শ্মশানবন্ধু
নাইট ডিউটির সময়টাতেই সবচেয়ে অসুবিধে হয়। দিনেরবেলা এখন পর্যন্ত তেমন কিছু গণ্ডগোল হয়নি। একটু-আধটু অপমান সহ্য করতে হয়, তা এমন কিছু নয়। অপমান গায়ে না মেখে বালির মতন ঝেড়ে ফেললেই হল।
সকালের ডিউটি নটা থেকে তিনটে পর্যন্ত। ঠিক তিনটের সময় বাড়ি ফেরার ট্রাম ধরে অমল। রাস্তায় ট্রাফিকের গোলযোগ না থাকলে পৌনে চারটের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যায়, বেহালার ট্রাম স্টপ থেকে মাত্র দশ-পা দূরে বাড়ি। অমলের পকেটে চাবি রাখতে হয়, এসময় বাড়িতে আর কেউ থাকে না, অমলকেই দরজা খুলে ঢুকতে হয়।
মায়ের ফিরতে-ফিরতে সাড়ে চারটে বেজে যায়, তিনি এসে চায়ের জল চাপান। মাঝখানের এই সময়টুকুই টেলিফোনের পক্ষে আদর্শ। মিলিকে সে বলে দিয়েছে, অফিসে যাতে কোনও ক্রমেই ফোন না করে, এই ব্যাপারে অফিসে খুব কড়াকড়ি চলছে। ব্যক্তিগত ফোন অপছন্দ করা হয়, ফোন রিসিভ করলেও লাইন আটকে রাখা বরদাস্ত করা হয় না। অমল নিজেই ফোন করবে। এখন বাড়িতে শুয়ে-শুয়ে বেশ আরামে গল্প করা যায় মিলির সঙ্গে। একটু-আধটু অসভ্য কথাও বলা যেতে পারে।
মিলি প্রায় প্রত্যেকদিনই জিগ্যেস করে, আজ অফিসে কী হল? সেরকম কোনও খবর এসেছে?
সকাল বা দুপুরে কোনও জবর খবর আসে না। বড়-বড় ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে সন্ধের পর। মিলির ধারণা, খবরের কাগজের লোকেরা অনেক কিছুই আগেভাগে জেনে যায়, তাই সে-ও জেনে নিতে চায়।
এই সময়টায় চতুর্দিকে গাদাখানেক বই ছড়িয়ে খাটের ওপর বসে থাকে মিলি, আর এক মাসের মধ্যে তাকে পি এইচ ডি-র থিসিস জমা দিতে হবে। সেটা লেখাও শেষ হয়ে গেছে, এখন কারেকশান চলছে, তারপর টাইপ করা, কপি মিলিয়ে দেখা, তাই মিলি বাড়ি থেকে বেরুতেই পারে না। অফিসে একদিন ছুটি নিয়ে অমল আড্ডা দিতে গিয়েছিল, মোটেই আড্ডা জমেনি, মিলির মুখে এখন শুধু তার থিসিসের কথাই ঘুরেফিরে আসে। অত পড়াশুনোর কথা অমলের ভালো লাগে না। জ্ঞানের কথায় প্রেম আড়ালে চলে যায়।
বিকেলের ডিউটি পরের সপ্তাহে তিনটে থেকে নটা। ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা তো হতেই পারে। সর্বক্ষণই যদি অফিসের কাজ করবে, তা হলে সে বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দেবে। কখন? অমলের বাবারও একটু রাত করে বাড়ি ফেরা স্বভাব। তিনি এক-একদিন তাঁর এক বন্ধুর বাড়ি থেকে মদ্যপান করে আসেন। তবে বেচাল হন না কোনওদিন।
তার পরের সপ্তাহ থেকে শুরু হয় নাইট ডিউটি। নটা থেকে রাত তিনটে। এর মধ্যে ঘুমোবার কোনও উপায় নেই। অবশ্য তিনটে পর্যন্ত থাকতে হয় না। দুটো-আড়াইটের মধ্যেই পেজ মেকআপ হয়ে যায়, তারপর বাড়ি ফেরা। আগেকার দিনে নাকি নাইট ডিউটির পর সবাই অফিসেই শুয়ে পড়ত, এখন আর সে নিয়ম নেই, অফিসের গাড়ি সেই নিশুতি রাতে সবাইকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। অত রাতে বাড়ির লোককে খুলে দিতে হয় দরজা।
অমলের কাছে অবশ্য চাবি থাকে।
পরশু রাতে রাত তিনটের সময়েও মা জেগে ছিলেন। তাঁর উপন্যাস পড়ার নেশা। এক একটা বই। ধরার পর শেষ না হলে ছাড়েন না। রাত্তির ছাড়া তাঁর পড়াশুনোর আর সময়ও তো নেই। তাঁর স্বামীর মতন তিনিও চাকরি করেন, তবু সংসারের সব কাজ তো তাঁকেই সামলাতে হয়।
উপন্যাস পড়তে-পড়তেও মাঝে-মাঝে ঘড়ির দিকে চোখ রাখছিলেন মা। অমল জানে না। অন্যান্য রাতেও ছেলে বাড়ি ফেরার সময় একবার তিনি জেগে ওঠেন। তাঁর ঘুম খুব পাতলা। সেদিন তিনি রাত তিনটের সময় গাড়ি থামার শব্দ পেয়ে দাঁড়িয়েছিলেন জানলার পাশে।
অমল যথাসম্ভব কম শব্দ করে দরজা খোলে। তারপর পা টিপে টিপে নিজের ঘরে চলে যায়। দিদির বিয়ের পর সে একটা নিজস্ব ঘর পেয়েছে। শিয়রের কাছে রাখা থাকে জলের বোতল।
মা এসে বললেন, হ্যাঁ রে খোকা, তুই আজ ট্যাক্সিতে এলি কেন? অফিসের গাড়ি কী হল?
হঠাৎ কেঁপে উঠল অমল।
মায়ের সামনে মিথ্যে কথা বলতে হলে সে সরাসরি চোখের দিকে তাকায় না। মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখে।
তারপরেই সে বলল, রাত্তিরের দিকে যে গাড়িগুলো দেয়, ভাড়াগাড়ি তো, সব লঝঝড়ে, ড্রাইভারগুলো শেষ রাত্তিরে এত জোরে চালায়, আজ গাড়িটা একটা ল্যাম্প পোস্টে ধাক্কা মারল–
মা নিদারুণ উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললেন, অ্যাঁ! কোথায় লেগেছে তোর!
অমল বলল, ফরচুনেটলি আমার কোথাও লাগেনি, ড্রাইভারটিরই কপাল ঠুকে গেছে, কিন্তু গাড়ি আর স্টার্ট নিল না। পরিতোষ ছিল আমার সঙ্গে। বাধ্য হয়ে একটা ট্যাক্সি নিলাম, পরিতোষ। আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল–।
মা তবু কাছে এসে অমলকে ভালো করে দেখলেন, হাত দিলেন তার মাথায়।
অমল বলল, আমার লাগেনি বলছি তো!
আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ার পর অমল বুঝতে পারল, তার গল্পটার বেশ বড় একটা খুঁত আছে। ট্যাক্সি থেকে নেমে সে ভাড়া মিটিয়েছে, মা কি সেটা দেখেননি! পরিতোষ নামিয়ে দিয়ে গেল। বলাটা ঠিক হয়নি।
দুদিন বাদে, বিকেল পাঁচটায় অমল দাঁড়িয়ে আছে বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের কাছে, কোথায় যাবে ঠিক করতে পারছে না, হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামল তার সামনে।
জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কৃষ্ণরূপ বলল, কী রে! এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস?
অমল বলল, আমার মন বলছিল, ঠিক পাঁচটার সময় কৃষ্ণরূপ ঘোষ এই রাস্তা দিয়ে যাবে। তাই অপেক্ষা করছিলাম, তোর জন্য।
কৃষ্ণরূপ বলল, তাই বুঝি? তা হলে উঠে পড় গাড়িতে!
কৃষ্ণরূপ কাজ করে একটা বিজ্ঞাপন সংস্থায়, এটা তার অফিসের গাড়ি। সারাদিন তাকে অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়।
গাড়িটা আবার চলতে শুরু করলে কৃষ্ণরূপ বলল, এখন অফিসে ফিরব, খানিকক্ষণ কাজ আছে। তুই একটু বসবি। তারপর দুজনে বেরুব। ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে একটা বাউল গানের ফাংশান আছে, তোকে নিয়ে যাব সেখানে। যাবি তো?
অমল বলল, হ্যাঁ, যেতে পারি। আমাকে আজ আর অফিসে যেতে হবে না। আজ ছুটি নিয়েছি। এখন বিকেলের ডিউটি চলছে। বিকেলগুলো অফিসের বদ্ধ ঘরে কেটে যায়। বাইরে ঝড়বৃষ্টি হলেও টের পাই না।
কৃষ্ণরূপ জিগ্যেস করল, কদিনের ছুটি নিয়েছিস?
অমল বলল, শুধু আজই। বেশি ছুটি দিতে চায় না। বিশ্বদাকে তো তুই চিনিস, একটু চান্স পেলেই গলাবাজি করে।
কৃষ্ণরূপ একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল বন্ধুর দিকে।
অফিসে পৌঁছে নিজের টেবিলে বসে কৃষ্ণরূপ বলল, নীচের একটা ক্যান্টিনে ভালো ফ্রেঞ্চ টোস্ট করে, অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি, চায়ের সঙ্গে খেয়ে নে। কাগজটাগজ পড়। আমাকে একবার ম্যানেজারের ঘরে যেতে হবে। মিনিট পনেরো লাগবে।
কৃষ্ণরূপ উঠে যাওয়ার পর অমলের মনটা খচখচ করতে লাগল। কৃষ্ণরূপ ওভাবে তাকাল কেন!
কৃষ্ণরূপের ফিরতে ফিরতে আধ ঘণ্টা কেটে গেল।
টেবিলের কাগজপত্র গুছোতে-গুছোতে সে অমলকে জিগ্যেস করল, এতক্ষণ ভেবে-ভেবে কী ঠিক করলি?
অমল বলল, কী ঠিক করলাম মানে? বাউল গান শুনতে যাব তো বলেইছি।
—তুই আমাকে ঠিক বন্ধু বলে মনে করিস না, তাই না?
-কেন?
—বন্ধুর কাছে কোনও বন্ধু যদি এসব কথা গোপন করে, তাহলে সে আর বন্ধু কীসের?
—এসব কথার মানে।
-ন্যাকা সাজিস না, অমল, ন্যাকা সাজিস না। কাল তুই বিকেলে শুভ্রাংশুর অফিসে আড্ডা দিতে গিয়েছিলি। ছুটি নিসনি। দিন তিনেক আগে তোকে নন্দনের সিনেমা হলে দেখা গেছে। ছুটি নিয়েছিলি? দ্যাখ, আমরা অ্যাড এজেন্সির লোক, সব খবরের কাগজের নাড়িনক্ষত্রের খবর রাখি। তোর যে চাকরি চলে গেছে, সেটা জানব না!
অমল ফ্যাকাসে মুখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল বন্ধুর দিকে। তারপরই সামলে নিয়ে বলল, তুই আর কারওকে বলিসনি তো? এখন কিছুতেই জানানো চলবে না। কিছুতেই না!
কৃষ্ণরূপ বলল, এ-খবর কখনও বেশিদিন চাপা দিয়ে রাখা যায়! বাড়িতেও জানাসনি?
—না।
—আর মিলিকে?
—না। কিছুতেই না। এর মধ্যে আমাকে আর একটা চাকরি জোগাড় করতেই হবে।
—অত সহজে নয়। চাকরি থাকতে-থাকতে অন্য চাকরিতে যাওয়া যায়। একবার চাকরি গেলে অন্য কেউ চান্স দিতে চায় না। মনে হচ্ছে, কিছু গণ্ডগোল আছে। এমনিতেই এখন বাজার খুব টাইট! তুই বিশ্বদাশগুপ্তকে চটালি কী করে? কাজে ফাঁকি দিয়েছিস?
—মোটেই না। আমার কাজে কেউ খুঁত ধরতে পারবে না। বিশ্বদারও কোনও ক্ষতি করিনি। একদিন শুধু…জানিস তো বিশ্বদা কীরকম ছটফটে স্বভাবের, সব সময় অফিসময় ঘুরে বেড়ায় আর সবাইকে বকাবকি করে, আমি ক্যান্টিনে বসে চুপিচুপি শুভ্রকে বলেছিলাম, বিশ্বদার গণ্ডগোলটা কী জানিস? নিশ্চয়ই খুব শুকনো লঙ্কার ঝাল খায়, সেই জন্যই ওর গুহ্যদ্বারে খুব জ্বালা করে, আর তাই নিজের চেয়ারে পেছন ঠেকিয়ে বেশিক্ষণ বসতে পারে না। সেই কথাটাই কেউ বিশ্বদার কানে তুলে দিয়েছে। এটা তো একটা ইয়ার্কি। এজন্য কারও চাকরি যায়!
—বিশ্বদাশগুপ্ত বদমেজাজি লোক। কেন এসব বাজে ইয়ার্কি করতে যাস?
—আড়ালে কেউ একটু ইয়ার্কি ঠাট্টা করতে পারবে না!
কৃষ্ণরূপ বলল, তুই মিলান কুন্দেরার জোকস নামে একটা উপন্যাস পড়িসনি? পোস্টকার্ডে একজন ছাত্র তার বন্ধবীকে একটা যৌন ইয়ার্কি করেছিল, সোসালিস্ট কান্ট্রির এক দাদার হাতে সেই পোস্টকার্ড পড়ে, একটা নিরীহ ঠাট্টার জন্য প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনের জীবনই দুর্বিষহ হয়ে যায়।
একটু থেমে কৃষ্ণরূপ বলেছিল, আমাদের দেশটা সে রকম নয়। শুধু এই জন্য কারও চাকরি খেয়ে দেওয়া এই বাজারে খুবই ইনহিউম্যান ব্যাপার। হয়তো এটাই একমাত্র কারণ নয়। সব খবরের কাগজেই এখন ছাঁটাই হচ্ছে। কমপিউটারের জন্য তিনজনের কাজ একজন করতে পারে। এখন কেউ পার্মানেন্ট পোস্ট পায় না, সব কন্ট্রাক্ট।
অমলের চাকরি গেছে ঠিক চব্বিশ দিন আগে। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো নোটিস ধরিয়ে দেওয়া হল। তাকে তিন মাসের মাইনে দিয়ে দেওয়া হবে, পরের দিন থেকেই তার আর অফিসে আসার দরকার নেই।
চিঠিখানা সে প্রথমে বিশ্ব দাশগুপ্তকেই দেখিয়ে অসহায়ভাবে জিগ্যেস করেছিল, এটা কী হল? আমি কী দোষ করেছি?
বিশ্বদাশগুপ্ত গম্ভীরভাবে বলেছিল, এটা কোনও দোষ-গুণের প্রশ্ন নয়। কোম্পানির সিদ্ধান্ত। আমার কোনও হাত নেই। আরও হয়তো কয়েকজনকে চলে যেতে হবে!
বিশ্ব দাশগুপ্তর কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। একটা আড়ালের ইয়ার্কি শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে সে অমলের চাকরি খায়নি, তা ঠিক। মালিকদেরই সিদ্ধান্ত। কিন্তু মালিকরা তো অমলের মতন সাধারণ। কর্মীদের চেনে না। কাকে-কাকে ছাঁটাই করা হবে, সে ব্যাপারে বিশ্ব দাশগুপ্তর কাছেই পরামর্শ চেয়েছে। বিশ্বদাশগুপ্ত প্রথমেই অমলের নাম পাঠালেন কেন?
বাড়িতে জানাতে পারেনি, মিলি বা অন্য বন্ধুদের জানাতে পারেনি। অমল প্রতিদিন ডিউটির হিসেব করে বাড়ি থেকে বেরোয়, ঠিক সময়ে ফিরে আসে। রাস্তায়-রাস্তায় ঘোরে, পার্কে বা ময়দানে শুয়ে থাকে। চেনা রেস্তোরাঁয় যায় না। ন্যাশনাল লাইব্রেরির ধার ঘেঁষে না, কারণ ওখানে মিলি যায় প্রায়ই।
আর-একটা চাকরি তাকে যেমন করে হোক জোগাড় করতেই হবে। কিন্তু কী করে তা সম্ভব? বন্ধুবান্ধবদের কাছে সে দয়া চাইতে পারে না। শুধু অ্যাপ্লিকেশান পাঠালে আজকাল কোথাও চাকরি হয়!
এখন মে মাস, দুপুরবেলা অসহ্য গরমের মধ্যেও তাকে মাঠেঘাটে থাকতে হয়। জুলাই মাসের সাত তারিখে মিলির সঙ্গে তার বিয়ের দিন ঠিক হয়ে আছে। তখন বৃষ্টি নামবে।
মিলির সঙ্গে কথা হয় শুধু টেলিফোনে। মিলির সামনাসামনি যেতে তার ভয় হয়, যদি সে বুঝে ফেলে? মেয়েরা অনুভূতি দিয়ে অনেক কিছু বোঝে। মা বোধহয় প্রায় বুঝে ফেলেছেন, মুখে কিছু বলেননি এখনও।
মা আর বাবা দুজনেই এখনও চাকরি করেন। অমলের উপার্জন না থাকলেও এক্ষুনি খাওয়াপরার সমস্যা নেই। দেশে তো কত বেকার ছেলে, বেকার থাকা এমন কী লজ্জার ব্যাপার! কিন্তু বেকার থাকা আর চাকরি যাওয়ার অনেক তফাত আছে। সবাই ধরে নেবে, সে অযোগ্য।
সকাল দুপুর-বিকেল তবু কেটে যায়, কিন্তু রাত আড়াইটে-তিনটে পর্যন্ত সে কোথায় সময় কাটাবে? এই সময় রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাও নিরাপদ নয়, মাঠে শুয়ে থাকা নিরাপদ নয়। কোনও বন্ধুর বাড়িতেও থাকা যায় না। একদিন সে আবিষ্কার করল, একমাত্র শ্মশানগুলিই সারারাত। জাগ্রত, সবসময়ই মানুষ আসে, সেখানে এক জায়গায় বসে থাকলে কেউ কিছু প্রশ্ন করে না।
একদিন সিনেমায় একটা নাইট শো দেখতে গিয়ে সে প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিল আর কি! মিলি তার মা-মাসিদের একটা বড়ো দলের সঙ্গে এসেছে। অমলের খুব কাছেই ওদের সিট। অমল তাড়াতাড়ি মাথা নীচু করে ফেলেছে। তারপর অন্ধকারের মধ্যে সরে পড়েছে চুপিচুপি!
দেখা হলে কী হত? সে কি একদিন অফিস থেকে বেরিয়ে বিখ্যাত কোনও সিনেমা দেখতে আসতে পারে না? সেটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু প্রবল এক লজ্জা তাকে ছেয়ে ফেলে।
সাতই জুলাইয়ের আগে অন্য কোনও চাকরি জোগাড় করতে না পারলে কী হবে? এখনও পর্যন্ত কোনও আশা পাওয়া যায়নি।
শ্মশানের কাছাকাছি দোকানগুলোও খোলা থাকে সারারাত। সিগারেট পাওয়া যায়, চা কিংবা ঘুগনি-আলুরদম খাওয়া যায়। কত রকম মানুষ আসে।
উত্তর কলকাতার শ্মশানগুলোতেও সে যায়। ওদিককার শ্মশানের পরিবেশ তার বেশি পছন্দ হয়, কারণ, পাশেই গঙ্গা। সিঁড়িতে বসে নদী দেখতে-দেখতে দিব্যি সময় কাটে। তবে ট্যাক্সি ভাড়া বেশি পড়ে।
এর মধ্যে একদিন শ্মশানে বসে থাকতে-থাকতে এমন ঘুম এসে গিয়েছিল যে জেগে উঠেছে ভোরবেলা। বাড়ি ফিরেছে ট্রামে। সেদিন তার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। শেষ রাতে ট্যাক্সিতে ফিরলে মা আবার দেখে ফেলতে পারেন, তাই সে মাকে বলল, এখন থেকে সকাল হলেই ফিরব, অফিসে থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।
কেওড়াতলা শ্মশানে একদিন এক কাণ্ড হল।
রাত সাড়ে এগারোটা, এখনও অনেকটা সময় কাটাতে হবে। আজ এত ভিড় যে কোথাও শুয়ে পড়বারও জায়গা নেই। খাট সমেত শবদেহগুলি নামিয়ে রাখা হচ্ছে, একেবারে লাইন পড়ে গেছে।
নতুন একটা শববাহকের দল আসছে, পাশ দিয়ে অমল যাচ্ছে সিগারেট কিনতে। হঠাৎ সে একেবারে বিশ্ব দাশগুপ্তর মুখোমুখি। সে ভয়ে একটু কেঁপে উঠল।
বিশ্ব দাশগুপ্ত খানিকটা বিস্মিতভাবে বললেন, অমল? তোমার…কেউ গেছেন?
অমল বলল, না। আমি এমনিই…
বিশ্ব দাশগুপ্ত যেন উত্তরটা শুনতে পেলেন না। আবার বললেন, তুমি আমার মায়ের খবর পেয়ে এসেছ? তোমাকে কে বলল?
কয়েক মুহূর্ত মাত্র দ্বিধা করে অমল বলল, সন্ধেবেলা আপনাদের পাড়ায় আমার এক বন্ধু থাকে, তার কাছে গিয়েছিলাম, তখনই শুনলাম।
বিশ্বদাশগুপ্ত বললেন, ঠিক পাঁচটা দশমিনিটে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তার ডাকারও সময় পাওয়া যায়নি। আমি তখন অফিসে—
অমল বলল, আপনাদের বাড়িতে দুবার গেছি, মাসিমা কত যত্ন করেছেন। আমার মতন একজন। সামান্য লোককেও গত বছর জোর করে পায়েস খাওয়ালেন। মাথায় হাত রাখলেন। তাই খবরটা শুনে ইচ্ছে হয়েছিল, মাসিমাকে শেষ প্রণাম করে আসি। আপনি যদি রাগ করেন, সেই ভয়ে বাড়িতে ঢুকিনি।
বিশ্ব দাশগুপ্ত উদাসীনভাবে বললেন, তুমি বাড়িতে এলে কি আমি…এখানে কতক্ষণ অপেক্ষা করছ?
অমল কিছু বলার আগেই তিনি ধরা গলায় বললেন, অফিস-অফিস করে তো সর্বক্ষণ…বাড়িতে কতটুকু সময়ই বা থাকি, মার সঙ্গে দিনের-পর-দিন একটা কথাও হয়নি, ভেতরে-ভেতরে যে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কক্ষনো মুখ ফুটে বলেননি, আমি দু-সপ্তাহের মধ্যে এক দিনও মায়ের পাশে গিয়ে বসিনি…তুমি দু-বার মাত্র মাকে দেখেছ, তার জন্য এই শ্মশানে, এত রাতে…
হঠাৎ অমন জাঁদরেল মানুষটি কেঁদে উঠলেন শিশুর মতন। অমল হাত বাড়িয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গেলে তিনি অমলের কাঁধে মাথা রাখলেন। তাঁর কয়েকজন সঙ্গী অবাক হয়ে দেখতে লাগল এই দৃশ্য।
কাঁদতে-কাঁদতে বিশ্ব দাশগুপ্ত এলোমেলোভাবে বলতে লাগলেন, মাকে তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, যদিও এক বাড়িতে…একটা আয়া রেখে দিয়ে, শেষ সময় মা আমার নাম ধরে । ডেকেছিল, তখন আমি অফিসে…অমল, তোমার জন্য আমি কিছুই করিনি, কতটুকুই বা আমার ক্ষমতা…তুমি হয়তো ভেবেছ…
আস্তে-আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অমল বলল, বিশ্বদা, আমি কি একবার মাসিমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে পারি?