শিরোনামহীন (অসম্পূর্ণ গল্প)
তিন নেতার মাজারের সামনে অবস্থিত দুই বেশ্যার চায়ের দোকানে বোসে পর পর দু কাপ চা খেয়েছি। শিরদাঁড়াটি আস্তে আস্তে নমনীয় হয়ে আসছে। পাশের রাস্তাটা এখন সন্ধেবেলা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। তাছাড়া গত দুদিন এলাকায় গাড়ি ঢুকছে না। ছাত্রদের আন্দোলন চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাত্ররা কী করবে? কতোদূর যেতেই বা তারা পারবে?
স্বাধীনতা বিরোধীরা ক্ষমতায় গাঁট হয়ে বসছে। মুক্তিযোদ্ধাদের খবর নেই। পাক সেনাদের অস্ত্র সমর্পনের জায়গায় এখন শিশুদের বালখিল্যতা চলছে। বনাঞ্চলে ঢেকে গেছে সাতই মার্চের রেসকোর্স। শালার বাঙালি, নিজের প্রথম বিজয়ের চিহ্নটুকুও ধ’রে রাখতে পারলি না।
কিন্তু তাই বোলে এ-ও কি হয়!
আচ্ছা সুযোগ পেলেই রজনীটা অমন গা ঘষে কেন? ও কি অন্য কিছু চায়! বছর দুয়েক বিয়ে করেছে। বিয়ের পরেই কেবল মেয়েরা স্বাভাবিক হয়। শরীর নিয়ে কুমারী মেয়েদের তালবাহানা একদম বরদাস্ত করা যায় না। আসলে বিয়ের পরেই ওরা ফাঁকিটা বুঝতে পারে।
বখতিয়ার আসছে না কেন এখনো! এখন রওনা হতে না পারলে রাত হয়ে যাবে তো! এই সব গৃহপালিত লোক নিয়েই যতো মুশকিল! সিগারেটেও স্বাদ নেই। একটার পর একটা টেনে চলেছি কোনো খরব হচ্ছে না। এক স্টিক ধুন খেতে পারলে জমতো।
‘নে চল’ বখতিয়ারের রিক্সা এসে সামনে দাঁড়ায়। বেশ গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে রিক্সায় বোসে আছে ও।
‘ছাত্রদের মিটিংটা শেষ পর্যন্ত শুনে আসলাম’ মনে হলো আরো কিছু বলবে ও। কিন্তু কিছু বললো না। শুধু সংক্ষেপে ডাকলো ‘নে উঠে পড়।’
চা সিগারেটের বিল মিটাতে যতোক্ষন, তারপর আমাদের রিক্সা ময়ুরপংখির গতিতে ছুটে চল্লো। মাথার মধ্যে এখন বেশ আলো বাতাস বইছে। আগের দমবন্ধ হওয়া ভাবটা আর নেই। গলা মিলিয়ে দুজনে গান ধরলাম— ‘ও আমার মনের বনে বাউরি বাতাস কান্দিয়া লুটায় বন্ধু, কান্দিয়া লুটায়—’
বেচারা বুলবুল ভাই! স্লা, মদের মধ্যে ডুবে মরলো। গনসংগীতের এমন গলা ভাবা যায় না। কিন্তু এই বাঁদরামোর কোনো মানে হয়! সব কাজ বাদ দিয়ে খালি নেশা করা— এটা কি?
কিরকম ব্যাটা ছেলেরে বাবা, নেশাই যদি গিলে ফেল্লো! তাও আবার স্লা দেবদাস ডাইসের। ওহ্ গড! পারসোনালি হেল্প মি। কথাটা অবশ্য বুলবুল ভায়ের। আসর জমানোর মাস্টার লোকটা।
‘রাজাকার তো প্রধানমন্ত্রী হয়েই গেল’ বখতিয়ারের নিরাশা, ক্ষোভ ও দীর্ঘশ্বাস মাখানো কন্ঠস্বর ঝাঁকি দিলো। হ্যাঁ, হ্যাঁ তা-ইতো, তা-ইতো হলো, কোথায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা? সারোয়ারের মতো এংরি মুক্তিযোদ্ধা এখন আল বদরের পত্রিকায় কাজ করছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের অপরাজেয় বাংলা হয়ে গেছে।
‘ওহ শীট্’, মাথার মধ্যে জানালা দরোজা বন্ধ। আবার শো-শো-শো কলারের পাশের রগগুলো টান টান—
‘আমরা শালা আসলেই বোকাচোদা’ বখতিয়ার আক্ষেপ ঝাড়ে। ‘হাজার বছরের চেষ্টায় একজন বঙ্গবন্ধু বানাতে পেরেছিলাম। কিন্তু কী হলো? পুরো ব্যাপারটাই লেজে গোবরে কোরে ছাড়লো।’
‘ওইটুকুই ছিলো তার হাইয়েষ্ট পারফর্মেন্স। কি করা যাবে। প্রত্যেক মানুষেরই সীমাবদ্ধতা আছে।’ আসলেই আমরা হতভাগা, তা না হলে এতো বড়ো একটা মানুষের মধ্যে এই সব সীমাবদ্ধতা কেন থাকলো!
‘ডাইনে ডাইনে যাও। দেখো দেখো সামনে ট্রাক’— বখতিয়ারের সতর্ক পথ নির্দেশে আমাদের ঠিকানা অন্তজ পাড়ার প্রবেশ গলির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
বা-বা একেবারে জমজমাটি। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মাসুম হক, চলচ্চিত্র আন্দোলনের মাশরু শেখ, ভারত প্রত্যাগত কবি মখমল আহমেদ, এ্যাকশন ফটোগ্রাফার বাদশা, যৌন পত্রিকার সম্পাদক শেখ ইউনুস আর আমাদের নাটের গুরু হক ভাই নরক গুলজার করছে। সমাবেশে আমার দুই বন্ধু গল্পকার সৌরভ খান ও প্রেমিক মতলেব আলী নিষ্প্রভ উপগ্রহের মতো কোনা কাঞ্চিতে সেঁটে আছে। আমাদের দেখেই তারা দুজন বোকা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সবাই পরিচিত। ‘কি খবর?’ ‘এসেছো তাহলে’, ‘ও দুটোকে চাগাও’, ‘গুরু গুরু’– সরস অভ্যর্থনার ফুটন্ত কড়াইয়ে আমরা দুজন জায়গা কোরে বোসে পড়লাম। আহ একেবারে স্বর্গের বারান্দা।
সৌরভ আর মতলেব বোতল জমা দিয়ে আমাদের সাথে ভিড়ে গেল। খানিক দূরে খাটিয়ায় বোসে আছে মা— মানে আমাদের সবার মা। কৃষ্ণা। একবারে সাক্ষাৎ মা জননী। বাকির খাতা কারোরই ছোট নয়। মায় নগদ ধার হাওলাত পর্যন্ত। তিথি পার্বনে জংলীর মাংশের নিমন্ত্রন তো বাঁধা। আমার গোটা চারেক মুরিদ আছে। তার একজন ডিংরি, জানায়ে গেল ঘরে চা-পাতি আর শবজি আছে, ইচ্ছে হলে খাওয়া যেতে পারে। ওসব পরে হবে। আগে গলা ভেজানো চাই। ‘আপ্পারা রান্ডো পায়েটো, কোম্পানি সারা।’
বড়ো এক বোতল মাতৃভাষা টুলের উপর ল্যান্ড করলো। অগ্রজ নক্ষত্রেরা শেষ পর্যায় এসে পড়েছে। কথা বলছে সকলে। কেউ কারো কথা শুনছে না। চোখের পাতা ভারি, জিভ আড়ষ্ট।
‘বুজেচো মখমল, স্লা এখনকার তরুনদের যা অবস্থা না— কাগজে খান তিনেক লেখা ছাপা হলো তো ওমনি বোহেমিয়ান। আর বোহেমিয়ান মানেই তো— লে হালুয়া। মদ গাঁজা চরসের অন্ধকূপ। আর ভাবখানা কি! যেন আস্ত এক একটা বোদলেয়ার। মাসুম ভাই শান্তিপুরি উচ্চারনে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপিত হলেন।
বখতিয়ারের চোখে মুখে যেন একটা ঝিলিক খেলে গেল। মাত্র দু গেলাশেই ও গোলাবি হয়ে গেছে। ‘আমরা কিন্তু অগ্রজদেরকেই নিখুঁতভাবে অনুসরন করতে চেষ্টা করছি। কে কতোটা সফল হচ্ছি সেটা অন্য হিশেব। তাই না?’
মাসুম হকের জিভ আরো আড়ষ্ট হয়ে উঠলো এবং শব্দ উচ্চারনের সাথে সাথে তিনি তর্জনী তুলতে লাগলেন। ‘তোমাদের মতো বয়সে আমাদের মদের দোকানে দ্যাখা যেতো না।
বখতিয়ার যেন ইস্পাতের মতো টান টান হয়ে যায় ‘কিন্তু আপনারা যে বয়সে একটি স্কুলের মেয়েকে পটাতে চেষ্টা করেছেন সেই বয়সেই আমরা যুদ্ধ করেছি— অস্ত্র হাতে বনে জঙ্গলে ঘুরেছি। জান আর মৃত্যুকে রেখেছি এই হাতের মুঠোয়।’
‘ও মুক্তিযোদ্ধা! মুক্তিযোদ্ধাকে আমি চুদি—’ অবজ্ঞা ছিটালো মাসুম হক। আর সাথে সাথেই কে যেন বখতিয়ারের সারা মুখে সিন্দুরের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিলো। ‘বাজে কথা বলবেন না। আমরা এখানে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা আছি, আমাদের সামনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো বাজে কথা বল্লে আমরা শারীরিকভাবে আঘাত করবো।’ বখতিয়ার দাঁড়িয়ে পড়েছে।
‘বাল করবে! যদি আঘাতই তোমরা করতে পারতে তাহলে আর রাজাকার প্রধানমন্ত্রী হতো না। তোমরা পারো মদের দোকানে গ্লাস ভাঙতে, আর কিছু না— মাসুম ভাই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আর কি। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে মাশরু ভাই সঠিক সিদ্ধান্তটি গ্রহন করেন। ‘চলেন, আমাগো টাইম ওভার হয়ে গেছে। সাড়ে আটটায় পৌঁছাইতে হইবো। উইঠা পড়ি।’ একরকম খেদিয়েই সবাইকে নিয়ে মাশরু ভাই বেরিয়ে পড়েন। মখমল আহমদ তখন প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছেন।
গুমোটটা কেটে যেতেই হক ভাই-এর সরেস কন্ঠস্বর শোনা গেল ‘ও, এতোক্ষনে ব্যাপারটা পরিষ্কার হইলো। মানে তোমরা হইলা মিয়া দন্ত ন তরুন, মুদ্ধন্য না, মানে বুঝলা তো— ভুল বানানের তরুন।’ স্বভাব-সুলভ অট্টহাসিতে পরিবেশটি রম্য হয়ে ওঠে।
ওইটাই সই, দন্ত ন তরুন হয়েই থাকতে চাই। দন্ত ন-র মাত্রা আছে, জীবনে মাত্রা দরকার। মাত্রা না বুঝলেই মুশকিল— ছন্দ প’ড়ে যাবে। ছন্দ হচ্ছে সবচে’ প্রয়োজনীয় জিনিশ। জীবনে যে অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছে এবং অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে যাবে, তার জন্যে ছন্দ এবং মাত্রা যে কি দরকারি তা তার চে’ আর কে ভালো জানে! সৌরভ খান কাঁপা কাঁপা চিকোন মেয়েলি গলায় গান ধরলো ‘কলকল ছল ছল নদী করে টলমলো ঢেউ ভাঙে ঝড় তুফানে রে—’
‘খোগ্যায়ে বালাম, ম্যায় হায় একেলা হো-গা-ই—’ ধলা রহমান ঢুকলো কন্ঠে চল্লিশের দশক। আড্ডায় দুই রহমান হয়ে যাওয়ার কারনে একজন ধলা আর অন্যজন কালা রহমান। আপ্পাবার হাতে সিকি লিটারের একটা প্লাস্টিকের ক্যান ধরিয়ে দিয়ে রহমান ভাই সরব হলেন ‘দো পাইট—’ মতলেব বাক্যটি শেষ করে ‘একঠো টেবিল মে আর একঠো চিবি সাবকে লিয়ে।’ হাসির হল্লা ওঠে ‘উঁই উঁই হিঁইহ হিঁইহ্…
বুলবুলটা মারা গেল! শালা একটা ক্যালাস।’ হক ভাই বুজবুড়ি কাটে। জীবিত থাকলে এই ‘ক্যালাস’ নিয়েই এতোক্ষন লেগে যেতো— প্রথমে বাক্য বর্ষন এবং পরিশেষে হাতাহাতি। দুদিন কথা বন্ধ, তৃতীয় দিনে আবার যা তাই। চমৎকার ছিলো এদের সম্পর্ক। প্রাইমারি স্কুল থেকে এরা বন্ধু।
বুকের ভেতর কোথায় যেন মোচড় দিয়ে ওঠে ‘বেচারা!’
[অসমাপ্ত]
১৯৯১