শীতল ষষ্ঠীর কথা
এক দেশে এক ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী বাস করতেন। ব্রাহ্মণের এক ছেলে ও একটি বউ; বউয়ের ছেলেপুলে কিছুই হল না। সেই জন্যে তাঁরা দিন রাত মা ষষ্ঠীর কাছে প্রার্থনা করেন—‘হে মা ষষ্ঠী, বউমার যেন একটি ছেলে হয়।’ শেষে মা ষষ্ঠীর দয়াতে বউয়ের গর্ভ হল। ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণীর আর আহ্লাদের সীমা নেই। গর্ভটি খুব বড়ো হল। এক বৎসর গেল তবুও ছেলে হল না। একদিন বউটি খেয়ে দেয়ে ঘাটে মুখ ধুতে গেছে, এমন সময় হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গিয়ে একটি লাউয়ের মতো থলে প্রসব করলে। বউটি বাড়ি গিয়ে শাশুড়িকে সব বললে। শাশুড়ি ঘাটে গিয়ে দেখেন যে একটা কাকে সেই থলেটা ছিঁড়ে ফেলেছে, আর কতকগুলো ছোটো ছেলে তার ভিতর কিলবিল করছে। এই না দেখে ব্রাহ্মণী বাড়ি গিয়ে কর্তাকে ডেকে নিয়ে এলেন। কর্তা আহ্লাদ করে সেই থলেটি বাড়ি নিয়ে গেলেন। গুণে দেখলেন যে ষাটটি ছেলে। তখন আঁতুড়-ঘর বাঁধা হল, দাই এল, সেঁক-তাপ হল, ব্রাহ্মণ ঘটা করে ষেটেরা পুজো করলেন। তার পর ষষ্ঠী পুজো করে বউকে নাইয়ে ধুইয়ে ঘরে তুললেন। ক্রমে ছেলেগুলি বড়ো হল, ঘরে আর ধরে না।
ব্রাহ্মণী কর্তাকে বললেন, মা ষষ্ঠীর কৃপায় ষেটের ষাটটি ছেলে হয়েছে, এখন ছেলেদের জন্যে ষাটটি ঘর করো। কর্তা ঘর করতে আরম্ভ করলেন। এদিকে ছেলেগুলি বড়ো হল, লেখা-পড়া শিখলে, ক্রমে পৈতে হল। তারপর ঘর হলে যে যার ঘর দখল করলে। কর্তা গিন্নির ভারি আহ্লাদ, বড়ো বাড়ি হল, ষাটটি নাতি হল, এখন তাদের নিয়ে বেশ মনের আনন্দে তাঁরা কাল কাটাতে লাগলেন।
একদিন ছেলে বললে, ‘মা, যেমন আমাদের ছেলে ছিল না, তেমনি মা ষষ্ঠী একেবারে এক ঘর ছেলে দিয়েছেন। এরা বড়ো হয়েছে, এখন আবার এদের বিয়ে দিলে আর এ বাড়িতে জায়গা হবে না, তাই ভাবছি কী হবে—এদের আর বিয়ে দেব না।’ তখন মা বললেন, ‘সে কিরে, তা হলে যে বংশ লোপ হবে, বিয়ে না দিলে কি হয়!’ তখন বউ এসে বললে, ‘মা, যদি বিয়ে দিতে হয়, তা হলে যে ঘরে একেবারে ষাটটি মেয়ে পাওয়া যাবে, সেই ঘরে আমার ছেলেদের বিয়ে দেব, তা নইলে বিয়ে দেব না।’ ব্রাহ্মণী বল্লেন, ‘তবেই হয়েছে, তোমার মতো কে মা ষাটটি মেয়ে বিইয়ে বসে আছে যে, তোমার ছেলেদের বিয়ে হবে! দুজনে বুঝি বসে বসে এই মতলব করেছ?’ ছেলে বললে, ‘সেই বেশ কথা মা, একেবারে ষাটটি মেয়ে চাই, তা নইলে বিয়ে হবে না।’
