সত্য কোনটা। ঘোড়া তো সত্য নয়, সাজগোজ, অস্ত্রশস্ত্রও সত্য নয়। শেষে সত্যই সত্য দেখালে, যে সওয়ার, সে একলা সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

‘তবে ব্রহ্ম একেবারে শেষে। ব্রহ্ম সত্য, মায়াও সত্য। এই আমি বলি ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরও সেই একই কথা। মায়া জেনে নিষ্কাম কর্ম। তাই গীতায় সাংখ্যের পর কর্মযোগ। তারপর জ্ঞানযোগ। তারপর সন্ন্যাসযোগ। তারপর ধ্যান, তারপর জ্ঞানবিজ্ঞান, তারপর অক্ষরব্রহ্ম, তারপর রাজযোগ। রাজযোগের পর বিভূতিযোগ। ভগবান বলছেন, আমিই সব, আমাতেই সব। তার পরেই ভগবান অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখালেন। আহা! অর্জুন বললেন, হে পুরুষোত্তম, আপনার জ্ঞান, ঐশ্বর্য, শক্তি, বল, বীর্য তেজোময় বিশ্বরূপ দেখতে চাই। সেরূপ অর্জুনের মতো বীরও সহ্য করতে পারলেন না। ভীষণের চেয়ে ভীষণ, ভয়ের চেয়েও ভয়াল। সংবরণ করুন এই ভয়ঙ্কর রূপ। কে আপনি! আকাশ-বাতাস প্রতিধ্বনিত করে ভগবান বললেন—আমি কাল। এর পরেই ভক্তিযোগ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুদ্ধ শেষ। ভক্তের ভগবান।’

কথক বললেন, ‘আজ্ঞে সেই জায়গাটিই ধরে বসে আছেন ব্রজধামের সহজ, সরল রাখাল আর গোপীরা, উদ্ধবের কাছে ছুটে এসে ঘিরে ধরে জিগ্যেস করছেন, কেমন আছেন শ্রীকৃষ্ণ? তিনি কি আমাদের ভুলে গেছেন? তিনি কি আমাদের নাম করেন? বলছেন, আর কাঁদছেন। গোপীরা উদ্ধবকে নিয়ে বৃন্দাবন পরিক্রমায় বেরিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণের লীলাস্থল সব দেখাচ্ছেন। লীলা বর্ণনা করছেন।

এইখানে শ্রীকৃষ্ণ গোবর্ধন ধারণ করেছিলেন। এই স্থানটিতে ধেনুকাসুর বধ, এইখানে শকটাসুর বধ। এই মাঠে গরু চরাতেন, এই যমুনাপুলিনে তিনি বিহার করতেন। এখানে রাখালদের নিয়ে খেলা করতেন।

উদ্ধব গোপীদের জ্ঞানের কথা বলছেন। শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে আরও যেকারণে বৃন্দাবনে পাঠিয়েছিলেন সেই কারণটি হল, উদ্ধব ভক্তি বুঝতেন না, তিনি জ্ঞানমার্গী। উদ্ধবকে ভক্তি চেনাতে, ভক্তি বোঝাতে কাদের কাছে পাঠালেন! না গোপীদের কাছে!’

ঠাকুর বললেন, ‘ভজনানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, এই আনন্দই সুরা; প্রেমের সুরা। মানবজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরে প্রেম, ঈশ্বরকে ভালোবাসা। ভক্তিই সার। জ্ঞান বিচার করে ঈশ্বরকে জানা বড়ই কঠিন। দেখলে না, শ্রীকৃষ্ণ গীতায় সব শেষে এলেন ভক্তিতে।’

কথক ঠাকুর বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, বললেন, তেষামহং সমৃদ্ধর্তা মৃত্যুসংসার সাগরাৎ/ভবামি চ চিরাৎ পার্থ ময্যাবেশিতচেতসাম/হে পার্থ, সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণ করো। একমাত্র আমিই উপাস্য। যোগ হল, আমার উপাসনা, আমার ধ্যান। আমার ভক্তকে আমি মৃত্যুময় এই সংসারসাগর থেকে অসিচরে উদ্ধার করি।’

