শরৎকাল

শরৎকাল

আমার ছেলেবেলা মানে ১৯৪০ সাল। সেই সময় ছেলেদের ওপর বাড়ির শাসন খুব প্রবল। পাঠ্যপুস্তক পড়ো। গল্প, উপন্যাস পাঠ নিষিদ্ধ। ও-সব পড়ার বয়েস এলে পোড়ো। সবার আগে ম্যাট্রিক পাস। কোনওরকমে পাস করলে চলবে না। ফার্স্ট ডিভিসান উইথ লেটার্স। অঙ্কে একশোর মধ্যে একশো চাই। আর্টস সাবজেক্টে নম্বর তোলা সহজ নয়। ডিভিসান তুলতে হলে সায়েন্স সাবজেক্টের ওপর জোর দাও। বাংলা খুবই উপেক্ষিত। ইংরেজ আমল। ইংরেজি আর বিজ্ঞানের ভীষণ কদর। দেশ যে একদিন স্বাধীন হবে, এমন বিশ্বাস কারও ছিল না। আন্দোলন হচ্ছে বটে, দোর্দণ্ড-প্রতাপ ইংরেজদের সহজে দেশ ছাড়া করা যাবে না। তখন রাজা বাহাদুর, রায় বাহাদুরে দেশ ভরতি। সেই রকম তাঁদের অহঙ্কার। এঁদের পাশাপাশি ছিলেন জমিদার। বিরাট বিরাট থামঅলা বাড়ি। জুড়ি গাড়ি। ফিনফিনে পাঞ্জাবি। চুনট করা ধুতি। হাতে ছড়ি। জুতোর পালিশে রাস্তার কুকুর মুখ দেখতে পারে। চোখে রিমলেস। ভয়ংকর, ভয়ংকর সব ব্যক্তিত্ব।

পরিবারে মেয়েদের আর বালকদের অবস্থা সেই সময় মিউ-মিউ বেড়ালের মতো। কর্তারা অপিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর মেয়েদের ‘অরিজিন্যাল’ গলা বেরোত। ছোটদের দাপাদাপি শুরু হত। এ সময় যত ফেরিওয়ালার আগমন। ঠ্যাং ঠ্যাং বাসনওয়ালা। খ্যানখ্যানে গলার দেহাতি মহিলা, ‘দাঁতের পুকা বের করি, বাত ভালো করি।’ হঠাৎ সুরেলা গলা, ‘জরি পাড় বেনারসি শাড়ি বিক্রি করবে।’ ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে ব্যস্তসমস্ত সংক্ষিপ্ত নিবেন, ‘আইসক্রিম’। কিছুক্ষণ পরেই দীর্ঘ আবেদন, ‘সাতা সারাবে।’

দুপুরে জমজমাট মহিলামহল। কলতলা শুকনো খটখটে। কাজের মহিলার জন্যে থালা, গেলাস, ঘটি বাটি আসর সাজিয়ে বসে আছে। স্তুপাকার ডাঁটার ছিবড়ে, ছ্যাতরানো আমড়ার আঁটি। কোনও নবীনা তার উৎফুল্ল দাঁতে নি:শেষে নির্যাস শুষে নিয়েছে। মাছের কাঁটার সর্বস্বান্ত অবস্থা দেখে মাছও ঘাবড়ে যাবে, বাড়ির পুষি সেই রিক্তকঙ্কাল থেকে আহার্য বের করায় অতি নিবিষ্ট। কাকের বিলাপ। শালিকের শাসন। কলের প্যাঁচ খুলে রাখা হয়েছে। ওটি মেয়েদের ঘড়ি। ঠিক তিনটের সময় টিপটিপ, তারপর ছ্যাড় ছ্যাড়। সেই সময় টেনলেস স্টিলের আবির্ভাব ঘটেনি। সব কাঁসার বাসন। তেঁতুল দিয়ে মাজলে ঝকঝকে সোনা।

মনসার মায়ের প্রবেশ। মাথায় বড়ি খোঁপা। মুখে পান-দোক্তা। একালের কর্মীদের মতো চটকদার নয়। সাত বাড়ি থালা ঘষে ঘষে হাত দুটো সাদা। পায়ের দিকে কোনওদিন তাকায় না। পড়ে আছে পড়ে থাক। কেউ কখনও প্রণামও করে না। সেকালের কাজের মহিলারা কখনও অসন্তোষ প্রকাশ করতেন না। বাসনের পর বাসন মেজেই যাচ্ছেন, মেজেই যাচ্ছেন। দু’চারখানা নতুন ঢুকে যেতে পারে।

কলে জল আসা আর মনসার মায়ের আবির্ভাব মানেই মেয়েদের দিন শেষ হল। স্বাধীনতা যতটা ছড়িয়েছিল ঠিক ততটাই গুটিয়ে যাবে। আর একটু পরেই কর্তারা বাড়িমুখো হবেন। এক-একজনের এক-একরকম মেজাজ। মনসার মা কাহিনি শুনতে ভালোবাসে। খুব স্মৃতিশক্তি। মেঝেতে থেবড়ে বসে জিগ্যেস করবে, ‘হ্যাঁ গা! অশান্তিটা কী নিয়ে হচ্ছে! ক্ষ্যান্তমাসির রাগের কারণ?’ মেজবউ লেখাপড়া জানা মেয়ে। বাবা রেঙ্গুনের অ্যাডভোকেট। রেঙ্গুনেই জন্ম। সেইখানে লেখাপড়া। ‘প্লিজিং পার্সোন্যালিটি।’ ছোট বউ ভোলেভালে। জমিদার বাড়ির রুচিসম্পন্ন মেয়ে। মেজই তার জীবনের ধ্রুবতারা।

 মেজবউ হাতের ইশারায় মনসার মাকে থামিয়ে দিলেন। তিনি পড়ছেন। শ্রোতা চার পাঁচজন। জোড়া মাদুর। পাশে পানের বাটা। নানারকম মশলার ডিবে। মেজ পড়ছেন, ‘ক্ষ্যান্তমাসি চিৎকার করিয়া উঠিল, ম’লে তোমার নিজের মেয়েকে কাঁধে করে পুড়িয়ে এসো বাছা—আমার মেয়ের ভাবনা তোমাকে ভাবতে হবে না। বলি, হাঁ গোবিন্দ, নিজের গায়ে হাত দিয়ে কি কথা কও না? তোমার ছোটভাই যে ওই ভাঁড়ারঘরে বসে পান সাজচে, সে তো আর বছর মাস-দেড়েক ধরে কোন কাশীবাস করে অমন হলদে রোগা শলতেটির মতো হয়ে ফিরে এসেছিল শুনি? সে বড়লোকের বড় কথা বুঝি? বেশি ঘাঁটিয়ো না বাপু। আমি সব জারিজুরি ভেঙে দিতে পারি। আমরাও ছেলেমেয়ে পেটে ধরেচি, আমরা চিনতে পারি। আমাদের চোখে ধুলো দেওয়া যায় না।

 গোবিন্দ খ্যাপার মতো ঝাঁপাইয়া পড়িল, ‘তবে রে হারামজাদা মাগী—’

মনসার মা ভীষণ উত্তেজিত, ‘তোমরা বসে আছ কী গো। মিনসেটাকে মারতে পারছ না। গরিবের ওপর বড়লোকের অত্যাচার। কবে এর একটা বিহিত হবে!’

মনসার মা ঠিকরে বেরিয়ে গেল। মুড়ো ঝাঁটার প্রবল দৌরাত্মা শুরু হল উঠোনে। পারলে পৃথিবীর সব বড়লোককে এখুনি ঝেঁটিয়ে গৃহছাড়া করে দেয়। মনসার মায়ের একটা ইতিহাস ছিল। জমিদারের চক্রান্তে স্বামীর বিষয়-সম্পত্তি সব গেল। ঘরের বউ ঘরে ঘরে কাজ করে সংসার চালায়।

কাকের দল বাসন-পত্র নিয়ে উৎপাত করছিল। চিৎকার উঠল, ‘মুখপোড়া কাক’।

‘পল্লী-সমাজ’ পালটাবে না। শরৎচন্দ্রের ‘পল্লী-সমাজ’ এর রমেশের প্রশ্ন ক্যালেন্ডারের মতো ঝুলেই থাকবে, ‘এর কি কোনো প্রতিকার নেই?’

প্রতিকার? ‘হরনাথ বিশ্বেস দুটো বিলিতি আমড়া পেড়েছিল বলে তারা আপনার ভাগ্নেকে জেলে নিয়ে তবে ছাড়লে। মামলায় মামলায় একেবারে শতচ্ছিদ্র।’

 সেকালের ঘরেঘরে শরৎচন্দ্র। মেয়েদের দুপুরে চোখের জলের দুপুর। রবিবারে কর্তাদের বৈঠকে সব বিলিতি লেখককে ম্লান করে দিয়ে সেই শরৎচন্দ্র। একদিকে ঘোর যুদ্ধ, আর একদিকে প্রবল স্বদেশি আন্দোলন। ইংরেজ-কুইট ইন্ডিয়া। ভারত ছাড়ো। সকলেরই এক প্রশ্ন, ‘পথের দাবী পড়েছ’! বৈঠকখানায় যাঁরা বসে আছেন, সকলেই ইংরেজ সরকারের বড়-বড় চাকুরে। দু-একজন যে-কোনও দিন ‘রায় বাহাদুর’ হয়ে যেতে পারেন। ইংরেজ সরকার ‘পথের দাবী’ ‘আনন্দমঠ’ ইত্যাদি অনেক বই ‘ব্যান’ করে দিয়েছেন। দু-এক কপি যার কাছে আছে, হাতবদল হয়ে ঘোরাফেরা করে।

পাশের দেয়ালের গায়ে সাজানো কাঁচা ঝাউপাতা দিয়ে লেখা কয়েকটা অক্ষরের প্রতি সহসা দৃষ্টিপাত করিয়া বলিয়া উঠিল, ‘ওটা কী লেখা ওখানে?’

ভারতী কহিল, ‘পড়ুন না।’

অপূর্ব ক্ষণকালে মন:সংযোগ করিয়া বলিল, ‘পথের দাবী। তার মানে?’

ভারতী কহিল, ‘ওই আমাদের সমিতির নাম, ওই আমাদের মন্ত্র, ওই আমাদের সাধনা।’

আমাদের বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক মহাশয় সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন। পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও অন্যান্য সাহিত্য পাঠের উপদেশ দিতেন। শরৎচন্দ্রের লেখার নানা অংশ খাতায় লিখে আনতেন। বলতেন, মন দিয়ে শোনো, সাহিত্য কাকে বলে!

শরৎচন্দ্রের বর্ণনা, চরিত্রনির্মাণ অতুলনীয়।’

পড়তে পড়তে মশগুল হয়ে যেতেন। আমরা স্তব্ধ হয়ে শুনতুম,

‘এই সূচিভেদ্য আঁধারে পিচ্ছিল পথহীন পথে বিপুল বোঝার ভারে একজন আনতদেহে সাবধানে অগ্রসর হইয়াছে,…..’

মাস্টার মশাই বোঝাতেন, শব্দের খেলাটা দেখো, পিচ্ছিল পথহীন পথে। তিনটে প-এর খেলা। আবার বিখ্যাত উপন্যস ‘শ্রীকান্ত’ থেকে পড়তেন, ‘বায়ুলেশহীন নিষ্কম্প, নিস্তব্ধ, নি:সঙ্গ নিশীথিনীর সে যেন এক বিরাট কালীমূর্তি।’ ‘ন’-এর খেলাটা একবার দেখো। এ আর কার কলম থেকে বেরবে। আবার শোনো, ‘নিবিড় কালো চুলে দ্যুলোক ও ভূলোক আচ্ছন্ন হইয়া গেছে, এবং সেই সূচিভেদ্য অন্ধকার বিদীর্ণ করিয়া করাল দংষ্ট্রারেখার ন্যায় দিগন্তবিস্তৃত এই তীব্র জলধারা হইতে কী এক প্রকারের অপরূপ স্তিমিত দ্যুতি নিষ্ঠুর চাপাহাসির মতো বিচ্ছুরিত হইতেছে।’

আমাদের স্কুলপাঠ্যে ‘শ্রীকান্ত’-র অংশবিশেষ ছিল। ‘নতুন দাদা’। আমরা স্বপ্ন দেখতুম ‘ইন্দ্রনাথ’ হওয়ার। সাহসী। বাউণ্ডুলে। পুরো বইটা পড়ার অনুমতি ছিল না। বড়দের আলোচনা সভায় দুটি বইয়ের উল্লেখ ঘুরে-ফিরে আসতই—’দেবদাস’ আর ‘শ্রীকান্ত’। এইকালেই প্রমথেশ বড়ুয়া ‘দেবদাস’ চলচ্চিত্রায়িত করলেন। একালের ভাষায় ‘ফাটাফাটি’ ব্যাপার। আমাদের মধ্যে অনেকেই তখন পাকতে শুরু করেছে। গলার স্বরে সেকালের ভাষায় ‘বয়সা’ লেগেছে। সমবয়সি মেয়েদের দেখলেই দূর থেকে ‘পারু পারু’ বলে ডেকেই ঝোপে-ঝাড়ে লুকিয়ে পড়ছে। শুধু লুকোচ্ছে না। ডাকার উত্তেজনায় অজ্ঞান মতো হয়ে যাচ্ছে। জিগ্যেস করলেই বলছে—’উরে বাবারে! ডেকে ফেলেছি রে!’ ডেকেছিস তো কী হয়েছে! ওর নাম কি পারু?’ ‘তোরা ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস না, মেয়েদের মধ্যে একটা না একটা পারু আছেই।’

সবে আমরা তখন বড় হয়ে উঠছি। অর্থনীতি, সমাজনীতি, অতশত কিছুই বুঝি না। বড়দের মুখে সেই চির-পরিচিত উপদেশ—ছাত্রানাং অধ্যায়নং তপ:। গাছ-পালা-নদী-নালা-পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ, হেডস্যার, গণিতের স্যার, শাসক পিতা, স্নেহময়ী মাতা সব দেখা শেষ। কোনও ‘ইন্টারেস্ট’ নেই। একমাত্র ‘ইন্টারেস্টিং মেয়েরা। দূর থেকে দেখা যেতে পারে। কাছে গিয়ে ঘনিষ্ঠতা করার আইন নেই। বেপরোয়া সুখেন ক্লাস নাইনের ভক্তিকে একটা প্রেমপত্র লিখে বসল। পরীক্ষার রেজাল্টের মতো আমরা উদগ্রীব ফলাফল কী হয়! সাতদিন দেখা নেই। আমাদের খুব ঈর্ষা হচ্ছে যা:, প্রেম বোধহয় পেকে গেল। সুখেনকে আর চন্দ্রমুখীর কাছে গিয়ে দেবদাসের মতো বোতল-বোতল মদ গিলতে হল না। ব্যাটা বেঁচে গেল।

সাতদিন পরে সুখেন প্রকাশিত হল। মাথা তেল চুকচুকে করে কামানো। মুখ থমথমে গম্ভীর।

‘কী হল রে! কেউ মারাটারা গেলেন?’

‘সুখেন মারা গেছে।’

সুখেনের ডাকাবুকো দাদা আর ভক্তির বাবা উভয়ে মিলে ক্ষৌরকারকে ডেকে সকলের সামনে ইটের ওপর বসিয়ে মাথা কামিয়ে দিয়েছেন। প্রেমপত্র-রচনার প্রায়শ্চিত্ত। ভক্তির সামনে কান ধরে ওঠবোস।

‘কী করবি?’

‘দেখবি? আমার নাম সুখেন। আমি বাঘের বাচ্চা! আগ্নেয়গিরি যখন নিদ্রিত, টুরিস্টরা তখন মাথায় বসে মজা করে, পিকনিক করে, আগ্নেয়গিরি যখন জেগে ওঠে!’

‘জেগে উঠে কী করবি?’

‘উলটো দেবদাস।’

‘উলটো রথ হয়, উলটো দেবদাসটা কী?’

‘দেখবি।’

সুখেন লেখাপড়ায় ভালোই ছিল। এই ঘটনার পর সে আরও ভালো হয়ে গেল। প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রথম। ম্যাট্রিকে থার্ড! শিবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে বিরাট চাকরি। ওই দিনের ঘটনার পর ভক্তি মনে হয় সুখেনকে ভালোবেসে ফেলেছিল। তারপরে সুখেনের বিরাট সাফল্য। বৃহৎ চাকরি। বিপুল উপার্জন। সেই সময় ক’জনেরই বা মোটর গাড়ি ছিল! সুখেনের ঝকঝকে বিলিতি গাড়ি। একটা ফার্মের চিফ-ইঞ্জিনিয়ারের যেমন হওয়া উচিত। সুখেনের সঙ্গে ভক্তির বিয়ে। জোর ঘটা। ঘটার কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়িই বলা চলে। তা হবে না কেন। বড়লোকের বিয়ে। দেউড়িতে জোড়া সানাই। একই রাগে বাজছে। সুখেন আমাদের ভোলেনি। আমরা বরযাত্রী। দূরত্ব সাতখানা বাড়ি।

ছাঁদনাতলায় বরের বেশে সুখেন। মাথা তেল চুকচুকে করে কামানো। বিয়ে হচ্ছে, না শ্রাদ্ধ হচ্ছে! কন্যা সম্প্রদানের পর সুখেন সুন্দর একটা বাক্স ভক্তির বাবার হাতে দিয়ে বললে, ‘খুলুন।’

খুলে অবাক। এক বাক্স চুল।

সুখেন বললে, ‘মনে পড়ে সেদিনের কথা! ওই চুল একটা-একটা করে আমার মাথায় লাগিয়ে দিন।’ শাঁক, উলু থেমে গেছে। আসর থমথমে। শ্বশুরমশাইয়ের মুখটা কেমন হয়ে গেছে। কী সাংঘাতিক! মাথা কামিয়ে বিয়ে করতে আসার রহস্যটা পরিষ্কার হল।

বঙ্কিমচন্দ্রের আলোচনায় একটি লাইনই মুখে মুখে ফিরত, ‘মা যা ছিলেন, মা যা হইয়াছেন, মা যা হইবেন। সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ’ কে না পড়েছেন! সেই বিখ্যাত বিখ্যাত লাইন—বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। মানুষ বৃদ্ধ না হইলে সুন্দর হয় না।

শিক্ষিত ‘কলোনিয়াল’ বাঙালিরা ‘হিউমার’ ভালোবাসতেন। ডিকেন্সের ‘পিকউইক পেপারস’ ভীষণ প্রিয় বই। স্বামী বিবেকানন্দ মুখস্থ করে ফেলেছিলেন গোটা বইটা। এখন আর কেউ পড়েন কি, ‘এ টেল অফ টু সিটিজ’, ‘অলিভার টুইস্ট, ‘ডেভিড কপারফিল্ড’, ‘গ্রেট একসপেক্টেসান’!

 সেকালের পাঠক অস্কার ওয়াইল্ডের ভক্ত ছিলেন। ‘হ্যাপি প্রিনস’ ‘পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে’। আলেকজান্ডার ডুমা এখন কেউ পড়েন না। সেকালের বাঙালির হট ফেভারিট। ‘কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টো’, ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’। বঙ্কিমচন্দ্রের আদর্শ ছিলেন ‘স্কট’। বাঙালি গল্প চায়। এখন আর ‘আইভান হো’ পড়বেন না। টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ পড়ার ধৈর্য কোথায়! শরৎচন্দ্রের প্রিয় পাঠ্য ছিল, টলস্টয়ের ‘রেসাররেকসান’।

সেকালের বাঙালি কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভক্ত ছিলেন। রবিবারের দুপুর কাটত তাঁকে নিয়ে ‘চীনযাত্রীর ডায়েরি,’ ‘আই হ্যাজ,’ ‘ভাদুড়ীমশাই’ ‘কোষ্ঠীর ফলাফল।’ বাঙালি-পাঠক সেই মজলিশি লেখককে ভুলেই গেছেন। পরশুরাম লেখার জগতে এসেই শিক্ষিত বাঙালির মন কেড়ে নিয়েছিলেন। গান্ডেরিরাম বাটপাড়িয়া, সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড, ধুস্তরি মায়া, হনুমানের স্বপ্ন ইত্যাদি গল্প। পরশুরাম, অর্থাৎ রাজশেখর বসু। তাঁর দাদা শশিশেখর বসুর একটি বইই প্রকাশিত হয়েছিল। অনবদ্য। কেউ আর ছাপবেন না কোনওদিন।

বড়দের জগতে, সেকালের নৈতিক শাসনে আমরা কী পড়ব! ‘রামের সুমতি’, ‘শ্রীকান্ত’র প্রথম খণ্ড চলতে পারে। ‘চরিত্রহীন’ কখনওই নয়। কিন্তু শরৎসাহিত্যের মহা আকর্ষণ উপেক্ষা করা যায় না যে! লুকিয়ে-চুরিয়ে পড়ে ফেলো। ‘পথের দাবী’-তে স্বাদেশিকতা আছে, কতটা আছে বুঝি না। ভারতীর প্রেমে হাবুডুবু। ‘সদ্য-স্নান-সিক্ত বিপুল কেশভার ভিজিয়া যেমন নিবিড় কালো হইয়াছে, তেমনি ঝুলিয়া প্রায় মাটিতে পড়িয়াছে। স্নিগ্ধ সাবানের গন্ধে ঘরের সমস্ত রুদ্ধ বায়ু হঠাৎ যেন পুলকিত হইয়া উঠিয়াছে। পরনে একখানি কালোপাড়ের সুতার শাড়ি গায়ে জামা না থাকায় বাহুর অনেকখানি দেখা যাইতেছে।’

সামনে টেবল-ল্যাম্প। বাইরে কালো আকাশ। তারার দল ছিটকে ছড়িয়ে গেছে। যেন মিছরির টুকরো। রাত গভীর। ঘরেঘরে ভারী-নিশ্বাসের অকাতর শব্দ। যুদ্ধের কালো বাজারের কালো টাকায় কিছু লোক উচ্ছৃঙ্খল বড়লোক। সেই রকম মাতালদের হট্টগোল থেকেছে। শেষ মাতাল জড়িত গলায় শ্যামাসঙ্গীত গাইতে গাইতে টাল খেতে-খেতে বাড়ি ফিরছে।

পাঠ্যপুস্তকের আড়ালে শরৎচন্দ্র। মন উড়ে চলে গেছে শরৎচন্দ্রের বার্মায়। প্রেম, ভালোবাসা, রেঙ্গুন। ঝড়ের রাতে সব্যসাচী কোথায় চলেছেন? তিনি কি নেতাজী! ‘নিমিষ মাত্র। নিমিষমাত্র পরেই সমস্ত বিলুপ্ত করিয়া দিয়া রহিল শুধু নিবিড় অন্ধকার।’ দেখতে পাচ্ছি—ভারতী পাষাণমূর্তির মতো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে। দু-চোখে জলের ধারা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *