শল্য
আমার জীবনে আমি এইরকম ভোলেভালা লোক দেখেছি, তিনি সবসময়েই আনন্দে থাকেন, সদা হাস্যময়। নিজস্ব কিছু ঐশ্বর্য-ধন তথা প্রতিপত্তি থাকার ফলে তিনি অন্যপ্রদত্ত তৈলে যথেষ্ট প্রীত হন। সত্যি বলতে কী, আমার এক মামাই ছিলেন এই গোছের মানুষ— সদানন্দ, আত্মভোলা। নিজের পয়সা খরচ করে, প্রচুর চা-জলপানির আয়োজন করে তিনি নিজের বাড়িতে আড্ডা বসাতেন এবং অনেক মানুষই চা-জলখাবারের লোভে তাঁর বাড়িতে বসে তাঁকে তেল দিতেন। মামা পাটভাঙা ধুতি পরে সহাস্যে বসে বসে সেই তেল খেতেন। আরও আশ্চর্য লাগত দেখে— একদল তাড়াতাড়ি এসে একটি বিষয় উত্থাপন করে তাঁর পরামর্শ চাইলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাতে মত দিতেন এবং প্রয়োজনে অর্থসাহায্যও করতেন। আবার পরে যে দল এসে বিষয় উত্থাপন করলেন এবং হয়তো পুরোপুরি উলটো বিষয় নিয়েই কথা বলতে আরম্ভ করলেন, আমার মামা কিন্তু সে-বিষয়েও পুরোপুরি একমত হতেন এবং অর্থসাহায্যও করতেন। আমি এখনও ভাল করে আমার মামার চরিত্র বুঝে উঠতে পারিনি। তিনি কি অতিরিক্ত বুদ্ধিমান ছিলেন, নাকি মেরুদণ্ডহীন, পরমতাবলম্বী নির্বোধ পুরুষ অথবা রবীন্দ্রনাথের সেই রসিকখুড়ো, যিনি বলতেন—
তা, রাজি আছি ভাই। যে-রকম পরামর্শ চাও, তাই দেব। যদি ‘হাঁ’ বলাতে চাও ‘হাঁ’ বলব, ‘না’ বলাতে চাও ‘না’ বলব। আমার ওই গুণটি আছে। আমি সকলের মতের সঙ্গে মত দিয়ে যাই বলেই সবাই আমাকে প্রায় নিজের মতোই বুদ্ধিমান ভাবে।
আমরা ধারণা, মহাভারতের কবি সারা জীবন ধরে এত মানুষ দেখেছেন, এত বিচিত্র তাঁদের ব্যবহার এবং সংসারের বিচিত্র ক্ষেত্রে এত অদ্ভুত তাঁদের বিচরণ যে, কবি তাঁর মহাকাব্যের প্রধান পরিমণ্ডলের মধ্যেও তাঁদের এড়িয়ে যেতে চাননি। মহাভারতের শান্তিপর্বের পূর্ব পর্যন্ত আপ্রবন্ধ স্থির যে বীর-রস বয়ে চলেছে, তার বৈচিত্র্য বাড়ানোর জন্যই হোক, অথবা এই মানুষগুলি না থাকলে বিপ্রতীপভাবে ভীম-অর্জুন, দুর্যোধন-কৰ্ণরা যে অপরিস্ফুট থেকে যাবেন, সেই কারণেই হোক, মহাভারতের কবি কিন্তু এইসব চরিত্রকে সযত্নে লালন করে গেছেন। বস্তুত মানুষ— মানুষ যে কত রকমের হতে পারে— মহাকাব্যের কবির এই স্বাভাবিক কৌতূহল ছিল বলেই মদ্ৰাধিপতি শল্যের মতো মানুষকে মহাভারতের ঘটনা-ধারার মধ্যে নিহিত করে রেখেছেন তিনি।
গোটা মহাভারতে মহামতি শল্যের যে অনেক ক্রিয়া-কর্ম কিংবা জীবনচর্যার পরিচয় পাওয়া যায়, তা নয়। এমনকী কুরুক্ষেত্র মহাযুদ্ধের অন্যতম যুদ্ধ-নায়ক হওয়া সত্ত্বেও শল্যের বংশ, পিতৃপরিচয় এবং তাঁর যুদ্ধ-জীবন সম্বন্ধেও কিছু জানা যায় না। মহাভারতের আদিপর্বে প্রথম যেখানে মদ্রপতি শল্যের সঙ্গে আমাদের দেখা হচ্ছে, সেখানে শল্যের পিতা কে, তাও আমরা জানি না। মনে পড়ছে সেই শল্য-পর্বে যখন কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে শল্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উদ্দীপিত করছেন, তখন কৃষ্ণ তাঁর পরিচয় দিচ্ছেন ‘আর্তায়নি’ বলে অর্থাৎ আর্তায়ন বা অর্তায়নের পুত্র। কৃষ্ণ বলছেন— আর্তায়নি শল্যকে আমি খুব ভালভাবে জানি— আর্তায়নিমহং জানে যথাতত্ত্বেন ভারত।
সত্যিই শল্যের আচার-ব্যবহার, তাঁর কৌলীন্য, তাঁর দেশজ ঐতিহ্য— এর অনেকটাই অনেকের জানা না থাকলেও হয়তো কৃষ্ণের জানা আছে। কৃষ্ণ সব জানেন— এই জানাটা অবশ্য তাঁর সর্বজ্ঞতা বা বিভুত্বের অঙ্গ বলে এখানে প্রমাণ করতে চাই না, বরঞ্চ এই জানার মধ্যে আমার নিজের একটা ভাবনা অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। খেয়াল করে দেখুন— শল্য যে দেশের রাজা, সেই মদ্রদেশের অবস্থিতিটা কোথায়। তাঁর রাষ্ট্রতন্ত্রের মূল ভিত্তিটাই বা কী? উত্তরটার মধ্যেই কৃষ্ণ এবং শল্যের একটা ‘কমন এলিমেন্ট’ বেরিয়ে পড়বে এবং সেই সমানতার মধ্যেই কৃষ্ণের জানাটুকু লুকিয়ে আছে।
অনুসন্ধিৎসার চোখে দেখলে বোঝা যাবে যে, মদ্রদেশটা বৈদিককালে আৰ্যায়ণের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এখানকার জ্ঞান-চর্চা, আচার-ব্যবহার এবং আর্য-ঐতিহ্য তখনকার দিনে অনেক রাজ্যের কাছে ঈর্ষণীয় ছিল। অবশ্য খোদ ঋগ্বেদ-সামবেদের মতো কুলীন বৈদিক গ্রন্থে আমরা মদ্রদেশের নাম পাচ্ছি না বটে, কিন্তু বেদোত্তর গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম প্রাচীন বৃহদারণ্যক উপনিষদের মধ্যে মদ্রদেশের যে পরিচয় পাচ্ছি, তাতে মদ্রে জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য সুপ্রাচীনকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলেই ধরে নিতে হবে। নইলে দেখুন, বৃহদারণ্যকে যাজ্ঞবল্ক্যের মতো ব্রহ্মর্ষি পুরুষকে প্রশ্ন করায় সময় লহ্যপুত্র লাহ্যায়নি ভুজ্যু বলছেন— আমরা পড়াশুনো করার জন্য ব্ৰতাচরণ করে মদ্রদেশে পর্যটন করতে করতে কাপ্য পতঞ্জলের ঘরে বাসা বেঁধেছিলাম— মদ্রেষু চরকাঃ পর্য্যব্ৰজাম, তে পতঞ্জলস্য কাপ্যস্য গৃহান্ ঐম। পুনরায় প্রায় একই তথ্য উচ্চারিত হচ্ছে আরুণি উদ্দালকের মুখে। তিনি যাজ্ঞবল্ক্যকে বলছেন— আমরা মদ্রদেশে কাপ্য পতঞ্জলের বাড়িতে থেকে যজ্ঞবিদ্যা শিক্ষা করছিলাম— যাজ্ঞবল্ক্যেতি হোবাচ, মদ্রেষু অবসাম পতঞ্জলস্য কাপ্যস্য গৃহেষু যজ্ঞমধীয়ানাঃ।
এই দুটি দৃষ্টান্ত থেকে বেশ বোঝা যায় যে, বৈদিক যুগে মদ্রদেশ বিদ্যাশিক্ষার অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল। উদ্দালক আরুণির মতো বিশিষ্ট ঋষি অথবা লাহ্যায়নি ভুজ্যুর মতো বেদজ্ঞ পণ্ডিত যে স্থানে পড়াশুনো করবার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন, সেই স্থানটি যে বিদ্যাস্থান হিসেবে বিখ্যাত ছিল, সে-কথা বলাই বাহুল্য। উপনিষদে উল্লিখিত কাপ্য পতঞ্জল (অথবা পতঞ্চল) খুব উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্থান পাননি বটে, কিন্তু বৃহদারণ্যকের চেয়েও পুরাতন সাহিত্য ঐতরেয় ব্রাহ্মণে উত্তর মদ্রদেশের অবস্থান দেখছি হিমালয় পর্বতের পরেই— পুরেণ হিমবন্তম্। এই একটা মাত্র বিশেষণ ‘উত্তর’, উত্তরমদ্র, এই কথা থেকেই বোঝা যায় যে, সেই অতিপূর্বকালের বৈদিক যুগেই মদ্রদেশ দুইভাবে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। তার একভাগের নাম যদি উত্তরমদ্র হয়, তা হলে অন্যটি যে দক্ষিণ-মদ্রই হবে সেটা জোর দিয়ে বলছি না এই কারণে যে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর মহাবৈয়াকরণ পাণিনি একভাগ মদ্রকে বলছেন পূর্বমদ্র আর অন্য ভাগকে বলেছেন অপর-মদ্র। হয়তো এই অপর-মদ্রই উত্তরমদ্র কিন্তু তাই বলে পূর্ব-মদ্র মানে পুবদিকের মদ্র নয়। কেন না সংস্কৃতে ‘পূর্বাপর’ কথাটা এদিক-ওদিক বা এইদিক-অন্যদিক— এইরকম বোঝায়। যাই হোক, উত্তরমদ্রের আধুনিক অবস্থিতিটা চেনাব নদী থেকে ঝিলাম নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন, যাকে হাইনরিখ জিমার স্পষ্ট করে কাশ্মীর বলতে চেয়েছেন। আর পূর্ব মদ্রের অবস্থিতি ছিল আধুনিক শিয়ালকোট এবং পাকিস্তানে অবস্থিত পঞ্জাব অঞ্চলে।
মহারাজ শল্য ঠিক কোনদিকের মদ্রদেশে বাস করতেন জানি না, তবে উত্তরমদ্র দেশটাই চিরকাল বিখ্যাত বলে এই দেশটাকেই গোটা মদ্রদেশ বলে চিহ্নিত করার একটা প্রবণতা ছিল। দ্বিতীয়ত, চেনাব-ঝিলামের জল-ধোয়া কাশ্মীরের মেয়েরা যে কতটা সুন্দরী হতেন, সেটা আপনাদের বিলক্ষণ ধারণা আছে, আর শল্য-ভগিনী মদ্রজা মাদ্রীর যেহেতু আগুনপানা রূপ ছিল, তাই বিশেষ করে মনে হয় শল্য আধুনিক কাশ্মীরেরই একাংশের রাজা ছিলেন। অবশ্য উত্তরমদ্রের রাজাকে খুব ভাল করে রাজা বলা যায় কিনা সেটাও একটা গবেষণার বিষয় এবং হয়তো সেইখানেই শল্যের উদার ভোলেভালা চরিত্রের বীজ লুকিয়ে আছে।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে যেভাবে উত্তরমদ্রের শাসনতন্ত্র ব্যাখ্যাত হয়েছে তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘বৈরাজ্য-তন্ত্র’। বৈরাজতন্ত্রের কর্ণধার পুরুষকে ‘বিরাট’ নামে ডাকা হত এবং রাজা উপাধিটা এখানে উপাধিমাত্র, তার বেশি কিছু নয়। কথাটা আরও একটু পরিষ্কার করে বলি— পণ্ডিতেরা বৈরাজতন্ত্রের যে সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন, তাতে বৈরাজ্য ব্যাপারটাকে বিশদর্থে গণরাজ্য বলাই ভাল। অনেক পণ্ডিত বৈরাজ্য-তন্ত্রকে বলেছেন Kingless constitution, যেখানে গণরাজ্যের প্রথম আভাসটুকু পাওয়া যায়। উত্তরমদ্রের এই বৈরাজ্য-ভাবনার মধ্যে যে একটা প্রজাতান্ত্রিক চরিত্র ছিল, সেটা ম্যাসিডন-বীর আলেকজান্ডারের সময় পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল এবং তা গ্রিক-লেখকদের লিখিত দলিল থেকেও প্রমাণ হবে। মনে রাখা দরকার, পাণিনির প্রায় সমসাময়িক কালে অর্থশাস্ত্রকার যেসব সংঘ-রাষ্ট্রের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যেও এই মদ্রদেশ আছে। এইসব দেশের নির্বাচিত প্রধান পুরুষেরা রাজা উপাধি ধারণ করতেন মাত্র, কিন্তু রাজতন্ত্রের রাজা বলতে যেমন সর্বেসর্বা একনায়ক বোঝায় এমন তাঁরা ছিলেন না এবং এইখানেই পুরুষোত্তম কৃষ্ণের সঙ্গে শল্যের মিল। কৃষ্ণের নিজরাজ্য মথুরা-শূরসেন অঞ্চলেও সংঘরাষ্ট্রের প্রথা চালু ছিল এবং যদু-বৃষ্ণিসংঘের প্রধান পুরুষেরাই সম্মিলিত মতামতের মাধ্যমে এই রাষ্ট্র চালাতেন। আমাদের ধারণা— শল্যরাজও মদ্রদেশে এই ধরনের কোনও সংঘরাজ্যের প্রধান পুরুষ ছিলেন এবং সেই অন্যতম প্রধান পুরুষ রাজার উপাধিতে ভূষিত হলেও রাজতন্ত্রী রাজার স্বাতন্ত্র্য এবং গর্ব তিনি বহন করতেন না।
হয়তো সংঘরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান পুরুষ বলেই শল্যের কৌলীন্য এবং বংশ-পরিচয়ও তেমন জানা যায় না। তবে তাঁর পিতার নাম আর্তায়ন— হয়তো বা তিনি আর্ত, দীন-দুঃখী মানুষের আশ্রয়স্থল ছিলেন বলেই আর্তায়ন। অথবা ঋত, সত্যকে যিনি আশ্রয় করেছিলেন, তিনি আর্তায়ন। তাঁর পুত্র আর্তায়নি শল্য পিতার আর্তবৎসল চরিত্র এবং গণরাজ্যের উদার মানসিকতা বহন করতেন বলেই হয়তো তিনি খুব কঠিন মানুষ নন, বরঞ্চ অনেক বেশি ঢিলে-ঢালা সরল স্বভাবের মানুষ হলেন শল্য। তা ছাড়া শল্যের মধ্যে হয়তো ঐতিহ্যের পরম্পরায় একটা মিশ্রণের পরম্পরাও আছে এবং সেটাও হয়তো তাঁকে শত্রু-মিত্র, আত্মীয়-অনাত্মীয়ের ভেদাভেদ ভোলাতে শিখিয়েছে। আমরা এ-সব কথার পরে ফিরে আসব আবার। আপাতত শল্যরাজার সঙ্গে আমাদের ভাল করে পরিচয় হওয়া দরকার। এই প্রসঙ্গে একবার আমরা মহাভারতের কথাও তুলব, আর একবার আমাদের সমর্থনে মহামতি পাণিনির কথাও স্মরণ করতে হবে।
মহাভারতে ব্যুষিতাশ্ব বলে এক রাজার কথা আছে। পাণ্ডুর আমন্ত্রণ সত্ত্বেও কুন্তী যখন নিয়োগপ্রথায় অন্য কোনও পুরুষের সাহায্যে পুত্র উৎপাদন করতে রাজি হচ্ছিলেন না, তখন তিনি নিজেই ব্যুষিতাশ্বের প্রাচীন কাহিনি পাণ্ডুকে শোনান। এই রাজার পতিব্রতা স্ত্রী ভদ্রা মৃত স্বামীর সঙ্গে সহবাসেই আপন গর্ভে পুত্র উৎপাদন করেন— এই ছিল কুন্তীর বক্তব্য। এই কাহিনির মধ্যে অলৌকিকতাই থাকুক অথবা যোগবল অথবা মৃত না বলে রাজা ব্যুষিতাশ্বকে আমরা না হয় মৃতপ্রায় বলেই বাস্তবতা স্থাপন করি, কিন্তু আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল— ব্যুষিতাশ্বের ঔরসে ভদ্রার গর্ভে তাঁর যে কয়টি পুত্র জন্মাল, তাদের তিনজন হল শাল্ব আর চারজন মদ্র— ত্ৰীন্ শাল্বাংশ্চতুরো মদ্ৰান্ সুতান্ ভরত সত্তম।
এই শ্লোকের কোনও জটিল মর্মার্থ ঘাঁটিয়ে না বার করলে অর্থটা হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের বাংলায় এইরকম দাঁড়াবে যে, মৃতপতির সংসর্গজাত ভদ্রার তিন ছেলে শাল্বদেশীয় রাজা আর চারজন ছিলেন মদ্রদেশীয় রাজা। লক্ষণীয়, মূল মহাভারত কিন্তু একবারও এই পুত্রদের শাল্বদেশীয় রাজা বা মদ্রদেশীয় রাজা বলেনি, মহাভারত এখানে দেশ-নামের মাধ্যমে জনজাতির নাম উল্লেখ করেছে এবং সেখানে অবধারিত প্রশ্ন আসবে— একই রাজা কীভাবে তিনজন শাল্ব জনজাতীয় পুত্র এবং চারজন মদ্ৰ জনজাতীয় পুত্র উৎপাদন করলেন। ঠিক এইখানেই ইতিহাসের দৃষ্টিতে বৈয়াকরণ পাণিনির কথা এসে পড়বে।
পাণিনি তাঁর বিখ্যাত গণপাঠের মধ্যে ‘মদ্রকার’ নামে একটি জনজাতির উল্লেখ করেছেন এবং তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন শাল্ব জনজাতীয় গোষ্ঠীর মধ্যে। মহাভাষ্যকার পতঞ্জলির মতে মদ্রকারেরা হলেন শাল্ব জনজাতির ‘অবয়ব’— অর্থাৎ শাল্বদের অংশ। মদ্রের সঙ্গে ‘কার’-প্রত্যয়টা একটু ভাবাচ্ছে বটে, তবে পণ্ডিতেরা বলেছেন ‘কার’ হল ইরানি ভাষার একটি প্রত্যয়, ইন্দো-ইরানীয় আর ইন্দো-এরিয়ান ভাষা-বিচ্ছেদের কালে এই প্রত্যয়টি আর্যভাষার স্টকে তখনও থেকে গেছে। ‘কার’ মানে সেনা, মদ্রকার অর্থ মদ্রসেনা। আগে তো সুযোগ পাইনি বলার, কিন্তু এখন আপনাদের জানাতেই হবে যে, প্রাচীনকালে যেসব রাষ্ট্রের গণরাষ্ট্রিক চরিত্র ছিল, তার মধ্যে যেমন কৃষ্ণের মথুরা-শূরসেন আছে তেমনই মদ্ররাও আছেন, তেমনই শাল্বরাও আছেন। লক্ষ করে দেখবেন— রাজসূয় যজ্ঞকালে কৃষ্ণ যখন জরাসন্ধের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া নিজেদের আঠেরোটি কুলসংঘের খবর দিচ্ছেন, তখন তিনি আরও কতগুলি জনজাতির উল্লেখ করছেন এবং তাঁদের মধ্যে আছেন শূরসেন, ভদ্রকার, শাল্ব এবং শাল্বায়ন জনগোষ্ঠী— শূরসেনা ভদ্রকারা বৌধাঃ শাল্বাঃ পটচ্চরাঃ। শাল্বায়নাশ্চ রাজানঃ… ইত্যাদি।
এই শ্লোকের মধ্যে যে ‘ভদ্রকার’ শব্দটি দেখছেন, পণ্ডিতেরা সকলেই এটাকে পাঠান্তরে ‘মদ্রকার’ বলতে চান। মদ্রকার অর্থ মদ্রসেনা।
শল্য-রাজার সঙ্গে আমাদের প্রথম দেখা হয় পাণ্ডুর সঙ্গে মাদ্রীর বিবাহ-সূত্রে। অবশ্য তারও আগে যেখানে মহাভারতের অংশাবতরণ-পর্বে কে কোন দেবতা-দানব-গন্ধর্বের অংশে জন্মেছেন, তার বহুতর পরিচয় দেবার সময় কবি লিখেছেন— দৈত্যরাজ প্রহ্লাদের অনুজ ভ্রাতা সংহ্লাদের অংশে নাকি শল্যের জন্ম। আমরা যারা পুরাণ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করি, সেই ভাবনায় দেখেছি সংহ্লাদ একেবারে অকিঞ্চিৎকর নাম, শুধু সুবিখ্যাত প্রহ্লাদের ভাই বলেই তিনি বিখ্যাত। পিতা হিরণ্যকশিপুর বিরোধিতা করেও তিনি বিখ্যাত হননি, প্রহ্লাদের অনুগামিতা করেও নয়। তবে হ্যাঁ, মহাভারতের বিরাট যুদ্ধটি যেহেতু দেবাসুর সংগ্রামের আদলে চিহ্নিত এবং শল্য যেহেতু দেবাংশজাত পাণ্ডবদেরও স্পষ্ট বিরোধিতা করেননি, আবার অশুভশক্তির প্রতীক দুর্যোধনেরও প্রতিও তাঁর তেমন আনুগত্য ছিল না— এই দৃষ্টিতে ভাবলে সংহ্লাদের উদাসীন ব্যক্তিত্বটি প্রতিরূপে তাৎপর্যসহ হয়ে ওঠে।
এই প্রতীকোক্তির পরেই একেবারে মদ্রদেশেই আমাদের পরিচয় হয় শল্যের সঙ্গে। পিতামহ ভীষ্ম ঠিক করলেন— তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র পাণ্ডুর বিবাহ দেবেন। কুন্তীর সঙ্গে তখন পাণ্ডুর বিবাহ হয়ে গেছে। তবুও যে ভীষ্ম আবারও পাণ্ডুর আরও একটি বিবাহ দিতে চাইলেন, তার কারণ মদ্রদেশীয়া মাদ্রীর রূপগুণের কথা ভীষ্মের কানে এসেছে। মদ্রদেশের অবস্থিতি যদি কাশ্মীর বা পঞ্জাব-শিয়ালকোটে হয়ে থাকে, তবে মাদ্রীর সৌন্দর্যের সুখ্যাতি কোনও আশ্চর্য কথা নয়। যাই হোক, ভীষ্ম মদ্ররাজ্যে কোনও আগাম খবর দিলেন না, কুরুরাজ্যের প্রাচীন মন্ত্রী আর ঋষি-ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নিয়ে সোজা মদ্রদেশের রাজধানীতে এসে পৌঁছলেন। সঙ্গে অবশ্য বেশ কিছু সৈন্য-সামন্তও থাকল। ভীষ্ম এসেছেন শুনেই মদ্রদেশের রাজা বাহ্লীকবংশের গৌরব শল্য রাজা অনেকটা এগিয়ে এসে প্রত্যুদ্গমনপূর্বক ভীষ্মকে সাদরে নিজের রাজধানীতে প্রবেশ করালেন— প্রত্যুদ্গ্ম্যার্চ্চয়িত্বা… ভীষ্মং বাহ্লীকপুঙ্গবঃ।
দেখুন, কেবল শল্যরাজের নামটুকু মাত্র উচ্চারণ করেছি, তাতেই এমন একটা বিপদ আমার বেধেছে, যাকে আমরা বিশেষণের বিপদ বলতে পারি। শল্যকে বলা হয়েছে— ‘বাহ্লীকপুঙ্গবঃ’, অর্থাৎ বাহ্লীক-বংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ। তবে এই বিশেষণ নিয়েও আমরা পরে কথা বলব, কেন না ভবিষ্যতে এই ‘বাহ্লীক’ শব্দটি ভদ্রসভ্য থাকবে না, এটা রীতিমতো গালাগালির বিষয় হয়ে উঠবে। ফলে আবারও আমরা মূল ঘটনাস্রোতে ফিরে আসি। মদ্ৰপতি শল্য ভীষ্মকে সাদরে নিয়ে আসলেন রাজধানীতে। তৎকালীন দিনের অতিথি সৎকারের উপচার— পাদ্য-অর্ঘ্য-মধুপর্ক নবাগত বিশিষ্ট অতিথিকে নিবেদন করে সুখাসীন ভীষ্মকে আগমনের হেতু জিজ্ঞাসা করলেন শল্য— মধুপর্কঞ্চ মদ্রেশঃ পপ্রচ্ছাগমনেহর্থিতাম্।
ভীষ্ম কোনও ভণিতা না করে একেবারে পাকা বরকর্তার মতো শল্যকে বললেন— আমি কিন্তু মশাই আপনার দেশে এসেছি কন্যাপ্রার্থী হয়ে— আগতং মাং বিজানীহি কন্যার্থিনমরিন্দশ। আমি নানা জায়গা থেকে শুনেছি আপনার একটি ভগিনী আছে, শুনেছি, সে পরমা সুন্দরী, তার গুণ এবং সচ্চরিত্রের প্রশংসা করেন অনেকেই— শ্রূয়তে ভবতঃ সাধ্বী স্বসা মাদ্রী যশস্বিনী। ভীষ্ম শেষ কথায় তাঁর অভীষ্ট প্রয়োজন জানালেন— আমার ভ্রাতুষ্পুত্র পাণ্ডুর জন্য আপনার মেয়েটিকে আমার চাই।
এই প্রথম আমরা জানলাম— মদ্ৰপতি শল্যের পিতা বেঁচে নেই। যাঁর বোনের এখনও বিয়ে হয়নি এবং বিয়ের আয়োজন করার কথাও যিনি ভাবেননি, সেই শল্য যে খুব বয়স্ক মানুষ তা মনে হচ্ছে না। এবং আমাদের ধারণা, তাঁর পিতার আকস্মিক মৃত্যু ঘটেছে, নইলে বয়স্থা রূপবতী মাদ্রী ঘরে রয়েছেন, অথচ তাঁর বিবাহের ব্যাপারে কোনও তোড়জোড় নেই, এমনটি কোনও সুস্থ রাজগৃহের চিত্র ছিল না সেকালে। পাণ্ডু যে কুন্তীকে বিবাহ করতে গিয়েছিলেন, সেটা স্বয়ংবরসভা ছিল। শল্য কোনও স্বয়ংবরসভাও ডাকেননি, হয়তো এখনই তা প্রয়োজনও ছিল না। ভীষ্ম শুধু মাদ্রীর রূপ-গুণের প্রশংসা শুনে হঠাৎ মদ্রদেশে চলে এসেছেন এবং বৈবাহিক সম্বন্ধ হিসেবে কুরুবংশীয়রা যে মদ্রবংশীয়দের যোগ্য পালটিঘর সে-বিষয়েও ভীষ্ম অবহিত করে দিলেন শল্যকে। ভীষ্ম বললেন— আমাদের বৈবাহিক সম্বন্ধে সমস্ত দিক থেকেই আপনারা যেমন আমাদের উপযুক্ত, তেমনই আমরাও আপনাদের উপযুক্ত— যুক্তরূপো হি সম্বন্ধে ত্বাং নো রাজন্ বয়ং তব। অতএব আপনি আমাদের সেই ভাবনাতেই গ্রহণ করবেন আশা করি।
মদ্ররাজ শল্য অতিশয় ভদ্রলোক। এতদূর হস্তিনাপুর থেকে ভীষ্মের মতো প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের জন্য কন্যাপ্রার্থী হয়ে এসেছেন, শল্য এতটুকুও অভব্য আচরণ করলেন না ভীষ্মের সঙ্গে। বরঞ্চ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ভীষ্মকে বললেন— আপনার বংশে যদি আমার বোনের একটি বর পাওয়া যায়, তবে তার চাইতে ভাল আর কী হতে পারে— ন হি মেহন্যো বরস্ত্বত্তঃ শ্রেয়ানিতি মতির্মম। তবে কিনা…
কথাটা বলতে শল্যের একটু সংকোচ হচ্ছিল। তাঁর পিতাঠাকুর আর্তায়ন বেঁচে থাকলে তাঁর পক্ষে কথাটা বলা অনেক সহজ হত। বয়স্ক লোকের পক্ষেই কথাটা মানায়, কিন্তু এতদিনকার কুলপ্রথা স্মরণ করে শল্যকেও বলতেই হবে কথাটা। শল্য বললেন— দেখুন মহাশয়! কথাটা আমাকে বলতেই হচ্ছে, আমাদের প্রাচীন অগ্রজন্মা পুরুষেরা এই নিয়ম চালু করে গিয়েছিলেন— পূর্বেঃ প্রবর্তিতং কিঞ্চিৎ কুলেহস্মিন্ নৃপসত্তমৈঃ। আমি জানি, এটা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। কেউ বলতে পারেন কথাটা মন্দ, কেউ বা ভালও বলতে পারেন। কিন্তু যিনি যাই বলুন, আমি আমার পূর্বপুরুষের প্রবর্তিত প্রথাটি অতিক্রম করতে পারব না— সাধু বা যদি বাসাধু তন্নাতিক্রমিতুম্ উৎসহে।
কথার তোড় যেমন এসেছিল, তাতে মনে হচ্ছিল যেন এই তোড়েই সব কথা বলে ফেলবেন শল্য। কিন্তু বলতে গিয়ে আবারও ভদ্রতার খাতিরে কথার আড়ম্বরেই জড়িয়ে পড়লেন শল্য। আসলে, এমন কথা বলতে লোকের লজ্জা করে। এখনকার দিনে এখনকার মানুষ হলে লজ্জা করত না। এখনকার দিনে ছেলের বাবা, ছেলের মা এমনকী ছেলেও মেয়ের বাড়ি থেকে পণ চাইতে কোনও লজ্জা পান না। পণের লোভে যারা পুত্রকে প্রায় বিক্রয় করেন, তাদের লজ্জা বস্তুটা থাকবারও কথা নয়। কিন্তু শল্যের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। অবশ্য সেইদিক থেকে দেখতে গেলে শল্যেরও খুব লজ্জা পাবার কারণ নেই, কেন না তিনি কন্যাপক্ষে আছেন। কিন্তু তবু শল্য এত বেশি ভদ্রলোক যে মুখ ফুটে নিজের কুলপ্রথার কথা বলতেও তাঁর লজ্জা করছে, কেন না এই প্রথার মধ্যে পণ নেবার একটা সমাজ-বিরুদ্ধ মানসিকতা আছে। শল্য বললেন— আমাদের কুলপ্রথা আমি অতিক্রম করতে পারছি না— এটা আপনার মতো মানুষ বুঝতে পারবেন যথেষ্টই, হয়তো ব্যাপারটা আপনার অজানাও নয়। তবু এটা বলতে আমার বাধছে যে, আমাদের ঘরের মেয়ে চাইতে গেলে আপনাকে শুল্ক হিসেবে কিছু দিতে হবে— ন চ যুক্তস্তদা বক্তুং ভবান্ দেহীতি সত্তম— সত্যি, একথা কী করে বলি আপনাকে। অথচ এই রীতিটা আমাদের কুলধর্ম, আর কুলধর্ম ব্যাপারটা যেমন আমার কাছে মান্য, তেমনই আপনি যেহেতু আমাদের সঙ্গে বিবাহ-সম্বন্ধে আবদ্ধ হচ্ছেন, অতএব তা আপনার কাছেও মান্য— কুলধর্মঃ স নো বীর প্রমাণং পরমং মহৎ। কিন্তু তবু আমার ধর্মের বিষয়ে আমি যতই নিঃসংশয় হই না কেন, ব্যাপারটা আপনাদের কাছে অপরিচিত বলেই কথাটা বলতে আমার সংকোচ হচ্ছে— তেন ত্বাং ন ব্রবীম্যেতদ্ অসন্দিগ্ধং বচোহরিহন্।
শল্য এত সংকোচ করছেন বটে, তবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে, এমনকী এই বঙ্গদেশের পৃথক পৃথক এক-একটি জেলাতেও বিবাহ-বিষয়ক রীতি-নীতি এত বিভিন্ন যে বিবাহের আসরে বসেও কন্যাপক্ষ এবং বরপক্ষে নানান গণ্ডগোল লেগে যায়। বিবাহের মন্ত্র বা কুশণ্ডিকা নিয়ে কোনও স্মার্ত গণ্ডগোল নেই, থাকবার কথাও নয়, কিন্তু এক-একটি বিবাহ-বাসরে ‘আমাদের কুলের এই নিয়ম’, ‘না। আমাদের অন্য নিয়ম’— এই ব্যাপারগুলি এমন গুরুতর হয়ে উঠত যে, সেখানে একসময় বিবাহ-ভঙ্গ-যোগ দেখা দিত। আজ থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগেও আমি এমন বিবাহবাসর দেখেছি যেখানে অতি-বিভিন্ন স্ত্রী-আচারের তাড়নায় বরপক্ষ-কন্যাপক্ষের মনোমালিন্য সৃষ্টি হত। শল্য যেটা সসংকোচে বলবার চেষ্টা করছেন, সেটা অবশ্য স্ত্রী-আচার নয়, কুলধর্ম। মদ্রদেশে শল্যের ঘরে এইরকম নিয়ম যে, সে বাড়িতে বিবাহ করতে হলে কন্যাপণ দিতে হবে। অর্থাৎ এখন যেমন বরপণ চালু আছে অর্থাৎ ছেলেপক্ষ যেমন কন্যার বাড়ি থেকে মোটা টাকা পণ নেয়, ফ্রিজ-টিভি-আলমারির ব্যবস্থা করে ফেলে— এই প্রথাটাকে যদি উলটে দেওয়া যায়, অর্থাৎ বিয়ে করতে হলে বরপক্ষকেই মোটা টাকা পণ দিতে হবে মেয়ে পাবার জন্য, সোনা-দানা-ফ্রিজ-টিভি দিতে হবে মেয়ে পাবার জন্য— এই প্রথাটা শল্যের বাড়িতে চালু আছে।
ভারতবর্ষে পুরুষতন্ত্র এবং পৌরুষেয়তার তাগিদে কন্যাপণের নিয়ম উঠে গেছে, হয়তো বা বহুতর কন্যাসন্তানের জন্মও এই নিয়ম বন্ধ হয়ে যাবার পিছনে অন্যতম কারণ, কিন্তু শল্যের বাড়ির এই নিয়ম যদি অন্যত্রও চাল থাকত, তা হলে ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক বিন্যাস আরও প্রগতিশীল হয়ে উঠত বলে আমাদের ধারণা। তবে একালের পৌরুষেয়তার কী দোষ দেব, পৌরুষেয়তার মধ্যে তো চিরকালীন পৌরুষেয় শক্তির এক সার্বিক প্রয়োগ ঘটে, অতএব তা শুধু এ-যুগেই সত্য নয়, সব যুগেই সত্য। কন্যাপণের ব্যাপারে শল্যরাজার সসংকোচ অভিব্যক্তিগুলি শুনলেই বোঝা যায় যে, সেকালের দিনে বাড়িতে বাড়িতে বরপণই চালু ছিল, কন্যাপণ নয়। যদিও বরপণের মাত্রা অতিকামী পৌরুষে দিনে দিনে যেভাবে বিকারের রূপ ধারণ করেছে, সেকালে এমন ছিল না। আর কন্যাপণ চালু ছিল এইরকম দু’-একটি বাড়িতে। আমার খুব অবাক লাগে এই ভেবে যে, কোনও কালের সেই সামাজিক সংস্কার এখনও ধূসরভাবে কোনও কোনও বাড়িতে কূলধর্মের আকারে চালু আছে এবং এই আচারটুকু তাঁরা বোধহয় নিজেরাও বুঝতে পারেন না।
বছর কুড়ি আগের এক বিবাহ-বাসরে কন্যাকে যখন সাত পাক ঘোরানোর জন্য পিড়িতে করে আনা হবে, তখন লিলুয়ার সি পি এম কাউন্সিলার মুকুন্দলাল সরকার বলেছিলেন, আপনাকে একটি টাকা দিতে হবে আমার হাতে, নইলে মেয়ে আনা যাবে না এখানে। আমি ভাবলাম, একটা টাকা খুব বড় কথা নয়, এমনকী এটা পৌরোহিত্যেরও কোনও যন্ত্রণা নয়, তা হলে কন্যাপক্ষ এক টাকার জন্য এমন কঠিন কথা বলেন কেন। একটু জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন— আমাদের বংশে এই নিয়ম। আমি সেটার অন্যথা করি কী করে! আমি এক টাকা বাড়িয়ে দিলাম তাঁর হাতে, তবে মনের মধ্যে একটা জিজ্ঞাসা রয়েই গেল। তখন বুঝিনি, কিন্তু পরে বুঝেছি যে ওই একটাকা হল— কন্যাপণের প্রতিভাস— যেন, এমন কন্যে নেই ত্রিভুবনে, তোমায় মূল্য দিয়ে নিতে হবে এমনই আমার মেয়ে। ব্যাপারটা আমার বেশ ভাল লাগে, ভাল লাগে কন্যাপিতার মুখে এই গর্বিত উচ্চারণ— মূল্য না দিলে মেয়ে আনা যাবে না এই বিবাহ-মণ্ডপে।
আমরা শল্যকে যে একটু বিব্রত হয়ে কন্যাপণের কথা বলতে শুনছি, তার কারণ প্রথমত, কন্যাপণ সে যুগেও তেমন চালু ছিল না, আর দ্বিতীয়ত, তিনি কথা বলছেন কুরুকুলপতি ভীষ্মের সঙ্গে। ভীষ্ম প্রবীণ অভিজ্ঞ পুরুষ, তিনি যেমন নিজের মর্যাদা সম্বন্ধে অবহিত, তেমনই পরের মর্যাদা সম্বন্ধেও সমান সচেতন। ভীষ্ম বললেন— কুলধর্ম পালন করা সমস্ত মানুষেরই কর্তব্য, স্বয়ং বিধাতার নির্দেশই তো এইরকম। তা ছাড়া এতে আপনার কিছু অন্যথা করবারও কারণ নেই। আপনার পূর্বজেরা যে নিয়ম করে গেছেন, সেখানে আপনার কোনও দোষই নেই— নাত্র কশ্চন দোষোহস্তি পূর্বৈৰ্বিধিরয়ং কৃতঃ। আপনি যে আপনার পূর্ব পুরুষদের নিয়ম মেনে চলছেন— এটাই আমার বেশ লাগছে।
ভীষ্মের কথা থেকে বোঝা যায় যে, নিয়মটা তাঁর খুব পছন্দ হয়নি, যার জন্য পূর্বপুরুষের মর্যাদার কথা স্মরণ করছেন বারবার— বিদিতেয়ং চ তে শল্য মর্যাদা সাধুসন্মম্মতা! তবু ভীষ্ম শল্যের সাধুভাষিতায় তৃপ্ত হয়ে আর কোনও কথা বাড়ালেন না। বরঞ্চ আপন বংশমর্যাদা অনুসারে তৈরি-করা সোনার গয়না এবং মাদ্রীর পছন্দ অনুযায়ী পরে বানানো যাবে এমন সোনার তালও দিলেন অনেকটা— শাতকুম্ভং কৃতাকৃতম্। মণি, মুক্তো, প্রবাল এবং অন্যান্য রত্নখণ্ডও দিলেন অনেক। শল্য বংশের নিয়মে সেইসব সুবর্ণ-মণি-রত্ন ভীষ্মের কাছ থেকে নিয়ে সেগুলো দিয়েই মাদ্রীকে অলংকৃত করে দিলেন বধূবেশে। অর্থাৎ বরপণ নেবার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বরপক্ষ যেমন কন্যাপণের টাকা নিজের কাজে লাগান, এখানে তেমন হল না। সমস্ত অলংকার, সোনা-দানা, মণিরত্ন শল্য দিয়ে দিলেন মাদ্রীকে— তাঁর আদরের বোন বলে কথা— তৎ প্রগৃহ্য ধনং সর্বং… দদৌ তাং সমলঙ্কৃত্য স্বসারং কৌরবর্ষভ।
মদ্ররাজ শল্য এবং তাঁর পূর্বজেরা কন্যাশুল্কের যে নিয়ম সমর্থন করে বরপক্ষের ঘর থেকে পাওয়া অলংকার অথবা অর্থ মেয়ের সঙ্গে বা বোনের সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছেন, তাতে সুবিধে এই যে, বিবাহিতা রমণীর স্ত্রীধনের পরিমাণটা বাড়ে। বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া গয়নাগাঁটির ওপর ভারতবর্ষের পুরুষ কোনওদিন আইনত হাত বাড়াতে পারত না, কিন্তু সেই স্ত্রীধন যদি বরপক্ষের আনুকূল্যে আরও খানিকটা বাড়িয়ে নিয়েই বরের ঘরে আসা যায়, তবে অত্যাচারী এবং নির্মম স্বামীদের আয়ত্তে থেকেও বিপন্না রমণীর খানিকটা ভরসা থাকে, এই যা। অতএব মদ্রদেশের এই নিয়ম আজকের দিনেও আমরা সমর্থন করি। শল্যরাজ এ-বিষয়ে আমাদের প্রমাণপুরুষ হয়ে থাকুন।
এই যে মাদ্রীর বৈবাহিক আলোচনার মধ্যে আমরা এক পরিণত শল্যরাজকে পেলাম, এই কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়। ছোটবেলায় তিনি কীভাবে মানুষ হয়েছেন, তাও জানি না অথবা বালক বয়সেই নাকি যৌবনসন্ধিতে তিনি পিতাকে হারিয়ে রাজ্য পেয়েছেন কবে, তাও স্পষ্ট করে বলেননি মহাভারতের কবি। তিনি শুধু বোনের বিয়ে দিলেন সাড়ম্বরে, কিন্তু তাই বলে গান্ধারীর ভাই শকুনির মতো মাদ্রীর পিছন পিছন হস্তিনাপুরের রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলেন না। নানা ব্যাপারেই তিনি বড় উদাসীন মানুষ। কোনও কিছুর মধ্যে তিনি নিজে চেষ্টা করে প্রয়াস নিয়ে নাক গলাবেন এমন উদ্যোগপতি পুরুষ তিনি নন। তবে এত উদাসীন, এত নিরুদ্যোগ, এমনকী যথেষ্ট ভোলেভালা হলেও শল্য যথেষ্ট আমুদে পুরুষ বটে। লক্ষ করে দেখুন, তাঁর ভগিনী মাদ্রী বিধবা হলেন অকালে, তিনি পাণ্ডুর সঙ্গে সহমরণে গেলেন, অথচ শল্যরাজকে আমরা একবারের তরেও কোনও সংবাদ নিতে দেখলাম না। মাদ্রীর গর্ভজাত দুই সন্তান নকুল এবং সহদেব তথাকথিতভাবে অরক্ষিত রইলেন, নাকি অধিক সুরক্ষিত রইলেন মাদ্রীর সপত্নী কুন্তীর কাছে— সে-সব খবর জানার জন্য শল্যরাজ কিন্তু একবারও হস্তিনাপুরে এলেন না। এই ব্যবধান, এই মানসিক ব্যবধানের জন্য শল্যকে যে আমরা খুব দোষী করতে পারি, তাও নয়। তিনি মানুষটাই এইরকম, কোনও কিছুই তিনি খুব ভাল করে খেয়াল করেন না, প্রয়োজনীয় কর্তব্য সম্পাদনের ব্যাপারেও তাঁর তেমন কোনও হুঁশ নেই।
অথচ কী আশ্চর্য দেখুন— চক্রান্তকারী দুর্যোধনের জতুগৃহের আগুন থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর দুই ভাগনে নকুল-সহদেব এবং আর তিন পাণ্ডবরা যে কুন্তীসহ পঞ্চাল-রাজ্যে পৌঁছেছিলেন, শল্য কিন্তু সে-সব খবর কিছুই রাখেন না। অথচ তিনি কিন্তু দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে যোগ দিতে এসেছেন। কী জন্য ঠিক দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে এসেছিলেন শল্য, সে-কথা বলা খুব মুশকিল। একেবারে সোজাসুজি যদি ভাবি, তা হলে বলতেই পারি যে, তিনি দ্রৌপদীকে বিবাহ করার আশা নিয়েই এসেছিলেন। এমনকী দ্রুপদ-সভায় মীনচক্ষু ভেদ করার জন্য তিনি ধনুকও তুলেছিলেন। কিন্তু তার প্রমাণটা অবশ্য পাওয়া যাবে তাঁর অক্ষমতায়। ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা অৰ্জুন যখন ব্রাহ্মণদের মধ্যে থেকে ধনুক তোলার জন্য এলেন, তখন সকলে দুয়ো দিয়ে বলেছিল— আরে! কর্ণ-শল্য রসাতল। অৰ্জুন বলে কত জল— যৎ কর্ণ-শল্য-প্রমুখৈঃ… নানতং বলবদ্ভিৰ্হি ধনুর্বেদ-পরায়ণৈঃ। তার মানে শল্য গিয়েছিলেন মীনচক্ষু ভেদ করার জন্য, অবশ্য গিয়েছিলেন অনেক পরে। আমাদের ধারণা— তরুণ রাজারা যাঁরা পরস্পরের প্রতি স্পর্ধা-সহকারে তাকাচ্ছিলেন দ্রৌপদীকে পাবার লোভে তাঁরাই আগে চেষ্টা করেছিলেন ধনুক তুলে মীনচক্ষু ভেদ করার জন্য। এঁদের সকলের শেষে আছেন কর্ণ। দ্রৌপদীর কর্ণ-প্রত্যাখ্যানের পর খানিকটা বয়স্ক লোকেরা যেমন জরাসন্ধ চেষ্টা করছিলেন, তার পরেই ধনুক তোলার জন্য আসেন মদ্ররাজ শল্য। শল্যের গায়ে বৃদ্ধ জরাসন্ধ অথবা তরুণতর শিশুপালের চেয়ে শক্তি বেশি ছিল অনেক। তিনি অন্তত ভারী ধনুকটা তুলেছিলেন, কিন্তু ধনুকে ছিলা পরাতে গিয়ে তার শক্তিতে আর কুলোল না, তিনি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন মাটিতে— ততঃ শল্যো মহাবীরো… জানুভ্যামগমন্মহীম্।
তবে এই চেষ্টার পরেও আমার এই বিশ্বাস যে, তিনি ঠিক বিবাহ করার মানসে দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-সভায় আসেননি। আমুদে মানুষ, তিনি এসেছিলেন স্বয়ংবরের মজা দেখতে। কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন যখন স্বয়ংবরে আগত রাজাদের পরিচয় দিচ্ছিলেন, তখন তিনি অনেকের নামের সঙ্গে শল্যের নাম করে জানিয়েছেন— শল্য এসেছেন তাঁর দুই তরুণ পুত্রদের সঙ্গে— মদ্ররাজস্তথা শল্যঃ সহপুত্রো মহারথঃ। দুই ছেলে রুক্মাঙ্গদ আর রুক্মরথকে সঙ্গে নিয়ে যিনি স্বয়ংবর-সভায় এসেছেন, তিনি এই প্রৌঢ়তর বয়সে বিবাহের বাসনা নিয়ে আসেননি বলেই মনে হয়। তিনি এসেছিলেন বিবাহসভার আমোদে যোগ দিতে। কিন্তু ওই যে দ্রুপদ একটা কঠিন শর্ত দিয়ে রেখেছেন বিবাহের সিদ্ধিতে, তাতে বীর ক্ষত্রিয়ের মনে একটা আবেগের তাড়না আসে, বিশেষত একের পর এক মহাবীর যেখানে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ছে, সেখানে একটা ভাগ্যসন্ধান করার বীরোচিত চেষ্টা কাজ করে। শল্য তাই করেছেন। ধনুক তুলে জ্যারোপণের চেষ্টা করেছেন এবং পারেননি।
কিন্তু এই যাঁরা পারেননি, সেই অপারগদের একটা দল তৈরি হতে সময় লাগে না। বিশেষত কেউ যদি স্বয়ংবরসভায় বীরপনা দেখিয়ে রমণী-মণির লক্ষ্য জিতে নেয়, তবে অপারগ বীরেরা ঈর্ষাবদ্ধ হয়েই একত্র হন। এখানে রাজারা একত্রিত হয়েই যুদ্ধ আরম্ভ করলেন বটে, কিন্তু এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে দেখলাম দু’জনকে। একজন কর্ণ, যিনি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন, অন্যজন হলেন শল্য, যিনি যুদ্ধ আরম্ভ করলেন ভীমের সঙ্গে— অপরস্মিন্ বনোদ্দেশে বীরৌ শল্য-বৃকোদরৌ। ভাবতে পারেন, সম্বন্ধে যিনি মামা হন, সেই শল্য যুদ্ধ করছেন ভাগিনেয়-প্রতিম ভীমের সঙ্গে। নেহাত তাঁর আপন দুই ভাগনে নকুল আর সহদেব সেদিন অকুস্থলে ছিলেন না, তাঁরা যুদ্ধারম্ভেই রণভূমি পরিত্যাগ করে চলে যান। তা নইলে দুই সাক্ষাৎ ভাগনের সঙ্গেও তাঁর যুদ্ধ হতে পারত।
এতে যেটা খুব পরিষ্কার হয়ে যায়, সেটা হল— ভগিনীর বিবাহের পরে আর তিনি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। অপরিচয়ের এই বৃত্ত এতটাই বড় যে ভাগনেদেরও তিনি চেনেননি। এমনকী তাঁর কোনও সরল সন্দেহও নেই। অন্য লোকেরা কিন্তু বলাবলি করছিল, সন্দেহ করছিল এই বলে যে, সত্যিই জানা দরকার— এরা কারা, কোথায়ই বা থাকে? নইলে কর্ণের সঙ্গে এমন যুদ্ধ করছে, সে কি পরশুরাম, দ্রোণ অথবা অর্জুন ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব? আর এদিকে শল্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, সে লোকটাই বা কে? গদাযুদ্ধে নিপুণ বলরাম, দুর্যোধন অথবা বৃকোদর ভীম ছাড়া মদ্ৰপতি শল্যের সঙ্গে লড়াই করবে, এটা তো অসম্ভব— বলদেবাদৃতে বীরাৎ পাণ্ডবাদ্ বা বৃকোদরাৎ। কিন্তু অন্য রাজারা সন্দেহবশত যতই বলাবলি করুন, শল্য কোনও সন্দেহও করেননি। ভাগনেদের তিনি চিনতেও পারেননি। বলতে পারেন, পাণ্ডবরা ব্রহ্মচারীর ছদ্মবেশে ছিলেন, তাই শল্যের পক্ষে না চেনাটা অসম্ভব নয়। একথা মানতে পারি খানিকটা। কেন না অতিশত্ৰু কৰ্ণ-দুর্যোধনরাই যেখানে তাঁদের চেনেননি, সেখানে শল্য কোনও ছার! চেনা থাকলেও তিনি চিনতেন না, আর এরা তো সেখানে জন্ম থেকেই অচেনা।
তবে অচেনা থাকার সুবাদেই মদ্ৰপতি শল্য ভাগনে ভীমের হাতে মার খেলেন প্রচুর। মহাভারতে যুদ্ধাস্ত্রচালনার বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে দেখা যাবে— যাঁরাই সেকালের গদাযুদ্ধে নিপুণ ছিলেন, তাঁদের শারীরিক বল ধানুষ্ক বীরদের চাইতে বেশি থাকত। হয়তো সেই দৈহিক শক্তির কারণেই একদিকে যেমন গদার মতো ভারী অস্ত্র তাঁরা চালনা করতে পারতেন, তেমনই অন্যদিকে মল্লযুদ্ধে এবং মুষ্টিযুদ্ধেও তাঁরা নৈপুণ্য দেখাতে পারতেন। মহাভারত-পুরাণেই দেখবেন— জরাসন্ধ, বলরাম, দুর্যোধন, ভীম অথবা রামায়ণের হনুমান যতটা গদাযুদ্ধে পারঙ্গত, ঠিক ততটাই মল্লযুদ্ধে কুশল! মদ্ৰপতি শল্যও কিন্তু গদাযুদ্ধে তখনকার দিনের নামকরা যোদ্ধা এবং তিনি মল্লযুদ্ধেও সমান পারদর্শী।
ব্রাহ্মণবেশী ভীম অস্ত্র ছাড়াই যেহেতু বিবাহ-সভায় প্রবেশ করেছিলেন, অতএব তাঁর পক্ষে মল্লযুদ্ধ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না বলেই তিনি বোধহয় প্রতিপক্ষ শল্যের দিকে মল্লযুদ্ধের প্রথম কল্প— গালাগালি খিস্তি-খেউড় আরম্ভ করেন, যাতে করে শল্য মল্লযুদ্ধেই প্ররোচিত হন। মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে এই খবর দেননি, কিন্তু যুদ্ধারম্ভেই দুই পক্ষের ‘চ্যালেঞ্জ’ করার খবরটা দিয়েছেন বলেই অনুমান হয় ‘চ্যালেঞ্জটা ভীমের দিক থেকেই প্রথম এসেছিল— অন্যোন্যমাহ্বয়ন্তৌ তু মন্তাবিব মহাবলৌ। আরম্ভ হল কুস্তির কৌশল এবং মুষ্ট্যাঘাত। প্রথমে দু’-চারবার ঘুষি চালানোর পরেই পাকা ‘বক্সার’রাও যেমন একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে পরপক্ষের মুষ্টি-বৃষ্টি বন্ধ করার চেষ্টা করে, এখানে জড়িয়ে ধরার বদলে মল্লের কৌশল জানুর সাহায্যে কাঁচি মারার কায়দা আরম্ভ হল— মুষ্টিভির্জানুভিশ্চৈব নিঘ্নন্তাবিতরেতরম্।
কুস্তিগীরের যেসব কৌশল আজও চালু আছে, তার সঙ্গে প্রাচীনদের প্রাথমিক পাঠ মিলে যাবে। কেন না সভ্যতার সমবয়সি এই যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে একবার দূরে ঠেলে দেওয়া, একবার চেপে ধরে নীচে ফেলবার চেষ্টা, পরমুহূর্তে ছেড়ে দিয়ে সামনাসামনি আস্ফালন এবং তার পরেই লেঙ্গি মেরে ফেলে দেবার চেষ্টা— মহাভারতের কবি এগুলির যোজনা করেছেন মহাকাব্যিক সংস্কৃতে— প্রকর্ষণ, আকর্ষণ, অভ্যাকর্ষণ এবং বিকর্ষণ— প্রকর্ষণাকর্ষণয়োরভ্যাকর্ষণবিকর্ষণৈঃ। আর আমরা যে এইশব্দগুলির অর্থ করেছি, তা টীকাকার নীলকণ্ঠের ব্যাখ্যা ধরে। মল্লযুদ্ধের এই আকর্ষণ-বিকর্ষণের মধ্যে কিন্তু প্রবল মুষ্ট্যাঘাতও এতটুকু বাদ যাচ্ছে না। কেন না একালের ‘বক্সিং’ এবং কুস্তির মধ্যে যেমন পরস্পরের কোনও মিশ্রণ নেই, সেকালে কিন্তু এই মিশ্রণ ছিল।
ফলে দুই মহামল্লের পরস্পরাকর্ষণের মধ্যে প্রচণ্ড চড়-থাপ্পড়-ঘুষি মারা চলতে লাগল এবং তার সীমা এতটাই যে দূর থেকে তার শব্দ শোনা যাচ্ছিল— ততশ্চটচটাশব্দঃ সুঘোরঃ সমপদ্যত।
একটা সময় এল, যখন এই মল্লযুদ্ধের প্রক্রিয়ায় মহাবলী ভীমসেন শল্যকে দু’হাতে ওপরে তুলে আছাড় দিলেন মাটিতে— ততো ভীমঃ সমুৎক্ষিপ্য বাহুভ্যাং শল্যমাহবে। ব্রাহ্মণবেশী ভীমের শক্তি দেখে সমবেত বামুনদের দারুণ গর্ব হল। শল্যের অবস্থা দেখে বামুনরা আহ্লাদে হেসে উঠলেন। শল্য একটু দূরে গিয়েই আছড়ে পড়েছিলেন, শত্রুর এই ভূপাতিত দুর্বল-ভগ্ন অবস্থায় প্রতিমল্লের সুযোগ আসে তাকে আপন শক্তিতে চেপে ধরে মেরে ফেলার। মহাভারতের কবি লিখেছেন— এ বড় আশ্চর্য ঘটনা ঘটল যে, ভীম শল্যের মতো এমন এক বীরকে ভূপাতিত দেখেও তাঁকে বধ করলেন না— যচ্ছল্যং পাতিতং ভূমৌ নাবধীদ্ বলিনং বলী। আসলে মহাকবি যেটা উহ্য রেখে দিলেন, সেটা হল— শল্য তাঁর ভাগনেদের যতই না চিনে থাকুন, ভীম তাঁকে চিনেছেন ধৃষ্টদ্যুম্নের মুখে বিবাহ-সভায় আগত রাজনাম-কীর্তনের সময়। ভীম জানেন— শল্য তাঁদের মামা, নিরুপায় হয়ে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে বটে, কিন্তু বিবাহ-সভায়-আসা ভোলেভালা মামাকে মেরে ফেলাটা কোনও বীরোচিত কর্ম হবে না।
এই মার খাবার পরেও আমরা শল্যকে আর ধারে-কাছে দেখিনি এবং তিনি যদি পরে জেনেও থাকেন যে, দ্রুপদের রাজসভায় তিনি ছদ্মবেশী ভাগনের হাতে মার খেয়েছেন, তবে তাতেও তিনি দুঃখ পাননি। তিনি সরল যুক্তিতেই বুঝেছেন যে, ওই আঘাত তাঁর প্রাপ্যই ছিল। এর পরে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের কালে দিগ্বিজয় করতে বেরোলেন ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব চার ভাই। নকুল তো মদ্ররাজের আপন ভাগনে, দিগ্বিজয়ের ক্রমে এক সময় তিনি এসে পৌঁছোলেন মদ্রদেশের রাজধানী শাকল বলে একটা জায়গায়। সেখান থেকেই তিনি দূত পাঠালেন মাতুলের কাছে, যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের খবর দিয়ে। দূতের মুখে ভাগনেদের রাজসূয় যজ্ঞের খবর শুনে তিনি মহাখুশি হলেন। নকুলকে আর যুদ্ধ করতে হয়নি, তিনি সানন্দে নকুলের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন— মাতুলং প্রীতিপূর্বেণ শল্যং চক্রে বশে বলী। শল্য শুধু যুধিষ্ঠিরের বশ্যতা স্বীকার করে নিলেন না, এই তিনি প্রথম সুযোগ পেলেন আপন ভাগনেটিকে যথাসাধ্য আদর-যত্ন করার। নকুলকে খুব যত্ন-আত্তি করলেন শল্য— সে তেন সৎকৃতো রাজ্ঞা সৎকারার্হো বিশাম্পতে। নকুলও তাঁর মাতুলের দেওয়া মণি-রত্নের বিচিত্র উপহার নিয়ে প্রস্থান করলেন দিগ্বিজয়ীর মতোই।
আমরা জানি— রাজসূয় যজ্ঞের ক্ষেত্রে দিগ্বিজয় ব্যাপারটা একটু সাজানো গোছের হয় সব সময়েই। কেন না রাজ্যের পর রাজ্য লাইন দিয়ে শত্রু-মিত্র-নির্বিশেষে যুধিষ্ঠিরের বশ্যতা স্বীকার করে নিচ্ছে, এটা একটু আশ্চর্য লাগে। কোনও কোনও রাজ্য যে বিজিগীষু রাজার বিরুদ্ধে লড়াই দিচ্ছিলেন না, তা নয়। কিন্তু সেটাও যেন কিছু সাজানো লাগে, যেন রাজসূয়-প্রবৃত্ত রাজা কতটা ক্ষমতাশালী সেটা দেখানোর জন্যই যেন এই যুদ্ধ। বাস্তবে রাজসূয় যজ্ঞকারী রাজার বাহুবল, সৈন্যবলের চেয়েও রাজধর্ম-নিবিষ্টতা এবং ধর্মভাবনা বেশি মূল্য পেত বলেই প্রায় সকলেই তাঁর বশ্যতা মেনে নিয়ে রাজকর দিত— অন্তত মহাকাব্যিক সংঘটনাগুলি এইরকমই দেখি। এমনটি যদি না হত, তা হলে মদ্ৰপতি শল্যের সঙ্গে যুদ্ধে নকুল হয়তো হেরেই যেতেন। কেন না যোদ্ধা হিসেবে শল্য কিছু কম ছিলেন না, অন্তত তাঁকে নকুলের মতো বীরের পক্ষে হারানো সম্ভব হত না। এখানে অবশ্য যুদ্ধের জায়গাটা ছাড়া শল্যের সঙ্গে নকুলের যে মামা-ভাগনের সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের মধ্যে এমনিতে যুদ্ধের কোনও সম্ভাবনাই নেই। অন্যদিকে তাঁর চরিত্রের মধ্যেও সরলতা আছে এবং একবার যদি তিনি বুঝে ফেলেন যে তাঁর সহায়তা প্রার্থনা করা হচ্ছে, তা হলেই তিনি তার দলে। নকুলও এই মূহূর্তে তাঁর মামাকে খুঁজে পেয়েছেন।
রাজসূয় যে শুধুই মেনে নেবার জায়গা নয়, অথবা প্রাথমিকভাবে মেনে নিলেও কোনও-না-কোনও সময়ে যে চরম বিরোধিতার জায়গাও থাকে, সেটা যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়-যজ্ঞের অন্তিম অনুষ্ঠান থেকেই প্রমাণ হয়ে যাবে এবং লক্ষণীয়, সেখানেও মদ্রপতি শল্য যুধিষ্ঠিরের শত্রুর মুখে প্রশংসিত এবং সমর্থিত হচ্ছেন। দোষের মধ্যে এই— রাজসূয় যজ্ঞের মূল অনুষ্ঠানে যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মের কথায় বাসুদেব কৃষ্ণকে জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্যটুকু দান করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এই অবস্থায় চেদিরাজ শিশুপাল সমাগত রাজাদের সামনে কৃষ্ণের নিন্দা আরম্ভ করলেন। নিন্দার বিষয় আরও অনেক ছিল, কিন্তু শিশুপালের সবচেয়ে রাগের কারণ যেটা দাঁড়াল, সেটা হল— এত এত গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব রাজসূয়ের আসরে উপস্থিত থাকতে যুধিষ্ঠির কেন কৃষ্ণকে অর্ঘ্য দিতে গেলেন। আসলে কৃষ্ণ তাঁর চরম শত্রু, কৃষ্ণ তাঁর পিতা-প্রতিম জরাসন্ধকে পাণ্ডবদের মাধ্যমে মেরে ফেলেছেন। অতএব তাঁর তুলনায় অন্য যে-কোনো মানুষই তাঁর কাছে অর্ঘ্যদানের যোগ্যতম ব্যক্তি। ভীষ্ম, দ্রোণ, দ্রুপদ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন— কার নাম গ্রহণ করেননি শিশুপাল? অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে এঁদের সম্বন্ধে কথা বলতে বলতে শিশুপাল মদ্ৰপতি শল্যের নাম করে বলেছেন— মদ্ৰাধিপ শল্যও তো উপস্থিত আছেন এখানে। তিনি থাকতে কৃষ্ণকে কেন অর্ঘ্যদান করলে তুমি— শল্যে মদ্ৰাধিপে চৈব কথং কৃষ্ণস্ত্বয়ার্চিতঃ?
শিশুপালের এই সশ্রদ্ধ রাজনাম-কীর্তনের মধ্যে অন্য রাজা বা ঋষিদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা কতখানি ছিল বলা মুশকিল, কিন্তু তাতে যে কৃষ্ণের প্রতি বিদ্রোহ-বিদ্রূপটাই বেশি সেটা বোঝার কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু এই অসংশ্লিষ্ট ঘটনার মধ্যে আমাদের কাছে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেটা হল— শক্তি, শৌর্য কিংবা সম্মানের দিক থেকে শল্যরাজ কিছু কম ছিলেন না। যতই তিনি দূরে থাকুন, অথবা খানিকটা ‘আন্ইন্ভলভড’, তবু তৎকালীন বীর নামের মধ্যে তাঁকে গণ্য করতে হবে, তাঁকে ডাকতে হবে প্রয়োজনে। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়ে কৃষ্ণের তুলনায় শল্যকে মহত্তর করে দেখিয়ে শিশুপাল যতই ভাল্ভালাই করুন, শল্য তাঁর প্রশংসায় স্ফীত হয়ে যাননি। তিনি রাজসূয় যজ্ঞের শেষ পর্যন্ত থেকেছেন এবং রাজসূয়-যজ্ঞে যোগ দিয়ে অন্যান্য রাজারা যে-সব উপহার দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরকে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম দামি উপহার দিয়েছিলেন শল্য। নিজের রাজ্য থেকে তিনি তাঁর বড় ভাগনের জন্য বয়ে এনেছিলেন অসাধারণ একটি তরবারি, যেটার ‘গ্রিপ’ নেবার জায়গাটা এত সূন্দর যে মুঠো করে ধরলে মনে হবে যেন এই হাতের মাপ করেই তরবারিটি তৈরি হয়েছিল। শল্য আরও একটি জিনিস এনেছিলেন যেটা ‘শো-পিস’ হিসেবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। সেটি ছিল সোনার কারুকার্য করা একটা ‘শো-পিস’ যাকে বলা হয়েছে ‘শৈক্য’ অর্থাৎ শিকেয় তুলে রেখে প্রদর্শন করতে হয়। শল্যের দেওয়া সেই সুন্দর মুষ্টিযুক্ত তরবারি এবং সেই ‘শৈক্য’ স্বর্ণ-পাত্রের প্রদর্শনী দেখে সভায় উপস্থিত দুর্যোধনের চোখ এতই টাটিয়েছিল যে, তিনি পিতা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যখন যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সাফল্য বর্ণনা করছিলেন, তখন বিভিন্ন রাজোপহারের মধ্যে তিনি শল্যের দেওয়া উপহারটিকেও যথেষ্ট মর্যাদা দিয়ে বর্ণনা করেছেন— অসিঞ্চ সুৎসরু শল্যঃ শৈক্যং কাঞ্চনভূষণম্।
যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ হয়ে যাবার পরেও শল্য কিছুদিন এই অঞ্চলে থেকে গিয়েছিলেন বলে মনে হয়। কেন না রাজসূয়-যজ্ঞের কিছুদিনের মধ্যেই দুর্যোধনের প্ররোচনায় হস্তিনাপুরে যে পাশাখেলার আসর বসে সেখানে শল্যকে আমরা উপস্থিত দেখেছি। যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে হস্তিনাপুরে পাশা খেলতে এসে যাঁদের সঙ্গে প্রথমে সৌজন্য সাক্ষাৎকার করেন, তাঁদের মধ্যে যেমন ভীষ্ম-দ্রোণ, কৃপ-কর্ণের মতো চিরাচরিত মুখ ছিল, তেমনই ছিলেন শল্য এবং অন্যান্য দেশীয় কিছু রাজা, যাঁরা আগেই এসে উপস্থিত হয়েছিলেন হস্তিনাপুরে, অথবা আগে থেকেই সেখানে ছিলেন— যে চান্যে তত্র রাজানঃ পূর্বমেব সমাগতাঃ। আমাদের ধারণা— যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে যোগ দিতে এসে শল্য কিছুদিন ইন্দ্রপ্রস্থে থাকার পর হস্তিনাপুরে গিয়েছিলেন সেখানকার বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে। বিশেষত ভীষ্মের সঙ্গে, যিনি তাঁর ভগিনীর পাণিপ্রার্থনা করেছিলেন পাণ্ডুর জন্য। শল্য হস্তিনাপুরে থাকাকালীনই ধৃতরাষ্ট্রের তরফ থেকে পাশাখেলার নিমন্ত্রণ যায় যুধিষ্ঠিরের কাছে এবং তিনি এসে ভীষ্ম; দ্রোণ সকলের সঙ্গে দেখা করার পর কর্ণ-দুর্যোধনের পরেই শল্য এবং শকুনির সঙ্গে সৌজন্য-সাক্ষাৎকার করেন— দুর্যোধনেন শল্যেন সৌবলেন চ বীর্যবান।
হস্তিনাপুরে মদ্ৰপতি শল্যের একটা প্রাথমিক উপস্থিতি টের পেলাম বটে, কিন্তু এই উপস্থিতির কোনও ক্রিয়াকারিতা আমাদের চোখে পড়েনি। এত যে অন্যায় পাশাখেলা হল, উন্মুক্ত সভার মধ্যে কুলবধূ দ্রৌপদীকে নিয়ে অসভ্য টানাটানি হল, সেখানে পারুন না পারুন বিদুর কিছু বলেছেন, ভীষ্ম কিছু বলেছেন, এমনকী বলেছেন বিকর্ণও, কিন্তু ভাগনেদের এই বিপদে শল্যের মুখে আমরা একটা কথাও শুনিনি। এমনকী এই সময় থেকে পাণ্ডবদের বনবাসে যাওয়া পর্যন্ত আমরা শল্যের উচ্চবাচ্য কিছু শুনিনি। হয় তিনি হস্তিনাপুর থেকে চলে গিয়েছিলেন অথবা সেখানে থেকে থাকলেও সমস্ত ঘটনাবলীর প্রতি তিনি উদাসীন ছিলেন। হয়তো বা পাণ্ডব-কৌরবের এই জ্ঞাতিশত্রুতার মধ্যে নাক গলিয়ে তিনি কোনও পক্ষকেই সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট করতে চাননি। সম্পূর্ণ সময়টা ধরে তিনি থেকেছেন নিশ্চুপে অথবা চলে গেছেন নিশ্চুপে। নাকি মনে মনে এটাও জল্পনা করব যে, ভাগনে-বাড়ির রাজসূয়-যজ্ঞে এসেও সেখানে যথেষ্ট আতিথেয়তার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও তিনি হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্রের গৃহে এসে বসবাস করছেন কেন? আর কেনই বা যুধিষ্ঠিরের সৌজন্য-বিনিময়ের কালে তিনি দুর্যোধন-শকুনির মাঝখানে আছেন? তার মানে কি এই যে, ভাগনেদের সঙ্গে মদ্ৰপতি শল্যের যত সুসম্পর্কই থাকুক, তবু ধৃতরাষ্ট্র এবং তাঁর পুত্র-পরিজনের প্রতি তাঁর অন্য সহানুভূতিও ছিল।
তবে আমরা যত জটিলভাবে ভাবছি, শল্য এতটা জটিল চরিত্রই নন। হয়তো হস্তিনাপুরের ভীষ্ম কিংবা ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল বলেই তিনি ভাগনের রাজসূয় সেরে সেখানে গিয়ে ছিলেন এবং পাশাখেলার পূর্ব দিনে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে দৈবক্রমে এবং হয়তো তিনি তার পরেই চলে গেছেন মদ্রদেশে অথবা হস্তিনাপুরে থাকলেও তিনি নিজেকে উহ্য রেখেছেন সযত্নে। এটাই তাঁর স্বভাব। এই স্বভাবের পরিবর্তনও হয় না। পাণ্ডব-ভাগনেদের বারো বছরের বনবাস-জীবন কাটল— বনবাসেও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন কৃষ্ণ, এবং অন্যান্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়েরাও, কিন্তু শল্য কোনওদিনও এলেন না। বনবাস এবং অজ্ঞাতবাসের সময় চলে গেল। বিরাটের রাজধানীতে সেই বিরাট ‘মিটিং’ বসল। সেখানে কৃষ্ণ, বলরাম, দ্রুপদ সকলেই এসেছেন, কিন্তু শল্য পাণ্ডবদের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের এই দুর্ভাবনার দিনে নিজে উপস্থিত হননি।
একটা খটকাও লাগে মাঝে মাঝে। লক্ষ করে দেখুন, পাণ্ডবজননী কুন্তীর সঙ্গে কৃষ্ণপিতা বসুদেবের যে সম্বন্ধ, মাদ্রীর সূত্রে শল্যের সঙ্গেও কিন্তু সেই একই সম্বন্ধ। অথচ কুন্তীর সম্বন্ধে বাসুদেব কৃষ্ণ পাণ্ডবদের যে কোনও ব্যাপারে যতখানি সক্রিয়, শল্য ঠিক তার উলটো— ঠিক ততটাই নিষ্ক্রিয়। আমাদের জিজ্ঞাসা হয়— এই নিস্ক্রিয়তা কি মাদ্রীর সপত্নী কুন্তীর কারণেই অথবা কুন্তীর সূত্রে কৃষ্ণের অত্যুপস্থিতি শল্যের মনে কোনও অবহীন চেতনা জাগাত। হয়তো এই কারণেই অমন একটা সময়ে, যখন পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধ-সম্ভাবনায় পাণ্ডবদের ঘনিষ্ঠ-জনেরা সকলেই বিরাটের রাজসভায় উপস্থিত, তখন শল্যকে কিন্তু নিমন্ত্রণ করে নিজেদের দলে যোগ দেবার কথা বলতে হচ্ছে যুধিষ্ঠিরকে।
শ্বশুরবাড়ির লোক বলেই হয়তো দ্রুপদই এই লৌকিকতার কথা প্রথম তুললেন। তিনি বললেন— কৌরবদের মন বোঝাবুঝির কথা পরে হবে, দুর্যোধন কী ভাবছেন অথবা ভীষ্ম-দ্রোণ কী ভাবছেন— এ-সব প্রক্রিয়া চলতে থাকুক। কিন্তু যুদ্ধের সম্ভাবনা মাথায় ধরে নিয়েই আমাদের সকলকেই ডাকতে হবে, দূত পাঠাতে হবে সবার কাছে, বিশেষত আমাদের মিত্রগোষ্ঠীকে জানাতে হবে— তাঁরা যেন সৈন্য-সামন্ত দিয়ে আমাদের শক্তি বাড়ান— প্রস্থাপয়াম মিত্রেভ্য বলান্যুদযোজয়স্ব নঃ। এখানে পাণ্ডবদের মিত্রশক্তি বলে যাঁদের ভাবা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে দ্রুপদ রাজা প্রথমে যাঁর নাম করছেন, তিনি কিন্তু মদ্ৰপতি শল্য। দ্রুপদ বলছেন— শীঘ্রগামী দূতেরা আগে যাক শল্যরাজার কাছে, ধৃষ্টকেতু এবং জয়ৎসেনের কাছে— শলস্য ধৃষ্টকেতোশ্চ জয়ৎসেনস্য বা বিভো। আগে যাবার দরকার এই কারণে যাতে দুর্যোধনের লোকেরা আমাদেরও আগে তাঁদের হাত করে না ফেলে। দ্রুপদ বলছেন— আমি খুব ভালই জানি যে, ভদ্র-সজ্জন রাজাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা আগে-আসা প্রার্থী রাজাকে ফিরিয়ে দিতে পারেন না— পূৰ্বাভিপন্নাঃ সন্তশ্চ ভজন্তে পূর্ব চোদনম্।
দ্রুপদের কথা থেকে খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, মদ্ৰাধিপতি শল্য পাণ্ডবদের সম্পর্কে মামা হলেও, তিনি কিন্তু তেমন ‘কমিটেড’ মানুষ নন, যিনি ভাগনেদের প্রয়োজন-মাত্রেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন তাঁদের দলে। অর্থাৎ শল্য সেই ধরনের মানুষদের মধ্যে পড়েন যেখানে সমান আশা এবং সম্ভাবনা নিয়ে পাণ্ডবরাও দূত পাঠাবেন এবং দুর্যোধনও দূত পাঠাবেন। দ্রুপদ বলেওছেন সে-কথা। বলেছেন— এই শল্য, ধৃষ্টকেতু বা জয়ৎসেনের কাছে দুর্যোধনও সাহায্য প্রার্থনা করবেন— স তু দুর্যোধনো নূনং প্রেষয়িষ্যতি সর্বশঃ। অন্তত তাঁর আগে যাতে আমাদের দূত চলে যায়, আমাদের সেই চেষ্টাটা তাড়াতাড়ি করতে হবে।
দ্রুপদের সন্দেহ এবং পূর্বভাবনা যে কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল তা শল্যের আচরণ থেকেই সবচেয়ে ভাল বোঝা যায়। মহাভারতের কবি এই উদ্যোগপর্ব পর্যন্ত শল্যের কথা তেমন সবিস্তারে কোথাও বলেননি, কিন্তু রাজনীতি যে কত বিষম বস্তু, এখানে যে বাপ-ভাই, মামা-ভাগনেও কার্যকালে অন্যরকম চেহারা নেয়, সে-কথা বলতে গিয়ে মহাকবি সম্পূর্ণ একটি অধ্যায় খরচ করেছেন শল্যের জন্য। মহাকাব্যের কবি সব সময় স্পষ্টভাষণে তত্ত্ব বোঝান না। তিনি ঘটনার বিস্তারে মানুষের চরিত্র বলতে বলতে রাজনীতির মারপ্যাঁচ পরিষ্কার করে দেন। বিশেষত শল্যের মতো ব্যক্তি— ঘটনাক্রমে যাঁর নিজের শক্তিও আছে, সৈন্যবলও আছে— অথচ স্বভাবে সরল, রাজনীতির কূট তেমন বোঝেন না, তিনি যে কী করে অন্যের তৈল-প্রলেপ লাভ করে বিপরীত স্থানে নিজেকে সমর্পণ করেন, সেটা মহাভারতের কবি দেখিয়ে দিয়েছেন মানব-চরিত্রের অঙ্কনশৈলী প্রকট করে।
দ্রুপদরাজার প্রস্তাব-মতো পাণ্ডবরা কিন্তু খুব ভুল করেননি। তাঁরা আগেভাগেই দূত পাঠিয়ে শল্যকে তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে যোগ দিতে বলেছিলেন তাঁদের সঙ্গে। দুর্যোধনের দূত তখনও তাঁর কাছে যায়নি। অতএব দূতের মুখে পাণ্ডবদের আমন্ত্রণ শুনেই বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে সপুত্রক চললেন পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করতে। মহাভারতের যুদ্ধে শল্যের যে খুব অবদান আছে, তা নয়; তৎসত্ত্বেও এত যে তাঁর গুরুত্ব সেটার কারণ বোধহয় তাঁর সৈন্যসংখ্যা। আমি আগেই বলেছি— মদ্রদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র যতখানি রাজতান্ত্রিক ছিল, তার চেয়ে বেশি গণরাজ্যের বৈশিষ্ট্য আত্মসাৎ করেছিল। আর গণরাজ্যের সৈন্য এবং সৈন্যসংখ্যা একটা খুব বড় ব্যাপার। কেন না সময়কালে এরা ‘মার্সেনারি’ হিসেবে যে কাজ করত, সে প্রমাণ আমরা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ‘বার্তাশস্ত্রোপজীবী’ শব্দটার মধ্যে পেয়েছি। বার্তা মানে কৃষি-পশুপালন অথবা বাণিজ্য। গণরাজ্যের অনেকেই সময়কালে এই সব কাজ করত, আর যখন প্রয়োজন হত শস্ত্রধারণ করে যুদ্ধ করত। গণরাজ্যের প্রধানেরাও এইরকম সৈন্য পোষণ করতেন। মহাভারতের এক জায়গায় বলা হচ্ছে— মদ্ৰপতি শল্য এক বিরাট সেনাবাহিনী পোষণ করতেন— তথাহি বিপুলাং সেনাং বিভর্তি স নরর্ষভঃ।
সেনাবাহিনীর এই বিপুল আকার উল্লেখ করে মহাভারতের কবি সেই ঐতিহাসিক তথ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন যাতে প্রমাণ হয়— শল্য খুব নামিদামি রাজা না হলেও তাঁর আসল গুরুত্বটা কোথায়। শল্যের সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমে যখন, তাঁরই পিছন পিছন চলছিল তখন মহাভারতের কবি মন্তব্য করেছেন— শল্যের সেনাবাহিনী প্রায় আধ যোজন পথ জুড়ে চলছিল— তস্য সেনানিবেশোহভূদ্ অধ্যর্ধমিব যোজনম্। শল্যরাজের সৈন্য-পরিমাণ— এক অক্ষৌহিণী। অনেকগুলি ক্ষত্রিয়বীর তাঁর সেনাপতির কাজ করেন। সৈন্যদের বর্ম, ধ্বজ, ধনুক, আভরণ, বাহন যতই বিচিত্র হোক, একটা জায়গায় তাদের মিল হল— মদ্রদেশের সৈন্যদের একটা নিজস্ব ‘ইউনিফর্ম’ আছে, তারা প্রত্যেকে স্বদেশি মদ্রদেশীয় বেশভূষায় অলংকৃত— স্বদেশ-বেশাভরণা বীরাঃ শত-সহস্রশঃ।
শল্য চলেছেন পাণ্ডবদের কাছে, তাঁর সৈন্যদের কুচকাওয়াজে পৃথিবী কম্পিত হচ্ছে, মাঝে মাঝে অবশ্য তিনি সৈন্যদের বিশ্রাম করারও সুযোগ দিচ্ছেন। রাস্তাও তো কিছু কম নয়। এখনকার পাকিস্তানের শিয়ালকোট অথবা পাক-অধিকৃত কাশ্মীর অঞ্চল থেকে বিরাট রাজার রাজধানী জয়পুর-ভরতপুর অঞ্চলে আসা— এতটা রাস্তা, শল্য ধীরেসুস্থেই যাচ্ছিলেন পাণ্ডবদের কাছে— শনৈর্বিশ্রাময়ন্ সেনাং স যযৌ যত্র পাণ্ডবাঃ। কিন্তু এতগুলি সৈন্য নিয়ে শল্যের এই ধীর-প্রয়াণই কিন্তু পাণ্ডবদের সৌভাগ্য কেড়ে নিয়ে চলে গেল। অথচ পাণ্ডবরা এইবারে কোনও ভুল করেননি, তাঁদের দূত পূর্বেই উপস্থিত হয়ে শল্যকে সৈন্য-নির্যাণেও প্রবৃত্ত করেছিল। কিন্তু সময় পার হয়ে গেলেও, এমনকী প্রথমে ভুল করে ফেললেও পরে কীভাবে শুধরে নিয়ে পরিস্থিতি নিজের অনুকূল করে নিতে হয়, সেটা দেখিয়ে দিলেন দুর্যোধন।
শল্য বিশাল সৈন্য নিয়ে পাণ্ডবদের কাছে যাচ্ছেন— এ কথা শোনা মাত্রেই দুর্যোধন শল্যের যাত্রাপথে উপস্থিত হয়ে এক অদ্ভুত সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করলেন খুব তাড়াতাড়ি— উপায়ান্তম্ অভিদ্রুত্য স্বয়মানৰ্চ ভারত। আসলে দুর্যোধন দূতের মুখে খবর পেয়ে গিয়েছিলেন যে শল্য সৈন্য নিয়ে যেতে যেতে মাঝে মাঝে তাদের বিশ্রামও করাচ্ছেন। দুর্যোধন আর দেরি না করে শল্যের অনুমিত যাত্রাপথের এক জায়গায়— যেখানে শল্য এখনও এসে উপস্থিত হননি, কিন্তু অবশ্যই সেখান দিয়ে যাবেন— সেইরকম একটা জায়গায় অস্থায়ী কতগুলি গৃহ-মণ্ডপ তৈরি করলেন— অস্থায়ী হলেও রত্নখচিত, সুসজ্জিত আবাস-গৃহ। সময় কাটানোর জন্য ব্যবস্থা রাখলেন নানাবিধ আমোদ-প্রমোদ-ক্রীড়ার। পরিবেশ মনোরম করার সঙ্গে সঙ্গে এতগুলি সৈন্যের বাস্তব প্রয়োজন মাথায় রেখে এখানে-ওখানে কুয়োর জলের ব্যবস্থা, এবং ছোট-বড় দিঘিও কাটানো হল। রান্না করার জায়গা অস্থায়ী হলেও খাদ্য-পেয়, মধু-মাংস সমস্ত ব্যবস্থাই পাকা। এমনকী সুদৃশ্য সেই আবাস গৃহগুলিতে মালাও রাখা হল অনেক, যাতে যে গৃহেই শল্য উপস্থিত হন তাঁকে অভ্যর্থনা করা যায় রাজোচিত মর্যাদায়— তত্র মাল্যানি মাংসানি… ঔদনানি গৃহাণি চ।
যতগুলি গৃহমণ্ডপ তৈরি হয়েছিল, তার প্রত্যেকটাতে দুর্যোধনের লোকেরা শল্যকে সন্তুষ্ট করার মহড়া নিয়েই বসেছিল— দুর্যোধনস্য সচিবৈর্দেশে দেশে সমন্ততঃ। সমস্ত ব্যবস্থা করে দুর্যোধন নিজে রইলেন সংগুপ্তভাবে, ছদ্মবেশে। দূর যাত্রাপথ বেয়ে আসতে আসতে শল্য হঠাৎ রাস্তার মধ্যে এমন বিচিত্র গৃহমণ্ডপ দেখে কৌতূহলী হয়ে থামতেই দুর্যোধনের লোকেরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল— এই সব ব্যবস্থা আপনার জন্যই। অভিভূত শল্য একটি গৃহমণ্ডপ ছেড়ে অন্যটিতে যেতে থাকেন, আর দুর্যোধনের লোকেরা তাঁকে দেবতার মতো অভ্যর্থনা করতে থাকে। এত অভ্যর্থনা, এত মান-লাভ— শল্য দেবতার মতোই সুখী মনে করছিলেন নিজেকে; ভাবছিলেন— দেবরাজ ইন্দ্রও বোধহয় এত পূজা-মান লাভ করেন না— মেনেহভ্যধিকমাত্মানম্ অবমেনে পুরন্দরম্।
পাণ্ডবদের কাছে যাবার পথে এই দান-মান-অভ্যর্থনা লাভ করে শল্যের মনে হল— নিশ্চয়ই এত সব ব্যবস্থা যুধিষ্ঠিরই করে রেখেছেন তাঁর ক্লান্ত পথযাত্রায় আরাম আনার জন্য। সেই ভ্রান্তিতেই তিনি স্বসুখগর্বে হেঁকে বললেন— যুধিষ্ঠির-নিযুক্ত লোকজন কারা আছ এখানে, কারাই বা এই সুন্দর আবাস তৈরি করেছে আমার জন্য, তাদের ডাক, আমি সবাইকে পারিতোষিক দেব— যুধিষ্ঠিরস্য পুরুষাঃ কেহত্ৰ চক্রুঃ সভা ইমাঃ। আশা করি, কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠিরের এতে অমত হবে না। উটকো রাস্তার মধ্যে যারা এমন সুন্দর ঘর তৈরি করতে পারে, তারা তো অবশ্যই পরিতোষিক লাভ করার যোগ্য— আনীয়ন্তাং সভাকারাঃ প্রদেয়ার্হা হি তে মতাঃ।
দুর্যোধনের লোকজনেরা শল্যের কথা শুনে বেশ পরিতৃপ্ত হল এবং ঠিক সময়ে এসে দুর্যোধনকে সব ঘটনা জানাল, বিশেষত শল্যের সন্তুষ্টির কথা। মহাভারতের কবি লিখেছেন— দান-মান-সম্ভাষণে তৃপ্ত-স্ফীত শল্য যখন মানদাতার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত— এমন একটা মনোভাব পোষণ করছেন, ঠিক তখনই দুর্যোধন লুকিয়ে শল্যের সঙ্গে দেখা করতে এলেন— গূঢ়ো দুর্যোধনস্তত্র দর্শয়ামাস মাতুলম্। দুর্যোধন বললেন— এই সমস্ত যত্ন-আত্তি-অভ্যর্থনার ব্যবস্থা তিনিই করেছেন এবং তা মাতুল শল্যের সন্তোষের জন্য, আর কোনও হেতু নেই। শল্য একেবারে বিগলিত হয়ে গেলেন। দুর্যোধনকে আলিঙ্গন করে তিনি বললেন— বলো বৎস! কী চাও, কী তোমার অভীষ্ট?
সম্পূর্ণ এই ঘটনাটার মধ্যে সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হল— দুর্যোধনের ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং তাঁর লোক চেনার ক্ষমতা, অপিচ ঠিক তার উলটো দিকে শল্যরাজার সন্তুষ্ট হবার ক্ষমতাটাও অনুমান করতে হবে, বুঝতে হবে— কতটুকু বাহ্য আড়ম্বরে তিনি বিগলিত হন। শল্য দুর্যোধনকে অভীষ্ট যাচনা করতে বললে দুর্যোধন ততোধিক সতর্ক হয়ে বললেন— আপনি যেমনটি বলছেন, সেই প্রার্থনা-পূরণের সংকল্প যেন আপনার সত্য হয়। আমি শুধু চাই— আপনি আমার সমস্ত সেনাবাহিনীর নায়ক হিসেবে কাজ করুন— সর্বসেনা-প্রণেতা মে ভবান্ ভবিতুমর্হসি। শল্য দ্বিতীয় কোনও চিন্তা না করে, এমনকী তাঁর ভাগনেরা ব্যাপারটাকে কীভাবে নেবে, সেটা এতটুকুও মাথায় না রেখে দুর্যোধনকে সায় দিয়ে বললেন— ‘ডান্’। বলো, আর কী করতে পারি তোমার জন্য— কৃতমিত্যব্রবীচ্ছল্যঃ কিমন্যৎ ক্রিয়তামিতি।
দ্রুতসম্মতির ক্ষেত্রে ইংরেজির ‘ডান’ (done) শব্দটির যে এমন একটা ‘স্মার্ট’ মহাকাব্যিক প্রতিশব্দ থাকতে পারে, সে আমি ভাবতেও পারিনি। শল্য বললেন— কৃতমিতি— অর্থাৎ তুমি যা চাইছ, তা করা হয়ে গেছে— কৃতমিত্যব্রবীচ্ছল্যঃ— তুমি আর কী চাও বলো। দুর্যোধন বললেন— আমার আর কিছু চাই না, শুধু আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। শল্য দুর্যোধনকে নিশ্চিন্ত করে বললেন— তুমি তোমার রাজধানীতে ফিরে যাও। আমি সময়মতো ঠিক পৌঁছে যাব সেখানে। তবে আমাকে একবার যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। তাঁর সঙ্গে দেখা করেই যত শীঘ্র সম্ভব আমি চলে যাব তোমার কাছে— দৃষ্ট্বা যুধিষ্ঠিরং রাজন্ ক্ষিপ্রমেষ্যে নরাধিপ— কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা একবার করতেই হবে।
শল্য আত্মদংশনে ভুগছেন সামান্য। একেবারে সামান্যই অবশ্য। তাঁর ভাগনেরা তাঁকে ডেকেছে এবং দুর্যোধনের অনেক আগেই ডেকেছে, তিনিও তাদের কাছেই যাচ্ছিলেন। অথচ মাঝখানে দুর্যোধনের আদর-অভ্যর্থনায় তিনি একেবারে ভেসে গেলেন। ভেসে যাবার জন্য তাঁর যে খুব দুঃখ হচ্ছে, তা নয়। যুধিষ্ঠিরের কাছে যেতে গিয়ে দুর্যোধনকে তিনি আত্ম-সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন, তাতেও তাঁর কোনও আত্মদহন নেই। আসলে হঠাৎ ভেসে যাওয়ার বীজটা তাঁর চরিত্রের মধ্যেই নিহিত ছিল। আদর, আপ্যায়ন, প্রশংসা তাঁকে আত্মতৃপ্তি দেয়, তিনি ভেসে যান। তবে হ্যাঁ, ভেসে গেলেও তিনি পুরোটা ভোলেন না। তাই এখনও যুধিষ্ঠিরের কাছে যাবার অপেক্ষা আছে। যুধিষ্ঠিরের কাছে যাচ্ছেন দেখে দুর্যোধন অবশ্য মনে মনে ভয় পেলেন, কিন্তু রাজোচিত নিগূহন-বৃত্তিতে বাইরে সে-আতঙ্ক এতটুকু প্রকাশ না করে দুর্যোধন শল্যকে বললেন— আপনি কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবেন, মহারাজ! পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে দেখেই চলে আসবেন তাড়াতাড়ি— ক্ষিপ্রম্ আগম্যতাং রাজন্ পাণ্ডবং বীক্ষ্য পার্থিব— আমরা কিন্তু আপনার নায়কত্বের অধীন হয়েই রইলাম, আর আপনি আমাকে যে বর দিয়েছেন, তা যেন আপনার স্মরণে থাকে— ত্বয্যধীনাঃ স্ম রাজেন্দ্র বরদানং স্মরস্ব নঃ। দুর্যোধনের ভয় ছিল— শল্য যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে আবার না ভেসে যান।
কিন্তু না, শল্য এমন নন যে, তিনি কথা দিয়ে কথা রাখেন না। দুর্যোধনকে তিনি আশ্বস্ত করে বললেন— আমি খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসব। তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও— ক্ষিপ্রমেষ্যামি ভদ্রং তে গচ্ছ ত্বং স্বপুরং নৃপ। বিদায়কালে শল্য এবং দুর্যোধন দু’জনেই দু’জনকে গাঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর শল্য চললেন যুধিষ্ঠিরের বাড়ি আর দুর্যোধন চললেন নিজের বাড়ি। এতক্ষণে কিন্তু শল্যের মনের ভিতর একটা খচখচানি হচ্ছে, তাঁর বোধ হচ্ছে— সব কথা যুধিষ্ঠিরকে খুলে বলা দরকার। পাণ্ডবরা তখন বিরাট রাজধানীর কাছাকাছি ‘উপপ্লব্য’ নামে অন্য একটি ক্ষুদ্র নগরে বাস করছেন। বিভিন্ন রাজ্যে সৈন্য পাঠানোর আর্জি জানানোর পর উপপ্লব্যে তাঁরা একটি অস্থায়ী সেনা-ছাউনিও তৈরি করে ফেলেছেন। সেখানে সেই পটমণ্ডপের স্কন্ধাবারে এসেই যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করলেন শল্য— উপপ্লব্যং স গত্বা তু স্কন্ধাবারং প্রবিশ্য চ।
আতিথেয়তার সামান্য বিধানে পাদ্য-অর্ঘ্য এবং একটি গোরু শল্যকে দান করার পরেই যুধিষ্ঠিরকে জড়িয়ে ধরে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন শল্য। তারপরেই একে একে জড়িয়ে ধরলেন ভীম-অর্জুন এবং দুই ভাগনে-প্রবর নকুল-সহদেবকে— তথা ভীমার্জুনৌ হৃষ্টৌ স্বস্রীয়ৌ চ যমাবুভৌ। উপযুক্ত আসনে বসে কুশল-বিনিময়ের পর শল্য যুধিষ্ঠিরকে বললেন— ভাগ্যি মানি যুধিষ্ঠির! এতদিনে তোমরা বনবাসের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়েছ। কম কষ্ট তো যায়নি, নির্জন বনের মধ্যে ভাইদের নিয়ে, দ্রৌপদীকে নিয়ে কোথায় থাকা, কোথাও খাওয়া, কোথাও শোয়া, সত্যিই বহু কষ্ট করেছ তুমি— সুদুষ্করং কৃতং রাজন্ নির্জনং বসতা বনে। তার ওপরে ছিল আবার অজ্ঞাতবাস। রাজ্যভ্রষ্ট অবস্থায় তোমাদের দুঃখই গেল শুধু, সুখ বলে কিছু নেই— দুঃখমেব কুতঃ সৌখ্যং রাজ্যভ্রষ্টস্য ভারত। আমি জানি, তোমার সমস্ত দুঃখেরই মূলে আছে দুর্যোধন এবং একদিন শত্ৰুসংহার করে তুমি সুখ লাভ করবে অবশ্যই— অবাপ্স্যসি সুখং রাজন্ হত্বা শত্রূন্ পরন্তপ।
শল্য অনেক প্রশংসা করলেন যুধিষ্ঠিরের, তাঁর কষ্টের জন্য দুঃখিত হয়ে সমব্যথাও জানালেন অনেক এবং আপনাদের বিশ্বাস হবে কিনা জানি না— শল্যের সমদুঃখভাবিতার মধ্যে কোনও ভান অথবা প্রবঞ্চনা ছিল না। যুধিষ্ঠির যে সদা-সর্বদা ধর্মে প্রতিষ্ঠিত এবং ধর্ম এবং সত্যের পথেই যে একদিন তিনি এবং তাঁর ভাইরা শত্ৰুসংহার করে রাজ্য উদ্ধার করবেন— এই কথা শল্য মন থেকেই বললেন। শল্য যদি চতুর প্রবঞ্চক হতেন তা হলে দুর্যোধনের সঙ্গে তাঁর যে আগেভাগেই দেখা হয়েছিল, সে কথা তিনি সম্পূর্ণ চেপে যেতেন। শল্য কিন্তু তা করেননি, বরঞ্চ যুধিষ্ঠিরের কাছে আসতে গিয়ে মাঝপথে দুর্যোধনের সঙ্গে যেভাবে তাঁর দেখা হয়েছে এবং প্রাথমিক আতিথেয়তায় ভুলে তিনি যে তাঁর প্রার্থনা সম্পূর্ণ মঞ্জুর করেছেন— সে-সব কথা সব খুলে বললেন শল্য— তচ্চ শুশ্ৰূষিতং সর্বং বরদানঞ্চ ভারত।
বিরাট-নগরে উপপ্লব্যে থাকাকালীন যুধিষ্ঠিরের হয়ে কোনও গুপ্তচর-সংস্থা কাজ করছিল না, এটা ভাবার কারণ নেই। তারা নিশ্চয়ই এসে শল্য-দুর্যোধন সমাগমের খবর যুধিষ্ঠিরকে দিয়েছিল। ফলত যুধিষ্ঠির শল্যের হঠাৎ-আচরণে খুব বেশি অবাক হননি, কেন না মাতুলের চরিত্র অনেক কাল ধরেই তিনি যা অনুধাবন করেছেন, তাতে খুব বেশি অবাক হবার কারণ নেই, এটা তিনি বোঝেন। বিশেষত শল্য যখন নিজের দুর্বল আচরণ সবটাই খুলে বলেছেন, তখন যুধিষ্ঠির আর ক্ষোভ প্রকাশ করেননি। বরঞ্চ বলেছেন— আপনি কোনও খারাপ কাজ করেননি, মহারাজ! আপনি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে কথা দিয়েছেন, সেটা অন্যায় বলি কী করে, আপনি ভালই করেছেন— সুকৃতং তে কৃতং রাজন্… ত্বয়া বাচা প্রতিশ্রুতম্।
যুধিষ্ঠির শল্যের স্বীকারোক্তি থেকেই বুঝেছেন যে, মনে মনে তিনি বিব্রত বোধ করছেন, মাতুল-সম্বন্ধী হয়েও তাঁদের শত্রুপক্ষে যোগ দেবার হঠকারিতায় তার মনে খোঁচা লাগছে কোথাও। সেই সুযোগ নিয়েই যুধিষ্ঠির বললেন-আপনি দুর্যোধনের পক্ষে এক অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে যোগ দিয়েছেন, সেখানে আমার বলার কিছু নেই, কিন্তু আমারও একটা কাজ আপনাকে করে দিতে হবে— একন্ত্বিচ্ছামি ভদ্রং তে ক্রিয়মাণং মহীপতে। যুধিষ্ঠির বোঝেন যে, তাঁর প্রস্তাব শোনার পর শল্য ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করবেন, এমনকী সে কাজের নীতিগত ঔচিত্য নিয়েও চর্চা আসবে শল্যের মনে, কিন্তু নিজেদের মামা শত্রু পক্ষে নাম লিখিয়েছেন, এই দুর্বলতায় আঘাত দিয়ে কোনও অন্যায় করার জন্যও তাঁকে অনুরোধ করা যায়, এটাও যুধিষ্ঠির বুঝে গেছেন। যুধিষ্ঠির একটু সাফাই গেয়েই বললেন— আমার একটা কথা কিন্তু রাখতেই হবে, মামা! সে আপনি অন্যায় কাজ বলুন, আর যাই বলুন, অন্যায় কাজ হলেও আপনাকে এই কাজটি করে দিতে হবে, মামা— রাজন্ অকর্তব্যমপি কর্তুমর্হসি সত্তম। আমি আপনার ক্ষমতা জানি। যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্যবীর্যে আপনি বাসুদেব কৃষ্ণের সমান। আমি জানি— এই বিরাট যুদ্ধে কর্ণ আর অর্জুনের মুখোমুখি লড়াই হবেই এক সময়। সেই যুদ্ধ ঘনিয়ে এলে কৃষ্ণকে অর্জুনের সারথি দেখে কর্ণ আপন হীনম্মন্যতায় ঠিক আপনাকে নিজের রথের সারথি হিসেবে চাইবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই— কর্ণস্য ভবতা কার্য্যং সারথ্যং নাত্ৰ সংশয়ঃ। এই সারথ্যের কালেই আমার কাজটুকু আপনার করে দিতে হবে।
ভণিতা বলুন, সাফাই বলুন, অথবা ধানাই-পানাই বলুন, তা এইটুকুতেই শেষ হয়েছে। যুধিষ্ঠির এবার প্রয়োজনের কথা বললেন। বললেন— আপনার ওই সারথ্য-কালে আপনি কিন্তু আপনার ভাগ্নে অর্জুনের কথাটা মনে রাখবেন, তাকে যেভাবেই হোক রক্ষা করতে হবে আপনাকে। আপনি যদি আমার কিছুমাত্র প্রিয়কার্য করতে চান, তা হলে ওই সময় অর্জুনকে বাঁচিয়ে রাখার কথাটা আপনাকে চিন্তা করতেই হবে— তত্র পাল্যোহর্জুনো রাজন্ যদি মে প্রিয়মিচ্ছসি। যদি বলেন, এটা করব কী করে, আমি তো সারথির কাজ করব, তা হলে বলি— অর্জুনকে মারার জন্য কর্ণ যখন বিপুল উৎসাহ দেখাবে, তখন আপনি একটু একটু করে তার মনোবল ভেঙে দেবেন শুধু, আর তাতেই আমাদের জয় হবে— তেজোবধশ্চ তে কার্য্যঃ সৌতেরস্মজ্ জয়াবহঃ।
অসাধারণ এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন দ্বৈপায়ন ব্যাস— ‘তেজোবধ’ অর্থাৎ যে উত্তেজনা, যে উৎসাহ, যে উদ্যম একজন বীর যোদ্ধাকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় প্রবৃত্ত করে, কেউ যদি যুদ্ধযাত্রার অব্যবহিত পূর্বেই সেই যোদ্ধার উৎসাহ-উদ্দীপনায় জল ঢেলে দিয়ে প্রতিপক্ষের প্রশংসা করতে থাকে, তাহলে সেই মনোবল ভেঙে দেওয়াটাকেই মহাভারতের কবি বলেছেন ‘তেজোবধ’। যুধিষ্ঠির শল্যকে অনুরোধ করেছেন— কর্ণার্জুনের ভয়ংকর যুদ্ধের প্রাক্কালে শল্য যেন কর্ণের মনোবল ভেঙে দেবার চেষ্টা করেন। যুধিষ্ঠির জানেন যে, নৈতিক দিক থেকে ব্যাপারটা অন্যায়, কিন্তু যুদ্ধে অর্জুনের সুরক্ষার দৃষ্টিতে এটা সাংঘাতিক কোনও অন্যায় নয় বলেই তিনি বললেন— দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দেবার পর তাঁরই অন্যতম যোদ্ধার মনোবল ভেঙে দেওয়াটা অকর্তব্য হলেও এই কাজটা আমাদের জন্য করতে হবে আপনাকে— অকর্তব্যমপি হ্যেতৎ কর্তুমর্হসি মাতুল।
শল্য সাময়িক আতিথেয়তায় দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিয়েছেন বলে তাঁর অন্যায় কর্মগুলি সব ভুলে গেছেন— এ-কথা ভাবা ভুল হবে। আমাদের খেয়াল আছে যে, যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের পর শল্য হস্তিনাপুরীতে ধৃতরাষ্ট্রের আতিথেয়তাতেই বেশ কিছু দিন বসবাস করেছিলেন। এমনকী দ্যূতক্রীড়ার সময়েও তিনি দ্যূতসভায় উপস্থিত ছিলেন বলেই আমাদের ধারণা। সত্যবদ্ধ যুধিষ্ঠিরের সামনে কর্ণ সেদিন কুলবধূ দ্রৌপদীর প্রতি যে আচরণ করেছেন, সে-দৃশ্য শল্য স্বচক্ষে দেখেও ছিলেন হয়তো। কেন না দ্যূতক্রীড়ার অব্যবহিত পূর্বের দিন যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরীতে এসে অনেকের মধ্যে শল্যের সঙ্গেও কুশল বিনিময় করেছিলেন। কর্ণের এই আচরণ শল্যের মনে আছে বলেই আজ যুধিষ্ঠিরকে তিনি অভয় দিয়ে বললেন— তুমি চিন্তা কোরো না, ভাগ্নে! আমি এ-কাজ করব। এটা অবশ্যই ঠিক যে, কর্ণ আমাকে সারথ্য-কর্মে নিযুক্ত করবেই, কারণ এ-ব্যাপারে সে আমাকে কৃষ্ণের মতোই সমান পটু মনে করে। অতএব সেই সময়েই— কর্ণকে আমি এমন সব প্রতিকূল কথা বলব যেটা যুদ্ধাভিমুখী যোদ্ধার পক্ষে একেবারেই হিতকর নয়। এইভাবে মনোবল ভেঙে গেলে অর্জুনের পক্ষে কর্ণকে বধ করাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে— ভবিষ্যতি সুখং হন্তুং… হৃততেজাশ্চ পাণ্ডব।
এই কাজটাকে শল্য অকর্তব্যও মনে করছেন না। তিনি বলেছেন— দূতক্রীড়ার সময় দ্রৌপদীকে নিয়ে তুমি যে দুঃখ পেয়েছিলে, সূতপুত্র কর্ণ যে-সব নিষ্ঠুর আচরণ তখন করেছিল, তার মুখে যে-সব কথা তুমি শুনেছিলে— পরুষাণি চ বাক্যানি সূতপুত্ৰকৃতানি চ— সেই সব দুঃখ এবার মিটে যাবে। দুঃখ তত আসে, অনেক বড় মানুষ এমনকী দেবতারাও দুঃখ ভোগ করেন, আবার সে-দুঃখের অবসানও হয়। তোমারও সব দুঃখ পরিণামে সুখ নিয়ে আসবে নিশ্চয়— সর্বং দুঃখমিদং বীর সুখোদৰ্কং ভবিষ্যতি।
শল্য যুধিষ্ঠিরের কথা শুনেছেন এবং সান্ত্বনা দেবার প্রক্রিয়ায় দেবরাজ ইন্দ্র আপন ভার্যা শচীর সঙ্গে কত দুঃখ পেয়েছিলেন, তা বর্ণনা করতে গিয়ে শল্য নহুষের আখ্যান শোনালেন যুধিষ্ঠিরকে। বিশাল সেই আখ্যান শোনানোর পর শল্য পুনরায় দুর্যোধন-কর্ণদের দুর্ব্যবহারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন এবং এ-বিষয়ে তাঁর যথেষ্টই ক্ষোভ থাকায় কর্ণের ব্যাপারে যুধিষ্ঠিরের অনুরোধটুকু একেবারেই অন্যায় বলে মনে করলেন না। যুধিষ্ঠিরকে কথা দিয়ে শল্য সসৈন্যে দুর্যোধনের শিবিরে গিয়ে যোগ দিলেন— জগাম সবলঃ শ্রীমান্ দুর্যোধনমরিন্দম। শল্য এক অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন এবং দুর্যোধন তাঁকে এক অক্ষৌহিণী সেনার নায়ক হিসেবেই তাঁর নিজের সৈন্য পরিচালনার সুযোগ দিয়েছিলেন।
অস্ত্রজীবী যুদ্ধবীরদের মধ্যে শল্য যে একজন মহাপ্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব তাতে খুব একটা সন্দেহ নেই। মহাভারতের বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে কৃষ্ণের সমান যুদ্ধবীর— বাসুদেবসমো যুধি— বলেও উল্লেখ করা হয়েছে, অথচ মহাভারতের এই বিশাল যুদ্ধে তাঁকে যে খুব কৃতিত্ব প্রকাশ করতে দেখি তা নয়। তার কারণ হয়তো ভীষ্ম এবং দ্রোণের মতো তিনি কৌরবপক্ষে থেকে যুদ্ধ করলেও পাণ্ডবদের ব্যাপারে তাঁর মমতা এবং গৌরব বোধ ছিল বেশি। কথাটা তাঁর নিজের কথা থেকেই প্রমাণ হয়ে যায়। যুদ্ধ আরম্ভ হবার আগে দুর্যোধন নিজপক্ষের এবং পাণ্ডব-পক্ষের যুদ্ধবীরদের অস্ত্ৰক্ষমতা এবং বীরত্ব পরিমাপ করার জন্য ভীষ্মকে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তর দেবার সময় যুদ্ধনায়কদের ক্ষমতা নির্ণয় করার সঙ্গে সঙ্গে ভীষ্ম ছোট ছোট এমন দু’-একটি টিপ্পনী দিয়েছেন, যাতে বোঝা যায়— কৌরবপক্ষের সকল যুদ্ধনায়ক যথেষ্ট ক্ষমতাশালী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা পূর্ণপ্রাণে যুদ্ধ করতে পারছেন না। ফলে তাঁরা যতটা পারেন, ততটা করতে পারছেন না। দুর্যোধনের দুর্ভাগ্য বুঝিয়ে দিয়ে ভীষ্ম বলেছেন— মদ্ৰাধিপতি শল্য যোদ্ধা বড় কম নয়। তিনি ‘অতিরথ’ যোদ্ধা। বাসুদেব কৃষ্ণের সঙ্গে স্পর্ধা করতে পারেন, তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন, এমন বড় যুদ্ধাস্ত্রবিৎ হলেন শল্য— স্পর্ধতে বাসুদেবেন নিত্যং যো বৈ রণে রণে।
এই শেষ পংক্তিটি আমাদের কাছে অবশ্য খুব ‘ইনট্ৰিগিং’। আমরা শল্যের সঙ্গে পাণ্ডবদের মামা-ভাগনে সম্পর্কের কথা যখন মনে রাখি, তখন তো সন্দেহ হয়ই যে, কেমন মানুষ এই শল্য, এতটাই কি তিনি আত্মভোলা এবং এতটাই কি তিনি খোশামুদি পছন্দ করেন যে, ভাগনেদের দূরে ঠেলে দিয়ে দুর্যোধনের তৈলমর্দনে তাঁরই পক্ষে যুদ্ধ করতে গেলেন— এ কেমন মামা শল্য! ঠিক এইখানে উপরিউক্ত সংস্কৃত পংক্তিটির আক্ষরিক অর্থ আমাদের খানিকটা অন্য ইঙ্গিত দেয়। শ্লোকের মধ্যে আছে— রণে রণে— অর্থাৎ প্রত্যেকটা যুদ্ধেই তিনি চিরকাল বাসুদেব কৃষ্ণের সঙ্গে সমান ক্ষমতা দেখিয়ে এসেছেন। সত্যি কথা বলতে কী, মহাভারতে আমরা এমন কোনও জায়গা পাইনি, যেখানে কৃষ্ণের সঙ্গে শল্যের কোনও সরাসরি যুদ্ধ হয়েছে বলে প্রমাণ দিতে পারি। কিন্তু মহাভারতের কোনও ঘটনার ঐতিহাসিকতা শুধু মহাভারতেই লুকিয়ে নেই, আরও অন্য জায়গাতেও আছে। বিশেষত কৃষ্ণের পূর্বজীবন সংক্রান্ত ঘটনার বিবরণ মহাভারতের চেয়ে খিল-হরিবংশে বেশি আছে। সেই হরিবংশে কৃষ্ণের পূর্ব-জীবনের যে সমসাময়িক রাজমণ্ডলের বিবরণ আছে, সেখানে কিন্তু কৃষ্ণের প্রধান প্রতিপক্ষ জরাসন্ধের মিত্রবাহিনীর মধ্যে মদ্ৰাধিপতি শল্য একজন। কংস মারা যাবার পর মগধরাজ জরাসন্ধ যে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে কৃষ্ণের বাসস্থান মথুরা আক্রমণ করেছিলেন, সেই মিত্র-রাজগোষ্ঠীর মধ্যে শল্য কিন্তু অন্যতম যোদ্ধা— মদ্ররাজশ্চ বলবান্ ত্রিগৰ্তানামধীশ্বরঃ— এবং যে-সব রাজারা জরাসন্ধের আজ্ঞায় কৃষ্ণকে বাধা দেবার জন্য মথুরা-নগরের পূর্বদ্বারে যুদ্ধবেশে অধিষ্ঠিত ছিলেন, শল্য কিন্তু সেখানে অন্যতম নায়ক।
আমাদের বক্তব্য— কৃষ্ণের সঙ্গে শল্যের সরাসরি যুদ্ধ এখানে হয়নি ঠিকই, কিন্তু কৃষ্ণ-বাসুদেবের সঙ্গে যুদ্ধে শল্য একজন অন্যতম সক্ষম প্রতিদ্বন্দ্বী— এই ধারণাটা তখন থেকেই গড়ে উঠেছে নিশ্চয়। আরও একটা কথা। তখনকার দিনের রাজনৈতিক কূটচক্র এমনটাই ছিল যে, যাঁরা মাগধ জরাসন্ধের মিত্রগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তাঁরা অনেকেই কৃষ্ণকে পছন্দ করতেন না এবং উলটোদিকে কৃষ্ণেরও সেই মনোভাব থাকার কথা। এই সূত্র থেকেই এই সিদ্ধান্ত বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে— যদিও হাতেনাতে প্রমাণ দিয়ে এই সিদ্ধান্ত স্থাপন করা যাবে না— তব এটাই বিশ্বাসযোগ্য যে, প্রধানত কৃষ্ণ পাণ্ডবপক্ষের অন্যতম কর্ণধার ছিলেন বলেই পাণ্ডবদের একান্ত মাতুল হওয়া সত্ত্বেও শল্য দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন, নইলে যাত্রাপথের মাঝখান থেকে শল্যকে ‘হাইজাক’ করে নিজের পক্ষে নিয়ে আসাটা কি অত সহজ হত দুর্যোধনের পক্ষে! রাজনৈতিক তাড়নাগুলির কথা না ভেবে শল্যের ভোলেভালা স্বভাবটা বড় করে দেখানোর মজাটা আমরা পেতেই পারি, কিন্তু তাতে সমীকরণ সহজীকরণের জায়গায় চলে যায়।
তবে হ্যাঁ, কৃষ্ণের কারণেই হোক অথবা তাঁর সহজ স্বভাবের গুণেই হোক, শল্যের ক্ষেত্রে মাতুল-সম্বন্ধের স্নেহটুকু অনস্বীকার্য বলেই ভীষ্ম বলেছেন— যে শল্যরাজ প্রত্যেকটি যুদ্ধে নিজেকে কৃষ্ণ-বাসুদেবের সমান বলে স্পর্ধা করে থাকেন, তিনিও তোমার হয়ে সর্বপ্রযত্নে তোমার শত্ৰুসংহার করবেন বটে, কিন্তু মনে রেখো— তিনি কিন্তু নিজের ভাগনেদের ছেড়ে তোমার পক্ষে যোগ দিয়েছেন— ভাগিনেয়ান্ নিজাংস্ত্যক্কা শল্যস্তে রথ সত্তমঃ— অর্থাৎ ভীষ্ম ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন যে, অতিরথ বীর হওয়া সত্ত্বেও ভাগনেদের ব্যাপারে তাঁর দুর্বলতা শল্যের কাছে তাঁর প্রত্যাশিত শক্তি কমিয়ে দেবে, তিনি পূর্ণপ্রাণে যুদ্ধ করতে পারবেন না।
এটা কিন্তু সত্যি যে, মহাভারতের মধ্যে শল্যের সম্বন্ধে বীরত্ব-গৌরব প্রচুর আছে, কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি তেমন কোনও যুদ্ধ-ভূমিকা গ্রহণ করেননি যাতে তাঁর অতিরথ-ব্যক্তিত্ব প্রমাণিত হয় এবং হয়তো সেটা ভাগনেদের কারণেই। সমর-শৌণ্ড দুর্যোধনের দুর্ভাগ্য এইখানেই। ভীষ্ম— তিনি কৌরবের পাণ্ডবের এক পিতামহ বলেই হোক অথবা তাঁর স্বকল্পিত যুক্তি অনুসারে কৌরবদের অন্নদাস বলেই হোক, তিনি দুর্যোধনের পক্ষে থেকেও পাণ্ডবদের বিজয় প্রার্থনা করেছেন। দ্রোণও তাঁর অর্থদাসত্বের কথা পুরোপুরি স্বীকার না করলেও সে-কথা ধরে নিয়েই পাণ্ডবদের মঙ্গল চেয়েছেন এবং তাঁর সবিশেষ দুর্বলতাও ছিল মধ্যম পাণ্ডব অর্জুনের ওপর। আশ্চর্য লাগে শল্যের ব্যাপারে। যুদ্ধ-পূর্বাহ্নে যুধিষ্ঠির যখন ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপের আশীর্বাদ দিতে এসেছেন, তখন একই মান্যতায় শল্যের আশীর্বাদ চাইলেও তিনি ভীষ্মের মতো করেই সস্নেহে বলেছেন— তুমি যদি এইভাবে আমার কাছে যুদ্ধ করার অনুমোদন প্রার্থনা না করতে, তা হলে আমি তোমাকে অভিশাপ দিতাম। তবে ব্যাপারটা কী জানো, পুরুষ অর্থের দাস, অর্থ কারও দাস নয়। আমি কৌরবের সঙ্গে অর্থের বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছি বলেই আমাকে থাকতে হচ্ছে তাঁদের সঙ্গে— বদ্ধোহস্মি অর্থেন কৌরবৈঃ।
আমাদের জিজ্ঞাসা হয়— ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ— এঁরা না হয় কুরুবাড়ির অন্নভুক্ অর্থদাস, কিন্তু শল্য তো কুরুবাড়িতে থাকতেনও না, কুরুবাড়ির প্রসাদও তিনি ভোগ করতেন না। তবে তাঁর মুখে এই কথা কেন? ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপদের কথার প্রতিধ্বনি করাটাই নিশ্চয়ই তাঁর মাহাত্ম্য নয়। এর সমাধান একটাই হতে পারে। আমি আগেও বলেছি— মথুরা-শূরসেন অথবা বৃজি-বজ্জি-দেশের মতো মদ্র-দেশেরও একটা প্রজাতান্ত্রিক পরিকাঠামো ছিল এবং হয়তো তাঁরা যুদ্ধকালে সৈন্য-সামন্ত ভাড়া খাটাতেন, যাকে আমরা ‘মার্সেনারি’ বলি। যুধিষ্ঠিরের কাছে শল্যের যাত্রাপথে দুর্যোধন যে মাঝখান থেকে তাঁকে অন্ন-পান-বিলাসে মুগ্ধ করে নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন, সেটা অর্থের বিনিময়ে নয়তো? স্পষ্ট এ-কথা লেখা নেই মহাভারতে, কিন্তু আত্মীয়-সম্বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এক অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে ভাগনেদের পক্ষে যোগ না দিয়ে শল্য যে মাঝখান থেকে হঠাৎই দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিলেন, সেখানে অর্থঘটিত ব্যাপার আছে বলেই মনে হয় এবং সেই কারণেই হয়তো আজকে যুধিষ্ঠিরের কাছে এই আত্মদৈন্যসূচক উচ্চারণ— মানুষ অর্থের দাস, আমি সেই কারণেই কৌরবদের বন্ধনে আটকে পড়ে আছি।
যুধিষ্ঠির অবশ্য শল্যের এই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত দায়বদ্ধতার কথা বোঝেন, আর বোঝেন বলেই তিনি কথা বাড়ান না। শল্য বলেন— আমার কাছে তুমি তোমার প্রয়োজনের কথা বলতে পারো। আমাকে কৌরবপক্ষে থেকেই যুদ্ধ করতে হবে। শুধু এই ব্যাপারটা ছাড়া তুমি আর কী চাও বলো ভাগনে, আমি করবার চেষ্টা করব— করিষ্যামি হি তে কামং… যুদ্ধাদন্যং কিমিচ্ছসি? যুধিষ্ঠির শল্যের পূর্ব-প্রক্রিয়া এবং ব্যবহার নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেন না, একবারও তিনি আক্ষেপ করে বলেন না যে, তুমি আমাদের মামা হয়ে কেমন করে আমাদের শত্রুপক্ষে নাম লেখালে। বরঞ্চ শল্যের অসহায়তা সমস্তটা অনুধাবন করেই যুধিষ্ঠির প্রথমে বললেন— শত্রুর পক্ষে তুমি যুদ্ধ করছ করো। কিন্তু আমার মঙ্গলের চিন্তাটা তুমি ছেড়ো না। শল্য বললেন— মঙ্গল-চিন্তা! তা বেশ, আমি তোমায় কী সাহায্য করতে পারি বলো, কিন্তু তোমার শত্রুপক্ষে থেকেই আমায় যুদ্ধ করতে হবে, কী করব বলো কৌরবদের অর্থ আমাকে দায়বদ্ধ করে রেখেছে— কামং যোৎস্যে পরস্যার্থে বদ্ধোহস্ম্যর্থেন কৌরবৈঃ।
দেখলেন তো, আবারও সেই অর্থবন্ধনের কথা এল এবং এই অর্থদায় ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপের মতো অন্নদায় নয় বলেই আমার ধারণা হয় যে, শল্য কোনও-না-কোনও সময়ে কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের প্রাক্কালে দুর্যোধনের কাছ থেকে সৈন্যের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করেছিলেন। সেই দায় তাঁর পক্ষে এড়ানো সম্ভব ছিল না, কিন্তু মনের মধ্যে একটা পাপবোধ কাজ করছে বলেই শত্রুপক্ষে থেকেও যুধিষ্ঠিরকে কীভাবে এখন সাহায্য করা যায়, সেটা বারবার বলছেন। যুধিষ্ঠির বেশি কিছু চাননি, তিনি শুধু শল্যকে পূর্বকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন— আমাকে আপনি এই যুদ্ধের উদ্যোগকালে যে বিষয়ে কথা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন আপনি যে, মহাযুদ্ধের সময় কর্ণের যুদ্ধের মানসিক উদ্দীপনা আপনি নষ্ট করে দেবেন, আপনি সেটুকু করলেই আমার যথেষ্ট— স এব মে বরঃ শল্য উদ্যোগে যস্ত্বয়া কৃতঃ। শল্য সানন্দে উত্তর দিলেন— তুমি যেমনটি চেয়েছ, তাই হবে। তুমি নিশ্চিন্তে যুদ্ধের আয়োজন করো। আমি কথা দিচ্ছি তুমি যা বলেছ, তাই করব— গচ্ছ যুধ্যস্ব বিশ্রদ্ধঃ প্রতিজানে বচস্তব। যুধিষ্ঠির মদ্ররাজের অনুমতি নিয়ে ভাইদের সঙ্গে ফিরে গেছেন নিজের শিবিরে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। দশ দিন যুদ্ধ করে ভীষ্ম শরশয্যায় পতিত হলেন, দ্রোণাচার্য যুদ্ধ পরিচালনা করলেন আরও পাঁচদিন। দ্রোণের মৃত্যুর পর কর্ণের সেনাপতিত্বেও দুই দিন কাটল। কিন্তু এই সতেরো দিন ধরে শল্যকে আমরা খুব মহাযোদ্ধা হিসেবে চিনিনি। তার দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, ভাগনেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণেই তাঁদের বিরুদ্ধে তিনি যোদ্ধা হিসেবে তেমন করে প্রয়োগ করেননি নিজেকে এবং এই সংশয় তো স্বয়ং ভীষ্মই প্রকাশ করেছিলেন। আর দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, অন্যের সেনা-নায়কত্বে বড় যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রকট করে লাভ কী, সুনাম-দুর্নাম যা হবার, তা তো নায়কেরই হয়। তাই বলে ভীষ্ম-দ্রোণের মতো গুণী মানুষ তাঁকে অশ্রদ্ধা করেননি কখনও। ভীষ্ম যখন পাণ্ডব-সৈন্য ধ্বংস করার জন্য সর্বতোভদ্র ব্যূহ সাজালেন, তখন সেই ব্যূহের দক্ষিণ পার্শ্ব রক্ষা করার জন্য মহামতি দ্রোণের সঙ্গে শল্যও অন্যতম যোদ্ধা হিসেবে আছেন— দক্ষিণং পক্ষমাশ্ৰিত্য স্থিতা ব্যূহস্য দংশিতাঃ। আবার যখন দ্রোণের সেনা-নায়কত্ব চলছে, তখনও কিন্তু দ্রোণের সাজানো গারুড়-ব্যূহের ডান পাশ শল্যই রক্ষা করছেন।
এতে করে অবশ্য আধুনিক কালের ‘প্যাটার্ন’ বার-করা গবেষকদের মতো এটা ভাবার কারণ নেই যে, শল্য ডানদিক থেকেই শুধু ভাল যুদ্ধ করতে পারতেন। কেন না সেকালের দিনের অস্ত্রশিক্ষায় অস্ত্রের বিশেষজ্ঞতা— যেমন গদা-যুদ্ধ অথবা ধনুর্বাণ, ভল্ল-যুদ্ধ অথবা শূল-যুদ্ধ, এগুলি যোদ্ধার শারীরিক এবং মানসিক প্রবৃত্তি অনুসারে গ্রহণ করা যেত, কিন্তু ডাইনে পারি, বামে পারি না— এমন লোক শিক্ষার অনুপযুক্ত বলেই পরিগণিত হতেন। অতএব বাম-দক্ষিণ নয়, ভীষ্মের অথবা দ্রোণের নায়কত্বে বিভিন্ন পরিসরে শল্য যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধ করেছেন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে, ভীমের সঙ্গে, এমনকী সম্বন্ধে ঘনিষ্ঠতর নকুল-সহদেবের সঙ্গেও। তবে এই সব যুদ্ধে কোনও পক্ষেরই কোনও মারণ-আক্রোশ দেখা যায়নি। এটা অবশ্য মানতে হবে যে, হিসেব মতো পাণ্ডব ভাইদের মধ্যে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গেই তাঁর যুদ্ধ হয়েছে সবচেয়ে বেশিবার। তবে এসব ক্ষেত্রে জয়-পরাজয় তেমন নিশ্চিত নয়। একবার যেটা চোখে পড়ে— তিনি আর্জুনি অভিমন্যুর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হলেন। সেটা অবশ্য দ্রোণের সেই চক্রব্যূহের অভিসন্ধি মধ্যে। অভিমন্যুর সঙ্গে সেদিন কেউই যুদ্ধে পেরে উঠছিলেন না। শল্যকে তো তিনি এমন আঘাত করেছিলেন যে, শল্য তাঁর রথদণ্ড ধরে রথের ভিতরে বসে পড়েছিলেন এবং সাময়িকভাবে অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছিলেন— শল্যো রাজন্ রথোপস্থে নিষসাদ মুমোহ চ। শল্যকে এইভাবে যুদ্ধে পরাজিত এবং বসে পড়তে দেখে শল্যের ছোট ভাই অভিমন্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলেন এবং অভিমন্যুর হাতে তিনি মারাই পড়লেন।
কখনও জিতে কখনও হেরে কখনও সমাবস্থায় এইভাবেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন শল্য। কিন্তু এগুলির মধ্যে কোনও যুদ্ধই তেমন বড় যুদ্ধ নয় এবং শল্য সেভাবে নিজেকে তেমন প্রয়োগও করেননি। কিন্তু তিনি যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের ষোলো দিনের দিন কর্ণ সেনাপতি হলেন এবং মহা উৎসাহে যখন মকর-ব্যূহ সাজালেন তখন শল্যকে দেখছি— তিনি সেই ব্যূহের শেষের দিকে বামভাগে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর মদ্রদেশী সৈন্যদের নিয়ে— অনুপাদে তু যো বামস্তত্র শল্যো ব্যবস্থিতঃ। কর্ণের সেনাপতিত্বেও শল্য একইরকমভাবে চালিয়ে গেলেন, একইরকম নির্বিণ্ণতায়, নিন্দা-প্রশংসার ঊর্ধ্ববস্থানে অবস্থিত হয়ে।
যুদ্ধের সপ্তদশ দিন। পূর্বদিনের অনেক যুদ্ধতাড়নার পর সেনাপতি কর্ণ এবার চরম আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। সপ্তদশ দিবসের প্রভাতেই তিনি তাঁর নতুন স্ট্রাটিজি জানাচ্ছেন দুর্যোধনকে— প্রভাতায়াং রজন্যান্তু কর্ণো রাজানমভ্যয়াৎ। কর্ণ বললেন— দ্যাখো দুর্যোধন! ধনুক-বাণ চালানোর কৌশল এবং সৌষ্ঠব— কোনওটাতেই অর্জুন আমার সমান নয়। ওর গাণ্ডীব ধনুক, যা নিয়ে ও অত গর্ব করে, সেটা আমার এই পরশুরামের দেওয়া ‘বিজয়’-ধনুকের কাছে ম্যাড়ম্যাড় করছে। আজকে আমি অর্জুনকে মেরে এই সসাগরা পৃথিবী তোমার হাতের মুঠোয় এনে দেব। তবে তার জন্য একটাই মাত্র জিনিস আমার দরকার এবং সেখানেই আমার খামতি আছে। ওই যে অর্জুনের অগ্নিদত্ত রথখানি, ওই রথের রশি এমন একজনের হাতে রয়েছে, যাঁকে সকলে মান্যি করে চলে— রশ্মিগ্রাহশ্চ দাশার্হঃ সর্বলোক-নমস্কৃতঃ। যেমন ওই রথের অভেদ্য গঠন, তেমনই তেজি তার ঘোড়াগুলি, আর সেই রথ সামলাচ্ছেন এমন একটি লোক, যিনি জগৎকেও সৃষ্টি করতে পারেন। ঠিক এই সারথির জায়গায় আমার খামতি রয়ে গেছে বলে এই জায়গাটায় আমি অর্জুনের চেয়ে কমা হয়ে আছি— এতৈর্দ্রব্যৈরহং হীনো যোদ্ধুম্ ইচ্ছামি পাণ্ডবম্।
এবারে কী ব্যবস্থা করলে কর্ণ অর্জুনের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী অবস্থানে থাকবেন, সেই প্রস্তাব কর্ণ এবার দুর্যোধনের কাছেই রাখছেন। কর্ণ বললেন— দ্যাখো ভাই। রথ-চালনার কথা বলছিলাম। এইখানে কৃষ্ণের সমান যদি কেউ থাকে, তা হলে ওই মদ্ররাজ শল্য— অয়ং তু সদৃশঃ শৌরেঃ শল্যঃ সমিতিশোভনঃ। তিনি যদি আমার সারথ্য স্বীকার করেন, তবে জেনো— তোমার জয় একেবারে নিশ্চিত।
সেকালের দিনে সারথি হতে গেলে যুদ্ধবিদ্যাটাও তাকে ভাল করে জানতে হত, আর সারথ্যের ক্ষেত্রেও শুধু যোদ্ধা-যুক্ত রথখানির সারথ্য করলে চলত না। যিনি সারথি হতেন, যুদ্ধবিদ্যায় তাঁর পারদর্শিতা থাকত বলেই একদিকে যেমন পরপক্ষের প্রয়োগ-নৈপুণ্য অনুমান করে আপন রথের গতি বিপরিবর্তন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হত, তেমনই রথের সঙ্গে মুখ্য যুদ্ধাস্ত্রের অনুষঙ্গী এবং উপযোগী অস্ত্রগুলি শকটবাহিত হয়ে সঠিক স্থানে জোগান দেবার জন্য যে বাহক থাকে, তারও দেখভাল করতে হত সারথিকেই। কর্ণ তাই বলেছেন— আমার নারাচ, আমার সার্ধপত্র বাণগুলি শকটে ঠিকমতো এল কিনা, সেটাও তিনিই খেয়াল রাখতে পারবেন, যিনি শল্যের মতো সারথি হবেন। সত্যি বলতে কী, শল্যের মতো একজন সারথি যদি আমি পাই, তা হলে প্রথম এই সুবিধে হবে যে, ধনঞ্জয় অর্জুনের চেয়ে আমি অনেক বেশি এগিয়ে থাকব— এবমভ্যধিকঃ পার্থাৎ ভবিষ্যামি গুণৈরহম্।
কর্ণের অঙ্ক কষার কারিগরিটা অন্যরকম, সেখানে মদ্ররাজ শল্যের অন্তর্ভাব একটা নতুন মাত্রা তৈরি করছে, তৈরি করছে নতুন ভাগশেষ। কর্ণের বক্তব্য হল— তাঁর ব্যক্তিত্ব, অস্ত্র-চালনার ক্ষমতা এবং অন্যান্য সব বিষয়ে তিনি অর্জুনের চেয়ে এককাঠি এগিয়ে আছেন, শুধু খামতি আছে সারথ্যের জায়গায়। সেটা প্রতিপূরণের জন্য কর্ণ এবার শল্যকেও বাড়িয়ে তুলছেন। কর্ণ বলছেন— আমি যেমন অর্জুনের চেয়ে অনেক বড় যুদ্ধবাজ বীর তেমনই শল্যও কৃষ্ণের চেয়ে বড় সারথি— শল্যোহপ্যধিকঃ কৃষ্ণাদ্ অর্জুনাদপি চাপ্যহম্। শল্যের সবচেয়ে বড় গুণ— শল্য নাকি খুব ভালরকম অশ্ববিদ্যা জানেন— সেকালের দিনের ভাষায়— অশ্বহৃদয়। মহাভারতে ক্ষত্রিয়বীরদের জীবনযাত্রার খবর রাখলে ‘অক্ষহৃদয়’ ‘অশ্বহৃদয়’— এইসব জীবন-সংপৃক্ত শব্দের সঙ্গেও পরিচয় থাকার কথা। সাম্রাজ্য জয়, সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজনে ঘোড়ার ব্যবহারটা মহাভারতের আমলে ভীষণরকমের সচল বলেই কৃষ্ণ অথবা শল্যের মতো মানুষের ভীষণরকমের চাহিদা। যুদ্ধাশ্বের গতি-প্রকৃতি, তার শুশ্রূষা এবং অশ্বের নিজস্ব ‘মুড্’ অতিক্রান্ত করে তাকে যুদ্ধের ব্যাপারে ‘মোটিভেট্’ করাটাই অশ্বহৃদয়ের জ্ঞান— যেটা কৃষ্ণের আছে এবং শল্যেরও আছে। কর্ণের কাছে আজ তাই শল্যের এত মূল্য। তিনি বলেছেন— আমার মতো ধনুর্ধরও যেমন দুনিয়ায় আর একটিও নেই, তেমনই শল্যের মতো অশ্বজ্ঞানীও এই দুনিয়ায় দুটো নেই— তথা শল্যসমো নাস্তি হয়জ্ঞানে হি কশ্চন।
কর্ণ মহা ধনুর্ধর, কিন্তু অর্জুনের ব্যাপারে সবসময় ঈর্ষাসূয়াযুক্ত। সেই কারণেই আজ তিনি শল্যকে সারথি হিসেবে চাইছেন এবং আজকের এই চাওয়াটা যে ঘটবে, তা যুধিষ্ঠির— যুদ্ধেও নিয়ত স্থির সেই মানুষটা কত দিন আগে থেকে জানতেন। অবশ্য কর্ণের ঈর্ষাসূয়াযুক্ত হৃদয়টুকু জানতেন বলেই যুধিষ্ঠির ধারণা করতে পেরেছিলেন যে, শল্যকে কর্ণ একদিন সারথি হিসেবে চাইবেনই। কর্ণ চাইলেন।
আমি শল্যের কথাটাও ভাবি। তিনি ভাগনেদের শত্রুপক্ষে নাম লিখে তাঁদেরই হয়ে ছোট-বড় যুদ্ধ করে চলেছেন, কেন না তাঁর নিজের মন্তব্য অনুযায়ীই তিনি দুর্যোধনের কাছে অর্থদায়ে আবদ্ধ। অথচ তিনি শত্রুঘাঁটিতে বসে শত্রু হিসেবেই যুদ্ধ করতে করতে যুধিষ্ঠিরের অনুরোধটুকু ঠিক মনে রাখবেন বলে কথা দিয়েছেন। আচ্ছা, আমার জিজ্ঞাসা হয়— শল্যকে আমরা কী বলব— পাণ্ডবদের প্রতিপক্ষ নায়ক, নাকি তাঁদের অনুকূল বন্ধু, যিনি তাঁদের কার্যসাধনের জন্য শত্রুপক্ষে ঘাপটি মেরে বসে আছেন। আমরা বলব— দ্বিতীয় কল্পটা মোটেই মিথ্যে নয়, তিনি ভাগনেদের কথা দিয়েছেন, সেই সম্বন্ধ-ঘনিষ্ঠতায় তাঁদের কাজটিও করবেন, কিন্তু একমাত্র এই জায়গাটা ছাড়া তিনি আর সবই করেছেন, যা দুর্যোধনের প্রয়োজন, এমনকী অবশেষে নিজের মৃত্যুও ডেকে এনেছেন শত্রুতার ভূমিতে দাঁড়িয়ে থেকে। কর্ণের তেজোবধ, অর্থাৎ যুদ্ধকালে তাঁর উৎসাহ-উদ্দীপনা নষ্ট করে দেওয়াটাও এমন বড় কোনও অপরাধ নয়। ব্যক্তিত্ব যদি খুব কঠিন এবং অনমনীয় হয়, তা হলে তাঁর উৎসাহ নষ্ট করে দিলেই তিনি বিপর্যস্ত হয়ে যান না। অতএব শল্য অধিকাংশে শত্রুপক্ষেই আছেন, পাণ্ডবদের স্বপক্ষে নন অন্তত।
যাই হোক, কর্ণের কথা শুনে সর্বাধিনায়ক দুর্যোধন এলেন শল্যের কাছে। এর আগে কর্ণ যখন দুর্যোধনের কাছে শল্যের সারথ্য-প্রস্তাব পেশ করছিলেন, সেটা কিন্তু সমস্ত রাজবর্গের সামনেই করছিলেন এবং এখন যে দুর্যোধন শল্যের কাছে কর্ণের প্রস্তাব জানাতে গেলেন, তখনও উপস্থিত রাজাদের সামনেই কথা হচ্ছিল। বন্ধু কর্ণের কার্যসাধনের জন্য দুর্যোধন শল্যকে চরম মর্যাদা দিয়ে— আপনি ‘রণে শূর’, আপনি ‘শত্রুসৈন্যের যম’ ইত্যাদি শব্দরাশিতে শল্যকে তৈলসিক্ত করে বলতে আরম্ভ করলেন— আপনি তো শুনলেন, সমস্ত রাজাদের সামনেই কর্ণ কীভাবে আপনার সহায়তা ভিক্ষা করলেন, কী মর্যাদায় আপনাকে সারথ্যে বরণ করলেন— শ্রুতবানসি কর্ণস্য… যথা ত্বা বরয়ত্যয়ম্। অতএব অর্জুনকে মেরে যাতে আমার হিতসাধন করা যায়, তার জন্য কর্ণের সুরক্ষায় নিযুক্ত হোন আপনি। আপনি যদি একবার কর্ণের রথের রশিটি ধরেন, তা হলে শত্রুরা কেউ তাঁর সামনে দাড়াতে পারবে না। আর এ কথা আমি বেশ জানি যে, আপনি একেবারে কৃষ্ণের সমান। অতএব আপনি ছাড়া কর্ণের ঘোড়ার লাগাম ধরবে, এমন লোক আর একটাও নেই— অভীষূণাং হি কর্ণস্য গ্রহীতান্যো ন বিদ্যতে।
দুর্যোধনের কথার মধ্যে শল্যের জন্য যত শ্রদ্ধাই থাক, হঠাৎ করে এক তুল্যমূল্য বীর যোদ্ধাকে অন্য এক যোদ্ধার ঘোড়ার লাগাম ঠিক রাখার দায়িত্ব দিলে তাঁর মানে লাগে এবং তাঁর মাথা ঠান্ডা রাখা দায় হয়। দুর্যোধনের কথা শুনে শল্যের মুখ ভ্রূকুটি-কুটিল হয়ে উঠছিল, মুখ লাল হয়ে যাচ্ছিল। দুর্যোধন তবু বলে যাচ্ছেন শল্যকে— জানেন তো যুদ্ধের আরম্ভেই আমরা পাণ্ডব-সৈন্যদের কে কীভাবে মারব, তার একটা ভাগ করে নিয়েছিলাম। দেখুন, আমরা এই পক্ষে ন’জন যোদ্ধা ছিলাম— ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, আপনি, কৃতবর্মা, শকুনি, অশ্বত্থামা এবং আমি। প্রত্যেকের জন্যই বিপক্ষের সৈন্য ধ্বংস করার এক-একটা ভাগ ছিল। তো আমাদের মধ্যে ভীষ্ম এবং দ্ৰোণকে তো ওরা অন্যায়ভাবে মেরে ফেলল। ওঁরাও বৃদ্ধ হয়েছিলেন অবশ্য এবং আমাদের ভাগের কথা মনে না রেখেই ওঁরা যথাসাধ্য শত্ৰুশাতন করে গেছেন। এখন আমার প্রিয় এবং হিতের কথা ভাবার জন্য একমাত্র বড় যোদ্ধা রয়ে গেছেন কর্ণ— কর্ণো হ্যেকো মহাবাহুরস্মৎ-প্রিয়হিতে রতঃ।
কথাটা বলেই দুর্যোধন বুঝলেন যে, তিনি বোকামি করে ফেলেছেন। শল্য নিজে কম বড় যোদ্ধা নন, অন্তত বড় যোদ্ধা হিসেবে তাঁর যথেষ্ট নাম আছে। সেখানে ‘কর্ণই একমাত্র বড় যোদ্ধা উপস্থিত আছেন’, আর শল্য তাঁর সারথি হবেন, এই অমর্যাদার কথাটা বলে ভুল করেই সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করে বললেন— আর আপনি নিজেও তো এক বিরাট মহারথ যোদ্ধা— ভবাংশ্চ পুরুষব্যাঘ্ৰ সৰ্বলোক-মহারথঃ। কিন্তু আজকে এমন একটা প্রয়োজন পড়েছে— জানেনই তো কর্ণ আজই রণস্থলে অর্জুনের মুখোমুখি হতে চাইছে, সেখানে কৃষ্ণার্জুনের সঙ্গতির মতো আপনি যদি একবার কর্ণের সারথি হন, তা হলে দেবতাদের সঙ্গে ইন্দ্রও কর্ণকে রুখতে পারবে না, সেখানে ওই পাণ্ডুর বাচ্চারা কী করবে কর্ণের? আপনি বিশ্বাস করুন— আমি ঠিক বলছি— কিং পুনঃ পাণ্ডবেয়ানাং মা বিশঙ্কীর্বচো মম।
দুর্যোধন বোধহয় বুঝতে পারেননি যে শল্যের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে। প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পূর্বেই মহাভারতের কবি সঙ্গে সঙ্গে শল্যের সমাজ, শিক্ষা, মানের বিশেষণ দিতে আরম্ভ করেছেন। কবি জানিয়েছেন— নানা ব্যাপারে শল্যের বিচিত্র অভিমান আছে— বংশ, ধন-সম্পদ, নিজের বহুজ্ঞতা এবং শক্তি— এই সব কিছু নিয়ে শল্যের অভিমান আছে, তিনি গর্ব বোধ করেন তাঁর জাতি-কুল-মানের সচেতনতায়— কুলৈশ্বর্য-শ্রুত-বলৈর্দৃপ্তঃ শল্যোহব্রবীদিদম্। দুর্যোধনের কথা শুনে শল্য রাগে লাল হয়ে উঠলেন, কপালে ভাঁজ পড়ল তিন ফালা হয়ে, ভ্রুকুটি-কুটিল হয়ে উঠল শল্যের চোখ। হাত-পা নাড়িয়ে, চোখের তারা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে শল্য বললেন— এটা কী বলছেন আপনি? কী কাজ করতে বলছেন আমাকে। আমার মতো উঁচু জাতের মানুষ ওরকম একটা পাপী বেজাত মানুষের দাসত্ব করতে পারে— ন হি পাপীয়সঃ শ্রেয়ান্ প্ৰেষ্যত্বং কর্তুর্মহতি।
কথাটা বলেই শল্য জাতিভেদ নিয়ে ছোটখাটো একটা বক্তৃতাই দিয়ে ফেললেন এবং তার মর্মকথা এই যে একজন মহান ক্ষত্রিয় হিসেবে জন্ম লাভ করে তিনি সূত-সারথিজাতীয় এক নীচস্থানীয় ব্যক্তির রথ-চালক হতে পারেন না। বিশেষত তিনি যেখানে এক রাজর্ষিবংশে জন্মেছেন এবং এখন তিনি মান্য-গণ্য রাজা-মহারাজাদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। শল্য বললেন— শুনেছি চিরকাল যে, এই সূত-সারথি-জাতীয় লোকেরা ক্ষত্রিয়দের পরিচারকের কাজ করে, সেখানে আমি নিজে ক্ষত্রিয় হয়ে সারথির হুকূম শুনে চলব! কক্ষনও নয়— ন ক্ষত্রিয়ো বৈ সূতানাং শৃণুয়াচ্চ কথঞ্চন। তা ছাড়া আর পাঁচজনে আমার এই দুর্গতির কথা শুনলে কী বলবে? লোকে আমাকে মহারথ যোদ্ধা বলে জানে, সামনে এলে তোকজন আমাকে স্তুতি-নতি করে তুষ্ট করে, সেই আমি কিনা সূতপুত্র কর্ণের সারথ্য করব— সোহহমেতাদৃশো ভূত্বা …সারথ্যং কর্তুমুৎসহে।
শল্যের সরল স্বভাবটুকু বোঝা যায় এইখানে। তাঁকে যে লোকে অনেক সম্মান করে, বন্দি-জনের খ্যাতিতেই তিনি নিজের যশের সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছেন এবং নিজের প্রশংসা নিজেই করছেন আপ্লুত হয়ে— এটা তাঁর সরলতা; কিন্তু এই সরলতার মধ্যেও তাঁর রাজজনোচিত আকার-ইঙ্গিতের বহিঃপ্রকাশ সংবৃত করে রাখার শক্তিটুকু নিশ্চয় লুকিয়ে আছে। তবুও তাঁর সরলতাও কম নয়, নইলে দুর্যোধনের প্রস্তাবে অমন— ‘ঠাকুর ঘরে কে কলা খাইনি’— গোছের একটা উত্তর আসে কেমন করে? শল্য দুর্যোধনকে বললেন— ‘কর্ণের সারথ্য করো’— একথা বলে আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন, অথবা এমনও হতে পারে যে, বিপক্ষের লোক বলে আপনি নিশ্চয় আমায় সন্দেহ করছেন— অবমন্যসি গান্ধারে ধ্রুবং বা পরিশঙ্কসে— নইলে আমারই সামনে কর্ণকে আপনি আমার চেয়ে বড় যোদ্ধা বলে প্রশংসা করছেন— অস্মত্তোহভ্যধিকং কর্ণং মন্বানস্তং প্রশংসসি। শুধু এটুকু বলেই শল্য থামলেন না। বিপক্ষের সৈন্যধ্বংস করার একটা ভাগের কথা দুর্যোধন বলেছিলেন, সে-কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শল্য বললেন— যোদ্ধা হিসেবে কর্ণকে আমি নিজের সমান মনে করি না, আপনি বরং আমার ভাগে বেশি সৈন্য ধ্বংস করার বরাত দিন, আমি আজ দেখিয়ে দেব যুদ্ধ কাকে বলে— পশ্য বীর্যং মমাদ্য ত্বং সংগ্রামে দহতো রিপূন্।
নিজের অপরিমেয় শক্তি-সমাখ্যান করার জন্য শল্য এবার তার দৃঢ়-পীন বাহু-দুটি তুলে ধরলেন, নিজের ধনুক-বাণ দেখিয়ে, গদা দেখিয়ে নানা শক্তি প্রদর্শন করে শল্য বললেন— আপনি আমাকে কর্ণের সারথ্য করতে বলে চরম অপমান করেছেন। এটা মনে রাখবেন যে, আমি কোনও সাধারণ ফালতু লোক নই, যাতে করে যখন যা ইচ্ছে তাই করতে বলতে পারেন, তা ছাড়া আমি নিজের ইচ্ছেতেও আপনার পক্ষে যোগ দিতে আসিনি— ন চাহং প্রাকৃতঃ কশ্চিন্ন চাস্মি অধিগতঃ স্বয়ম্— আপনিই আমাকে বরণ করে এনেছেন। তারপর সব বুঝেও আপনি আমাকে যে কাজ করতে বলছেন, তার চেয়ে আমার বাড়ি চলে যাওয়া ভাল। আমি ঘরে ফিরে যাব, আপনি অনুমতি করুন— আপৃচ্ছে ত্বাদ্য গান্ধারে গমিষ্যামি গৃহায় বৈ— এমন অপমান সহ্য করার পর আর আমি যুদ্ধ করতে চাই না।
এতখানি রাগ যে শল্য করলেন, তারমধ্যে কতটুকু সত্য আছে, আর কতটুকু ভাণ আছে, তা বোঝা দুষ্কর হতে পারে, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের কাছে শল্যের প্রতিজ্ঞার নিরিখে এটা ভাণ বলেই মনে হয়। অন্যদিকে শল্যের স্বভাবটা দেখুন, তিনি কিন্তু খুব সহজেই প্রতিক্রিয় হয়ে ওঠেন। যদি এটা ভাণই হত, তা হলে দুর্যোধনের কাছ থেকে কর্ণের সারথ্য করার প্রস্তাব পাওয়া মাত্রই তো শল্যের লুফে নেওয়া উচিত ছিল; নাকি শল্য যথেষ্টই ভাণ করতে পারেন, তিনি এতটাই বড় অভিনেতা যে, মনের মধ্যে সবটা গুঁজে রেখেও এমন প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। আমার কিন্তু এটাকে অভিনয় বলে মনে হয় না, বরঞ্চ স্বভাবই মনে হয়— দুর্যোধনের অত্যাগ্রহে যেমন তিনি সাড়ম্বরে তাঁর পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন, তেমনই পাণ্ডবদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ-সম্পর্কের নিরিখে তাঁদের কাজটাও করে দেবেন বলেছেন। কর্ণের সারথ্য-প্রস্তাবে তাঁর প্রচণ্ড মানে লেগেছে এবং যেভাবে তিনি সব ছেড়ে বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছেন, সেখানেও ওই তাঁর স্বভাবের অনিশ্চয়তাই কাজ করে। বিশেষত ওই যে কথাটা— আমি নিজের ইচ্ছেয় এখানে আসিনি, আপনি আমাকে সসম্মানে ডেকে এনেছিলেন— অতএব এখন এই সারথ্যের প্রস্তাবটা ‘মার্সেনারি’ বীর যোদ্ধার মানে লাগছে। তিনি বিদায় নিতে চাইলেন।
দুর্যোধন বুঝলেন শল্যের কোথায় লাগছে। তাঁকে তৈলসিক্ত করে সবার ওপরে তোলা দরকার। দুর্যোধন বললেন— দেখুন, সারথ্যে নিযুক্ত করার ব্যাপারে আমার নিজস্ব একটা উদ্দেশ্য আছে। নইলে যুদ্ধশক্তিতে কর্ণ বা অন্য কোনও যোদ্ধা আপনার চেয়ে বেশি নন, এমনকী আপনার সামনে পড়লে স্বয়ং কৃষ্ণও আপনার তেজ সহ্য করতে পারবে না— ন চ মদ্রেশ্বর ত্বাং বৈ কৃষ্ণঃ সোঢুঞ্চ শক্ষ্যতি। দুর্যোধন এবার শল্যকে কথা-মোহিত করার জন্য তাঁর পূর্বপুরুষদের সত্যবাদিতার প্রশংসা করলেন। এই পূর্ব সত্যবাদিতার কারণেই নাকি তাঁর আর এক নাম ‘আর্তায়নি’। ঋত মানে সত্য, ঋতই যাদের ‘অয়ন’ অর্থাৎ আশ্রয়— তাঁর নাম ঋতায়ন, ঋতায়নের ‘অপত্যং পুমান্’— তদ্ধিত প্রতয়ে আর্তায়নি। আবার শল্য— মানে ছুড়ি-কাঁচি-অস্ত্র— যা থেকে শল্যচিকিৎসক বলি আমরা, শত্রুর ওপরে তিনি সেই অস্ত্রাঘাতের মতো বেদনাকর, অতএব তাঁর নাম শল্য। এসব নাম-ব্যাখ্যা দুর্যোধনের। তিনি শল্যকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন। শেষ কথায় আবার সেই আবৃত্তি— কর্ণ, আমি, কৃষ্ণ— কেউ আপনার শক্তিমত্তার ধারে-কাছে নেই, তবু আমি আপনাকে এই সারথ্য করার কথা বলছি এই কারণে যে, যুদ্ধে আমি কর্ণকে অর্জুনের থেকে বড় বীর মনে করি, আর আপনাকে শুধু আমি নয়, সমস্ত লোক বলবে— আপনি কৃষ্ণের চেয়ে অনেক উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন— ভবন্তং বাসুদেবাচ্চ লোকোহয়মিতি মন্যতে। আর অশ্বহৃদয়-বিজ্ঞানে আপনি কৃষ্ণের চেয়ে দ্বিগুণ বুদ্ধি ধরেন— দ্বিগুণং ত্বং তথা বেৎসি মদ্ররাজেশ্বরাত্মজ।
এতক্ষণে দুর্যোধন শল্য-মনস্তত্ত্বের একেবারে সঠিক জায়গায় আঘাত করেছেন। আমি আগেও বলেছি এবং এখনও বলছি— কৃষ্ণের সঙ্গে মহারাজ শল্যের এমন একটা কিছু অন্তঃসলিল বিরুদ্ধতা ছিল, যা বাইরে থেকে বোঝবার কোনও উপায় নেই। কিন্তু সেটা এমন একটা কিছু, যা এতকাল ধরে তাঁর মানসিক প্রতিযোগিতার ইন্ধন জুগিয়েছে এবং হয়তো সেই অন্তর্গূঢ় কারণেই তিনি নকুল-সহদেবের নিজের মামা হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় আজ পাণ্ডবদের বিপক্ষে যুদ্ধ করছেন। আমরা এমন সংবাদও দুর্যোধনের মুখেই শুনেছি, যেখানে কৃষ্ণ-শব্দটি উচ্চারণ না করেও কৃষ্ণের বিশাল গুষ্টিকে ইঙ্গিত করে দুর্যোধন শল্যকে বলেছেন— সাত্ত্বতবংশীয়রা সকলে মিলে আপনার বাহুবল সহ্য করতে পারেনি, সেখানে কৃষ্ণ আপনার চাইতে বেশি শক্তিমান হবেন কী করে— তব বাহুবলাদ্ রাজন্ কিন্নু কৃষ্ণো বলাধিকঃ। সবচেয়ে বড় কথা, রথী যোদ্ধার চেয়ে গুণাধিক ব্যক্তিকে রথের সারথি হতে হয়। সেইদিক থেকে কৃষ্ণ যেমন অর্জুনের সারথি, তেমনই আপনাকেও কর্ণের সারথি হতে হবে— রথিনোহভ্যধিকো বীর কর্তব্যো রথসারথিঃ। দুর্যোধনের মুখে নিজের কৃষ্ণাধিক প্রশংসা শোনার পরেই শল্যের ক্রোধ প্রশমিত হল এবং তিনি বললেন— তুমি যখন সমস্ত রাজা এবং সৈন্যদের মাঝখানে আমাকে কৃষ্ণের চাইতেও অনেক বড় বলে প্রশংসা করলে, তাতে আমি সন্তুষ্ট বোধ করছি— বিশিষ্টং দেবকীপুত্ৰাৎ প্রতিমানস্ম্যহং ত্বয়ি। তুমি আর চিন্তা কোরো না, কর্ণ যখন পাণ্ডবাগ্রগণ্য অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবে, তখন আমি তার সারথ্য-কর্ম করব, স্বীকার করলাম— এষ সারথ্যমাতিষ্ঠে রাধেয়স্য যশস্বিনঃ। এই অঙ্গীকারের সঙ্গে সঙ্গে শল্য কিন্তু এবার নিজের শর্তটাও সন্নিবেশ করে নিলেন কথার মাঝে। দুর্যোধন যতটা অত্যাগ্রহে তাঁকে কর্ণের সারথ্য-কর্মে স্বীকার করিয়েছেন, তাতে এই শর্তটা পুরে দেওয়া অত্যন্ত সহজ ছিল শল্যের পক্ষে এবং শল্য তাই সুযোগ বুঝে বললেন— আমি কর্ণের সারথ্য-কর্ম করব বটে, কিন্তু সারথ্য-কর্ম করতে করতে আমি আমার ইচ্ছানুসারে কথা বলব, সে-ব্যাপারে কিন্তু কিছু বলতে পারবে না বাপু— উৎসৃজেয়ং যথাশ্রদ্ধমহং বাচোহস্য সন্নিধৌ।
দুর্যোধন ভাবলেন— কী আর শল্য বলতে পারেন কর্ণকে, তাও রথ চালাতে চালাতে? বড়জোর খানিক বকবক করবেন, বড়জোর খানিক জ্ঞান দেবেন কর্ণকে, তাতে কর্ণের মতো যোদ্ধার কী ছিন্ন হবে? দুর্যোধন বললেন আপনার শর্ত মঞ্জুর, তবু আপনি সারথ্য করুন। কর্ণসহ সবার সামনেই কথাটা বললেন দুর্যোধন— অব্রবীন্ মদ্ররাজানং সর্বক্ষত্রস্য সন্নিধৌ। শুধু তাই নয় সকলের সামনে শল্যের অকুণ্ঠ প্রশংসা করে কর্ণের সুরক্ষার ভারও শল্যের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছেন দুর্যোধন। তাতে ফল এই হল, শল্যের মেজাজটাও বেশ চড়ে গেল, কিন্তু নিজের শর্তটাও আরও একবার ঝালিয়ে নিলেন। শল্য বললেন— সব কাজই আমি বেশ ভালভাবে করতে পারি, দুর্যোধন! যুদ্ধ বলো, সারথ্য বলো, সবই আমি পারি— যত্রাস্মি ভরতশ্রেষ্ঠ যোগ্যঃ কর্মণি কর্হিচিৎ। এবারে অঙ্গরাজ কর্ণের দিকে তাকিয়ে বললেন— দেখুন অঙ্গরাজ! আত্মনিন্দা বা আত্মপ্রশংসাও যেমন করা উচিত নয়, তেমনই পরনিন্দা বা পরপ্রশংসাও করা উচিত নয়। সজ্জনদের বারণ সেটা। তবুও আপনার বিশ্বাসের জন্য আমায় বলতেই হচ্ছে যে, সাবধানে অশ্বচালনা করা, অশ্বের ‘মুড’ বুঝেও নিজের কাজটা তাকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া— এই অশ্বহৃদয়জ্ঞান, অশ্বশাস্ত্রের বিদ্যা এবং অশ্বচিকিৎসায় আমি ইন্দ্রের সারথি মাতলির সমান। অতএব চিন্তা নেই, আপনি নিরুদ্বিগ্ন থাকুন। তবে হ্যাঁ— এবার দুর্যোধনের দিকে তাকিয়ে শল্য আবারও বললেন— তবে হ্যাঁ, আপনাদের হিতকামী হওয়া সত্ত্বেও কর্ণকে প্রিয় বা অপ্রিয় যা কিছুই আমি বলব— যত্তু কৰ্ণমহং ব্রূয়াং হিতকামঃ প্রিয়াপ্রিয়ে— সে-সব কিন্তু আমায় ক্ষমা করতে হবে। এ-কথা আমি কর্ণকেও বলে রাখলাম, তোমাকেও বলে রাখলাম, দুর্যোধন!
বেশ বোঝা যায়, এই শেষের কথাটায় শল্যের দোষমানিতা, পাপমন্যতার মুক্তি, অর্থাৎ তিনি যা করবেন, তা পুরোপুরি বোঝা না গেলেও নিজের ভবিষ্যৎ-কর্মের সাফাইটুকু গেয়ে রাখলেন। পরের দিন শল্যের সারথির আসনে বসা এবং কর্ণের জৈত্র-রথে আরোহণের ঘটনাটা রীতিমতো আড়ম্বরে সম্পন্ন হল। সূর্যোপাসনা করার পর কর্ণই শল্যকে বললেন— আপনি আগে রথে উঠুন। শল্য রথে উঠলেন এমন আড়ম্বরে, যেন সিংহ উঠছে পাহাড়ে। তারপর উঠলেন কর্ণ। বন্দিরা স্তব করতে লাগল, দুর্যোধন পরম আশ্বস্ত হলেন এই কথা ভেবে যে ভীষ্ম-দ্রোণ যা পারেননি কর্ণ আজ তাই করবেন শল্যসহায়ে। খানিকক্ষণ রথ চলার পরেই কর্ণের বোলচাল আরম্ভ হল। মহাভারতে যেমনটি অন্যদের ক্ষেত্রেও দেখেছি, তাতে যুদ্ধের পূর্বমুহূর্তে সকল বীরেরই ক্ষমতা জাহির করার একটা সার্বিক প্রবণতা থাকে এবং পারিপার্শ্বিক জন এবং রথের সারথি এতে সাগ্রহে ইন্ধন জুগিয়ে যান। কর্ণও সেইভাবেই আরম্ভ করে বলেছিলেন— মদ্ররাজ! আপনি ঘোড়াগুলিকে চালিয়ে দিন। আজ আমি অর্জুন-ভীম-যুধিষ্ঠির সবগুলোকে মারব। শল্য বললেন— ওরে সারথির পো! পাণ্ডবদের এত কমা ভাবিস না তুই। ওরা প্রত্যেকেই যুদ্ধ জানে, অতএব অত সোজা ভাবিস না— সূতপুত্র কথং নু ত্বং পাণ্ডবান্ অবমন্যসে! অনেক বড় বড় কথা বলছিস। এরপর যখন অর্জুনের গাণ্ডীব-ধ্বনি শুনবি, তখন আর এসব কথা আসবে না। যখন দেখবি— ভীমের যুদ্ধে দাঁত ভাঙা হাতিগুলো সব মারা পড়ছে, তখন আর এসব বলবি না— তদা নৈবং বদিষ্যসি।
শল্য একেবারে ধ্রুবপদ বেঁধে দিলেন— তদা নৈবং বদিষ্যসি। এতেই কর্ণের বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু শল্যের সঙ্গে পাণ্ডবদের মামা-ভাগনের সম্পর্কের কথা মনে রেখে, কৰ্ণ ভাবলেন— যা বলছেন বলুন শল্য। তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন— ঠিক আছে, এবার ঘোড়াগুলো চালাও তো সেইদিকে— যাহীত্যেবাব্রবীৎ কর্ণো মদ্ররাজং তরস্বিনম্। শল্য অশ্বচালনা করে এগিয়ে যেতেই কৌরববাহিনীর মধ্যে জয়কার-শব্দ ধ্বনিত হল। কৌরবরা ধরেই নিলেন— এবারে আর পাণ্ডবদের রেহাই নেই। কর্ণও খানিক চুপ করে থেকে শল্যের পূর্বকথার জবাব দিতে আরম্ভ করলেন সদম্ভে। নিজের শক্তি সোচ্চারে ঘোষণা করে যেই না কর্ণ পাণ্ডবদের মৌখিক অবমাননা করতে আরম্ভ করলেন, অমনই শল্য সাবহাসে অপমান করে থামিয়ে দিলেন কর্ণকে— অবহসদ্অবমন্য বীর্যবান্/প্রতিষিষিধে চ জগাদ চোত্তরম্। শল্য বললেন— আরে থাম, থেমে যা। অনেক ক্ষণ ধরে গেয়ে যাচ্ছিস নিজের কথা। তোর খুব বাড় বেড়েছে নারে! এতক্ষণ ধরে ভুলভাল অনেক বকেছিস, এবারে থেমে যা— বিরম বিরম কর্ণ কত্থনাদ্/অতিরভসোহতি চাপ্যযুক্তবাক্। কোথায় সেই অর্জুন আর কোথা ব্যাটা তুই নরাধম। শল্য একটা একটা করে অর্জুনের কীর্তি-কাহিনি সূত্রাকারে বলতে লাগলেন, বিশেষত যেসব যুদ্ধে অর্জুন কৌরবদের পরাস্ত করেছেন, অথচ সেখানে কর্ণ পালাতে বাধ্য হয়েছেন, শল্য সেইসব ঘটনা খুঁচিয়ে তুলে বললেন— তখন তুই কোথায় ছিলি, কর্ণ! তখন এই পাণ্ডবদের জয় করিসনি কেন? আর আজকে যে ভয়ংকর যুদ্ধ উপস্থিত হয়েছে, এটা একেবারে তোর শেষ যুদ্ধ। পালিয়ে যদি না যাস, তবে ধরে নে আজ তুই মরেই গেছিস— যদি ন রিপুভয়াৎ পলায়সে/সমরগতোহদ্য হতোহসি সূতজ।
কর্ণ এবার কিন্তু রেগে গেলেন। তাঁর মাথা গরম হয়ে উঠছে। বললেন— আরে যা যা। অর্জুনের এত প্রশংসা করার কিছু হয়নি। তার সঙ্গে আসল যুদ্ধটাই তো এখনও হয়নি। যুদ্ধ হোক, অর্জুন জিতুক, তারপরে বাক্যি দেবেন; এখন চলুন তো অৰ্জুন যেখানে আছে সেইখানে— যাহি শল্যেতি চাপ্যেনং কর্ণঃ প্রাহ যুযুৎসয়া। মহাভারতের কবির চরিত্র-সৃষ্টি এবং বাস্তব-বোধ দেখে অবাক হয়ে যাই। তিনি জানেন এবং আমরাও জানি যে, অতিরিক্ত ব্যক্তিত্বময় মানুষও যদি কঠিন পরীক্ষার সামনে উপস্থিত হন, এবং সেই মুহূর্তে যদি অন্যতর কোনও ব্যক্তিত্ব সুকৌশলে তাঁর স্নায়ুর বিকার তৈরি করতে পারেন, তবে অতি বড় মানুষও ভেঙে-নুয়ে পড়েন। কর্ণের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে, শল্যরাজ তাঁরই রথের সারথি হয়ে বিপক্ষ অর্জুনের ভূয়সী প্রশংসা করে যাচ্ছেন, কোথায় কোথায় অর্জুনের সঙ্গে কর্ণ হেরে গেছেন, সেই লিস্টি কর্ণকে শোনাচ্ছেন, এতে কর্ণের মনে যে চাপ বাড়ছে, কর্ণ সেটাকে সামাল দেবার চেষ্টা করছেন রেগে গিয়ে। বিপক্ষ তাই চায় এবং শল্যও তাই চাইছেন। শল্য তাঁর স্নায়ুর চাপ বাড়াচ্ছেন এবং কর্ণ সেই ফাঁদে পা দিয়ে রেগে যেতে আরম্ভ করলেন— ভৃশমভিরুষিতঃ পরন্তপঃ। কর্ণের ধারণ-শক্তি কমে গেছে, তিনি শল্যের উত্তেজক কথাগুলির জবাব দিতে চাইছেন। আর জবাব যখন হারিয়ে যাচ্ছে, তখন কর্ণ শল্যকে শুধু বলছেন— ‘যাহি’— তুমি চালাও রথ। আবার খানিক চলতে চলতে কর্ণ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিস্ফারণে আত্মশ্লাঘা আরম্ভ করেন, উত্তরে শল্যের স্নায়ু-শোষিণী বক্তৃতা আরম্ভ হয়।
আমরা শল্য-কর্ণের এই চাপান-উতোর, এই বাক্য-প্রতিবাক্য দুই লাইনে শেষ করে বলতে পারতাম— তারপর শল্য কথার পর কথায় অর্জুনের প্রশংসা করে কর্ণের মনোবল ভেঙে দিলেন। কিন্তু তা হলে বিশালবুদ্ধি ব্যাসের জীবনকে নিরন্তর দেখার শৈলীটুকু একেবারেই অনালোচিত থেকে যেত। সেটা পাঠকের প্রতি বঞ্চনা বলে আমি মনে করি। ফলে কর্ণের শল্যসারথি রথ চলার পথে আবারও আমাদের শুনতে হবে কর্ণ এবার কী বলেন।
কর্ণ দ্বিগুণ আস্ফালনে এবার বললেন— ওহে, তোমাদের মধ্যে কেউ কি আছ যে আমায় শুধু দেখিয়ে দেবে অর্জুন কোথায় আছে। অথবা বলতে পারবে— অর্জুন কোথায় আছে— যো মে ব্রূয়াদ্ধনঞ্জয়ম্— কর্ণ এবার একটার-পর-একটা দান ঘোষণা করতে লাগলেন— যে আমাকে দেখিয়ে দেবে অর্জুন কোথায়, তাকে আমি একশো গাই দেব, মণিরত্নের গাড়ি দেব, গ্রাম দেব— ইত্যাদি শত বিকল্পের মধ্যে হাতি, ঘোড়া থেকে আরম্ভ করে শেষ পর্যন্ত স্তন-জঘনবতী সুন্দরী রমণী দানেরও সন্নিবেশ ঘটল। এমনকী কর্ণ নাকি সন্তুষ্ট হয়ে নিজের স্ত্রী-পুত্রকেও দিয়ে দিতে পারেন শুধু অর্জুনকে দেখিয়ে দেবার বিনিময়ে। আর যুদ্ধে একবার দেখা হলে অর্জুন-কৃষ্ণ দু’জনেই মারা পড়বেন কর্ণের হাতে— আবারও এমন আস্ফালন শুনে শল্য আর থাকতে পারলেন না। বললেন— ওরে সারথির পো! সোনার হাতি, ছ’খানা গোরু— কাউকে দিসনে বাছা! অর্জুনকে তুই এমনিই দেখতে পাবি। সেই ছোটবেলা থেকে এখন অবদি এনতার কথা তুই এ-বাবদে বোকার মতো খরচা করেছিস— পুরা সৃজসি যচ্চাপি বিত্তং বহু চ মূঢ়বৎ— সেগুলো সব অপাত্রে দান করা হয়েছে, আর এমন করিস না, আজ এমনিই দেখতে পাবি অর্জুনকে— দ্রক্ষ্যসি ত্বং ধনঞ্জয়ম্। আর বলছিস কি না— কৃষ্ণ আর অর্জুন, দু’জনকেই তুই মারবি। এমন কথা জন্মেও শুনিনি বাপু যে, একটা শেয়াল দুটো সিংহকে লড়াই করে মেরেছে— ন হি শুশ্রুম সংমর্দে ক্রোষ্ট্রা সিংহৌ নিপাতিতৌ।
শল্য আরও কিছু অসম্ভবের বস্তুসম্বন্ধ সম্ভাবনা করে কর্ণকে তিরস্কার করার পর কর্ণের ক্রোধ চরমে উঠল। দোষের মধ্যে শল্য বলেছিলেন— বাঁশবনে খরগোশের মধ্যে থেকে শেয়াল নিজেকেই সিংহ মনে করে এবং যতক্ষণ সে সিংহকে না দেখেছে, ততক্ষণই তার আলাপ-চিৎকার শোনা যায়— মন্যতে সিংহমাত্মানং যাবৎ সিংহং ন পশ্যসি। বার বার কর্ণের সম্বন্ধে ‘শেয়াল’ কথাটা প্রয়োগ করা আরও একটা গভীর ইঙ্গিত দিয়েছেন। সাধারণত শেয়াল বাঘ-সিংহের মেরে যাওয়া ভুক্তাবশিষ্ট খেয়ে বাঁচে, আর নিজে মারলে বড় জোর হাঁস-মুরগি-খরগোশ। কর্ণ অঙ্গরাজ্য পেয়েও সেখানে গিয়ে বাস করেননি, দুর্যোধনের অন্ন খেয়েই তিনি আজ অর্জুনের সঙ্গে লড়াই করতে যাচ্ছেন। শল্য বলেছেন— বনের মধ্যে মাংসভক্ষণ করে যে শেয়াল তৃপ্ত থাকে, সে শেয়াল সিংহের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে মরবে, অতএব তুমিও কর্ণ, অর্জুনের কাছে গিয়ে আবার মরে না যাও, দেখো— বনে শৃগালঃ পিশিতস্য তৃপ্তো/মা পাৰ্থমাসাদ্য বিনঙ্ক্ষ্যসি ত্বম্।
শেয়াল কথাটা আরও কয়েকবার উচ্চারণ করেছেন শল্য এবং তার সঙ্গে আরও অপমানজনক কথা। কর্ণের ক্রোধ এবার চরমে উঠছে, তিনি শল্যের অপমানে এবার যুক্তি হারিয়ে ফেলছেন এবং আস্তে আস্তে এটাও অনুধাবন করছেন যে, পাণ্ডব-ঘনিষ্ঠ কাউকে এইভাবে অর্থের বিনিময়ে স্বপক্ষে নিয়োগ করাটা ঠিক হয়নি। কর্ণ বললেন— গুণী লোকেরাই গুণীর কদর বোঝে, আপনার মতো নির্গুণ লোক কতটুকু চিনবেন অর্জুনকে অথবা কৃষ্ণকে— যথাহং শল্য জানামি ন ত্বং জানাসি তত্তথা। একইভাবে আমি নিজের শক্তিটাও ভালভাবে জানি বলেই আমি অর্জুনকেই যুদ্ধে আহ্বান করি। এই অসাধারণ বীরোচিত কথাটা কর্ণ অত্যন্ত সযৌক্তিকভাবে বলেছেন নিজেকে ‘জাস্টিফাই’ করার জন্য, কিন্তু শল্যের বাক্যবাণে তিনি জর্জরিত হচ্ছিলেন, অতএব অর্জুন-কৃষ্ণকে বাদ দিয়ে এবার তাঁকেই পেড়ে ধরলেন কর্ণ। বললেন— এঁদের কথা থাক, কিন্তু আপনি কেমন মানুষ শল্য, আপনি তো আমাদের বন্ধু সেজে শত্রুর কাজ করছেন, নইলে কৃষ্ণার্জুনের প্রশংসা করে আপনি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন কেন? অর্জুন আসুক, কৃষ্ণ আসুক, তাদের একশো জন আসুক, আমি সেটা বুঝে নেব, খারাপ কোনও কুদেশের মানুষ তুই! তুই চুপ করে থাক না— অহমেকো হনিষ্যামি জোষমাস্স্ব কুদেশজ।
ক্রোধের তর-তম বুঝেই আমরা কর্ণের সম্বোধনে আপনি-তুমি-তুই নির্ধারণ করেছি। শল্যের প্রতি কর্ণের শেষ সংক্ষিপ্ত সম্বোধন-তিরস্কার ছিল— কুদেশজ অর্থাৎ খারাপ কুৎসিত দেশে যাঁর জন্ম হয়েছে। সেই কালের দিনেও মহাকবির দৃষ্টিতে কী জীবন্ত এই তিরস্কারের সংস্কার। আমরা এখনও ঘটি-বাঙালের দেশ নিয়ে পরস্পরকে গালাগাল দিই। ওড়িয়া-বিহারি-বাঙালিরা আপন প্রাদেশিকতায় একে অন্যকে দেশ নিয়ে গালাগালি দেন। সেকালেও এমনই ছিল, তবে কতগুলি দেশ সম্বন্ধে এক এক জায়গার মানুষের যেমন বিশেষ আক্রোশ থাকে, তেমনই মদ্রদেশ সম্বন্ধে উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের কুচেতনা বেশি ছিল। আমরা কথারম্ভে বলেছিলাম— শল্যের জন্মভূমি মদ্রদেশ বৈদিককালে যথেষ্ট আর্যোচিত আচারে সম্পন্ন ছিল, কিন্তু পঞ্চ নদীর দেশ ঝিলাম-চেনাবের জল-ধোয়া কাশ্মীর অথবা পূর্বমদ্র— পঞ্জাব-শিয়ালকোট ছেড়ে আর্যরা যেই সরস্বতী-দৃষদ্বতীর দিকে চলে এসেছেন এবং তারপরে গঙ্গার তীরভূমির প্রভাব যত বেড়েছে, তখনই মদ্রদেশের সাংস্কারিক অবনমন ঘটেছে। তার মধ্যে যবন-আক্রমণ এবং মদ্রদেশের গণরাষ্ট্রিক পরিকাঠামোও মহাভারতের কালে মদ্রদেশকে গাঙ্গেয় উপত্যকার রাজ্যগুলির প্রতিতুলনায় অবহীন অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। ফলে কর্ণ এবার তাঁর বীরাসন ছেড়ে একেবারে গ্রাম্য-জনের প্রাকৃত বিবাদের মধ্যে নেমে এসেছেন। তিনি শল্যকে সরাসরি তাঁর দেশ নিয়ে গালাগালি দিতে দিতে মদ্রদেশের আচার-বিচার-সভ্যতা নিয়ে এমনভাবে বলা আরম্ভ করলেন, যাতে ব্যক্তিগতভাবে শল্য আহত হয়ে চুপ করে যান। শল্যের দেশ সম্বন্ধে তিরস্কারগুলি শল্যের সার্বিক পরিচয় বহন করে বলেই এবং মহাভারতের আমলেও তা একান্ত কৌতূহলোদ্দীপক বলেই সেগুলির খানিক উচ্চারণ করতে হবে। বিশেষ করে ক্রুদ্ধ মুহূর্তে কীভাবে অন্য মানুষকে মানুষ দেশ তুলে গালাগাল দেয়, সেটা মহর্ষি দ্বৈপায়ন ব্যাস পুরোহিত-দর্পণের কায়দায় লেখেননি, সেটার আস্বাদনও সংস্কৃতভাষা-বিদ্বেষী পণ্ডিত-মূর্খদের বোঝা প্রয়োজন।
কর্ণ বললেন— শল্যমশায়! শুধু আমি কেন, মেয়েরা, বালকেরা, বুড়োরা এবং তোমাদের দেশ ঘুরে-আসা মানুষগুলিও তো কথায় কথায় এই কথাগুলি বলে যে, বিনা কারণে বিদ্বেষ করা অথবা বন্ধুজনকে বাঁশ দেওয়াটাই মদ্রকদের স্বভাব, আর মদ্রদেশের লোকেরা এত মিথ্যেবাদী, এত কুটিল এবং এত বদমাশ যে, মরা না পর্যন্ত মদ্রকদের বদমায়েশি ঘোচে না— যাবদন্তং হি দৌরাত্ম্যং মদ্রকেষ্বিতি নঃ শ্রুতম্। মদ্রকদের ঘরগুলোর দিকে একবার তাকাও, কোনও বিধিনিষেধ নেই, কোনও আচার-বিচার নেই— মা-বাবা, ভাই-বোন, শ্বশুর-শাশুড়ি, মেয়ে-জামাই, আত্মীয়-স্বজন— সব এক বাড়িতে। যা-তা খাচ্ছে, ছাতুর সঙ্গে মাছ খাচ্ছে, গোরুর মাংসের সঙ্গে মদও খাচ্ছে, তারপর হাসছে, গাইছে, কাঁদছে এবং যখন-তখন যার-তার সঙ্গে যৌন আলাপ করে যাচ্ছে, যৌন মিলনও করছে— গায়ন্তি চাপ্যবদ্ধানি প্রবর্তন্তে চ কামতঃ। এমন লোকের সঙ্গে মানুষ মেশে কখনও? এদের সঙ্গে শত্রুতাও করা উচিত নয়, মিত্রতা তো দূরের কথা, কেন না শত্রুতা হলেও এদের সংস্পর্শে আসতে হয়, আর এত অসভ্য লোকের সংস্পর্শ কি ভদ্রলোকের চলে— মদ্রকে সঙ্গতং নাস্তি মদ্ৰকো হি সদামলঃ।
কর্ণের কথা শুনে বোঝা যায়, গাঙ্গেয় উপত্যকায় যখন আর্যায়ণ ঘটেছিল— একেবারে মথুরা-মানস সরোবর থেকে মগধ পর্যন্ত— তারা মাছ খাওয়াটা ভাল চোখে দেখত না, গোমাংস তো নয়ই, বিশেষত মেয়েদের মদ-খাওয়ার ঘটনাকে ভীষণই ঘৃণা করত। ওদিকে কাশ্মীর-কান্দাহার অর্থাৎ তখনকার মদ্র এবং গান্ধার ততদিনে অন্যতর প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে, অন্যতর প্রভাব যদি বা নাও থাকে, তবু এটাই ঘটনা যে, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের কেন্দ্র-পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় আচার-বিচার-সংস্কার, নীতিবোধ এবং জীবনযাত্রা সেখানে ব্রাহ্মণ্য শুদ্ধতার গণ্ডি অতিক্রম করেছে, যার জন্য মদ্র-গান্ধার অঞ্চলের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে খানিকটা আর্যেতর! নইলে ভাবুন একবার, শল্য দুর্যোধনের স্তুতি-নতিতেই কৌরবপক্ষে যোগ দিয়ে থাকুন অথবা অর্থের বিনিময়েই সেখানে যোগ দিয়ে থাকুন, কোন নীতিতে, কোন নীতিবোধে শল্য যুধিষ্ঠিরকে কথা দিলেন যে, তিনি বিপক্ষে থেকেও তাঁর কাজটুকু করে দেবেন আত্মীয়তার সম্মানে। তখনকার দিনের ক্ষাত্র-নীতি এমন দুর্নীতিতে সিঞ্চিত হয়নি। আমার তো এমনও মনে হয় যে, ঘটনাটা আগে ঘটে গিয়েছিল। অর্থাৎ দুর্যোধনের কারণে অথবা অর্থের কারণে শল্য কৌরব-পক্ষে যোগ দিয়ে ফেলেছিলেন এবং কর্ণের সারথ্যকালে নিজের আত্মীয়দের কাছে মুখরক্ষার জন্য শল্য আপন নীতি-শিথিল ভাবনায় কর্ণের মনোবল ভেঙে দিয়েছিলেন। সেটা তাঁর দেশজ স্বভাব, নইলে ভীষ্ম-দ্রোণ মারা যাবার পর কর্ণের সময়ে শল্য তাঁর সারথ্য করবেন কি না এবং কর্ণও সেটা চাইবেন কি না, এ কথা যুধিষ্ঠির আগে থেকে জানবেন কেমন করে! জানাটা অলৌকিতার মহাকাব্যিক প্রশ্রয় বলেই এবং আত্মীয়তাহেতু পাণ্ডব-ঘনিষ্ঠের নীতিবোধ নিন্দার্হ হয় বলেই ঘটে-যাওয়া ঘটনাকে দ্বৈপায়ন ব্যাস এমন কাব্যিক প্রশ্রয়ে ব্যক্ত করেন।
সবচেয়ে বড় কথা, একজনের দেশজ স্বভাব নিয়ে গালি দেওয়াটা এখনকার দিনে যেমন অসভ্যতা, তেমনি তখনকার দিনেও এটা অসভ্যতা ছিল। বরঞ্চ প্রাচীনেরা আমাদের চেয়ে অধিক প্রগতিশীল, কেন না দেশ তুলে মানুষকে স্বভাবের গালি দিলে সে-যুগে ‘ফাইন’ হত, এবং তা প্রমাণ করতে পারলে অর্থদণ্ড হত। আবার এটাও ভীষণভাবে ঠিক, তা আমরা যতই প্রগতিশীলতায় ভুগি না কেন— একটি দেশ-প্রদেশ-জেলার নদ-নদী, জলবায়ু, রক্তের মিশ্রণ, ভাষা, আচার— এসব কিছুই একটি বিশেষ জায়গার স্বভাব তৈরি করে। তার ওপরে আছে মানুষের ব্যক্তিগত পরিবেশ, রুচি এবং ব্যক্তিচরিত্র। সেটা দেশজ স্বভাবের সঙ্গে মিশে মানুষের একটা নির্দিষ্ট চরিত্র তৈরি করে। সেটা মন্দ হোক, ভাল হোক, উত্তম হোক, মধ্যম হোক, এমনকী লজ্জা কিংবা প্রশংসারই হোক, দেশজ চরিত্র একটা তৈরি হয়ই— সেটা প্রগতিশীল হয়েছি বলেই অস্বীকার করা যায় না। আমরা বাঙালিরা পঞ্জাব-সিন্ধু-গুজরাট-মারাঠার একরকম প্রশংসা করি, আবার নিন্দা বা তাচ্ছিল্যও করি অতি স্বতন্ত্র কোনও বৈশিষ্ট্যের জন্য। একইভাবে দ্রাবিড়, উৎকলের সম্বন্ধেও আমাদের নিজস্ব ভাল-মন্দ ধারণা আছে এবং সেটাও তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের জন্যই। অন্য দিকে ভারতবর্ষের তাবৎ লোকেরা বাঙালিদের সম্বন্ধেও কিছু কিছু চারিত্রিক দোষ আবিষ্কার করেন— বাঙালিরা ‘ইমোশনাল’, বাঙালি কাজে ফাঁকি দেয়, বাঙালি বাংলাদেশের বাইরে যেতে চায় না। এইরকম আর কী, এখন তো বিদেশ-বিভুঁই-ঘোরা ছেলেমেয়েদের কাছে এবং অবশ্যই বইতেও পড়েছি যে, জার্মানরা এইরকম, তো আমেরিকানরা ওইরকম, চিনেরা সেইরকম, তো জাপানিরা আর একরকম। এইভাবেই নিন্দা-প্রশংসায় প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র মানুষের এক একটি স্বতন্ত্র প্রাদেশিক এবং দৈশিক চরিত্র আরোপিত হয় এবং তার মধ্যে মেয়েদের নিয়ে কৌতূহলও কম নয়— চরিত্র আরোপণের ক্ষেত্রে তাঁরাও ভীষণভাবে চিত্রপটে উপস্থিত স্তুতি বা নিন্দায় জর্জরিত হয়ে॥
শল্যের দেশজ নিন্দা করতে করতে কর্ণ বললেন— মদ্র দেশে লোকের কাছে যদি টাকা-পয়সা গচ্ছিত রাখা হয়, তবে সেটা আর ফেরত আসবে না, ঠিক যেমন কান্দাহার-গান্ধারের মানুষদের শুচিতা, শুদ্ধতার কোনও বোধও নেই— মদ্রকেষু চ সংসৃষ্টং শৌচং গান্ধারকেষু চ। বোঝা যাচ্ছে, মহাভারতের কালে কান্দাহার-গান্ধার এবং প্রায় তার পাশাপাশি রাজ্য পঞ্জাব-শিয়ালকোট তথা কাশ্মীরের পশ্চিমাংশ তাদের বৈদিক ব্রাহ্মণ্য-গৌরব হারিয়েছে। অপিচ আগে গৌরব ছিল বলেই এখন এত তিরস্কার। কর্ণ বললেন— আরে শল্য! তোদের মেয়েগুলোর চরিত্রটা একবার ভেবে দেখ। তোদের মেয়েগুলোর পেটে মদ পড়লেই ন্যাংটো হয়ে নাচে– বাসান্যুৎসৃজ্য নৃত্যন্তি স্ত্রিয়ো যা মদ্যমোহিতা। আর দেখ, স্ত্রীলোকের ব্যাপারে পুরুষের অথবা পুরুষের ব্যাপারে স্ত্রীলোকের কৌতূহল সব দেশেই থাকে, তবু তার মধ্যে একটা সংযম থাকে। তাদের মেয়েদের তো লজ্জা বলে কিছু নেই, সব তো স্বৈরিণী, স্ত্রী-পুরুষের মৈথুনের ক্ষেত্রেও কোনও সংযম নেই, যার-তার সঙ্গে ঝুলে পড়ছে, সে তো ছেড়েই দিলাম, মৈথুনের সময়ে তোদের মেয়েরা, ভাবতে পারছিস— তোদের মেয়েরা এমন আওয়াজ করে মুখ দিয়ে— মৈথুনেহসংযতাশ্চাপি যথাকামচরাশ্চ তাঃ— তাতেই আমি ভাবি— তাদের ঘরের ছেলে তুই মদ্রক শল্য আর কত ভাল হবি? সে আবার আমায় ধর্ম শেখাচ্ছে— তাসাং পুত্রঃ কথং ধর্মং মদ্রকো বকুমর্হতি!
যে কোনও দেশের মানুষকে তাদের মেয়েদের কথা তুলে গালাগাল দিলে সবচেয়ে বেশি মানে লাগে। কেন না কন্যা-জায়া-জননী এতটাই ব্যক্তিগত অধিকার এবং আবেগের বিষয় যে, তাদের ওপর যে কোনও আক্ষেপ এবং আরোপ ভীষণভাবে পীড়িত করে মানুষকে। দেশের মেয়েদের চরিত্র হনন করে ব্যক্তিগত মানহানি করা যায় বলেই কর্ণ বললেন— যে দেশের মেয়েরা উট আর গাধার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করে— যা স্তিষ্ঠন্ত্যঃ প্রমেহন্তি যথৈবোষ্ট্র-দশেরকাঃ— তুই সেই মা-মেয়েদের ছেলে হয়ে আমাকে ধর্ম শেখানোর চেষ্টা করছিস, শল্য! আর্য এবং ব্রাহ্মণ্য ভাবনায় প্রভাবিত সমাজে, দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করাটা ভীষণ রকমের বিগর্হিত ছিল। সেখানে আবার মেয়েদের এই আচরণ। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর বিখ্যাত বৈয়াকরণ পতঞ্জলি তাঁর মহাভাষ্যে অব্রাহ্মণের লক্ষণ বলার সময় অন্যতমভাবে সেই লোকটাকে ধরেছেন যে দাঁড়িয়ে মূত্র বিসর্জন করে— যস্তিষ্ঠন্ মূত্রয়তি। কর্ণও ঠিক সেটাই ধরেছেন, বিশেষত যে-দেশের মেয়েরা এই আচরণ করে, তাঁদের দেশের জাতক শল্যকে কর্ণ এই বাবদে ছেড়ে দেবেন না।
আর এক বস্তু হল মদ। মহাভারতের কালে ক্ষত্রিয় রাজন্যবর্গের মধ্যে মদ্য পান করার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। কিন্তু একমাত্ৰ স্বৈরিণীভিন্ন অন্য মেয়েদের মধ্যে মদ্যপানের রীতি ব্রাহ্মণ্য-ভাবপুষ্ট মহাভারতের কালেও ছিল না। সেখানে মদ্র-দেশের মেয়েরা বহুলভাবে মদ্যপান করত এবং তা এতটাই বহুল যে কর্ণ প্রাবাদিক পর্যায়ে উচ্চারিত এক লোক -কথা শুনিয়ে শল্যকে বলছেন— কোনও লোক যদি মদ্র-রমণীর কাছে মদ চায়, তবে সে নিজের কোমরের পিছনে কাপড় ধরে টানাটানি করে বলে— ওরে তোরা কেউ যেন মদ চাস না আমার কাছে, আমার স্বামী নিয়ে যা, ছেলে নিয়ে যা, সব নিয়ে যা, কিন্তু আমার মদটুকু কিছুতেই দেব না— পুত্ৰং দদ্যাং পতিং দদ্যাং ন তু দদ্যাং সুবীরকম্। কান্দাহার-পঞ্জাব-শিয়ালকোট অথবা কাশ্মীরি মেয়েদের চেহারা জানেন কর্ণ, কিন্তু তাদের চরিত্র নিয়ে কর্ণের বক্তব্য আছে। কর্ণ বলছেন— মদ্রিকা রমণীরা লম্বা হয়, দেখতেও খুব ফর্সা, কিন্তু তারা নির্লজ্জ, কম্বল গায়ে দিয়ে থাকে, আর খায় বেশি, আচার-বিচারেও বালাই নেই কোনও— গৌর্যৌ বৃহত্যো নির্হ্রীকা মদ্রিকাঃ কম্বলাবৃতাঃ॥
বোঝা যাচ্ছে, শল্য যে জায়গা থেকে এসেছেন, সেখানে ঠান্ডা বেশি পড়ে, ফলে কম্বলও গায়ে দিতে হয় সর্বদা। ঠান্ডায় জায়গা হলে সেখানকার শুচিবোধে স্নান করা এবং জলশুদ্ধির চেষ্টা কম থাকে। কিন্তু সেটাও কর্ণের কাছে নিন্দার্হ। বিশেষত মদ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করে কর্ণ আর যেসব দেশের নাম করেছেন— যেমন গান্ধার, সিন্ধু, সৌবীর— এর কোনওটাই মহাভারতের আমলে ব্রাহ্মণ্য ভাবধারায় পুষ্ট আচারে সমৃদ্ধ ছিল না, অন্তত তখন তার পূর্বগৌরব হারিয়েছে। কিন্তু সেটা আমাদের কাছে নিতান্তই গৌণ কথা হলেও কর্ণ দেশজ নিন্দাগুলিই বড় করে প্রকট করে তুললেন শল্যকে ব্যক্তিগত আঘাত করার জন্য এবং শেষে বললেন— আমি আমার সংকল্পে স্থির আছি, আমি অর্জুন-কৃষ্ণকে মারবই। কিন্তু তোর চরিত্রটা কী শল্য! আমি বেশ বুঝেছি— তুই নকুল-সহদেবের মামা, অতএব তুই তাদের পক্ষেরই লোক, আমাদের এই কৌরবপক্ষের ক্ষতি করার জন্য তোকে আমাদের মধ্যে সুকৌশলে ঢুকিয়ে দিয়েছে ওরা— ব্যক্তং ত্বমপ্যুহিতঃ পাণ্ডবৈঃ পাপদেশজ— নইলে আমাদের ঘরে বসে তুই এরকম শত্রুর মতো কথা বলছিস? ফের যদি, শল্য তুই আর একবার উলটো-পালটা কথা বলিস— পুনশ্চেদীদৃশং বাক্যং মদ্ররাজ বদিষ্যসি— তা হলে আমার এই বজ্রের মতো গদাটা দিয়ে তোর মাথাটা আমি গুঁড়িয়ে দেব।
শল্য কিন্তু শল্যের কাজটা করে দিয়েছেন। কর্ণের মাথাটা সম্পূর্ণ গরম হয়ে গেছে, তাঁর ‘কনসেন্ট্রেশন’ নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি এখন এই মুহূর্তে অর্জুনের কথা যত না ভাবছেন, তার চেয়ে বেশি ভাবছেন শল্যর তিরস্কার-বাক্যগুলি। কিন্তু শুল্য যে এত গালাগালি খেলেন, দেশের মা-বোন-মেয়েদের নিয়ে এত যে কুকথা শুনলেন, তবু কিন্তু তাঁর কোনও বিক্রিয়া হল না। কে জানে তিনি তেমনই কুটিল কি না— কর্ণ বলেছেন, মদ্রদেশের লোকেরা প্রায়ই কুটিল হয় এবং মৃত্যু না-হওয়া পর্যন্ত তাঁদের দুরাত্মতা যায় না। শল্যের সার্বিক চরিত্র বিচার করে আমাদের অবশ্য তেমন মনে হয় না। তা ছাড়া মদ্রদেশ অথবা গান্ধার যদি এতই খারাপ হত, সে-দেশের মেয়েরা যদি এতই কুচরিত্র হতেন তা হলে ভীষ্মের মতো বিশালবুদ্ধি পুরুষ পুত্র-সমান ধৃতরাষ্ট্রের মেয়ে খুঁজে খুঁজে গান্ধারীর সঙ্গে বিয়ে দিতেন না, অথবা পাণ্ডুর সঙ্গে বিয়ে দিতেন না মাদ্রীর। শল্য তো মাদ্রীরই ভাই, তিনি কুটিল বলে মনে হয় না, তবে আপন সংকল্পে তিনি স্থির— কর্ণকে তিনি অস্থির করে তুলবেনই। অতএব চরম তিরস্কার শুনেও তিনি প্রতিক্রিয় হলেন না, বরঞ্চ কর্ণের দিক থেকে চরম মৃত্যু-পরোয়ানা শুনে তিনি আরও ঠান্ডা মাথায় সেই কাজটাই করতে লাগলেন, যা তিনি আগে করছিলেন।
প্রথমে তিনি একটু ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজের সাফাই গাইলেন। বললেন— যথাবিধানে যাঁরা বৈদিক যজ্ঞ করেন, যাঁরা যুদ্ধে পলায়ন করেন না এবং যে দেশের রাজাদের লোকে পরম সম্মানে মাথায় রাখে, আমি তাঁদেরই বংশে জন্মেছি। আমি নিজেও ধর্ম মেনে চলি। কিন্তু ওরে ষাঁড়! কেন না মদ-খাওয়া মানুষ যেমন ষাঁড়ের মতো একগুঁয়ে, তোমাকে সেইরকমই লাগছে। তুমি আমার কথায় পাত্তা দিচ্ছ না বলেই তোমার চিকিৎসা করছি আমি। অর্জুন-কৃষ্ণকে মারার ব্যাপারে কর্ণ যে গোয়ার্তুমি করছেন, সেই জন্যই হয়তো এই বৃষের সম্বোধন— যথৈব মত্তো মদ্যেন ত্বং তথা লক্ষ্যসে বৃষ। শল্য স্বসংকল্পে স্থির থেকে ভণিতা করে বললেন— তোমার হিত-অহিত দুই-ই আমার চিন্তা করা উচিত, বিশেষত আমি তোমার রথের সারথি বলেই তোমার হিতৈষী হয়ে তোমার সবলতা-দুর্বলতা, তোমার অনুকূল-প্রতিকূল অবস্থা সবই জানাচ্ছি— সমঞ্চ বিষমঞ্চৈব রথিনশ্চ বলাবলম্। শল্য এবার অদ্ভুত কায়দায় একটি কাক এবং মানস-সরোবরগামী একটি হংসের গল্প বলতে আরম্ভ করলেন এবং সেই কাকের চরিত্র-বিস্তারে কর্ণের সমস্ত জীবনটা প্রতিফলিত হয়ে উঠল।
এই গল্পটা আমি আর বিস্তারিত বললাম না, কিন্তু এটা মানতে হবে যে, শল্য কী ঠান্ডা মাথায় একটা বীর মানুষকে বিচলিত করে দিতে পারেন। বিশেষত কর্ণ শল্যের দেশ নিয়ে অত্যন্ত কুকথা বলেছেন বলেই শল্য প্রমাণ করতে চাইলেন যে, কর্ণের নিজের বলতে কোনও দেশই নেই। শল্যকথিত কাহিনিতে কাকটি এক ধনী বৈশ্যের বাড়িতে উচ্ছিষ্ট খেয়ে নধর হয়ে উঠেছিল। বৈশ্যবাড়ির দই-দুধে পুষ্ট কাকটিকে বৈশ্য গৃহস্থটিও এমন তোল্লাই দিত যে, কাকটি ভাবত— তাঁর চেয়ে উত্তম পক্ষী কেউ নেই। এমন সময় সেইখানে মানস সরোবরগামী পরিযায়ী হাঁসেদের আগমন ঘটল। বৈশ্য গৃহস্থ বলল— তুমি কাক! এই হাঁসেদের চাইতে অনেক উচ্চতর পক্ষী। কথায় গর্বিত কাকটি এবার হাঁসদের মাঝখানে গিয়ে তাদের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী হাঁসকে ‘চ্যালেঞ্জ’ জানিয়ে বলল— এসো আমরা উড়ে দেখাই কার কত ক্ষমতা। হাঁসেরা হেসে কুটিকুটি হল কাকের কথা শুনে। কাক কোনও পাত্তা না দিয়ে বলল— আমি একশো রকম কায়দায় শত-পাতে উড়তে পারি, তোরা পারিস— শতমেকঞ্চ পাতানাং পতিতাস্মি ন সংশয়ঃ— ওইরকম শত-পাতে শত যোজন উড়ে যাব আমি, তোরা পারবি সেসব?
কথাটা বলেই কাক আকাশে ওড়ার বিচিত্র কৌশল শাস্ত্র আউড়ে বলতে লাগল— উড্ডীনম্ অবডীনঞ্চ প্রডীনং ডীনমেব চ। হাঁসেরা হেসে বলল— না বাবা! অত শত কায়দা আমরা জানি না। আমরা উড়ে যাবার একটাই উপায় জানি, সেটা হল উড়ে যাওয়া আর তাতেই আমরা বহু দূর পথ চলে যাই। কাকের বন্ধু কাকেরা বলল— বোকা হাঁস! তোদের এক পাতে ওড়ার কায়দায় কাকের শত পাত জয় করবি কী করে? পরীক্ষা হয়ে যাক। কাক এবং হাঁস এবার উড়তে আরম্ভ করল। কাক বিচিত্র কায়দায় সামনে-পিছনে, ডান পাশে বাঁ পাশে উছলে পড়ে উড়তে লাগল, আর হাঁস উড়তে আরম্ভ করল একমাত্র কায়দায়, সংকল্পে স্থির। প্রাথমিক অবস্থায় কাকের গতি এবং বৈচিত্র দুই-ই যেন বেশি মনে হল এবং সাময়িকভাবে মনে হল যেন মানস-বিহারী হংস কিছু শ্লথ, কিছু শিথিলই হয়ে পড়েছে। কাকেরাও সেটা দেখে খুব হাসাহাসি করতে আরম্ভ করল। প্রিয়-মানস হংসের তাতে কোনও হৃক্ষেপ নেই, এবার সে স্থলপথ ছেড়ে সমুদ্রের ওপর দিয়ে চলতে আরম্ভ করল সঙ্গে প্রতিযোগী কাক। খানিক চলার পরেই কাক দেখল— বিশাল সমুদ্র, বহু দূর পথ পাড়ি দিতে হবে, পথে কোনও বৃক্ষ নেই, দ্বীপ নেই, বিশ্রাম নেবারও ঠাঁই নেই। এবারে আস্তে আস্তে স্নায়ুর বিকার আরম্ভ হল, কাক ভয় পেতে আরম্ভ করল— ততো ভীঃ প্রাবিশৎ কাকম্।
কাকের গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে শল্য কিন্তু মাঝে মাঝেই কর্ণকে সম্বোধন করে বলছেন— আরে কর্ণ! মানুষই পারে না, সেখানে কাক কি আর সমুদ্রের অন্ত-অবসান পরিমাপ করতে পারে! নাকি সে একনাগারে অতদুর উড়তেই পারে— বিদূরপাতাত্তোয়স্য কিং পুনঃ কর্ণ বায়সঃ। শল্য বুঝিয়ে দিতে চাইলেন যে, কর্ণের অস্ত্রশৈলীর বৈচিত্র্য থাকতে পারে, শতপাতে তিনি শত্রুধ্বংস করতে পারেন, কিন্তু তাঁর ধৈর্য থাকে না, শেষপর্যন্ত তিনি চালিয়ে যেতে পারেন না এবং বহুবার সেটা দেখা গেছে। যেমন কাকের একটা সময় এল, যখন তার ওড়ার শক্তি শিথিল হয়ে এল, বারবার তার চক্ষুপুট সমুদ্রের জল স্পর্শ করতে আরম্ভ করল পথশ্রমে, অধঃপাতে, সে প্রায় ডুবে যায়। এবার সে হাঁসকেই তার অক্ষমতা জানাল। হাঁস তাকে বাঁচাবার কথা ভেবেও একবার বলল— তুমি একাধিক বহুতর শতপাতে ওড়ার কথা বলেছিলে, কিন্তু এই পরম গোপন পাতটির কথা তো বলনি। তুমি এখন যে কৌশলে সমুদ্রের মধ্যে শিথিল হয়ে পড়ে যাচ্ছ এটা কোন পাত, এর শাস্ত্রসম্মত নাম কী— কিং নাম পতিতং কাক যত্ত্বং পতসি সাম্প্রতম্? কাক হংসের কৃপায় বেঁচেছিল শেষ পর্যন্ত।
গল্প শেষ করে শল্য বললেন— বৈশ্যগৃহের উচ্ছিষ্টে পুষ্ট কাক যেমন নিজের সমান এবং অধিক সমস্ত পক্ষীকে অবজ্ঞা করত, সেইরকম তুমিও তোমার সমান এবং অধিকতর গুণী মানুষদের অবজ্ঞা করো। অর্জুনকে মারার সুযোগ তুমি অনেক বার পেয়েছ, তখন তুমি তাকে মারোনি, মানে মারতে পারোনি, পালিয়ে এসেছ অনেকবার। তাই বলছিলাম— এই দুরাগ্রহ ত্যাগ করো এবং আত্মপ্রশংসায় বিরত থাক— জোসমাস্ব বিকত্থনে। কর্ণ অবশ্য আত্মশ্লাঘা বন্ধ করেননি এবং শ্লাঘার শেষে আবারও শল্যকে ধরেছেন, কুদেশের নিন্দাবাদে আবারও তাঁকে অস্থির করে তুলেছেন। তাঁর কথার মর্ম থেকে বোঝা যায় যে, পঞ্চনদের দেশ— সিন্ধু, শতদ্রু, বিপাশার দেশ মহাভারতের কালে সমস্ত প্রাচীন গৌরব হারিয়েছে। কর্ণ কোনও ভদ্র মানুষকে সেখানে যেতে বারণ করেছেন— নষ্টধর্মা ন তান্ ব্রজেৎ— এবং শল্য এই বৃহৎ ভূমিখণ্ডে জন্মেছেন বলে বারবার কর্ণ সেই মর্মেই তাকে আঘাত করেছেন। শেষ পর্যন্ত দুর্যোধনের হস্তক্ষেপে এই কথ্য-বিবাদ বন্ধ হল বটে, কিন্তু শল্য এতক্ষণে কর্ণের মনঃসমাধি বিপর্যস্ত করে দিয়েছেন অবশ্যই। অবশেষে কর্ণের সেই বিখ্যাত আদেশ ছিল শল্যের প্রতি— ‘যাহি’— তুমি চলো এবার।
গোটা যুদ্ধকালে শল্য কর্ণকে খুব যে জ্বালিয়েছেন তা মোটেই নয়, বরঞ্চ তাঁর অশ্বচালনার একটা প্রতিযোগিতা চলছিল কৃষ্ণের সঙ্গে— মুখোমুখি যুদ্ধের সময় কৃষ্ণ যেমন চোখ দিয়ে বিঁধছিলেন শল্যকে, শল্যও তেমনই বিদ্ধ করছিলেন কৃষ্ণকে— স চাপি পুণ্ডরীকাক্ষং তথৈবাভি সমৈক্ষত। কর্ণকে শল্য বাঁচাতে পারেননি, কেন না শুধু অশ্বচালনায় রথীকে বাঁচানো যায় না; দৈববশত সেদিন পৃথিবী কর্ণের রথচক্র গ্রাস করেছিল এবং তাতে শল্যের কোনও ‘সাবোতাজ’ ছিল না। সম্পূর্ণ যুদ্ধকালে তিনি কর্ণকে যথেষ্টই উৎসাহ জুগিয়েছেন এবং প্রকৃত হিতৈষীর মতোই অর্জুনের শক্তিমত্তা বুঝে কর্ণকে যথাসাধ্য পরিচালিতও করেছেন।
কর্ণ মারা যাবার পর কুরুরাজ দুর্যোধনের মনে ভীষণ রকমের হতাশা তৈরি হয়েছিল। খানিক সময়ের জন্য তিনি হিমালয়ের নির্জনতায় গিয়ে মন স্থির করার চেষ্টা করেছেন। তারপরে যা হয়, আবারও সৈন্য-সামন্তেরা উৎসাহ জুগিয়ে মহামতি শল্যের সামনে দুর্যোধনকে নতুন সেনাপতি নিযুক্ত করার জন্য অনুরোধ করল। ভীষ্ম-দ্রোণ গত হবার পর দুর্যোধন বোধহয় চেষ্টা করছিলেন যাতে সেনাপতিত্বের ব্যাপারটা অপেক্ষাকৃত তরুণতর প্রজন্মের হাতে থাকে। মানে, দুর্যোধনের কাছাকাছি বয়সের যারা তাঁদেরই সেনাপতিত্বে নিয়োগ করার একটা ভাবনা বোধহয় দুর্যোধনের মনে কাজ করছিল। ফলে শল্যের সামনে তাঁকেই সেনাপতি করার অনুরোধ পেয়েও দুর্যোধনের প্রায় সমবয়সি অশ্বত্থামার কাছে গিয়ে তাঁর বহুল প্রশংসা করে তাঁকেই বললেন— এখন আপনিই আমাদের গতি, আপনিই বলুন— কাকে এখন সেনাপতি করা যায়? আসলে বয়স্ক এবং বীর হিসেবে খ্যাত শল্যকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আর কীভাবেই বা তরুণতর অশ্বত্থামাকে জিজ্ঞাসা করা যেত— আবার এমন করে জিজ্ঞাসা করলে অশ্বত্থামার পক্ষেও বলা সম্ভব নয় যে, আমিই এবার সেনাপতি হব। অতএব অশ্বত্থামা কাল বিলম্ব না করে প্রস্তাব করলেন— বংশ বলুন, তেজ বলুন, বীরখ্যাতি বলুন, আর চেহারাই বলুন, সবদিক থেকে শল্যই আমাদের সবচেয়ে উপযুক্ত সেনাপতি হতে পারেন— সর্বৈর্গুণৈঃ সমুদিতঃ শল্যো নোহস্তু চমূপতিঃ। শল্যকে সেনাপতি স্থির করার জন্য অশ্বত্থামা আরও একটা সংবেদনশীল কারণও বললেন। দুর্যোধনকে তিনি বললেন— এই মানুষটি কতখানি দায়বদ্ধ তোমার কাছে যে, ইনি নিজের ভাগনেদের ছেড়ে আমাদের পক্ষে যোগ দিয়েছেন— ভাগিনেয়ান্ নিজাংস্ত্যক্ত্বা কৃতজ্ঞোহম্মানুপাগতঃ। সবচেয়ে বড় কথা, ইনি মহাশক্তিধর পুরুষ, অতএব শল্যকে সেনাপতি করেই এবার আমরা যুদ্ধ করব।
অশ্বত্থামা এ কথা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত রাজা, রাজন্য বর্গ অশ্বত্থামাকে ঘিরে ধরলেন, তাঁরা জয়কার দিতে থাকলেন শল্যের নামে। স্বয়ং দুর্যোধনও মাটিতে দাঁড়িয়ে বদ্ধাঞ্জলি অবস্থায় ভীষ্ম-দ্রোণকে যে সম্মান-মৌখিকতা দিয়ে বরণ করেছিলেন, ঠিক সেই বহুমানে শল্যকে সেনাপতিত্বে বরণ করলেন। শল্যের বুক স্ফীত হয়ে উঠল। খানিকটা আবেগোচ্ছলিত কণ্ঠেই তিনি বলে উঠলেন— দুর্যোধন! তুমি যে কাজ দেবে আমি সেটাই করতে রাজি আছি। তা ছাড়া আমাকে সেনাপতি নিযুক্ত করে তুমি ভুল করোনি। যে অর্জুন এবং কৃষ্ণকে তুমি খুব বড় যোদ্ধা বলে মনে করো, আমার শক্তির কাছে তারা কিছুই নয়— ন মে তুল্যাবুভাবেতৌ বাহুবীর্য্যে কথঞ্চন। আমি যদি যুদ্ধাকাঙক্ষী হয়ে সৈন্য-সামন্তের সামনে গিয়ে দাঁড়াই, তা হলে দেবতা, অসুর, মানুষ সকলের সঙ্গেই সমান যুদ্ধ করতে পারি, পাণ্ডবদের কথা আর কীই বা বলব— যোধয়েয়ং রণমুখে সংক্রুদ্ধঃ কিমু পাণ্ডবান্। যে যা হোক, তুমি কোনও চিন্তা কোরো না, পাণ্ডব-পাঞ্চালদের আমি জয় করেই ছাড়ব, এমন সৈন্যব্যুহ তৈরি করব যে, শত্রুরা তা কোনওভাবেই অতিক্রম করতে পারবে না।
আমরা বুঝতে পারি— এ হল সেই বীরোচিত গর্বোক্তি, যা সেনাপতিত্বে নিযুক্ত যোদ্ধামাত্রেই করে থাকেন। নইলে একটু আগে, একটু আগেই বা কেন বলি, এই দিনই তো কর্ণ মারা গেছেন এবং এই কর্ণের কাছেই তো শল্য কৃষ্ণ, অর্জুন এবং ভীমের শক্তি সম্বন্ধে প্রচুর কথা বলেছেন। অতএব এখন যে গর্বোক্তি করছেন শল্য, সেটা মহাভারতীয় বীরদের একটা স্বভাব বটে। যথাবিধানে দুর্যোধন সেনাপতি-পদে বরণ করলেন শল্যকে এবং কৌরবপক্ষের সমস্ত সৈন্যরা সিংহনাদ করে উঠল আনন্দে। সত্যি বলতে কী, শল্যের বীরপনাও এতটাই বিশ্রুত ছিল যে, কৌরবপক্ষের সমবেত রাজন্যবর্গ ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণের অভাব ভুলে গেল মুহূর্তেই— ন কর্ণব্যসনং কিঞ্চিন্মেনিরে তত্র ভারত।
আপনাদের মনে থাকার কথা— কুরুক্ষেত্রের এই যুদ্ধ-বিবরণ সমস্তটাই ধৃতরাষ্ট্রের কাছে অনুপুঙ্খ বর্ণনা করছিলেন সঞ্জয়। যুদ্ধে অভিষিক্ত শল্যকে যখন উন্মাদিনী প্রশংসায় ভরিয়ে তুলছেন সকলে, সেই সময় সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের কাছে অদ্ভুত একটা মন্তব্য করলেন। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন— সমস্ত লোকের মুখে প্রশংসা শুনে যুদ্ধে অশিক্ষিত ব্যক্তি যে দুর্লভ আনন্দ পায়, শল্য সেই আনন্দ লাভ করলেন— হর্ষং প্রাপ তদা বীরো দুরাপম্ অকৃতাত্ম ভিঃ। এখানে বলা দরকার যে, সংস্কৃতে ‘কৃ’ ধাতু ইংরেজিতে ঠিক verb to do-এর মতো ব্যবহৃত হয়। ‘ডু’ ভার্বটা যেমন অন্য ক্রিয়ার পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় (যেমন— Do you mind my smoking? Yes, I do.), ঠিক তেমনই ‘কৃ’ ধাতু বহু ক্রিয়ার বিকল্প হয়ে ওঠে। যদি বলি— কৃতার্থ হলাম, তা হলে বুঝতে হয়— অর্থ অর্থাৎ প্রয়োজন যার কৃত অর্থাৎ সিদ্ধ হয়েছে। অন্য দিকে যদি বলি ‘কৃতাত্মা’, তা হলে ‘আত্মা’ বলতে যেমন ইন্দ্রিয় বোঝায়, তেমনই ‘কৃত’ মানে বুঝতে হবে ‘জিত’ হয়েছে। অর্থাৎ কৃতাত্মা মানে জিতেন্দ্রিয়, অকৃতাত্মা মানে অজিতেন্দ্রিয়। কিন্তু এই যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার পূর্বমুহূর্তে শল্যের মতো যোদ্ধার প্রসঙ্গে যখন ‘অকৃতাত্মা’ কথাটা উঠছে, তখন অজিতেন্দ্রিয়তার কোনও অর্থেই অবকাশ তৈরি হয় না। অতএব এই অর্থই এখানে শ্রেয় যে, অধস্তন সৈন্য-সামন্ত এবং পার্শ্বগত রাজন্যবর্গের বহুমানন-প্রশংসায় অভিভূত হয়ে শল্য যে প্রবল প্রতাপশালী পাণ্ডবদের শক্তিমত্তা ভুলে গেলেন এবং সেনাপতিত্ব-লাভের ঘটনাটা উপভোগ করলেন, এটার মধ্যে একটা অজ্ঞতার আনন্দ আছে। কর্ণও যেটা অর্জুন-কৃষ্ণ সম্বন্ধে বলেছিলেন— অর্থাৎ নিজে বড় যোদ্ধা বলেই জানি যে, ওঁরা কতটা বড় যোদ্ধা— সেটা সত্যিই শল্য যুদ্ধে অশিক্ষিত ব্যক্তির মতো ভুলে গেলেন। কাজেই যুদ্ধে অশিক্ষিত ব্যক্তির মতোই সেদিন আনন্দ পেলেন শল্য— হর্ষং প্রাপ তদা বীরো দুরাপমকৃতাত্মভিঃ।
সেদিন কৌরবপক্ষের সকল সেনা শল্যকে সেনাপতি লাভ করে সুখে নিদ্রা গেল বটে— তাং রাত্রিং সুখিনী সুপ্তা সুস্থচিত্তা চ সা’ভবৎ— কিন্তু বিপক্ষ পাণ্ডবশিবিরে শল্যকে নিয়ে ভাবনা আরম্ভ হল। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে ইতিকর্তব্য স্থির করতে বললে কৃষ্ণ কিন্তু শল্যকে যথেষ্ট বড় যোদ্ধা, এমনকী ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণের চেয়েও তাঁর যুদ্ধক্ষমতা বেশি বলে চিহ্নিত করলেন, অন্তত শল্য যে তাঁদের চেয়ে কিছু কম নন, সেটা ভাল করেই বুঝিয়ে দিলেন কৃষ্ণ। কিন্তু যত তাঁকে বড় করে দেখান কৃষ্ণ, সেটা হয়তো এই কারণেই যাতে প্রতিপক্ষকে পাণ্ডবরা একেবারেই ছোট করে না দেখেন। তা নইলে, কৃষ্ণ কেন ভীম-অর্জুনকে ছেড়ে— শল্য যদি এতই বড় বীর— তবে তাঁদের ছেড়ে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকেই কেন শল্যের ভবিষ্যৎ-হন্তা হিসেবে চিহ্নিত করবেন। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন— দাদা! আপনি তো বাঘের মতো বিক্রমী মানুষ, অতএব আপনি ছাড়া শল্যের প্রতিযোদ্ধা হিসেবে আমি আর কাউকে ভাবতে পারছি না— নান্যস্ত্বত্তঃ পুমান্ ভবেৎ।
শল্যকে বড় যোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তারপর মহামতি যুধিষ্ঠিরকে উদ্দীপিত করলেন কৃষ্ণ এবং তার পরেই তাঁকে দিয়ে শল্য-বধের ভাবনা করার পিছনে কৃষ্ণের দুটি উদ্দেশ্য সাধিত হল। এটা তো এখানে ভাবতেই হবে যে, কৌরবপক্ষের বড় বড় যোদ্ধাদের মৃত্যু প্রধানত অর্জুন এবং তারপরে ভীমের হাতেই হয়েছে। অথচ এই বিরাট যুদ্ধের পাণ্ডবপক্ষীয় প্রতিনিধি কিন্তু যুধিষ্ঠিরই— যুদ্ধে তাঁর তেমন বীরখ্যাতি নেই, তেমন বড় যোদ্ধাও কেউ যুধিষ্ঠিরের হাতে নিহত হননি। অন্যদিকে যুধিষ্ঠির ধর্মপ্রধান মানুষ হলেও তাঁর অন্তর্গভীর সত্ত্বগুণ যেহেতু তাঁকে সবসময় হিংসাবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রেরিত করে, তাই যুদ্ধ ব্যাপারটাই তিনি পছন্দ করেন না। অথচ তাঁকে এই বিরাট যুদ্ধে নামতে হয়েছে শুধু ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম পালনের জন্য। কৃষ্ণ ঠিক এই দুর্গম জায়গাটাই ধরেছেন। বিপক্ষের অন্যতম সেনানায়ককে বধ করার ভার যুধিষ্ঠিরের হাতে দেওয়া হলে পাণ্ডবদের প্রতিনিধি-স্থানীয় যুধিষ্ঠিরের গৌরব যেমন সূচিত হয়, অন্যদিকে ধর্মযুদ্ধের সংজ্ঞায় সংজ্ঞিত এই যুদ্ধে আত্মীয়স্থানীয়কে হত্যা করলেও যে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম ঠিক থাকে, সেটা কৃষ্ণ বুঝিয়ে দিলেন একটিমাত্র বাক্য বলে। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন— মহারাজ! এই শল্য সম্পর্কে আমার মামা হয়, এই কথা ভেবে আপনি যেন আবার তাঁর ওপরে দয়া দেখাবেন না। আপনি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম সামনে রেখে মদ্ররাজ শল্যকে হত্যা করুন— ক্ষত্রধর্মং পুরস্কৃত্য জহি মদ্রজনেশ্বরম্।
তবু আরও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। কেন না যে মুহূর্তে শল্যবধের জন্য যুধিষ্ঠিরকে নির্বাচন করেছেন কৃষ্ণ, সেই মুহুর্তেই বোঝা যায় যে, মৌখিকভাবে শল্যের যতই বহুমান করা হোক, তবু যুধিষ্ঠিরকে দিয়েও শল্যবধ সম্ভব। তার মানে, শল্য তেমন বড় যোদ্ধা নন, যাতে ভীম-অর্জুনের মতো মহাশক্তি খরচ করার প্রয়োজন পড়ে। আবার শল্য যতখানি বড় যোদ্ধা সে-তুলনায় যুধিষ্ঠির হয়তো তেমন তুল্যমূল্য নন; অথচ তাঁকে দিয়ে যদি শল্যবধ করাতেই হয়, তবে সেই বাড়তি উদ্দীপনা প্রয়োজন— যা কৃষ্ণ জোগাচ্ছেন যুধিষ্ঠিরকে এবং হয়তো সেইজন্যই যুধিষ্ঠিরকে তিনি বোঝাচ্ছেন যে, বিপক্ষকে কিন্তু ছোট করে দেখা ঠিক হবে না। এমন যেন না হয় যে, ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণের মতো সমুদ্র পার হয়ে এসে শেষে শল্যের মতো পানা-পুকুরে এসে ডুবে মরতে না হয়— মা নিমজ্জস্ব সগণঃ শল্যমাদায় গোষ্পদম্।
কৃষ্ণের উদ্দীপনে যুধিষ্ঠির শল্যবধের জন্য দৃঢ়ভাবে সংকল্পিত হলেন। সে-রাত্রে কৌরব-পাণ্ডব দু’পক্ষই ঘুমোতে গেলেন পরম নিশ্চিন্তে— কৌরবরা শল্যকে পেয়ে কর্ণের অভাব ভুলে নিশ্চিন্ত হলেন, আর পাণ্ডবপক্ষ নিশ্চিন্ত হল এই ভেবে যে, শল্য অন্তত কর্ণের মতো প্রতিযোদ্ধা নন, অতএব পাণ্ডব-বিজয়ের পথে আর কোনও বড় কাঁটা নেই— সুস্বাপ রজনীং তাং তু বিশল্য ইব কুঞ্জরঃ।
পরের দিন কৌরবপক্ষীয়রা সকলে শল্যের সেনাপতিত্বে যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হলেন হই হই করে। শল্য ‘সর্বতোভদ্র’ নামে এক বিরাট সৈন্য-ব্যুহ সাজিয়ে হাতি-ঘোড়া-রথ এবং পদাতিকের চতুরঙ্গিনী সেনা নিয়ে যুদ্ধ করতে চললেন। শল্যের সেনাপতিত্বকালে একটা ব্যাপার খুব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মনে হয় এবং সেটা কৌরবপক্ষের দুর্বলতা সূচিত করে। দেখা গেল, যুদ্ধে যাবার আগে যে কর্মপরিকল্পনার কার্যকরী সভা হয়, সেখানে কৃপ, অশ্বত্থামা, শকুনি, কৃতবর্মা এবং শল্য সকলে মিলে দুর্যোধনের সঙ্গে বসে একটা নিয়ম করলেন। ঠিক হল— আমরা কেউ এককভাবে কোনও একক পাণ্ডবের সঙ্গে যুদ্ধ করব না— ন ন একেন যোদ্ধব্যং কথঞ্চিদপি পাণ্ডবৈঃ। যদি একজন পাণ্ডবের সঙ্গে আমাদের কারও একজনের যুদ্ধ আরম্ভ হয়, তা হলে সেক্ষেত্রে আমরা সকলে মিলে তার সঙ্গে যুদ্ধ করব এবং একে অপরকে রক্ষা করব— অন্যোন্যং পরিরক্ষদ্ভির্যোদ্ধব্যং সহিতৈশ্চ নঃ।
এই নিয়ম করার চেষ্টা থেকে বোঝা যায়— ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কর্ণ স্বৰ্গত হবার পর দুর্যোধনের অবস্থাটা আর তেমন শক্তিস্থলে নেই। তিনি কথঞ্চিৎ দুর্বল, অন্তত এইটুক দুর্বল তো বটেই যাতে সেনাপতি শল্যকে এককভাবে পাণ্ডবদের কারও সঙ্গে যুদ্ধে ভরসা করা যাচ্ছে না। অবশ্য এটা শল্যের কোনও নিজস্ব দুর্বলতা নয়। যে দুর্যোধনের স্বপক্ষে যুদ্ধ-বীর মহানায়কের অভাব ছিল না, সেখানে অনেকেই আজ প্রয়াত হওয়ায় সেনাপতি হিসেবে শল্য সেই বীরশক্তির সহায়তা পাচ্ছেন না। অতএব শল্য নিজে যোদ্ধা হিসেবে দুর্বল না হলেও যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি একভাবে দুর্বল বটেই।
শল্যের নায়কত্বে যে-ভাবে পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ হল, তার বিশদ বর্ণনা আছে মহাভারতে। অন্যান্য যোদ্ধর কথা বাদই দিলাম, শল্যের সঙ্গে একক পাণ্ডবদের প্রত্যেকেরই যুদ্ধ হয়েছে। তাঁর একান্ত নিজের ভাগনে নকুল এবং সহদেবের সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট যুদ্ধ হয়েছে। মহাভারতের কবির বীরভাষায় এই যুদ্ধবর্ণনা যত বীররসের সঞ্চার করে, তার মধ্যে মহাকাব্যিক অভিসন্ধি থাকায় আমার লৌকিক ভাষা তার সুর ছুঁতে পারে না। ফলত সে বর্ণনা খানিকটা পিষ্ট-পেষণ বা চর্বিত-চর্বণে পরিণত হবে। তবে হ্যাঁ, এটুকু বলা দরকার, যে, উপযুক্ত বীরের অভাব তো ছিলই, কিন্তু শল্যও বুঝি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগ করেননি। তাঁর শক্তি এবং যুদ্ধখ্যাতি, যা কৃষ্ণের মুখে পর্যন্ত বহুমানিত, সেই শল্য পাণ্ডবদের অনেক সৈন্যক্ষয় করেছেন, পাণ্ডবপক্ষের বহু যুদ্ধবীরের সঙ্গে লড়াই করেছেন, কিন্তু খুব বড়সড় ক্ষতি তিনি করতে পারেননি, অথবা করেননি।
অপরদিকে শল্যকে মারার জন্য যুধিষ্ঠিরকে কিন্তু অনেক দৃঢ়ভাবে সজ্জিত হতে হয়েছে। যুধিষ্ঠিরকে রণক্ষেত্রে চলতেই হয়েছে অনেক সুরক্ষিত হয়ে। দুই ভাই নকুল এবং সহদেব নিরন্তর নজর রেখে চলেছেন যাতে দূর থেকে যদি কেউ যুধিষ্ঠিরের রথের চাকায় আঘাত করে, তখন নকুল-সহদেব শত্রুর সেই পরিকল্পনা নষ্ট করে দেবেন। যুধিষ্ঠির নিজেই নকুল-সহদেবকে তাঁর চক্ররক্ষক হিসেবে চাইলেন— চক্ররক্ষাবিমৌ শূরৌ মম মাদ্রবতীসুতৌ। আবার চক্ররক্ষক মানে এও হতে পারে যে, যুধিষ্ঠিরের রথের দুই চাকার খুব কাছ থেকে দু’জন যোদ্ধা শত্রুসৈন্যের ওপর বাণ বর্ষণ করতে করতে এগোবেন। নকুল-সহদেব ছাড়াও যুধিষ্ঠির সাত্যকি এবং ধৃষ্টদ্যুম্নকে চাইলেন যথাক্রমে দক্ষিণ এবং বাম-চক্ররক্ষক হিসেবে— সৈনেয়ো দক্ষিণং চক্রং ধৃষ্টদ্যুম্ন স্তথোত্তরম্। যুধিষ্ঠির চাইলেন তাঁর রথের পিছনে থাকুন অর্জুন— বিপর্যয়ে তিনি সর্বশেষ দায়িত্ব নিতে পারবেন এবং সবার সামনে থাকুন বৃকোদর ভীম— যাঁর সম্মুখ উপস্থিতি শত্রুপক্ষের সমূহ ভয় উৎপাদন করে। যুধিষ্ঠির রইলেন মাঝখানে, শল্যের সঙ্গে তিনি যুদ্ধ করতে চললেন সকলের দ্বারা সুরক্ষিত হয়ে এবং এমন সুরক্ষিত অবস্থাতেই যুধিষ্ঠির ভাবলেন— আমি শল্যের থেকে বলবত্তর ভূমিকায় আছি— এবমভ্যধিকঃ শল্যাভষিষ্যামি মহামৃধে।
এই দু’জনের যুদ্ধ-বর্ণনার মধ্যে আমরা যাচ্ছি না। তবে যুদ্ধের শেষ ‘সিন’টায় যুধিষ্ঠির আর শল্যের যে দ্বৈরথ যুদ্ধ হল, সেখানে দু’জনেই আপ্রাণ যুদ্ধ করলেন এবং তখন এক সময় মনে হচ্ছিল যেন যুধিষ্ঠিরও জিততে পারেন, আবার শল্যও জিতে যেতে পারেন। কিন্তু এর পরেই যে সময়টা এল, তাতে দেখা গেল সব কিছুই যুধিষ্ঠিরের অনুকূলে ঘটতে লাগল— প্রদক্ষিণম্ অভূৎ সর্বং ধর্মরাজস্য যুধ্যতঃ। অর্থাৎ যুধিষ্ঠিরের বাণে শল্যের রথের অশ্ব এবং তাঁর পৃষ্ঠসারথি মারা গেল। তারপরেই যুধিষ্ঠিরের সেই বিখ্যাত ভল্ল-ক্ষেপণ। আমরা সেই অস্ত্রপরীক্ষার কালেই জেনেছি যে, যুধিষ্ঠির ভল্লযুদ্ধেই একমাত্র পারদর্শী ছিলেন, অতএব সেই ভল্লক্ষেপই আরম্ভ করলেন যুধিষ্ঠির। প্রথমবারেই শেষ কাজ হল না এবং অশ্বত্থামা ত্বরিতে শল্যকে নিজের রথে তুলে নিয়ে প্রস্থান করলেন। এরপরেই দেখছি— শল্য নতুন রথে সজ্জিত হয়ে আবার এসেছেন যুদ্ধ করতে এবং যুধিষ্ঠির তাঁর ভাই ভীম, নকুল, সহদেব এবং সাত্যকির দ্বারা সুরক্ষিত হয়ে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন শল্যের সঙ্গে। ভয়ানক যুদ্ধ হল এবং শেষ পর্যন্ত যুধিষ্ঠির নিক্ষিপ্ত ভীষণ দৈবী শক্তির আঘাতে শল্যের বর্ম এবং বক্ষ একই সময়ে বিদারিত হল।
শল্যের মৃত্যুসময়কালীন বর্ণনাটি মহাভারতের কবির জবানিতে যতখানি অসাধারণ তার থেকেও বেশি রাজসিক। যুধিষ্ঠিরের শক্তিক্ষেপে শল্য রথ থেকে ভূমিতে পতিত হয়েছিলেন। প্রাথমিক চেতনা হারিয়ে গেছে শুল্যের, তিনি যুধিষ্ঠিরের দিকে বাহু প্রসারণ করে এগোতে-এগোতে ধপাস করে পড়ে গেলেন। মহাকাব্যের কবি মন্তব্য করলেন— প্রিয়তমা কামিনী যেমন প্রেমবশত আপন বক্ষোদেশে পতনার্থী প্রিয়তমের প্রত্যুদ্গমন করে, তেমনই ভূমিও যেন প্রেমবশত অস্ত্র-বিদীর্ণ, রক্তসিক্ত নরশ্রেষ্ঠ শল্যের প্রত্যুদ্গমন করেছিলেন। আসলে এই উৎপ্রেক্ষা অলংকারের একটা গভীর অর্থ আছে। সেকালে যে ভূমির ওপর রাজারা অধিকার ভোগ করতেন অর্থাৎ কিনা যে রাজ্য তাঁদের অধিকারে আসত, সেটা তখনকার রাজতন্ত্রের আদর্শে রাজ্যলক্ষ্মী বলে গণ্য হত এবং বিবাহের আগে সেই ভূমিলক্ষ্মীই তাঁদের প্রধানা এবং প্রথম প্রেয়সী। আজ মদ্ররাজ শল্য যখন যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ভূমিতে শয়ান হলেন, তখন মহাভারতের কবির মন্তব্য হল— রাজা শল্য প্রিয়তমা কামিনীর মতো এই পৃথিবীকে ভোগ করেছেন স্বামীর অধিকারে— চিরং ভুক্ত্বা বসুমতীং প্রিয়াং কান্তামিব প্রভুঃ— সেই তিনি আজ ভুক্তভোগা পৃথিবীর সর্বাঙ্গ আলিঙ্গন করে তাঁরই কোলে শান্ত মৃত্যুনিদ্রায় সমাহিত হয়ে আছেন— সর্বৈরঙ্গৈঃ সমাশ্লিষ্য প্রসুপ্ত ইব সোহভবৎ।
শল্য মারা যাবার পর কৌরবপক্ষে ঘোর বিপর্যয় নেমে এল। শল্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতাও নিহত হলেন যুধিষ্ঠিরের হাতে এবং কৌরবপক্ষে একমাত্র দুর্যোধন ছাড়া আর কোনও প্রথিত ব্যক্তি বেঁচে রইলেন না। অশ্বত্থামা-কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা— এঁরা কৌরবপক্ষে যত যুদ্ধই করুন, এঁরা পুরোপুরি নিজেদের প্রয়োগ করেছেন বলে আমরা মনে করি না এবং শল্যের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের আঠেরো দিন শেষ হল। শল্য মহাভারতের একটি পর্বাধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি দিনের শেষ সময় পর্যন্ত যুদ্ধ করতে পারেননি এবং তাঁর মৃত্যুলেখায় অঙ্কিত দিনটিতেই মারা যান কৌরবপক্ষের ধুরন্ধর কৌশলী শকুনি এবং তাঁর পুত্র। শল্যের পতনের পর যতটুকু যুদ্ধ-সময় অবশিষ্ট ছিল, তার মধ্যে দুর্যোধনের সম্পূর্ণ সৈন্য ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল এবং দুর্যোধন নিজে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন দ্বৈপায়ন হ্রদে।
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা শল্যের সম্বন্ধে যতটুকু আলোচনা করেছি, তাতে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, শল্যের চরিত্র আমাদের খানিকটা বিভ্রান্ত করে। শল্য পাণ্ডবদের আত্মীয় সম্বন্ধে মামা হওয়া সত্ত্বেও স্বভাব-সরলতায় দুর্যোধনের স্তুতি-নতিতে মুগ্ধ হয়ে তাঁর পক্ষে যোগ দিলেন, অথচ তলায় তলায় আমরা জানলাম যে, আরও গভীরতর কোনও শত্রুতা এবং হয়তো বা অর্থও শল্যের পক্ষ-পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। ওদিকে আত্মীয়তার কারণে পাণ্ডবদের জন্যও কিছু ইতিকর্তব্যতা মাথায় রেখে যুদ্ধবীর কর্ণের মনোবলও বেশ খানিকটা ভেঙে দিলেন বটে, কিন্তু সেটাতে এমন বড় কিছু ক্ষতি-সাধন হয়নি কৌরবপক্ষের। বরঞ্চ এই কাজটা করতে গিয়ে কর্ণ তাঁকে তাঁর দেশজ স্বভাব নিয়ে যত গালাগালি দিলেন, তাতে এই জটিল সত্যটাই প্রমাণ ওঠে যে, জীবনের বিচিত্র টানাপোড়েন একটি সরল মানুষকে কতটা বিভ্রান্ত করতে পারে। ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে একপক্ষের সাক্ষাৎ মাতুল হয়ে অর্থের বিনিময়ে তিনি প্রতিপক্ষে যুদ্ধে যোগ দেন। আবার সেই পক্ষে যুদ্ধ করতে করতে পূর্বসম্বন্ধের স্মৃতিকাতরতায় স্বপক্ষীয় সেনাপতির মনোবল ভেঙে দেবার মতো নীচতা প্রকাশ করেন। অবশেষে যেখানে এই ধ্বনি নিনাদিত যে, ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণ পারল না, আর শল্য জিতবে পাণ্ডবদের— শল্যো জেষ্যতি পাণ্ডবান্— সেখানে শল্য অসহায়ের মতো আপন প্রাণ বিসর্জন দেন শুধু গোঁয়ার্তুমি করে।
এগুলি কোনও বিশেষ দেশজ চরিত্রের লক্ষণ-চিহ্ন হতে পারে কিনা, নাকি ব্যক্তিগত চরিত্রের জটিলতা, যার উদ্ভব দুর্বলতা থেকেও হতে পারে অথবা এই দুটিই— অথচ বাইরে থেকে আপাতদৃষ্টিতে শল্য বড় সরল স্বভাবের মানুষ। ভগবদ্গীতা পড়বার আগে ঐতিহ্যবাদীরা কয়েকটি ধ্যানমন্ত্র উচ্চারণ করেন। তার মধ্যে একটি মন্ত্রে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধটাকে একটা নদীর সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে যে, কত বিপরীত অবস্থা পেরিয়ে কৃষ্ণের মতো মাঝির সহায়তায় পাণ্ডবরা এই রণনদীর পারে এসে পৌঁছেছেন। এই নদীর বিশেষণ দেবার সময় কৌরবপক্ষের মুখ্য সেনানায়কদের উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে এই রণনদীর দুই তীর হলেন ভীষ্ম-দ্রোণ, জয়দ্রথ তার জল, কর্ণ তার বেলাভূমি, শকুনি তার নীলপদ্ম— ইত্যাদি বলতে বলতে শল্যের কথা বলার সময় তাঁকে চিহ্নিত করা হল এই বলে যে, এই রণনদীর অন্তরস্থিত কুমির হলেন শল্য— শল্য-গ্রাহবতী কৃপেণ বহনী কর্ণেন বেলাকুলা। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম এই সরল শল্য মানুষটাকে হঠাৎ কুমির বলা কেন, বরঞ্চ শকুনির বিশেষণ হওয়া উচিত ছিল এটা। পরে বুঝেছি, অনেক ভেবেচিন্তে এই শ্লোক লেখা হয়েছে। সত্যিই তো শকুনির বাইরের ব্যবহার কখনও খারাপ নয় অথচ কুটিল বুদ্ধিটুকুই তো এই রণনদীর শোভা। আর শল্য! তাঁকে সত্যিই বোঝা যায় না, কখনও তিনি তীরে আসেন, কখনও জলে, কখনও বেলাভূমির আছড়ে পড়া জলে কখনও বা আধা-শরীর ডুবিয়ে শিকার ধরার অপেক্ষায় নিস্তরঙ্গ শরীরে। চরে এসে দুর্যোধনের সঙ্গে মিত্রতায় তিনি যতখানি স্পষ্ট, জলে নেমে কর্ণের মনোবল ভাঙার সময় তিনি একেবারেই অন্য মূর্তি— এমন মানুষ যতই সরল হয়ে নিস্তরঙ্গ পড়ে থাকুন, তিনি ভয়ংকর কুমিরই বটে। ভয়ংকর প্রতিপক্ষ।