শুধু তোমাকেই চাই
যদি তুমি এই ভেবে থাক, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ করছ বলে তোমাকে আমি সিংহাসনে বসিয়ে দেব, কালিয়া-কোপ্তা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব, এয়ারকণ্ডিশন্ড গাড়ি কিনে দেব, তোমার শরীরে যেখানে যত যান্ত্রিক গোলযোগ আছে, মাঝরাত্তিরে মেকানিক হয়ে ঢুকে সব ঠিক করে দেব, তাহলে তুমি কিন্তু বাপু মস্ত ভুল করবে।
কেন জান? তোমার প্রারব্ধ তোমারই। তোমাকেই ক্ষয় করে যেতে হবে। ঝোলায় ভরে কি এনেছ, তুমি জান না। ক্রমশ প্রকাশ পাবে। খোদ মালিক তোমার জন্য যেমন যেমন ব্যবস্থা করে রেখেছেন সেরকমই হবে।
তুলসীদাস বলছেন :
“রাম ঝরোখে বয়েঠ কর সবকো মুজরা লে।
জ্যায়সা যাকে গকরি, অ্যায়সা উকো দে।।”
–ঐ দেখ, অনেক উঁচুতে গগনের গবাক্ষে বসে আছেন শ্রীরামচন্দ্র। দিবসরজনী মানুষকে দেখছেন। কে কি করছে! কাজ অনুসারে পুরস্কার অথবা তিরস্কার।
কখনো কি ভেবেছ, আবার আসতে হবে? পুনঃপুনঃ গতাগতি। যেই শেষ হলো আবার শুরু। সাপলুডো। এক চালে নেমে এলে লেজে। আবার দান ফেলা। ধাপে ধাপে ওঠা। যতক্ষণ ছকে আছ, এই চলবে। ছকের বাইরে যাও, খেলা শেষ। তোমার কর্মের দিকে, তোমার মর্মের দিকে কি নজর রেখেছ! ‘হাম্বা, হাম্বা’ করেছ সারাটা জীবন। অহঙ্কারের একতারা বাজিয়েছ। মরণে কে তোমাকে মুক্তি দেবে! কসাই টানতে টানতে নিয়ে যাবে। কাটবে। নাড়ি-ভুঁড়ি বের করে শুকোবে। তখন তুমি চড়বে গিয়ে একতারায়। বাউলের আঙুলে খেলবে। তখন বলবে, ‘তুঁহু, তুঁহু’। যদি তুমি অহং-এর খাঁচায় বসে ‘তুঁহু’ বলতে পারতে তাহলে মরণ টপকে অমৃতের হ্রদে গিয়ে পড়তে। পুনর্জন্মের ভয় থাকত না। আর যদি আবার ফিরেও আসতে তাহলে নিত্যসিদ্ধের থাকের মানুষ হতে। সংসারের জালে পড়তে না আর।
তোমার এজীবনের সংস্কারে ভক্তি থাকতে পারে, থাকতে পারে প্রবল ঈশ্বরবিশ্বাস। তার মানে এই নয়, উত্তরোত্তর তোমার জীবন ধনে, মানে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। এটা আর ওটাকে এক করে ফেললে একুল, ওকূল দু-কূলই যাবে।
ঠাকুর তাঁর নিজের ঘরটিতে বসে আছেন। আগস্টের মাঝামাঝি। ১৮৮৩ সাল। কলকাতা তখন সরগরম। মাত্র কয়েকদিন আগে ৬৮নং বিডন স্ট্রীটে গুরমুখ রায়ের স্টার থিয়েটারের উদ্বোধন হলো। অভিনীত হলো গিরিশচন্দ্রের ‘দক্ষযজ্ঞ’। ম্যানেজার স্বয়ং গিরিশচন্দ্র। বিনোদিনীর নামানুসারে ‘বি-থিয়েটার’ নাম হওয়ার কথা ছিল। স্টার কোম্পানির চক্রান্তে তা আর হলো না।
অন্যদিকে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অত্যন্ত তৎপর। ভৈরব ব্যানার্জী, সুরেন ব্যানার্জী ন্যাশনাল ফান্ড তৈরির জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। বরানগরের প্রেমচাঁদ মল্লিকের বাগানবাড়ি নেতাদের মিলনকেন্দ্ৰ।
কিন্তু দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে ঠাকুরকে ঘিরে চলেছে অন্য আন্দোলন। বাইরে এক জগৎ, ভিতরে আরেক জগৎ। ঠাকুরকে ঘিরে বসে আছেন অধর সেন, বলরাম বসু, মাস্টারমশাই। বেলা প্রায় তিনটে। বর্ষাকালে ভ্যাপসা গরম। কারো গ্রাহ্যই নেই। ঠাকুর সব ভুলিয়ে দিয়েছেন। কথায় কথায় সিংহবাহিনীর প্রসঙ্গ এসে পড়েছে।
বড়বাজারে মল্লিকদের সিংহবাহিনী ঠাকুর দেখে এসেছেন। আবার চাষা- ধোপাপাড়ার জনৈক মল্লিকদের সিংহবাহিনীও ঠাকুর দেখে এসেছেন। বড়বাজারের মল্লিকদের খুব অবস্থা। আবার চাষা-ধোপাপাড়ার মল্লিকরা গরিব হয়ে গেছে। পোড়ো বাড়ি, এখানে পায়রার গু, ওখানে শেওলা, এখানে ঝুরঝুর করে বালি-সুরকি পড়ছে। বাড়ির সেই শ্রী নেই।
উভয়েই উপাসক। একজনের বৈভব উপচে পড়ছে, আরেক জনের পতন হচ্ছে।
ঠাকুর মাস্টারমশাইকে প্রশ্ন করছেন : “আচ্ছা, এর মানে কি বল দেখি?” মাস্টারমশাই নিরুত্তর।
ঠাকুর তখন নিজেই ব্যাখ্যা করছেন : “কি জান, যার যা কর্মের ভোগ আছে, তা তার করতে হয়। সংস্কার, প্রারব্ধ—এসব মানতে হয়।’
কর্মফলের কথা গীতায় শ্রীভগবান এইভাবে বলছেন :
“ভূতগ্রামঃ স এবায়ং ভূত্বা ভূত্বা প্রলীয়তে।
রাত্র্যাগমেহবশঃ পার্থ প্রভবত্যহরাগমে।।” (গীতা, ৮।১৯)
জীবচরাচরের জন্ম ও মৃত্যুকে বিশালের পটে স্থাপন করলেন ভগবান। তুমি কে? যেই সূর্য উঠল, তুমি বললে দিন। যেই সূর্য অস্ত গেল, বললে রাত। এ তো তোমার দিন-রাত। সেই অর্থে ‘দিন-রাত’ বলে কিছু নেই। অর্জুন! তুমি স্রষ্টার দিকে তাকাও। ব্রহ্মার দিন, ব্রহ্মার রাত জীবের দিন-রাত নয়।
মানুষের গণনায় সহস্রচতুর্যুগ পর্যন্ত ব্রহ্মার যে একটি দিন এবং সহস্ৰচতুর্যুগ পর্যন্ত তাঁর যে একটি রাত্রি—এই তত্ত্বজ্ঞান যাঁর হয়েছে, তিনিই দিবারাত্রের প্রকৃত তত্ত্ববেত্তা। এইবার শোন পার্থ, ব্রহ্মার দিনাগমে অব্যক্ত কারণে এই চরাচরের আবির্ভাব, আবির্ভাব জীবগণের। আবার ব্রহ্মার রাত্রিসমাগমে সেই অব্যক্ত নামক মূল কারণেই সবকিছুর লয়। আরো আছে পার্থ! ঐ প্ৰথমে যা বলেছি—”ভূতগ্রামঃ স এবায়ং” ইত্যাদি। সেই প্রাণিগণই—পূর্ব পূর্ব কল্পে যারা ছিল কর্মফলের বশে—বারে বারে আসে, ব্রহ্মার রাত্রিসমাগমে প্রলীন হয়। আবার ব্রহ্মার দিবাসমাগমে নিজ নিজ কর্মের ফলস্বরূপ প্রাদুর্ভূত হয়। ব্ৰহ্মই এই ব্রহ্মাণ্ডের কারণ, একমাত্র কারণ।
তবে? ঠাকুর বলছেন, দুই উপাসকের দুরকম বৈষয়িক অবস্থা হলেও উপাসনার প্রভাব দেবীর মুখে ফুটেছে। “পোড়ো বাড়িতে দেখলুম যে, সেখানেও সিংহবাহিনীর মুখের ভাব জ্বলজ্বল করছে। আবির্ভাব মানতে হয়।”
দুটোকে জড়িয়ে ফেলো না—ধর্ম আর বিষয়। ধর্মাচরণের পাওনা অন্যরকম। অনুভূতিতে খেলা করে। তথ্য থেকে তত্ত্বে নিয়ে যায়। ভোগের সঙ্গে দুর্ভোগ আছে। দুটোর পারে যাও। তখন বাড়িও যা, পোড়ো বাড়িও তা। সম্পর্ক দেবীর সঙ্গে, সাধনার সঙ্গে। ভূমি আর ভূমা এক করে ফেলো না।
একে একে আরো অনেকে এসে গেছেন ঘরে। ঠাকুরকে ঘিরে বসেছেন সবাই। বৈঠক পরিপূর্ণ। বাইরে ভরা বিকেল। মেঘের ফাঁকফোকরে অস্তে নামা সূর্যের গোল মুখখানি। বর্ষার গঙ্গা ভরভরন্ত। ঠাকুর নিজের অভিজ্ঞতার কথা, অনুভূতির কথা বলছেন :
“আমি একবার বিষ্ণুপুরে গিছিলুম। রাজার বেশ সব ঠাকুরবাড়ি আছে। সেখানে ভগবতীর মূর্তি আছে, নাম মৃন্ময়ী। ঠাকুরবাড়ির কাছে বড় দীঘি। কৃষ্ণবাঁধ, লালবাঁধ। আচ্ছা, দীঘিতে আবাঠার (মাথাঘষার প্রসাধনী) গন্ধ পেলুম কেন বল দেখি? আমি তো জানতুম না যে, মেয়েরা মৃন্ময়ীদর্শনের সময় আবাঠা তাঁকে দেয়। আর দীঘির কাছে আমার ভাবসমাধি হলো, তখন বিগ্ৰহ দেখি নাই। আবেশে সেই দীঘির কাছে মৃন্ময়ীদর্শন হলো—কোমর পর্যন্ত।”
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতে ঠাকুর ধ্যানস্থ। সেই ভাবটি কেটে যেতেই ঘুরে এল ভক্তের সুখ-দুঃখের প্রসঙ্গ। তুমি ভক্ত বলে কেবল সুখের অধিকারী হবে—এ কেমন কথা! সুগন্ধী গরমমশলায় সব মশলাই থাকবে। কাঁঠালে রসাল কোয়ার সঙ্গে আঠাও থাকবে।
একজন কাবুলের রাজবিপ্লব ও যুদ্ধের প্রসঙ্গ পাড়লেন। ইয়াকুব খাঁ সিংহাসনচ্যুত, অথচ তিনি শুধু রাজা ছিলেন না, পরম ভক্তও ছিলেন। কেন এমন হলো! ভক্তের এই দুর্ভাগ্য কেন? ঠাকুর বললেন : “কি জান, সুখ-দুঃখ দেহধারণের ধর্ম। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে যে, কালুবীর জেলে গিছিল। তার বুকে পাষাণ দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কালুবীর ভগবতীর বরপুত্র। দেহধারণ করলেই সুখ-দুঃখ ভোগ আছে।
“আবার শোন, শ্রীমন্ত বড় ভক্ত। আর তার মা খুলনাকে ভগবতী কত ভালবাসতেন। সেই শ্রীমন্তের কত বিপদ। মশানে কাটতে নিয়ে গিছিল
“একজন কাঠুরে পরমভক্ত, ভগবতীর দর্শন পেলে; তিনি কত ভালবাসলেন, কত কৃপা করলেন। কিন্তু তার কাঠুরের কাজ আর ঘুচল না। সেই কাঠ কেটে আবার খেতে হবে। কারাগারে চতুর্ভুজ শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী ভগবান দেবকীর দর্শন হলো। কিন্তু কারাগার ঘুচল না। কি জান, প্রারব্ধ কর্মের ভোগ। যে কদিন ভোগ আছে, দেহধারণ করতে হয়। একজন কানা গঙ্গাস্নান করলে। পাপ সব ঘুচে গেল। কিন্তু কানাচোখ আর ঘুচল না। পূর্বজন্মের কর্ম ছিল তাই ভোগ।”
তাহলে কি পেলে! “দেহের সুখ-দুঃখ যাই হোক, ভক্তের জ্ঞান, ভক্তির ঐশ্বর্য থাকে, সে-ঐশ্বর্য কখনো যাবার নয়। দেখ না, পাণ্ডবদের অত বিপদ! কিন্তু এ-বিপদে তারা চৈতন্য একবারও হারায় নাই। তাদের মতো জ্ঞানী, তাদের মতো ভক্ত কোথায়?”
শ্রীভগবান বলছেন, ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে নিষ্কাম যজ্ঞই অনুষ্ঠেয়, অর্থাৎ শুধুমাত্র বিষ্ণুপ্রীত্যর্থে যজ্ঞ। মন সেখানে স্থির-নিবাত, নিষ্কম্প দীপশিখা। বাসনার লেশমাত্র থাকবে না-
“অফলাকাঙ্ক্ষিভির্যজ্ঞো বিধিদৃষ্টো য ইজ্যতে।
যষ্টব্যমেবেতি মনঃ সমাধায় স সাত্ত্বিকঃ।।” (গীতা, ১৭।১১ )
আর কোন কথা নয়। ঐ যে গজরাজের মতো ঘরে প্রবেশ করছেন নরেন্দ্রনাথ, সঙ্গে রয়েছেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়, ঠাকুর যাঁকে বলেন ‘কাপ্তেন’। “নরেন এসেছিস! তাহলে গান গা।” দেওয়ালে ঝুলছিল তানপুরা। নেমে এল আসরে। বাঁয়া-তবলা সুরে বাঁধা হচ্ছে। নরেন্দ্রনাথ একটু পরেই ধরবেন— “সত্যং শিব সুন্দর রূপ ভাতি হৃদিমন্দিরে।”