ঠাকুর বললেন, ‘ভক্তি থেকে ভালোবাসা। কেমন ভালোবাসা, যেমন বৃন্দাবনে গোপ-গোপীরা, রাখালরা, শ্রীকৃষ্ণকে ভালোবাসত। শ্রীকৃষ্ণবিচ্ছেদে বিরহ। কেঁদে কেঁদে বেড়াত। গোপীদের কৃষ্ণের ওপর যেরকম টান ছিল, সেই টানটা নিতে হবে। গোপীদের ব্যাকুলতা গোপীদের কেমন প্রেম, কেমন ভালোবাসা! শ্রীমতী স্বহস্তে শ্রীকৃষ্ণের চিত্র এঁকেছেন, কিন্তু পা আঁকেননি, পাছে তিনি মথুরায় চলে যান। বুঝলে, এই হল, ব্যাকুলতা, এই হল ভাব। অত্রুর শ্রীকৃষ্ণকে রথে বসিয়ে মথুরায় নিয়ে যাচ্ছেন দেখে গোপীরা রথচক্র আঁকড়ে ধরেছেন কেউ কেউ রথের সামনে পথের ওপর শুয়ে পড়েছেন। শোনো, একটা উপায় বলি, সাধন পথের কথা, সকলের ভেতরেই তিনি রয়েছেন। তবে গ্যাস কোম্পানিকে আর্জি করো। তোমার ঘরের সঙ্গে যোগ হয়ে যাবে। তবে ব্যাকুল হয়ে আর্জি করতে হয়। তিন টান একসঙ্গে হলে ঈশ্বরদর্শন হয়। সন্তানের ওপর মায়ের টান, সতী স্ত্রীর স্বামীর ওপর টান আর বিষয়ীর বিষয়ের ওপর টান। ঠিক ভক্তের লক্ষণ জাতসম্পন্ন স্থির হয়ে শোনে, কিন্তু কেউটে নয়। আর একটি লক্ষণ আগে গুরুর উপদেশ শুনে স্থির হয়ে থাকে বেহুলার গানের কাছে। ঠিক ভক্তের ধারণা শক্তি হয়। শুধু কাচের ওপর ছবির দাগ পড়ে না, কিন্তু ** মাখানো কাচের ওপর ছবি ওঠে, যেমন ফটোগ্রাফ, ভক্তিরূপ আর একটি লক্ষণ, ঠিক ভক্ত জিতেন্দ্রিয় হয়, কামজয়ী হয়, গোপীদের কাম হত না। ওদেশে শ্যামবাজারে নটবর গোস্বামীর বাড়িতে কীর্তন হচ্ছিল—ভাবে দেখলাম, গোপী পরিবৃত শ্রীকৃষ্ণের সমাধি হয়ে গেল! বোধ হল আমার লিঙ্গ শরীর শ্রীকৃষ্ণের পায়ে পায়ে বেড়াচ্ছে। এক মতে আছে যশোদাদি গোপীগণ পূর্বজন্মে নিরাকারবাদী ছিলেন। তাঁদের তাতে তৃপ্তি হয়নি। বৃন্দাবনলীলায় তাই শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে এত আনন্দ! শ্রীকৃষ্ণ একদিন বললেন, তোমাদের নিত্যধাম দর্শন করাব, এসো যমুনায় স্নান করতে যাই, তাঁরা যেই ডুব দিয়েছেন একেবারে গোলকদর্শন। আবার তারপর আবার জ্যোতি:দর্শন। যশোদা তখন বললেন, কৃষ্ণ রে ওসব আর দেখতে চাই না—এখন তোর সেই মানুষরূপ দেখব। তোকে কোলে করে খাওয়াব। গোপীদের ভক্তি কেমন জানো, প্রেমাভক্তি। প্রেমাভক্তিতে দুটি জিনিস থাকে—অহংতা আর মমতা। আমি কৃষ্ণকে সেবা করলে কৃষ্ণের অসুখ হবে—এর নাম অহংতা। এতে ঈশ্বরবোধ থাকবে না। মমতা—’আমার আমার করা। পাছে পায়ে কিছু আঘাত লাগে গোপীদের এত মমতা, তাদের সূক্ষ্ম শরীর শ্রীকৃষ্ণের চরণে থাকত। যশোদা বললেন, তোদের চিন্তামণি-কৃষ্ণ জানি না,—আমার হৃদয়বল্লভ।’ আমার গোপাল! গোপীরাও বলছে, ‘কোথায় আমার প্রাণবল্লভ!’ ঈশ্বরবোধ নেই। তাই নরীলালায় অবতারকে ঠিক মানুষের মতো আচরণ করতে হয়, তাই অবতারকে চিনতে পারা কঠিন। ** হয়েছেন তো ঠিক মানুষ। সেই ক্ষুধা-তৃষ্ণা, রোগশোক, কখন ভয়—ঠিক মানুষের মতো। রামচন্দ্র সীতার শোকে কাতর হয়েছিলেন, গোপাল নন্দের জুতো মাথায় করে নিয়ে গিয়েছিলেন—পিঁড়ে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।’

ঠাকুর একটুক্ষণ নীরব থেকে কথক ঠাকুরকে বললেন, ‘এই দ্যাখো বলছিলে তুমি, এখন বলছি আমি।’

কথক ঠাকুর সবিনয়ে বললেন, ‘আপনারই তো কথা। তাই যে অমৃত লাগছে,

তব কথামৃতং তপ্তজীবনং কবিভীরীড়িতং কল্মষাপহম।

শ্রবণমঙ্গলং শ্রীমদাততং ভুবি গৃণন্তি যে ভূরিদাজনা:।

উদ্ধব তো শ্রীকৃষ্ণের এই বার্তা নিয়েই ব্রজে এসেছিলেন। গোপীরা কৃষ্ণবিচ্ছেদে কাতর। এই দু:খ নিবারণের উপায় তোমরা কৃষ্ণের কথা শোনো। উদ্ধব! তুমি তাদের কৃষ্ণকথা শোনাও। বলল, কৃষ্ণ তোমাদের ভোলেননি, তোমরা যেমন তাঁর জন্য কাতর, তিনিও তেমনি তোমাদের জন্য কাতর। মথুরার কাজ শেষ করে আবার তিনি ব্রজে আসবেন। আবার বাঁশি বাজবে, রাখালের বাঁশি।

‘উদ্ধবকে গোপীরা শ্রীকৃষ্ণের লীলাস্থল দেখাচ্ছেন, লীলা বর্ণনা করছেন। কাঁদছেন, হাসছেন, বিমর্ষ হচ্ছেন। উদ্ধব তো জ্ঞানী। ভক্তি কেমন, আবেগ কেমন, বিরহ কাকে বলে জানেন না। তিনি অবাক হচ্ছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘শ্রীমতীর এরূপ বিরহানল চোখের জল সেই আগুনের ঝাঁজে শুকিয়ে যেত—জল হতে হতে বাষ্প হয়ে উড়ে যেত।’

কথক ঠাকুর বললেন, ‘উদ্ধব নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছেন। কেন কাতর হচ্ছেন আপনারা! আপনাদের মনেই তো তিনি বসে আছেন। গোপীরা বললেন, শুনুন, আমরা ওসব বুঝি না। বুঝতে পারিও না। আমরা লেখাপড়া কিছুই জানি না। কেবল আমাদের বৃন্দাবনের কৃষ্ণকে জানি, কৃষ্ণের লীলা জানি আর মন? আমাদের দেহ, মন দুটোই কৃষ্ণকে দিয়ে দিয়েছি। উদ্ধব বলছেন, মুক্তি! তিনি সাক্ষাৎ ভগবান, তাঁকে চিন্তা করলে এ সংসারে আর আসতে হয় না। গোপীরা উত্তেজিত হয়ে বলছেন, মুক্তি-ফুক্তি আমরা চাই না ঠাকুর, আমরা আমাদের প্রাণকৃষ্ণকে দেখতে চাই।’

ঠাকুর গভীর সমাধিতে। সমাধি থেকে নেমে এসে বলছেন, ‘দুটি কথা শুনে রাখ, মা আমায় জানিয়ে দিয়েছেন, বেদান্তের সার—ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। গীতার সার—দশবার গীতা বললে যা হয়, অর্থাৎ তাগী, তাগী নবদ্বীপের পণ্ডিত বলেছিলেন, তাগী আর ত্যাগী এক। ত্যাগী মানেও যা তাগী মানেও তাই। হে জীব, সব ত্যাগ করে ভগবানকে পাবার জন্যে সাধন কর।

‘দ্বিতীয় কথাটি হল, ভীষ্মদেব দেহত্যাগ করবেন। শরশয্যায় শুয়ে আছেন। পাণ্ডবেরা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সব দাঁড়িয়ে। তাঁরা দেখলেন যে ভীষ্মদেবের চোখ দিয়ে জল পড়ছে। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, ভাই, কী আশ্চর্য! পিতামহ, যিনি স্বয়ং ভীষ্মদেব, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয়, জ্ঞানী অস্টবসুর এক বসু, তিনিও দেহত্যাগের সময় মায়াতে কাঁদছেন। শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মদেবকে এ কথা বলাতে তিনি বললেন, কৃষ্ণ, তুমি বেশ জানো, আমি সেজন্য কাঁদছি না! যখন ভাবছি যে, যে পাণ্ডবদের স্বয়ং ভগবান নিজে সারথি, তাদেরও দু:খ-বিপদের শেষ নেই। তখন এই মনে করে কাঁদছি যে— ভগবানের কার্য কিছুই বুঝতে পারলাম না।’

‘জানো, একজন এসে আমাকে বললে, ইয়াকুব খাঁ সিংহাসনচ্যুত হয়েছেন তিনি কিন্তু খুব ভক্তলোক ছিলেন। আমি তাকে বলেছিলুম, কী জানো, সুখ-দু:খ দেহধারণের ধর্ম। কবিকঙ্গণ চণ্ডীতে আছে যে কালুবীর জেলে গিয়েছিল; তার বুকে পাষাণ দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কালুবীর ভগবতীর বরপুত্র। শ্রীমন্ত বড় ভক্ত। তার মা খুল্লনাকে ভগবতী কত ভালোবাসতেন। সেই শ্রীমন্তের কত বিপদ। মশানে কাটতে নিয়ে গেল। একজন কাঠুরে পরম ভক্ত, ভগবতীর দর্শন পেলে। তিনি কত ভালোবাসলেন, কত কৃপা করলেন। কিন্তু তার কাঠুরের কাজ আর ঘুচল না। সেই কাঠ কেটেই আবার খেতে হবে কারাগারের চর্তুভুজ শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী ভগবান দেবকীকে দর্শন দিলেন; কিন্তু কারাগার ঘুচল না। কি জানো, প্রারদ্ধ কর্মের ভোগ। যে ক’দিন ভোগ আছে, দেহধারণ করতে হয়। একজন কানা গঙ্গাস্নান করলে। পাপ সব ঘুচে গেল। কিন্তু কানা চোখ আর ঘুচল না।

‘তাহলে রইল কি—দেহের সুখ-দু:খ যাই হোক, ভক্তের জ্ঞান, ভক্তের ঐশ্বর্য তাকে, সে ঐশ্বর্য কখনও যাবার নয়। পাণ্ডবদের অত বিপদ—তারা কিন্তু একবারও চৈতন্য হারায়নি।’

 চৈতন্য। চৈতন্য। চৈতন্য।

একটি পালকি চলেছে বৃন্দাবনের পথ ধরে। পাশে পাশে চলেছেন দীর্ঘদেহী পুরুষ। তাঁর নাম হৃদয়। পালকির দরজাটি খোলা। ভেতরে বসে আছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। হাতে একটি কাঁচা কঞ্চির ছড়ি! একটি প্রান্তরে একঝাঁক সাদা ময়ূর। তিনি লাফিয়ে পড়েন আর কী! হে কৃষ্ণ! হা কৃষ্ণ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *