প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

শিশুতে শিশু নেই

শিশুতে শিশু নেই

একালে আর শিশু বলে কিছু নেই। সব প্রবীণেরও প্রবীণ। সে ছিল আমাদের কালে। তিরিশের দশকে, চল্লিশের দশকে শিশু ছিল। ফোলা-ফোলা গাল, ড্যাবা-ড্যাবা চোখ। আমাদের শৈশব ছিল। মজার শৈশব, কল্পনায় ভরা। কেউ যদি জিগ্যেস করত, অপরিচিত কেউ, ‘খোকা, তোমার নাম কী?’ আমরা অমনি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলতুম। প্রশ্নকারী সঙ্গে-সঙ্গে মহা অপ্রস্তুত হয়ে বলে উঠতেন, ‘না, না, তোমার কোনও নাম নেই, তোমার কোনও নাম নেই। আমারই ভুল হয়ে গেছে বাবা।’

‘অপরিচিতের সামনে আমরা মায়ের আঁচলের তলা খুঁজতুম। গোঁফঅলা মানুষ হলে তো কথাই ছিল না। মা যখন বলতেন, ‘ওই জুজু আসছে।’ অমনি আমাদের সব বাঁদরামি ঠান্ডা হয়ে যেত। বাইরের লোক কি, নিজের বাবাকে দেখেই আমরা ভিরমি খেতুম। মা যখন বলতেন, ‘দাঁড়া, বাবা আসুন সব আজ বলে দোবো,’ আমাদের হাত-পা পেটের মধ্যে সিঁধিয়ে যেত।

আমাদের সাজ-পোশাকও ছিল সেইরকম। মনে আছে, সেকালে ‘মিলিসিয়া’ বলে অদ্ভুত এক রকমের কাপড় ছিল। আমাদের পরিবারে এক থান ওইরকম কাপড় আসত। সেই কাপড়ে তোশকও তৈরি হত, আর তৈরি হত আমাদের ইজের। হাফপ্যান্ট-ট্যান্ট নয়, ইজের। তাতে লম্বা দড়ি পরানো থাকত। মা কষে বেঁধে দিতেন। বাড়তি অংশটা সামনে লটরলটর করে দুলত। বাড়িতে বেশির ভাগই আদুর গায়ে। ভুঁড়ো পেটটা সামনে ঠেলে থাকত। বর্ষা-বাদলায় হাফ-হাতা-গেঞ্জি। বাইরে বেরোবার সময় একটু সাজগোজ হত। হাফ-হাতা শার্ট, পায়ে নটি বয় জুতো, যা কখনও ছিঁড়ত না। চকচকে, ঝকঝকে করার কোনও বালাই ছিল না। ফিতে যতই বাঁধ না কেন, কিছুদূর যেতে না যেতেই খুলে লটরপটর। চুলে দেওয়া হত ঘাস ছাঁট। টেরি বাগাবার কোনও উপায় ছিল না। আর ছ-সাত বছর বয়স পর্যন্ত ক-মাসই বা চুল থাকত মাথায়। সব সময়েই তো নেড়া। তখন একটা সর্বনাশা ধারণা ছিল—যত নেড়া করবে তত চুল ঘন হবে। বছরের তিন চার মাসই বেলের মতো একটি মাথা নিয়ে