শিহরণ
শক্তিব্রতবাবু মুখ তুলে কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখলেন। এই ভয়ংকর গরমেও গাছটা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। চোখ জুড়িয়ে যায়। তাঁর শ্বাস পড়ল। উদাস গলায় বললেন, আজকাল আর যুবতী বিধবা বড় একটা দেখা যায় না!
সুধাকরবাবু অবাক হয়ে মুখ ফেরালেন, হঠাৎ এই ভাবনা?
কৃষ্ণচূড়া দেখে মনে এল। শক্তিরতবাবু উত্তর দিলেন।
বিমলেন্দু একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। ওপাশ থেকে একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন, আশ্চর্য!
শক্তিব্রতবাবু তাকালেন, অন্যায় কি করলাম?
কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে যুবতী বিধবার কি সম্পর্ক তাই বুঝতে পারছি না। বিমলেন্দু বললেন।
বঙ্কিম পড়েছেন? শক্তিব্রতবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
বিমলেন্দু সারা জীবন রেলে চাকরি করেছেন। প্রবাসে কাটিয়েছেন। গল্প উপন্যাস পড়ার বাতিক তাঁর ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্রের একটি বই তিনি পড়েছিলেন কারণ সেটি তাঁর স্ত্রী বিয়ের সময় উপহার পেয়েছিলেন। কচি বাচ্চা-বাচ্চা মেয়ের মুখে বঙ্কিমচন্দ্র এমন সব সংলাপ বসিয়েছেন যে লেখকের বাস্তব জ্ঞান নিয়ে সন্দেহ হয়েছিল। যদিও তাঁর স্ত্রী মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি তাঁর মায়ের চৌদ্দো বছর বয়সের সন্তান। বিমলেন্দু উত্তর দিলেন না।
এই তিন ব্যক্তির বয়স সত্তর পেরিয়েছে। আলাপ বছর দেড়েকের। এখানকার নতুন হাউজিং কমপ্লেক্সের বাসিন্দা এঁরা। রোজ বিকেলে এই পার্কের একটি বিশেষ বেঞ্চিতে তিনজন এসে বসেন। সুধাকরবাবু লোহালক্কড়ের ব্যাবসা, এখন ছেলে দেখছে। শক্তিব্রতবাবু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেক্রেটারি হিসেবে অবসর নিয়েছেন।
সুধাকরবাবু বললেন, আগে বিজ্ঞান পিছিয়ে ছিল। অল্প বয়সে মানুষ মারা যেত ফলে তাদের যুবতী স্ত্রীরা বিধবা হয়ে যেতেন। কিন্তু সেইসব বিধবাদের তো বাইরে বের হওয়ার ব্যাপারে অনেক নিষেধ ছিল। তাদের দেখতেন কি করে?
শক্তিরতবাবু বললেন, দূর মশায়। আমি বিয়ে করিনি, আজ অবধি কোনও মহিলার শরীর দেখা দূরের কথা আঙুলও ছুঁয়ে দেখিনি, আমি কি করে স্বচক্ষে ওঁদের দেখব। আমি তাঁদের দেখেছি বইয়ের পাতায়। ওই বঙ্কিম থেকে বটতলা, কত বইতে ওঁরা আছেন।
শক্তিবাবু সংসার করেননি এটা ওঁরা জানতেন কিন্তু জীবনে কোনও মহিলার আঙুল স্পর্শ করেননি শুনে বেশ বিমর্ষ হলেন সঙ্গী দুই বৃদ্ধ। কিন্তু তা সত্বেও বিমলেন্দুবাবু প্রশ্ন করলেন, বটতলা?
শক্তিব্রতবাবু একটু লজ্জিত হলেন, ওই যে মলাট বিহীন চটি-চটি বইগুলো। বাঁকুড়ায় যখন পোস্টেড ছিলাম তখন এক সহকর্মী কলকাতায় গেলেই নিয়ে আসত। একটু, একটু কেন বেশ অশ্লীল। তবে কিনা ওই বয়সে মন্দ লাগত না।
সেদিন সন্ধেবেলায় ফ্ল্যাটে ফিরে এসে সুধাকরবাবু দেখলেন তাঁর স্ত্রী বউমার সঙ্গে হেসে-হেসে খুব গল্প করছেন। তিনি কথা না বলে নিজের ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসলেন। শক্তিব্রতবাবুর জন্য ওঁর মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল। চায়ের কাপ নিয়ে বউমা ঢুকতেই তিনি বললেন, তোমার শাশুড়িকে একটু আসতে বলল।
বউমা ঘাড় নেড়ে চলে গেল। সবিতা এলেন, কি বলছ?
না কিছু না। মাথা নাড়লেন সুধাকরবাবু।
আরে। কি হয়েছে বলবে তো? শরীর খারাপ লাগছে?
না।
তাহলে? কোনও খারাপ খবর পেয়েছ?
ওসব কিছু না।
এই শক্তিব্রতবাবুর কথা ভাবছিলাম। অবিবাহিত মানুষ একাই থাকেন।
সঙ্গে ভাইপো থাকে বলেছিল না?
হ্যাঁ ভাইপো মানে তো সংসার নয়!
অনেক মানুষ অবিবাহিত থাকে। একমাত্র সাধু সন্ন্যাসী ছাড়া বেশিরভাগই বদ হয়। ওদের সংসার করার প্রয়োজন হয় না। সবিতা চলে গেলেন টিভি দেখতে।
আলো নিভিয়ে ছন্দা বিছানায় এসে চাপা গলায় বললেন, সরে শোও। শরীরটাকে নাড়াচাড়া করলেন বিমলেন্দু। তারপর শ্বাস ফেললেন।
ধপ করে বিছানায় পড়ে বালিশটাকে স্বামীর বালিশ থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে ছন্দা বললেন, আবার কি হল?
শক্তিব্রতবাবুর জন্যে মন খারাপ লাগছে।
কারণ? অন্ধকারে প্রশ্নটা হল চটজলদি।
ভদ্রলোকের বয়স এখন তেয়াত্তর। এখন পর্যন্ত কোনও নারীশরীর চোখে দ্যাখেননি। বিয়ে করেননি। কিন্তু অন্য অনেকভাবে তো দেখা যায়। আবার শ্বাস ফেললেন বিমলেন্দু।
ভালো মানুষ, সৎ চরিত্র। তোমার মতো ছোঁকছোঁক বাতিক নেই।
আঃ। তুমি বুঝতে পারছ না। আমরা রোজ একসঙ্গে আড্ডা মারি, অলমোস্ট একই বয়সি, আমি আর সুধাকরবাবু দেখেছি আর উনি দ্যাখেননি, এক ধরনের কমপ্লেক্স তৈরি হয় না? তুমি পুরুষ হলে বুঝতে!
আমি পুরুষ হলে এখানে শুতাম না। দূরত্ব বাড়ালেন ছন্দা, মেয়েমানুষের শরীর যেন বিড়লা প্লানেটরিয়াম! না দেখলে জীবন বৃথা! কথা শুনলে গা জ্বলে যায়!
বিমলেন্দু স্ত্রীর বাজুতে হাত ছোঁয়াতেই ছন্দা খেপে গেলেন, খবরদার আমাকে ছোঁবে না।
বয়ে গেছে ছুঁতে। এখন তোমার ছোঁয়া আর পাশ বালিশকে ছোঁয়ার মধ্যে তফাত নেই।
কি? আমি পাশবালিশ?
অলমোস্ট!
ছন্দা বালিশ নিয়ে নিচে নেমে ঘরের মেঝেতে শুয়ে পড়লেন। গরমকাল। ঠান্ডা লাগার কোনও
ভয় নেই।
*
বিকেলবেলায় সবিতা যাচ্ছিলেন কোঅপারেটিভের দোকানে। সকাল থেকে তাঁর স্বামী মুখে কুলুপ দিয়ে বসে আছেন। দু-তিনটে কথা বলে উত্তর না পেয়ে আর কথা বাড়াননি, যা বলার বউমাই বলছে। পিঠে ঘামাচি হয়েছে। পাউডারটা শেষ হয়ে গিয়েছে। স্বামীকে বললে এনে দিতেন। কিন্তু জেদে বলেননি। নিজেই বেরিয়েছেন, একটু হাঁটা হবে।
সেলস কাউন্টারে গিয়ে দ্যাখেন ভিড় নেই। দাঁড়াতেই শুনলেন, ভালো? তাকিয়ে দেখলেন বিমলেন্দুবাবুর স্ত্রী ছন্দা। পুজোর সময় আলাপ। কিন্তু যাওয়া আসা নেই। মাথা নাড়লেন, ভালো। আপনি?
এই আর কি! ছন্দা এগিয়ে এলেন, একা, না সঙ্গে কর্তা আছেন?
এই সময়? পাগল। এখন তিন বন্ধু পার্কে বসে গল্পে মশগুল। কেন? আপনার কর্তা যাননি? শরীর খারাপ নাকি?
না-না। গেছেন। না গেলে ভাত হজম হবে কেন? ছন্দা হাসলেন।
কিন্তু-কিন্তু করেও জিজ্ঞাসা করে ফেললেন সবিতা, আচ্ছা, ওই শক্তিব্রতবাবু লোকটি কীরকম
বলুন তো? সবিতা জিজ্ঞাসা করলেন।
এই দেখুন, আমার মনেও একই প্রশ্ন এসেছে। বিয়ে কয়েনি, ভাইপোকে নিয়ে থাকে। তার মানে সংসারী নয়। এঁদের সঙ্গে তাহলে কি নিয়ে কথা বলে?
ঠিক। কাল একটা কথা শুনে লজ্জায়–কি যে বলব! সবিতা লজ্জা পেলেন।
ঘনিষ্ঠ হলেন ছন্দা, কি বলুন না, কি শুনেছেন?
আমার বলতে খারাপ লাগছে!
মেয়েমানুষের কথা? ছন্দা জিজ্ঞাসা করলেন।
হ্যাঁ-হ্যাঁ। এত বয়স বেঁচে আছেন, তিনি নাকি দ্যাখেননি তাই ওর জন্য সমবেদনায় মরে যাচ্ছেন
আমার স্বামী। ভাবতে পারেন! সবিতা চোখ বড় করলেন।
শুধু আপনার? আমারটিও। বুড়ো বয়সে কি মতিভ্রমই না হয়?
লোকটা বদ। ওর সামনে গেলে মনে হবে এক্সরে-র চোখে আমাকে দেখছে।
যা বলেছেন। অথচ জানেন, কোনওদিন কেউ কারও বাড়িতে যায়নি।
অথচ এসব আলোচনা হয়! ভাবতে পারেন!
আর কি হয় কে জানে!
আমার মাঝে-মাঝেইচ্ছে করে ওর বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিই।
কিন্তু, কি বলে যাবেন? লোকটা কীরকম তাও তো জানি না।
না-না। লোকটা যখন থাকবে না তখন যাব। এই বিকেল সাড়ে পাঁচ থেকে ছটার মধ্যে। ওর ভাইপো বাড়িতে থাকলে ঠিক কথা বের করতে পারব।
কিন্তু গেলে তো কিছু বলতে হবে!
দুজনে মিনিট পাঁচেক আলোচনা করে শেষপর্যন্ত কথা পাকা করলেন।
পরের দিন স্বামীরা কথা বলতে চেয়েছিলেন, স্ত্রীরা রাজি হননি। বিকেল পৌনে পাঁচটায় ওঁরা পার্কের দিকে চলে গেলে সবিতা এবং ছন্দা দেখা করলেন।
সবিতা বললেন, যদি ওর ভাইপো ফ্লাটে না থাকে?
ফিরে আসব। কেউ জানতেও পারবে না।
বাড়ি বের করতে অসুবিধা হল না। বেল বাজাতে যে ছেলেটি দরজা খুলল তার বয়স কুড়ির আশেপাশে। সবিতা বললেন, আমরা মহিলা সমিতি থেকে এসেছি।
ও, আসুন। কিন্তু কেউ তো বাড়িতে নেই।
ঘরে ঢুকে ছন্দা জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় গিয়েছেন?
পার্কে।
এ-বাড়িতে মহিলা আছেন?
সবিতার প্রশ্ন।
না। আমি আর জেঠু।
কোনও মহিলা আছেন? ছন্দা জিজ্ঞাসা করেন।
না। জেঠু মহিলাদের পছন্দ করেন না।
কেন?
আমি জানি না। আমাকে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে বারণ করেছেন।
বুঝলাম। কিন্তু আমরা ওঁর জন্যে অপেক্ষা করব।
দেরি হবে। পার্কে গেলে দেখা পাবেন।
না। উনি কোন ঘরে থাকেন?
ওই ঘরে।
বলমাত্র ওঁরা চলে এলেন সেখানে। কোনও অবিবাহিত পুরুষদের ঘর এত সুন্দর সাজানো হতে পারে ওঁরা জানতেন না। তাদের স্বামীরা তো জল গড়িয়ে খান না।
আমরা এখানেই বসছি।
আপনারা কি চা খাবেন?
তুমি তৈরি করতে পারো?
হ্যাঁ।
বেশ।
ছেলেটি চলে গেলে সবিতা বললেন, ভাইপোকে চাকরের মতো খাটায়।
মেয়েদের সঙ্গে মিশতে দেয় না। ওটা কি বই? সবিতা এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে বইটা তুলল, বিদ্যাসুন্দর। এই বই পড়ছে, খুব রস!
রসালো বই?
হুঁ। বেশ অশ্লীল! পড়েননি?
না।
ভারতচন্দ্রের গ্রন্থাবলি আছে আমার কাছে, দেব, পড়বেন।
বলতে-বলতে টেবিলের কাছে গিয়ে ড্রয়ার টানলেন ছন্দা। বাধা দিলেন, সবিতা, এই, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না।
একটা লোকের চরিত্র বোঝা যায় তার ড্রয়ার দেখে। এমা, এগুলো কি বই।
তিনটে মলাটহীন চটি বই বের করলেন ছন্দা। পড়লেন, লাল শায়া, যুবতী বিধবা, ভরদুপুরে শিহরন। লাল শায়ায় প্রথম পাতায় চোখ রাখলেন তিনি। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর মুখে রক্ত জমল। কোনওক্রমে বইটা এগিয়ে দিলেন সবিতার দিকে। সবিতা পড়তে আরম্ভ করলে ওঁরও একই দশা হল। বললেন, একি!
ছন্দা বললেন, আমার শরীর কীরকম করছে। মাথা ঝিমঝিম–।
আমারও।
এরকম বই কেউ লেখে? ছাপা হয়?
হয়েছে তো?
কেউ পড়ে?
পড়ে। পড়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নেয়। নচ্ছার লোক।
বলে নচ্ছার।
এসব ওদের পড়াচ্ছে কিনা কে জানে!
না। পড়ায়নি। মাথা নাড়ল ছন্দা, পড়লে বাড়িতে এসে রসিয়ে বলত, চলো।
যাবে?
হ্যাঁ। যা জানার তা হয়ে গেছে। বইগুলো ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখতে গিয়েও একটা বই বের করে নিল ছন্দা।
সবিতা জিজ্ঞাসা করল, ওটা?
পড়ে দেখব। কেন পড়ে তা জানা দরকার।
ও তো টের পেয়ে যাবে। একটা বই নেই।
পাক। ভাইপোর মুখে শুনে বুঝতে পারবে না আমরা কারা। বাইরে বেরিয়ে টের পেলেন রান্নাঘরে চা বানানো চলছে। নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন ওরা।
তুমি আগে পড়ে নাও, তারপর আমি পড়ব। হঠাৎই তুমি বেরিয়ে এল সবিতার মুখ থেকে। কয়েক লাইন পড়ে শরীর ঘিনঘিন করলেও রক্ত গরম।
ঠিক আছে। কিন্তু কোথায় পড়ি? বাড়ির সবাই তো তাকিয়ে দেখবে!
শোওয়ার ঘরে, দরজা বন্ধ করে?
ছন্দা হাসলেন, দরজা বন্ধ করার চল উঠে গেছে দশ বছর আগে। এখন সব সাদা পাতা। কোনও আড়াল নেই। হঠাৎ তো দরজা বন্ধ করা যায় না।
আমারও তাই।
দেখি।
আলমারিতে শাড়ির তলায় বইটা রেখে দিয়েছিলেন ছন্দা। ভেবেছিলেন ভোরবেলায় যখন বিমলেন্দু অঘোরে ঘুমিয়ে থাকেন তখন নিশ্চিন্তে পড়বেন। কিন্তু মাঝরাতে ঘটনা ঘটে গেল। বুকে ব্যথা, বমি, প্রবল ঘাম, ছন্দাকে নাসিরংহোমে নিয়ে যেতে হল। যমে মানুষে টানাটানি। বাহাত্তর ঘণ্টা না গেলে জানা যাবে না কিছু।
খবর পেয়ে নার্সিং হোমে এসেছিলেন শক্তিব্রতবাবু এবং সুধাকরবাবু। দুজনেই চিন্তিত। ভরসা দিলেন বিমলেন্দুকে। বিমলেন্দু ভেঙে পড়েছেন। সারা জীবন রেলে চাকরি করায় সময় দিতে পারেননি স্ত্রীকে। এরকম সতীসাধ্বী স্ত্রীকে মর্যাদা দিতে পারেননি।
খবরটা পেয়ে ছটফট করেছেন সবিতা। তাঁর বদ্ধ ধারণা, ওই বই পড়েই ছন্দার শরীর খারাপ। হয়েছে। কিন্তু বইটা কোথায়? স্বামীকেও বলতে পারছিলেন না। চব্বিশ ঘণ্টা পরে ডাক্তার কথা বলতে অনুমতি দিলেন। বিমলেন্দু ফিশফিশ করে জিজ্ঞাসা করলেন, কষ্ট হচ্ছে?
না, বইটা।
বই? কি বই বলো? এখন কি পড়তে পারবে?
আমি না। সবিতাকে–। আলমারিতে–। ওকে দিয়ে দিয়ো।
সুধাকরবাবুর স্ত্রীর নাম সবিতা তা বিমলেন্দু জানতেন না। খোঁজ নিয়ে জানলেন। বাড়ি ফিরে আলমারি ঘেঁটে আবিষ্কার করলেন, ভরদুপুরে শিহরন। পাতা ওলটাতে তাঁর কান গরম হল। তবু পড়লেন। পড়ে গা ঘিনঘিন করে উঠল। এই বই তাঁর স্ত্রী পড়তেন? তাঁর স্ত্রীকে তিনি সতীসাধ্বী বলে ভাবতেন? কিন্তু সুধাকরবাবুর স্ত্রীও কি তাই? তাঁকে এই বই দিতে বলেছেন ছন্দা।
সোজা সুধাকরবাবুর বাড়িতে চলে গেলেন বিমলেন্দুবাবু। সুধাকরবাবু তাঁকে দেখে অবাক। আপ্যায়ন করলেন। সবিতা ছন্দার খোঁজখবর নিলেন। চা খেতে হল। কিন্তু কিছুতেই বইটা পকেট থেকে বের করতে পারলেন না তিনি।
সেদিন নার্সিংহোমে যাওয়ার পথে শক্তিব্রতবাবুর বাড়িতে এলেন তিনি। আপনার তো এসব পড়ার অভ্যেস আছে। রাখুন।
কি? একি? ভরদুপুরে শিহরন? এ বই আপনি কোথায় পেলেন? প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন শক্তিব্রতবাবু।
কেন? কি হল?
আরে মশাই দুজন মহিলা সমিতি থেকে এসে বইটা চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি মহিলা সমিতিতে গিয়ে খোঁজ নিয়েছি। ওঁরা কাউকে পাঠাননি।
মহিলা সমিতি? ঘাবড়ে গেলেন বিমলেন্দু। ভাইপোকে তাই বলেছিল। দুজনেই বয়স্কা।
সেকি?
আরে মশাই আমার শোওয়ার ঘরে ঢুকে টেবিলের ড্রয়ার খুলে নিয়েছে। টাকাপয়সায় হাত দেয়নি। এইজন্যেই বলি বিয়ে না করে ভালো আছি। শক্তিব্রতবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এটাকে কোথায় পেলেন?
রাস্তায়।
পড়ে-উড়ে বাড়িতে রাখতে না পেরে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। হয়ে গেল!
কি হয়ে গেল? ঘাবড়ে গেলেন বিমলেন্দু।
এবার ওই দুই মহিলার বৃদ্ধ স্বামীরা বিপদে পড়বেন। প্রৌঢ়ারা তরুণী হয়ে যাবেন আর বৃদ্ধরা সরষের ফুল দেখবেন। হে হে হে, হাসলেন শক্তিব্রতবাবু।
নার্সিংহোমে গিয়ে দেখলেন সবিতা এসেছেন ছন্দাকে দেখতে। ছন্দা আজ ভালো। বেডে দিয়েছে ওরা। এক মুহূর্তেই বুঝে গেলেন শক্তিব্রতবাবুর বাড়িতে কারা হানা দিয়েছিল। সবিতা চলে গেলে স্ত্রীর পাশে টুল নিয়ে বসে গম্ভীর গলায় বললেন, অবিবাহিত পুরুষের বাড়ি থেকে চুরি করে আনার মতো আর কিছু পেলে না? ছন্দা তাকালেন। চোখ বন্ধ করলেন লজ্জায়। তারপর একটা হাত স্বামীর হাঁটুর ওপর রেখে কাঁপা গলায় বললেন, অসভ্য।