শুভানুধ্যায়ী

শুভানুধ্যায়ী

কতরকমের মানুষই না আছেন। যত মত তত পথের মতো, যত মানুষ তত রকম। রকম রকম। তা তো হবেই। কত রকমের সবজি, ফুল, ফল, গাছপালা, কীটপতঙ্গ, মানুষ কেন রকমরকম হবে না!

এক ধরনের মানুষ আছেন অভিভাবক টাইপ।

বাজার করে ফিরছি, পথে দেখা, ‘এই যে আছ কেমন? একটু যেন রোগা হয়েছ?’

—আজ্ঞে, তা বয়েস হয়েছে, তা ছাড়া কত রকমের টেনসান?

—না, না, ও ব্যাখ্যা শুনব। না। জীবন মানেই টেনসান। টেনসান কার নেই, একমাত্র পাগল ছাড়া। এই যে কথা বলছি, আর ওই যে লরিটা আসছে, ব্রেক ফেল করে, কি টাইরড কেটে ঘাড়ে উঠে পড়তে পারে। কী মনে করো, তোমার ওই ব্যাগের একটা হাতল ছিঁড়ে সব বাজার রাস্তায় পড়ে যেতে পারে। ছাতের আলসে থেকে একটা থান ইট আমাদের মাথায় পড়তে পারে। নিদেন একটা কাক আমার এই গেরুয়া পাঞ্জাবিটা নষ্ট করে দিতে পারে। তুমি বাড়ি ফিরে দেখতে পারো গ্যাসের সিলিন্ডার ফেটে গেছে। ওই যে কুকরটা শুয়ে আছে, গাড়ির চাকা থেকে একটা ইট ঠিকরে এসে লাগতে পারে, কুকুরটা ঘ্যাঁক করে আমাদের পায়ে কামড়াতে পারে। ছেলে পরীক্ষা দিয়েছে, খাতা দেখার কারসাজিতে ফেল করতে পারে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছ ডিভোর্স হয়ে যেতে পারে। স্ত্রীর ব্রেস্ট ক্যানসার হতে পারে। তোমার নাতনি বারান্দায় ঝুঁকে রাস্তা দেখছে, ডিগবাজি খেয়ে উলটে পড়ে যেতে পারে। ওষুধের শিশির সিল খুলতে গিয়ে আঙুলে টিনের খোঁচা লেগে তোমার টিটেনাস হতে পারে। পৃথিবীটা কী সহজ জায়গা ভাই। টেনসান নয়, তোমার সুগার হয়েছে। এখন হল কত? সে যাই হোক ফর্টি ক্রস করেছে। অ্যায়, দিস ইস রাইট এজ ফর সুগার। আজই।

—আজ্ঞে, আজই মানে?

—মানে আজই ব্লাড টেস্ট করাবে ফর সুগার। কয়টায় খাওয়া হবে?

—তা ধরুন একটায়।

—ধরাধরি নয়, একটার সময় খাবেই খাবে। আমি উদয়কে পাঠিয়ে দেবো। ঠিক তিনটের সময়, ব্লাড নিয়ে যাবে। মোস্ট রিলায়েবল ল্যাবরেটরি। এসব আবোলতাবোল জায়গা থেকে কখনও করাবে না। আমার একবার কী হয়েছিল জানো, রিপোর্ট এল, লেখা রয়েছে প্রেগন্যান্ট! একমাত্র যুবনাশ্ব। যুবনাশ্ব ছাড়া কোনও পুরুষ প্রেগন্যান্ট হয়নি। কী ব্যাপার! উই আর সরি স্যার। প্রীতি বোস নমে দুটো স্যাম্পল ছিল, আমি ছেলে, সে মেয়ে। উদোরপিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। রিপোর্ট দেখে প্রথমে আমার বউয়ের খুব আনন্দ হয়েছিল। পৌরানিক যুগ ফিরে এল। কাগজে তোমার নাম বেরোবে। সবাই দেখতে আসবে। একশো টাকা টিকিট। দুটো শো দোব, ম্যাটিনি আর ইভনিং। গিনেসবুকে নাম বেরোবে। আমরা অ্যামেরিকা যাব। দেখেছ! তুমি যাকে ভুঁড়ি বলতে, সেটা ভুঁড়ি নয়। তাই বলি, মদ খাও না, ভুঁড়ি এল কোত্থেকে! এইবার বুঝবে, মা হওয়া কী মুখের কথা, কিন্তু সমস্যা একটাই, ছেলেই হোক মেয়েই হোক। সে তোমাকে বাবা বলবে, না মা বলবে!

—কত দিন আগের ঘটনা?

—সে আমার মধ্য যৌবনের ঘটনা। সে ল্যাবরেটারি পটল তুলেছে।

—মাইকেল জ্যাকসানের নাম শুনেছেন?

—মুম্বাইতে যে নেচে গেল?

—বলুন তো ছেলে না মেয়ে!

—না, ওসব খবর আমি রাখি না। আমি এখন তোমাকে নিয়ে চিন্তিত। লাস্ট মানথে তোমাকে যা দেখেছি, আজ তুমি তার হাফ। কেন? উই মাস্ট ইনভেস্টিগেট। যদি সুগার হয়েই থাকে। আহা থাকে কেন, ধরো হয়েইছে। হয়েছে, হয়েছে। সো হোয়াট। আমার কাছে জামকাঠের জামবাটি আছে, তোমাকে লোন দোব। রাতভর জল রেখে সকালে খালিপেটে চোঁ চোঁ করে মেরে দেবে। শোনো, শোনো এ হল ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের যুগ। বিজনেস ম্যানেজমেন্টের মতোই সুগার ম্যানেজমেন্ট। ব্যাপারটাকে কন্ট্রোলে রাখতে হবে। থেকে থেকে ব্লাডটেস্ট আর স্ট্রিক্ট কন্ট্রোল ওভার খাওয়া। স্বামীজি কী বলে গেছেন?

—বলে গেছেন, যতদিন ভারতের কোটি-কোটি লোক দারিদ্র্য ও অজ্ঞানান্ধকারে ডুবে রয়েছে, ততদিন তাদের পয়সার শিক্ষিত অথচ যারা তাদের দিকে চেয়েও দেখছে না, এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে আমি দেশদ্রোহী বলে মনে করি। যতদিন ভারতের বিশ কোটি লোক ক্ষুধার্ত পশুর মতো থাকবে, ততদিন যেসব বড়লোক তাদের পিষে টাকা রোজগার করে জাঁকজমক করে বেড়াচ্ছে অথচ তাদের জন্য কিছু করছে না, আমি তাদের হতভাগা পামর বলি।

—যা:, কোথা থেকে কোথায় গেলে, ওই একটাই বুঝি মনে আছে! হচ্ছে কথা ডায়াবিটিসের। স্বামীজি পরিস্কার বলছেন, ময়রার দোকান যমের বাড়ি। তোমাদের ফ্যামিলিতে বেশ্যাগমনের মতো ময়রাগমনের ব্যাড হ্যাবিট আমি লক্ষ করেছি। তোমার দাদু পান্তুয়া খেয়ে খেয়ে উদুরিতে মারা গেলেন। তোমার বাবা গেলেন ক্ষীরমোহনে, তুমি যাবে কমলাভোগে। আমি প্রায়ই দেখি, তুমি মধুর দোকানের দরজার আড়ালে ঘোমটাটানা কুলবধূর মতো গপাগপ কমলাভোগ সাঁটাচ্ছ। তোমাদের ফ্যামিলিতে লুচি, আলুভাজার ভয়ানক উৎপাত। খাস্তা কচুরির নামে তোমাদের বোম্বাই নাচ শুরু হয়। কাপুরুষদের কথা তো অনেক শুনলে, মহাপুরুষদের কথায় কান দিয়ে দেখো না। স্বামীজি কী বলছেন!

—জ্যাঠামশাই একটু তাড়া ছিল আজ।

—সেই কেস, দাদা, পাইলে আয় মাস্টার শালা অঙ্ক শেখাচ্ছে। করো তো সরকারি চাকরি! বারোটায় হাজিরা, সারাদিন, হয় ক্রিকেট, না হয় ফুটবলের আলোচনা, আর না হয় নরসিংহ, আই টি সি ক্ল্যাসিক। কাজের কথাটা শুনে যাও। দাঁত ছিরকুটে পড়লে কে দেখবে তোমাকে। স্বামীজি বলছেন, ‘খিদে পেলেও কচুরিও জিলিপি খানায় ফেলে দিয়ে এক পয়সার মুড়ি কিনে খাও, —সস্তাও হবে, কিছু খাওয়াও হবে।’

—তা হলে আসি!

