শিবু আর রাক্ষসের কথা
‘অ্যাই শিবু—এদিকে শোন।’
শিবুর ইস্কুল যাবার পথে ফটিকদা তাকে প্রায়ই এইভাবে ডাকে।
ফটিকদা মানে পাগলা ফটিক।
জয়নারায়ণ বাবুদের বাড়ি ছাড়িয়ে চৌমাথার কাছটায় যেখানে একটা পুরোনো মর্চে-ধরা স্টীম রোলার আজ দশ বছর ধরে পড়ে আছে, তার ঠিক সামনেই ফটিকদার ছোট্ট টিনের চালওয়ালা বাড়ি। অষ্টপ্রহর দাওয়ায় বসে কী-যে খুটুর খুটুর কাজ করে ফটিকদা তা ও-ই জানে। শিবু শুধু জানে ফটিকদা খুব গরিব, আর লোকে বলে যে এককালে খুব বেশি পড়াশুনো করেই ফটিক পাগল হয়ে গেছে। শিবুর কিন্তু তার এক-একটা কথা শুনে মনে হয় যে তার মতো বুদ্ধিমান লোক খুব কমই আছে।
তবে এটা ঠিক যে ফটিকদার বেশির ভাগ কথাই আজগুবি আর পাগলাটে। ‘হ্যাঁরে, কাল চাঁদের পাশ-টা লক্ষ করেছিলি—বাঁ দিকটায় কেমন একটা শিং-এর মতো বেরিয়েছিল?’ ‘ক’দিন থেকে কাকগুলো কেমন নাকি-নাকি সুরে ডাকচে শুনেছিস? সব হোলসেল সর্দি লেগেছে!’
শিবুর হাসিও পায়, আবার মাঝে মাঝে বিরক্তিও লাগে। যেসব কথার কোন জবাব নেই, যার সত্যি করে কোন মানে হয় না, সেসব কথা শুনে তো খালি সময় নষ্ট। তাই এক-একদিন ফটিক ডাকলেও শিবু যায় না। ‘আজ সময় নেই ফটিকদা, আরেকদিন আসব,’ বলে সে সটান চলে যায় ইস্কুলে।
আজও সে ভেবেছিল যাবে না, কিন্তু ফটিকদা আজ যেন একটু বেশি চাপ দিল। ‘তোকে যা বলতে চাই, সেটা না শুনলে তোর ক্ষতি হবে।’
শিবু শুনেছে পাগলরা নাকি মাঝে মাঝে এমন সব সত্যি কথা বলে যা এমনি লোকেদের পক্ষে সম্ভবই না। তাই সে ক্ষতির কথা ভেবে ভয়ে ভয়ে ফটিকদার দিকে এগিয়ে গেল।
একটা হুঁকোর মধ্যে ডাবের জল ভরতে ভরতে ফটিক বলল, ‘জনার্দনবাবুকে লক্ষ করেছিস্?’
জনার্দনবাবু শিবুদের নতুন অঙ্কের মাস্টার। দিন দশেক হল এসেছেন।
শিবু বলল, ‘রোজই তো দেখছি। আজও তো প্রথমেই অঙ্কের ক্লাস।’
ফটিক জিভ দিয়ে ছিক্ করে একটা বিরক্ত হওয়ার শব্দ করে বলল, ‘দেখা আর লক্ষ করা এক জিনিস নয়, বুঝেছিস? বল তো, তুই যে বেল্টটা পরেছিস তাতে ক’টা ফুটো, শার্টটার ক’টা বোতাম? না দেখে বল তো?’
শিবু কোনটারই ঠিকমতো জবাব দিতে পারল না।
ফটিক বলল, ‘ওই দ্যাখ—তোর নিজের জিনিস, নিজে পরে আছিস, অথচ লক্ষই করিস নি। তেমনি জনার্দনবাবুকেও লক্ষ করিস নি তুই।’
‘কী লক্ষ করব? কোন্ জিনিসটা?’
হুঁকোতে কলকে লাগিয়ে গুড়ুক গুড়ুক করে দুটো টান দিয়ে ফটিক বলল, ‘এই ধর—দাঁত।’
‘দাঁত?’
‘হুঁ, দাঁত।’
‘কী করে লক্ষ করব? উনি যে হাসেন না।’
কথাটা ঠিক। রাগী না হলেও, ওরকম গম্ভীর মাস্টার শিবুদের ইস্কুলে আর নেই।
ফটিক বলল, ‘ঠিক আছে। এরপর যেদিন হাসবেন সেদিন ওঁর দাঁতগুলো খালি লক্ষ করিস। তারপর আমায় এসে বলে যাস কী দেখলি।
আশ্চর্য ব্যাপার! ঠিক সেই দিনই অঙ্কের ক্লাসে জনার্দনবাবুর একটা হাসির কারণ ঘটে গেল।
জ্যামিতি পড়াতে পড়াতে শঙ্করকে চতুর্ভুজ মানে জিজ্ঞেস করাতে শঙ্কর বলল, ‘ঠাকুর, স্যার! নারায়ণ, স্যার!’—আর তাই শুনে জনার্দনবাবু খ্যাক খ্যাক করে রাগী হাসি হেসে উঠলেন, আর শিবুর চোখ তৎক্ষণাৎ চলে গেল তাঁর দাঁতের দিকে।
বিকেলে ফেরার পথে ফটিকদার বাড়ির সামনে পৌঁছে শিবু দেখল সে হামানদিস্তায় কী যেন হেঁচছে। শিবুকে দেখে ফটিক বলল, ‘এই ওষুধটা যদি উতরে যায় তো দেখিস বহুরূপীর মতো রং চেঞ্জ করতে পারব।’
শিবু বলল, ‘ফটিকদা, দেখেছি।’
‘কী দেখেছিস?’
‘দাঁত।’
‘ও। কিরকম দেখলি?’
‘এমনি সব ঠিক আছে, খালি পানের দাগ, আর দুটো দাঁত একটু বড়।’
‘কোন্ দুটো?’
‘পাশের। এইখানের।’ শিবু আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
‘হুঁ। ওখানের দাঁতকে কী বলে জানিস?’
‘কী?’
‘শ্বদন্ত। কুকুরে দাঁত।’
‘ও।’
‘এত বড় কুকুরে দাঁত মানুষের পাটিতে দেখেছিস এর আগে?’
‘না বোধহয়।’
‘কুকুরে দাঁত কাদের বড় হয় জানিস?’
‘কুকুরের?’
‘ইডিয়ট! শুধু কুকুরের কেন? সব মাংসাশী জন্তু-জানোয়ারেরই শ্বদন্ত বড় হয়। ওই দাঁত দিয়েই তো কাঁচামাংস ছিঁড়ে হাড়গোড় চিবিয়ে খায় ওরা। বিশেষ করে হিংস্র জানোয়ারেরা।’
‘ও!’
‘আর কার বড় হয় শ্বদন্ত?
শিবু আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল। আর কার হবে আবার? মানুষ আর জন্তু-জানোয়ার—এ ছাড়া দাঁতওয়ালা জিনিস আর আছেই বা কী?
ফটিকদা তার হামানদিস্তায় একটা আখরোট আর এক চিমটে কালোজিরে ফেলে দিয়ে বলল, ‘জানিস না তো? রাক্ষস।’
রাক্ষস? রাক্ষসের সঙ্গে জনার্দনবাবুর কী? আর আজকের দিনে রাক্ষসের কথা কেন? সে তো ছিল রূপকথার বই-এর পাতার মধ্যে। রাক্ষস-খোক্কসের গল্প তো শিবু কত শুনেছে, পড়েছে। তাদের মুলোর মত দাঁত, কুলোর মত—
শিবু চমকে উঠল।
কুলোর মত পিঠ!
জনার্দনবাবুর পিঠটা তো ঠিক সিধে নয়। কেমন যেন কুঁজো-কুঁজো কুলো-কুলো ভাব। শিবু কাকে যেন বলতে শুনেছে যে, জনার্দনবাবুর বাতের রোগ, তাই পিঠ টেনে চলতে পারেন না।
মুলোর মত দাঁত, কুলোর মত পিঠ—আর? আর যেন কী হয় রাক্ষসের?
আর ভাঁটার মত চোখ।
জনার্দনবাবুর চোখ কি শিবু লক্ষ করেছে? না, করে নি। করা সম্ভব নয়। কারণ জনার্দনবাবু চশমা পরেন, আর সে চশমার কাঁচ ঘোলাটে। চোখের রং লাল কি বেগ্নি কি সবুজ তা বোঝবার কোন উপায় নেই।
শিবু অঙ্কেতে খুব ভালো। লসাগু, গসাগু, সিঁড়িভাঙা, বুদ্ধির অঙ্ক—কোনটাতেই সে ঠেকে না। অন্তত কিছুদিন আগে অবধি সে ঠেকত না। প্যারীচরণবাবু যখন অঙ্কের মাস্টার ছিলেন তখন তো রোজ সে দশে দশ পেয়েছে। কিন্তু এই দু’দিন থেকে শিবুর একটু গণ্ডগোল হচ্ছে। কাল সে মনের জোরে অনেকটা সামলে নিয়েছিল নিজেকে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে মনে মনে বলতে আরম্ভ করেছিল, ‘রাক্ষস হতে পারে না। মানুষ রাক্ষস হয় না। আগে হলেও, এখন হয় না। জনার্দনবাবু রাক্ষস নয়, জনার্দনবাবু মানুষ।’ ক্লাসে বসে বসেও সে মনে মনে এই কথাগুলো আওড়াচ্ছিল। এমন সময় একটা ব্যাপার হয়ে গেল।
জনার্দনবাবু ব্ল্যাকবোর্ডে একটা অঙ্ক লিখেই কেমন জানি অন্যমনস্ক হয়ে তাঁর চশমাটা খুলে সেটা চাদরের খুঁট দিয়ে মুছতে লাগলেন। আর ঠিক সেই সময় তাঁর সঙ্গে শিবুর চোখাচোখি হয়ে গেল।
শিবু যা দেখলে তাতে তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
জনার্দনবাবুর চোখের সাদাটা সাদা নয়। সেটা লাল। টকটকে লাল। পল্টুর পেনসিলটার মত লাল।
এটা দেখার পরে শিবুর পর পর তিনটে অঙ্ক ভুল হয়ে গেল।
এমনিতেই শিবু ছুটির পরে সোজা বাড়ি ফেরে না। সে প্রথমে যায় মিত্তিরদের বাগানে। ছাতিম গাছটার গুঁড়ির আশপাশটায় যে লজ্জাবতী লতাগুলো আছে, সেগুলোর প্রত্যেকটাকে সে আঙুলে টোকা মেরে মেরে ঘুম পাড়ায়। তারপর সে যায় সরলদীঘির পাড়ে। দীঘির জলে রোজ সে খোলামকুচি দিয়ে ব্যাঙবাজি করে। সাত বারের বেশি লাফ খাইয়ে যদি খোলামকুচি ওপারে পৌঁছতে পারে তবেই সে হরেনের রেকর্ড ব্রেক করবে। সরলদীঘির পরেই ইঁটখোলার মাঠ। সেখানে থরে থরে সাজানো ইটের পাঁজার উপর প্রায় দশ মিনিট জিমন্যাষ্টিক করে তারপর কোনাকুনিভাবে মাঠ পেরিয়ে সে বাড়ির খিড়কি দরজায় এসে পৌঁছায়।
আজ সে মিত্তিরদের বাগানে এসে দেখল লজ্জাবতী লতাগুলো নেতিয়ে পড়ে আছে। এরকম হল কেন? কেউ কি হেঁটে গেছে লতাগুলোর উপর দিয়ে? এ পথে তো বড় একটা কেউ আসে না।
শিবুর আর ইচ্ছে করল না বাগানে থাকতে। কেমন যেন একটা থমথমে-ছমছমে ভাব। সন্ধেটা যেন আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘনিয়ে আসছে। কাকগুলো কি রোজই এত চেঁচায়—না আজ কোন কারণে ভয় পেয়েছে?
সরলদীঘির পাড়ে বইগুলো হাত থেকে নামিয়ে রেখেই শিবুর মনে হল আজ আর ব্যাঙবাজি করা উচিত হবে না। আজ বেশিক্ষণ বাইরে থাকাই তার উচিত নয়। থাকলে হয়তো বিপদ হবে।
একটা বিরাট কী যেন মাছ দীঘির মাঝখানে ঘাই মেরে ঘপাৎ করে ডুবে গেল।
শিবু বইগুলো হাতে তুলে নিল। ওপারের অশ্বত্থগাছটায় বাদুড়গুলি ঝুলে গাছটা একেবারে কালো করে দিয়েছে। একটু পরেই ওদের ওড়ার সময় হবে। ফটিকদা বলেছে বাদুড়ের মাথায় কেন রক্ত ওঠে না সেটা একদিন বুঝিয়ে দেবে।
জামরুল গাছটার পেছনের ঝোপড়াটা থেকে একটা তক্ষক ডেকে উঠল—‘খোক্কস! খোক্কস! খোক্কস!
শিবু বাড়ির দিকে রওনা দিল!
ইঁটখোলার কাছাকাছি আসতেই সে দেখতে পেল জনার্দনবাবুকে।
ইঁটের পাঁজাগুলোর হাত বিশেক দূরেই একটা কুলগাছ। তার পাশেই দুটো ছাগলছানা খেলা করছে, আর জনার্দনবাবু বই আর ছাতা হাতে একদৃষ্টে ছাগলদুটোর খেলা দেখছেন।
শিবু প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে কোন শব্দ না করে একটা ইঁটের পাঁজার উপর উঠে দুটো ইটের মধ্যিখানের ফাঁক দিয়ে তার মাথাটা যতদূর যায় গলিয়ে জনার্দনবাবুকে দেখতে লাগল।
সে লক্ষ করল যে, ছাগলগুলোকে দেখতে দেখতে জনার্দনবাবু দু’বার তাঁর ডান হাতটা উপুড় করে ঠোঁটের নীচে বুলোলেন।
জিভ দিয়ে জল না পড়লে মানুষ কক্ষনো ওভাবে ঠোঁটের নীচটা মোছে না।
তারপর শিবু দেখল জনার্দনবাবু ওত পাতার মত করে নীচু হলেন।
তারপর হঠাৎ হাত থেকে বই ছাতা ফেলে দিয়ে খপ করে একটা ছাগলের বাচ্চাকে জাপটে ধরে কোলে তুলে নিলেন। আর সেইসঙ্গে শিবু শুনতে পেল ছাগলছানার চীৎকার, আর জনার্দনবাবুর হাসি।
শিবু একলাফে ইটের পাঁজা থেকে নেমে আরেক লাফে আরেকটা পাঁজা টপকাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে চিৎপটাং।
‘কে ওখানে?’
কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠতে গিয়ে শিবু দেখে জনার্দনবাবু হাত থেকে ছাগল নামিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছেন।
‘কে, শিবরাম? চোট পেয়েছ নাকি? ওখানে কী করছিলে?
শিবু কথা বলতে গিয়ে দেখল তার গলা শুকিয়ে গেছে। তার ইচ্ছে করছিল উল্টে জনার্দনবাবুকে জিজ্ঞেস করে—আপনি ওখানে কী করছিলেন? আপনার কোলে ছাগল কেন? আপনার জিভে জল কেন?
জনার্দনবাবু শিবুর কাছে এসে বললেন, ‘ধরো, আমার হাত ধরো।’
শিবু কোনমতে হাত না ধরেই উঠে দাঁড়াল।
‘তোমার বাড়ি তো কাছেই, না?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘ওই লালবাড়িটা কী?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘ও।’
‘আমি যাই স্যার।’
‘ও কি, রক্ত নাকি?
শিবু দেখল তার হাঁটু ছড়ে গিয়ে সামান্য একটু রক্ত চুইয়ে পড়ছে, আর জনার্দনবাবু একদৃষ্টে সেই দিকে চেয়ে রয়েছেন, আর তাঁর চশমার কাঁচ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
‘আমি যাই স্যার।’
শিবু কোনমতে বইগুলো খচমচিয়ে মাটি থেকে তুলে নিল।
‘শোনো শিবরাম।’
জনার্দনবাবু এগিয়ে এসে শিবুর পিঠে একটা হাত রাখলেন। শিবুর বুকে কে যেন দুরমুশ পিটতে লাগল।
‘তোমাকে একা পেয়ে ভালই হয়েছে। একটা কথা তোমায় জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম। তোমার অঙ্কের ব্যাপারে কোন অসুবিধে হচ্ছে কি? আজ এত সহজ সহজ অঙ্ক ভুল হল কেন? যদি কোন অসুবিধে হয় তো ছুটির পর আমার বাড়িতে এসো-না, আমি তোমায় দেখিয়ে দেব’খন। অঙ্কেতে যে ফুলমার্কস পাওয়া যায়! পরীক্ষায় ভালো করতে হলে অঙ্কেতে তো ভালো করতেই হবে। তুমি আসবে আমার বাড়ি?’
শিবু কোনমতে দু’ পা পিছিয়ে জনার্দনবাবুর হাত পিঠ থেকে সরিয়ে নিয়ে ঢোক গিলে বলল, ‘না স্যার। আমি নিজেই পারব স্যার। কালই ঠিক হয়ে যাবে!’
‘বেশ। তবে অসুবিধে হলে বলো। আর আমাকে এত ভয় পাও কেন, অ্যাঁ! এত ভয় পাও কেন? আমি কি রাক্ষস যে, কামড়ে দেব? অ্যাঁ? হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ…’
ইঁটখোলা থেকে এক দৌড়ে বাড়ি ফিরে এসে শিবু দেখল সামনের ঘরে হীরেন জ্যাঠা এসেছেন। হীরেন জ্যাঠা কলকাতায় থাকেন, মাছ ধরার খুব শখ। বাবা আর হীরেন জ্যাঠা প্রায়ই রবিবার রবিবার মাছ ধরতে যান সরলদীঘিতে। এবারও বোধহয় যাবেন, কেননা শিবু দেখল পিঁপড়ের ডিম দিয়ে মাছের চার বানানো রয়েছে।
শিবু আরও দেখল যে, হীরেন জ্যাঠা এবার বন্দুকও এনেছেন। সোনারপুরের ঝিলে নাকি চখা মারতে যাবেন বাবা আর হীরেন জ্যাঠা। বাবাও বন্দুক চালান, তবে হীরেন জ্যাঠার মত অত ভালো টিপ নেই।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়া করে শোবার ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে শিবু ভাবতে লাগল। জনার্দনবাবু যে রাক্ষস সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই তার মনে। ভাগ্যিস ফটিকদা তাকে সাবধান করে দিয়েছিল। নাহলে আজকে ইঁটখোলাতেই হয়তো…। শিবু আর ভাবতে পারল না।
বাইরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। ভজুদের বাড়ি অবধি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সামনে শিবুর পরীক্ষা, তাই রাত্রে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে ভোরে উঠে পড়তে হয় ওকে। বাতি না নিভোলে ওর আবার ঘুম আসে না। অবিশ্যি চাঁদনি রাত না হলে আজ সে বাতি জ্বালিয়ে রাখত, কারণ তা না হলে বোধহয় তার ভয়ে ঘুম আসত না। মা-ও এখনো ঘরে আসেন নি। বাবা আর হীরেন জ্যাঠা সবে খেতে বসেছেন, মা তাঁদের খাওয়াচ্ছেন।
জানালার বাইরে জ্যোৎস্নার আলোয় চিকচিকে বেলগাছটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে শিবুর ঘুম এসে গিয়েছিল, এমন সময় একটা জিনিস দেখে তার ঘুম ছুটে গিয়ে হাতের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠল।
দূর থেকে একটা লোক তারই জানালার দিকে এগিয়ে আসছে।
লোকটা একটু কুঁজো, আর তার চোখে চশমা। চশমার কাঁচটা চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে।
জনার্দনবাবু!
শিবুর গলা আবার শুকিয়ে এল।
জনার্দনবাবু পা টিপে টিপে বেলগাছটা পেরিয়ে ক্রমশ তার জানালার খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন। শিবু তার পাশবালিশটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।
কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক চেয়ে একটু যেন ইতস্তত করে জনার্দনবাবু ডেকে উঠলেন, ‘শিঁবরাম আঁছ?’
এ কী? গলাটা এমন খোনা কেন জনার্দনবাবুর? রাত্তিরে কি তাঁর রাক্ষুসে ভাবটা আরো বেড়ে যায়?
আবার ডাক এল—‘শিঁবরাম!’
এবারে শিবুর মা দাওয়া থেকে বলে উঠলেন, ‘অ শিবু! বাইরে কে ডাকছে যে! এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?
জনার্দনবাবু জানালা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মিনিটখানেক পর শিবু তাঁর গলা শুনতে পেল, ‘শিবরাম তার জ্যামিতির বইটা ইঁটখোলায় ফেলে এসেছিল। কাল আবার রবিবার তো, ইস্কুলে দেখা হবে না, আর ও তো আবার সকালে উঠে পড়বে, তাই—’
তারপর কিছুক্ষণ বিড়বিড় ফিসফিস কী কথা হল শিবু শুনতে পেল না। শুধু শেষটায় শুনল বাবার কথা, ‘হ্যাঁ, তা যদি বলেন সে তো ভালই। আপনার ওখানেই হয় পাঠিয়ে দেব।…হ্যাঁ কাল থেকে।’
শিবুর ঠোঁট নড়ল না, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না, কিন্তু তার মন চীৎকার করে বলতে লাগল, না, না, না! আমি যাব না, কিছুতেই না। তোমরা কিছু জান না। উনি যে রাক্ষস! গেলেই যে আমায় খেয়ে ফেলবেন!
পরদিন রবিবার হলেও শিবু সকালেই চলে গেল ফটিকদার বাড়ি। কত কী যে বলার আছে তার ফটিকদাকে!
ফটিকদা তাকে দেখে বলল, ‘স্বাগতম্! তোর বাড়ির কাছে ফণীমনসা আছে না? আমায় কিছু এনে দিস তো দা দিয়ে কেটে। একটা নতুন রান্না মাথায় এসেছে।’
শিবু ধরা গলায় বলল, ‘ফটিকদা!’
‘কী?’
‘তুমি যে বলছিলে না জনার্দনবাবু রাক্ষস—’
‘কে বলল?’
‘তুমিই তো বললে।’
‘মোটেই না। তুই আমার কথাগুলোও লক্ষ করিস না।’
‘কেন?’
‘আমি বললাম তুই জনার্দনবাবুর দাঁতগুলো লক্ষ করিস। তারপর তুই এসে বললি তাঁর কুকুরে দাঁতগুলো বড় বড়। তারপর আমি বললাম ওরকম কুকুরে দাঁত রাক্ষসেরও হয় বলে শুনেছি। তার মানে কি জনার্দনবাবু রাক্ষস?’
‘তাহলে উনি রাক্ষস নন?’
‘তা তো বলি নি।’
‘তবে?’
ফটিকদা দাওয়া থেকে উঠে একটা মস্ত হাই তুলে বলল, ‘তোর জ্যাঠাকে যেন দেখলাম আজ। মাছ ধরতে এসেছেন বুঝি? ছিপ দিয়ে বাঘ ধরেছিল একবার ম্যাকার্ডি সাহেব। সে গল্প জানিস?’
শিবু মরিয়া হয়ে বলে উঠল, ‘ফটিকদা, কী আজেবাজে বকছ তুমি? এদিকে জনার্দনবাবু যে সত্যিই রাক্ষস। আমি জানি তিনি রাক্ষস। আমি অনেক কিছু দেখেছি আর শুনেছি।’
তারপর শিবু গত দু’দিনের ঘটনা ফটিককে বলল। ফটিক সব শুনেটুনে গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, ‘হুঁ। তা তুই এ ব্যাপারে কী করবি কিছু ঠিক করেছিস?’
‘তুমি বলে দাও না ফটিকদা! তুমি তো সব জান।’
ফটিক মাথা হেঁট করে ভাবতে লাগল।
শিবু ফাঁক পেয়ে বলল, ‘আমার বাড়িতে এখন একটা বন্দুক আছে।’
ফটিক দাঁত খিচিয়ে উঠল।
‘তোর যেমন বুদ্ধি! বন্দুক আছে তো কী হয়েছে? বন্দুক দিয়ে রাক্ষস মারবি? গুলি রিবাউন্ড করে এসে যে মারছে তারই গায়ে লাগবে।’
‘তাই বুঝি?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। বোকসন্দর?’
‘তাহলে? শিবুর গলা মিহি হয়ে আসছিল। ‘তাহলে কী হবে ফটিকদা? আমাকে যে আবার বাবা আজ থেকে—’
‘মেলা বকিস নি। বকে বকে কানের চিংড়ি নড়িয়ে দিলি।’
প্রায় দু’ মিনিট ভাবার পর ফটিক শিবুর দিকে ফিরে বলল, ‘যেতেই হবে।’
‘কোথায়?’
‘জনার্দনবাবুর বাড়ি।’
‘সে কী?’
‘ওর কুষ্ঠীটা জানতে হবে। আমি এখনো শিওর নই। কুষ্ঠী দেখলে সব বেরিয়ে যাবে। বাক্স-প্যাঁটরা ঘাঁটলে কুষ্ঠীটা বেরোবে নিশ্চয়ই।’
‘কিন্তু—’
‘তুই থাম্। আগে প্ল্যানটা শোন্। আমরা দু’জনে যাব দুপুরবেলা। আজ রোববার, লোকটা বাড়ি থাকবে। তুই বাড়ির পিছন দিকটায় গিয়ে জনার্দনবাবুকে ডাকবি। বাইরে এলে বলবি অঙ্ক বুঝতে এসেছিস। তারপর দু’-একটা আজেবাজে বকে লোকটাকে আটকে রেখে দিবি। আমি সেই ফাঁকে বাড়ির সামনের দিক দিয়ে ভেতরে গিয়ে কুষ্ঠীটা বের করে নিয়ে আসব। তারপর তুই এদিক দিয়ে পালাবি, আমি ওদিক দিয়ে পালাব। ব্যস্।’
‘তারপর?’ শিবুর যে প্ল্যানটা খুব ভালো লেগেছিল তা নয়, কিন্তু ফটিকদার উপর নির্ভর করা ছাড়া তো আর কোন রাস্তাই নেই।
‘তারপর তুই বিকেলে আবার আমার বাড়ি আসবি। আমি ততক্ষণে কুষ্ঠীটা দেখে কিছু পুরনো পুথিপত্তর ঘেঁটে একেবারে রেডি থাকব। যদি দেখি জনার্দনবাবু সত্যিই রাক্ষস, তাহলে তার ব্যবস্থা আমার জানা আছে। তুই ঘাবড়াস না। আর যদি দেখি রাক্ষস নয়, তাহলে তো আর ভাববার কিছুই নেই।’
ফটিকদা বলেছিল দুপুরে বেরোবে। শিবু তাই খাওয়া-দাওয়া করে গিয়ে ফটিকের বাড়ি হাজির হল। মিনিট পাঁচেক পর ফটিকদা বেরিয়ে এসে বলল, ‘আমার হুলোটার আবার নস্যির বাতিক হয়েছে। ঝামেলা কি কম? শিবু লক্ষ করল ফটিকদার হাতে একজোড়া ছেড়া চামড়ার দস্তানা, আর একটা সাইকেলের ঘণ্টা। ঘণ্টাটা সে শিবুর হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা তুই রাখ। বিপদ হলে বাজাস। আমি এসে তোকে বাঁচাব।’
পুবপাড়ার একেবারে শেষ মাথায় দোলগোবিন্দবাবুদের বাড়ির পরেই জনার্দন মাস্টারের বাড়ি। একা মানুষ, বাড়িতে চাকর পর্যন্ত নেই। বাইরে থেকে বাড়িতে যে একটা রাক্ষস আছে সেটা বোঝবার কোন উপায় নেই।
কিছুটা রাস্তা বাকি থাকতেই শিবু আর ফটিকদা আলাদা হয়ে গেল।
বাড়ির পিছনে পৌঁছে শিবু বুঝল যে, তার আবার গলা শুকিয়ে আসছে। জনার্দনবাবুকে ডাকতে গিয়ে তার যদি গলা দিয়ে আওয়াজ না বেরোয়?
বাড়ির পিছনে পাঁচিল, তার গায়ে একটা দরজা, আর দরজার কাছেই একটা পেয়ারা গাছ। গাছের আশপাশ আগাছার জঙ্গলে ভরা।
শিবু পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল। আর বেশি দেরি করলে কিন্তু ওদিকে ফটিকদার সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে।
আরেকটু বেশি সাহস পাবার জন্য শিবু পেয়ারা গাছটায় একটা হাত দিয়ে ভর করে ‘মাস্টারমশাই’ বলে ডাকতে যাবে, এমন সময় একটা খচমচ শব্দ পেয়ে সে চমকে নীচের দিকে চেয়ে দেখে একটা কালভৈরবী লতার ঝোপের ভিতর একটা গিরগিটি চলে গেল। আর গিরগিটিটা যেখান দিয়ে গেল তার ঠিক পাশেই সাদা সাদা কী যেন পড়ে রয়েছে।
একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঝোপটা ফাঁক করতেই শিবু দেখল—সর্বনাশ! এ যে হাড়! জন্তুর হাড়! কী জন্তু? বেড়াল, না কুকুর—না ছাগল?
‘কী দেখছ ওখানে শিঁবরাম?’
শিবুর শিরদাঁড়ায় একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে পিছন ফিরে দেখল জনার্দনবাবু খিড়কি দরজা ফাঁক করে গলা বাড়িয়ে তার দিকে অদ্ভুতভাবে চেয়ে আছে।
‘কিছু হাঁরিয়েছ নাকি?’
‘না স্যার…আ-আমি…’
‘তুঁমি কি আমার কাঁছেই আঁসছিলে? তাহলে পেঁছনের দঁরজা দিয়ে কেন? এসো—ভেঁতরে এসো।’
শিবু পেছোতে গিয়ে দেখল তার একটা পা লতায় জড়িয়ে গেছে।
‘আঁমার আবার কাঁল থেকে একটু সঁর্দিজ্বর হয়েছে। রাত্রে আবার তোমার বাড়ি গেলাম তো! তুমি তঁখন ঘুমোচ্ছিলে।’
শিবুর এত তাড়াতাড়ি পালানো চলবে না। ওদিকে ফটিকদার যে কাজই শেষ হবে না।
মাঝখান থেকে হয়তো সে ধরাই পড়ে যাবে। একবার মনে হল ঘণ্টাটা বাজাবে। তারপর মনে হল, এখনও তো সত্যি করে তার বিপদ কিছু হয়নি। ফটিকদা হয়তো রেগেই যাবে।।
‘তুঁমি নীচু হয়ে কী দেখছিলে বঁল তো?’
শিবু চট করে কোন উত্তর পেল না। জনার্দনবাবু এগিয়ে এসে বললেন, ‘জায়গাটা বড় ময়লা। ওঁদিকে না যাওয়াই ভাঁলো। ভুলো কুঁকুরটা কোত্থেকে মাংসের হাড়গোড় এনে ফেঁলে ওখানে। এঁক-এঁকবার ভাবি ধমক দেব—কিন্তু পারি না। আমার আবার জন্তু-জানোয়ার ভীষণ ভাঁলো লাগে কিনা!’
জনার্দনবাবু তাঁর হাতের পিছন দিয়ে ঠোঁটের নীচটা মুছলেন।
‘তুমি ভেঁতরে চলো শিবু—তোমার অঙ্কের ব্যাঁপারটা—’
আর দেরি নয়! শিবু ‘আজ থাক, কাল আসব’ বলে, উলটোমুখো হয়ে এক দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে, নীলুর বাড়ি, কার্তিকের বাড়ি, হরেনের বাড়ি পেরিয়ে একেবারে সা-বাবুদের পোড়োবাড়ির গেটের রোয়াকে এসে বসে হাঁফ ছাড়ল। আজকের ব্যাপারটা সে কোনদিন ভুলবে না। তার যে এত সাহস হতে পারে সে নিজেই ভাবতে পারে নি।
বিকেল হতে না হতে শিবু ফটিকের বাড়ি হাজির হল। না জানি কুষ্ঠী থেকে কী বার করেছে ফটিকদা!
শিবুকে দেখেই ফটিক মাথা নাড়ল।
‘সব গোলমাল হয়ে গেছে রে!’
‘কেন ফটিকদা? কুষ্ঠী পাও নি?’
‘তা পেয়েছি। তোর অঙ্কের মাস্টার যে রাক্ষস সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। শুধু রাক্ষস নয়—পিরিণ্ডি রাক্ষস। সাংঘাতিক ব্যাপার। এরা পুরোপুরি রাক্ষস ছিল সাড়ে-তিনশ পুরুষ আগে। কিন্তু এত তেজ যে, এক-আধটা হাফ-রাক্ষস এখনও বেরিয়ে পড়ে এদের মধ্যে। পুরো রাক্ষস তো এখন সভ্য দেশে কোথাও নেই—এক আছে আফ্রিকার কোন কোন অঞ্চলে, আর ব্রেজিল, বোর্নিও এইসব জায়গায়। তবে হাফ-রাক্ষস এখনও কচি-কদাচিৎ সভ্যদেশে পাওয়া যায়। জনার্দনবাবু ওই ওদের মধ্যে একজন।’
‘তাহলে গোলমাল কেন? শিবুর গলাটা একটু কেঁপে গেল। ফটিকদা হাল ছেড়ে দিলে সে চোখে অন্ধকার দেখবে। ‘তুমি যে সকালে বললে তোমার ব্যবস্থা জানা আছে?’
‘আমার জানা নেই এমন জিনিস নেই।’
‘তবে?’
ফটিকদা একটু গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর বলল, ‘মাছের পেটে কী থাকে?’
এই রে! ফটিকদার আবার পাগলামি আরম্ভ হয়েছে। শিবু এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘ফটিকদা, রাক্ষসের কথা হচ্ছিল, তুমি আবার মাছ আনলে কেন?’
‘কী থাকে?’ ফটিক গর্জন করে উঠল।
‘প-পট্কা?’ ফটিকদার গলা শুনে শিবুর রীতিমতো ভয় লাগতে আরম্ভ করেছিল।
‘তোর মাথা! এত কম বিদ্যে দিয়ে তো তুই বকের বকলসটাও লাগাতে পারবি। শোন্। আড়াই বছর বয়সে একটা শ্লোক শিখেছিলাম, এখনও মনে আছে—
নর কি বানর কিম্বা অন্য জানোয়ার
জেনে রাখো হৃৎপিণ্ডে রহে প্রাণ তার।
রাক্ষসের প্রাণ জেনো মৎস্যের উদরে,
সেই হেতু রাক্ষস সহজে না মরে॥’
তাই তো! শিবু তো কত রূপকথার গল্পে পড়েছে মাছের পেটে থাকে রাক্ষসের প্রাণ। এটা তো তার মনে হওয়া উচিত ছিল!
শ্লোকটা আওড়ে ফটিক বলল, ‘দুপুরে যখন গেলি ওর বাড়ি, জনার্দন রাক্ষসকে কেমন দেখলি?’
‘বলল সর্দিজ্বর হয়েছে।’
‘হবেই তো! ফটিকদার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। ‘হবে না? প্রাণ নিয়ে টানাটানি যে! যেই কাৎলা উঠেছে ছিপে, অমনি জ্বর! এ তো হবেই।’
তারপর শিবুর দিকে এগিয়ে এসে তার শার্টের সামনেটা খপ করে হাতের মুঠোয় খামচে ধরে ফটিকদা বলল, এখনও হয়তো সময় আছে। তোর জ্যাঠা এই আধঘণ্টা আগে সরলদীঘির ওই আধমনি কাৎলাটা ধরে নিয়ে বাড়ি ফিরছে। আমি দেখেই আন্দাজ করেছি যে ওটার পেটের মধ্যেই আছে জনার্দন রাক্ষসের প্রাণ। এখন জ্বরের কথাটা শুনে আরো শিওর মনে হচ্ছে। ওই মাছটাকে চিরে দেখতে হবে।’
‘কিন্তু সেটা কী করে হবে ফটিকদা?’
‘সহজে হবে না। তোরই ওপর নির্ভর করছে। আর এটা না করতে পারলে যে তোর কী বিপদ হতে পারে সেটা ভাবতেও আমার ঘাম ছুটছে।’
ঘণ্টাখানেক পরে শিবু একটা দড়ির মাথায় সরলদীঘির আধমনি কাৎলাটাকে বেঁধে সেটাকে হিঁচড়ে হিঁচড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ফটিকের বাড়ির সামনে এসে হাজির হল।
ফটিক বলল, ‘কেউ জানতে পারে নি তো?’
শিবু বলল, ‘না। বাবা চান করছিলেন, জ্যাঠামশাই শ্রীনিবাসকে দিয়ে দলাইমলাই করাচ্ছিলেন, আর মা সন্ধে দিচ্ছিলেন। নারকোলের দড়ি খুঁজতে দেরি হল। আর উঃ, যা ভারী!
‘কুছ পরোয়া নেই। মাস্ল হবে।’
ফটিক মাছ নিয়ে ভিতরে চলে গেল। শিবু ভাবল—কী আশ্চর্য বুদ্ধি আর জ্ঞান ফটিকদার। ওর জন্যই বোধ হয় শিবু এ যাত্রা রক্ষা পাবে। হে ভগবান—জনার্দন রাক্ষসের প্রাণটা যেন থাকে মাছটার পেটে।
মিনিট দশেক পরে ফটিক বেরিয়ে এসে শিবুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘নে। এটা হাতছাড়া করবি না কক্ষনো। রাত্রে বালিশের নীচে নিয়ে শুবি। ইস্কুলে যাবার সময় প্যান্টের বাঁ পকেটে নিয়ে নিবি। এটা হাতে থাকলে রাক্ষস কেঁচো, আর হামানদিস্তায় গুঁড়িয়ে ফেললে রাক্ষস ডেড। আমার মতে গুঁড়োবার দরকার নেই, হাতে রাখলেই যথেষ্ট। কারণ অনেক সময় দেখা গেছে পিরিণ্ডি রাক্ষস চুয়ান্ন বছর বয়সের পর থেকে পুরো মানুষ হয়ে গেছে। তোর জনার্দন মাস্টারের বয়স এখন তিপ্পান্ন বছর এগারো মাস ছাব্বিশ দিন।
শিবু এবার সাহস করে তার হাতের তেলোর দিকে চেয়ে দেখল—একটা ভিজে-ভিজে মিছরির দানার মত পাথর নতুন-ওঠা চাঁদের আলোয় চকচক করছে।
পাথরটাকে পকেটে নিয়ে শিবু বাড়ির দিকে ঘুরল। পিছন থেকে ফটিকদা বলল, ‘হাতে আঁশটে গন্ধ রয়েছে তোর। ভালো করে ধুয়ে নিস। আর বোকা সেজে থাকিস, নইলে ধরা পড়ে যাবি।
পরদিন অঙ্কের ক্লাসে জনার্দনবাবু ঠিক ঢোকবার আগে একটা হাঁচি দিলেন, আর তার পরেই চৌকাঠে ঠোক্কর খেয়ে তাঁর জুতোর সুকতলা হাঁ হয়ে গেল। শিবুর বাঁ হাত তখন তার প্যান্টের বাঁ পকেটের ভিতর।
ক্লাসের শেষে শিবু অনেকদিন পরে অঙ্কে দশে দশ পেল।