ঘোরো। সেকালের শিশুদের কাপ্তেনি করার কোনও উপায় ছিল না। আগাপাশতলা সরষের তেল মেখে ঠান্ডা জলে চান। মাঝেমধ্যে মা চেপে ধরতেন। খড়খড়ে গামছা দিয়ে গা রগড়ে যাচ্ছেন, আর ছেলে চিল-চেল্লান চেঁচিয়ে যাচ্ছে। বেবি-সোপ, বেবি-স্যাম্পু এ-সব আদিখ্যেতা ছিল না। শীতকালে চানের পর রোদে গিয়ে হিহি। সারা গায়ে শীতকাঁটা। নানা ডিজাইনের সোয়েটার ছিল না, ভোরবেলা চাদর। দোলাই বাঁধা। যেন একটা পুঁটলি। ঘাড়ের পেছন দিকে বিশাল বড় এক গাঁট। হাত নাড়াবার উপায় নেই। পেঙ্গুইন পাখির মতো হাঁটা। বেবি স্যুট, বিবি স্যুট, টুপিস স্যুট, সেকালের শিশুর অঙ্গে ওসব চাপত না। শিশু ভোলানাথ ছাড়া থাকত প্রকৃতির কোলে। শিশুর জলখাবার ছিল ছোট-ছোট বেতের ধামাতে মুড়ি আর আখের গুড়ের মুড়কি। তার সঙ্গে কখনও নারকোল নাড়ু, তিলের নাড়ু, ছোলা-পাটালি। একালের শিশুরা গুড়ের মুড়কির নামই শোনেনি হয়তো। অবস্থা খুবই জটিল। বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে গিয়ে মুড়কি, পাটিসাপটা, তিলের নাড়ু চিনতে হয়, চাখতে হয় মালপো। একালের মায়েরা হেলথ কনসাস। স্বামীর সিগারেট র‌্যাশান করে দেন। ছেলের লজেন্স। মিষ্টি খেলে দাঁত খারাপ হবে। থাবড়া মেরে চকলেট কেড়ে নেবেন। প্রাোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, মিনারেলস পরিমাপমতো হচ্ছে কি না। হিসাব করে খাদ্য নির্বাচন। ডিম সেদ্ধ, কলা, ছানা, টোস্ট এর মধ্যেই বিচরণ। ফাস্ট ফুড এসে গেছে। শিশুর আহারের বৈচিত্র্যও শেষ হয়ে গেছে। সেই থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। শিঘ্রই হয়তো দেখা যাবে, পাড়ার মোড়ে সার্ভিসিং সেন্টার। বাইরে সাইনবোর্ড—এখানে নারকোল ফালা করে ও কুরে দেওয়া হয়। মোচা ও থোড় কেটে দেওয়া হয়। অর্ডার দিলে, নারকোল নাড়ু তৈরি করে দেওয়া হয়। দিদিমা, ঠাকুমারা গেছেন, গেছে শিশুর শৈশব। ঘুরতে-ফিরতে খাওয়া, নিস্তব্ধ দুপুরে আচার চুরি করা, সে সুযোগ আর নেই। কোথায় আচার, কোথায় মোরব্বা!

আমাদের কালের শিশুদের স্কুলে যাওয়াটা ছিল নিরতিশয় নিরাড়ম্বর। কোনও ইউনিফর্মের বালাই ছিল না। পিঠে বাঁধা থাকত না স্কুল ব্যাগ, কাঁধে ঝুলত না জলের বোতল। ইজের আর শার্ট পরা ভোমলা একটা ছেলে, বগলে বই, খাতা নিয়ে চলেছে। খাতার মলাট আধ ছেঁড়া। এ বগলে বই, ও বগলে স্লেট-পেন্সিল। স্লেট তো এখন মিউজিয়ামে চলে গেছে। একালে হল খাতার রেলা।

এক এক স্কুলের এক একরকম ইউনিফর্ম। পায়ে মোজা, স্পোর্টস শু। স্পোর্টসের বারোটা যত বাজছে, স্পোর্টস শু-র রমরমা তত বাড়ছে। পিঠে ক্রস বেল্ট লাগানো ব্যাগ। কাঁধে ডোনাল্ড ডাক জলের বোতল।

আজকাল আবার মাথা-ছাতা বেরিয়েছে। হাতল নেই। ইল্যাস্টিক আছে। কপালে লাগিয়ে দাও। ধরার প্রয়োজন নেই। চাঁদির ওপর ছাতার বাহার। ছেলে চলেছে স্কুলে। স্কুলে যাচ্ছে, না শিকারে যাচ্ছে বোঝার উপায় নেই। গম্ভীর মুখ। পাশে-পাশে চলেছেন মা। একালের শিশুর শৈশবকে ময়ান দিয়ে চটকানো হচ্ছে। তৈরি হবে খাস্তা গজা। ছেলে সবেতেই ‘টপ’ হবে। আঁকবে, গাইবে, আবৃত্তি করবে, অভিনয় করবে, সাঁতার কাটবে, সমারসল্ট খাবে, পরীক্ষায় ফার্স্ট হবে, ক্যুইজ কনটেস্টে তাল ঠুকবে, কালচারাল অ্যাম্বাসাডার হয়ে বিদেশ যাবে। ক্রিকেট-টেনিস-ফুটবল-হকি সবেতেই চৌকস। আশার আর শেষ নেই। টপ করতে গিয়ে কত শিশু যে টপকে গেল! আমাদের সময় শিশু কালবৈশাখীর ঝড়ে আমবাগানে ছুটত। গাছে চড়ে পেয়ারা খেত। রোদ ঝলমলে দুপুরে মাঠে ফড়িং ধরত, পায়ে সুতো বেঁধে উড়িয়ে দিত, ঘুড়ি ওড়াত। খেলার মধ্যে ছিল চোর চোর, গাদি, কপাটি, লাট্টু, ড্যাঙ্গুলি। মেয়েদের সঙ্গে এক্কা-দোক্কাতেও আপত্তি ছিল না। বাতাবি লেবুর ফুটবল। বর্ষায় যখন শিল পড়ত, শিশু ছুটত শিল কুড়োতে। গলায় থ্রম্বোসিস হয়ে যাবে ভেবে কোনও মা ক্ষিপ্ত হতেন না। সেকালের শিশু মানুষ হত কেয়ার অফ ভগবান। একালের শিশু মানুষ হয় কেয়ার অফ বিজ্ঞাপন আর চাইল্ড স্পেস্যালিস্ট। একালের একটি শিশুকে লজেন্স দিতে গেলুম, শিশুর মা হাঁ হাঁ করে, ‘দেবেন না, দেবেন না, হাত লেগে আছে। র‌্যাপারে মোড়া না হলে আমার ছেলে খাবে না।’ আমার বেশ মনে আছে, ছেলেবেলায়ে পান খাওয়ার ইচ্ছা হলে, মা মুখ থেকে চিবনো পান সামান্য বের করে মুখে ঢুকিয়ে দিতেন। কনট্যামিনেশান, ইনফেকান। এইসব শব্দ অজানা ছিল।

একালের শিশুদের দেখলে সেকালের প্রবীণরা বলতেন ডেঁপো। খেলার চেয়ে খেলা দেখতে ভালোবাসে। স্ট্যাটিসটিকস মুখে-মুখে। আমরা ফুটবলটাই বুঝতুম। এরা ক্রিকেট আর টেনিস। ক্রিকেট আর টেনিস হল স্ট্যাটাস-সিম্বল। কমিক্স হল পাঠ্য। আমাদের শৈশবে দিদির সঙ্গে আলুর পুতুল, মাটির পুতুল খেলতুম। হাঁড়ি কুড়ি নিয়ে মিছিমিছি রান্না। কখনও শুকনো পাতা যোগাড় করে আলু পুড়িয়ে বনভোজন। একালের শিশুরা স্কুলের গাড়ি চেপে কঠিন চেহারার দিদিমণিদের সঙ্গে পিকনিকে যায়। আমাদের জন্মদিনের আদিখ্যেতা ছিল না। অভিভাবকরা মনে করতেন, জন্মেছ, বেশ করেছ। এখন বাঁদর থেকে মানুষ হও। আলালের ঘরের দুলাল করে মানুষ করা হত না। একালের শিশুদের হিন্দি সিনেমার কায়দায় জন্মদিন হয়। ঢাউস ঢাউস বেলুন ঝুলছে। বাতি জ্বলছে। হ্যাপপি বার্থ ডে। ঠাকুরদা আর ঠাকুমা, যদি সেই পরিবারে থাকার সুযোগ পেয়ে থাকেন, তাঁরা একপাশে বসে থাকেন ফ্যাল-ফ্যাল করে। চোখে ছানি-কাটা চশমা। অসহায় দুটি প্রাণী। ঠোঁটে নীরব প্রশ্ন—এ সব ক্যা হো রাহা হ্যায়। প্রেজেন্টেসান আসছে—একালের রিমোট কনট্রোল খেলনা। কার বাড়িতে গিয়ে যেন দেখলুম, ফ্রিজের মাথায় পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে—অরণ্যদেব। কয়েকদিন আগেই ছেলের জন্মদিন গেছে। সেই ছেলে আবার রেগে গেলে সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়ায়—আজ মায়ের লাশ ফেলে দেব। সেদিন এক শিশুকে জিগ্যেস করলুম,—কী রে মুখ ভার করে বসে আছিস কেন?

বললে, মুড অফ।

আমার এক আত্মীয়ের ছেলে স্কুল থেকে ক্লান্ত কয়লার খনির শ্রমিকের মতো ফিরছে। জিগ্যেস করলুম, কেমন আছিস?

বললে—যেতে পারলেই ভালো হয়।

একদিন আমি বসে আছি বিরস বদনে। আমার ভাইপো, এই এতটুকু একটা বাচ্চা, আমার পাশে দাঁড়িয়ে, পিঠে দু-বার চাপড় মেরে বললে—চলো একটু হুস্কিই খেয়ে আসি। হুইস্কি শব্দটা শুনেছে। উচ্চারণ করতে পারে না ঠিকমতো। চোখ নাচিয়ে বললে, বসে আছ কেন! ওঠ, আমার সঙ্গে একটু ড্যান্স করো। সে নিজেই নাচতে লাগল। আদো আদো গান, এ হাওয়া, হাওয়া।

পাশের বাড়িতে একটা বাচ্চা এসেছে, বেশ গোলগাল। খুব ডাঁটে দাঁড়িয়ে আছে। জিগ্যেস করলুম, তোমার নাম কী?

বললে, বাবা, মা বাবু বলে ডাকে। আমি নাম রেখেছি মিঠুন।

আমাদের বাড়িতে একটা বাচ্চা এসে ভয়ঙ্কর দুষ্টুমি করছে। বললাম, তোকে দেখে মনে হচ্ছে, মানুষের পূর্বপুরুষ সত্যিই বাঁদর ছিল। সে সঙ্গে-সঙ্গে বললে, পূর্বপুরুষ কেন, মানুষ তো বাঁদরই।

আমার মনে আছে, দূর শৈশবে, একবার স্কুলের অনুষ্ঠানে আমাকে মঞ্চে তুলে দিয়েছিল। এইবার আবৃত্তি করবে…। হাত জোড় করে নমস্কারটা ঠিকই করেছিলুম, প্রথম লাইনটা কোনওক্রমে বেরলো—আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে-বাঁকে, তারপর বাঁকে বাঁকেতেই আটকে গেলুম, বাঁকে-বাঁকে, অ্যাঁ, বাঁকে-বাঁকে। অনুষ্ঠান সভাপতি, জমিদার রায় চৌধুরীমশাই হেঁকে বললেন—দে দে কান ধরে নামিয়ে দে। আমার তখন চোখের জলের নদী গান বেয়ে এঁকে-বেঁকে চলেছে। সেকাল আর একালে এই তফাত। শিশুর শৈশব পাকামির ঠেলায় হাওয়া হয়ে গেছে। এখন সব চাইল্ড প্রডিজি। আমাদের কালে নাম রাখা হত, নেড়া, বোঁচা, খাঁদা। একালের নাম হর্যক্ষ, গবাক্ষ, খতপ্রভ, প্রস্রবণ গিরি। অসাধারণ সব নামের সন্ধানে পিতা-মাতা আকুল। এমন সব নাম কেন? বললেন, ভোরে দাঁত মেজে, বারকতক ছেলের নাম ধরে ডাকাডাকি করলেই, অটোমেটিক জিভছোলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *