শেষ ছবি – দুলেন্দ্র ভৌমিক

শেষ ছবি – দুলেন্দ্র ভৌমিক

যাতায়াতের পথেই ব্যাপারটা ঘটছে অথচ এতদিন নজরে আসেনি নিমাইয়ের। রাস্তার পাশে যে সিগারেটের দোকানটা থেকে সে প্রায়ই, বলতে গেলে রোজই এক প্যাকেট করে সিগারেট কেনে সেই দোকানটার দিকে পেছন ফিরে সামনে তাকালেই সে দেখতে পেত অথচ এতদিন সে অভ্যাসবশত তাকায়নি। আজও তার খেয়াল করার কথা নয়, নেহাত দোকানদার ছিল না বলে তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল এবং দোকানদার রাস্তার উল্টোদিকের গাছতলায় বসে নাপিতকে দিয়ে দাড়ি কাটাচ্ছিল, নিমাই তার রোজকার খদ্দের সে-কারণেই নিমাইকে দেখতে পেয়ে নিজেই চেঁচিয়ে উঠে বলেছিল, ‘এট্টু দাঁড়ান, আমি আসছি।’ দোকানদারকে দেখবার জন্য সে দোকানের দিকে পেছন ফিরে সামনে তাকিয়েছিল। ভাগ্যিস তাকিয়েছিল তাই সে দৃশ্যটা দেখতে পেল।

খুবই সাধারণ এবং নিরীহ একটা দৃশ্য। এমন কিছু নয় যা দেখে মানুষ চমকে উঠতে পারে অথবা অবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে। বাঁশের নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে একজন প্রৌঢ় চেহারার লোক ওপরে উঠে যাচ্ছে। লোকটির পায়ের ভারে অথবা চাপে বাঁশের সিঁড়িটা থরথর করে কেঁপে উঠছে। দূর থেকে লোকটির সঠিক চেহারা অনুমান করা যাচ্ছে না। খাকি রঙের একটা হাফপ্যান্ট, খুব সম্ভব খালি পা, শীর্ণ দুটি ঠ্যাং আর গায়ে ময়লা ফতুয়া জাতীয় পোশাক। ঝকঝকে রোদে গোটা আকাশ আজ যেন অতিমাত্রায় উজ্জ্বল। সেই উজ্জ্বল আকাশের নিচে এই রকম একটা দৃশ্য দেখে সাধারণত কেউ কোন রকম বিস্ময় বা চমক অনুভব করে না। কিন্তু নিমাই ভেতরে ভেতরে একটু চমকাল। তার দৃষ্টি দূরের ওই প্রৌঢ়টির দিকে, যে এতক্ষণে অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। লোকটা যত ওপরে উঠছে ততই তাকে অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। বাঁশের সিঁড়িটার কাঁপন এখনও থামেনি। ওপর থেকে সেই কম্পনটা বোধ হয় নিচের দিকে থরথর করে নেমে আসছে।

‘চোদ্দতলা বাড়ি তৈরি হচ্ছে বাবু।’ সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে দোকানদার নিমাইয়ের উদ্দেশে কথাটা বলেই সদ্য দাড়ি-কাটা-গালে হাত বোলাতে লাগল।

সিগারেটের প্যাকেট হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে নিমাই বলল, ‘এত বড় বাড়ি উঠছে আগে তো কখনও খেয়াল করিনি।’

দোকানদার সিগারেটের দাম নিয়ে ফেরত পয়সা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আগে তো টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল তাই দেখতে পাননি।’

নিমাই সিগারেট ধরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দৃশ্যটা আবার দেখল। এই দোকানের সামনে থেকে ওপরের লোকটিকে এখন ছোট্ট একটা পুতুলের মতো দেখাচ্ছে। ঠিক পুতুলও নয়, একটা ছোট্ট পিণ্ডের মতো। মানুষের শরীর পেছন থেকে দেখলেও তার কতকগুলো বৈশিষ্ট্য থাকে যা দেখে বোঝা যায় সে মানুষ। এখান থেকে সেটা বোঝবার উপায় নেই। দূরত্ব বেড়ে যাওয়ায় তার চেহারা এখন আর মানুষের মতো নয়। নিমাই জানে এখন তার চোখে ওই লোকটার যেমন আকার ধরা পড়ছে, ওপর থেকে এই দোকানের দিকে যদি লোকটি একবার তাকায় তাহলে তাকেও সে তেমনই দেখবে।

নিমাই কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে মিনিবাসের জন্য দাঁড়াল। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হয় না। আর এ-সময় বাসে উঠে জায়গা পেয়ে বসতে পারাটাও দুর্লভ নয়। জানালার কাছে বসে খানিক বাদে সে টের পেল মিনি-টা অনেকখানি পথ এগিয়ে এসেছে, দু’পাশের দৃশ্য বদল হয়েছে অথচ তার চোখের সামনে এখনও ভেসে আসছে খানিক আগের সেই দৃশ্যটা। উজ্জ্বল আকাশের নিচে সারা গায়ে রোদ মেখে একজন প্রৌঢ় লোক নড়বড়ে বাঁশের সিঁড়ি দিয়ে ক্রমশ কাঁপতে কাঁপতে ওপরে উঠে যাচ্ছে। পেটের ভাত বড় কঠিন জিনিস। কাউকে মাটি ছেড়ে ওপরে উঠতে হয়, কাউকে আবার মাটি ফুঁড়ে পাতালে নামতে হয়। নিমাই জানে, এ বড় হৃদয়হীন লড়াই। চার বছর ধরে এই লড়াইটা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, অথচ এখন পর্যন্ত তার উদ্বেগ দূর হয়নি। চার বছর ধরে সে দেখছে বছরে একজন না একজন রিটেনার হয়ে যাচ্ছে না হয় স্টাফ ফটোগ্রাফার হচ্ছে। প্রতি বছরই সে গোড়ার দিকে ভাবে এবার হয়তো তার ভাগ্যে কিছু একটা ঘটবে, কিন্তু ঘটে না। নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে এই অফিসে এসে ঠাঁই মিলেছিল ফ্রি-ল্যানসার ফটোগ্রাফার হিসাবে। তখন মনে হয়েছিল তার সৌভাগ্য এখান থেকেই শুরু হবে। কিন্তু গত চার বছরে সেই শুরুটা হয়ে ওঠেনি। চিফ ফটোগ্রাফারের করুণা আর নিউজ এডিটারের অনুকম্পার ওপর নির্ভর করে পেটের ভাত যোগানো বড় কঠিন হয়ে উঠছে নিমাইয়ের কাছে। ছবি ছাপা হলে তবে চেক পাওয়া যায়। তবুও আশা ছাড়েনি নিমাই। রোজই হাজিরা দিয়ে যাচ্ছে, যেতে হচ্ছে। চিফ ফটোগ্রাফার অতীশদার কাছাকাছি অথাৎ চোখের সামনে সামনে থাকলে একটা না একটা কাজের দায়িত্ব পেয়ে যায়। অর্থাৎ অ্যাসাইনমেন্ট। খবরের কাগজের এই রোজগার থেকে সংসার চালানো এই বাজারে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। বড়লোকদের ছেলেমেয়ের বিয়ে, অন্নপ্রাশন আর জন্মদিনগুলো আছে বলে কোনরকমে চালিয়ে যেতে পারছে। গত দু’বছর থেকে অতীশদা তাকে বলে আসছেন, ‘তোমার নামটা প্যানেলে আছে। টার্ন এলে নির্ঘাত হয়ে যাবে।’

নিজের বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাস আর ক্ষোভটাকে চাপতে চাপতে নিমাই ভাবে, ‘দু’বছরেও টার্ন এল না। গোটা জীবন কি আমি প্যানেলে ঝুলে থাকব?’

