শূন্য থেকে শূন্যে
আর তো পারা যায় না, তিরিশ বত্রিশ বছর ধরে এক নাগাড়ে চাকরি করেই যাচ্ছি। করেই যাচ্ছি। রোজ সকালে ওঠ। এক কাপ পাঁচন গেলো। বাজার করার থলিটা হাতে নাও। বেরিয়ে যাও বাজারে। গুঁতোগুঁতি। ঠ্যালাঠেলি। যেন ফ্রি-স্টাইল কুস্তির আখড়া। থলেটার তলার দিকের সেলাই খুলে গেছে। বাড়িতে কারুর ছুঁচ ধরার সময় নেই। হাত যেন উত্তাল নদীতে সংসারের হাল ধরে আছে। হাল ছেড়ে এক মুহূর্ত ছুঁচ ধরলে নৌকো ডুবে যাবে। সুতরাং ড্যাবা ড্যাবা দুটো সেপটিপিন লাগানো আছে। আলুপটল গায়ে গতরে জিনিস। গলবে না। কড়াই শুঁটি কি ছোট মাপের উচ্ছে গলে যাবে। কোনও রকমে বাজারটা সংসারের চাতালে ফেলে দিয়ে দাড়ি কামাও। তিরিশটা বছর ধরে উলটোপালটা টান মেরে দাঁড়ির কী আবস্থা! যেন এলোমেলো পিন কুশান। সিঙ্গল ব্লেড, ডবল ব্লেড, বিলিতি ব্লেড, সবই ফেল মেরে যায়। মসৃণ গোলাপি গাল আর বেরোয় না। অবশ্য গাল বলে আর কিছুই নেই। দু-পাশে দুটো গর্ত। কোনও সুন্দরী যদি ক্ষমা ঘেন্না করেও হঠাৎ একটা চুমু খেতে চায়, তাহলে বলতে হবে, সুন্দরী, ওয়েট এ মিনিট। গালটাকে গজিয়েনি। বাতাস পুরে ফুলিয়েনি।
তারপর হুড়হুড় চান। ভালো করে গা মোছারও সময় নেই। নটা পনেরো মিস করব। প্যাঁক-প্যাঁক গিলেই দে দৌড়। ঘামতে-ঘামতে, হাঁপাতে-হাঁপাতে, অফিস নামক সেই গারদে। আর পারা যায় না মা! এবার মুক্তি দে। ট্যাঁকের জোর থাকলে কবেই এই ছ্যাঁচড়া জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতুম। ভাবা যায় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা জলের দরে বিকিয়ে গেল! সকালটা দেখার উপায় নেই। দুপুরটা মুখ থুবড়ে ফাইলের গাদায়। সন্ধেটা বাসের ভিড়ে। আর রাত। রাতে তো সারাদিনের ক্লান্তিতে হাঁ। আর রাতে মানুষের করারই বা কী থাকে, দেখারই বা কী থাকে। সবই তো অন্ধকারের কম্বলে মোড়া। ঝাপসা-ঝাপসা গাছপালা ঢ্যাপসা-ঢ্যাপসা বাড়ি আর আকাশ ভরা তারা। কখনও সেখানে ক্ষেয়ো চাঁদ। কখনও আসরে পূর্ণ চন্দ্র। কখনও ল্যাপা মোছা মেঘ। বিদ্যুতের দেঁতো ঝিলিক। দিনের শোভা তো সকাল, দুপুর, বিকেল। সেই তিনটে সময়ই জীবিকার ধান্দায় পড়ে রইল জীবনের বাইরে। আসে যায়, তাকাবার সময় নেই। কী পরাধীনতা।
আমার ইচ্ছে করছে, আহা, এমন সুন্দর সকাল আমি এখন গঙ্গার ধারে গিয়ে ছোট-ছোট ঢেউয়ের ওপর রোদের কাঁপন দেখব। উপায় নেই অফিস। অফিসে বসে মনে হচ্ছে, আহা এমন সুন্দর রোদে ঝাঁ-ঝাঁ দুপুর, বেশ ফাঁকা মাঠে গাছের ছায়ায় বসে ক্লান্ত পাখির ডাক শুনব। উপায় নেই অফিস। ইচ্ছে করছে দিবা দ্বিপ্রহরে টকের ডাল, নিম বেগুন ভাজা, চারা মাছের ঝাল দিয়ে এক পেট ভাত খেয়ে, দোতলার ঘরে উত্তরের জানালার ধারে নিপাট সাদা বিছানায় শুয়ে, নীল আকাশ আর ঝিরি ঝিরি সবুজ পাতা দেখতে-দেখতে ধীরে ধীরে ঘুমের কোলে চলে যাব। উপায় নেই। চাকরি।
তেমন একটা মোটা মাইনের চাকরি হলে, এই সব আত্মবিসর্জন পুষিয়ে যেত। মনকে তবু বোঝাতে পারতুম যাক গে মন, বশে থাকো, মাসের শেষে কড়কড়ে এক বান্ডিল হাতে আসছে। গুণে শেষ করতেই আধঘণ্টা সময় লাগে। এই নাও তুমি তন্দুরি চিকেন খাও। মেওয়া খাও। সুরাপান করো। ফ্রুট জুস খাও। মন, দামি-দামি জামা কাপড় পরো। সুন্দর করে ঘর সাজাও, পৃথিবীর কোনও ধনী মানুষ, আকাশ বাতাস, গাছপালা, পশুপক্ষী, চাঁদ তারার জন্যে লালায়িত নয় মন। তুমি কেন দু:খ করছ। কেরিয়ার, অর্থ আর ভোগ এই হল সব।
তা যার ধরো নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তার এ কুল ও কুল দুকুলই গেল। বাইরে বিদ্রোহ হলে গুলি চালিয়ে ঠান্ডা করে দেওয়া যায়, ভেতরে বিদ্রোহ হলে মানুষ কী করবে। ভেতরটাকে তো আর ডিভোর্স করা যায় না। বিষণ্ণ বলদের মতো দিন কাটাই, আর ভাবি আসছে বার কিছু না পারি, নিদেন একটা স্মাগলার হয়ে জন্মাব। আজ হংকং কাল হনুলুলু, পরশু আর্জেন্টিনা, তরশু টোকিও। এক একদিন এক এক রকম জীবন। ভিয়েনায় পূর্ণিমা, দিল্লিতে অমাবস্যা। মেক্সিকোয় সমুদ্রস্নান, ক্যালিফোর্নিয়ায় লাঞ্চ।
আমি, রোজ রাতে বিছানায় গ্যাঁট হয়ে বসে ঈশ্বরকে ডাকি। মাথায় ঠেকে আছে মশারির চাল। অন্ধকার ঘর। আমি হাত জোড় করে আকুল হয়ে ডাকি—ভগবান। মুক্তির একটা পথ দেখাও। ভগবান, দেশ স্বাধীন হয় মানুষ কেন স্বাধীন হতে পারে না। তুমি একটা পথ করে দাও আমাকে। আমি যাতে ড্যাং-ড্যাং করে ঘুরে বেড়াতে পারি ধর্মের ষাঁড়ের মতো। যা খুশি তাই করতে পারি মা। মেয়ের বিয়ে, ছেলের পড়া, বউয়ের গেঁটে বাত, শেষ জীবনের শত চিন্তা থেকে এইবার অব্যাহতি দাও মা। আমি তো আমার ইচ্ছেতে আসিনি, তোমার ইচ্ছায় এসেছি। আমি তোমারই পাঁঠা মা। তুমি ন্যাজে কাটলে ন্যাজে কাটবে, মুড়োয় কাটলে মুড়োয়। তবে আমারও তো কিছু বলার আছে! তোমার ম্যাও এবার তুমি সামলাও। হাত জোড় করে এইসব বলে-টলে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। জানি ঈশ্বর সকলের ডাকে সাড়া দেন না, তবু আমি বলি।
আমার সহকর্মী সদানন্দের বড় মেয়ের বিয়ে। যাক অনেক চেষ্টার পর ভালো একটি পাত্র পেয়েছে। অনেক টাকার ধাক্কা। তা হোক। বিয়ে তো দিতেই হবে। সোদপুরে সদানন্দর বাড়ি। যেতেই হল। একটা শাড়ি বগলদাবা করে চলে গেলুম। বেশ স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন ছিল রবিবার। যা হয়, খাওয়া দাওয়ার পাট চুকতে বেশ দেরি হয়ে গেল। তারপর আরও যা হয়, ফেরার গাড়ি পেলাম না। তখন মনে হল কিছুটা হাঁটা যাক। হাঁটলে হজম হবে। ভরপেট খাওয়া হয়েছে।
রাস্তার একপাশ দিয়ে-দিয়ে টুকটুক করে হাঁটছি। কোথাও অন্ধকার, কোথাও আলো, কোথাও আঁধারী। এদিকটা একটু পাড়াগাঁ-পাড়াগাঁ। রাস্তার দু পাশে গভীর কাঁচা ড্রেন। ঝোপ ঝাড়। রাত হয়েছে। রাস্তায় লোক চলাচল নেই বললেই হয়। একবার উল্টোদিক থেকে দুটো লোক মাথায় সাইনবোর্ড নিয়ে হন হন করে আমাকে পেরিয়ে চলে গেল। তার অনেক পরে আর একটি লোক পাশ দিয়ে বলতে বলতে গেল—শুয়ারের বাচ্ছা আমাকে ভোগা দিয়ে গেল। বার-বার এই একই কথা বলতে-বলতে সে বাঁ পাশের একটা গলিতে ঢুকে গেল।
আমি হাঁটছি। হেঁটেই চলেছি। হাঁটার একটা নেশা আছে তো! ছন্দ আছে। ডান বাঁ, ডান বাঁ। সামনেই একটা আলো আঁধারী জায়গা। ওইটুকু পেরোলেই বড় রাস্তা। আর বড় রাস্তায় পড়তে পারলেই গাড়ি ঘোড়া যা হয় একটা কিছু পাওয়া যাবে। আমার বেশ মনে আছে আমি রাস্তার বাঁ দিক ধরে হাঁটছিলুম। এদিকটায় নর্দমা ছিল না। এবড়ো খেবড়ো রাস্তা। মেরামত হবে বলে কিছু খোয়া গাদা করা ছিল। সারাটা পথে এইখানেই একটা ল্যাম্পপোস্ট দেখলুম। আলোটা জ্বলছে। আমাদের পরাধীনতার স্মৃতি। স্বাধীন ভারতে রাস্তায় আলো জ্বালার বিধান নেই। হেলথগ্রাউন্ডে। অন্ধকারে চোখ ভালো থাকে।
পাথরের গাদার ওপর আলোটা পড়েছে, আর সেখানে দেখি সুন্দর লাল মতো একটা পুঁটলি পড়ে আছে। অনেকটা গেঁজের মতো। অনেক-অনেক আগে শ্রেঠী বা ধনকুবেররা এই রকম সুদৃশ্য থলিতে মোহর টোহর রাখত। সিল্কের ফাঁস টানা। জিনিসটার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ালুম। এপাশে ওপাশে তাকালুম। না কেউ কোথাও নেই। রাস্তা একেবারে ফাঁকা! কালো ভোদকা মতো একটি কুকুর নেচে নেচে এল, এসে ঠ্যাং তুলে ল্যাম্প পোস্টে পেচ্ছাপ করে পালাল।
মনটা ভেঙে দু খণ্ড হয়ে গেল। একটা মন বলছে, তুলে নিয়ে নাও। আর একটা মন বলছে, লোভ সামলে। দুটো মনে দাঙ্গা বেঁধে গেল। এ বলে, তুলে নে, ও বলে তুলিসনি। শেষে নেতিবাচক মনটা হেরে গেল। আসলে পৃথিবীটাতো ইতিবাচক। নাস্তি নয়, অস্তি। আমি আছি, আমার সামনে আছে লাল পুঁটলি। আমার হাত আছে। হাতের কাজ ধরা। ধরে তোলা!
পুঁটলিটা টক করে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলুম। মসৃণ ভেলভেটের থলি। মোটামুটি মনে হল মোহর টোহর নেই পাথর কুঁচিটুচি হবে। কোনও বদমাইশ ছেলের লোকঠকানো কারবার। তবু থলিটা পাঞ্জাবির পকেটে ভরে রাখলুম। মানুষের অপরাধবোধ বড় মজার জিনিস। থলিটা ধরা মাত্রই মনে হচ্ছে—আমি একটা চোর। বারে বারে, পেছন ফিরে তাকাচ্ছি। কেউ দ্যাখেনি তো। দেখে ফেলেনি তো। দুপা এগোই পেছন ফিরে তাকাই। বুকের বাঁ পাশ ঢিপ ঢিপ করছে।
বড় রাস্তায় এসেই একটা প্রাইভেট ট্যাক্সি পেয়ে গেলুম। কলকাতার দিকেই যাচ্ছে। একেই বলা চলে বরাত। মানুষের কী রকম কুসংস্কার। মনে হল, আমার বরাত তো এই রকম নয়। আমার তো সব কাজেই বাধা পড়ে। হঠাৎ কী হল? এ কি ওই লাল পুঁটলির কৃপা?
বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। কোনও রকমে দরজা খুলে দিয়ে সবাই শুয়ে পড়ল। আমি সেইটাই চাইছিলুম। ভেতরটা হাঁকপাঁক করছে। কখন নির্জনে বসে লাল ভেলভেটের থলিটা খুলব? নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলুম। খাটের মাঝখানে লাল থলিটা রাখলুম। পাঞ্জাবিটা কোনও রকমে খুলে হ্যাঙ্গারে। আমার আবার এই সব খুব আছে। টিপটিপ। যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে গোছগাছ করে তবে অন্য কাজ। সে যতই প্রলোভন থাক না কেন। কাচা একটা পাজামা পরলুম। গেঞ্জিটা পাল্টালুম। খবরের কাগজটা জানলার ধারের টেবিলে ছিল, বাতাসে এলোমেলো হয়ে গেছে। সেটার ভাঁজে-ভাঁজ মিলিয়ে পাট করে রাখলুম। এই সব করছি, আর মাঝে-মাঝে লাল থলিটার দিকে তাকাচ্ছি। কী আছে ভেতরে কে জানে? মনে হচ্ছে, ছুটে গিয়ে খুলে ফেলি! ধরে রেখেছি নিজেকে। একেই বলে সংযম। সব শেষে এক গেলাস জল খেলুম। ট্যাং ট্যাং করে দুটো বাজল।
সব দরজা জানলা বন্ধ করে একটা ধূপ জ্বালালুম। এইবার বিছানার মাঝখানে বসে থলিটা খুলব। বুকের ভেতরটা কেমন করছে। স্ট্রোক না হয়ে যায়! থলির মুখের দড়ির ফাঁসটা আলগা করে বিছনায় উপুড় করে দিলুম। স্তম্ভিত। চোখ ছানাবড়া। এ কী? এমনও হয়।
ঝকঝকে সাদা আর লাল লাল পাথর। আলো পড়ে ঝিলিক মারছে। হিরে না কি? লালগুলো মনে হয় চুনি। উঠে গিয়ে আর এক গেলাস জল খেলুম? বুক ধড়ফড় করছে। মরলে চলবে না। আমাকে যেভাবেই হোক বাঁচতে হবে। এখন মরলে চলবে না। ভগবান মনে হয় আমার প্রার্থনা শুনেছেন। পাখার গতি বাড়ালুম। হাত জোড় করে ভগবানকে বললুম—জীবনের মোড় যখন ঘুরিয়েই দিলে তখন দুম করে মেরে দিও না প্রভু। তুমিও যেমন আছ, আমাকেও তেমনি থাকতে দাও।
সাদা পাথর আর লাল পাথর গুনে-গুনে আলাদা করলুম। সাদা আছে কুড়িটা। বেশ বড়-বড়। আর লাল, এক একটা বেদানার দানার মতো। একশো আটটা। এই ধরনের চুনিকেই বলে পিজিয়নস ব্লাড। জমাট বাঁধা পায়রার রক্ত। হিরেও দামি, চুনিও দামি। এইবার আমার মাথাটা না খারাপ হয়ে যায়। কারণ মনে-মনে আমি বারেবারেই বলতে শুরু করেছি—এমনও হয়, এমনও হয়?
হঠাৎ সন্দেহ হল, হিরে তো! না কাঁচ। পরীক্ষা করা দরকার। হিরে কাঁচ কাটে। দাড়ি কামাবার ছোট্ট আয়নাটা দেয়াল থেকে পেড়ে আনলুম তারপর বেশ বড় সাইজের সাদা একটা পাথর দিয়ে টানতেই কড়কড় করে কেটে গেল। আনন্দে ভেতরটা এমন লাফিয়ে উঠল, মনে হল হার্টটা ছিটকে বিছানায় না পড়ে যায়! সারাটা রাত ধরে আমি আমার বহুদিনের সঙ্গী সেই দাড়ি কামাবার আয়নাটাকে হিরে টেনে-টেনে ফালা ফালা করে ফেললুম। তাকালে নিজের একটা মুখ নয় একশোটা মুখ দেখতে পাচ্ছি।
মনি মানিক্য নিয়ে অনেকক্ষণ খেলা করার পর ভবিষ্যৎ একটা পরিকল্পনা ঠিক করে ফেললুম। ছকে ফেললুম, ব্রাসেলস না অ্যামস্টারডামে জুহরীদের একটা বাজার আছে। সেইখানে আমি যাব। গিয়ে হিরেগুলো সব বেচে দেব। কলকাতার বড়বাজারে আমি যাচ্ছি না যাব না। ভালো দাম তো পাবই না, উলটে পেছনে টিকটিকি লেগে যাবে। ইনকাম ট্যাক্স লেগে যাবে।
কিন্তু ব্রাসেলসে যাব কী করে? অনেক টাকার ধাক্কা? হিরে না বেচা পর্যন্ত তো আমি সেই আমি। নুন আনতে পান্তা ফুরনো আমি। শুনেছি বোম্বেতে একটা বিশাল ডায়মন্ড মার্কেট আছে। বোম্বেতেই যাব। দু-চার পয়সা দাম কম পাই ক্ষতি নেই।
পরের দিন সকালে আয়নায় তাকিয়ে দেখি চোখ গর্তে ঢুকে গেছে। গাল আরও বসে গেছে। সারা রাত না ঘুমোলে যা হয়। মনে-মনে বললুম, ঠিক আছে। শরীর আর কটা দিন অপেক্ষা করো তারপর চেকনাই কাকে বলে দেখবে। ফলের রস খাওয়াব, মুর্গমসল্লুম খাওয়াব, মাঝে মধ্যে বিরিয়ানি, রাত্তিরে মেপে এক ডোজ বিলিতি। মুশকিল হল বড়লোকরা কি করে, কী খায় আমার তেমন জানা নেই। মোটর গাড়ি চড়ে এইটুকু জানি আর একদম হাসে না, মুখটা সব সময় গোবদা মতো করে রাখে, আর খুব হিসেবি হয়। আর খুব গরিব হয়। আমাদের পাড়ার একজনের উপকারে আমরা সবাই চাঁদা তুলতে বেরিয়েছিলুম তা বিশাল এক ধনী মানুষের বাড়ি যেতে তিনি অনেক নাকে কেঁদে আমাদের পাঁচটি টাকা ঠেকিয়েছিলেন। আমরা তো অবাক, সে কি মশাই, আপনি পাঁচ, ফাইভ ইনটু টেন অন্তত করুন। তাতে তিনি বলেছিলেন, ভাই আমার কাছে পাঁচের বেশি নেই, আমার যা দিন যাচ্ছে! আমার সবই তো হয় ফিকসড করা, না হয় ইনভেস্ট করা পাঁচের বেশি আমি পাই কোথা থেকে। তা তখন আমরা সেই ময়লা পাঁচ টাকার নোটটা তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলুম—রাখুন, আহা, আপনার এই কপর্দক শূন্য অবস্থা আমাদের জানা ছিল না। বিড়িটিড়ি কিনে খাবেন। এমন সময় ঘরে এসে ঢুকল তাঁর কর্মচারী। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাকে চেপে ধরলেন, কালকের হিসেবের দশটা পয়সা তো তুমি আমাকে দিলে না।
আমি তিনটে দিন বাজারটাকে একটু বাজিয়ে নিলুম। আমার এক সহকর্মীকে জিগ্যেস করলুম, আচ্ছা, বলতে পারেন, এখন একটা হিরের দাম কত পড়তে পারে। তিনি ফাইল থেকে মুখ তুলে বললেন, খুব লোককে জিগ্যেস করেছেন যা হোক। যে কাচের দাম জানে না, তাকে জিগ্যেস করছেন হিরের দাম। আমার স্ত্রীর খুব সাধ ছিল হিরের নাকছাবি পরবে। মেয়েটা বড় ভালো মশাই। জীবনে তো কিছুই পেলে না। আমাকে বিয়ে করে গোটা কতক ছেলেমেয়ে ছাড়া আর কীই বা পেয়েছে। তাই ভাবলুম যাক, ইচ্ছে যখন হয়েছে চেষ্টা করে দেখাই যাক। গেলুম এক গয়নার দোকানে, অ মশাই প্রথমে মিনিট পাঁচেক আমাকে দেখলে। তারপর বারে-বারে বলতে লাগল, হিরে! হিরের নাকছাবি! আমি বললুম, অমন করছেন কেন? হিরের নাকছাবি হয় শোনেননি!
ভদ্রলোক ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন। তারপর বললেন, জিরে দেখেছেন? জিরে?
কেন দেখব না?
জিরের মাপের একটা আসল হিরের দাম দশ থেকে বারো হাজার। আর তিল দেখেছেন? তিলের মাপের একটা হিরের দাম ছ থেকে সাত হাজার টাকা।
ধীরে-ধীরে মাথা নীচু করে দোকান থেকে বেরিয়ে এলুম। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সারা জীবনের সঙ্গীকে একটা জিনিস দিতে পারলুম না। এত আশা করে চাইলে! বছরের পর বছর কলম ঘষে এই আমার সঙ্গতি! বিশ্বাস করুন, আমার চোখে জল এসে গেল। একটা ব্যাবসাদারের ছেলে একশো টাকা টিপস দেয় আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ। দশটা ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি, ছটা ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দিয়ে প্রাোমোশান, আমার ব্যাঙ্ক রেস্তো সাতহাজার তিনশো টাকা চল্লিশ পয়সা। সেদিন আমি টানা দুঘণ্টা স্ট্র্যান্ডরোডের গঙ্গার ধারে একা বসে রইলুম। শেষে কী ভাবলুম জানেন, শুনলে হাসবেন, আমাদের হীরে আমাদের চোখেই আছে, চোখের জল।
আমার সহকর্মীর দু:খের কথা শুনে মুখটাকে যতদূর সম্ভব করুণ করুণ করলুম। অন্য সময় হলে হয়তো অন্তরস্পর্শ করত। আমি নিজে হীরের মালিক। একটা নয় দুটো নয় বিশটা। এক একটার সাইজ কী! আকাশ থেকে যে শিলাবৃষ্টি হয়, এক একটার সাইজ ঠিক সেই শিলের মতো। কী তার জেল্লা। কালো একটা কাপড়ের ওপর সেদিন ছড়িয়ে দিয়েছিলুম, একেবারে জ্বলজ্বল করছে! আহা কী যে রূপ তার!
ফিনফিনে একটা ধুতি পরলুম। সিল্কের পাঞ্জাবি। সোনার বোতাম। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। কানে আতর। মুখে আবার একটু পাউডার ঘষে নিলুম। তারপর ঘণ্টা হিসেবে একটা লাক্সারি ট্যাক্সি ভাড়া করে চলে গেলুম কলকাতার সবচেয়ে বড় জুয়েলারের ঘরে। হাতে সিল্কের রুমাল। আলতো করে ঠোঁট মুছতে-মুছতে দোকানে ঢুকলুম। মালিক খুব খাতির করলেন। জানতুম করবেন। পোশাকের কদর সভ্য মানুষ জানে। আর আমি জানি, জাত বড়লোকেরা কী ঢঙে কথা বলে। আস্তে, ধীরে, চিবিয়ে-চিবিয়ে।
আমি বললুম—হিরে।
হিরে?
বড় দোকান। তার ব্যাপার স্যাপারই আলাদা। দোকানের ভেতর দোকান। অনেকটা গর্ভগৃহের মতো। বোতাম টিপতেই বৈদ্যুতিক দরজা খুলে গেল। একটা স্টিল প্লেটে র ওপর দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলুম। বেশ বুঝতে পারলুম মেটাল ডিটেকটারের ভেতর দিয়ে যেতে হল। মনে হয় একসরে ডিটেকসনিও হয়ে গেল।
ভেতরটা একেবারে রহস্যপুরী যেন! সারা ঘরে চাপা একটা আলো। জায়গায় জায়গায় আলোর ফোকাস! যাঁরা ঘড়ি মেরামত করেন, তাঁরা যেমন চোখে ঠুলি পরেন, সেইরকম ঠুলি পরা এক সার কর্মচারী এক একটা ফোকাসের তলায়। প্রত্যেকের সামনেই এক একজন ক্রেতা। সাংঘাতিক সুন্দরী এক মহিলা, মনে হয় রানিটানি হবেন একের পর এক জড়োয়ার হার পরছেন, আয়নায় দেখছেন, আর খুলে-খুলে রাখছেন। সে এক দৃশ্য। বড়লোকেদের জগৎটা কী সুন্দর! সুর, সুরা, সুন্দরী মহিলা, হিরে চুনি, পান্না।
হ্যাঁ বলুন, কী ধরনের হিরে চান? গোল না চৌকো, সাদা না হলদে?
প্রশ্ন শুনে প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গেলুম। কত রকমের হিরে আছে! যাক ঠিক সময়ে নিজের অপ্রস্তুত ভাবটা সামলে নিলুম। পকেট থেকে নরম কাগজে মোড়া আমার হিরেটা বের করলুম। তারপর মোড়ক খুলে তাঁর সামনে মেলে ধরে বললুম, এইটা দেখুন।
ভদ্রলোক চোখে ঠুলি লাগিয়ে দু আঙুলে হিরেটা চোখের সামনে তুলে ধরলেন। অনেকক্ষণ ধরে দেখে বললেন, অসম্ভব দামি হিরে। এতকাল আমরা ব্যাবসা করছি, এমন জিনিস দেখিনি। এ একেবারে, জেনুইন সাউথ অ্যাফ্রিকান মাল।
কত দাম হবে?
হিরের তো ওভাবে দাম হয় না। অকসান হয়। নিলামে যেমন দাম উঠবে। তা ধরুন দশ, বিশ, বাইশ লাখ পর্যন্ত দাম উঠতে পারে।
জিনিসটা আমি বেচতে চাই।
তাহলে আপনাকে বোম্বাই যেতে হবে। জহুরি বাজারে। সেখানে চিমনলাল সব চেয়ে বড় অকসানার। আপনি সেখানে চলে যান। কলকাতায় এ জিনিস কেনার মতো লোক নেই।
কেন আপনারা?
আমরা মশাই অ্যামেরিকান হিরে আর হিরের ছাঁট বিক্রি করি। আমরা হলুম গিয়ে হাজারের কারবারি। লাখে এখনও উঠতে পারিনি।
দোকান থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলুম। গাড়ি ভাড়া একশো কুড়ি টাকা বেরিয়ে গেল। রাতে শুয়ে-শুয়ে ভাবলুম ব্যাপারটা যত সহজ হবে ভেবেছিলুম তা হবে না। বড়লোক হওয়া মোটেই সহজ নয়। ভগবান তুমি যদিই বা দিলে তো এই ভাবে দিলে কেন? নগদ দিলে পারতে। পরে ভাবলুম তা কি করে হয়। একটা থলিতে ভরে তিনি আমাকে যা দিয়েছেন তার দাম দশ বারো কোটি টাকাও হতে পারে। এই টাকা নগদ দিতে হলে বিরাট একটা বস্তা পথের পাশে ফেলে রাখতে হত। অ্যাবসার্ড। ভগবান কি আমার মতো গাধা! তিনি এই জগৎ সংসারের রাজা রে বাবা।
থলিটা পাবার পর থেকে রাতে দু চোখের পাতা এক করতে পারি না। পরিবারের পরিজনের সঙ্গে ভালো করে মিশতে পারি না। তারা ভাবছে লোকটার হঠাৎ কী হল! পাগলটাগল হয়ে গেল না কি! সব সময় অন্যমনস্ক। সাতবার ডাকলে একবার উত্তর মেলে। শুকনো চেহারা। লাল চোখ। উদভ্রান্ত। আমরা বলছি এক শুনছে আর এক।
একদিন আমার বউ বললে, তোমার কী হয়েছে বলো তো?
কই কিছু হয়নি তো।
নিশ্চয় হয়েছে। অফিসে কোনও গোলমাল চলছে না তো।
না, অফিসে আবার কী গোলমাল হবে। করি তো কেরানির কাজ।
তুমি অবশ্যই আজ আমার সঙ্গে ডাক্তারখানায় যাবে। তোমাদের ফ্যামিলিতে পাগলের ইতিহাস আছে। আমার ভয় করে বাপু।
পাগলের ইতিহাস মানে?
তোমার বড় বোন পাগল হয়ে গিয়েছিল।
সে কি ইচ্ছে করে হয়েছিল। হয়েছিল স্বামী আর শাশুড়ির নির্যাতনে।
আমিও তো তোমাকে সারা জীবন অনেক নির্যাতন করেছি!
আরে তোমার নির্যাতন আর সে নির্যাতনে অনেক তফাৎ!
কিছুতেই যে বলতে পারছি না, আমার প্রবলেমটা কী। চালাকি ব্যাপার। লাখোপতি হয়, কোটিপতিও হতে পারে। আমার মতো এমন কোটি কোটি কোটিপতি হতে পারে। আমি ইচ্ছে করলে এখন প্রশান্ত মহাসাগরে ছোটখাটো একটা দ্বীপ কিনতে পারি। একটা হেলিকপ্টার কিনতে পারি। আমি কী যে না করতে পারি। কেবল একটাই সমস্যা টাকাটা পাথর হয়ে আছে। কোনও রকমে ভাঙাতে পারলেই মার দিয়া কেল্লা। সেই কেল্লাটা মারি কী করে! ব্যাপারটা তো সহজ নয়।
আগে সকাল হলেই সাত তাড়াতাড়ি অফিস বেরবার একটা তাগিদ বোধ করতুম। এখন মনে হয় কেন বেরব। কী কারণে বেরব। আমার যা আছে সাত পুরুষ ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে খেতে পারবে। আমার আর কী দরকার গোলামির! পদত্যাগ পত্র লেখা হয়ে গেছে, মাননীয় মহাশয়, নিতান্তই ব্যক্তিগত কারণে আমি চাকরিতে ইস্তফা দিচ্ছি। আমার পদত্যাগপত্র অনুগ্রহ করে বিবেচনা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দায়িত্বভার থেকে মুক্তি দিলে বাধিত হব। বিনীত ইতি।
এত বিনয়ের প্রয়োজন ছিল না। আজকাল কেউ চাকরি ছাড়তে চাইলে আনন্দ। আনন্দের হিল্লোল ওঠে। সব চাকরির জন্যে লাইন দিয়ে আছে। তুমি ছাড়লেই আর একজন এসে বসবে। সে বিয়ে করবে, সংসারী হবে। ফ্ল্যাট কিনবে। ছেলেকে ইংলিশ স্কুলে পড়াবে। ছুটি নিয়ে সপরিবারে পাহাড়ে বেড়াতে যাবে।
আমি একাই বোম্বে চলে এলুম। কিছুই চিনি না। কাউকে জানি না। একটা হোটেলে উঠেছি। বেশ ভালোই চার্জ। বোম্বে বড় সাংঘাতিক জায়গা। সঙ্গে একটি মাত্র হিরে এনেছি। ঘুণাক্ষরে কেউ যদি জানতে পারে আমি হিরাপতি, হোটেলের বিছানাতেই মেরে ফেলে রেখে যাবে। স্মাগলার, কিলার, স্পাই, এজেন্ট, কেজিবি, সি আই এ সব থিকথিক করছে এই আরব সাগরের কূলে।
তিন দিন ফ্যাল-ফ্যাল করে বোম্বাই শহরে ঘুরে বেড়ালুম। জহুরি বাজারেও গেলুম। গেলে কী হবে। সেখানে সমস্ত মানুষের চাল চলন এমন সন্দেহজনক, ভয়ে ফিরে এলুম। বেশিরভাগ লোকেরই চোখে রঙিন চশমা। সরু-সরু গোঁফ। ছুঁচল মুখ। কারুর-কারুর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। একটা করে ব্রিফ কেস হাতে নিয়ে একবার এ ঘরে ঢুকছে, একবার ও ঘরে। পুরো এলাকাটাই যেন ভয়ে ভরা। যারা ঘোরাঘুরি করছে তারা কেউই সোজা লোক নয়। আমাকে অচেনা মানুষ দেখে অনেকেই ফিরে-ফিরে তাকাচ্ছে। সাদা জোব্বা পরা ধারালো চেহারার এক সিন্ধি ভদ্রলোক হঠাৎ থেমে পড়লেন আমার সামনে। বেশ ভয় পাওয়ানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আমি ভয়ে-ভয়ে গুণগুণ করে গান গাইতে শুরু করলুম। যেন গান গেয়ে পথে-পথে ঘোরাই আমার কাজ।
পকেটের হিরে পকেটে নিয়েই কিছু অর্থদণ্ড দিয়ে কলকাতায় ফিরে এলুম। শুনেছি বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, হিরে ছুঁলে দেখি সর্বাঙ্গে ঘা। প্রায় পাগল হয়ে যাবার মতো অবস্থা। সাপের ছুঁচো গেলা আর কী। না পারছি ওগরাতে, না পারছি গিলতে। সব সময় দুশ্চিন্তা। এই বুঝি পুলিশ এল বাড়িতে। এই বুঝি ডাকাত পড়ল বাড়িতে। সে ভাবে লুকোতেও পারছি না। রোজই জায়গা পালটে-পালটে রাখছি। যখন অফিসে থাকছি তখন কেবলই মনে হচ্ছে, বাড়ির লোক এটা ওটা ঘাঁটতে-ঘাঁটতে সন্ধান না পেয়ে যায়।
হঠাৎ খুব একটা গোপনীয় বই হাতে এল। কী ভাবে কালো টাকা, সোনার বিস্কুট, হিরোইন, হাসিস লুকিয়ে রাখতে হয়। প্রথম পদ্ধতি হল, যে কোনও একটা দেয়ালের ভেতর এখানে ওখানে পকেট তৈরি করো। ছোট, ছোট ঘুলঘুলি, তার মধ্যে ছড়িয়ে-ছড়িয়ে রেখে, প্লাস্টার করে দাও। দ্বিতীয় পদ্ধতি খাটের যে কোনও একটা পায়া ফাঁপা করে তার মধ্যে ভরে রাখো। তৃতীয় পদ্ধতি, একটা মোটা বইয়ের অনেকগুলো পাতা এক সঙ্গে চৌকো করে কেটে ফেলে দিয়ে ফোকর বের করো। সেই ফোকরে মাল ভরো। তারপর অনেক বইয়ের মধ্যে সেই বইটা রেখে দাও। চতুর্থ পদ্ধতি, একটা বাথরুম তৈরি করো। সেখানে একটা কমোড বসাও। বাথরুম অথবা কমোড কোনওটাই ব্যবহার করবে না। কমোডের বেদিটা হবে ফাঁপা। সেই জায়গায় সব ভরে রাখো। পঞ্চম পদ্ধতি, ভেন্টিলেটারে, ভেন্টিলেটারের তলার দিকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পরপর সাজিয়ে রাখো। ষষ্ঠ পদ্ধতি, ঠাকুর ঘরে ফাঁপা শালগ্রাম শিলা ‘রুপোর সিংহাসনে’ লাল কাপড় ঢাকা। প্রত্যেকটি শিলার মধ্যে মাল। জোড়ের মুখটা ঢেকে দাও রূপোর পইতে দিয়ে। বইটা বড় মজার! এইরকম গোটা কুড়ি পদ্ধতি দেওয়া আছে। লেখা আছে, গোপন প্রচারের জন্য। পড়ার পর নিজের স্বার্থে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলুন। আমিও তাই করলুম। বইটা আমার কোনওই কাজে লাগল না। যাই করি না কেন তৃতীয় আর একজনের সাহায্য নিতে হবে। জানাজানি হয়ে যাবে। আমার যা অবস্থা তাতে তো বাড়ির লোককেও জানানো যাবে না।
আমার এক উকিল বন্ধুকে কথায়-কথায় জিগ্যেস করলুম, আচ্ছা ধর, হঠাৎ যদি কেউ কয়েক কোটি টাকা পেয়ে যায়, তার কী হবে?
সঙ্গে-সঙ্গে পুলিসে ধরবে।
কেন? কোন অপরাধে?
জানতে চাইবে সোর্সটা কী? তারপর পেছনে লেগে যাবে ইনকামট্যাক্সের লোক। হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দেবে।
অ, বলে আমি একটা ঢোঁক গিললুম।
বন্ধু বলল, কত রকমের অদ্ভুত চিন্তাই না মানুষের আসে!
আমি মনে-মনে হাসলুম। ভাবছে গল্প কথা। আমি যদি থলিটা উলটে, হিরে আর চূনিগুলো সামনে ছড়িয়ে দি, যতই আমার প্রাণের বন্ধু হোক বুকে ছুরি বসিয়ে দেবে। আর কোনও কথা না বলে আমি চলে এলুম।
সেদিন রাতের বেলা ঠিক করে ফেললুম আমার ওই থলিটা ব্যাংকের লকারে ফেলে রাখব। সুইস ব্যাংকে, সুইস ব্যাংক শুনেছি; কিন্তু তার নিয়মকানুন আমি জানি না। সুইস ব্যাংকে টাকা আছে এমন কোনও বড়লোককেও আমি চিনি না। পরের দিন লকারের ঠান্ডা গহ্বরে লাল ভেলভেটের থলিটা ফেলে দিলুম! যাও, তোমার কোনও দাম নেই। হিরে আর পাথর কুচিতে কোনও তফাৎ নেই আমার কাছে।
আমার সেই রেজিগনেশান লেটার বুকপকেটেই রয়ে গেল! রইল তোমার চাকরি বলে ফিরে আসতে পারলুম না ঘরের ছেলে ঘরে। ভেবেছিলুম কোটিপতি হলেও বাইরের কাউকে বুঝতে দেব না। জীবনযাত্রার মান আরও নামিয়ে আনব। পাড়ার লোক, বাড়ির লোক হঠাৎ একদিন দেখবে বিশাল একটা লরি ঢুকছে গলিতে। কয়লার লরি! লরিটা আমার বাড়ির সামনে থামবে। আমার বউ ছুটে এসে বলবে, এ কী! তোমাকে আমি দোকানে দু-মন কয়লা দেবার কথা বলতে বললুম, এ যে দেখছি ঢাউস একটা লরি পাঠিয়ে দিলে!
আমি হেসে বলব, দোকান নয়, এ কয়লা আসছে ডিপো থেকে। তোমাকে বলা হয়নি, আমি কাল থেকে একটা কয়লার দোকান দিচ্ছি। এরপর আসবে চ্যালা কাঠ।
বউ বলবে, সত্যিই তোমার মাথাটা গেছে। অমন ভালো চাকরিটা ছেড়ে শেষে, কাঠ আর কয়লার দোকান। বাড়ির সামনের পাঁচিলটা ভেঙে ফেলেছি। সেখানে একটা আটচালা। বিশাল এক দাঁড়িপাল্লা হেলে আছে একদিকে। বড়-বড় বাটখারা। কয়লার ডাঁই, দুটো বেলচা। কেলে-কেলে বস্তা। ফেত্তা মেরে ধুতি পরেছি। ফুটোফাটা গেঞ্জি। পইতেতে দুলছে ক্যাশ বাকসের চাবি।
কল্পনা কল্পনাই রয়ে গেল। রোজ সকালে উঠি, ধড়ফড় করে অফিসে ছুটি। সন্ধ্যের পর ফিরি আর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ি। শুয়ে-শুয়ে ভাবি, ইচ্ছে করলে, আমি একটা প্যালেস তৈরি করতে পারতুম। দু-একর বাগান। গ্যারেজে দশ দশ রঙের গাড়ি। পারি কিন্তু পারব না। শুয়ে-শুয়ে ভাবতে থাকি, তালেগোলে হাজার ছয়েক টাকা বেরিয়ে গেল। কাজের কাজ কিছুই হল না। সেই পোস্তর তরকারি আর ভাত। সেই মাঝ মাসে টাকার টানাটানি। এর ওর কাছে হাত পাতা।
একদিন রাতে বউকে বলছি, জানো তুমি কত বড়লোক! তুমি প্রায় বারো কোটি টাকার মালিক। বউ বললে, যত বয়েস বাড়ছে তত তোমার বাজে বকাও বাড়ছে।
আমি বললুম, তুমি বিশ্বাস করো, আমি মিথ্যে বলছি না, তুমি দশ বারো কোটি টাকার মালিক। জানো তো একশো লাখে এক কোটি টাকা।
আমার কথা শুনে আমার বউয়ের চোখ জলে ভরে গেল।
আমি বললুম, তুমি কাঁদছ কেন?
সে বললে, ওগো তুমি পাগল হয়ে যেও না। তুমি যেমন আছ সেইরকম থাকে। তা না হলে আমি যে বড় একা হয়ে যাব। কাকে নিয়ে বাঁচব?
আমি বললুম, বিশ্বাস করো, এতদিন তোমাকে বলিনি আজ তোমাকে বলছি, আমার কাছে কুড়িটা নকুলদানা সাইজের সাচ্চা হিরে আর একশো কুড়িটার মতো বেদানার দানা সাইজের চুনি আছে। সব আছে আমার ব্যাংকের লকারে।
কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, বুকের বাঁ দিকটা তুড়ুক তুড়ুক করে তিনবার নেচে উঠল। মনে হল হার্টে যেন কেউ পিন ফোটাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে গেল। আর মুখ দিয়ে একটা কথাও বের করতে পারলুম না। হঠাৎ দেখি খুব হালকা হয়ে গেছি। তুলোর মতো, মেঘের মতো। আরও আশ্চর্য, আমি আমাকে দেখতে পাচ্ছি। সামনে আয়না নেই কিন্তু আমার প্রতিফলন দেখছি। আমার বউয়ের কাঁধের ওপর আমার মাথাটা হেলে পড়েছে। মুখটা হাঁ হয়ে গেছে। মসীবর্ণ চেহারা। মনে-মনে বললুম, যা: ব্যাটা শেষ হয়ে গেল নাকি!
আর ঠিক সেই সময় আমার কাঁধে যেন কে হাত রাখল। সারা মন যেন জুড়িয়ে গেল। কানের কাছে গাছের পাতায় বাতাসের সুরের মতো গলায় কে যেন বললে, যাক এবারের মতো খেলা সাঙ্গ, যা দেহটাকে একটা লাথি মেরে আয়।
কে আপনি?
আমি ভগবান।
প্রভু আমি কি মরে গেলুম?
হ্যাঁ বাবা। মরে গেলে না, দেহটা পালটালে এই আর কী! যা ওই খাঁচাটাকে লাথি মেরে আয়। আমি আমাকে লাথি মারব।
আর তো আমি তুমি নেই, যতক্ষণ, যতদিন দেহে ছিলে ততদিন আমি তুমি। যাও, ক্যাঁত করে ওই মায়ার শরীরটাকে একটা লাথি মেরে এসো।
সূক্ষ্ম শরীর স্থূল শরীরকে লাথি মারতেই সেটা হেলে পড়ল ওই রমনির কোলে। মহিলা তখন আকুল হয়ে প্রশ্ন করছে হ্যাঁ গা, কোন ব্যাংকে আছে তোমার হিরে, চুনি, পান্না। হ্যাঁ গা কোন ব্যাংকের লকারে আছে তোমার হিরে, চুনি, পান্না!
ভগবান আবার আমার কাঁধে বন্ধুর মতো, পিতার মতো হাত রাখলেন। বললেন, চলে আয়।
আমরা দুজনে হাঁটতে-হাঁটতে, বেড়াতে-বেড়াতে চলেছি। মাঠ, ঘাট, গাছপালা, নদী প্রান্তর সব অন্যরকম। আরও উজ্জ্বল, আরও নির্মল। ভগবান বললেন, অবাক হচ্ছ। অবাক হবার কিছু নেই। এ সবই হল আসল। নীচে যা দেখে এসেছ, সে সব নকল। আসলে ছায়া।
আমি তখন বললুম, আপনি আমাকে যাকে বলে ছপ্পর ফুঁড়ে দিলেন, কিন্তু কাজে লাগল না। সব পড়ে রইল ওখানে।
তুই তো আমার বার্তাটাই ধরতে পারিসনি। চলে গেলি টাকা পয়সার জগতে। ভেবেছিলাম, কথামালার সেই গল্পটা তোর মনে পড়বে।
কোন গল্পটা প্রভু!
সেই যে রে, একদা এক কাক গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরে বড় তৃষ্ণার্ত হল। জল চাই একটু জল। তা আমি তাকে একটা কলশি দিলুম আর দিলুম কিছু নুড়ি পাথর। আর একটু দুষ্টুমিও করলুম। জানিস তো ভগবান একটু রসিক। সৃষ্টিকে নিয়ে মাঝে মধ্যে মজা করাই তার কাজ। কাককে আমি ভরা কলশি দিলুম না। তলায় সামান্য কিছুটা জল ভরে ছেড়ে দিলুম। শুধু ভাগ্যের ওপর নির্ভর করলেই হবে, পুরুষকার থাকবে না। কাকের কিন্তু সেই গুণটি ছিল। সে ঠোঁটে করে এক একটি নুড়ি তোলে আর কলশির মধ্যে ফেলতে থাকে। আর ধীরে-ধীরে জল উঠে আসে কানায়।
প্রভু সে গল্প আমি পড়েছি : কিন্তু আমিও তো কম করিনি।
তুই ওটাকে টাকা করতে চেয়েছিস। পৃথিবীর সব মানুষের যা ধান্দা। আমি চেয়েছিলুম কর্ম। জীবনের সৎকর্ম হল এক একটি হীরকখণ্ড। জীবন যখন খালি হয়ে আসতে থাকে, জীবন পাত্রে প্রাণরস যখন এতটুকু তলানি মাত্র, তখন এক একটি সৎকর্মের হীরকখণ্ড ফেলতে থাকো আর চুনির লাল রঙ হল অনুরাগ, ভালোবাসা। জীবনের সৎকর্মে অনুরাগের লাল রঙ ধরাও। সেই বার্তাটাই তুই ধরতে পারিসনি বোকা। তুই ছুটলি কতকগুলো ছাপা, ময়লা কাগজের সন্ধানে।
তাহলে আমি আর একবার ফিরে যাই। দেহটা এখনও আছে।
নিজের ইচ্ছেয়। নিজের ইচ্ছেতে জন্মানোও যায় না, মরাও যায় না। আয় তোকে সৃষ্টিচক্রের একটা খোপে ভরে দি। সময় হলেই আবার শূন্য থেকে শুরু করে শূন্যে ফিরে আসবি।