শুশুক-মানুষের রহস্য – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
এক
গোয়ার মারগাঁও থেকে বিমানবাহিনীর একটি ডাকোটা বিমান আমাদের পাঁচজন সাংবাদিকের একটি দল নিয়ে যখন আকাশে উড়ল, তখন বিকেল চারটে। আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জের কোরাডিভি দ্বীপে। ভারত সরকারের সমুদ্রবিজ্ঞান দফতরের একটি গষেণাগার রয়েছে সেখানে। সেটি আমাদের দেখাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকার আশা করেন, সব দেখেশুনে ফিরে গিয়ে আমরা নিজেদের কাগজে চমৎকার রিপোর্ট লিখব। কোরাডিভি জাহাজে অথবা স্টিমারেও পৌঁছনো যায়। কিন্তু তাতে অনেক বেশি সময় লেগে যাবে। এখানে বিমানবাহিনীর একটি বিমানঘাঁটি আছে। তাই ওইভাবে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন হয়েছে। পৌঁছতে মোটে দু-ঘণ্টা লাগবে। আরব সাগরের সৌন্দর্য নাকি বিমান থেকে দেখলে মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না…।
সত্যি তাই। আমাদের বিমানটি নাক বরাবর দক্ষিণ-পশ্চিমে এগিয়ে ঠিক ছ’টায় দ্বীপের বিমানঘাঁটিতে মাটি ছুঁল। সেখানে একদফা বিমানবাহিনীর আতিথ্যে কফি পান করে এবার আমরা একটা স্টেশন ওয়াগনে উঠলুম।
কোরাডিভি আসলে একটি প্রবালদ্বীপ। শেষ-বেলায় চারদিকে তাকিয়ে বুঝলুম, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসামান্য। মাটি অসমতল। কোথাও-কোথাও ন্যাড়া টিলা মাথা তুলে আছে গাছপালার মধ্যে। গ্রীষ্মকালে সাড়ে ছ’টায় বঙ্গদেশে যখন গোধূলিকাল, এখানে তখনও দেখছি সূর্য অস্ত যায়নি।
আমরা তিন কিলোমিটার পশ্চিমে এগিয়ে যেখানে পৌঁছলুম, সেখানেই সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণাগার। যিনি আমাদের অভ্যর্থনা করে গাড়িতে তুলেছেন, তাঁর নাম ডক্টর রাজগোপাল। স্বয়ং ডিরেক্টর।
ডক্টর গোপাল বললেন, আজ রাতের মতো আপনাদের কষ্ট দেব না। বিশ্রাম করুন। আগামী সকালে প্রোগ্রাম অনুসারে দেখাশোনার ব্যবস্থা করব।
একটা টিলার গায়ে গবেষণাগার। তার পিছনে পঞ্চাশ-ষাট ফুট নীচেই সমুদ্র। অর্থাৎ আরব সাগর। সর্দার শোভন সিং নামে এক সাংবাদিক বললেন, পশ্চিমদিকটা খাড়াই। পূর্ব এবং দক্ষিণে কিন্তু চমৎকার বিচ আছে। দু-দিকেই এক কিলোমিটার করে চওড়া। বালির ওপর গাড়ি চালিয়ে ছোটা যায়। আমি বছর-তিন আগে একবার এসেছিলুম। প্রচুর নারকেল গাছ আছে ওদিকে। ট্যুরিস্ট লজ আছে। দুটো প্রাইভেট হোটেল আছে। তবে কোনও বসতি নেই। সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি থাকার দরুন স্থায়ীভাবে কাকেও বাস করতে দেওয়া হয় না। যারা বাইরে থেকে এখানে বেড়াতে আসে, তাদের বিশেষ অনুমতি নিতে হয়।
জিগ্যেস করলুম, পাশাপাশি আর-সব দ্বীপে নিশ্চয় বসতি আছে?
জবাব দিলেন ডক্টর রাজগোপাল, আছে। তবে বেশিরভাগই কেরল এলাকার জেলে। কিছু আরবও মাঝে-মাঝে এসে কিছু সময় থেকে যায়। তারা শাঁখ আর কড়ির ব্যবসা করে। কোনও-কোনও দ্বীপে স্থায়ী বাসিন্দাও কাছে। স্কুল-ডাকঘর-হাসপাতালও আছে।
কথা বলতে-বলতে আমরা পৌঁছলুম দক্ষিণে রাস্তার ওপারে আরেকটা টিলার ওপর অবস্থিত রেস্টহাউসে। দোতলায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলুম। একটা ছোট্ট হ্রদও রয়েছে পিছনে। ততক্ষণে সূর্য ডুবেছে। কিন্তু যথেষ্ট আলো আছে। বাড়িটার নীচে দক্ষিণে ঢালু হয়ে নেমেছে টিলা। তার নীচে খানিকটা সমতল জমি সবুজ ঘাসে ভরা। হ্রদের জল সেই জমিকে ছুঁয়ে আছে। হ্রদের ধারে কোথাও শর জাতীয় ঝোপঝাড় এবং ঝোপের পাশে একটা পাথরের ওপর বসে কে যেন তন্ময় হয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরছে। তার পেছনটা দেখতে পাচ্ছি। মাথায় টাক আছে। টাকে সূর্যাস্তের লালচে ছটা পড়েছে। সে ছিপে খ্যাঁচ মেরে একটা মাছ টেনে তুলল এবং আমাদের দিকে ঘুরল। তখন দেখলুম, লোকটার মুখে দাড়িও আছে। সাদা ঝকমকে দাড়ি। খাড়া নাক। কোনও আমেরিকান হওয়াই সম্ভব। কিন্তু এ-দ্বীপে বিদেশিদের নাকি আসা বারণ…।
কিন্তু ওই বাদামি রঙের বিদঘুটে জ্যাকেট এবং ধূসর পাতলুন, পাথরের ওপর সযত্নে রাখা টুপি ও ছড়ি, এমনকী মাছ ধরতে বসেও যার গলা থেকে বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা ঝোলে, সে পৃথিবীতে একজনই।
তারপর দেখলুম, মাছটা কিটব্যাগে রেখে বুড়ো টাক-দাড়িওলা লোকটা পকেট থেকে চুরুট বের করে ধরাল। হাওয়া বাঁচিয়ে চুরুট ধরানোর ভঙ্গিটি তো আমার চোখস্থ হয়ে আছে। এই সময় সে আচমকা ঘাসের ওপর থেকে কী একটা তুলে নিল। একটা অদ্ভুত ছোট জাল—দু-দিকে দুটো দু-হাত, আড়াই হাত লম্বা সরু কাঠিতে আটকানো। জালটা নিয়ে সে ঝোপের দিকে পা টিপে-টিপে এগোল। হুঁ, প্রজাপতি ধরতে যাচ্ছে।
ব্যস। সবাইকে হতবাক করে আমি সিঁড়ি ভেঙে পাহাড়ি টাট্টুর মতো দৌড়লুম। নীচে লনে পৌঁছে দেখি বাঁ-দিকে পাঁচিল। পাঁচিলটা ফুটতিনেক উঁচু মোটে। সেই পাঁচিল ডিঙিয়ে ওপারে পড়লুম। পেছনে দোতলায় হতবাক লোকগুলো এতক্ষণ পরে চেঁচাতে শুরু করেছে, মিস্টার চৌধুরী! মিস্টার চৌধুরী! হল কী? ব্যাপারটা কী?
কে যেন ভাঙা বাংলায় বিকট ডাক ছাড়ছে, জয়োন্তোবাবু! জয়োন্তোবাবু! কী হোয়েসে—কী হোয়েসে?
ততক্ষণে ঢালু জমি দিয়ে প্রায় গড়াতে-গড়াতে ঘাসের জমিটায় পড়েছি এবং পড়া মানে একেবারে চিৎপাত। ব্যথা অবশ্য পেলুম না। কিন্তু উঠতে দেরি হল।
ঝোপের কাছে লোকটা প্রজাপতি ধরার তালে এত তন্ময়, যেন পেছনে কী ঘটছে—তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। ধীরে-সুস্থে প্রজাপতিটা একটা সচ্ছিদ্র ছিপি-আঁটা মোটা কাচের জারে ভরে সে জালটা ভাঁজ করল। কিটব্যাগে ভরল। আলো অনেকটা কমে গেছে ততক্ষণে।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। এবার রীতিমতো অপমানিত বোধ করছি। অভিমানের বাষ্পে মন গুমোট। কোথায় আশা করেছিলুম—’হ্যালো ডার্লিং’ বলে একটি চিৎকার, কোথায় এই নির্বিকার অমনোযোগ।
নাকি আমার সত্যি ভুল হচ্ছে? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একটু ঘুরে টিলার ওপর রেস্টহাউসের দোতলার বারান্দা থেকে লোকেরা দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখছে। বুদ্ধির দোষে কী হাস্যকর কাণ্ড না করে ফেললুম! এরপর ওরা হাসাহাসি করবে আমাকে নিয়ে। বলবে, এই হল কিনা বাঙালি বুদ্ধু।
আর চুপ করে না থেকে বললুম, মহাশয় কি অন্ধ এবং বধির?
নির্বিকার বৃদ্ধ লোকটি ছিপ গোটাতে-গোটাতে চাপা গলায় বলে উঠলেন, ওদের গিয়ে বলো, ভুল করে চেনা লোক ভেবেছিলে। ঘণ্টাখানেক পরে যে-কোনও ছলে পূর্বদিকের বিচে ওপেন এয়ার রেস্তোরাঁয় যাবে। খুব সাবধান, একা যাবে। কেউ যেন জানতে না পারে। এই রাস্তা ধরে গেলেই পেয়ে যাবে।
—কিন্তু ব্যাপারটা কী?
—ছেলেমানুষি কোরো না। চলে যাও এখান থেকে। ওদের এ-কথাও বোলো না যে ভুল করে আমাকেই ভেবেছিলে।
হতভম্ব হয়ে টিলা বেয়ে উঠতে শুরু করলুম। রেস্টহাউসের পাঁচিলের কাছে গিয়ে দেখি এদিক থেকে অন্তত ছ’ফুট উঁচু। ওপরের বারান্দা থেকে ডক্টর রাজগোপাল বললেন, পশ্চিমদিকে ঘুরে গেট দিয়ে আসুন…।
ক্লান্ত শরীরে রেস্টহাউসের দোতলায় উঠতেই ঝাঁকে-ঝাঁকে প্রশ্ন ছুড়ে মারতে থাকলেন ওঁরা। কাঁচুমাচু হেসে বললুম, আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক ভেবেছিলুম। কিন্তু তিনি না। চোখের ভুল।
বোম্বের ‘ডেকান টাইমস’ এর রিপোর্টার রবি ভার্মা হাসতে-হাসতে বলল, চেনা লোক দেখে মানুষ যে পাগলা টাট্টুর মতো পাহাড় ডিঙিয়ে ছোটে, এ-দৃশ্য কখনও দেখিনি। হরিবল।
মাদ্রাজের ‘প্যাটিয়ট’-এর রাঘবন বলল, জয়ন্তবাবুর হবু শ্বশুর নন তো ভদ্রলোক?
খুব হাসাহাসি চলতে থাকল। আমি আমতা-আমতা করে নানারকম কৈফিয়ত দিতে থাকলুম।
একটু পরে আমাদের ঘর দেখিয়ে দেওয়া হল। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের শেষ ঘরটায় আমার এবং রবি ভার্মার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আবার কফি এবং স্ন্যাকসের প্যাকেট এল। রাত সাড়ে আটটায় নীচের ডাইনিং হলে ডিনার পরিবেশন করা হবে। বিছানায় বসে সিগারেট ধরিয়ে ব্যাপারটা ভাবতে ব্যস্ত হলুম। ভার্মা অন্ধকারে সমুদ্রশোভা দেখতে বারান্দায় চলে গেল।
অচেনা জায়গা। পুবের বিচে কোথায় সেই মুক্তাঙ্গন রেস্তোরাঁ কে জানে? অথচ রহস্যময় বুড়ো আমাকে সেখানে যেতে বলল। একবার ভাবলুম, চুলোয় যাক। আমি যা করতে এসেছি, তাই নিয়ে থাকি। আবার ভাবলুম, রথ দেখতে এসে কলা বেচে পয়সা উসুল করার মতো তেমন কোনও চমকপ্রদ খবর পেয়ে যেতেও তো পারি! তাতে ‘দৈনিক সত্যসেবক’ পত্রিকার প্রচার বেড়ে যেতে পারে। আমার বেতনবৃদ্ধি হতে পারে।
কিন্তু তার চেয়ে আদত কথা, বুড়োর সঙ্গে যেন আমার রক্তের সম্পর্ক। তা না হলে দেখামাত্র অমন করে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কি কেউ দৌড়ে যায়?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ডাকে আমি এভারেস্ট ডিঙিয়ে যেতেও পারি।
কিন্তু উনি দেখছি সর্ব ঘটে বিরাজমান। ভাবতেও পারিনি, এই কোরাডিভিতে ওঁকে দেখতে পাব। এবং তার চেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার, চিররহস্যময় এবং রহস্যসন্ধানী বৃদ্ধ এই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার এখানে আত্মগোপন করে রয়েছেন। ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতেই হয়…।
দুই
ক’জন সাংবাদিক এক জায়গায় জড়ো হলে যা হয়। রাজনীতির হাঁড়ির খবর নিয়ে তর্কাতর্কি, হুল্লোড়, এবং কখনও খিস্তি, কখনও বিপুল অট্টহাসি। দিল্লির ‘দৈনিক আর্যাবর্ত’-এর ব্রজলাল শর্মা খুব জমিয়ে তুলতে পারেন। আড্ডাটা তাঁর ঘরেই বসেছে। তখন সাড়ে সাতটা বাজে। আর দেরি করা যায় না। এক ফাঁকে বেরিয়ে এলুম।
লনে একজন কর্মীর সঙ্গে দেখা হল। শশব্যস্তে বলল, সঙ্গে যাব, স্যার?
বললুম, না। একটু ঘুরে আসি।
—সঙ্গে টর্চ আছে তো, স্যার? একটু সাবধানে দেখে-শুনে ঘুরবেন।
—কেন বলুন তো?
—অন্য কিছু না। সাপটাপ থাকতে পারে।
হাসতে-হাসতে বললুম, বাঘ-ভাল্লুক নয় তো?
—না, স্যার। বাঘ-ভাল্লুক এখানে কোথায়!
গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় পড়লুম। গবেষণাগার ডাইনে রেখে হ্রদের ধারে গিয়ে সোজা পুবে এগোলুম। রাস্তাটা সংকীর্ণ হলেও সুন্দর পিচ-বাঁধানো এবং পরিষ্কার। দু-ধারে একটু দূরে-দূরে লাইটপোস্ট রয়েছে। কাজেই একটুও অন্ধকার নেই।
কিন্তু অজানা জায়গার নির্জন রাস্তায় হাঁটলে গা-ছমছম করবেই। আমার ডাইনে হ্রদটা যেখানে শেষ হল, সেখানে রাস্তাটা একটু বাঁয়ে মোড় নিয়েছে। সামনে সমুদ্র। দু-ধারে ন্যাড়া পাঁচিলের মতো পাথরের পাহাড়। সমুদ্রের ধারে গিয়ে রাস্তাটা ঘুরে উত্তরে চলে গেছে বিমানঘাঁটির দিকে।
আমি রাস্তা থেকে বালির বিচে নামলুম। বিচে আলো রয়েছে। উঁচু লাইটপোস্ট আছে এখানে-ওখানে। এবার দু-চারজন করে লোক দেখা যাচ্ছিল। কেউ বালিতে বসে আছে, কেউ বেঞ্চে বসেছে। চাপা গলায় কথা বলছে। সামনে ট্যুরিস্ট লজ ও হোটেলের আলো দেখা গেল। আমার বাঁ-দিকে নারকেল গাছের জটলা, ডাইনে সমুদ্র। সেখানে দেখলুম, নারকেল গাছের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় বিশাল কয়েকটা ডোরাকাটা ছাতা এবং তার তলায় লোকেরা বসে আছে। এটাই তাহলে ওপেন এয়ার রেস্তোরাঁ। হালকা নিচু বেতের চেয়ারে বসে নানা বয়সের পুরুষ ও মহিলা আড্ডা দিচ্ছে।
সেখানে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমার বৃদ্ধ বন্ধুকে খুঁজছি, ডানপাশ থেকে চাপা গলায় আওয়াজ এল হ্যালো ডার্লিং।
আহা, এই সেই স্নেহভরা মিঠে ডাক। এই সেই প্রাণমাতানো আপনকরা সম্ভাষণ। ঘুরে দেখি, উনি ফাঁকায় একটি টেবিলের পাশে বসে আছেন। শুধু মুন্ডুটা টেবিলের ওপর দেখা যাচ্ছে। গিয়ে সামনাসামনি বসে পড়লুম।
—তুমি রাগ না করে চলে এসেছ, খুব খুশি হয়েছি, ডার্লিং। এখন চুপচাপ বসো। কফি খেয়ে ক্লান্তি দূর করো।
—আর কফি নয়। চা খাব।
একটু তফাতে একটা গ্যারেজের মতো ঘরে চা ও কফি বানানো হচ্ছে। ঘরটা যে গাড়ি, তা চাকা দেখে মালুম হল। ভ্রাম্যমাণ রেস্তোরাঁ আর কী। ইশারা করতেই একজন বয় এসে সেলাম দিল। কর্নেল চায়ের অর্ডার দিলেন। সে চলে গেল।
তখন বললুম, আপনি কি কারও ভয়ে এখানে এসে লুকিয়ে আছেন?
বুড়ো হাসলেন : তা যা বলেছ! সেইরকমই অবস্থা।
—শুট। ঝাড়ুন, কী মালকড়ি আছে।
হাত তুলে কর্নেল বললেন, সবুর বৎস, সবুর। চা খেয়ে আগে ক্লান্তি দূর করো।
—কবে এসেছেন এখানে? উঠেছেন কোথায়?
—গতকাল সকালে। উঠেছি ওই সি-ভিউ হোটেলে।
—আমরা আসব জানতেন কি? মানে—আমি আসছি কি না, জানতেন?
—অবশ্যই।
বয় ট্রে রেখে গেল। কর্নেল পট থেকে চা ঢালতে-ঢালতে বললেন, দেখছ, কত কুইক সার্ভিস করে এরা? পৃথিবীর কোথাও এরকম সার্ভিস পাবে না, জয়ন্ত। গতকাল থেকে লক্ষ করছি। এর মালিক ভদ্রলোক মাদ্রাজি। অতি অমায়িক সজ্জন মানুষ।
এরপর চা খেতে-খেতে আমাদের এইসব কথাবার্তা হল।
—এবার বলুন, এখানে আগমনের উদ্দেশ্য কী আপনার?
—তোমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি।
—চালাকি রাখুন। সাংবাদিকদের ওপর গোয়েন্দাগিরি! সরকারের আর কাজ নেই? তার ওপর কি না সেজন্যে বেছে-বেছে এক বেসরকারি বুড়ো ঘুঘুকে পাঠিয়েছেন! বিশ্বাসই করি না।
—ডার্লিং, আস্তে। সমুদ্রবায়ু খুব জোরালো।
—কিন্তু ব্যাপারটা কী?
—বললুম তো।
—অসম্ভব। আপনি এক কিলোমিটার দূরে বসে গোয়েন্দাগিরি করছেন? ভ্যাট!
—শোনো জয়ন্ত, দিল্লিতে সাংবাদিকদের লিস্টে তোমার নাম আমিই ঢুকিয়েছি। দিস ইজ সিরিয়াস। হাতে সময় ছিল না তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করার। ট্রাঙ্ককল করাটা ভালো মনে করিনি। ভেবেছিলুম, যে-কোনওভাবে যোগাযোগ করে ফেলব এখানে এসে। সেই উদ্দেশ্যে রেস্টহাউসের পেছনের হ্রদে মাছ ধরতে গিয়েছিলুম। তুমি যে বোকার মতো অমন করে দৌড়ে যাবে ভাবতে পারিনি!
—ভাবা উচিত ছিল আপনার।
—প্লিজ জয়ন্ত! এবার থেকে এটা ভেবে নিয়েই কাজ করব।
—যাকগে, বলুন কী ব্যাপার?
—তোমার সাহায্য আমার খুবই দরকার। যা বলছি মন দিয়ে শোনো।
—শুনছি তো। বলুন!
—তোমাকে কেউ ফলো করেনি, আর ইউ শিয়োর?
—না। সারা রাস্তা ভয়ে-ভয়ে এসেছি। আলোও ছিল। বারবার পেছনে ঘুরেছি, কাকেও দেখিনি।
—খাসা! এবার শোনো—তোমাদের দলে কোনও বিদেশি এজেন্ট থাকার সম্ভাবনা আছে। এখানে সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণা সংস্থার একটি মূল্যবান আবিষ্কারের ফরমুলা তার হাতে পাচার হতে পারে। কোনও এক সূত্রে সরকার এটা আঁচ করেছেন। এখন…।
—কী কাণ্ড! তাহলে সাংবাদিকদের অত ঘটা করে না নিয়ে এলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত! এত রিস্ক নেওয়ার কী দরকার ছিল সরকারের?
—প্লিজ, জয়ন্ত, ধৈর্য ধরে শোনো। সরকার এ-ব্যাপারে নিঃসংশয় হতে চান বলেই গোপন সূত্রে খবর জেনেও প্রোগ্রাম ক্যানসেল করেননি। অর্থাৎ সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণা সংস্থার কোন লোকটি ওই চক্রে জড়িত, তা আবিষ্কার করাই উদ্দেশ্য। এটা একটা ফাঁদ বলতে পারো।
—বুঝলুম। তা আপনি বুড়ো বয়েসে এতে নাক গলালেন কেন? খুন-খারাপি নিয়ে গোয়েন্দাগিরি করেন, এসব স্পাই রিং-এর ব্যাপার। এ তো মারাত্মক!
—ডার্লিং, এই দ্বীপে এক বিরল প্রজাপতি আছে শুনেছিলুম।
—বেশ তো। প্রজাপতি ধরতে আপনার অসুবিধে ছিল নাকি? এই তো, কত সব ট্যুরিস্ট এসেছে মেনল্যান্ড থেকে। তেমনিভাবে এলেও পারতেন।
—জয়ন্ত, জয়ন্ত, প্লিজ। উত্তেজিত হয়ো না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বিশেষ অনুরোধে এ-কাজ না নিয়ে পারিনি।
—ভালো। আপনি দেশের সেবায় নেমেছেন। কিন্তু…।
—তুমি কি ভয় পাচ্ছ, ডার্লিং?
—ভয়? আপনি বললে কী না পারি? বলুন না, সাগরে ঝাঁপ দেব?
—হাঃ হাঃ হাঃ! বেশ, বেশ। এবার শোনো, তুমি বাকি চারজন সাংবাদিকের ওপর নজর রাখবে। আর…।
—এতক্ষণে হয়তো ফরমুলা পাচার হয়ে গেছে! কী আপনার বুদ্ধি!
—সম্ভবত হয়নি। কারণ ওখানে নজর রাখার লোক আছে। গবেষণাগারেরই লোক। সে সরকারি গোয়েন্দা। তবে সাংবাদিকদের মধ্যে কোন ভদ্রলোক এ-ব্যাপারে লিপ্ত সেটা জানা তোমার পক্ষে যতটা সোজা, তার পক্ষে নয়। তুমি তাদের সঙ্গেই রয়েছ এবং তোমার চোখ এড়িয়ে কিছু করা কঠিন। তা ছাড়া, এখনও ফরমুলা পাচার হয়নি, বলার কারণ আছে। পরে জানতে পারবে।
—কিন্তু ফরমুলাটা কীসের?
—তুমি মলিকিউলার বায়োলজি, অর্থাৎ আণবিক জীববিদ্যা কিংবা আধুনিক প্রজননবিদ্যার খবরাখবর কি রাখো? তাহলে বলতে পারি।
—অত অশিক্ষিত ভাববেন না, মাই ডিয়ার ওল্ডম্যান।
—আধুনিক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ প্রাণী ও উদ্ভিদের দেহ-কোষ নিয়ে ক্রোমোজোমের মধ্যে জিনের হেরফের ঘটিয়ে নতুন সজীব পদার্থ সৃষ্টি করা হয়েছে। ডি এন এ-র কথা তো জানো। জিনের হেরফের ঘটাতে ওই জিনিসটি মোক্ষম। খোদার ওপর খোদকারি। সংক্ষেপে বলছি। আমাদের প্রজননবিদরা সামুদ্রিক প্রাণী শুশুকের দেহে ওইভাবে জিনের হেরফের ঘটিয়ে তাকে বুদ্ধিমান প্রাণীতে পরিণত করতে পেরেছেন। সমুদ্রের তলায় গিয়ে তারা অনায়াসে শত্রুর জাহাজের তলা ফাঁসিয়ে আসতে পারবে। এমনকী, শত্রুর জাহাজের অবস্থিতি, অস্ত্রশস্ত্র, সরঞ্জাম, পরিকল্পনা—সবকিছুর হদিশ করে আসতে পারবে। শত্রুদের সন্দেহই হবে না। অর্থাৎ, সেই শুশুক একইসঙ্গে কম্পিউটারের এবং মানুষের কাজ করতে পারবে। বুঝলে তো এবার? কিন্তু সাবধান—এ-খবর তোমার ‘দৈনিক সত্যসেবক’ পত্রিকায় ছাপবার জন্যে নয়। ছাপলে সরকার অস্বীকার করবেন এবং তোমাদেরও ঝামেলা বাড়বে।
—ফরমুলাটার আবিষ্কারক কে?
—ডক্টর রাজগোপাল।
এরপর কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, তোমায় আর আটকে রাখব না, জয়ন্ত। তুমি এসো। আমি হোটেলে গিয়ে কতকগুলি কাজ সেরে নিই। দুঃখিত যে, তোমায় এগিয়ে দিতে পারছি না। কিন্তু তুমি খুব সতর্ক হয়ে ফিরে যাও। বাই দা বাই, সঙ্গে কি তোমার সেই খুদে যন্ত্রটি আছে?
—আছে। ভাববেন না।—বলে আমি উঠে দাঁড়ালুম।
খুদে যন্ত্রটি একটি পয়েন্ট বত্রিশ ক্যালিবারের রিভলবার। ক’বছর আগে কলকাতার ডক এলাকায় একটা চোরাচালান চক্রের খবর দিয়ে কাস্টমসকে সাহায্য করার পুরস্কারস্বরূপ রাজ্য সরকার আমাকে এই অস্ত্রটির লাইসেন্স মঞ্জর করেন। সেবার ওই চক্রের মধ্যে নাক গলাতে গিয়ে একটুর জন্যে প্রাণে বেঁচে যাই।
বিচ থেকে রাস্তায় পৌঁছে এবার কিন্তু বুক কেঁপে উঠল। চারদিকে কড়া নজর রেখে হাঁটতে থাকলুম। কিন্তু ফেরার পথেও কোনও লোক দেখলুম না।
অবশ্য মনটা খারাপ হয়ে গেল। কর্নেলের উপভোগ্য সঙ্গলাভের জন্যে তীব্র ইচ্ছে দমন করাটা আমার পক্ষে ভারী কঠিন। নিরন্তর সদালাপী এবং কৌতুকপরায়ণ ওই বৃদ্ধের সংসর্গে কী জাদু আছে, সে আমিই জানি।
হ্রদের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালুম। কে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আবছা আলোয়। সে এদিকে ঘুরলে দেখি, ‘দৈনিক পাঞ্জাব নিউজ’ এর সর্দার শোভন সিং। আমায় দেখে সর্দারজি বললেন, হ্যাল্লো।
আমিও সন্দিগ্ধভাবে বললুম, হ্যাল্লো।
সর্দারজি বললেন, ঘুরতে বেরিয়েছিলেন, জয়ন্তবাবু?
—হ্যাঁ, সর্দারজি।
—আমিও ঘুরতে বেরিয়েছি। হল্লা আমার ভালো লাগে না।
তিন
‘ডেকান টাইমস’-এর রবি ভার্মা আমার অনেকদিনের পরিচিত এবং বন্ধু মানুষ। ‘প্যাট্রিয়ট’-এর রাঘবনের সঙ্গে বেশিদিনের আলাপ নয়। কিন্তু সে-ও এখন আমার বন্ধু হয়ে উঠেছে। এরা দুজনেই আমার প্রায় সমবয়েসি। ‘আর্যাবর্ত’-এর ব্রজলাল শর্মার সঙ্গে এবারই পথে আলাপ। ভদ্রলোকের বয়স পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ হবে। নাদুসনুদুস গড়ন, ভুঁড়ি আছে এবং তুখোড় রসিক লোক। জমিয়ে তুলতে ওস্তাদ। ‘দৈনিক পাঞ্জাব নিউজ’ এর সর্দারজি পাকা প্রৌঢ়। একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। কম কথা বলেন। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বিশাল আকারের সর্দারজিকে নিয়ে আড়ালে ঠাট্টা-তামাসা চলে। ওঁর সঙ্গে গতবছর বোম্বাইয়ে আলাপ হয়েছিল। মাঝে-মাঝে কলকাতা যান। ‘সত্যসেবক’ পত্রিকা অফিসে ফোন করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওঁর প্রতি আমার যেভাবেই হোক প্রচুর শ্রদ্ধা জন্মেছে।
হ্রদের ধারে নির্জনে দাঁড়িয়ে উনি কী করছিলেন? একটু সন্দেহ দানা বেঁধেছিল মনে। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই শব্দটুকুর প্রশ্রয় না দিয়ে পারিনি। দুজনে পাশাপাশি দু-চারটে ছোট বাক্যে দ্বীপের ভালোমন্দ নিয়ে মতামত দিতে-দিতে আমরা রেস্টহাউসে ফিরেছিলুম। তখনও শর্মার ঘরে তুখোড় আড্ডা চলেছে। আমাদের দেখে শর্মা চেঁচিয়ে উঠলেন, পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে। জোড়া লাশের খোঁজ মিলেছে।
এতে খুব হাসাহাসি পড়ে গেল। এইসময় নীচের ডাইনিং হলে ডিনার খাওয়ার ডাক এল।
খাওয়াদাওয়া শেষ হতে সাড়ে নটা বেজে গেল। তারপর শর্মা প্রস্তাব দিলেন : এবার কিছুক্ষণ নৈশভ্রমণ না করলে নির্ঘাত পেটের গোলমাল হবে। অতএব ভদ্রমহোদয়গণ, চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।
ভার্মা বলল, শিয়োর। পঞ্চপাণ্ডব মিলে দ্বীপটা জয় করে ফেলি। চলুন।
রাঘবন চাপা গলায় বলল, কিন্তু দ্রৌপদী কোথায়? একজন দ্রৌপদী চাই।
শর্মা বললেন, মাই গুডনেস! সর্দারজি কেমন কটমট করে তাকাচ্ছেন।
সর্দারজি হেসে ফেললেন। বললেন, কিন্তু দোস্ত, দুঃখের বিষয় এ-দ্বীপে শুনেছি একজনও স্ত্রীলোক নেই।
বলতে যাচ্ছিলুম, আছে। কিন্তু সংযত হলুম! ট্যুরিস্টদের দলে বিচে কয়েকজন স্ত্রীলোক দেখেছি।
পাঁচজনে বেরিয়ে পড়লুম। গেটে যেতেই দেখা হল ডক্টর রাজগোপালের সঙ্গে। রাস্তায় ওঁর গাড়ি। সবিনয়ে জানালেন, খুবই লজ্জিত এবং দুঃখিত যে, ডিনার টেবিলে উপস্থিত থাকতে পারেননি। একটা কাজে আটকে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।
আমরা সেজন্যে যে কিছু মনে করিনি, পঞ্চমুখে বাক্যসহযোগে সে-বিষয়ে ওঁকে আশ্বস্ত করলুম। তারপর উনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ভার্মা বলল, ডক্টর রাজগোপালের কোয়ার্টার কোনটা?
সর্দারজি বললেন, ল্যাবরেটরির ওপরতলায়।
শর্মা বললেন, সর্দারজির সবতাতেই চোখ। এ রিয়্যাল অবজার্ভার।
কথা বলতে-বলতে আমরা দক্ষিণে সেই হ্রদের ধারে পৌঁছলুম। সর্দারজি জলের ধারে একটা চ্যাটালো পাথরের ওপর উঠে বসলেন। ওই পাথরে বসেই কর্নেল মাছ ধরছিলেন।
শর্মা আর রাঘবন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে পূর্বে এগিয়ে গেলেন। আমি আর ভার্মা ঘাসের ওপর বসলুম। সর্দারজির কাছ থেকে আমাদের দূরত্ব দশ গজের বেশি নয়। তাঁর সামনে দক্ষিণে হ্রদ, বাঁ-দিকে উঁচু শর এবং নলখাগড়ার ঝোপ, ডানদিকে হ্রদের কিনারা বরাবর আস্তে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে একটা টিলা—প্রচুর ঝোপঝাড়ে ভরা।
হঠাৎ জলে একটা শব্দ হল। ভার্মা ও আমি মুখ তুলেছি, আবার শব্দ হল। জলে কিছু একটা পড়ল। ঢিল নয়, পাথরের চাঙড় পড়ার মতো চবাং করে শব্দ। তারপর আবিষ্কার করলুম, রাশভারি সর্দারজি পাথরের ওপর বসে কী ছুড়ে মারছেন জলে।
ভার্মা হাসতে-হাসতে বলল, ও কী, সর্দারজি! ব্যাঙ মারছেন নাকি?
সর্দারজি একবারে ঘুরে হেসে বললেন, স্রেফ খেয়াল!
কখন রাস্তার ধার থেকে নুড়ির মতো পাথর কুড়িয়ে নিয়েছেন—সম্ভবত আসার সময়, এবং জলে ছুড়ে খেলা করছেন—এর প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার মানে হয় না। অনেক প্রবীণকে অনেক হাস্যকর কাজ করতে দেখা যায়।
সর্দারজি ফের আপনমনে জলে নুড়ি ফেলতে থাকলেন। এবার নুড়িগুলো ছোট বলেই মনে হল। আমরা ওদিকে আর মন দিলুম না। চাপা গলায় নানান গল্পগাছা করতে থাকলুম। ভার্মা পা ছড়িয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় কথা বলছিল। একটু পরে ঘড়ি দেখে সে উঠে বসল। বলল, চলো চৌধুরী, একটু পায়চারি করে আসি। পেটটা ফুলে উঠেছে।
ডাকলুম, সর্দারজি! হাঁটবেন নাকি কিছুক্ষণ?
সর্দারজি জবাব দিলেন, না ভাই। আপনারা হাঁটুন।
ভার্মা আর আমি হাঁটতে-হাঁটতে রাস্তা ধরে পূর্বে এগোলুম। কিছুদূর গিয়েই দেখি, শর্মা আর রাঘবন ফিরে আসছে। চারজনে রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আবার একদফা কথাবার্তা এবং হাসাহাসি হল। তারপর শর্মা বলল, চলো, রাত হয়েছে। ফেরা যাক।
চারজনে ফিরে এসে সেই ঘাসের জমির কাছে পৌঁছেছি, হঠাৎ বাঁয়ে সেই পাথরটার দিকে চোখ গেল। সর্দারজি জলে নেমেছিলেন—তখনই দু-হাতে পাথরটা ভর করে উঠে বসলেন। চপ্পল দুটো পাথরের ওপর রাখা আছে।
শর্মা বললেন, সর্দারজি! আসুন, শুয়ে পড়া যাক।
সর্দারজি উঠে পায়ে চপ্পল গলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, চলুন।
জলে নেমেছিলেন—এটা কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এ-স্বভাব অনেকেরই থাকে। জল দেখে পা ধুয়ে নেওয়ার বাতিকও দেখেছি অনেকের।
আমরা রেস্টহাউসে ফিরে এলুম। রাঘবন ও শর্মা এক ঘরে, আমি এবং ভার্মা তার পাশে শেষদিকের ঘরে, আর সর্দারজি একা একটা ঘরে শুতে গেলেন—রাঘবন ও শর্মার ঘরের ওপাশের ঘরটায়।
ভার্মা বলল, আলো না নেভালে আমার ঘুম হয় না, জয়ন্ত।
বললুম, আমারও।
আলো নিভিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করলুম। কিন্তু নতুন জায়গায় ঘুম আসে না। চোখ বুজে এপাশ-ওপাশ করতে-করতে রাত একটা বেজে গেল। রেডিয়াম দেওয়া ঘড়ির কাঁটা সময় বলে দিল। ভার্মার নাক ডাকছে সমানে।
সবে একটু তন্দ্রামতো এসেছে, কী একটা শব্দে সেটা কেটে গেল। চোখ খুলে দেখি, ভার্মা উঠে বসেছে। বাইরের আলোর সামান্য ছটা ঘরে প্রতিফলিত হয়েছে। তাই তাকে দেখতে পাচ্ছিলুম। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সম্ভবত। আবছাভাবে তার আউটলাইন নজরে পড়ছে।
আমি শ্বাসপ্রশ্বাস ঘুমন্ত মানুষের মতো তালে-তালে নিচ্ছি। কর্নেলের সঙ্গে এ-দ্বীপে দেখা না হলে তো তখুনি কথা বলে উঠতুম, কী হল, ভার্মা?
ভার্মা পা টিপে-টিপে দরজার দিকে এগোল, তারপর সাবধানে দরজা খুলে বেরুল এবং বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমার তখন উত্তেজনায় বুক কাঁপছে। তাহলে কি ভার্মাই সেই বিদেশি গুপ্তচক্রের এজেন্ট? এভাবে কোথায় গেল সে? ঘড়ি দেখলুম। রাত একটা ঊনষাট।
দীর্ঘ দু-মিনিট পরে ভার্মা যেমন গিয়েছিল, তেমনি পা টিপে-টিপে ফিরে এল। শুয়ে পড়ল। উত্তেজনায় বাকি রাতটা আর ঘুমই এল না। দেখতে-দেখতে ভোরের আলোয় ঘর ভরে গেল। তখন আবার সেই তন্দ্রার ঘোরটা ফিরে এল। তারপর কখন সত্যি-সত্যি ঘুমিয়ে গেছি।
সেই ঘুম ভাঙল বাইরে কী একটা চাপা গোলমাল শুনে। তাকিয়ে দেখি ঘরে রোদ ঢুকেছে। বিছানায় ভার্মা নেই। বাইরে কারা ব্যস্তভাবে চলাফেরা করছে। চাপা উত্তেজিত স্বরে কথা বলছে কারা। নীচের সিঁড়িতে বারবার কারা উঠছে এবং নেমে যাচ্ছে—সেইসব জুতোর শব্দ। লক্ষণটা ভালো নয়। উঠে বসলুম তক্ষুনি।
দরজায় গিয়ে পরদা তুলে দেখি বারান্দায় ভার্মা, শর্মা এবং রাঘবন কথা বলছে। তাদের মুখে উত্তেজনার ছাপ। বললুম, কী ব্যাপার, মিস্টার শর্মা?
শর্মা গম্ভীর মুখে বললেন, সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেছে, জয়ন্তবাবু। সর্দারজি ইজ ডেড।
চমকে উঠলুম।—সর্দারজি মারা গেছেন! সে কী?
—বোধহয় হার্ট অ্যাটাকে।—শর্মা বললেন, রাতে দরজা খুলে বেরিয়েছিলেন—মানে বেরুতে যাচ্ছিলেন, তখনই পড়ে যান সম্ভবত। বডি অর্ধেক ঘরে অর্ধেক বাইরে পড়ে রয়েছে। দেখে আসুন না।
সর্দারজির ঘরের সামনে কর্মীদের ভিড়। গিয়ে উঁকি মেরে দেখলুম, উপুড় হয়ে পড়ে আছেন সর্দারজি। মুখটা কাত হয়ে আছে। নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে জমাট বেধে আছে। আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল।
চার
সামরিক হাসপাতালে সর্দারজির মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হল, তখন বেলা সাড়ে আটটা। ডাক্তার ভদ্রলোক সমর বিভাগের। নাম মেজর টি. আর. আনতুলে। তিনি এসে পরীক্ষা করে রায় দিয়েছেন, হ্যাঁ—হার্ট অ্যাটাকই বটে, তবু আইনত লাশের পোস্টমর্টেম করতে হবে। তাই লাশ সামরিক হাসপাতালের মর্গে গেল।
দ্বীপে ছোট্ট একটা পুলিশ বিট আছে। সেটা বিচের ওদিকে। নেহাত ট্যুরিস্টদের রক্ষণাবেক্ষণে। অফিসার-ইন-চার্জ এসে রুটিনমাফিক সর্দারজির কিটব্যাগ হাতড়ে অনেক প্রেসক্রিপশান, হার্টের রোগের ওষুধ, রিপোর্টিং নোটবুক ইত্যাদি পরীক্ষা করেছেন।
ডক্টর রাজগোপাল রেডিও-মেসেজ পাঠিয়েছেন ‘ডেলি পাঞ্জাব নিউজ’ পত্রিকার অফিসে। স্বরাষ্ট্র দফতরকেও খবর জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র দফতরকে অনুরোধ করেছেন, এই ট্যুর প্রোগ্রাম উদ্যোক্তা বিজ্ঞান ও গবেষণা দফতরকে খবরটা পৌঁছে দিতে। শর্মার কাছে এসব জানতে পারলুম।
তারপর একফাঁকে অধৈর্য হয়ে বেরিয়ে পড়লুম বিচের দিকে। হাঁটতে-হাঁটতেই গেলুম। সি-ভিউ হোটেলের বোর্ডারদের তালিকা দেখে দোতলায় কর্নেলের ঘরের দরজায় বোতাম টিপলে সাড়া এল, এসো, জয়ন্ত।
বুড়ো ম্যাজিক জানেন সম্ভবত। ঢুকে দেখি, টেবিলে একগাদা ফটো নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। পাশের সোফায় বসে বললুম, আমিই বেল বাজিয়েছি, বুঝলেন কীভাবে?
—তোমার বোতাম টেপার ভঙ্গি আমার সুপরিচিত। তা ছাড়া, রেস্টহাউসে অমন একটা ঘটনার পর তোমার দৌড়ে আসাটা অনিবার্য ছিল। যাকগে, সংক্ষেপে বলো।
সর্দারজির নির্জনে হ্রদের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা, দ্বিতীয়বার সেখানে গিয়ে পাথরে বসে জলে নুড়ি ছুড়ে খেলা, জলে নামা, তারপর ভার্মার এত রাতে চুপিচুপি বেরুনো—সবটা উত্তেজিতভাবে বর্ণনা করলুম।
শোনার পর কর্নেল বললেন, হুম। আশা করি, এসব যা লক্ষ করেছ, আর কাকেও বলোনি?
—মোটেও না।
—তোমার কি মনে হচ্ছে, সর্দারজির হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর ব্যাপারটা গোলমেলে?
—নিশ্চয় গোলমেলে।
—কিন্তু ওঁর তো হার্টের অসুখ ছিল।
—ছিল। তবু অত রাতে ভার্মার অমন করে চুপিচুপি বেরুনো।
বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, ওতে কিছু প্রমাণ হয় না। যাকগে, পোস্টমর্টেম রিপোর্টের ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। আপাতত তুমি আমার অতিথি। তোমার যথাবিহিত সৎকার করা আমার কর্তব্য। নিশ্চয় পেটপুরে ব্রেকফাস্ট খেতে পারোনি। তোমার মুখ দেখেই টের পাচ্ছি।
…বলে মৃদু হেসে কর্নেল ফোন তুললেন। ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিয়ে ছবিগুলো গোছাতে ব্যস্ত হলেন। কৌতূহলী হয়ে একটা ছবি তুলে নিলুম। নিছক প্রাকৃতিক দৃশ্য।
কর্নেল ছবি ড্রয়ারে খামের মধ্যে রেখে বললেন, এখনই যে-কোনও মুহূর্তে ডক্টর রাজগোপাল আসার কথা। তোমাকে আমার এখানে দেখে অবাক হয়ে যাবেন। তোমার-আমার সম্পর্কটা ওঁর কাছে এবার স্পষ্ট হওয়া ভালো।
—ভালো।
একটু পরে ব্রেকফাস্ট এল। খেতে-খেতে দরজার ঘণ্টা বাজল। কর্নেল উঠে গিয়ে দরজা খুললেন। হ্যাঁ, ডক্টর রাজগোপালই। এবং আমাকে দেখে সত্যি অবাক চোখে তাকালেন।
তখন কর্নেল সহাস্যে আমার এবং তাঁর সম্পর্কও ব্যাখ্যা করে দিলেন। ডক্টর রাজগোপাল অন্তরঙ্গভাবে আমার একটা হাত নিয়ে বললেন, তাহলে তো খুবই সুখের কথা। জয়ন্তবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়ে আশ্বস্ত বোধ করছি।
কর্নেল বললেন, জয়ন্ত আমার দক্ষিণহস্তই বলতে পারেন। অতএব নির্দ্বিধায় আমরা ওর সামনে খোলাখুলি কথা বলতে পারি।
ডক্টর রাজগোপাল পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে বললেন, নকশাটা এনেছি। আপনাকে বুঝিয়ে দিই।
নিচু টেবিলে কাগজটা ছড়িয়ে রেখে ডক্টর রাজগোপাল বোঝাতে শুরু করলেন।
—ল্যাবরেটরির দুটো ব্লক। এ আর বি। বি-এর ওপরতলায় আমার কোয়ার্টার। বেডরুমের পাশের এই ছোট ঘরটা দেখছেন, এটাই সেই লিফট। কিন্তু কিছুতেই বোঝা যাবে না। ঘরটা চমৎকার সাজানো। এখানে টেবিল, টেবিলে বোতাম টিপলে সামনের চেয়ারে বসা লোকেরা কিছু টের পাবে না। লিফটটা নিঃশব্দে নেমে যাবে একশো ফুট নীচে। এই দেখুন, দরজার বাইরে প্যাসেজ এবং প্যাসেজটা রাস্তার তলা দিয়ে হ্রদের তলায় গিয়ে পৌঁছেছে। প্যাসেজের শেষে একটা ঘর দেখছেন। এটাই সেই গোপন ল্যাবরেটরি। শুশুক-মানুষের ফরমুলা এখানে এই আলমারিতে রয়েছে। এ-দেওয়ালটা কাচের। ওপাশে হ্রদের জল। দৈবাৎ কাচের দেওয়াল ফেটে গেলে জলে সব ডুবে যাবে—প্যাসেজ এবং বি ব্লকের তলার ঘর অব্দি জল ঢুকে পড়বে। এই কাচের দেওয়ালে যন্ত্র ফিট করা রয়েছে। ওপাশে শুশুক-মানুষগুলো দেখা যাবে। দেওয়ালের যন্ত্রে বোতাম টিপে ওদের সঙ্গে সংকেতে যোগাযোগ করা যায়। হ্রদের কোনও তথ্য আনতে বললে তক্ষুনি ওরা চলে যায় এবং যথাসময়ে এসে দেওয়ালের ও-পিঠের নির্দিষ্ট বোতামটি টেপে। এপাশের কম্পিউটারে ডেটাগুলো সঙ্গে-সঙ্গে বিশ্লেষিত হয়ে তথ্যটি আমরা পেয়ে যাই।
শোনার পর কর্নেল বললেন, হ্রদটার সঙ্গে তো সমুদ্রের যোগ আছে?
—আছে। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। একটা খাঁড়ি এসে ঢুকেছে হ্রদে। দু-ধারে উচু প্রবাল-পাঁচিল।
—জল লোনা দেখেই সেটা টের পেয়েছিলুম।
আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। এবার বললুম, তা হলে তো দক্ষিণে ভারত মহাসাগরে সেই দিয়াগো গার্সিয়ার মার্কিন ঘাঁটির খবর আনাও সম্ভব।
ডক্টর রাজগোপাল সগর্বে বললেন, ভারতীয় বিজ্ঞানীরা তা সম্ভব করেছেন। ওই ঘাঁটির তাবৎ তথ্য আমরা নিয়মিত পাচ্ছি। শুশুক-মানুষরা এনে দিচ্ছে। এবং এজন্যেই এত সতর্কতা। আমেরিকা ব্যাপারটা টের পেলে আমাদের এই ল্যাবরেটরি ধ্বংস করতে এজেন্ট পাঠাবেই। তবে আপাতত সেরকম কোনও আশঙ্কার কারণ নেই। শুধু শুশুক-মানুষের গবেষণার খবর বিশেষ একটি দেশ কীভাবে পেয়ে গেছে, জানি না। ওরা আমাদের ফরমুলাটা হাতাতে চায়।
বললুম, আপনি নিশ্চয় সাংবাদিকদের ওই পাতাল ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যেতেন না?
হাসলেন ডক্টর রাজগোপাল।—না। মোটামুটি ওপরের গবেষণাঘরে সব দেখিয়ে একটা আভাস দিতুম, এইমাত্র। আমার আবিষ্কারের মূল কথাটা গোপন রেখে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সাফল্য সম্পর্কে বিবরণ দেওয়াই সরকারের প্রোগ্রাম। অবশ্য ব্যাপারটা হাইলি টেকনিকাল।
কর্নেল বললেন, যাকগে। নকশাটা আমার কাছে রইল। এবার বলুন, গতরাতে কী ঘটেছে?
ডক্টর রাজগোপাল গম্ভীর মুখে বললেন, ফোনে একটুখানি আভাস দিয়েছিলুম আপনাকে। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি অদ্ভুত।
কর্নেল সোফায় শরীর এলিয়ে চুরুট ধরালেন। চোখ বুজে বললেন, হ্যাঁ। বলুন।
—তখন রাত প্রায় দুটো। হঠাৎ কেন কে জানে, ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসলুম। আপনি তো জানেন, এখানে ফ্যামিলি রাখার নিয়ম নেই। একা থাকি। তো ঘুম ভাঙার পর পশ্চিমের জানলায় গিয়ে দাঁড়ালুম। ওদিকে সমুদ্র। কয়েকটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছিল। জেলে নৌকো মনে হল। কিন্তু একটু পরেই একটা নৌকো থেকে জোরালো একঝলক আলো একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে ছড়িয়ে তারপর নিভে গেল। সংকেত দেখাচ্ছে নিশ্চয়। দ্রুত দক্ষিণের জানলায় গেলুম। ওদিকে হ্রদের পশ্চিমপাড়ের পাহাড়। পাহাড় না বলে টিলা বলাই উচিত। ঝোপে ভরতি।
—হ্যাঁ। দেখেছি। একদৌড়ে ওঠা যায়।
—অবাক হয়ে দেখলুম, টিলার ওপর থেকেও ঠিক ওইরকম আলো একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে সঞ্চালিত হল। তারপর নিভে গেল। আলোটা কিন্তু সমুদ্রের দিকে নয়। রেস্টহাউসের দিকে। একটা কিছু অনুমান করে পুবের জানলায় গেলুম। আশ্চর্য, রেস্টহাউসের দোতলার বারান্দা থেকে কে টর্চ জ্বেলে ঠিক অমনি দুবার আলো ফেলল।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ভার্মা। নিশ্চয় ভার্মা।
ডক্টর রাজগোপাল আমার দিকে ঘুরে বললেন, ভার্মা! তার মানে?
কর্নেল হো-হো করে হেসে বললেন, ভার্মাই যে আলোর সংকেত করল, তুমি কি দেখেছ জয়ন্ত?
অপ্রস্তুত হয়ে বললুম, না। তা দেখিনি। তবে ঠিক ওই সময় সে…।
হাত তুলে কর্নেল বললেন, তা না দেখলে ওই সময় সে কী করতে বেরিয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করে কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় না। ও-কথা থাক। ডক্টর রাজগোপাল কি নৌবাহিনীর কাছে ব্যাপারটা জানিয়েছেন?
ডক্টর রাজগোপাল বললেন, তখনই জানিয়েছিলুম। স্টিমবোট নিয়ে ওরা ওত পেতেছিল ওদিকটায়। এখনও অব্দি কোনও খবর নেই।
কর্নেল বললেন, ওটা চোরাচালানিদের সংকেত হতেও পারে। রেস্টহাউসের কোনও কর্মী যে চোরাচালান চক্রে জড়িত নয়, কে বলতে পারে?
ডক্টর গোপাল বললেন, হ্যাঁ। তা-ও ঠিক। একবার তো ধরা পড়েছিল একজন। এখনও সে জেল খাটছে।
পাঁচ
রেস্টহাউসে ফিরে দেখি ততক্ষণে কড়া পাহারা বসে গেছে। সমুদ্রবিজ্ঞান ভবন ঘিরে সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। রেস্টহাউসের গেটে পরিচয়পত্র দেখিয়ে তবে ঢুকতে পেলুম। ওপরে বারান্দায় ভার্মা, রাঘবন এবং শর্মার সঙ্গে দেখা হল। তিনজনেই গম্ভীর মুখে কীসব আলোচনা করছিল। আমাকে দেখে শর্মা বললেন, খুব তালে আছ, ব্রাদার। লম্বাচওড়া একখানা ডেসপ্যাচ ঝেড়ে এলে তোমার কাগজের জন্যে। তাই না?
মুচকি হেসে মাথা দোলালুম। রাঘবন বলল, আর আমাদের বরাত দ্যাখো! বেরুতে দিচ্ছে না।
ভার্মা বলল, জয়ন্ত খুব স্বার্থপর। যাওয়ার সময় আমাকে ডেকে গেল না।
অবাক হয়ে বললুম, বেরুতে দিচ্ছে না মানে?
শর্মা বললেন, চারদিকে তাকিয়ে টের পাচ্ছ না?
ভার্মা উত্তেজিতভাবে বলল, খুব অপমানজনক ব্যাপার কিন্তু। সাংবাদিকদের হয়রান করার ঠেলাটা কী জানে না। ফিরে গিয়ে যা কাণ্ড করব।
বললুম, কিন্তু হঠাৎ এমন কী ঘটল যে…।
বাধা দিয়ে রাঘবন বলল, সর্দারজির পোস্টমর্টেম রিপোর্টে নাকি কী গোলমেলে ব্যাপার আছে। মার্ডার বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। স্টমাকে বিষ পাওয়া গেছে।
শর্মা বললেন, হাতি পাওয়া গেছে। ছাড়ো তো।
ভার্মা বলল, খামোকা হয়রানি। কখন বোম্বে থেকে ফরেনসিক এক্সপার্ট টিম আসবে, ক্রাইম ব্র্যাঞ্চের অফিসাররা আসবে, আমাদের জেরা করবে—তারপর আমাদের মুক্তি।
শর্মা রসিকতা করলেন।—মুক্তি না হাজত, কে বলতে পারে, ব্রাদার? জয়ন্ত, তুমি বোকার মতো ফিরে এলে কেন, বলো তো? দিব্যি কেটে পড়তে পারতে।
আমরা শর্মার ঘরে গিয়ে বসলুম। একটু পরে লাঞ্চের ডাক এল। নীচে ডাইনিং হলে গিয়ে খেয়ে এলুম। তারপর শর্মার ঘরে আবার কিছুক্ষণ কথাবার্তা হল। আমার ঘুম পাচ্ছিল। নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লুম।
ভার্মা আমাকে ওঠাল যখন, তখন বিকেল সাড়ে চারটে। সে চাপা গলায় বলল, উঠে বসো, জয়ন্ত। কাঠগড়ায় যাওয়ার জন্যে তৈরি হও। এক্সপার্ট ব্যাটারা এসে গেছে।
সেই সময় চায়ের ট্রে আনল একজন বেয়ারা। এতক্ষণে ডক্টর রাজগোপালও এলেন। ঘরে ঢুকে বিনীতভাবে বললেন, আপনাদের নিশ্চয় খুব অস্বস্তি এবং অসুবিধের মধ্যে কাটাতে হচ্ছে। সে-জন্যে আমি খুবই দুঃখিত। ক্ষমা চাইছি। এমন পরিস্থিতি অপ্রত্যাশিত ছিল। যাই হোক, রুটিন তদন্ত হয়ে গেলেই আপনাদের ফেরার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে সেটা আজ রাতে সম্ভব নয়। আগামীকাল সকাল সাতটায় বিমানবাহিনীর প্লেনে আপনারা ফিরতে পারবেন।
ভার্মা বলল, খুব ভালো খবর। কিন্তু ডক্টর রাজগোপাল, আমাদের কাগজে ডেসপ্যাচ পাঠাতে দেওয়া হচ্ছে না। দিস ইজ সিরিয়াস।
ডক্টর রাজগোপাল বললেন, প্লিজ। বলেছি, অপ্রত্যাশিত অবস্থা। ক্ষমা করবেন—উপায় নেই।
আমি বললুম, আপনাদের ল্যাবরেটরি দেখাবার প্রোগ্রাম?
—দুঃখিত, মিস্টার চৌধুরী। সব প্রোগ্রাম বাতিল হয়েছে। যেজন্যে আপনাদের আনা হল, বর্তমান অবস্থায় সেটা আর কার্যকর করা যাচ্ছে না। সরকারের কঠোর নির্দেশ।
উনি শর্মাদের ঘরে গেলেন। ভার্মা এবং আমি চা খেতে-খেতে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছিলুম। হঠাৎ ভার্মা উঠে দক্ষিণের জানলায় গিয়ে বলল, দেখে যাও, জয়ন্ত। হ্রদে লঞ্চ ঢুকিয়েছে। আরে! ডুবুরি নামিয়েছে যে! ব্যাপার কী?
জানলার কাছে গিয়ে দেখি, নৌবাহিনীর লঞ্চ হ্রদের মাঝখানে ভেসে রয়েছে এবং সত্যি ডুবুরি নেমেছে। কতকটা অনুমান করতে পারছি, অনেকটাই পারছি না। নিশ্চয় জলের তলার সেই গোপন ল্যাবরেটরিতে কোনও গণ্ডগোল বেধেছে।
একটু পরে আমাদের ডাক এল নীচে।
রেস্টহাউসের ড্রয়িংরুমে আমাদের চারজন সাংবাদিককে বসতে বলা হল। বুঝলুম, অফিসের মধ্যে কাদের জেরা করা হচ্ছে। মিনিট-দশেক পরে প্রথম ডাক এল শর্মার। পাঁচ মিনিট পরে রাঘবনের। কিন্তু ওরা কেউ বেরুল না।
এর পর আমার ডাক এল। ভেতরে গিয়ে দেখি, বিরাট টেবিলের ওপাশে গোমড়ামুখো চারজন লোক বসে রয়েছেন। সবাই সিভিলিয়ান পোশাক পরা। এবং তাঁদের মধ্যিখানে বসে আছেন আমার বৃদ্ধ বন্ধু ও প্রখ্যাত ঘুঘু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
প্রশ্ন প্রত্যেকেই করলেন। আমি এখানে এসে যা-যা দেখেছি, সব বললুম। তারপর আমাকে পেছনের দিকে একটা সোফায় বসতে বলা হল। সেখানে শর্মা আর রাঘবন বসে আছে। অন্য পাশে কয়েকটা চেয়ার। সেখানে রেস্টহাউসের কয়েকজন কর্মী বসে আছে। শর্মা মুচকি হাসলেন। আমিও হাসলুম।
এবার ভার্মা এল। তার নামধাম পরিচয়পত্র ইত্যাদি আনুষ্ঠানিক ব্যাপার যথারীতি চুকে গেল। তারপর কর্নেল বললেন, মিস্টার ভার্মা, আপনি গত রাতে আন্দাজ দুটোর সময় কি বাইরে বেরিয়েছিলেন?
ভার্মা চমকে উঠল। তারপর একটু হেসে বলল, হ্যাঁ। বেরিয়েছিলুম।
—কেন বেরিয়েছিলেন, তার সদুত্তর নিশ্চয় পাব আশা করছি।
—পাবেন। আমার বিছানা থেকে পশ্চিমের জানলার বাইরে দেওয়ালের খানিকটা অংশ দেখা যায়। নতুন জায়গায় ঘুম ডিস্টার্বড হয়। রাত দুটো নাগাদ হঠাৎ ঘুম ভেঙে তাকাতেই দেওয়ালের ওই জায়গায় দেখলুম, আলো পড়ল এবং নিভে গেল। আমি একজন সাংবাদিক। সব ব্যাপারে আমার কৌতূহল আছে। গাড়ির শব্দ নেই—অথচ অমন জোরালো আলো পড়ার কারণ কী? তাই বেরিয়ে গেলুম। কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিন্তু বাইরে তেমন কিছু দেখলুম না। তখন ঘরে এসে শুয়ে পড়লুম।
—তখন বারান্দা নিশ্চয় অন্ধকার ছিল না?
—ছিল। তাই একটু অবাকও হয়েছিলুম।
—সর্দারজির ঘরের দিকে তাকিয়েছিলেন কি?
—না। তবে…।
—তবে?
—ওদিকে দরজা খোলার শব্দ—মানে আবছা শব্দ শুনেছিলুম, মনে পড়ছে। তবে অতটা খেয়াল করিনি। ভীষণ জোরে বাতাস বইছিল। আর হ্যাঁ, শুয়ে পড়ার পর বাইরে সিঁড়িতে কে নেমে গেল মনে হচ্ছিল।
—আপনি সমুদ্রবিজ্ঞান ভবনে কীসব কাজকর্ম হচ্ছে, জানেন নিশ্চয়?
—জানি না। অনুমান করি, নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু হচ্ছে। তা না হলে আমাদের আনা হল কেন?
—আপনার অনুমান সম্পর্কে কিছু জানাবেন কি?
ভার্মা একটু চুপ করে কী যেন ভাবল। তারপর বলল, শুনেছি, শুশুকের ওপর কী সব পরীক্ষা করে ডক্টর রাজগোপাল সফল হয়েছেন। জাস্ট শোনা কথা।
—কোথায় শুনলেন?
—কিছুদিন আগে বোম্বাই সমুদ্রবিজ্ঞান ভবনে গিয়েছিলুম। সেখানেই ডক্টর কার্নিকার কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন। অবশ্য উনিও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি।
—সর্দারজির সঙ্গে আপনার কতদিনের আলাপ?
—মাত্র গতকাল। মারগাঁও বিমানঘাঁটিতে। তবে ওঁর নাম শুনেছিলুম আগে।
কর্নেল একটা ছবি এগিয়ে দিয়ে বললেন, এঁকে চেনেন নাকি দেখুন তো?
ভার্মা বলল, না। কে ইনি?
সে-কথার জবাব না দিয়ে কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। আপনি প্লিজ আপনার বন্ধুদের কাছে গিয়ে বসুন।
ভার্মা গম্ভীর মুখে আমাদের কাছে এসে বসে পড়ল। ওখানে ডাক পড়ল আবার কার। একটু পরে দেখলুম, এক বেঁটে ভদ্রলোক, কালো কুচকুচে, প্রকাণ্ড শরীর—হাসিমুখে ঢুকে নমস্কার করে বসলেন।
কর্নেল বললেন, আপনার নাম ডক্টর সত্যকাম আচার্য? অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—আপনি গতকাল এখানে ছিলেন না শুনলুম।
—হ্যাঁ। বোম্বে গিয়েছিলুম পরশু বিকেলে। ফিরেছি একটু আগে। তারপর…।
—কিন্তু আমার যদি চোখের ভুল না হয়, তাহলে বলব, গতকাল সন্ধ্যায় আপনি সি-বিচে ওপেন এয়ার রেস্তোরাঁয় বসে একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
মিস্টার আচার্য লাফিয়ে উঠে বললেন, অসম্ভব। আপনি ভুলই দেখেছেন।
কর্নেল টেবিলে রাখা খাম থেকে একটা ছবি বের করে বললেন, তাহলে এ-ছবি কার?
মিস্টার আচার্যের চেহারা আরও কালো হয়ে গেল। হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন।
কর্নেল বললেন, আমার একটা বিচিত্র ধরনের ক্যামেরা আছে। অন্ধকার বা আলোর ধার ধারে না। এর ইলেকট্রনিক সিস্টেম অদ্ভুত। দরকার মতো অদৃশ্য আলো কোনও জিনিসের ওপর ফেলে তার ছবি তোলা যায়। গতকাল আমি আপনার কাছাকাছি বসেছিলুম, মিস্টার আচার্য।
ভদ্রলোক একটি কথাও বললেন না। কর্নেলের ডানপাশের ভদ্রলোক টেবিলের একটা বোতাম টিপলেন। একজন পুলিশ অফিসার ঢুকলেন।
—ডক্টর আচার্য, আপনাকে আমরা গ্রেফতার করলুম। আপনার বিরুদ্ধে সরকারের অভিযোগ, আপনি বিজ্ঞানভবনের ল্যাবরেটরি ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। সেইসঙ্গে একটি দেশকে আমাদের মূল্যবান একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফরমুলা পাচারের ষড়যন্ত্র করেছিলেন। ‘দৈনিক পাঞ্জাব নিউজ’-এর সাংবাদিক সর্দার শোভন সিংকে বেআইনিভাবে বোম্বেতে আটকে রেখে একজন জাল সাংবাদিক পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই জাল সাংবাদিক আর কেউ নয়—কুখ্যাত অপরাধী সুন্দরলাল।
এবার ডক্টর আচার্য বিকট হেসে উঠলেন। বললেন, কিস্যু প্রমাণ করতে পারবেন না।
কর্নেল বললেন, প্রমাণ জেলে-বস্তির ডুবুরি রঘুরাম। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হ্রদের তলায় ল্যাবরেটরির দেওয়ালে ডিনামাইট বেঁধে রেখে এসেছিল সে—আপনার নির্দেশে। সর্দারজি-বেশী সুন্দরলালের ওপর দায়িত্ব ছিল, সে হ্রদের ধারে পাথরের তলা থেকে তারদুটো খুঁজে বের করবে এবং সুযোগমতো নেগেটিভ-পজিটিভ জুড়ে দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাবে। কিন্তু আমি মাছ ধরতে গিয়ে তারদুটো দেখতে পেয়েছিলুম। তারদুটো অন্য জায়গায় সরিয়ে রাখার ফলে সুন্দরলাল গত রাত্রে খুঁজে পায়নি। এই খবর সে আপনাকে পাঠায় রেস্টহাউসের বেয়ারা সুলতানের মারফত। সুলতান কবুল করেছে সে-কথা। যখন আপনি খবর পেলেন, তার ঠিক জায়গায় নেই—তখনই টের পেলেন, যেভাবে হোক, ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেছে। সুলতানের হাতে বিষবড়ি পাঠালেন। সুন্দরলাল ইদানীং হার্টের অসুখে ভুগছিল। সুলতান সুন্দরলালের জলের গেলাসে বিষবড়িটি ফেলে দিয়েছিল। আরও বলব? ডুবুরি রঘুরামকেও আপনি হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে ভাগ্যক্রমে গভীর সমুদ্রে জেলেদের সঙ্গে মাছ ধরতে গিয়েছিল। আরও জানতে চান?
সি-ভিউ হোটেলে ফেরার পথে কর্নেল বললেন, তোমার বন্ধুরা চলে যাক, জয়ন্ত। তুমি এই বুড়োকে সঙ্গ দাও। আমরা দুজনে এই দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করি। হ্রদের জলে প্রচুর মাছ। মাছ ধরি। কী? রাজি তো?
বললুম, আপনি সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে বললেও রাজি।
অপরাধ
পুজো সংখ্যা, ১৯৭৭