শেষ ছবি – বনফুল
প্রথম যৌবনে তাহার সহিত বন্ধুত্ব হইয়াছিল। বন্ধুত্ব হইবার পর মনে হইয়াছিল এমন একটা জিনিস পাইলাম যাহা সহজে পাওয়া যায় না। রাত্রি জাগিয়া পড়া মুখস্থ করিয়া পরীক্ষায় বেশ ভাল নম্বর পাইয়াছিলাম। সেই নম্বরই আমাকে ঠেলিয়া প্রেসিডেন্সি কলেজের কূলে তুলিয়া দিয়াছিল। কূলে দেখিলাম বাঁশি হাতে শ্যাম দাঁড়াইয়া আছে। দেখিয়া অবাক হইয়া গেলাম শ্যাম যে রাধার উদ্দেশে বাঁশি বাজাইতেছে সে বৃন্দাবনবাসিনী রাধা নহে, সে বিদেশিনী। কখনও ফরাসী দেশে থাকে, কখনও বা রাশিয়ায়। সাহিত্যের কুঞ্জবনে শ্যামচাঁদ সেই অশরীরিণী নায়িকার মাঝে মাঝে দেখা পাইত এবং বাঁশি বাজাইত। সেই নায়িকা মুগ্ধ হইয়াছিল কি না জানি না, কিন্তু আমি মুগ্ধ হইয়া গেলাম। একজোড়া বাঁয়া-তবলা যোগাড় করিয়া তাহার সহিত মাতিয়া গেলাম সুর-সাধনায়। কিছুদিন পরে আরও জমিয়া গেল, সুরের আসরে সুরা দেবীও আসিয়া যোগ দিলেন।
সকলে আমাদের বলিত মানিকজোড়। এক সঙ্গে শোয়া-বসা, এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, এক চায়ের দোকানে আড্ডা মারা, এক সঙ্গে কন্টিনেন্টাল উপন্যাস পড়া, এক সঙ্গে স্বপ্ন দেখা। হায়, প্রগতির পথে পিতারা চিরকাল কণ্টকস্বরূপ। আমার পিতা একেবারে পর্বতের মতো পথরোধ করিয়া দাঁড়াইলেন। হঠাৎ একদিন টেলিগ্রাম পাইলাম, অবিলম্বে চলিয়া এস। গেলাম। পিতা গাল-মন্দ করিলেন না, কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন, তোমাকে আর কলিকাতায় পড়িতে হইবে না, এখানকার কলেজেই ভর্তি হইয়া যাও। পিতা অনমনীয় চরিত্রের লোক ছিলেন, তাঁহার সহিত বাদ-প্রতিবাদ করিতে সাহস হইল না। মনের দুঃখ মনে চাপিয়া বহরমপুর কলেজেই ভর্তি হইয়া গেলাম। এজন্য এখন এই বৃদ্ধ বয়সে স্বর্গীয় পিতার চরণে বারংবার প্রণতি জানাই। এখন আমি মুনসেফ, আশা আছে, রিটায়ার করিবার পূর্বে সাবজজ হইতে পারিব। শ্যামের সহিত বাঁশি বাজাইলে এসব হইত না।
শ্যামকে কিন্তু একেবারে বর্জন করিতে পারি নাই। চিঠি লেখালেখি চলিত। তাহার প্রথম চিঠিটার অংশবিশেষ পড়িয়া এখন ভারি মজা লাগিতেছে।
“তোমরা ভাল ছেলে। ভালত্বের বাঁধা সড়কে চলিয়া একদিন তোমরা একটা নির্দিষ্ট নাম-করা সরাইখানায় পৌঁছাইয়া যাইবে। কিন্তু আমরা বাঁধা সড়কের ধার ধারি না, যে পথে কেহই চলে নাই আমরা সেই পথের পথিক। আমাদের পথের বর্ণনা কবি নজরুল ইসলাম দিয়াছেন—‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’। কিন্তু এ কবিতায় কবি কল্পনা করিয়াছেন সঙ্গে আরও যাত্রী আছে। কিন্তু আমি যে পথে চলিয়াছি, সে পথে কেহ নাই, আমি একা। এমন কি সুনামও আমার সঙ্গী নহে। সবাই বলে আমি বখাটে ছেলে। সামাজিক অভিধানে সম্ভবত উহাই আমার সংজ্ঞা। কিন্তু আমার একমাত্র সান্ত্বনা শেলী, কীট্স, গ্যয়টেও একদিন আমার দলের লোক ছিলেন। সমাজের কাছে তাঁহারা ভাল ছেলের সার্টিফিকেট পান নাই। কিন্তু আমি একটা অভাব বোধ করিতেছি। মেয়েরা সাধারণত পুরুষের প্রতিভাকে উদ্দীপ্ত করে, তাহাকে — ব্যসাধনে প্রবৃত্ত করিতে উৎসাহ দেয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেরকম মেয়ে কোথায়। সবই যেন ছাঁচে-ঢালা পুতুল—হয় খেঁদি-নেড়ি-বগী-বিন্দীর ছাঁচে ঢালা, না হয় তথাকথিত আলোক-প্রাপ্ত সমাজের ছাঁচে ঢালা। স্বকীয়তার দীপ্তি কাহারও মধ্যে দেখি না। মেরি ফ্রগলে বা হ্যারিয়েট বা লটির মতো মেয়ে আমাদের ভদ্রসমাজে কই। সবাই মুখস্থ করা নীতিকথা বলে, প্রাণের কথা কাহারও মুখে বড় একটা শুনি নাই। সোনিয়ার মতো মেয়ে এদেশের মাটিতে কল্পনাতীত। শেরীর দাম সম্প্রতি প্রায় আকাশচুম্বী হইয়াছে। তুমি সিঁড়ি ছিলে অনেক আকাশচুম্বী রত্নই আহরণ করিতে পারিতাম। এখন সাধারণ ব্রাণ্ডি জোটানই দুষ্কর হইয়া পড়িয়াছে। ধান্যেশ্বরীর সহিত আলাপ করিবার চেষ্টা করিতেছি, যদি তাহার প্রেমে পড়িতে পারি। একজন বহুদর্শীর মুখে শুনিলাম, ধান্যেশ্বরী শুধু যে সস্তা তাহাই নন, শরীরের পক্ষে উপকারীও। তিনি অবশ্য গাঁজাকেই সর্বোচ্চ সম্মানের আসন দিলেন, কিন্তু ভাই গাঁজা খাইতে পারিব না⋯।”
দ্বিতীয় আর একটি পত্রে দেখিতেছি:
“ভাই শিবেন, শুনিলাম তুমি ভাল করিয়া আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছ। জানি এইবার তোমাকে লাইন ধরিতে হইবে। এই লাইন ধরিয়া যে টার্মিনাসে পৌঁছিবে তাহার একটা বাঁধাধরা ছবি তোমার জানা আছে। আমি যে পথে চলিয়াছি তাহারও একটি নাম সবাই জানে। সে নামটি ‘অজানা’। আমি সম্প্রতি একটি খবরের কাগজে প্রুফ-রিডারের চাকরি পাইয়াছি। বেতন যৎসামান্য, সিগারেটের খরচটা কোন-ক্রমে উঠিয়া যায়। আমার বাকি খরচ যে চালায়, তাহার নামটা আর নাই বলিলাম, তাহার নাম আর পরিচয় শুনিলে তোমার হয়তো শারীরিক ও মানসিক বিক্ষোভ হইবে। প্লীহা চমকাইয়া যাইবে, নাসিকাও কুঞ্চিত হইয়া কুৎসিত রূপ ধারণ করিবে। সুতরাং নামটা আর করিব না। শুধু এইটুকু জানিয়া রাখ মেয়েটি মানবী রূপে দেবী। সমাজ বা সংসার তাহার সহিত সদ্ব্যবহার করে নাই। তবু সে সদাহাস্যমুখী। তবু তাহার গানের ঝঙ্কারে স্বর্গীয় সুর। যদি কোনদিন এ অঞ্চলে আস আলাপ করাইয়া দিব। আমার বাবাও আর একটি আশ্চর্য লোক। এখনও আমাকে টাকা পাঠাইয়া যাইতেছেন। তাঁহার বোধ হয় এখনও আশা আছে, আমি বি-এ পাস করিয়া তাঁহার আপিসে একদিন ঢুকিব। আমি যে অন্যত্র চাকুরি লইয়াছি সে কথা তাঁহাকে এখনও জানাই নাই। জানাইলে হয়তো তিনি টাকা পাঠানো বন্ধ করিয়া দিবেন। এ বাজারে মাসে পঞ্চাশ টাকা তুচ্ছ করিবার মতো নয়। তবে এখন যে বন্দরে আমার নৌকা লাগিয়াছে তাহাতে মনে হয় আপাতত কিছুদিন নিশ্চিন্ত থাকা যাইবে। সোনা আমাকে একসেট ভাল কবিতার বই কিনিয়া দিয়াছে। ওই দেখ, নামটা শেষে বলিয়াই ফেলিলাম। কথাটা যেন চাউর করিও না। আলাপ হইলে দেখিবে, যে সব বড় বড় প্রতিভা-সম্পন্ন পণ্ডিতেরা তোমাদের বাণীমন্দির অলংকৃত করিতেছেন সোনা তাহাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কিন্তু সে সমাজের চক্ষে পতিতা ছাড়া আর কিছু নয়। স্যাকোর কথা নিশ্চয় শুনিয়াছ, আমার মনে হয় সোনা স্যাকোরই সম-গোত্রীয়া।⋯”
আর একটি চিঠিতে দেখিতেছি—
“ভাই, বড় মুশকিলে পড়ে গেছি। বাবা এক জায়গায় বিয়ের সম্বন্ধ করেছেন। মেয়ে সুলক্ষণা এবং সদ্বংশীয়া। এ দুটি গুণ ছাড়া আর কোন গুণ নেই। দেখতে কুৎসিত, লেখাপড়ায় ‘ক’ অক্ষর গোমাংস। অত্যন্ত রোগা। আমি আপত্তি করেছিলাম। বাবা সেকেলে গোঁড়া লোক। আমাকে জানিয়েছেন—তুমি যদি বিয়ে না কর, তাহলে তোমার ভাইয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দেব আর আমার বিষয়-সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করব তোমাকে। আমি ওদের কথা দিয়েছি। আমার কথার নড়চড় হবে না। ফেরত ডাকেই তোমার উত্তর চাই। আমি যে কি করে এই গোঁয়ার-গোবিন্দ বাপের ছেলে হলুম তা ভেবে পাই না। মত দিয়েছি, মানে, দিতে হয়েছে। তুই কি আমার বিয়েতে আসবি?”
আমার যাওয়া হয় নাই। সামনেই পরীক্ষা ছিল। সেদিন পুরাতন চিঠি ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে শ্যামের আরও চিঠি পাইলাম। একটা চিঠি এইরূপ—
“ভাই, সোনাকে নিয়ে বিপদে পড়েছি। বাবা কলকাতায় একটা বাসা ভাড়া করে পিসিমা আর আমার বউকে এখানে পাঠিয়েছেন। সোনা বলছে তুমি আর আমার এখানে থেকো না। তুমি নির্মলার কাছে গিয়েই থাক। তোমার যদি টাকার দরকার হয় আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও। সোনাকে কিছুতেই নিরস্ত করতে পারছি না। সে আমাকে কিছুতেই তার কাছে থাকতে দেবে না। আমি যে সোনার বাসাতে থাকি এবং সোনাই যে আমার ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন সব—একথা বাবা টের পেয়ে গেছেন মনে হচ্ছে। তা না হলে এখানে বাসা ভাড়া করতে যাবেন কেন? সোনার সঙ্গে রফা হয়েছে একটা শেষকালে। তাকে বলেছি নির্মলার কাছে মাঝে মাঝে যাব। ইতিমধ্যে একদিন গিয়েছিলাম। রাত্রি দুটো নাগাদ, মত্ত অবস্থায়। গলিতে ঢুকে দেখলাম আমাদের বাড়ির জানলার আবছা অন্ধকারে একটি রোগা মেয়ে গরাদে ধরে পথের দিকে চেয়ে আছে। আমার সাড়া পেয়ে ছুটে নেমে এসে কপাট খুলে দিলে। আমি কোনও খবর দিয়ে যাই নি। হঠাৎ মনে হল রোজই দাঁড়িয়ে থাকে না কি! জিগ্যেস করাতে চুপ করে রইল!”
শ্যামের আর কোন চিঠি পাইলাম না। সোনার এক নামজাদা ধনী বাবু ছিলেন। তিনি সোনাকে লইয়া ইয়োরোপ ভ্রমণে বাহির হইয়াছিলেন। সোনার অনুরোধে শ্যামও তাঁহার প্রাইভেট সেক্রেটারি রূপে গিয়াছিল। প্রায় তিন-চার বৎসর তাহার কোন খবর পাই নাই। হঠাৎ একদিন আমার আর এক বন্ধুর নিকট খবর পাইলাম শ্যাম খুব অসুস্থ। সে কলিকাতায় সোনার বাসাতেই আছে। একদিন তাহার সহিত দেখা করিতে গেলাম। কলিকাতায় অন্য একটা কার্যোপলক্ষে যাইতে হইয়াছিল, ভাবিলাম শ্যামকেও দেখিয়া যাই, অনেকদিন তাহাকে দেখি নাই। তাহার বাসায় যখন পৌঁছিলাম তখন সোনা বাড়িতে ছিল না। খবরটা শুনিয়া আরাম বোধ করিলাম। দেখিলাম শ্যাম একাই বিছানায় শুইয়া একটা বড় ছবির অ্যালবাম দেখিতেছে।
“তুই একাই রয়েছিস?”
“হ্যাঁ, সোনা ডাক্তারের কাছে গেছে।”
“শুনলাম তোর খুব অসুখ। কি হয়েছে?”
“যক্ষ্মা, রাজযক্ষ্মা। রাজকীয় জীবনযাপন করেছি তো—”
তাহার কোটরগত চক্ষু, খাঁড়ার মতো নাক, চোপসানো গালকে উদ্ভাসিত করিয়া তাহার সেই হাসিটি ফুটিয়া উঠিল।
“দুর্গম গিরি কান্তার মরু পার হয়ে অবশেষে এইখানে এসে পৌঁছেছি। যবনিকা পড়বার আর দেরি নেই।”
খকখক করিয়া কাসিতে লাগিল।
“জীবনটা যে এত চট্ করে শেষ হয়ে যাবে তা ভাবি নি। শেষ হয়ে যাওয়াই নিয়ম অবশ্য।” আবার কাসিতে লাগিল।
বলিলাম, “ওসব কথা থাক। ইয়োরোপে গিয়েছিলি শুনলাম, কি কি দেখলি সেখানে?”
“দেখলাম দুরন্ত জীবন-প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে চারিদিকে। আর দেখলাম ওদেশের আর্ট গ্যালারিগুলো। প্রতিভাবান শিল্পীদের অমর সৃষ্টি সব। অনেক ছবি, অনেক মর্মরমূর্তি। আর দেখলাম সোনাকে। ওরকম মেয়ে হয় না, ও আমার জন্যে যা করেছে তার তুলনা নেই। কিন্তু তবু মনে হচ্ছে যেন ভুল করেছি। রূপ, লেখা-পড়া, শিল্প, নাচ, গান, সাহিত্য এইসব নিয়েই তো জীবন কাটল—কিন্তু তবু মনে হচ্ছে—”
চুপ করিয়া শূন্যের দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার পর হাসিয়া বলিল—“ছবি তো অনেক রকম দেখলাম। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একটি ছবিই কেবল চোখের উপর ভাসছে, আর বাকি সব মুছে গেছে—”
“কি ছবি সেটা?”
“একটা রোগা মেয়ে অন্ধকার রাত্রে জানলার গরাদে ধরে রাস্তার দিকে আকুল নয়নে চেয়ে আছে। এ ছবিটা সব ছবিকে আড়াল করে চোখের সামনে ফুটে উঠেছে, মনে হচ্ছে, এইটেই শেষ পর্যন্ত থাকবে।”
বুঝিলাম আমি আসাতে শ্যাম একটু উত্তেজিত হইয়া পড়িয়াছে। বেশিক্ষণ বসিলাম না, চলিয়া আসিলাম।
পরদিনই শুনিলাম শ্যামের মৃত্যু হইয়াছে।
১৩৭০ (১৯৬৩)