ইউনিভার্সিটিতে আমরা যখন পড়াশোনা করেছি, তখন লেখাপড়া ছিল একটু পুরনো ধাঁচের। তিন বছর পড়ার পর অনার্স পরীক্ষা শুরু হতো। সেটা শেষ করার পর এক বছরের মাস্টার্স। আমরা যে বছর পাস করেছি, সেই বছর থেকে মাস্টার্সের জন্য নতুন একটা বিভাগ খোলা হলো। সেটার নাম থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স।
এটা মোটামুটি আধুনিক একটা বিভাগ। আমেরিকান কায়দায় দুটি সেমিস্টার। দুই সেমিস্টারে পাঁচটি পাঁচটি করে ১০টি আধুনিক কোর্স। আমরা প্রথমদিকের ১০ জন – ছয়জন ছেলে ও চারজন মেয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে এই আধুনিক বিভাগে ভর্তি হয়ে গেলাম। বাকি ছেলেমেয়েরা পুরনো বিভাগে রয়ে গেল।
এক বিভাগের ছেলেমেয়েদের দুই ভাগে ভাগ করলে যা হয়, তা-ই হলো। দুই ভাগের মাঝে একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। তারা দলে ভারী, পুরো ডিপার্টমেন্টই তাদের। আমাদের মাত্র একজন শিক্ষক, নিজেদের ক্লাসরুম নেই, ল্যাব নেই, বসার জায়গা নেই, খানিকটা উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়াই। পুরোনো বন্ধুবান্ধবরা কখনো আমাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে, কখনো হিংসা করে।
আমার নিজের সমস্যা একটু অন্য রকম, সারা জীবন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসেছি। যখনই সম্ভব হয়েছে পার্সেন্টেজ দিয়ে সটকে পড়েছি। বড় ক্লাস, কেউ টের পায়নি। ছোট ক্লাসে সেটা করা যায় না, হাতেগোনা ১০ জন মাত্র ছাত্রছাত্রী, স্যারেরা সবার মুখ চেনেন, পালানোর উপায় নেই। আমি মুখ কালো করে ক্লাস করি। নতুন বিভাগ, স্যারদের খুব উত্সাহ, আমরা নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাই না।
এর মাঝে নিঃশ্বাস নেওয়ার একটু সময় হলো। শীতের শুরুতে ঠিক করা হলো, আমরা শিক্ষা সফরে যাব। নামেই শিক্ষা সফর – এর মাঝে শিক্ষার কিছু নেই। কদিন সবাই মিলে কক্সবাজার, রাঙামাটি এ রকম মনোরম জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। শিক্ষা সফরে যাওয়ার জন্য সব বিভাগ ইউনিভার্সিটি থেকে টাকা পেয়েছে, সবার জন্য সমান টাকা এবং আমরা হঠাত্ করে আবিষ্কার করলাম, অন্যান্য বিভাগে ৫০-৬০ জন যে টাকা পেয়েছে, আমাদের মাত্র ১০ জনে সেই টাকা। আমরা মোটামুটি রাজার হালে ঘুরে বেড়াতে পারব।
তবে একটি সমস্যা এবং সেটি গুরুতর। আমরা সব ছেলেমেয়ে মিলে যেতে চাই, সঙ্গে একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক না থাকলে মেয়েদের বাবা-মায়েরা যত বড় শিক্ষা সফরই হোক, সেখানে যেতে দেবেন না। আমাদের এই নতুন থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স বিভাগের শিক্ষক মাত্র একজন এবং তিনি তখন বিদেশে। আমাদের সঙ্গে যাওয়ার কেউ নেই! আমরা শুকনো মুখে কয়েকজন স্যারের কাছে আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করলাম এবং তাদের মাঝখান থেকে একজন স্যার রাজি হয়ে গেলেন!
সদ্য বিদেশ থেকে এসেছেন স্যার। অত্যন্ত আধুনিক মানুষ। এখনো বিয়ে থা করেননি কিন্তু খুব দায়িত্বশীল। আমরা মহা খুশি। একদিন মহা উত্সাহে কক্সবাজার বেড়াতে বের হলাম। নির্দিষ্ট সময়ে সবাই কমলাপুর স্টেশনে হাজির হয়েছি, ফাস্র্ট ক্লাসের টিকিট কেনা হয়েছে। শেষ মুহূর্তে একজন মেয়ে বাদ পড়েছে, অন্য তিনজনের বাবা-মা তাদের তুলে দিতে এসেছেন। বাবা-মায়েরা স্যারকে বললেন, ‘আপনি একটু এদের দেখে রাখবেন।’
স্যার বললেন, ‘অবশ্যই দেখে রাখব।’
বাবা-মায়েরা বললেন, ‘আজকালকার ছেলেদের কোনো বিশ্বাস নেই, সঙ্গে আপনি যাচ্ছেন বলে এদের যেতে দিচ্ছি।’
স্যার বললেন, ‘আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। আমি আছি।’
আমরা ট্রেনে ওঠলাম, গার্ড হুইসেল দিল এবং আমাদের আনন্দভ্রমণ শুরু হলো। শুরুতেই একটা ছোট সমস্যা দেখা দিল, স্যার সদ্য বিদেশ থেকে এসেছেন, কিছুতেই যেখানে খুশি সেখানে কিছু ফেলতে দেবেন না! কলা খাওয়ার পর কলার ছিলকে, ডাব খাওয়ার পর ডাবের খোসা, বিস্কুট খাওয়ার পর বিস্কুটের প্যাকেট ময়লার ঝুড়িতে ফেলতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, কোথাও ময়লার ঝুড়ি নেই। তাই স্যার নিয়মমাফিক আমাদের হাতে বর্জ্য পদার্থ তুলে দিতে লাগলেন এবং ময়লার ঝুড়িতে ফেলে আসার ভান করে আমরা এদিক-সেদিক ছুড়ে ফেলতে লাগলাম।
প্রথম চট্টগ্রাম শহর, সেখান থেকে রাঙামাটি, আমরা মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি। স্যারের বাবা খুব বড় সরকারি কর্মকর্তা। আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করে রাখছেন। কাজেই যেখানেই যাই সেখানে গাড়ি, ট্রলার, গেস্টহাউস, খাবার-দাবার সব রেডি থাকে। আমরা রাজার হালে থাকি। রাঙামাটিতে বিশাল হ্রদের টলটলে নীল পানি, সেখানে সাঁতার কেটে বালুবেলায় শুয়ে থাকি। স্যার ট্রলারের গলুইয়ে বসে কবিতা লিখেন, সব মিলিয়ে চমত্কার সময় কাটছে।
শিক্ষা সফরের বড় অংশটি রেখেছি কক্সবাজারের জন্য। তাই যেদিন রাতে কক্সবাজার পৌঁছেছি আমাদের আনন্দ আর ধরে না। হোটেলে জিনিসপত্র রেখে তখনই বের হয়ে গেলাম, ঝাউবনের এক ধরনের উদাসী বাতাসের শব্দ, সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে, নির্জন বালুবেলা, জ্যোত্স্নার আলোতে রহস্যময় পরিবেশ – এক কথায় আমরা ব্যাকুল হয়ে গেলাম। আমাদের ভেতর একজন এর মাঝে গাঁজা খাওয়ার অভ্যাস করেছে, সে গাঁজা টেনে আরও ব্যাকুল হয়ে গেল। এই চমত্কার সমুদ্রতটে আমরা পাঁচ-ছয় দিন কাটাবচিন্তা করেই আমাদের মন পুলকিত হতে থাকে।
আমাদের স্ফূর্তি দেখে খোদা মুচকি হাসলেন। পরদিন সকালে দেখলাম, স্যার ব্যস্ত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন, খুব গম্ভীর হয়ে কিছু টেলিফোন করে আমাদের সবাইকে ডাকলেন। আমরা চিন্তিতভাবে স্যারকে ঘিরে দাঁড়ালাম, স্যার বললেন, ‘একটা বড় সমস্যা হয়ে গেছে।’
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী সমস্যা?’
‘বলতে পারো একধরনের ইমার্জেন্সি।’
আমরা শুকনো গলায় বললাম, ‘কী ইমার্জেন্সি!’
স্যার বললেন, ‘সেটা তোমাদের বলতে পারব না, কিন্তু আমাকে এক্ষুনি ফিরে যেতে হবে।’
আমরা মাথায় হাত দিয়ে বললাম, ‘সর্বনাশ! তাহলে আমাদের শিক্ষা সফরের কী হবে?’
স্যার বললেন, ‘আমি খুব দুঃখিত। আমাকে যেতেই হবে।’
‘আপনি চলে গেলে আমরা থাকি কেমন করে? সঙ্গে মেয়েরা আছে।’
একজন বলল, ‘গার্জিয়ানরা আপনি আছেন বলে মেয়েদের আসতে দিয়েছে।’
স্যার বললেন, ‘আমাকে ছাড়া তোমরা থাকতে চাইলে থাকো। কিন্তু আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।’
স্যার নিজের ব্যাগ গোছাতে শুরু করলেন। আমরা বিশাল লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেরা কথা বলতে থাকি। মেয়েদের একজন বলল, ‘আমরা বড় হয়েছি না? স্যার ছাড়া থাকি, সমস্যা কোথায়?’
আমরা হাতে কিল দিয়ে বললাম, ‘সমস্যা কোথায়?’ একজন একটু ইতস্তত করছিল, তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলাম।
স্যার একটু পরেই প্লেন ধরে ঢাকা রওনা হয়ে গেলেন। এখন শিক্ষকবিহীন আমরা নয়জন ছেলেমেয়ে। স্যার থাকার সময় আনন্দ-স্ফূর্তি একটু রয়েসয়ে করতে হতো, এখন আমাদের লাগাম ছাড়া স্ফূর্তি করতে শুরু করলাম। বালুর মাঝে গর্ত করে সারা শরীর পুঁতে রেখে শুধু মাথাটা বের করে রেখেছি। জিবে কামড় দিয়ে পড়ে থাকি, লোকজন চমকে ওঠে। বালুবেলায় একটা মুণ্ডু পড়ে থাকতে দেখে চমকে ওঠে। সমুদ্রের পানিতে লাফাঝাঁপি করার আনন্দ অন্য রকম, একজন চ্যাংদোলা শব্দটার অর্থ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করায় সবাই মিলে তাকে ধরে চ্যাংদোলা করে সমুদ্রের পানিতে ফেলে দিলাম। গভীর রাতে আমরা কাঁধে লাকড়ি আর খাবার নিয়ে বালুবেলায় চলে যেতাম, আগুন জ্বালিয়ে শরীর গরম করে বেসুরো গলায় গান গাইতাম। কম বয়সে আনন্দ করার জন্য যা করার কথা, তার কিছুই বাকি থাকল না।
শেষ পর্যন্ত কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই শিক্ষা সফর শেষ করে আমরা ফিরে আসতে শুরু করেছি। প্রথমে বাসে করে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে ঢাকায়। যতই ঢাকার কাছে আসছি, আমাদের ভেতর ততই এক ধরনের দুশ্চিন্তা চেপে বসছে। কমলাপুর স্টেশনে মেয়েদের বাবা-মায়েরা তাদের নিতে আসবেন, যখন দেখবেন স্যার নেই, তাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে। কমবয়সী ছেলেমেয়েরা কোনো অভিভাবক ছাড়া কক্সবাজারে ঘুরে বেড়িয়েছে, বাবা-মায়েরা সেটাকে মোটেও ভালো চোখে দেখবেন না। মেয়ে তিনজনকে বিশেষ দুশ্চিন্তিত দেখা গেল। বাবা-মায়েরা তাদের বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবেন।
ট্রেন টঙ্গী এসে থেমেছে, আর কয়েক স্টেশন পরেই কমলাপুর। এমন সময় আমাদের বগির দরজায় টুক-টুক শব্দ। দরজা খুলতেই দেখি, স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা আনন্দে চিত্কার করে উঠলাম, ‘স্যার আপনি?’
স্যার মৃদু হাসলেন, বললেন, ‘কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।’
আমরা বললাম, ‘বলব না, স্যার।’
ট্রেন এসে কমলাপুর থামল। মেয়েদের নেওয়ার জন্য তাদের বাবা-মায়েরা এসেছেন। স্যার আমাদের সবাইকে নিয়ে ট্রেন থেকে নামলেন। বাবা-মায়েরা এগিয়ে এসে বললেন, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সবাইকে সুস্থ শরীরে ফিরিয়ে এনেছেন।’
স্যার কোনো কথা না বলে মৃদু হাসলেন। আরেকজন বললেন, ‘ছেলেমেয়েরা যা পাজি, নিশ্চয়ই আপনাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে।’
স্যার এবারও মৃদু হাসলেন।
‘আপনার মতো এ রকম দায়িত্বশীল মানুষ সঙ্গে ছিলেন বলে যেতে দিয়েছিলাম, তা না হলে কি যেতে দিই?’
স্যার আবার একটু মৃদু হাসলেন।
আমরাও হাসলাম, আমাদের হাসি অবশ্য আরও অনেক বিস্তৃত হলো।
bhaloi.
খুব ই ই ভাল লাগল এ রখম একটা সাইট পেয়ে।
ধন্যবাদ
লব কুশ নামে হবে সীতার নন্দন।
উভয়ে শিভাবে তুমি বেদ রামায়ণ।।
এগার সহস্র বর্ষ পালিবেন ক্ষিতি।
পুত্রে রাজ্য গিয়া স্বর্গে করিবেন গতি।।
এতদিন পরে আর উত্তর পাওয়ার কোন প্রয়োজন বা ইচ্ছা আপনার আছে কিনা জানি না, কিন্তু মনে হল উত্তরটা দেওয়া দরকার। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে ১০৮টি নীলপদ্মে দেবী দুর্গার পূজা করলে মনস্কামনা পূর্ণ হতে বাধ্য। রামায়ণে আছে রামচন্দ্র রাবণবধের মানসে ১০৮ টি নীলপদ্মে দেবীর পূজার ব্রত নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত ১০৬টির বেশি জোগাড় করতে পারেন নি। তখন নিজের নীলপদ্মতুল্য চোখদুটি উপড়ে তিনি দেবীর পূজা করেন। দেবী সন্তুষ্টা হয়ে তাঁর চোখদুটি ফিরিয়ে দেন এবং রাবণবধের উপায় বলে দেন। এখানেও এক দেবীর সন্তুষ্টি বিধায় আর নিজের মনোকামনা পূরণের ইচ্ছার কথা রয়েছে, সম্ভবত তাই ১০৮ পদ্মের কথা এসেছে। 🙂
asadharon uttor..