রোজ এই রকম নানা কথা হয়, ক্রমে ছেলেগুলি বিয়ের যুগ্যি হল। তখন গিন্নি কর্তাকে বললেন, ‘নাতিরা যে ডাগর হয়ে উঠল, বিয়ে থা দাও। খালি ঘরে বসে থাকলে চলবে কেন, মেয়ে খোঁজ। বউমা আবার কোট ধরেছেন, যে আমার মতো ষাটটি মেয়ে প্রসব করেছে, তার মেয়েদের সঙ্গে আমার ছেলেদের বিয়ে দেব, তা নইলে বিয়ে দেব না।’ কর্তা শুনে বললেন, ‘সর্বনাশ! তাও কি কখন হয়? তাহলে ওদের ইচ্ছে নয় যে, ছেলেদের বিয়ে থা হোক।’ গিন্নি বললেন, ‘তা এখন খুঁজে দেখতে তো হবে। যখন মা ষষ্ঠী ছেলে দিয়েছেন তখন কনেও ঠিক করে রেখেছেন। তুমি ভাবছ কেন, সব মা ষষ্ঠীর খেলা। দেখবে তিনি বউয়ের কোট ঠিক বজায় রাখবেন।’ গিন্নির কথায় কর্তা তখন মেয়ে খুঁজতে বেরলেন।
কর্তা এদেশ ওদেশ করে কত জায়গায় খুঁজলেন, কিন্তু কোথাও সে রকম মেয়ে পাওয়া গেল না। একথা যে শোনে, সেই অবাক হয়ে যায়। এদিকে মা ষষ্ঠী ব্রাহ্মণকে ঠিক কনেদের দেশে এনে ফেললেন। ব্রাহ্মণ ঘুরতে ঘুরতে এক দেশে গিয়ে দেখেন যে, একটি বাঁধা ঘাটে বসে একটি বউ বিস্তর মেয়েকে স্নান করাবার জন্য তেল হলুদ মাখাচ্ছেন। ব্রাহ্মণ তো দেখেই অবাক! তিনি আহ্লাদে মা ষষ্ঠীকে প্রণাম করে সেই বউয়ের কাছে গিয়ে বললেন, ‘মা, এগুলি কি সব তোমার মেয়ে!’ বউ একটু ঘোমটা টেনে বললে, ‘হ্যাঁ বাবা, এত পাপ করেছিলুম যে, ভগবান আমায় একেবারে ষাটটা মেয়ে দিয়েছেন। একে খাওয়াবার পয়সা নেই, তার উপর আবার কী করে যে বিয়ে থা দেব, তাই বাবা ভাবছি।’ এই কথা শুনে কর্তা বললেন, ‘মা, তোমরা কি ব্রাহ্মণ?’ ‘হ্যাঁ বাবা, ব্রাহ্মণ না হলে আর ভগবান এত দুঃখু কাদের কপালে লিখে থাকেন।’ এই কথা শুনে কর্তা আহ্লাদ করে বললেন, ‘বেশ হয়েছে মা, আমার নাতিদের সঙ্গে তোমার মেয়েদের বিয়ে দেব। যদি তোমার ইচ্ছে হয়, তাহলে বাড়িতে চল, কর্তাদের সঙ্গে কথাবার্তা ঠিক করে ফেলি।’
তখন বউটি সমস্ত মেয়েদের নাইয়ে ধুইয়ে ব্রাহ্মণকে সঙ্গে করে বাড়ি এল। বাড়ির কর্তা, ব্রাহ্মণের সঙ্গে কথাবার্তা করে বিয়ের ঠিক করলেন। তারপর ব্রাহ্মণ বাড়িতে এসে সব কথা বললেন। তখন সকলে আহ্লাদ করে যথা দিনে ষাটটি ছেলের বিয়ে দিলেন; ষাটটি বউ ঘরে এলো। গিন্নি বললেন, বউমা যেমন কোট করেছিল, মা ষষ্ঠী তেমনি মুখ রেখেছেন। তখন ঘটা করে বাড়িতে মা ষষ্ঠীর পূজো হল।
একদিন ব্রাহ্মণীর কী মতিচ্ছন্ন ধরল। সে দিন মাঘ মাস, শীতল ষষ্ঠী পূজো, খুব জল হচ্ছে, শীতও খুব পড়েছে। ব্রাহ্মণী নাত-বউদের ডেকে বললেন, ‘আজ আমি ঠাণ্ডা জলে নাইতে পারব না, আমার বড়ো শীত করছে। আমার জন্যে এক হাঁড়ি গরম জল করো, আর চাট্টি গরম ভাত রেঁধে দাও। আমি এত ঠাণ্ডায় জল দেওয়া ভাত খেতে পারব না।’ নাত-বউরা সব মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। বউ বললে, ‘মা, তোমার কি ভীমরতি হয়েছে, আজ যে শীতল ষষ্ঠী, আজ কি উনুন জ্বালতে আছে?’ গিন্নি বললেন, ‘তা হোক বাছা, আমায় চাট্টি রেঁধে দাও।’ বউরা তখন কী করে, তাড়াতাড়ি জল গরম করে দিলে, গরম গরম ভাত রেঁধে দিলে, গিন্নি স্নান করে গরম ভাত খেলেন। তারপর সকলে খেয়েদেয়ে ঘরে শুল। সকালে গিন্নি ঘুম থেকে উঠে দেখেন যে, সব মরে রয়েছে—বউ, বেটা, নাতিরা, নাত-বউয়েরা, কর্তা, বেড়াল, কুকুর, গোরু, বাছুর পর্যন্ত সব মরে রয়েছে। গিন্নি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। তাঁর কান্নার শব্দ শুনে প্রতিবেশীরা সব ছুটে এল। বাড়ির কান্ড দেখে সকলে অবাক! বললে, ‘সে কি গো! আচম্বিতে কেন এমন হল?’ মা ষষ্ঠী বৃদ্ধ ব্রাহ্মণীর বেশ ধরে দেখা দিয়ে গিন্নিকে বললেন ‘কালকের মতো খুব গরম গরম ভাত খাও, গরম জলে স্নান করো, তাহলে তোমার ছেলে পুলে সব বাঁচবে!’ সকলে বললে, ‘ওমা, তা কি তখন করতে আছে গা! শীতল ষষ্ঠীর দিনে কি গরম ভাত খেতে আছে?’ তখন সকলে গিন্নির উপর রাগ করে বললে, ‘যেমন কাজ করেছ, তেমনি এখন মাথা খুঁড়ে মর!’ এই বলে সকলে যে যার বাড়ি চলে গেল।
তখন ষষ্ঠী বুড়ি রেগে বললেন, ‘তোর নাত-বউয়েরা যে শীতল ষষ্ঠী পেতেছে, সেই ষষ্ঠীর গায়ে যে দই আর হলুদ আছে তাই এনে আগে কুকুরের কপালে ফোঁটা দে, তার পর সকলকার কপালে দে, আর ওই হলুদ ছোপান যে সূতো আছে, ছেলে আর নাতিদের হাতে তাগা বেঁধে দে। আর কখনো শীতল ষষ্ঠীর দিন গরম ভাত খাসনি, গরম জলে স্নান করিসনি।’ এই বলে মা ষষ্ঠী অন্তর্ধান হলেন। গিন্নি গলায় কাপড় দিয়ে শীতল ষষ্ঠীর কাছে প্রণাম করে, সেই দই ও হুলদ নিয়ে আগে কুকুরের কপালে ফোঁটা দিলেন। তারপর ছেলেপুলের কপালে ফোঁটা দিতেই সকলে যেন ঘুম ভেঙে উঠল। তখন ব্রাহ্মণী কাঁদতে কাঁদতে নাতি, নাত-বউয়েদের কাছে এই সব ঘটনা বলে ছেলেদের হাতে সুতো বেঁধে দিলেন। কর্তাও যেন ঘুম থেকে উঠল। তারপর তিনি এই সব কথা শুনে রাগ করতে লাগলেন। ব্রাহ্মণীকে বকতে লাগলেন। তখন তিনি খুব ধূমধাম করে মা ষষ্ঠীর পুজা করলেন। এই সব কথা চারিদিকে রাষ্ট্র হল, সেই থেকে শীতল ষষ্ঠীর কথা পৃথিবীতে প্রচার হল। দই, পান্তা, গোটা সিদ্ধ খেয়ে শীতল ষষ্ঠী করতে হয়। সে দিন গরম ভাত খেতে নেই।
শীতল ষষ্ঠীর কথা সমাপ্ত।