একা-একা এসব কথা ভাবতে বসলেই অভিমানে তার বুক ছেয়ে যেতে থাকে। চাপা রাগ হয় নীতার ওপর। নীতার জন্যই সে একদিন পঞ্চাশ টাকা দিয়ে একটা ক্লিক থ্রি ক্যামেরা কিনেছিল। সেই ক্যামেরায় প্রথম ছবি তোলা হয়েছিল আলিপুর চিড়িয়াখানায়। এখন মনে হয় সেটা ছিল খুবই বাজে ছবি। অথচ নীতা ওই ছবি দেখে আনন্দে আত্মহারা। ছবিটাকে বড় করে দেবার বায়না ধরেছিল নীতা, কিন্তু বড় করা যায়নি। নেগেটিভ এনলার্জ করতে গেলেই গ্রেন এসে ছবিটা ফাটাফাটা হয়ে যাচ্ছে। কলেজে পড়ার সময় নীতাকে খুশি করতে ওটাই ছিল তার একমাত্র অবলম্বন। সেই নীতাই একদিন তাকে অবাক করে দিল। জন্মদিনে নিমাইয়ের হাতে উপহার হিসাবে তুলে দিল জাপানী ক্যামেরা ইয়াসিকা। ক্যামেরার সঙ্গে সত্যি সত্যি প্রেমে জড়িয়ে পড়ার সূত্রপাত এর পর থেকেই। সুরকারের যেমন নতুন সুরসৃষ্টির একটা আলাদা আনন্দ আছে, ছবি তোলার মধ্যেও সেই আনন্দের স্বাদ পেতে আরম্ভ করল নিমাই।

মাঝে-মধ্যে নিমাইয়ের মনে হয়, ব্যাপারটা খুব অবাক হবার মতো, যার জন্য একদিন ক্যামেরা কিনে ছবি তোলায় হাতেখড়ি হয়েছিল সেই নীতার এখন আর ফটোতে কোন অতিরিক্ত আগ্রহ নেই। নিমাইয়ের নিকন ক্যামেরা আর বহুবিধ সাজ-সরঞ্জামের প্রতিও তার বিশেষ কোন প্রেম আছে বলে মনে হয় না। প্রেমিকা বউ হয়ে গেলে বোধ হয় এই রকমই হয়। সমস্ত আগ্রহ আর বাড়তি আবেগ-টাবেগ আগে-ভাগেই শুকিয়ে যায়। নীতা এখন মেয়ের দুধ, বাড়িভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, রোজকার বাজার ইত্যাদি বিষয়েই বেশি মাথা ঘামায়।

ফটো ডিপার্টমেন্টের কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকবার আগেই নিমাই আন্দাজ করতে পারল কিছু একটা ঘটেছে। অতীশদা টেলিফোনে উত্তেজিত ভাবে কারো সঙ্গে কথা বলছেন। তপন কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে নিমাইয়ের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। তারই পেছন-পেছন টেলি, ক্যামেরা স্ট্যাণ্ড কাঁধে করে ছুটতে লাগল মনোজ। ডিপার্টমেন্ট প্রায় ফাঁকা। শুধু অখিল সেন সামনের চেয়ারে পা তুলে দিয়ে বসে সিগারেট টেনে যাচ্ছে।

এখানে নিমাইয়ের বসবার নির্দিষ্ট কোন চেয়ার-টেবিল নেই। কেউ না থাকলে তার খালি চেয়ারে বসে পড়ে। অখিল সেনের পাশের চেয়ারটায় নিমাই বসল। এখান থেকেও অতীশদার টেলি-সংলাপের কিছু কিছু শোনা যাচ্ছে। উত্তেজনার কোন ঘটনা বোধ হয় ঘটেছে। ক্যামেরা ব্যাগ নামিয়ে রেখে নিমাই প্রথমে জল খেল। একটা টেবিলে পর পর কয়েকটা জলভর্তি গ্লাস সাজানো থাকে। জলের গ্লাস মুখে তোলবার আগে অখিলকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেস কী? ডিপার্টমেন্ট ফাঁকা?’

অখিল চেয়ারের পেছনে মাথা রেখে এখন চোখ বুজে আছে। ঠোঁটের ওপর জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেট মুখে নিয়েই উত্তর দিল, ‘অগ্নিকাণ্ড!’

জল খেতে খেতে উত্তরটা শুনল নিমাই। এবার জলের গ্লাস নামিয়ে রেখে বলল, ‘কোথায়?’

অখিল এবার সোজা হয়ে বসে উত্তর দিল, ‘বড়বাজারের একটা প্লাসটিকের গোডাউনে। সবাই ফ্রণ্ট পেজের এক্সকুসিভ ছবি মারবার জন্যে দৌড়েছে।’

নিমাই জানে এসব নিউজ ফটোর ব্যাপারে অখিলদার আগ্রহ নেই। সে খেলার মাঠের ফটোগ্রাফার। বছরে গোটা তিনেক ফ্রন্ট পেজ ছবি করার এলেম অখিলের আছে। নিমাই নিজের প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করতে করতে দেখল নিউজ এডিটর অতীশদার ঘরে ঢুকছেন। একটু আগে এলে নিমাইও চলে যেতে পারত। তার ছবি ছাপা হতো কিনা সে বিষয়ে কোন নিশ্চয়তা নেই, তবুও একটা চান্স থাকতো। অমর, নিরাপদ, দেবী দত্ত সবাই যেখানে ছবি তুলছে সেখানে নিমাইয়ের ছবি ফ্রন্ট পেজে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। ছবি বাছাবাছির সময় অনেক রকম ব্যাপার ঘটে সেটা নিমাই জানে। গত মাসে বাসে আগুন লাগার ছবিটা তারই যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু যায়নি। পরে জেনেছে, তার নেগেটিভ থেকে ছবিটা প্রিন্টই করানো হয়নি। নিউজ এডিটরের ডেস্কে ছবি জমা না পড়লে ছাপা হবার প্রশ্নই ওঠে না। এসব ঘটনার সত্যাসত্য নিয়ে কাউকে প্রশ্ন করা যায় না। অমর, নিরাপদ কিংবা দেবী দত্তরা যা পারে সেটা নিমাইদের পক্ষে উচিত নয়। ওরা স্টাফ ফটোগ্রাফার। ফ্রি-ল্যানসারদের তাই খুব সতর্ক থাকতে হয়। স্পর্ধা প্রকাশ পায় এমন কিছু করার অধিকার নিমাইদের নেই। নিমাই সিগারেট টানতে টানতে অতীশদার ঘরের দিকে তাকিয়েছিল। অতীশদার সামনে নিউজ এডিটর অজয়দা। ওঁদের কথাবার্তা এখান থেকে শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ অখিল নড়েচড়ে বসে বলল, ‘তুই অগ্নিকাণ্ডে গেলি না?’

নিরাসক্ত ভঙ্গিতে নিমাই জবাব দিল, ‘কী হবে গিয়ে! চারজন তো গেছে শুনলাম। আমার জন্যে তো আগুন এখনও বসে নেই।’

অখিল ছাইদানিতে সিগারেট গুঁজে দিয়ে বলল, ‘বসে নেই কী রে? কলকাতায় জল কোথায়? ভোররাত্রে আগুন লেগেছে এখনও দমকল বাগে আনতে পারেনি।’

নিমাই কোন উৎসাহ পেল না। এখন গিয়ে নতুন কোন অ্যাঙ্গেল পাওয়া আর সম্ভব নয়। আজ হয়তো তার ভাগ্যে যথারীতি কোন মন্ত্রীর ফিতেকাটার ছবি তুলতে হবে। এসব ছবি যত ভোলা হয় তার অধিকাংশই ছাপা হয় না। আগামীকাল প্রথম পাতাটা খেয়ে নেবে বড়বাজারের আগুন। ফিতে-কাটার ছবি ছাপবার জায়গাই থাকবে না। নিমাই যেমন বসেছিল তেমনই বসে রইল। অজয়দা ততক্ষণে উঠে গেছেন। চা দেবার ছেলেটি এসে ওদের সামনে চায়ের কাপ রেখে চলে গেল। অতীশদা এবার ঘরে এলেন। অখিল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘অতীশদা, আজ তো মাঠ আছে। নিমাইকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।’

অতীশ বাঁ হাত দিয়ে চশমাটা ঠিক করে বসাতে বসাতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাদের খেলা?’

অখিল ক্যামেরার ব্যাগ নামাতে নামাতে উত্তর দিল, ‘মোহনবাগান আর রাজস্থান।’

অতীশ যেতে যেতে বললেন, ‘নিয়ে যাও। আজ আর কাউকে পাবে না। বিকেলে আবার চিফ মিনিস্টারের একটা মিটিং আছে রোটারীয়ানদের নিয়ে। ঠিক আছে, নিমু যাক তোমার সঙ্গে।’

খেলাটা তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবুও যাবার আগ্রহ বোধ করল নিমাই। সে জানে এসব ক্ষেত্রে নিমাইকেই ক্যামেরা খুলতে বলে অখিলদা। নিজের ছবি প্রিন্ট করতেই দেয় না। নিমাইয়ের ছবিগুলো নিয়েই জমা দেয় নিউজ এডিটরের কাছে। অতএব, খেলার পাতায় দু’কলমের একটা ছবি ছাপাও হয়ে যায়। মাঠ থেকে ফিরতে ফিরতে অখিল বলল, ‘তুই অতীশদাকে তোর ব্যাপারটা বলছিস না কেন? রতন তো আগামী মাসে চিঠি পাচ্ছে। স্টাফ ফটোগ্রাফার হয়ে যাবে। তুই এবার বল তোকে রতনের জায়গায় রিটেনার হিসাবে নিয়ে নিতে।’

হতাশ গলায় নিমাই বলে, ‘কতবার তো বলেছি। বারবার বলতে খারাপ লাগে।’

অখিল সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আজ অতীশদার মুড ভালো আছে। আজ একবার বল।’

ময়দানের দিক থেকে হাওয়া আসছিল। শরীর জুড়িয়ে দেওয়া এই বাতাস নিমাইকে কয়েক বছর পেছনে নিয়ে যায়। পড়ন্ত বিকেলের কামরাঙা আলোর মধ্যে দিয়ে নীতাকে নিয়ে কতদিন হেঁটে গেছে গঙ্গার দিকে। তখন কাঁধে ঝোলানো থাকতো নীতারই দেওয়া ইয়াসিকা। তখন ছবি তোলার সঙ্গে শুধু আনন্দের যোগ ছিল, জীবিকার যোগাযোগ ছিল না। ছিল না বলেই বোধ হয় ক্যামেরার ব্যাগটা এত ভারী মনে হয়নি তখন, যতখানি ভারী মনে হয় আজকাল। নিমাই দাঁড়িয়ে পড়ে সিগারেট ধরাল। অখিলও দাঁড়িয়ে পড়েছে। অখিল হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘চল প্রেস ক্লাব ঘুরে যাই।

প্রেস ক্লাব এই সময়টায় জমজমাট। অখিল এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘অফিস যাবার আগে একটা করে মেরে নি।’

অখিল ক্যামেরার ব্যাগ রেখে ভেতরে গেল এবং ফিরে এল দুটো গ্লাস নিয়ে। লনে বসে সেটা শেষ করেই আরও একটা করে আনবার জন্য উঠে গেল। সারাদিন কাজকর্মের পর এক-দু’পেগ হুইস্কি খেলে শরীরটা বেশ তাজা হয়ে ওঠে। কিন্তু নিমাই তো অখিল সেন নয়। সারাদিনে তার তেমন কোন কাজই নেই। কাজের প্রতীক্ষাতেই বসে বসে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অতএব, হুইস্কি খেয়ে শরীর তাজা করার কোন দরকার বোধ করে না নিমাই। তবুও অখিলের জন্য খেতে হল।

অফিসে এসে নিমাই টের পেল অগ্নিকাণ্ডের ছবি নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড বেঁধে গেছে। অমর এবং নিরাপদ দুজনেই নাকি দারুণ ছবি করেছে। নিজেরা ছবি প্রিন্ট করে তুলে দিয়েছে অতীশদার হাতে। ছবির তাড়া নিয়ে অতীশ গেছেন ওপরে নিউজ এডিটরের টেবিলে। অমর আর নিরাপদ দু’জনেই এখন টেনশনে সিঁটিয়ে আছে। ফ্রণ্ট পেজে কে যাবে? অমর না নিরাপদ? এখানে ছবিটা বড় নয়, ওদের দু’জনের প্রেসটিজের লড়াইটাই আসল। ওদের দু’জনের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা লড়াই আছে সেটা অফিসের সবাই জানে। অতীশদা ফিরে না আসা পর্যন্ত ওদের টেনশন কমবে না।

অতীশদা ফিরলেন প্রায় আধঘণ্টা বাদে। নিউজ এডিটর দু’জনের দুটো ফটো রেখেছেন। ফাইনাল সিলেকশন করবেন চিফ এডিটর। অতএব, ওদের টেনশন আবার বাড়তে লাগল। নিমাই নিজের ক্যামেরা থেকে রোল খুলে ডার্করুমে পাঠাল। উঁকি দিয়ে দেখল অতীশদা একা আছেন। একবার ভাবল এখনই কথাটা পাড়লে হয়। অখিল সেনের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘এখন বলব?’

অখিল চাপা গলায় উত্তর দিল, ‘ছবিটা হাতে নিয়ে যখন যাবি তখন বলবি। তোর আজকের ছবিটা ভালো হয়েছে।’

নিমাই জানে, মনে মনে স্বীকার করে, আজকের ছবিটা যদি সত্যিই ভালো হয়ে থাকে তাহলে তার পেছনে অখিলদার অবদানই বেশি। হাফ টাইমের পর রাজস্থানের গোলের পেছনে গিয়ে বসেছিল ওরা। আনুমানিক বারো মিনিটের মাথায় সুব্রত ভট্টাচার্যের উঁচু করে তোলা বল গোলের দিকে ছুটে আসছিল। রাজস্থানের গোলকীপার শূন্যে লাফিয়ে উঠে সেই বল ফিস্ট করতে গেল; কিন্তু তার আগেই লাফিয়ে উঠে বলের নাগালে পৌঁছে গেল প্রশান্ত ব্যানার্জি। ঠিক তখনই অখিলদা কনুই দিয়ে নিমাইকে ধাক্কা মেরে বললেন, ‘গেট রেডি।’

নিমাই ক্যামেরা তুলে আনল চোখের সামনে। সে দেখল গোলকীপার বল ধরবার আগেই প্রশান্ত ব্যানার্জি হেড করে বল নামিয়ে দিচ্ছে নিচে। বল মাটির দিকে নেমে আসছে আর সেই বল লক্ষ্য করে ছুটে এল বাবু মানি। গোলকীপার পজিশন নেবার আগেই পড়ন্ত বল বুটের ডগা দিয়ে গোলে ঠেলে দিল বাবু মানি। বলটা গোলের দিকে ভেসে আসছে, গোলকীপার মরিয়া হয়ে শূন্যে ঝাঁপ দিয়েছে ঠিক তখনই শাটার টিপেছিল নিমাই। এরকম অবস্থায় ছবিটা ভালো হওয়ারই কথা। নিমাইয়ের মধ্যে অবশ্য কোন টেনশন ছিল না। সে খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে এসে দেখল অখিলদা নিজেই নিমাইয়ের নেগেটিভ রোল থেকে ছবি পছন্দ করে, পেন্সিলে প্রিন্ট কতটুকু করতে হবে সেটা মার্ক করে আবার ডার্করুমে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

নিমাই বলল, ‘তুমি কি নচ্ করে দিয়েছ?’

অখিল মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘নচ্ করার দরকার নেই। পেন্সিলে মার্ক করে দিয়েছি। ভালো অ্যাকশন পেয়েছিস। ছবিটাতে ড্রামা আছে।’

ছবি নিয়ে অতীশদার হাতে দিতেই তিনি হেসে উঠে বললেন, ‘বাঃ, ভালো ছবি হয়েছে। গুড অ্যাকশন।’

ঠিক তখনই অখিল নিমাইকে ইশারা করে বলল, ‘এইবার কথাটা বল।’

নিমাই একটু ইতস্তত করে কথাটা বলল অতীশদাকে। অতীশদা সিগারেট ধরাবার আগে সেটাকে দেশলাইয়ের বাক্সের ওপর বার দুই ঠুকে নেন। এই রকমই অভ্যাস। আজ একটু বেশিক্ষণ ঠুকতে লাগলেন। নিমাই কিছু একটা শোনবার অপেক্ষায় চুপ করে রইল। অতীশদা একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘তুমি তো জান, আমি শুধু রেকোমেণ্ড করবার অধিকারী। চাকরি দেওয়ার মালিক চিফ এডিটর। আমি আগেও বার দুই তোমার কথা বলেছি। কিন্তু…’

অতীশদা থেমে গেলেন। সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। নিমাইয়ের কাছে এখন এই নীরবতা নানা রকম অর্থ বহন করতে পারে। সে নিজেই বলল, ‘কিন্তু কী? আমার ডিফেকটটা কোথায়?’

অতীশদা সিগারেট ধরিয়ে দেশলাইটা নিয়ে দু’ আঙুলে খেলা করতে করতে বললেন, ‘টেল ইউ ফ্রাঙ্কলি, উই আর অল প্রফেশন্যাল। আমাদের এখানে কাজের কদর, ব্যক্তির কোন কদর নেই। তোমাকে কাজ দিয়ে তোমার মেরিট, তোমার এফিসিয়েন্সি প্রুফ করতে হবে। তাছাড়া তোমার কদর নেই। তুমি এখন পর্যন্ত রিমার্কেবল কিছু করতে পারোনি। যেটার রেফারেন্স দিয়ে বলতে পারি ইউ আর জিনিয়াস।’

নিমাইয়ের মুখ কালো হয়ে এল। অভিমানের গলায় সে বলল, ‘তেমন সুযোগ তো আমি পাইনি অতীশদা। সুযোগ পেলে আমি চেষ্টা করতে পারতাম।’

অতীশদা আপত্তি করার ভঙ্গিতে বললেন, ‘এটা ঠিক কথা নয়। মেদিনীপুরের বন্যার কভারেজ করতে তোমাকেই পাঠানো হয়েছিল। তুমি দু’ রোল ছবি তুলেছিলে, সবই ফ্ল্যাট ছবি, কোন ড্রামা নেই। এসব ছবি নিউজপেপারে চলে না।’

বুকের মধ্যে অতীশদার কথাগুলো পেরেকের মতো বিঁধে যাচ্ছে। আহত অভিমানে ভারী হয়ে উঠছে মন। তবু মৃদু গলায় নিমাই বলল, ‘কিন্তু আপনিই তো বলেছিলেন ছবিগুলোর কোয়ালিটি ভালো।’

অতীশদা ঈষৎ বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আহাঃ, তুমি উল্টো মানে করছ। কোয়ালিটি মানে ছবির প্রিন্ট, তোমার কারেক্ট একসপোজার এসবের কথা বলেছিলাম। নিউজ ফটোর ক্ষেত্রে এগুলোই বড় ব্যাপার নয়। সেখানে সাবজেক্টটাই আসল। সাবজেক্ট স্ট্রং হলে ছবির কোয়ালিটি নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তোমার মনে আছে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে চলন্ত গাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। একজন ফটোগ্রাফারই সেই ছবিটা তুলতে পেরেছিলেন। গুলিবিদ্ধ কেনেডি গাড়িতে শরীর এলিয়ে পড়ে আছেন। ছবিটার কোয়ালিটি কি ছিল? একেবারে জিরো। কিন্তু সাবজেক্টের গুণে এটা সারা দুনিয়ায় এক্সক্লুসিভ হয়ে গেল। হাজার-হাজার কপি প্রিন্ট হয়েছে ছবিটা। এই তো কয়েক মাস আগে পাটনার কাগজে একটা ছবি বেরুল, একজন গৃহবধূ সারা গায়ে আগুন লাগিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিচ্ছে। ঠিক সেই মোমেন্টে ছবিটা তুলেছে একজন ফটোগ্রাফার। দুর্দান্ত ফটো। ছবিটা অ্যাওয়ার্ড পেয়ে গেল। একটা ছবি, যদি সেটা ছবির মতো ছবি হয় তাহলে দু’কলম নিউজের চাইতে সেটা বেশি কাজ করে।’

অতীশদার মুখে এই কথাগুলো আজ নিয়ে অন্তত পঞ্চাশবার শুনেছে নিমাই। কিন্তু সে কিছুতেই অতীশদাকে বোঝাতে পারেনি, অমন ছবি একজন ফটোগ্রাফার সারা জীবনে দু’তিনটের বেশি তুলতে পারে না। তার মতো ফ্রি-ল্যানসারদের অনেক বিপদ। অধিকাংশ দিনই তো তাকে সভা-সমিতি কভার করতে দেওয়া হয়। সেখানে এক্সকুসিভ কিছু ঘটে না।

অতীশদা খেলার ছবিটা নিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, ‘আজকের ছবিটা মোটামুটি ভালো হয়েছে। চোখটা খোলা রাখো। তোমাকে তো বলাই আছে, আমার অ্যাসাইনমেন্টের দরকার নেই, দারুণ কিছু সাবজেক্ট পেলে আমাকে এনে দেখাবে। তোমার হয়ে ফাইট করবার জন্য আমারও একটা গ্রাউণ্ড মানে হাতিয়ার দরকার।’

অতীশদা ওপরে গেলেন। নিরাপদর ছবি ফ্রন্ট পেজের জন্য নির্বাচিত হয়নি বলে নিরাপদ গজগজ করতে করতে বাড়ি চলে গেল। অমর টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে অগ্নিকাণ্ডের রোমহর্ষক বর্ণনা দিচ্ছিল। ছবিটা ফায়ার ব্রিগেডের লোকজনদের সঙ্গে গাড়িতে উঠে কেমন করে ম্যানেজ করেছে সে প্রসঙ্গটাও বিস্তারিত করে বলে যাচ্ছিল। নিমাই ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত বোধ করল। ক্যামেরা ব্যাগ গুটিয়ে নিতে নিতে বলল, ‘অখিলদা চলি।’

পরের দিনের কাগজে ছবিটা ছাপা হয়েছে এমনভাবে যাতে ছবিটার কোন মজাই টের পাওয়া যাচ্ছে না। দু’কলমের ছবি এককলম করলে এরকমই হয়। একটা ভালো ছবি শুধুমাত্র জায়গার জন্যে অতি সাধারণ একটা ছবি হয়ে গেল। ছবিটাতে শুধু গোলকীপার আর বলটা দেখা যাচ্ছে। প্রথম প্রথম এসব নিয়েও মন খারাপ হতো নিমাইয়ের। এখন আর তেমন হয় না। দাড়ি কামাতে বসে অতীশদার গতকালের কথাগুলো মনে এল। অনেকবার শোনা, বলতে গেলে প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। নিমাই অন্যদিনের মতো ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে যথারীতি বেরুল। দোকানের সামনে এসে সিগারেট কিনতে কিনতে বাড়িটার দিকে তাকাল। অনেক ওপরে দূরে কালো একটা পিণ্ডের মতো একটা মানুষের ক্ষীণ অস্তিত্ব শুধু এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। কোন দরকার ছিল না, তবু নিমাই রাস্তা পেরিয়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে খানিকটা এগিয়ে গেল। ওপরের মানুষটাকে এখান থেকে খানিকটা স্পষ্ট দেখা যায়। অন্তত বোঝা যায়, ওপরে একজন মানুষ রয়েছে। মাঠের এই জায়গাটায় এলোমেলো হাওয়া। সেই হাওয়ায় উড়ে আসছে ধুলো আর কাঁকর। নিমাই একটু ভেবে নিয়ে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বার করল। ক্যামেরায় চোখ রেখে ওপরে তাকিয়ে দেখল দৃশ্যটা ভারি অদ্ভুত। ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে নিঃসঙ্গ একজন মানুষ অট্টালিকা গেঁথে যাচ্ছে। অত উঁচুতে তার আশে-পাশে আর কোন মানুষ নেই। খানিক দূরে, প্রায় একই উচ্চতায় পাক খেয়ে ঘুরছে কয়েকটা পাখি। দৃশ্যটা অপরূপ মনে হচ্ছিল নিমাইয়ের কাছে। ক্যামেরা থেকে চোখ সরাবার আগেই তার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে একটা ঘটনা ঘটল। লোকটার পায়ের ধাক্কায় কিংবা হাতের ঠেলায় একটা বড় আকারের মগ ওপর থেকে নিচে পড়ে গেল। নিমাই ক্যামেরায় চোখ রেখে দেখল একটা বস্তু ওপর থেকে শূন্যে ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে এসে ইটের পাঁজার ওপর শব্দ করে আছড়ে পড়ল। শব্দটা এমন ভয়ঙ্কর যে, নিচে যারা কাজ করছিল তারা দুই চোখে আতঙ্ক নিয়ে প্রথমে নিচে পরক্ষণেই ওপরে তাকাল। ওপরের মানুষটা হাতের ইশারায় কিছু একটা বলছে। যার অর্থ নিমাই ধরতে পারল না। ক্যামেরা থেকে চোখ সরাল না নিমাই। সে ওপরের মানুষটাকে দেখতে লাগল। হয়তো আরও কিছুক্ষণ সে দেখত, কিন্তু দেখা হল না। কচি গলায় কেউ তাকে প্রশ্ন করল, ‘বাবুজী!’

নিমাই চোখ সরিয়ে পাশে তাকাল। তার পাশে দু’চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে একটি বালিকা দাঁড়িয়ে। বয়স হয়তো আট পেরোয়নি কিংবা পেরোতে যাচ্ছে। মাথার ধুলো মাখা রুক্ষ চুলে দুটো ছোট্ট বিনুনি, গায়ে নোংরা একটা ফ্রক। নিমাইকে তাকাতে দেখে মেয়েটি হাসল। যেন সকালবেলার ফুলে প্রথম রোদের কিরণ। মেয়েটি লজ্জা-পাওয়া মুখে বলল, ‘বাবুজী, হামার বাবার ছবি লিচ্ছো? আমাকে দিখাবে?’

নিমাই ক্যামেরাটা ব্যাগে পুরতে পুরতে হাসল। মেয়েটি তখনও তার দিকে তাকিয়ে। বোধ হয় তার জিজ্ঞাসার জবাব পেতে চাইছে। নিমাই বলল, ‘ছবি তুলিনি, শুধু দেখছিলাম। তোমার নাম কি?’

মেয়েটি মাথা দুলিয়ে বলল, ‘মুন্না।’

নিমাই ওপরে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বাবা?’

মেয়েটি গর্বিত মুখে উত্তর দিল, ‘জী, হামার পিতাজী। হামাকে বহুত প্যায়ার করে।’

নিমাই এক পা এগিয়ে এসে বলল, ‘আর তুমি?’

মেয়েটির সারা মুখে চাঁদের আলোর মতো খুশির লাবণ্য উদ্ভাসিত হল। মাথার বেণী দুলিয়ে বলল, ‘হামিও প্যায়ার করি।’

নিমাই আস্তে আস্তে হাঁটতে আরম্ভ করল। মেয়েটিও তার সঙ্গে ছোট-ছোট পায়ে হাঁটছে। নিমাই জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি বুঝি তোমার বাবার কাজ দেখতে আসো?’

মুন্না জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, না, হামি তো বাপুজীর খাবার লিয়ে আসি। এখন উপর থেকে নেমে এসে খেতে হবে না। ভুখ লাগছে না?’

নিমাই যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খাবার আনো?’

মুন্না জবাব দিল, ‘রোটি, ভাজি, লঙ্কা, পিঁয়াজ। আজ আচার ভি আছে।’

নিমাই দেখল মুন্নার হাতে কোন খাবারের পাত্র নেই। প্রশ্ন করল, ‘তোমার খাবার কোথায়?’

মুন্না হাত তুলে বটগাছ দেখিয়ে বলল, ‘ওইখানে আছে।’

মুন্নার সঙ্গে গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়াল নিমাই। ওপর থেকে লোকটা এখন ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসছে। পায়ের ভারে বাঁশের সিঁড়ি থরথর করে কাঁপছে। নিমাই দেখল মুন্নার মুখে এখন কোন কথা নেই, তার দুই চোখ স্থির হয়ে পাহারা দিচ্ছে তার বাবাকে।

নিমাই জিজ্ঞেস করল, ‘মুন্না, তোমার বাবা যে এত ওপরে উঠে যায়, কাজ করে তাতে তোমার ভয় করে না?’

মুন্নার ছোট-ছোট হাত দুটো এখন তার বুকের কাছে জড়ো করা। চোখের তারায় তিরতির করে কাঁপছে একটা উদ্বেগের অস্থিরতা। মুন্না চোখের দৃষ্টি সরাল না। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘বহুৎ ডর লাগে বাবুজী।’

নিমাইয়ের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছোট্ট একটা কম্পন জেগে উঠল। মুন্নার বাবা এখন অনেকখানি নিচে নেমে এসেছে। আরও একটু পরে সমতলভূমিতে নেমে এসে সে হাঁটতে হাঁটতে আসবে এই বটের ছায়ায়। মেয়ের কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে নেবে রোটি, ভাজি, পেঁয়াজ আর লঙ্কার বাটি। ক্ষুধার্ত রাজমিস্ত্রির নিত্যকার দ্বিপ্রহরিক আহার। বটের ছায়ায় বালিকা কন্যার মুখোমুখি বসে কোন শ্রমিক পিতা দুপুরের খাবার খাচ্ছে এই দৃশ্যের মধ্যে কোন সংবাদ নেই। এই ছবি কখনও এক্সকুসিভ হয় না। কিন্তু…

গলার কাছে কিন্তু শব্দটা খামচে ধরে আছে। নিমাই অদ্ভুত চোখে মুন্নার বাবার দিকে তাকাল। ঢোক গিলে নিয়ে ভাবল, আজ যেমন অসতর্ক হাত অথবা পায়ের ধাক্কায় একটা জলের মগ জাতীয় কিছু ওপর থেকে নিচে নেমে আছড়ে পড়ল, ঠিক যদি তেমনই কোন অসতর্কতার ফলে মুন্নার বাবা, মানে ওই প্রৌঢ় লোকটি ওপর থেকে নিচে আছড়ে পড়ে? তাহলে? তাহলে সেটা সংবাদ। একজন মানুষের পতনের সেই ছবি, মৃত্যুর সেই দৃশ্যটা নির্ঘাত এক্সকুসিভ। নিমাইয়ের বুকের মধ্যে একটা উত্তেজনা দাপাদাপি করে উঠল। যে ক্যামেরা একটু আগে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছিল এখন সেটাই বার করে আনল আবার। জ্যান্ত অবস্থায় লোকটার একটা ছবি তুলে রাখা দরকার। ক্যামেরায় চোখ রেখে নিমাই দেখল এক শ্রমিক বাপের সামনে একটি নাবালিকা কন্যা। মায়ের মতো মমতায় মুন্না গামছার পুঁটলি খুলে রুটি তুলে দিচ্ছে বাপের হাতে। ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত বাপ প্রসন্ন চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে। এমন একটা দৃশ্যের মধ্যে আর যাই থাক, আজকের কোন সংবাদ নেই। কোন সেলিং পয়েন্ট নেই। কোন রাজমিস্ত্রি অথবা কোন শ্রমিকের অপত্যস্নেহ অথবা তার ক্ষুধার্ত মুখের এই হাসি সেল করা যায় না। নিমাই জানে, সেলিং পয়েন্টটা এখানে নেই। তবুও অনেক বড় সংবাদের আশায় একটা ফিল্ম সে ইনভেস্ট করছে এই ভেবে ছবিটা তুলে নিল নিমাই।

॥ ২ ॥

একটা ভয়ঙ্কর সংবাদের পেছনে যে নিজেকে সমর্পণ করে বসে আছে সেই খবরটা কাউকে জানায়নি নিমাই। ক্যামেরাতে পুরো ফিল্ম লোড করে টেলি লাগিয়ে নিমাই তিনদিন থেকে বসে আছে ঝাঁ-ঝাঁ রোদুরে। রোদের তাপে শরীর পুড়ে পুড়ে গায়ের রঙ ঝলসে যাচ্ছে, তা যাক। গতকাল থেকে একটা জ্বর-জ্বর ভাব দেখা দিয়েছে, তা দিক, তবুও এই অ্যাঙ্গেলটা মিস করা যায় না। বড় কিছু পেতে হলে অনেক কিছু ছাড়তে হয়। সাকসেসটা এমনি এমনি আসে না। বিশ্ববিখ্যাত ফটোগ্রাফারদের জীবনে এমন অনেক কৃচ্ছ্রসাধনের ব্যাপার ঘটেছে। পৃথিবীর সব কাজেই অনেক মূল্য দিয়ে সাফল্য পেতে হয়। সাফল্যের ঢেউ এসে দুঃখের চিহ্নগুলো নিমেষেই মুছে দেয়। নিমাই সেই সাফল্য পেতে চায়। এমন একটা কিছু যা তার কেরিয়ার তৈরি করে দেবে। একটা গ্রাউণ্ড অর্থাৎ তার জন্যে অতীশদা যাতে লড়তে পারেন সেই হাতিয়ারটা তাকে তৈরি করে দিতে হবে। গতকাল অতীশদাকে জিজ্ঞেস করেছিল নিমাই, ‘আচ্ছা, ধরুন, একটা মানুষ চোদ্দতলা একটা বাড়ির ওপর থেকে নিচে পড়ে মারা গেল। আমি যদি তার পড়ার ছবিটা, অথাৎ বডিটা শুন্যে রয়েছে সেটা ধরতে পারি তাহলে ছবিটা নিউজ হবে না?’

অতীশদা টেবিলে চাপড় মেরে বলেছিলেন, ‘আলবাত হবে। তেমন ছবি এদেশে আজ পর্যন্ত একটাও হয়নি। বিদেশে হয়েছে। এগুলো যদি মোটরে, মানে মোটরাইজ ক্যামেরায় তোলা যায় তাহলে লোকটা যে পড়ছে তার পর পর স্টেজগুলো ডিটেলে পাওয়া যাবে। দুর্দান্ত কঠিন ব্যাপার।’

নিমাই একটু ভেবে নিয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘স্পিড কত দেওয়া উচিত? হাজার?’

অতীশদা ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, তা তো দেওয়া উচিত। তবে ডেলাইটে ছবি হলে, যদি এনাফ আলো থাকে তাহলে হাজার স্পিড দিলে ভালো রেজাল্ট পাওয়া যাবে।’

নিমাইয়ের নিজের মোটর নেই। অখিলদার আছে, কিন্তু চাইতে গেলে কারণ জিজ্ঞাসা করবে। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে। অগত্যা ভেবে-চিন্তে জ্যোতিষদার দোকান থেকে একটা মোটর ভাড়া নিতে হয়েছে নিমাইকে। নিমাই কনস্ট্রাকশন কোম্পানির লোকের কাছ থেকে খবর নিয়ে জেনেছে আজ থেকে প্যারাপেটের কাজ আরম্ভ হবে। তিনদিন পরেই কাজ খতম। মুন্নার বাপ তখন নিচে নেমে আসবে। প্যারাপেটের কাজের সময় সব চেয়ে উঁচুতে উঠে কাজটা করতে হয়। খারাপ কিছু ঘটলে ওই সময়ই ঘটবে। খারাপ কিছু ঘটার কথা নিমাই অবশ্য জানতে চায়নি, লোকটাই নিজে থেকে গড়গড় করে বলে গেছে। গত বছর নাকি অণ্ডালে রেলের একটা কাজ করতে গিয়ে এই রকমই হয়েছিল। লোকটা নিচে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ।

নিমাই সেই শেষ ছবিটার জন্যই তিনদিন থেকে ওত্ পেতে বসে আছে। আরও দুটো দিন তাকে এইভাবে ক্যামেরা তৈরি করে বসে থাকতে হবে। যেন গোলপোস্টের পেছনে জালের বাইরে ক্যামেরায় চোখ রেখে বসে আছে নিমাই কখন গোল হয় তার প্রতীক্ষায়। সেটা মাত্র নব্বই মিনিটের প্রতীক্ষা। এখানে সংবাদটা বড় তাই প্রতীক্ষাটাও দীর্ঘ। আজ বেরুবার সময় নীতা বলেছিল, ‘তোমার গায়ে জ্বর আছে। আজ নাই বা গেলে।’

নিমাই প্যান্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলেছিল, ‘ও কিছু নয়। ডিসপ্রিন খেয়েছি ঠিক হয়ে যাবে।’

লোকটা যত ওপরে উঠে যায় নিমাইয়ের সমস্ত আগ্রহ আর মনোযোগকেও সে সবেগে টেনে নিয়ে যায় ওপরে। চারপাশের সমস্ত দৃশ্য তার কাছে অর্থহীন, সংবাদহীন মনে হয়। সে জানে, এখন সবচেয়ে বড় সংবাদটি অপেক্ষা করছে অথবা তৈরি হচ্ছে ওপরে। মুন্না খাবার নিয়ে আসে। ‘বাবুজী’ বলে তার পেছনে দাঁড়ায়। কিন্তু মুন্নার দিকে তাকাতে তার ভালো লাগে না। ভাগ্যিস, মানুষ অন্য মানুষের মনটা দেখতে পায় না। যদি পেত তাহলে নাবালিকা মুন্নাও বুঝে যেত তার বাবুজী কিসের প্রতীক্ষায় রোদুরে বসে বসে তার পিতাকে দেখে। মুন্না যখন ‘বাবুজী’ বলে ডাকে, নিমাইয়ের মনে হয় কেউ তার বুকের মধ্যে জ্বলন্ত কয়লার টুকরো চেপে ধরছে। কিন্তু এসব ভাবনার তো কোন মানে নেই। সে শুধু ছবি তুলবে। তার অপরাধ কোথায়! কোন ঘটনাতেই তার কোন হাত নেই। সে কিছুই ঘটাতে যাচ্ছে না। যা ঘটবে সে শুধু সেটাকে ছবি করে রাখবে। বরং এতে মুন্নাদেরই ভালো। ছবিসুন্ধু খবরটা ছাপা হলে কোম্পানির কাছ থেকে মোটা খেসারত পাওয়া যাবে। বহুলোক জেনে যাবে। তদন্ত হবে। হয়তো ভবিষ্যতে আর কোন মুন্নার বাবাকে এমন দুর্ঘটনায় পড়তে হবে না। এটাও তো এক অর্থে সোস্যাল ওয়ার্ক। মুন্নার সঙ্গে কথা বললেও আসল জায়গা থেকে চোখ সরাচ্ছে না নিমাই। সে দেখল একখণ্ড ইটের টুকরো বা ওই জাতীয় কিছু একটা ওপর থেকে ছিটকে নিচের দিকে নেমে এল। নিমাই ক্যামেরায় চোখ রেখে ওপরের মানুষটাকে দেখে যেতে লাগল। তার গোটা শরীর জুড়ে দপদপ করছে একটা উত্তেজনা। গায়ের জ্বর বেড়ে যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি থেকে থেকে ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। সেই দৃষ্টি দিয়ে সে যেন থেকে থেকেই দেখতে পাচ্ছে লোকটা বাঁশের ভারা থেকে পা হড়কে নিচে পড়ে যাচ্ছে। শরীরটা শূন্যে ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে নিচের দিকে। মাঝে মাঝে এমন হয় যে নিমাই মোটরটা চালু করে দেবার জন্য হাত বাড়ায়। আজও বাড়াচ্ছিল, হয়তো চালু করেই দিত যদি না মুন্না ‘বাবুজী’ বলে ডেকে ফেলত।

ক্যামেরায় চোখ রেখেই ক্লান্ত চোখে নিমাই দেখল আজও কিছু ঘটল না। লোকটা অপরাহ্রে করুণ আলোয় ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসছে। আগামী কালই কাজ শেষ। হয়তো এতদিন যা ঘটেনি। কালই তাই ঘটবে, নির্ঘাত ঘটবে। নিমাই ভূতে-পাওয়া মানুষের মতো নিজের মনেই আওড়াতে থাকে, নির্ঘাত ঘটবে। আলবত ঘটবে। আমার এই প্রতীক্ষার একটা মূল্য আছে।

সেদিন রাত্রে বেদম জ্বর এল নিমাইয়ের। সকালে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে টের পেল তার মাথা ঘুরছে। ঠিকমতো পা ফেলতে পারছে না। চা খাবার পর দুটো ডিসপ্রিন জলে গুলে খেল। নীতার নিষেধ উপেক্ষা করে বেরুতে বেরুতে বলল ‘জরুরি অ্যাসাইনমেন্ট। ফেল করলে হবে না।’

আজ পৌঁছতেই মুন্না দৌড়ে এল। মুন্নার এ-সময় আসার কথা নয়। লোকটা বাঁশের সিঁড়িতে প্রণাম করে ধীরে ধীরে উঠতে আরম্ভ করেছে। মুন্না ভয়ের গলায় বলল, ‘আজ বহুত ডর লাগছে বাবুজী। কাল রাতে আমি খোয়াব দেখেছি। বহুত বুরা খোয়াব। বাবার তবিয়ত আজকে বিলকুল খারাপ। লেকিন কী করবে। কনটাকটর বাবু আজ কাম খতম করবে তাই বাবাকে লিয়ে আসলাম।’

ক্যামেরার যন্ত্রপাতি ঠিক করতে করতে নিমাই বলল, ‘আজ খাবার আনবে না?’

মুন্না জবাব দিল, ‘আজ তো আধাবেলা কাম। দুটোয় নেমে আসবে। দুটোর মধ্যেই কাম খতম হয়ে যাবে।’

নিমাই মনে মনে ভেবে নিল, তার মানে ফুল ডেলাইটে শেষ ছবিটা পাওয়া যাবে। হাজার স্পিড়ে দারুণ ছবি হবে। এ ছবি ফ্রণ্ট পেজে ছাড়া আর কোথাও যাবার নয়।

মাথা ঠিক রাখতে পারছিল না নিমাই। গোটা শরীর জুড়ে জ্বর আর যন্ত্রণা। মাথা ঘুরছে। লোকটা ধীরে ধীরে ওপরে উঠে যাচ্ছে। মুন্না চোখ বড় বড় করে তার বাবাকে দেখছে। মেয়েটার সারা মুখে ভয় আর উদ্বেগ এত স্পষ্ট করে কোনদিন ফুটে উঠতে দেখেনি নিমাই। নিমাই ক্যামেরায় চোখ রাখল। আজ নির্মেঘ নীল আকাশ। সেই আকাশের নিচে এক চোদ্দতলা বাড়ির মাথায় প্যারাপেটের কাজ করছে একজন শ্রমিক। লাবানী, অর্থাৎ হেল্পাররা উঠে গেছে বাঁশের ভারার ওপর। নিজের শরীরটা আজ অবাধ্য। তবুও নিজেকে তৈরি করে রাখল নিমাই। আজকেই সেই চরম দিন। ওই লোকটি যেই মুহুর্তে ওপর থেকে গড়িয়ে নিচে পড়বে সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হবে নিমাইয়ের ওপরে ওঠার পালা। অনেক দিনের অনেক অপমান আর গ্লানির যোগ্য জবাব দেবার জন্য নিমাই তৈরি হয়ে আছে। হয়তো নীতাও তার ওপর ভরসা হারিয়েছে। কিন্তু আজ সবকিছু ফিরে পাওয়ার দিন।

নিমাই দেখল মুন্না আজ কম কথা বলছে। ওর গম্ভীর মুখে বিপদের ছায়া। ‘ওকে ঘিরে দিনের আলো বড় করুণ হয়ে আছে। নিমাই ক্যামেরায় চোখ রেখে ওপরে তাকাল। তিরতির করে সময় চলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে কাজ শেষ করে আনছে লোকটা। আর একটু পরেই তার নামার পালা। হয়তো তখনই সেই ঘটনাটা ঘটবে। যা ঘটবে তার অগ্রিম চিত্রটা মনে মনে ভাবতে লাগল নিমাই। ঘোলাটে চোখ লোকটির ওপর স্থির হয়ে আছে।

এবার লোকটা নেমে আসছে। এরই মধ্যে কাজ শেষ করে ফেলল? লোকটা নামছে। বাঁশের সিঁড়ির প্রথম ধাপটা ছাড়িয়ে এসে নিচের ধাপে পা রাখল। সিঁড়িটা কাঁপছে। লোকটার পা কাঁপছে।

লোকটা পরের ধাপে পা রাখবার জন্য পা নামাল, হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে নিচে হাতটা রাখতে যাচ্ছে, বোধ হয় পা ফসকালো কিংবা অন্য কিছু, মুহূর্তের মধ্যে লোকটার শরীর সমস্ত অবলম্বন হারিয়ে শূন্যে ভেসে পড়ল। শরীরটা দ্রুত নিচে নামছে। সংবাদ তৈরি হয়ে গেল। নিমাই মোটর অন করে ক্যামেরার শাটার টিপতে লাগল। শুধু শুধু নিঃশব্দ হাহাকারের মধ্যে ক্যামেরার শাটার টিপে চলার ক্রিচ ক্রিচ আওয়াজ। তারপর সমস্তটা ঠাণ্ডা, অন্ধকার।

একদিন বাদে চোখ মেলে তাকাল নিমাই। ভাল করে চোখ খুলে দেখল নীতা তার সামনে। নীতার ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ টের পেল কপালে। অভিমানের গলায় নীতা বলল, ‘ভাগ্যিস ওরা তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল নইলে সর্বনাশ হয়ে যেত। জ্বরের ঘোরে তত বেহুঁশ হয়ে ছিলে।’

নিমাই জড়ানো গলায় বলল, ‘আমার ক্যামেরা, ফিল্মের রোল…’

নীতা বলল, ‘সব ঠিক আছে। দিলু তোমার ছবি প্রিন্ট করে এনেছে। পরে দেখো।’

উত্তেজনায় উঠে বসতে যাচ্ছিল নিমাই। নীতা তাকে জোর করে শুইয়ে দিতে নিমাই বলল, ‘ছবিগুলো দাও। এখনই দাও।’

নীতা ছবির প্যাকেটটা নিয়ে এল। নিমাই প্যাকেট থেকে ক্ষিপ্র হাতে ছবিগুলো বার করে দেখতে লাগল। কিন্তু এ কি ছবি! একজন প্রৌঢ় শ্রমিক হেঁটে আসছে আর একটি নাবালিকা মেয়ে দুই চোখ খুশিতে উজ্জ্বল করে হাত বাড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে তার দিকে। মৃত্যু নয়, শোক নয়, কোন হাহাকারের চিহ্ন নেই। একটি দরিদ্র বাপ আর তার নাবালিকা মেয়ে পরস্পরের কাছে হাত বাড়িয়ে ছুটে আসছে, হাসছে, আঙুল তুলে আকাশ দেখাচ্ছে। এর মধ্যে সংবাদ কোথায়?

নিমাই চোখ বুজে ফেলল। বুকের ওপর ছবিগুলো ছড়ানো। সে জানে এ ছবি কোথাও ছাপা হবার নয়। এর মধ্যে চমকে দেবার মতো কোন সংবাদ নেই। নিমাই চোখ বন্ধ রেখেই মনে মনে বলল, ‘নীতা, এগুলো আমার অ্যালবামে রেখে দাও।’

ছবিগুলো বুকের ওপর ছড়ানো পড়ে রইল। বুকের মধ্যে থেকে মুন্না ডাকছে, ‘বাবুজী! তুমি কিসের ফটো তুলছ, ও বাবুজী, বাবুজী।’ নিমাইয়ের বন্ধ চোখ জলে ভিজে গেল। এ-সময় তার চোখে কান্না এল কেন সেটা সে জানে না। সে শুধু অনুভব করতে পারছে, এখন কান্নাতেই তার সুখ, হয়তো স্বস্তিও।

১৩৯৪ (১৯৮৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *