শান্তুকে পাওয়া যাচ্ছে না

শান্তুকে পাওয়া যাচ্ছে না

আজ অফিসে খুব খাটুনি গেছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে আটটা। ফিরেই রাণুকে বললাম, ঠাকুরকে বললা, যা হয়েছে তা-ই দেবে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। খেয়েই ঘুমোব।

রাণু বলল, আজ ন্যাশনাল প্রোগ্রাম আছে। ভীমসেন যোশীর গান শুনবে না?

বললাম, তুমি বরং বাইরের ঘরে বসে শোনো। আমার ভীষণ ঘুম পেয়েছে।

গাঢ় ঘুমের মধ্যে কেউ ডাকলে প্রথমে কিছুই বোঝা যায় না। অচেতন থেকে অবচেতনে, অবচেতন থেকে চেতনে আসতে মস্তিষ্ক অনেকখানি সময় নিয়ে নেয় তখন।

চোখ মেলে দেখি, রাণু আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে। মুখে উদবেগের সঙ্গে অপরাধের ছাপ।

বলল, শুনছ! দিদি এক্ষুনি ফোন করেছিল, শান্তকে পাওয়া যাচ্ছেনা।

বলেই, অপরাধের গলায় বলল, তোমাকে তুলতে হল কাঁচা ঘুম থেকে।

ততক্ষণে আমি উঠে বসেছি। আমার মা-বাবা অনেকদিন হলই চলে গেছেন। দিদি-জামাইবাবুই আমাদের সব। আমরা আজ যে কোনোরকমে পায়ে দাঁড়িয়েছি, আমি ও পিন্টু, রাণু যে আমার ঘরে এসেছে, এসবের পেছনেই দিদি। তাই দিদির ছেলে শান্তুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এখবর জানার পরও আমাকে না-জাগালে রাণুর উপর রাগই করতাম।

পায়জামা গেঞ্জি পরেই বাইরের ঘরে এসে ফোন করলাম।

ডায়াল ঘোরাবার সময়েই রাণু বলল, প্রফেসারের বাড়ি গেছিল পড়তে, সেখানে থেকে ফেরার কথা ন-টায়। এগারোটা বেজে যেতে, দিদি খুবই চিন্তা করছেন। জামাইবাবুও এখানে নেই। পাটনা গেছেন, মামলা নিয়ে।

দিদিই ফোন ধরল।

আমি বললাম, পুলিস, হাসপাতাল এসবে খোঁজ করেছ?

দিদি বলল, ওর সব বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনদেরও ফোন করে দেখলাম কারো বাড়ি গেছে। কিনা। কোথাও নেই। মাস্টারমশায়ের বাড়িতেও কানুকে গাড়ি দিয়ে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বললেন, সাড়ে আটটাতে বেরিয়ে গেছে অন্য দু-জনের সঙ্গে। রতনও তো কলকাতায় নেই। আমি জানি না, কিছু ভাবতে পারছি না। তোরা যা ভালো মনে করিস, কর এসে।

রতনদা দিদির দেওর। রতনদাও কলকাতায় নেই। দিদির বাড়ি পৌঁছে রতনদার শালা ছবুকে নিয়ে আমরা সব কটা হাসপাতালে খোঁজ করলাম দক্ষিণের। তারপর থানায় গেলাম।

ও সি ছিলেন না। যিনি ছিলেন, তিনি টেবলের উপর পা তুলে, বুড়ো আঙুল আর মধ্যমার মধ্যে সিগারেট ধরে গাঁজার মতো টান দিচ্ছিলেন।

আমাদের শান্তু যে হারিয়ে গেছে তা নিয়ে আমাদের উত্তেজনা ও উদবেগের শেষ ছিল না। কিন্তু ভদ্রলোক নির্বিকার।

পা নামিয়ে বললেন, বসেন বসেন। পোলায় করে কী?

ছবু বলল, এবার প্রি-ইউ দেবে।

প্রি-টেস্ট কেমন দিছিল? আমার ছোটটাও দিতাছে প্রি-ইউ এইবার।

ফল ভালো করেনি। আমি লজ্জিত গলায় বললাম।

ভদ্রলোক কান খোঁচাতে খোঁচাতে বললেন, বুঝছি! চিন্তার কোনোই কারণ নাই। খামোখা দৌড়াদৌড়ি কইরেন্যন না। বাড়ি যাইয়া ঘুমান। ভয়ের কিছুই নাই। পোলায় আপনেই আইস্যা পড়বখন।

ছবু উত্তেজিত হয়ে বলল, আপনি তো বেশ ক্যাজুয়ালি নির্বিকারভাবে কথা বলছেন। আমরাই বুঝছি আমাদের কী হচ্ছে!

উনি নিরুপায় গলায় বললেন, আমাগো বিকার কি ভালো? আমাগো উত্তেজিত হওন শোভা পায় না! আমরা হইলাম গিয়া একজিকিউটিভ।

বলেই, খাতাটা বড়িয়ে দিয়ে বললেন, একখান ডাইরি লিইখ্যা দিয়া বাড়ি গিয়া ঘুমান দেহি।

ছবু উত্তেজিত হয়ে বলল, আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই?

উনি নিরুত্তাপ গলায় বললেন, বিলক্ষণ আচ্ছা। আপনাগো একটাই ছাওয়াল। আর আমাগো ছাওয়াল অনেক। মিনিটে মিনিটে হারাইতাছে।

আমরা বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলাম।

দারোগাবাবু ঘুমোতে বললেও, ঘুমোতে পারলাম না আমরা কেউই। পাটনাতে জামাইবাবুকে। ট্রাঙ্ককল করলাম। জামাইবাবু পাটনা হাই কোর্টে মামলা করতে গেছেন। সব শুনে বললেন, আই অ্যাম নট বদারড। কেন পালিয়েছে, তাও আমি জানি। সে বাড়ি ফিরুক আর নাই ফিরুক আমার কিছুই এসে যায় না। সো ফার আই অ্যাম কনসার্ড। হি ইজ ডেড।

আমি বললাম, কী বলছেন আপনি?

জামাইবাবু বললেন, ইয়েস! হি ইজ ডেড।

দিদিকে রিসিভার দিতেই দিদি কেঁদে ফেলল।

বলল, ডেড? শান্তু ডেড! ছিঃ ছিঃ তুমি কী বাবা? না শত্রু?

জামাইবাবু বললেন, শত্রু।

দিদি রিসিভারটা আমাকে দিল।

জামাইবাবু বললেন, থানায় বলে রাখ পিন্টু, যদি ইডিয়টটাকে পায় তাহলে একদিন আটকে রেখে যেন এমন মার মারে যাতে জীবনে আর পালাবার নাম না-করে। হাড়-গোড় না-ভেঙে যত মার মারা যায়, যেন মারে।

একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, আমাকে তোরা আর বিরক্ত করবি না। কমপ্লিকেটেড মামলা নিয়ে এসেছি। পোলিটিকাল মার্ডার, ম্যাটার পার্ট-হার্ড হয়ে আছে। তিন দিনের আগে আমি ফিরতে পারব না।

তারপর বললেন, কোর্টের বার-লাইব্রেরির ফোন নম্বরটাও লিখে রাখ। ইডিয়টটা ফিরলেই ফোন করে দিস একটা।

আমি রাণুকে একটা ফোন করে দিয়ে বললাম, সাবধানে থাকতে। ও একেবারে একা আছে বাড়িতে। তখন মনের এমন একটা অবস্থা সকলের যে, মনে হচ্ছিল, রাণুকেও কেউ চুরি করে নিতে পারে। কোনো বিপদ হতে পারে ওর। তখন মনে হচ্ছিল যে, পৃথিবীর সব লোক চোর, বদমাইশ, ছেলেধরা।

ছবু বলল, দিদি, শান্তুর কারো সঙ্গে লাভ-টাভ ছিল নাকি?

কী যে বলিস? দিদি বললেন। ক্লাস টেন-এ পড়ে।

ছবু বলল, প্রেমের আবার বয়স!

দিদি আহত হল।

কী আর করব? আমি তো দিদির ভাই। এখন পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন অনেকেই অনেক কথা বলবে, ভালো-মন্দ। সবই সইতে হবে। শান্তু যে এমন করতে পারে একথা আমিই ভাবতে পারছিনা আর তার মা-বাবা কী করে ভাববে?

দিদি বলল, শুনলি তোর জামাইবাবুর কথা? খুনের মামলা করে করে খুনিদের সঙ্গে উঠে বসে নিজেও খুনি-টুনি হয়ে গেছে। নইলে এমন করে কথা কেউ বলতে পারে। ছিঃ ছিঃ….

পরমুহূর্তেই দিদি বলল, খুনি-টুনি নিয়ে কাজ করে তোর জামাইবাবু। কেউ আমার ছেলেটাকে গুম করে, খুন-টুন…।

বলেই, দিদি মুখে হাত চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

দিদিদের বিরাট ড্রয়িংরুমের বড়ো গ্রান্ডফাদার ঘড়িটা টিকটিক করে আওয়াজ করছিল। রাত দুটো এখন। সময় চলে যাচ্ছে অথচ কিছুই করার নেই আমাদের।

জামশেদপুরে বড়োমামা থাকেন, শান্তুর খুব প্রিয় দাদু। সেখানে ফোন করে জানানো হল। জামাইবাবুর পরের বোন থাকে নাগপুরে। সেখানেও। কটকে থাকেন জামাইবাবুর ছোটো বোন, সান্তুর সবচেয়ে কাছের লোক। ছোটো পিসি। সেখানেও তাদের কটকচণ্ডী রোডের বাড়িতে ফোন করে বলা হল আজ এক্কেবারে ভোরে জগন্নাথ এক্সপ্রেস কটক স্টেশনে ঢোকার সময়ই যেন। স্টেশনে সদলবলে সমীর উপস্থিত থাকে। ট্রেন থেকে নামলেই সঙ্গে সঙ্গে শান্তকে গ্রেপ্তার করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে যেন আমাদের জানায়।

আজ রাতে শুধু আমরা নয়, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লোকে বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছে।

জামাইবাবুর পরিবারে শান্তই একমাত্র ছেলে। ওঁদের ভাই বোন সকলেরই মেয়ে। তাই শান্তর বিশেষ আদর ওই পরিবারে। আর আমাদেরও তো একটিমাত্রই ভাগনে।

একমাত্র জামাইবাবুই বোধ হয় ঘুমোচ্ছেন পাটনার এয়ারকন্ডিশানড পাটলিপুত্র হোটেলে।

ছবু আমাকে বলল, কত টাকা ছিল ওর সঙ্গে।

টাকা?

দিদি আকাশ থেকে পড়ল।

বলল, ওর হাতে কখনো টাকাপয়সা দিই না আমরা। যখন যা দরকার কিনে দিই। টাকা কোথায় পাবে ও?

দিদিকে বললাম, তুমি গিয়ে শোও দিদি। বাড়িতে সেডেটিভ আছে? ক্যাম্পোজ? বা অন্য কিছু? অ্যালজোলাম?

ছবু বলল, হ্যাঁ বউদি যান। শুয়ে পড়ুন। ঘুমের ওষুধ খেয়ে। আমরা তো আছি।

দিদি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল আমাদের মুখে। তারপর বলল, তোরা তো এখনও বাবা হোসনি, মা-বাবা হলে একথা বলতে পারতিস না। ওষুধ খেলেই বুঝি ঘুম আসে? রতনদাকেও বম্বেতে একটা ফোন করে দিল ছবু। কোম্পানির কাজে গেছে। গেস্ট হাউসেই উঠেছে।

রতনদা বলল, কালই সব ফেলে চলে আসব সকালেরফ্লাইটে।

ছবুর দিদি, মানে রতনদার স্ত্রীর একটা মেয়েলি অপারেশান হয়েছে। ছবুদের বাড়িতেই আছে মিলিদি।

আমি আর ছবু ড্রয়িংরুমে বসেছিলাম। টেলিফোনের কাছে। ছবু একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিল। শান্তুর যেসব বন্ধুর বাড়ি ফোন নেই তাদের বাড়ি গেছে কানু গাড়ি নিয়ে। তখনও ফেরেনি।

শান্তুটা আমাদের আত্মীয়স্বজনদের যত ছেলে-মেয়ে আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছেলে। খুব সুন্দর ছবি আঁকে। অতি মিষ্টি স্বভাব। বিনয়ী, নম্র, ভাব। কখনো ওকে কেউ সমবয়সিদের সঙ্গেও ঝগড়া করতে দেখেনি। বড়ো লাজুক, অন্তর্মুখী ছেলে। বাংলায় এবং ইংরেজিতে খুব। ভালো। অঙ্ক আর সায়ান্সের সাবজেক্টগুলো ওর একেবারেই ভালো লাগে না। কিছুতেই ও এঁটে উঠছে না। এর ফলে অত্যন্ত খারাপ রেজাল্ট করেছিল প্রি-টেস্টে। ক্লাস সেভেন থেকেই ক্রমাগত খারাপ রেজাল্ট করে আসছিল।

দিদির ধারণা যে, শান্তু নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল যে, ও কিছুতেই ফাইনাল টেস্ট পরীক্ষাতে অ্যালাও হবে না।

দিদি আড়ালে গেলে আমি ছবুকে বললাম, জামাইবাবুর ভয়েই শান্তু বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। খারাপ কিছু ঘটেনি, এমন হলেই ভালো।

ছবু বলল, সত্যিই অদ্ভুত কিন্তু আমাদের এই শিক্ষা ব্যবস্থা। কটা জিনিস জীবনে কাজে লাগে বল? আর বিষয়েরই বা কী বাহার! ভালো লাগুক না লাগুক, প্রত্যেক ছেলে-মেয়েকেই একগাদা বিষয় গিলতেই হবে। যে ছেলে ইংরেজি-বাংলাতে ষাট সত্তর করে নম্বর পাচ্ছে সে অঙ্ক আর সায়েন্স সাবজেক্টে ফেল করলেই অশিক্ষিত। উলটোটা হলেও অশিক্ষিত। মরাখাসীটির পেছনে করপোরেশনের একটা করে নীল-রঙা যেমন ছাপ থাকে তেমন প্রত্যেক ছেলে-মেয়ের পিছনেই একটা করে ছাপ না-মারলে এদেশে কেউই শিক্ষিত হয় না।

আমি বললাম, তার উপর এই পলিটিকস। স্কুল-কলেজে-ইউনিভারসিটি সবতেই পলিটিকস ঢুকে গেছে। দলবাজি হচ্ছে। লেখাপড়ার আর দরকার কি?

ছবু বলল, এসব বলে লাভ কী? আমাদের ছেলে হারিয়েছে বলেই এখন আমরা কনসার্নড। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে ভাবছি। পরমুহূর্তে ভুলে যাব। সব জেনেশুনেও আমরা কিছু কি। করি? এক পয়সা ট্রামভাড়া বাড়লে এখানে আন্দোলন হয়, গুলি চলে। লেখাপড়ার সর্বনাশ হচ্ছে, ইলেকট্রিসিটি নেই, কেরোসিন নেই, বন্দর বন্ধ, ট্রাম-বাসে ওঠা যায় না, ব্যাঙ্কে কাজ হয় না, রেল চলে না, তবু কিছুই ঘটে না এখানে। অত্যন্ত আন্তর্জাতিক, আঁতেল, সর্বজ্ঞ, সর্বংসহ আজকালকার এই বাঙালিরা। বুদ্ধিজীবী! হাঃ।

এমন সময় ফোনটা বাজল। এখন রাত তিনটে। জামাইবাবু!

জামাইবাবু বললেন, কী রে? ছোকরা ফিরেছে?

কে? আমি অবাক হয়ে শুধোলাম।

কে আবার? তোমাদের পেয়ারের ভাগ্নে।

বললাম, না।

হুমম…ম। রাণাং মাতুলক্রমঃ। যেমন সব মামারা, তেমন তো হবে ভাগ্নে। ভাগ্নের আর দোষটা কী?

তারপরই বললেন, ফিরলেই খবর দিতে ভুলিস না। আর শোন দিদিকে দেখিস। ফিট-টিট, হয়েছিল নাকি? ডাক্তার দত্তর নম্বর জানিস তো? ডঃ রায়কেও ফোন করিস।

আমি বললাম, ঠিক আছে।

তারপর বললেন, তোর দিদিই তো আদর দিয়ে দিয়ে এই অবস্থা করেছে। কী আর বলব। আমার প্রিন্স অফ ওয়েলস। কারখানার প্রোজেক্ট-রিপোর্ট পর্যন্ত হয়ে আছে আর…।

জামাইবাবু। ফোন ছেড়ে দিলেন।

আমি বললাম, বুঝলি ছবু, জামাইবাবুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ছেলে এখনও প্রি-ইউ পাশ করল না, আর এখনই কারখানার প্রোজেক্ট-রিপোর্ট। কারখানার মালিক তাকে করবেনই উনি!

তারপর বললাম, ছবু, তুই এবার বাড়ি যা। ওরা চিন্তা করছে। মিলিদি তো বটেই! ফোনটাও তো খারাপ তোদের, নইলে তো চিন্তার ছিল না কিছু।

ছবু ফুঁসে উঠে বলল, ফোনটা কি আজকে খারাপ। গত একমাস থেকে। পঞ্চাশবার ফোন করেছি অফিস থেকে, চিঠি লিখেছি, কে গ্রাহ্য করে? টেলিফোন অফিস থেকে একটা লোক ধরে এনে কিছু টাকা দিই যদি সঙ্গে সঙ্গে ফোন ঠিক হয়ে যাবে। তারপর বলল, তা আমি দিচ্ছি না। করাপশন সাপোর্ট করি না আমি। কাজ কে করে এখানে?

আমি বললাম, তুই মরগে যা! তোর ফোন জীবনেও ঠিক হবে না।

২.

রতনদা সকালের ফ্লাইটেই এসে পৌঁছেছিলেন। বাড়ি ভরতি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব। কলকাতার বাইরে যেখানে যেখানে খবর দেওয়া হয়েছিল সব জায়গা থেকে ঘনঘন ফোন আসছে।

জামাইবাবু নিজেও কাল রাতে খবর পাওয়ার পর থেকে পাঁচবার ফোন করেছেন।

বলেছেন, পাটনা থেকে লাইন পাওয়া সোজা। ভাবলাম, তোরা যদি চেষ্টা করে আমাকে না পাস।

অফিস থেকে দুপুরে ফিরে সোজা দিদির বাড়িতেই গেছিলাম। রাণুকে পাঠিয়ে দিয়েছি ওর মায়ের কাছে। রাণুর বিশেষ খবরটা কেউ জানে না। এমনকী রাণুর মাকেও জানায়নি রাণু।

অবশ্য শিওর না হয়ে জানাতে চাইও না আমরা কাউকেই। কাল ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। ডাক্তার কনফার্ম করলে তারপর ওর মা এবং দিদিকে জানানো হবে। কিন্তু যা অবস্থা। দিদির বাড়িতে, তাতে আমাদের আনন্দ-টানন্দ সব শুকিয়ে গেছে।

আমি চা খেয়ে, ভিতরের একটা ঘরে শুয়েছিলাম একটু।

এমন সময় ছবু দৌড়ে এসে বলল, এই, বড়দা এসেছেন।

জামাইবাবু চলে এসেছেন পাটনা থেকে। এসেই, সোজা শান্তুর ঘরে গেছেন।

শান্তুর ঘরের দেওয়াল নানারকম স্টিকারে ভরতি। ওর নিজের আঁকা ছবি আছে কয়েকখানা বই পত্র ছড়ানো। ক্রিকেটের ব্যাট ও উইকেট। রেকর্ডপ্লেয়ার। মেহেদি হাসান আর পপ মিউজিকের। এল পি। টানা-খোলা ওয়াদ্ৰোব থেকে ওর জিনস ঝুলছে, তালিমারা। পায়জামা-পাঞ্জাবি। জুতো। এদিকে-ওদিকে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির জার্নাল।

শান্তু ছেলেটা খুব অ্যাডভেঞ্চারাস। একবার আমার সঙ্গে সিমলিপালের জঙ্গলে গেছিল। খুব সাহসীও। পাশের বাড়ির হিতেনবাবু বলেছিলেন।

আমি জামাইবাবুর পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম।

অনেকক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে ঘরটার দিকে তাকিয়ে থেকে পিছন ফিরেই জামাইবাবু যেন নিজের মনেই বললেন, হোয়াট ফর? কীসের জন্যে? আমার কাজ, আমার দৌড়ে-বেড়ানো, এসব কার জন্যে? সব তো ওরই জন্যে। আর দ্যাখ, এই ছোকরা! হাইট অফ আনগ্রেটফুলনেস!

একটা একটা করে ঘন্টা যাচ্ছে আর আমাদের হতাশা বাড়ছে। চিন্তা বাড়ছে। চুপ-চাপ হয়ে ঠান্ডা মেরে যাচ্ছি আমরা।

দিদি অত্যন্ত উতলা ছিল কাল রাত থেকেই। কিন্তু হঠাৎ-ফিরে আসা জামাইবাবুর চোখে সে কী দেখেছিল তা দিদিই জানে। জামাইবাবুকে দিদি যতখানি বোঝে, ততখানি আমরা কী করে বুঝব? কিন্তু এখন দিদি শক্ত ও শান্ত হয়ে গেছে। ওঁকে দেখে, মনে হয় খুউব ভয় পেয়েছে। শান্তুর কারণের চেয়ে জামাইবাবুর কারণেই বেশি। মহিরুহকে ভুলুণ্ঠিত-করা ঝড়ের আগে প্রকৃতি যেমন থমথম করে, এ বাড়ির পরিবেশ তেমনই।

আমরা সকলে, এমনকী দিদিও আস্তে আস্তে কথা বলছি ও বলছে। দিদির জন্যে ডাক্তার ডাকার দরকার হয়নি। কিন্তু দিদির কথামতো আমি জামাইবাবুর জন্যেই একবার ডাঃ ভৌমিককে আসতে বলেছি। এও বলে দিয়েছি যে, উনি যেন বুঝতে না দেন জামাইবাবুকে কোনোমতেই যে, আমরা ওঁকে ডেকেছি। যেন এ-পাড়ায় এসেছিলেন কোথাও, হঠাৎই ঘুরে গেলেন আমাদের বাড়ি থেকে।

না। কোনো খবরই নেই। এখন রাত আটটা। চল্লিশ ঘন্টা হতে চলল। এখনও কোনো খবর নেই।

হাই কোর্টের বহুলোক এসেছিলেন। ফোন করেছিলেন। সলিসিটর, কাউনসেলর। একজন জজসাহেবও। অনেক জজসাহেব ফোন করেছিলেন।

কিছু খবর পেলেন?

না। এখনও কোনো খবর নেই।

একমাত্র খবর এই যে, খবর নেই।

আমরা সকলেই এবার যে যার বাড়ি ফিরে যাব।

এক এক করে উঠলাম আমরা।

৩.

পরদিন ভোরবেলা উঠেই রাণুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। বেরোবার আগে দিদির বাড়ি ফোন করেছিলাম। আজও কোনো খবর নেই।

রাণুর ইউরিন কালই দিয়ে এসেছিলাম। ডাক্তার রাণুকে পরীক্ষাও করলেন।

রাণু খুব লজ্জা পেয়েছিল।

পরীক্ষার পর ডাক্তারবাবু বাইরের চেম্বারে আমাদের সঙ্গে ফিরে এসে বলেছিলেন, ইয়েস। ইউ আর গোয়িং টু হ্যাভ আ বেবি। আর কথাটার উপর খুব জোর দিয়েছিলেন।

ট্যাক্সির পিছনের সিটে বসে আমি রাণুর ঊরুতে চিমটি কাটলাম।

রাণু, অস্ফুটে বলল, অসভ্য!

আমি বললাম, এবার? সিনিয়র বাই ওয়ান জেনারেশান! কী বল?

রাণু বলল, ফাজিল।

বললাম, চলো, দিদির বাড়ি যাই। তারপর তোমাকে বাড়ি পৌঁছে অফিস যাব।

ও বলল, আমি তো মায়ের কাছে যাব।

আমি বললাম, তা যাবে যেও, কিন্তু আমি অফিস থেকে ফেরার আগেই ফিরে এসো। তুমি তো আর আমার একার থাকবে না। একটা দুরন্ত দামাল ছেলে অথবা রিনরিনে গলার মিষ্টি মেয়ে তোমাকে দখল করে নেবে। কেড়ে নেবে, আমার কাছ থেকে। এই কটা মাস তোমাকে এক মুহূর্তও হারাতে চাই না আমি।

রাণু বলল, এখন থেকে মার কাছেই থাকতে হবে। মা অনেকদিন আগে থেকেই বলে রেখেছে মশাই। বাবারও তাই ইচ্ছা।

আমি বললাম, একদমই না। তোমার মাকে প্রমিস করে আসব যে, কোনোরকম দুষ্টুমি করব না আমি। লক্ষ্মী ছেলের মতো তোমার পাশে চুপটি থাকব শুধু। তোমার জন্যে আচার কিনে আনব। নানারকম বড়োবাজার থেকে। কিন্তু তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। একবারও আদর না-করে কাটিয়ে দেব এই ক-মাস। দেখো তুমি!

এত অসভ্য না!

বলে, রাণু লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।

ট্যাক্সি ড্রাইভার সর্দারজি। বাংলা বুঝছে না ভেবেই কথাবার্তা বলেছিলাম।

হঠাৎ ড্রাইভার পরিষ্কার বাংলায় বলল, সোজা যাব?

রাণু এবার আমার হাঁটুতে জোরে একটা চিমটি কাটল।

আমি বললাম, স্যরি।

ড্রাইভার বলল, আজ্ঞে?

আমি আরও ঘাবড়ে গিয়ে, তুতলে বললাম, ডানদিকে।

দিদির বাড়ির সামনে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নামতেই রতনদা দৌড়ে এল।

বলল, পিন্টু, দাদার অবস্থা প্রায় লুনাটিকের মতো।

কীসব বলছেন। পাগল হয়ে গেছেন জামাইবাবু।

রতনদা বললেন, আজ সকালের ডাকে শান্তর একটা চিঠি এসেছে। পরশু রাতে আসানসোল স্টেশন থেকে ড্রপ করেছিল। চিঠিটা পড়ে, কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছে দাদা। হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় গড়াগড়ি যাচ্ছে ছেলেমানুষের মতো। এ দৃশ্য দেখা যায় না। শান্তুটা যে কী করল!

আমি এগোতে এগোতে বললাম, কী লিখেছে শান্ত? চিঠিতে?

রতনদা পকেট থেকে একটা ইনল্যান্ড লেটার বের করে দিলেন।

রাণু, রতনদার সঙ্গে ভিতরে গেল। আমি ড্রয়িংরুমে বসে চিঠিটা খুললাম।

শান্তু লিখেছে,

মা ও বাবা,

আমি তোমাদের যোগ্য হতে পারলাম না।

আমার জন্যে তোমাদের কষ্টের ও অপমানের শেষ নেই। পাশের বাড়ির বুড়ি ক্লাসে প্রত্যেকবার সেকেন্ড-থার্ড হয়। রানি মাসিমার ছেলে, মনাও ফার্স্ট ডিভিসনে পাশ করবে অঙ্ক ও ফিজিক্স-এ লেটার পেয়ে। আর আমি জানি যে, আমি টেস্ট-এ অ্যালাওই হব না।

আমি তোমাদের অনেক দুঃখ দিয়েছি। কিন্তু তোমরা এটুকু জেন যে তোমাদের যতটুকু দুঃখ দিয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখ পেয়েছি আমি নিজে।

আমাকে তোমরা ভুলে যেও। মনে করো যে, আমি মরে গেছি।

সকলের কাছেই বড়োলোক হওয়াটা, সুখে-থাকাটাই কিংবা ডাক্তার, উকিল অথবা ভদ্রলোক কেরানি হওয়াটাই একমাত্র ব্যাপার নয়। আমি যা হতে চাই, আমি তাই-ই হব। আমি ছবি। আঁকব। গান গাইব। এবং লেখক হব।

যদি তা নাই-ই পারি, তাহলে ফুটপাথে পানের দোকান দেব। অথবা তেলেভাজার। যদি আমার এই পরিচয় তোমাদের কখনও গর্বিত করে, সেদিনই ফিরে আসব নিজে স্বাবলম্বী হয়ে।

আর যদি লজ্জিত করে তাহলে আর কখনো ফিরব না।

তোমাদের ভালোবাসা, স্নেহ-মমতার ঋণ কোনোদিনও শোধ করতে পারব না।

বাবা-মায়ের ঋণ কখনো শোধ করা যায় না।

আমি জানি।

তোমরা দুজনে আমাকে ক্ষমা কোরো। ইতি–

তোমাদের অযোগ্য ছেলে শান্তু।

চিঠিটা পড়ে আমার চোখ ছলছল করে উঠল।

নরম, লাজুক স্বল্পবাক, একটু মেয়েলি, স্বচ্ছল মা-বাবার একমাত্র ছেলে শান্তুর মধ্যে যে এমন একজন দৃঢ় মেরুদণ্ডের পুরুষমানুষ লুকিয়ে ছিল তা আমি কখনো ভাবতেও পারিনি। শান্তর মা বাবাও কি জানতেন?

জামাইবাবু রাগ করে বলেছিলেন, নরাণাং মাতুলক্রমঃ।

কিন্তু আমি জানি যে, কথাটা সত্যি নয়।

হলে, শান্তুর মামা হিসেবে আমারও শান্তুর মতোই চারিত্রিক দৃঢ়তা থাকত।

আমি কীই-বা করেছি জীবনে? সাধারণ ছাত্র। দিদি-জামাইবাবুর পৃষ্ঠপোষকতায় লেখাপড়া শিখেছি। সাধারণ হয়েও আমার যোগ্যতার চাইতে অনেক বড়ো মাপের একটা চাকরি পেয়েছি। জামাইবাবুরই কল্যাণে। নিজের জীবনকে ইচ্ছানুযায়ী চালিত যে করা যায়, একথা ভাবার মতো মনের জোরই আমার ছিল না। শান্তুর মতো আরাম ও আদরের জীবনের সমস্ত পাহারা স্বেচ্ছায়। ছেড়ে গিয়ে নিজের ভাগ্য অন্বেষণের জন্যে অজানা গন্তব্যে পাড়ি দেবার মতো সাহসও আমার ছিল না। কখনো এসব কথা ভাবিও না। জীবন মানে, মোটামুটি একটা ভালো চাকরি, ভালো থাকা, ভালো পরা, একজন মিষ্টি স্ত্রী। মধ্যবিত্ত বাঙালির অল্প সুখের, অল্প সাধের আটপৌরে জীবন। এই-ই মোক্ষ। এইটুকুই জানতাম। এ ছাড়াও যে কিছু…

ছোট্ট শান্তর প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মন নুয়ে এল।

রাণু উদবিগ্ন হয়ে দৌড়ে এসে ডাকল আমাকে বলল, অ্যাই, তাড়াতাড়ি এসো জামাইবাবু ডাকছেন তোমাকে।

ঘরে ঢুকে দেখি, দিদি ঘরের কোণায় চেয়ারে পাথরের মতো বসে। আর জামাইবাবু খাটের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছেন। চোখ বসে গেছে। চুল অনেক বেশি পেকে গেছে রাতারাতি।

আমাকে দেখেই বললেন, দ্যাখ, দ্যাখ রে। তোর আদরের বোনপো আমার কী দশা করেছে। দ্যাখ। ও যদি এই-ই চেয়েছিল তো একবার আমাকে বলল না কেন? আমাদের ও ছাড়া আর কে আছে বল? ওর জন্যেই তো সব, সব কিছু। শান্তু কি একবার আমাকে বলতে পারত না যে, ও কী হতে চায়?

আমি মুখ নীচু করে ভাবছিলাম, বললে, আপনি কি শুনতেন জামাইবাবু? ও চলে যাবার আগে ওর আলাদা অস্তিত্ব ও মানসিকতা সম্বন্ধে আপনি অথবা দিদি কেউই কি সচেতন ছিলেন একটুও? ওকে আলাদা একটা মানুষ বলে স্বীকার করেছিলেন কি?

আমরা কেউই কি করেছিলাম?

কিন্তু মুখে কিছুই বললাম না। চুপ করে তাকিয়ে রইলাম জামাইবাবুর মুখে।

তারপর জামাইবাবু একটু দম নিয়ে বললেন, বুঝলি, শান্তুর বয়সে সিকিওরিটিকে, টাকাকে। সহজেই তাচ্ছিল্য করা যায়। কিন্তু বয়স হলে তখনই বোঝা যায় যে টাকাটা কত মূল্যবান। ও যাতে সুখে থাকে, তাই-ই চেয়েছিলাম। আর ও এমনি করে চলে গেল। বল তো! তোরাই বল?

অতবড়ো রাশভারী মানুষটা ভাঙা গলায় কেঁদে কেঁদে কথা বলছেন। এ দৃশ্য যেমন অভাবনীয়, তেমনই হৃদয়বিদারক। জামাইবাবুকে কখনো আমি একটুও উত্তেজিত হতে দেখিনি। চেঁচিয়ে। কথা বলতেও না। আর সেই জামাইবাবু!

রাণু চা নিয়ে এসে বলল, জামাইবাবু, উঠুন, উঠে বসুন। চা খান।

জামাইবাবু উঠে বসে চা হাতে নিলেন।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জামাইবাবু বললেন, জানিস পিন্টু, আমার কী ইচ্ছা ছিল? আমার ইচ্ছা ছিল এয়ার ফোর্সের পাইলট হব আমি। ফাইটার পাইলট। আমার যখন আঠারো বছর বয়স তখনই যুদ্ধে যাওয়ার একটা সুযোগ এসেছিল। মাকে একথা বলতেই বাবা আমাকে ডেকে বললেন, তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র করব। আমার এত বড়ো লাইব্রেরি কলকাতা বার-এ এত। জানাশোনা, না, না। তোমাকে আইন পড়তেই হবে। উকিল হতেই হবে। তারপর চেম্বারে বোসা। আমি অনেকদিন খেটেছি, আর পারব না। আর আমি জোয়াল টানব না। আমি মিহিজামে গিয়ে গোলাপ বাগান করব।

তারপরই অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন জামাইবাবু।

বললেন, জানিস, ত্যাজ্যপুত্র করার ভয়টাতে ভয় যে একেবারেই পাইনি তা নয়। আমি যেভাবে মানুষ হয়েছিলাম, বাবার দয়া না থাকলে তো সেভাবে চলত না। কিন্তু বাবার মুখের দিকে চেয়ে আমার এও মনে হয়েছিল যে, বাবার ইচ্ছানুযায়ী কাজ না-করলে বাবা জেনুইনলি হার্ট হবেন। ভীষণ দুঃখ পাবেন। আমার পাইলট হতে না-পারার কারণ আসলে সেটাই। অথচ আমার একটামাত্র ছেলে আমার ফিলিংস-এর কথাটা একবারও ভাবল না?

একটু চুপ করে থেকে জামাইবাবু বললেন, আমি একজন সাকসেসফুল উকিল। যে কোনো কাজই ভালো করে করার মধ্যে একটা আনন্দ, খ্রিল আছেই। কিন্তু বিশ্বাস কর, আজকেও যখন আকাশে প্লেনের গুড় গুড় শব্দ শুনি, মনে হয়, এই কালো গাউন ছুঁড়ে ফেলে হাই কোর্টের বড়ো। বড়ো থামওয়ালা বারান্দা দিয়ে দৌড়ে চলে যাই কোনো গোপন এয়ারপোর্টে, যেখানে ছোট্ট ছোট্ট ফাইটার জেটরা আকাশে সাদা-ধোঁয়ার ছায়াপথ এঁকে উড়ে উড়ে শব্দের চেয়েও বেশি স্পিডে মাটিতে নেমে এসে একে মাটির তলায় ক্যামোফ্লোজ-করা হ্যাঙ্গারে ঢুকে যায়।

বলেই, জামাইবাবু একেবারে চুপ করে গেলেন।

আমি বললাম, জামাইবাবু, চা-টা খেয়ে নিন। ঠান্ডা হয়ে গেল। এখনও যদি আপনি এরকম করেন, তাহলে চলবে কেন? খবর তো পাওয়া গেছে শান্তুর।

উনি আমার দিকে চেয়ে বললেন, একে খবর বলে না।

আমি বললাম, ও বেঁচে তো আছে। ও যে গাড়ি চাপা পড়েনি, গুম হয়নি, এটাও কি স্বস্তির নয়?

জামাইবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে অবাক চোখে তাকালেন আমার চোখে।

বললেন, একে বেঁচে থাকা বলে না।

তারপর কি যেন বলতে গিয়েই থেমে গেলেন।

ডাঃ ভৌমিক এবং ডাঃ রায় এসে ঢুকলেন ঘরে।

কী ব্যাপার? জামাইবাবু চটে উঠে, ছেলেবেলার বন্ধু ডাক্তারকে শুধোলেন।

ডাঃ ভৌমিক হেসে বললেন, দ্যাখ সাধন, ছেলের খবর তো পাওয়া গেছে। সে তো আর হারিয়ে যায়নি। চুরি-ডাকাতি করেও বাড়ি থেকে যায়নি। কতদিন পালিয়ে থাকবে ও? দেখিস ও শিগগিরই ফিরে আসবে। তোর সঙ্গে দেখা হবে। কিন্তু এত বড়ো সংসারে নিজের ছেলে, নিজের জগৎ নিয়ে এত উত্তেজিত হয়ে পড়লে চলবে কেন?

জামাইবাবু বললেন, তুই চুপ কর তো গণশা। শালার দার্শনিক এসেছেন! তোর ছেলে হারালে তুই বুঝতিস। বেশি জ্ঞান দিস না। কোথায় আছে? কী খাচ্ছে? টাকা নেই, পয়সা নেই…অতটুকু ছেলে!

আমরা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

রতনদা বলল, ভৌমিকদা এসে গেছেন। সেডেটিভ পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই দেখিসনি, সে কী কান্না! আমার নিজেরই হাট-অ্যাটাক হবার অবস্থা দাদাকে দেখে। একবার কাঁদছে, একবার হাসছে। এখনও দেখলি না, কীরকম কনফিউজড?

বললাম, আমি তুমি আর কী করতে পারি বল? পুলিশ তো ওয়ারলেসে সব জায়গায় মেসেজ পাঠিয়েছে। যা যা করার সবই তো করেছ তোমরা।

রতনদা বললেন, আমি তো তাই-ই বলছি। ফিরে আসবেই ও। আজ আর কাল। যাবে কোথায়? ফিরে এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি বললাম, আমি এবার এগোই রতনদা। রাণুকে ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাব।

রতনদা বলল, গড়িটা নিয়ে যা না। আমি তো ছুটি নিয়েছি অফিস থেকে। আমার ছুটির মধ্যে ছেলেটা ফিরে এলেই বাঁচোয়া।

আমি বললাম, গাড়ি নিয়ে কী হবে! তোমাদের কখন কী দরকার হয়, গাড়ি থাক এখানে।

দিদির বাড়ি থেকে বেরিয়েই মোড়ে ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম।

রাণুকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল। ও আমার কাঁধ ঘেঁষে বসেছিল।

ট্যাক্সিটা চলতে আরম্ভ করতেই, রাণু বলল, অ্যাই জান, আমার না ভীষণ ভয় করছে।

আমি বললাম, কেন কীসের ভয়?

ও ফিসফিস করে বলল, বাচ্চা হওয়ার সময়েই কষ্ট হয় জানতাম। মানে শারীরিক কষ্ট! তারপর সারাজীবন এমন কষ্ট? বাবাঃ! আগে জানলে চাইতামই না।

আমি ওর পেটে হাত ছুঁইয়ে বললাম, জামাইবাবুর সব কথাই শুনেছে ব্যাটা। এসব কথা শোনার পরও বাবা-মায়ের এত কষ্ট দেখার পরও যদি ব্যাটা আমাদের কষ্ট দেয় তো বলার কিছুই নেই।

রাণু বলল, তোমার সবটাতে এই ইয়ার্কি আমার ভালো লাগে না।

সামনেই, রাস্তার বাঁ-দিকে একটা স্কুলের সামনে খুব ভিড়। টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়েছে বোধহয় আজ থেকে। শান্তুর বয়সি ছেলেরা এবং তাদের ভয়ার্ত, চিন্তিত মা-বাবারা ভিড় করেছেন স্কুলের গেটের সামনে। শান্ত থাকলে, ও-ও পরীক্ষাতে বসত আজ।

ওদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এদেশে এখন আর কারোরই ছেলে-মেয়ে না-হওয়াই ভালো। দেশের মেরদণ্ড, জাতির ভবিষ্যৎ এই উজ্জ্বল, উৎসুক চোখের ছেলে-মেয়েগুলোর কী হবে? কোনো প্রতিশ্রুতি আমরা রেখেছি? কোন ভরসায় পৃথিবীতে এনেছি, আনছি আমরা এদের? বঞ্চনাতে, সবরকম বঞ্চনাতেই ভরে দিয়েছি আমরা ওদের। এ লজ্জা রাখার জায়গা কি আছে?

একটা ছেলে ডাকল, বড়ো মামা, বড়ো মামা!

ট্যাক্সিটা দাঁড় করাতে বললাম।

ছেলেটা দৌড়ে এল। হাতে স্কেল, জ্যামিতির বাক্স।

ও শান্তুর বন্ধু মিঠু। ও অন্য স্কুলে পড়ে কিন্তু দিদিদের পাড়াতেই থাকে।

কপালে দইয়ের ফোঁটা। ওর শুভার্থিনী মা পরিয়ে দিয়েছেন। ছেলে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে।

ট্যাক্সির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শুধালো মিঠু, শান্তর কোনো খবর পেলেন?

বললাম পেয়েছি। ও সায়ান্স পড়বে না। চিঠি লিখেছে যে, ও যা হতে চায় তা-ই হবে। কোথায় আছে শান্তু? মিঠু শুধাল।

আমি বললাম, সেটা এখনও জানি না।

মিঠু কী একটু ভাবল, তারপর বলল, এই জন্যেই ওকে আমি এত অ্যাডমায়ার করতাম। সায়ান্স আমারও ভালো লাগে না। বাবা জোর করলেন।

তারপর মুখ নীচু করে বলল, এই পড়াশোনার দামই বা কী? করতে হয় করছি। ডিগ্রি পেয়েও তো কোথাও একটা কেরানির চাকরির জন্যে বছরের পর বছর বসে থাকব। আমরা যে সাধারণ ছেলে! আমরা বেশিরভাগই তো সাধারণ…। ফালতু…। সব ফালতু…

আমি বললাম, চলি রে!

মিঠু বলল, আচ্ছা। শান্তু বাড়ি আসলে খবর দেবেন। যাব।

মিঠু স্কুলের দিকে চলে যাচ্ছিল। পরীক্ষা শুরু হবে একটু পর। ওর কপালে দই-এর ফোঁটা। আমার দিদিও কি দিত? শান্তুকে? যদি আজ পরীক্ষায় বসত ও?

বোধহয় না।

আর রাণু? রাণুও কি দই-এর ফোঁটা পরাবে, ভাগ্যবিশ্বাসী দুর্বল ছেলের দুর্বলতর মা হয়ে?

নিশ্চয়ই না। হয়তো চুমু দেবে কপালে।

সময় দ্রুত বদলে যাচ্ছে, যাবে।

দূরে রাণুদের বাড়ি দেখা যাচ্ছিল।

রাণু বলল, কী ভাবছ গো?

আমি হাসলাম। ওর হাতে হাত ছুঁইয়ে বললাম, যে আসছে তার কথা, তাদের কথা।

তারপর বললাম, তুমি দেখো রাণু! যে আসছে, সে কিন্তু আমাদের ঠিক হারিয়ে দেবে। ও ওরিজিনাল হবে। আমাদের মতো ছাঁচে-ফেলা প্রোটোটাইপ নয়।

রাণু বলল, জান, আমার মা বলছিলেন, ছেলে-মেয়েদের কাছে হেরে যাবার মতো আনন্দ নাকি বাবা-মায়ের আর কিছুই নেই!

তারপরেই রাণু প্রথম মাতৃত্বের, গর্ব-গর্ব, ভয়-ভয়, কিন্তু দারুণ খুশি মুখে আমার দিকে চাইল একবার। বলল, তাহলে আমাদের খবরটা মাকে বলছি কিন্তু আজ। বুঝলে?

বলেই, বলল, ভীষণ লজ্জা করছে আমার!

আরেকটা স্কুল দেখা যাচ্ছে সামনে। ডানদিকের ফুটপাথে। এখানেও অনেক ছেলে। রিকশা, ট্যাক্সি ও গাড়ির ভিড়। বাবা-মায়েরা, দাদা, দিদিরা।

হঠাৎ আমার মনে হল, এইসব ছেলেদের অনেকের চেয়েই, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া আমার বোনপো শান্তু অনেক অন্যরকম। আমরা যা পারিনি, শান্তুরা হয়তো তা পারবে। আমাদের এই প্রাচীন ঘেরাটোপের মধ্যের ভীরু, একঘেয়েমির ক্লান্তিকর জীবনের নির্মোক ছিঁড়ে ফেলে ওরা স্বমত, আত্মসম্মানজ্ঞান এবং স্বাধিকারের উজ্জ্বল দীপ্তিতে প্রদীপ্ত হবে।

একটা নতুন যুগ আসছে। সে যুগের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি। এই নানারকম ডুগডুগি বাজানো বাঁদর নাচের দেশের শান্তু, মিঠু এবং লক্ষ লক্ষ শান্ত-মিঠুরা নতুন আলো হাওয়া, নতুন সাহস এবং প্রত্যয় আনবে। ওদের উপর অনেকই ভরসা আমার!

আমি নিশ্চয়ই জানি, এবং জেনে অত্যন্ত গর্বিত যে, শান্তুকে পাওয়া যাবে না। শান্তুদের আর পাওয়া যাবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *