শ্রীরামকৃষ্ণের দণ্ড
আমার দ্বারা যা সম্ভব হবে না, তোমাকে তা করতে হবে। আমি প্রকৃতি, তুমি পুরুষ। আমি কর্তা, তুমি কর্ম। প্রথমে তুমি আমাকে বাজাও। তোমার সংশয়ে, তোমার বিশ্বাসে, তোমার অবিশ্বাসে, তোমার বিলিতি বিদ্যায়, তোমার কান্ট, হেগেল, হিউম, স্পিনোজা, ডেকার্ট, হবস-এ তুমি আমাকে প্রেক্ষণ কর। উনবিংশের শহরজীবনের প্রেক্ষায় আমাকে নিরীক্ষণ কর। আমি পোশাকি সভ্যতাকে বর্জন করেছি। আমার তন্ত্র নেই, মন্ত্র নেই, আমি আকাশের মতো উদার। আমি কেতাবি জ্ঞানকে উপেক্ষা করেছি এই সত্য প্রমাণে যে, প্রকৃত জ্ঞান উদিত হয় ঠিক সূর্যোদয়ের মতো। হাজার বছরের অন্ধকার একটি দেশলাইকাঠির আলোকে নিমেষে আলোকিত হয়। আমি এই প্রমাণ করতে চেয়েছি—আমি যা বলব, আমার পিছনে শাস্ত্রগণ ‘যো হুজুর’ বলে হাজির থাকবেন। তুমি যা বলছ, এই তো আমাতে রয়েছে। আমি প্রমাণ করব, জ্ঞান আগে চলে পিছনে চলে শাস্ত্র। তোমার প্রিয় গ্রন্থ ‘ইমিটেশন অফ ক্রাইস্ট’-এ টমাস আ কেম্পিস যে-কথা বলেছেন, আমি তার প্রমাণ—
“How happy a man is when the truth teaches him directly, not through symbols and words that are soon forgotten, but by contact with itself.”
সেই মানুষ কত আনন্দিত হয়, যখন সত্য স্বয়ং এসে তাকে শেখায়। প্রতীক ও বর্ণমালার মাধ্যমে যে-শিক্ষা, তার স্মৃতি-বিস্মৃতি আছে; কিন্তু সত্য যখন নিজে এসে উদিত হন তখন ভরপুর আনন্দ। শোন নরেন্দ্র, উপমা অথবা তুলনাটা এইভাবেও করা যায়, যেমন—একটি মেয়ের সদ্য বিবাহ হয়েছে। সে এইবার বাপের বাড়িতে এসেছে। বান্ধবীরা সবাই ঘিরে ধরে জিজ্ঞেস করছে, ভাই সে কেমন! সেই ‘কেমন’টা বর্ণনা করা যায়, উপলব্ধিটা আসে না। সেই ‘কেমন’-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ যোগে উপলব্ধি আসে। আমার দেহাবসানের পর তুমি এই কথাই অন্যভাবে বলবে। জ্ঞান অন্তরেই আছে, বিকাশই হলো শিক্ষা। চিন্তা স্বাধীন। আরোপ হলো বন্ধন। পরাধীনতা।
তিন থাকে সাজিয়ে গেলাম মানুষের মনের ধারাকে—অজ্ঞান, জ্ঞান আর বিজ্ঞান। জগৎ-কারণস্বরূপ সেই পরমেশ্বরকে অস্বীকার করার নাম অজ্ঞান—সে তুমি বি.এ., এম.এ., ডক্টরেট, ডি.ফিল—যাই হও না কেন। তিনিই সব, তিনিই সব করাচ্ছেন, মানুষ যন্ত্রমাত্র—এই বোধের উদয় হলো জ্ঞান। আর বিজ্ঞান! তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। সমগ্র একটা হাতিকে সে স্বচক্ষে দেখেছে। স্পর্শনজ্ঞান নয়—দর্শন। তখন ‘জ্ঞান’ শব্দটাই লোপাট, তখন অনুভূতি, তখন আস্বাদন। স্বামী কেমন? যতভাবেই বলি না কেন, মস্ত বড় একটা দিক–আস্বাদনের দিক-সেটি বলা যাবে না। সেটি পেতে হলে স্বামিসঙ্গ করতে হবে। পাখি ওড়ে, আমি জানি। এটি জ্ঞান। বিজ্ঞানে যেতে হলে আমাকে উড়তে হবে নীল আকাশে পাখা মেলে।
তুমি আমাকে পরীক্ষা করলেই বুঝবে, তুমি যেখানে যেতে চাইছ জ্ঞানের পথ ধরে, আমি সেইখান থেকেই এসেছি—ওদিক থেকে এদিকে। আমি জাত নই, আমি অবতীর্ণ। “I am not born, I have descended.” তোমরাই আমাকে ‘অবতার’ করবে, আমি কিন্তু কোন বিশেষণের পরোয়া করি না, তুমিও আমাকে কোন বিশেষণে ভূষিত করতে চাইবে না; কারণ তুমিও আমার মতো প্রথাভাঙা, সংস্কারভাঙা এক বিদ্রোহী। তুমি আর আমি কোন একটি কালে বদ্ধ থাকব না, আমরা হব সর্বকালের, সর্বধর্মের। আমাদের দেবতা মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায় থাকবেন না; তিনি থাকবেন সর্বভূতে শিব হয়ে। সেই শিবের সেবাই হবে আমাদের ফলিত ধর্ম। আমি ‘গুরু’ হতে আসিনি, আমি এসেছি মানুষের গরিমা বাড়াতে।
আমি যেমন তোমাকে ধরতে পারব, তুমিও সেইরকম ধরতে পারবে আমাকে। এ যেন সেই সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। রতনের রতন চেনা। কদর্থে নয়, সদর্থে। প্রথম যেদিন দেখা হলো দক্ষিণেশ্বরে, মনে পড়ে নিশ্চয়! মনের আবেগে তোমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম উত্তরের নির্জনের ঝাঁপফেলা বারান্দায়। তুমি ভেবেছিলে, গোটা কতক সাধারণ উপদেশ দিয়ে তোমাকে ছেড়ে দেব। চিরাচরিত পথে তোমাদের শ্রীরামকৃষ্ণ চলে না বাছা। আমি তখন তোমার হাত-দুটি ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম : “এতদিন পরে আসতে হয়! আমি তোমার জন্যে কিভাবে প্রতীক্ষা করে রয়েছি, তা একবার ভাবতে নেই? বিষয়ী লোকের বাজে প্রসঙ্গ শুনতে শুনতে আমার কান ঝলসে যাবার উপক্রম হয়েছে; প্রাণের কথা কাউকেও বলতে না পেয়ে আমার পেট ফুলে রয়েছে।” সেদিন করজোড়ে এই বলে তোমার বন্দনা করেছিলাম, যেন কোন দেবতার বন্দনা—”প্রভু! আমি জানি, তুমি সেই পুরাতন ঋষি, নররূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করিতে পুনরায় শরীরধারণ করিয়াছ।”
নরেন্দ্রের অহং-এর আবরণ ভেঙে স্বামী বিবেকানন্দকে মুক্ত করাই ছিল আমার কাজ। আমি দর্পণ, তুমি বিম্ব। তুমি রথ, আমি রথী। তুমি সচেতন যন্ত্ৰ, আমি যন্ত্রী। আমি গোখরো। আমি আর তুমি গুরু-শিষ্য নই, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আমি মৰ্ম, তুমি কর্ম। আমি মন্ত্র, তুমি তন্ত্র। আমি শক্তি, তুমি শাক্ত। আমি বলেছিলাম, তোমার মধ্য দিয়ে ঘটবে আমার সিদ্ধাইয়ের কিঞ্চিৎ প্রকাশ। আমি বিন্দু, তুমি চরাচর। এমন প্রেম, এমন ভালবাসা তুমি কারো কাছে পেয়েছিলে কি? আমার চেনা দিয়ে তুমি নিজেকে চিনেছিলে। আমার ধর্মের তো একটিই কথা ছিল—ঈশ্বর নয়, নিজেকে চেন। চৈতন্য। তার জন্য একটি শলাকাই যথেষ্ট, সেটি হলো জ্ঞান। আমি একালের, সর্বকালের সার কথা সেকালেই বলে গেছি—”Don’t think God as a being, God is Being.” সর্বভূতে তিনি রেণু রেণু হয়ে আছেন। তুমি আমার সাধনার অনির্বাণ ধুনি।
তাই তো তুমি বলতে পারবে—
“এখন সিদ্ধান্ত এই যে—রামকৃষ্ণের জুড়ি আর নাই, সে অপূর্ব সিদ্ধি, আর সে অপূর্ব অহেতুকী দয়া, সে intense sympathy বদ্ধজীবনের জন্য—এজগতে আর নাই। হয়, তিনি অবতার—যেমন তিনি নিজে বলিতেন, অথবা বেদান্তদর্শনে যাঁহাকে নিত্যসিদ্ধ মহাপুরুষ “ লোকহিতায় মুক্তোঽপি শরীরগ্রহণকারী’ বলা হইয়াছে, নিশ্চিত নিশ্চিত ইতি মে মতিঃ, এবং তাঁহার উপাসনাই পাতঞ্জলোক্ত ‘মহাপুরুষ-প্রণিধানাদ্বা’।”
তুমি উঠলে চৈতন্যসাগরে স্নাত হয়ে! রোমাঁ রোলাঁ আমার সম্বন্ধে বলবেন : “Paramhansa-the Indian Swan-rested his great white wings on the sapphire lake of eternity beyond the veil of tumultous days.
আর তোমার সম্পর্কে বলবেন : “The spirit with the widest wings-Vivekananda.”
আমি চৈতন্যসাগরের হংস, তুমি আমার ওড়ার শক্তি।
ঘরে ঘরে আজ তোমার দৃপ্ত পরিব্রাজক-মূর্তি। তোমার হাতে ধরা বিশাল এক দণ্ড। ঐ দণ্ডের স্বরূপ কি জান তুমি? ওটি শ্রীরামকৃষ্ণ। তোমার সঙ্গে আমি দেশে দেশে বেড়াই ভেসে।
প্রথমে আমি তোমাকে ধরেছিলাম, পরে তুমি আমাকে ধরলে।
সংশয় হতে এলে সত্য সদনে। “শ্রীরামকৃষ্ণপ্ৰণিধানাদ্বা।“
আমি শাস্ত্র, তুমি ব্যাখ্যা।।