—না, এখনও হয়নি। একটি প্রসঙ্গ ধরলে, সেটাকে শেষ না করে ছাড়া উচিত নয়। এইজন্যেই একালের বাঙালির কিছু হল না। যা হয়ে গেছে সব সেকালে, আমাদের কালে। ঈশ্বরচন্দ্র ধরলেন, বিধবা-বিবাহ দিয়ে তবে ছাড়লেন। রবীন্দ্রনাথ ধরলেন কবিতা। শেষের কবিতা লিখে কলম বিসর্জন। মাইকেল বললেন, বাংলা শিখব, মেঘনাদবধ লিখেই ছাড়লেন, কত উদাহরণ তোমাকে দোব। সাধারণ একটা ব্যাপার দ্যাখো—বিয়ে। আমাদের কালে গাঁটছড়া বাঁধলুম। একজন আর একজনকে ধরলুম। যতদিন না মরছে ততদিন ধরেই রইল। সে যেমনই হোক। তোমাদের কালে, ধরছ, ছাড়ছ। মহীতোষের মেয়ের তিরিশ বছরে দুটো বিয়ে হয়ে গেল।

—জ্যাঠামশাই! আমার তো সুগার এখনও হয়নি!

—তোমার চেহারা, চুল, চোখ বলছে হয়েছে। কতটা হয়েছে, সেটা জানা যাবে কাল! এখন কথা হল, সেটাকে কন্ট্রোলে রাখতে হবে। এ সম্পর্কে স্বামীজি কী বলছেন :

ওই যে এত প্রস্রাবের রোগের ধুম দেশে, ওর অধিকাংশই অজীর্ণ, দু-চার জনের মাথা ঘামিয়ে, বাকি সব বদহজম। পেটে পুরলেই কি খাওয়া হল? যেটুকু হজম হবে, সেইটুকুই খাওয়া। ভুঁড়ি নাবা বদহজমের প্রথম চিহ্ন। শুকিয়ে যাওয়া বা মোটা হওয়া দুটোই বদহজম। পায়ের মাংস লোহার মতো শক্ত হওয়া চাই। প্রস্রাবে চিনি বা আলবুমেন দেখা দিয়েছে বলেই ‘হাঁ’ করে বাসো না। ওসব আমাদের দেশের কিছুই নয়। ও গ্রাহ্যের মধ্যেই এনো না। খাওয়ার দিকে খুব নজর দাও, অজীর্ণ না হতে পায়। ফাঁকা হাওয়ায় যতক্ষণ সম্ভব থাকবে। খুব হাঁটো আর পরিশ্রম করো। যেমন করে পারো ছুটি নাও, আর বদরিকাশ্রম তীর্থযাত্রা করো। হরিদ্বার থেকে পায়ে হেঁটে একশো ক্রোশ ঠেলে পাহাড় চড়াই করে বদরিকাশ্রম যাওয়া আসা একবার হলেই ও প্রসাবের ব্যারাম-ফ্যারাম ভূত ভাগবে। ডাক্তার-ফাক্তার কাছে আসতে দিও না, ওরা অধিকাংশ—’ভাল করতে পারব না, মন্দ করব, কি দিবি তা বল।’ পারতপক্ষে ওষুধ খেও না। রোগে যদি এক আনা মরে, ওষুধে মরে পনেরো আনা। এই হল কথা! সুগার যখন হয়েছে, হতে দাও। সুগারেরও যম আছে। যমের যমকে এক কথায় কী বলে!

—আজ্ঞে! জানা নেই।

—জামাই। সুগারের যম হন্টন। রোজ হেঁটে অফিস যাবে হেঁটে বাড়ি ফিরবে। বিরাট ব্যাগে এত কী বাজার?

—বেশিটাই আলু। একেবারে পাঁচ কেজি ফেলে দি হেঁসেলে। কিছু না হোক, ডাল, ভাত, আলুভাজা।

—একে আলু, তায় ভাজা, একা রামে রক্ষা নাই, দোসর লক্ষ্মণ। এই আলু খেকো বাঙালির সুগার ফ্যাকট্রি হবে না তো কী স্টিলফ্যাকট্রি হবে। যাও আলু ফেরত দিয়ে পেঁপে-কাঁচকলা কিনে আনো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *