শেষ অশ্বারোহী
জুলাই মাস নাগাদ একটা বর্ষা ভাল করে পেরোবার আগেই যখন পর পর তেরোটা ওয়াইপার চুরি গেল, সনাতন সরকার স্থির করে ফেললেন, আর গাড়ি নয় এবং সত্যি সত্যিই সাত দিনের মধ্যে জলের দামে গাড়িটা বেচে দিলেন।
গাড়িটা বেচে তার বিপদ কিন্তু আরও বাড়ল। থাকেন হাতিবাগানের কাছে। অপিসের সময় সেখান থেকে ট্রামে-বাসে ওঠা যায় না, মিনিবাস কিংবা ট্যাকসির নাগাল পাওয়া অসম্ভব। পঞ্চাশ বছর বয়স হয়েছে সনাতনবাবুর, সারাজীবন নিজের গাড়িতে অপিসে যাতায়াত করেছেন, এখন এই শেষবয়েসে নাকালের একশেষ।
দু-একদিন হেঁটে যাতায়াত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার ধাক্কায় রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে শয্যাশায়ী হয়ে রইলেন পনেরো দিন। রোগশয্যায় নিজের ঘরে চুপ করে শুয়ে বসে অবশেষে চিন্তাটা মাথায় এল তার, একটা ঘোড়া কিনলে কী রকম হয়? সেই কবে ছোটবেলায় পড়েছেন হর্স ইজ এ নোবল অ্যানিম্যাল–রোগশয্যায় ঘোড়ার কথা চিন্তা করতে করতে তিনি উত্তেজিত হতে লাগলেন। কত সুবিধে, গ্যারেজের দরকার নেই, প্যাসেজে বেঁধে রাখো, পার্কিং ফি নেই, পেট্রোল-মবিল লাগবে না, একটু ছোলা আর ঘাসজল হলেই হবে, তাও তিনি ঠিক করলেন বিকেলে অপিস থেকে ফিরবার পথে ময়দান হয়ে একটু ঘাস খাইয়ে আনাও চলবে, এবং সবচেয়ে বড় কথা ঘোড়ার পার্টস চুরি যাবার কোনও ভয় নেই, চুরি গেলে আস্ত ঘোড়াটা চুরি যেতে পারে, কিন্তু সে প্রায় অসম্ভব, ঘোড়াচোর এখন দেশে আর না থাকাই সম্ভব, অন্তত কলকাতায় তো নেই-ই।
দু-একদিনের মধ্যেই অবশ্য অনিবার্যভাবে, পরবর্তী চিন্তা মাথায় এল তার। প্রথম সমস্যা, ঘোড়া কোথায় পাওয়া যাবে? দ্বিতীয় হল, ঘোড়ার জন্য লাইসেন্স লাগবে কিনা?
এই দুই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে সনাতনবাবু অসুখ ভাল হওয়ার পরে আরও তিন সপ্তাহ ছুটি বাড়িয়ে নিলেন। প্রথমটির সমাধান তিনি নিজেই করলেন। একদিন বেড়াতে বেড়াতে শেয়ালদা গিয়ে ছ্যাকড়া গাড়ির কোচোয়ানদের কাছে আলাপ-আলোচনা করে জানতে পারলেন, কাটিহারের কাছে এক হাটে ভাল ঘোড়া পাওয়া যাবে। একজন বুড়ো গাড়োয়ান বলল, দার্জিলিং-এ ভাল টাটু-ঘোড়া পাওয়া যায়, দামও খুব কম।
কিন্তু দার্জিলিং কিংবা কাটিহার থেকে কে নিয়ে আসবে ঘোড়া? অবশেষে একজন সৎ পরামর্শ দিল, এই খিদিরপুরের গোহাটাতেই একবার খোঁজ করে দেখুন না, ভাল ঘোড়া পেয়ে যেতে পারেন হঠাৎ। মোটের উপর, শেয়ালদার সহিস-কোচোয়ান যারা আছে সবাই খুবই খাতির করল সনাতনবাবুকে। বহুদিন তাদের রুজির বাইরের কোনও লোক তাদের কাছে ঘোড়া সম্বন্ধে এত খোঁজখবর করেনি।
সহিসেরা খুব খুশি হল বটে, কিন্তু আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীদের নিয়ে খুব বিপদ হল সনাতন সরকার মশায়ের। বিশেষ করে যখন তিনি ওই দ্বিতীয় সমস্যা নিয়ে ঘোড়ার লাইসেন্স লাগে কি না…খোঁজখবর শুরু করলেন, সকলের ধারণা হল তার সম্পূর্ণ মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অনেকেই বলল, খুব খারাপ ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিল, আজকাল এরকম খুব হচ্ছে, ব্রেনটা টোটালি ড্যামেজ করে দিয়েছে। যারা একটু অচেনা, তারা অবাক হয়ে গেল, কী বললেন, ঘোড়ার লাইসেন্স? ঘোড়ার লাইসেন্স দিয়ে কী করবেন? ঘোড়ার গাড়ি, ভাড়াটে গাড়ি করবেন? নিজে চড়বেন? ঘোড়ায় চড়ে অপিস যাবেন? কোথায় অপিস, এসপ্ল্যানেডে? হাতিবাগান থেকে এসপ্ল্যানেড ঘোড়ায় চড়ে? দৈনিক দুবেলা?
একটা সামান্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রশ্নের ঝড়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন সনাতনবাবু। এবং দু-একদিনের মধ্যে সনাতনবাবু স্পষ্ট বুঝতে পারলেন–ঘোড়ার অর্থাৎ ঘোড়ার পিঠে কলকাতা শহরের রাস্তায় যাতায়াতের জন্যে ঘোড়া কিংবা তার মালিকের লাইসেন্স লাগে কিনা, অথবা ঘোড়ার পিঠে যাতায়াতে এই শহরে কোনও বাধানিষেধ আছে কিনা এই প্রশ্নটি খুব সোজা নয়। এর উত্তর কেউ জানে কিনা তার রীতিমতো সন্দেহ হতে লাগল।
সনাতনবাবু সর্বপ্রথমে লালবাজারে গিয়েছিলেন। সেখানে তারা ডি. সি. ট্রাফিকের অফিসে পাঠালেন। ট্রাফিক অপিসে সবাই ধরে নিয়েছিল তিনি কোনও পাঁচ আইন ভঙ্গের মামলার তদ্বিরে এসেছেন, যখন শুনল, ঘোড়া, সঙ্গে সঙ্গে তারা তাকে কর্পোরেশন দেখিয়ে দিলেন।
সনাতনবাবু কর্পোরেশনে গেলেন। সেই অপিসটি একটু অন্যরকম, কোথায় অনুসন্ধান করতে হবে সেটা জানতেই তার তিন দিন গেল। অবশেষে লাইসেন্স সেকশনে যেতে বললেন এক ভদ্রলোক। সেখানে গিয়ে একটু খোঁজ করতেই গো-মহিষ এবং সারমেয় শাখার পাশে অশ্ব-অশ্বেতর শাখা খুঁজে পেলেন। সেখানে সবাই বলল, হ্যাঁ, ঘোড়ার লাইসেন্স তাঁরা অনায়াসে দিতে পারেন, কিন্তু ঘোড়ায় চড়ার লাইসেন্স এ-বিষয়ে তাদের কিছু জানা নেই। এখান থেকে সেরকম কিছু দেওয়া হয় না–এখানেই এক ভদ্রলোক সনাতনবাবুকে পরামর্শ দিলেন, একবার রেসকোর্সে গিয়ে টার্ফ ক্লাবে খোঁজ করে দেখুন। টার্ফ ক্লাবের লোকেরা বললেন, আমাদের ঘেরা মাঠে ঘোড়দৌড়ের লাইসেন্স আছে। তারা ফাইল খুলে সনাতনবাবুকে সব লাইসেন্স-সার্টিফিকেট দেখালেন, তারা কী ভেবেছিলেন কে জানে, বোধহয় তাকে কোনও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তরের লোক, কর কিংবা লাইসেন্স ফাঁকির ব্যাপার নিয়ে তদন্ত করতে এসেছেন বলে ধরে নিয়েছেন। খুব ভদ্রতা করলেন, চা-জলখাবার খাওয়ালেন কিন্তু কিছুতেই বলতে পারলেন না কলকাতা শহরের রাস্তায় ঘোড়ায় চড়ে যেতে কোনও লাইসেন্স লাগবে কিনা?
সনাতনবাবু নাছোড়বান্দা প্রকৃতির লোক, তার ওপরে বে-আইনি কাজ করতে ভয় পান। বিনা লাইসেন্সে রাস্তায় ঘোড়া চড়া আইনসঙ্গত কিনা এটা তাকে জানতেই হবে।
এবার তিনি নিজে থেকেই গেলেন মাউন্টেড পুলিশের দপ্তরে। ওরা তো মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করে, ওরা জানতে পারে। মাউন্টেড পুলিশের দপ্তরে একদিন সন্ধ্যার দিকে সনাতনবাবু উপস্থিত হয়ে হাতের কাছে একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সার্জেন্ট পেয়ে সেই সাহেবকে তার হাতিবাগানি ইংরেজিতে সমস্যাটা যথাসাধ্য বোঝাবার চেষ্টা করলেন। সাহেব চোখ গোল গোল করে সব শুনে কী বুঝল কে জানে, শুধু একবার হাউ ফানি বলে, পাশেই একটা দশ ফুট উঁচু ওয়েলার ঘোড়া ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছিল, তার পিঠে সনাতনবাবুকে ঠেলে তুলে দিতে গেল। সনাতনবাবু কোনও ক্রমে তার হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচলেন।
কিন্তু তাতে সমস্যার কোনও সমাধান হল না। একটা সামান্য খবরের জন্য তিনি দিনের পর দিন অপিসে অপিসে দরজায় দরজায় ঘুরতে লাগলেন। সবকটা দৈনিক ও সাপ্তাহিক কাগজে প্রশ্নবোধক চিঠি পাঠালেন। কিন্তু তারা কেউ তাঁর চিঠি ছাপালেন না।
বাধ্য হয়ে সনাতনবাবু মুখ্যমন্ত্রী, লাটসাহেব এবং প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি তার সমস্যার দিকে আকর্ষণ করিয়ে পত্র দিলেন। কিছুদিন পরে রাইটার্স বিল্ডিং থেকে উত্তর এল, তার আবেদন উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য পরিবহন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। পরিবহন দপ্তর তাঁকে টুরিজম দপ্তরে পাঠালেন। সেখান থেকে খোঁজ করে জানলেন তাকে পশুপালন দপ্তরে যেতে হবে, সেখান থেকে বন-বিভাগ, সেখান থেকে কেন্দ্রীয় পর্যটন বিভাগ, সেখান থেকে আবার পশু-বিভাগ, তবে এবার পশুপালন নয়, পশু-চিকিৎসা বিভাগ, সনাতনবাবু ক্রমাগত ঘুরতে লাগলেন, আরও দুমাস ছুটি বাড়িয়ে নিলেন।
এইরকম অনেক ঘাটে জল খেয়ে সনাতনবাবু একদিন পশুক্লেশ নিবারণী সমিতিতে এসে পৌঁছালেন। তারা সব শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, ঘোড়াটা কোথায়? সনাতনবাবু বললেন, ঘোড়া এখনও কিনিনি। তারা তখন বললেন, তাহলে এখন আমাদের কিছু করণীয় নেই। আমাদের এটা পশুক্লেশ নিবারণী সমিতি। আপনার কথা শুনে বুঝতে পারছি আপনার খুবই ক্লেশ হয়েছে, কিন্তু আপনার ক্লেশ দূর করার ক্ষমতা আমাদের নেই। অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে সনাতনবাবু চলে এলেন।
এই শেষ ঘটনার পনেরো দিন পরের কথা। ইতিমধ্যে আশ্বিন মাস এসে গেছে। শরতের নীল আকাশে ঝকঝকে আরবি ঘোড়ার মতো সাদা মেঘগুলো গ্রীবা নাচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এইরকম এক সকালবেলায় হঠাৎ হাতিবাগানের লোকেরা দেখল এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোক টগবগিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। ঘোড়া অবশ্য আকাশের মেঘের মতো সাদা নয়, বাদামি এবং খুব বড়ও নয়, তবু তো সত্যিকারের ঘোড়া।
শুধু রাস্তার লোকেরাই নয়, জানলা, দরজা, বারান্দায়, ছাদে দাঁড়িয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই সবিস্ময়ে এই অভাবিত দৃশ্য দেখতে লাগল। কলকাতার জটিল রাস্তায় ট্রামবাস, ট্যাকসি-রিকশা, পদাতিক ইত্যাদির পাশাপাশি কদম চালে এক অশ্বারোহী প্রফুল্ল বদনে চলে যাচ্ছে। মোড়ের ট্রাফিক পুলিশ জিনিসটা বে-আইনি হচ্ছে কিনা বুঝতে না পেরে পকেট থেকে নোটবুক বার করে কী একটা লিখতে গিয়ে খেয়াল করল ঘোড়ার নম্বর নেই। সে হতভম্বের মতো ট্রাফিক কন্ট্রোল বন্ধ করে দিয়ে অশ্ব এবং অশ্বারোহীর দিকে হা করে তাকিয়ে রইল।
বলা বাহুল্য, শ্রীযুক্ত সনাতন সরকার মশায়ই এই অশ্বারোহী। তিনি কী করে ঘোড়া সংগ্রহ করলেন, ঘোড়া এবং তার আরোহী অর্থাৎ নিজের জন্যে লাইসেন্স সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন কিনা শেষ পর্যন্ত, ইত্যাদির বিস্তারিত আলোচনায় আমরা যাব না। কারণ, সেটা সনাতনবাবুর স্বার্থের বিরোধী হবে।
শুধু এটুকু বলে রাখি, সনাতনবাবু সাহসী লোক। আজ দু-দিন হল মাত্র ঘোড়াটি একটি সাময়িক সহিসসহ সংগ্রহ করে এনেছেন। আজ সকালবেলায় সহিস ঘোড়াকে দানাপানি খাইয়ে লাগাম পরিয়ে দিয়েছে। এখন সেও সঙ্গে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সনাতনবাবু তাকে রেখে একাই ঘোড়ার পিঠে চড়ে অপিসের দিকে রওনা হয়েছেন। কে কী বলতে চেয়েছিল, সনাতনবাবু তাতে একবিন্দু কর্ণপাত করেননি।
কর্ণপাত করার মতো কোনও কারণও দেখা গেল না। নির্বিবাদে গ্রে স্ট্রিট হয়ে সোজা চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ হয়ে কয়েক সহস্র পথচারী এবং অলিন্দবিহারী জনতার অভিভূত দৃষ্টির সামনে দিয়ে কলকাতার শেষ অশ্বারোহী এসপ্ল্যানেডে এসে পৌঁছালেন।
আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন, ধীরে-সুস্থে কার্জন পার্কের পিছন দিক দিয়ে ঘোড়া নিয়ে সনাতনবাবু মেয়ো রোডের একপাশে একটা ঘাসে-ভরা জায়গায় এসে দাঁড়ালেন। ঘোড়া থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমে হাতের ব্যাগ থেকে একটা পাটের দড়ি বার করে ঘোড়াটার গলায় বাঁধলেন, তারপর আরেকটা প্রান্ত বেঁধে দিলেন একটা কৃষ্ণচূড়ার গুঁড়ির সঙ্গে। এরপর অত্যন্ত সাবধানে, ভয়ে ভয়ে মুখ থেকে লাগামটা ছাড়িয়ে ব্যাগে ভরে নিলেন, ঘোড়াটা আনন্দে পরপর তিনবার হ্রেষাধ্বনি করে উঠল।
সনাতনবাবুও খুশিমনে অপিস চলে গেলেন। এতদিনে তার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে। তার ওপরে পার্কিং ফি লাগছে না।
বিকেলে অপিস থেকে বেরিয়ে মনে একটু শঙ্কা ছিল, গিয়ে ঘোড়াটা দেখতে পাবেন কিনা। কিন্তু দূর থেকেই দেখতে পেলেন, ঘোড়াটা গ্রীবা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ইতিমধ্যে পরিচিত অপরিচিত মহলে, নানা দিকে সনাতনবাবুর কীর্তির কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। সনাতনবাবু ঘোড়র কাছে পৌঁছে দেখলেন, ঘোড়ার থেকে একটু নিরাপদ দূরত্বে একটা ছোটখাটো জনতা। তারা এতক্ষণ অধীর কৌতূহলের সঙ্গে অপেক্ষা করছিল, সনাতনবাবু যেতেই একটা চাপা গুঞ্জন উঠল।
কোনওদিকে দৃষ্টিপাত না করে অত্যন্ত স্মার্টভাবে সনাতনবাবু ঘোড়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। তার আগে হাতের ব্যাগ থেকে লাগামটা বার করে নিয়েছেন। কিন্তু লাগাম পরাতে গিয়ে বুঝলেন অসম্ভব, সহিস ছাড়া এ কাজ তার পক্ষে অসম্ভব। ঘোড়াটা এমনিতে নিরীহ, কিন্তু কিছুতেই মুখ খুলবে না। আর মুখ না খুললে লাগামও লাগানো যাবে না।
অনেকক্ষণ চেষ্টার পর সনাতনবাবু ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। কৌতূহলী জনতাও আস্তে আস্তে কেটে পড়ল, শুধু কয়েকজন তখনও দাঁড়িয়ে। সনাতনবাবু খুব মাথা খাটিয়ে অবশেষে ঘোড়াটার মুখের সামনে আস্তে আস্তে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও মধ্যমার সাহায্যে ছোট ছোট তুড়ি দিতে লাগলেন। যে কয়েকজন তখনও উপস্থিত ছিল তারা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে গেল যে, সনাতনবাবু সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গেছেন। তারা কেউ সনাতনবাবুকে বুঝতে পারল না, সে বুদ্ধিই তাদের নেই। এই আশায় সনাতনবাবু তুড়ি দিয়ে চললেন, যে তুড়ির শব্দে ঘোড়াটা যদি একবার হাই তোলে, সঙ্গে সঙ্গে লাগামটা মুখে গলিয়ে দেবেন।
ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার ময়দানে ঘন হয়ে এল। সনাতনবাবুর হাতের বুড়ো আঙুলে ফোঁসকা পড়ে গেল, আশ্বিন মাসের আকাশের নীচে মেয়ো রোডের কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় কলকাতার শেষ অশ্বারোহী বাঁ হাতে লাগাম ধরে ডান হাতে অক্লান্ত, অনবরত ঘোড়ার মুখের সামনে তুড়ি দিয়ে চললেন।