ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

শৃগাল ও ছারপোকা

শৃগাল ও ছারপোকা

এখন বেঁচে থাকার উপায় বের করতে হবে। প্রাণীজগতে দেখা গেছে, পরিবেশ আর পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে বিশাল-বিশাল প্রাণীরা ক্রমে একসটিংক্ট হয়ে গেছে। বিশাল বলে পার পাবার উপায় নেই। দেহটা কোনও ফ্যাকটারই নয়। ফ্যাকটার হল মগজ, ব্রেন। বুদ্ধি খাটিয়ে বাঁচতে হবে। পৃথিবী মারবার জন্যে প্রস্তুত, তবু ছলে বলে কৌশলে বেঁচে থাকতে হবে। লিভ উই মাস্ট!

পৃথিবীতে যখন এসে পড়েছি, এই পাঠশালা থেকেই কৌশলের পাঠ নিতে হবে। ডায়নোসর, টেরোড্যাকটিল লোপাট হয়ে গেছে, কিন্তু শৃগাল আর ছারপোকা এখনও বহাল তবিয়তে আছে। মানুষের মধ্যে যারা টেরোড্যাকটিল কিংবা ডায়নোসর স্বভাবসম্পন্ন ছিলেন, তারা সব আউট হয়ে গেছেন। যাঁরা ছিলেন বার্ডস অফ প্যারাডাইস, তাঁরা এখন ভুতো বাবু। শৃগালের দিন কিন্তু চলছে, চলবে। গরম জল ঢেলে, ইনসেকটিসাইড স্প্রে করে ছারপোকার বংশও ধ্বংস করা যাবে না। অতএব শৃগাল আমাদের গুরু, ছারপোকা আমাদের শিক্ষক।

শৃগালের কাছে কী শিখব? প্রাণীজগতে শৃগাল হল মধ্যবিত্ত। ন্যাজের বাহার বেশ চামরের মতো, ন্যাজাভারী জন্তু। মুখটি ছুঁচোলো। নজরটি তীক্ষ্ণ, তক্কে তক্কে থাকে, ঝোপ বুঝে কোপ মারে। সবলের ফেউ দুর্বলের শত্রু। সবার ওপরে, সব শেয়ালের এক রা। হুক্কা হুয়া ছাড়া স্বরযন্ত্রে স্বতন্ত্র কোনও শব্দ নেই। শৃগালের সবচেয়ে বড় গুণ, কর্তাভজা প্রাণী। সে জানে, হিংস্র ক্ষমতাশালী পশুর একটি থাবায় তার অক্কা, কিন্তু পাশে-পাশে একটু গা বাঁচিয়ে চলতে পারলে উঁচু দরের উচ্ছিষ্ট মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়। বড়রা ছোটদের মারবেই, ক্ষমতাশালীরা ক্ষমতার লাঠি ঘোরাবেই, তবু ভুলিয়ে ভালিয়ে ভারী শিকারকে অর্থব পশুরাজের নাগালে এনে ফেলতে পারলেই পাকা ফলারের ভাগ মারে কে! দালালির চেয়ে ভালো জীবিকা আর কী আছে! আসল কৌশলটা কী? ছলে বলে কৌশলে বধ করে যাও। ঠোঁটে মাংসখণ্ড নিয়ে গাছের ডালে বসে আছে কাক। ওপর দিকে মুখ তুলে বলে যাও, তুমি কী সুন্দর, কী সুন্দর তোমার কণ্ঠস্বর মানিক! গ্যাস দিয়ে যাও অনবরত; যতক্ষণ না গাছস্থ কাক ‘কা’ করে উঠছে। করলেই কাজ হাসিল। ফসকে দেবার চেষ্টা চালাও। একজন ফসকালেই আর একজনের লাভ। একটু মোসায়েবি করলে আখের যদি ফেরে, মোসায়েব হতে আপত্তি কী! শৃগাল এই সত্যটুকু জানে বলেই তার এত বাহার, এত চেকনাই!

শৃগাল জানে, নিজস্ব সমাজে চলাফেরা না করলে শৃগালত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। শৃগাল তার বিচরণভূমি সরাতে জানে। শক্তিশালী ক্ষমতাশালী জীব যত এগোতে থাকে, শৃগাল ততই পেছতে থাকে। কখনও রুখে দাঁড়ায় না। সরে যায় তবে সরে পড়ে না। আশেপাশে থাকে, নিজের স্ট্রাটেজিটি ঠিক বজায় রাখে। নিজেদের মধ্যে কেউ-কেউ শ্রেষ্ঠ হতে চাইলে তাকে বর্জন করে, না হয় তার পেছনে লেগে জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। সেই নীল বর্ণ শৃগালকে কী শিক্ষাই দিয়েছিল! শৃগালনীতি আমাদেরও শিখতে হবে, এখনও শিখে না থাকলে। বড় বড় ব্যবসায়ীরা বাপ-ঠাকুরদার আমলের ভিটেমাটি গ্রাস করছে করুক, আমরা ক্রমশই সরতে থাকি শহরতলির দিকে। আমাদের জন্যে তৈরি হোক সরকারি শৃগাল খোপ, হাউসিং এস্টেট। আমাদের মধ্যে নীলবর্ণ বলে যে দাবি করছে, কিছুদিন তাকে লক্ষ করো, তারপর ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’। নিজের ন্যাজ কেটে গেলে ক্যামপেন চালাও, যাতে সকলেই ন্যাজটি কেটে ফেলে। তা না করলে ‘চলবে না, চলবে না’ স্লোগান তো আছেই। সমস্বরে হুক্কা হুয়া, কা হুয়া, কা হুয়া।

শৃগালের মতো শিখতে হবে প্রতিযোগিতা বড় অনিশ্চিত ব্যাপার! বাঘে-বাঘে লড়ছে, লড়তে দাও। তুমি শুধু তক্কে থেকে শিকারটি নিয়ে সরে পড়ো। শৃগালের সবচেয়ে বড় নীতি ‘সরে পড়ো, তবে শুধু হাতে নয়, যা পারো হাতিয়ে নাও’। যে হাতাতে জানে, সে বাঁচতে জানে। নীতিটা হল, লড়িয়ে দাও। মেষে মেষে লড়ে যাক, তারপর যে কেউ একজন মরবেই, তখন দৃশ্যপটে এসে ডেডবডিটি নিয়ে সরে পড়ো। শৃগাল শেখাতে চায়, অপেক্ষাই সবচেয়ে বড় ধর্ম। উইংসের পাশে বসে থাকো, এ নাটকের পরই আসল নাটক। তুমি দায়ভাগী হবে কেন? তুমি হবে ফলভোগী। শৃগালের কাছে আর একটা বড় জিনিস শিখতে হবে, তস্করবৃত্তি। বেওয়ারিশ মাল দেখলেই তুলে নাও। শৃগাল হল সবচেয়ে বড় লিফটার। শৃগালের সন্তোষ কনটেন্টমেন্ট। নাগালের বাইরে ঝুলছে দ্রাক্ষাফল, খানিক হাঁচড়পাঁচড় করে এই বলেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে, ‘দ্রাক্ষাফল বড় টক। বড়-বড় চাকরি, বড়-বড় ব্যবসা, গাড়ি, বাড়ি যার নাগালে আছে থাক, আমরা আঁস্তাকুড়ের পাশে খাপরার চালের তলায় বসে ন্যাজ নাড়তে-নাড়তে বলি, ওসব চুরির পয়সা ব্ল্যাক মানি ব্রাদার, ওসব আমাদের ধাতে সহ্য হবে না। আমরা হলুম বিশুদ্ধ গব্য ঘৃত। ছোটোখাটো ঘুষঘাস, একটু-আধটু চুরি, অল্পস্বল্প উঞ্ছবৃত্তিতে সাধুদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না। ছিঁচকে চুরি শৃগালের ধর্মেই পড়ে, শাস্ত্রসম্মত ডাকাতি না করলেই হল। শৃগাল ডাকাতি করতে গেলেই ধরা পড়ে জেলে যাবে নির্ঘাত।

ছারপোকার কাছে শিখতে হবে টেনাসিটি। খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকার কৌশল। চেয়ারের ফোকরে, খাটের খাঁজে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে বছরের পর বছর রক্তের অপেক্ষায় থাকো। হৃষ্টপুষ্ট মানুষটি এলেই সুড়সড়ু করে বেরিয়ে এস। মহাভোজে মেটাও তৃষ্ণা। গ্রামের মানুষ কেউ একবেলা খায়, কেউ একদিন অন্তর খায়। তারা এখনও বেঁচে আছে। শুধু বেঁচে নেই, বছরে-বছরে বংশ বৃদ্ধি করে চলেছে। এদের হাতে লাঙল। এদের কাঁধে গ্রামীণ শিল্পের জোয়াল। এরা আমাদের অর্থনীতির রূপকার। বছরের পর বছর শত চেষ্টাতেও এরা মরে না। বন্যা, খরা, মহাজনের স্প্রে, সব অস্বীকার করে অন্ধকার কোণে ফ্যাকাশে হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। তৈলচিক্কণ গুটিকয়েক মানুষ জৈন ধর্মের নীতি অনুসরণ করে মাঝে-মাঝে খটমল খিলাবে। আহারে অনাহারে ছারপোকাই আমাদের আদর্শ। স্বভাবে শৃগাল আমাদের অনুকরণীয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *