1 of 2

শরদিন্দু ও এই দেহ – গোবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়

শরদিন্দু ও এই দেহ – গোবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়

শরদিন্দু ফিরবে না। সেই যে গেছে, তার পর থেকে ও আর একবারের জন্যেও আমার কাছে আসেনি।

এবং আমিও জানি, আমার আগেকার জীবনে বারেকের জন্যেও আমি আর ফিরে যেতে পারব না।

এখন আমাকে যেখানে রাখা হয়েছে, জায়গাটা আর-পাঁচজনের কাছে আদৌ সুখকর নয়। সাধারণ সুস্থ মানুষের বসবাসের অনুপযুক্ত।

অন্ধকারময় ছোট্ট একরত্তি ঘর। সিলিংয়ের গা ছুঁই-ছুঁই গরাদ লাগানো একফালি জানালা। একটিমাত্র যে লোহার দরজা, তাতে তালা লাগিয়ে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে আলো-হাওয়া আসে কদাচিৎ।

আটকা পড়ে আছি এই চার-দেওয়ালের মধ্যে।

একটু পরেই হয়তো দরজা খুলে আমার এখানে দুই কিংবা তিনটি মানুষের আবির্ভাব ঘটবে। মুখে তাদের অটুট গাম্ভীর্য।

সেই তরল অস্পষ্টতার মাঝে আমার তরফ থেকে কোনও অভ্যর্থনার আভাস থাকবে না। কারণ, স্থিরপ্রজ্ঞের গাম্ভীর্য আঁটা এইসব মানুষ প্রায় প্রতিদিনই এখানে আসছে। আমার ব্যক্তিত্বের ওপরে কেন আমি ইচ্ছাকৃতভাবে ফাটল ধরিয়েছি, সে-সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করছে।

বিষাক্ত জ্বালা আর অনুপায় আক্রোশে আমি এক-এক সময়ে জ্বলতে থাকি, রক্ত যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে চায়।

তবু আমি বুক ভরে একটা নিশ্বাস টেনে নিই সেই সময়ে। শান্ত হতে চেষ্টা করি।

কারণ, ওদের প্রশ্নের উত্তর আমার অজানা নেই।

অতিমাত্রায় উত্তেজিত নিছক কল্পনা, আত্ম-পরিকল্পনা, বাধা-পাওয়া হৃদয়াবেগের সহজ ধারা থেকে পথ পরিবর্তন, আরও কত কী।

শরদিন্দু—আগে আমি এমন ছিলাম না। স্মৃতির ঝকঝকে উজ্জ্বল কাচের ভেতর দিয়ে এখন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি অতীতকে। পাঠাভ্যাসের কালেই, অসময়ে বিবাহ হয়েছিল আমার। তখন সবেমাত্র আই. এসসি. পাশ করেছি। কিশোরী স্ত্রী শর্মিষ্ঠার অনুরোধেই মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হই। তারই পরামর্শমতো কলকাতায় এসে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনো করতে থাকি। শর্মিষ্ঠাকে ভালোবেসে একান্ত করে পাওয়ার আগেই, বিরহ-জ্বালা আর মনের মধ্যে মাথা-কুটে মরা রাশি-রাশি দুঃখবোধের শিকার হয়ে পড়ি।

কত সন্ধ্যা রাত্রির তিমিরে নিঃশেষে লুপ্ত হয়েছে। আড়াইশো মাইল দূরে থেকে কত কথাই ভেবেছি শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে। ভেবেছি, যাই একবার, দেখা করে আসি। কিন্তু পিতার আদেশ অমান্য করতে সাহস পাইনি, ভরসা পাইনি শর্মিষ্ঠার অনুরোধ উপেক্ষা করার।

শর্মিষ্ঠা মারা গেছে, ভালোই হয়েছে। ওকে ঘৃণা করতে শিখেছিলাম। আজও করি।

সময়ের দুর্বার বন্যায় যৌবন তখন বুঝি আমার একটু-একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছিল। শর্মিষ্ঠা এত দেরি করে মারা গেল! আমি তখন নামকরা মনস্তত্ত্ববিদ। ন্যায়নীতির অনুশাসনে বাঁধা পড়ে গিয়ে জীবনের ধারাটিকে এক সুনির্দিষ্ট রূপ দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। তবে, তখন আমার ভগ্নপক্ষ জটায়ুর মতো অবস্থা। নিজেকে একান্তভাবে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিয়ে কোনওরকমে বেঁচে আছি।

বড় দেরি করে মারা গেল শর্মিষ্ঠা! একটু আগে হলে হয়তো সময় পেতাম নতুন স্বাধীনতা উপভোগ করার। আমার জীবনের রূপ হয়তো পালটে যেত। শিরা আর স্নায়ুতে রক্তের উল্লাস নতুন করে উপলব্ধি করতাম না এ-কথা বলি কী করে!

শনিবারের দুপুরের একটা ঘণ্টা যেসব রোগী বা রোগিণী আমার কাছে শুধুমাত্র পরামর্শ নিতে আসত, তাদের কাছ থেকে কোনওরকম পারিশ্রমিক গ্রহণ করতাম না। নির্দিষ্ট এই সময়টুকুর মাঝেই শর্মিষ্ঠা মারা গিয়েছিল মোটর দুর্ঘটনায়। শনিবারের অন্য কোনও সময়ে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোনও রোগী বা রোগিণীর চিকিৎসা আমি করতাম না।

পরের সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার আগে, মনস্তাত্ত্বিকের নিজের মন পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন বলেই আমার বিশ্বাস। তাই শর্মিষ্ঠার মৃত্যুর পর থেকে তার বিয়োগ-ব্যথা ভুলবার জন্য মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রমের মধ্যে আমি ডুবে গেছি।

আমার বেদনাদায়ক সেই সময়টুকুর ভেতরেই একদিন এসে হাজির হল শরদিন্দু।

সুন্দর চেহারা। ঋজু, দীর্ঘ, একমাথা রুক্ষ চুল। পরনে পাজামা, হাতা-গোটানো ফুলশার্ট গায়ে।

আমার এই নতুন রোগীটি চেম্বারে ঢুকল ধীরে-ধীরে। এগিয়ে এসে একপাশে থমকে দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে তাকাতে লাগল সন্দেহের চোখে।

তার উপস্থিতিটা আমার সেদিন ভালো লাগেনি। আমার ঠিক বিপরীত দিকের চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়েছিলাম চোখের ইশারায়।

চেম্বারে আমি ও শরদিন্দু ছাড়া আর কেউ ছিল না।

একসময়ে আপনাথেকেই মুখ খুলল সে। শান্ত ও মোলায়েম গলায় বলল, আপনার রিসেপশনিস্ট ভদ্রমহিলা মিস গুপ্ত একটা ব্যবস্থা না করে দিলে হয়তো এ-সুযোগ ঘটত না। শুনেছি, আপনার নাম-যশ—।

ইচ্ছা করেই শরদিন্দু কথার মাঝপথে থেমে যায়।

সংযত কণ্ঠে আমি বলি, যা শুনেছেন তার সবটুকু যোগ্যতা আছে কি না জানি না। আসলে আপনার মতো আমিও একজন মানুষ।

হ্যাঁ।—টেবিলে একটা ছোট্ট মুষ্ট্যাঘাত করে সম্মতির সুরে বলে ওঠে সে, হ্যাঁ, তা যা বলেছেন!

শরদিন্দুর কথাটা মিথ্যা নয়। চেহারায় ওর সঙ্গে আমার যথেষ্ট সাদৃশ্য বর্তমান। তবে তার তুলনায় আমার বয়েস কিছুটা বেশি। আমার মাথার চুল একটু পাতলা হয়ে এসেছে। পেছনের দিকে টাকও পড়েছে খানিকটা। হয়তো ওর মতো খেয়াল-খুশিকে অবাধে অনুসরণ করে চলার মতো স্পর্ধা আমার নেই।

আপনার নামটা কিন্তু এখনও আমাকে জানাননি!—আমি বললাম।

 চেয়ারের পেছনে পিঠটা ছেড়ে দিয়ে ও বলল, শরদিন্দু সান্যাল। আপনি আমাকে শরদিন্দু বলেই ডাকবেন। মিস গুপ্তের কাছে আপনার সাফল্যের অনেক ইতিবৃত্তই আমার কানে গেছে। মানুষের বহু সমস্যার সমাধান আপনি করে দিয়েছেন।

আমি বললাম, ঠিক তা নয়। প্রত্যেকের নিজের সমস্যার সমাধান নিজেরই করে নেওয়া উচিত। আমার কাজ তোমাকে সাহায্য করা, তোমার সত্যিকারের সমস্যাটা হৃদয়ঙ্গম করা।

বাঃ চমৎকার লোক তো আপনি! আপনি আপনার ‘ফি’ নেবেন, আর আমার নিজের প্রয়োজনটুকু নিজেকেই করে নিতে হবে!

শরদিন্দুর কণ্ঠে ব্যঙ্গের সুর। কিন্তু তাতে আমি বিন্দুমাত্র উত্তেজিত হলাম না। সহজ শান্ত

ভঙ্গিতে বললাম, সপ্তাহের এই দিনের এই সময়টুকুতে কোনওরকম পারিশ্রমিক আমি গ্রহণ করি না, এটা আমার অফিসের রিসেপশনিস্ট নিশ্চয় তোমাকে জানিয়েছে। আচ্ছা শরদিন্দু, তুমি কারও দ্বারা প্রতারিত হয়েছ এ-ধারণা কখনও তোমার হয়েছে?

ভুরু কুটিল করে শরদিন্দু আমার পানে তাকিয়ে রইল। কোনও উত্তর দিল না।

আমি এবার গলায় উত্তাপ মাখিয়ে বললাম, আমার প্রশ্নের উত্তর না পেলে তোমাকে সাহায্য করা হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

চেষ্টা করলেও আপনি পারবেন না। —অসহায়ভাবে বলে শরদিন্দু, কেউই পারবে না। আমার দোষ সম্পর্কে আমি ভালোরকমই বুঝে ফেলেছি।

তাহলে আলোচনা করতে বাধা কোথায়?

ভয় হয় ডাক্তার, কোনওকিছুর দ্বারা নিবৃত্ত না হলে হয়তো আমি অন্যায় কিছু করে ফেলতে পারি।

অন্যায় বলতে কী বোঝাতে চাইছ?—আমার কণ্ঠে কৌতূহলের সুর।

শরদিন্দুর ডান হাতের আঙুলগুলো যেন কুঁকড়ে যায় প্রচণ্ড বিতৃষ্ণায়। তীব্র একটা পাশবিক উত্তেজনায় দু-হাতের আঙুল মোচড়াতে থাকে। বুকভরে একটা নিশ্বাস টেনে নিয়ে শরদিন্দু বলে, আমার এই দু-হাতের মুঠোর ভেতরে কাউকে ধরে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা হয়।

মানুষের ভেতরে সে-প্রবৃত্তি অল্পবিস্তর বর্তমান, শরদিন্দু। এ-নিয়ে নিজেকে অস্বাভাবিক প্রকৃতির বলে ধরে নেওয়াটা তোমার উচিত কাজ নয়। ভালো কথা শরদিন্দু, কখনও কারও ওপরে চড়াও হয়ে মারধোর করেছ?

না এখনও সেটা হয়নি। তবে—।

থামলে কেন, বলো।

পরের জিনিসপত্রের দিকে ভীষণ ঝোঁক যাচ্ছে। চুরি করছি। তবে প্রয়োজনে করি বললে আমার ওপর অবিচার করা হয়। কীসের যেন প্রচণ্ড টানে এটা করতে বাধ্য হই।

কী-কী চুরি করো?

এই ধরুন সুন্দরী মেয়েদের শৌখিন সব জিনিসপত্তর। আমার সেও খুব সুন্দরী ছিল কিনা।

শরদিন্দুর কাছে জানতে চাইলাম, চুরি করার সময়ে ওর মানসিক অবস্থা কীরকম থাকে, ও পরে এ-সম্পর্কে ভাবে কিনা।

আমি জানি, চুরি করা জিনিসগুলো থেকে চৌর্যবৃত্তির সূত্র পাওয়া যায় সময়ে-সময়ে।

কিন্তু শরদিন্দু আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, অন্য প্রসঙ্গে চলে যায় এজন্যে আমি চিন্তিত নই, ডাক্তার।

চৌর্যবৃত্তিটা নীচে নামার প্রাথমিক সোপান, এটা বিশ্বাস করো?

যা করি তাগিদে।—শরদিন্দু বলে, কী জানেন ডাক্তার, জীবনে দুটো মস্ত আঘাত আমাকে সহ্য করতে হয়েছে।

আঘাত!

হ্যাঁ, হৃদয় সংক্রান্ত।

হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় শরদিন্দু। শান্ত সংযতকণ্ঠে বলে, পারিশ্রমিক আজ যখন আপনি নেন না তখন এর বেশি আর আপনার সময় নষ্ট করি কেন। মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে পারলে এই আপনার সঙ্গে শেষ দেখা। আচ্ছা, নমস্কার—।

প্রতি-নমস্কারের অবকাশ আমাকে না দিয়ে চেম্বারের সুইং-ডোর ঠেলে শরদিন্দু বেরিয়ে যায়।

একটু পরেই আমার রিসেপশনিস্ট মঞ্জুশ্রী গুপ্ত আসে।

মঞ্জুশ্রী বুদ্ধিমতী মেয়ে। প্রায় বছরখানেক হল আমার এখানে কাজ করছে। বয়স আন্দাজ বাইশ-তেইশ হবে।

কথাবার্তায় ভদ্র, ব্যবহারে মার্জিত ও। অহেতুক ভাবাবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে না। কাজলের ছোঁয়াচ লাগানো ভুরুর নীচে দুটি গম্ভীর চোখ। আর সেই অতল স্বচ্ছ চোখদুটিতে আশ্চর্য এক আকর্ষণ।

ডক্টর, মিস্টার ঘোষ চৌধুরী কাল সকালে তাঁর বাড়িতে আপনাকে যেতে অনুরোধ করেছেন।—মঞ্জুশ্রীর কণ্ঠস্বরে কোমলতা।

ফোন করেছিলেন বুঝি তিনি?—আমি জানতে চাইলাম।

ঘাড় নেড়ে মঞ্জুশ্রী সম্মতি জানাল।

আচ্ছা আমি যাব’খন।

মঞ্জুশ্রী চলে যেতে উদ্যত হতেই আমি ডাকলাম, মিসেস গুপ্ত, ওয়েটিং রুমে আর কোনও রোগী আছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, দুজন অপেক্ষা করছেন।

খুব সিরিয়াস কেস কিছু?

একজনের সিজোফ্রেনিয়া—।

মঞ্জুশ্রী কথাটা শেষ করবার আগেই আমি নিজের কপালে হাত বুলোতে-বুলোতে বললাম, মাথাটা বড় ধরেছে—আগের রোগীটার বক্তব্য শুনতে-শুনতে—।

ইচ্ছা করেই শেষ করলাম না কথাটা।

মৃদু হেসে ধমকের সুরে মঞ্জুশ্রী বলল, মাথার আর দোষ কী বলুন! দাঁড়ান ‘অ্যাসপিরিন’ এনে দিচ্ছি।

মঞ্জুশ্রী চলে গেল চেম্বার থেকে।

আশ্চর্য মেয়ে এই মঞ্জুশ্রী। সবসময়ে আমার ওপর ওর তীক্ষ্ম নজর। মাঝে-মাঝে ভারী ভালো লাগে। শিক্ষিত ও পাশ করা নার্স হয়েও ওর এতটুকু আত্মম্ভরিতা নেই।

ডক্টর।

মঞ্জুশ্রীর ডাকে যেন সম্বিত ফিরে পেলাম। তাকালাম।

আমার সামনে অ্যাসপিরিনের দুটো ট্যাবলেট ও একগ্লাস জল।

মঞ্জুশ্রীর হাত থেকে নিয়ে ওর নির্দেশ পালন করলাম। তারপর খালি গ্লাসটা ফিরিয়ে দিলাম।

ডাক্তার, আজ একটু আগে যাব ভাবছি,—মঞ্জুশ্রী বলে।

কেন?—আমি জিগ্যেস করি।

একটু সঙ্কুচিত হয়ে মঞ্জুশ্রী বলে, আয়োজনের ব্যবস্থা কিছু হয়নি। তাই আপনাকেও বলিনি। মৃণাল আর আমার—।

বিবাহ-বার্ষিকী! বুঝেছি-বুঝেছি।—আমি বলি, দেখতে-দেখতে একটা বছর কখন যে কেটে গেল—।

আমি আনমনা হয়ে গেলাম।

মঞ্জুশ্রী বলল, না, ছ’মাস হল। আপনার কাছে হয়তো অস্বাভাবিক ঠেকবে। ছ’টা মাস তো আর কম নয়!

হঠাৎ আমি হেসে উঠলাম। একান্ত নিঃশব্দে নয়, শব্দ করে। নিজের কানেই কেমন বিশ্রী ও বেমানান মনে হল। হাসি থামিয়ে বিজ্ঞের ভঙ্গিতে বললাম, ঠিক—ঠিক বলেছ, মঞ্জু।

এ-জগতে সুখী দম্পতি আর কজন!

ভেবেছিলাম, শরদিন্দু হয়তো আর আসবে না। কিন্তু সপ্তাহের সেই বিশেষ দিনটিতেই সে এসে হাজির হল আমার চেম্বারে।

গায়ের জামা-কাপড় অসংবৃত, চুলগুলো অবিন্যস্ত। একহাতে ঝুলছিল একটা এয়ার-ব্যাগ।

ব্যাগ আমার টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে, ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল।

আমি বললাম, কী ব্যাপার? আছ কেমন?

খুব খারাপ। প্রায় শেষ হওয়ার দাখিল।—বলল শরদিন্দু।

সেকী!—আমার এবারে অবাক হওয়ার পালা।

শরদিন্দুর অবস্থা নিশ্চল পর্বতের মতো। হাত-পা অবশ।

ব্যাগটা খুলুন তো ডাক্তার! জিনিসগুলো টেবিলের ওপর রাখুন।

শরদিন্দুর নির্দেশ পালন করলাম কৌতূহলভরে।

টেবিলের ওপর জমে উঠল কয়েকটি শাড়ি ও ব্লাউজ।

এগুলো নিয়ে কী করবে?—আমি জিগ্যেস করি।

শরদিন্দু সোজা হয়ে বসে—গলায় উত্তাপ মাখিয়ে বলে, আমার স্নায়ুতে-স্নায়ুতে হীরার বিষের জ্বালা ডাক্তার। ক’দিন ধরে এক তীব্র নেশা আমার মস্তিষ্কের ভেতরটা কীটের মতো কেটে-কেটে খাচ্ছে। আবার আমি চুরি করতে আরম্ভ করেছি।

শরদিন্দুর কথায় বিস্মিত হই না। কিন্তু চোখ চকিত হয়ে ওঠে। কপালে চিন্তার ছায়া পড়ে।

চেয়ারের হাতলে হাত রেখে তার ওপর থুতনিটা ছেড়ে দেয় শরদিন্দু। সংশয়-ক্লান্ত ক্ষীণ গলায় বলে, আমি কী ভালো হতে পারি না, ডাক্তার?

অভয়ের ভঙ্গিতে হেসে বলি, কেন পারবে না? আত্ম-সংবরণ করো শরদিন্দু। নিজেকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে রেখে কোনওদিনই শান্তি পাবে না। আত্মসংযমী হও। একটা দুঃখকে ভুলে থাকতে গিয়ে এভাবে নিজের সর্বনাশ কোরো না।

সহসা খপ করে আমার একটা হাত চেপে ধরে অনুরোধের সুরে শরদিন্দু বলে, সেইজন্যেই তো আপনার কাছে আসা, ডাক্তার। যেসব বাড়ি থেকে ওগুলো চুরি করেছি, তাদের ঠিকানাও ব্যাগের মধ্যেই পাবেন। দয়া করে আপনি ওগুলো ঠিক-ঠিক জায়গায় পাঠিয়ে দেবেন। ওতে ঠিকানাও লেখা আছে। কথা দিচ্ছি ডাক্তার, আর কখনও অমন কাজ করব না।

আমি সম্মত হলাম, যদিও জানতাম কাজটা সহজসাধ্য নয়। চুরি করা জিনিসগুলো ফেরত দিতে গিয়ে যেসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, তার উত্তর দেওয়াটা রীতিমতো বিরক্তিকরও বইকি। সেই কারণেই এয়ার ব্যাগে ভরা জিনিসগুলো তখনকার মতো আমার চেম্বারের স্টিলের আলমারিতে ভরে রাখলাম।

কিন্তু আমার অপকীর্তিটা মঞ্জুশ্রীর কাছে ধরা পড়ে গেল। ও আবিষ্কার করে ফেলল একদিন।

এক সকালে চেম্বারে ঢুকতেই মঞ্জুশ্রী সরাসরি জিগ্যেস করে বসল, ডক্টর মুখার্জি, আলমারিতে একটা এয়ার ব্যাগ দেখলাম। ব্যাগের ভেতরে কতকগুলো জিনিসও আমার চোখে পড়ল। কী ব্যাপার? ওগুলো ওখানে কেন?

ব্যাপারটা ওকে বিশদভাবে বুঝিয়ে দিলাম। তবে শরদিন্দুর নামটা উল্লেখ করলাম না। মঞ্জশ্রী হেসে বলল, এ-রকম হাস্যকর চুরির কথা কখনও শুনিনি।

তোমার কাছে এটা হাসির খোরাক জোগাবে।—আমি গম্ভীর গলায় বললাম, তবে আমি স্থির নিশ্চিত, আমার এই রোগীটি মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বে ভীষণভাবে জর্জরিত। ওর জন্যে সত্যিই আমার মায়া হয়।

শরদিন্দু আমার নির্দেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছিল। চৌর্যবৃত্তিকে আর প্রশ্রয় দেয়নি।

দু-সপ্তাহ পরে যখন আমি কাজে ব্যস্ত, একজন রোগীর প্রস্থানের পরমুহূর্তে বেল টিপে পরবর্তী রোগীকে আসতে জানাব মঞ্জুশ্রীকে, ঠিক সেই সময়ে মূর্তিমান বিশৃঙ্খলার মতো এসে উপস্থিত হল শরদিন্দু।

এসেই ধপ করে সামনের চেয়ারটা অধিকার করে আমার সামনে দশ টাকার খানকয়েক নোট মেলে ধরে বলল, আজ আর পরামর্শ নয়, আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।

‘ফিস’ দিচ্ছ?—আমি জিগ্যেস করলাম।

শরদিন্দু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, পঞ্চাশ টাকা, তাই না?

হ্যাঁ, ওটা মঞ্জুশ্রীকে দিয়ে আগে থাকতে দেখা করার ব্যবস্থা করাই তোমার উচিত ছিল, শরদিন্দু।

ফুরসত পেলাম না। যাই হোক, যথাস্থানেই দিয়ে দেব।—টাকাটা আবার সাইড পকেটে চালান করে দিয়ে শরদিন্দু বলে, ডাক্তার, আমি একটা বাইনোকুলার কিনেছি। যত সুন্দরী স্ত্রীর ওপর আমার দারুণ মোহ! নিজের বাড়ির চারতলার বারান্দায় বসে আশেপাশের যত বাড়ির সুন্দরী স্ত্রী দেখা যায়—।

থামিয়ে দিয়ে আমি বলি, তোমার স্ত্রীও সুন্দরী ছিল বুঝেছি। পেয়ে হারানোর ব্যথাটা এমনি করে মনের মধ্যে আজও পুষে রেখেছ কেন?

সে-জ্বালা বড় ভয়ানক, ডাক্তার। গতকাল বিকেলে সামনের ওই পার্কের বেঞ্চিতে বসে আপনার ওই মঞ্জুশ্রীকে দেখলাম চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে। চা খাচ্ছিল আর কী যেন লিখে নিচ্ছিল নোটবুকে। মেয়েটার রূপ আছে মানতে হবে।

গম্ভীরভাবে আমি বললাম, মঞ্জুশ্রী বিবাহিত। ওর স্বামী এক মার্চেন্ট অফিসে ক্যাশিয়ার। সুখের সংসার ওদের। ওর দিকে নজর না দিলে আমি খুশিই হব।

ওকে আমার চাই ডাক্তার।—শান্ত সমাহিতের মতো বলল শরদিন্দু।

শরদিন্দু!—আমি ধমকে উঠলাম।

শরদিন্দু বিন্দুমাত্র আহত হল না। নির্বিকার গলায় বলল, আমি অন্যায় কিছু বলিনি। মঞ্জুশ্রীকে আমি ভীষণভাবে ভালোবেসে ফেলেছি।

দেশে আরও অনেক মেয়ে আছে। দেখেশুনে তাদের যে-কোনও একজনকে বিয়ে করে সুখী হতে চেষ্টা করো।

আমি যদি ওকে চিঠি লিখে মনের কথা জানাই!

বাধ্য হয়ে তখন আমাকে পুলিশের শরণাপন্ন হতে হবে।

বুঝেছি, ডাক্তার। সব বুঝেছি।—চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে শরদিন্দু বলল, আপনি আমাকে সারিয়ে তুলতে চান না। আমার অবস্থাটা আপনি উপভোগ করতে চান। বেশ, করতে হবে না আমার চিকিৎসা। এই নিন আপনার ‘ফিস’।

টেবিলের ওপর দশ টাকার পাঁচখানা নোট রেখে বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে।

রাগে সমস্ত শরীর তখন আমার জ্বলছিল। ভাবলাম, পুলিশে সবকিছু জানিয়ে শরদিন্দুর প্রসঙ্গটার নিষ্পত্তি করে দেওয়া যাক। পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে ডায়ালও করলাম টেলিফোনের রিসিভার তুলে। অপর প্রান্ত থেকে সাড়াও এল। কিন্তু কিছুই বললাম না। স্থির করলাম, শরদিন্দুর সঙ্গে আর-একবার সাক্ষাৎকারের পরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।

আমি স্থির নিশ্চিত ছিলাম, শরদিন্দু আবার আসবে।

দুদিন পরে আমার অফিসের ডাকবাক্সে মঞ্জুশ্রীর নামে একখানা চিঠি আবিষ্কার করলাম। মঞ্জুশ্রীর নামে কোনও চিঠিই এতাবৎকাল এখানে আসে না। কৌতূহল হল। এনভেলাপ ছিঁড়ে নীল রঙের একটা কাগজ বের করলাম।

মঞ্জুশ্রীকে প্রেম নিবেদন করেছে শরদিন্দু।

আমার কপালে চিন্তার ছায়া পড়ল। ঘৃণা মেশানো বিদ্রপে ঠোঁট দুটো কুঁচকে গেল আপনাথেকেই। এনভেলাপ সমেত চিঠিখানা কুচি-কুচি করে ছিঁড়ে ফেললাম।

তিনদিন পরে আবার চিঠি এল।

শরদিন্দুর চিঠি। মঞ্জুশ্রীকে লিখেছে। সেই একই বক্তব্য।

মঞ্জুশ্রীকে কিছুই জানালাম না।

এরপর প্রতিদিনই একখানা করে চিঠি মঞ্জুশ্রীর নামে আসতে লাগল শরদিন্দুর কাছ থেকে।

পড়তাম, ছিঁড়ে ফেলতাম, আর শরদিন্দুর প্রতি অবিমিশ্র ঘৃণা ও ক্রোধে জ্বলতে থাকতাম।

শরদিন্দু এল শনিবারের নির্দিষ্ট সেই দুপুরটিতে। শেষ রোগী তখন বিদায় নিয়েছে। আমিও উঠব-উঠব ভাবছি, শরদিন্দু সুইং-ডোর ঠেলে প্রবেশ করল আমার চেম্বারে।

আমি বললাম, কেমন আছ শরদিন্দু! আমাদের আগের কথাগুলো সম্পর্কে এতদিনে নিশ্চয় একটা সিদ্ধান্ত তুমি করে নিয়েছ!

শরদিন্দু আস্তে-আস্তে এগিয়ে এসে আমার সম্মুখীন হল। চেয়ারে বসল না। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই বলল, হ্যাঁ, আলো একটা দেখতে পেয়েছি। এরপর থেকে আমার কোনও অভিযোগই তোমার কাছে আসবে না, ডাক্তার মুখার্জি।

ভুরু কুঁচকে আমি বললাম, বক্তব্যটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, শরদিন্দু।

শরদিন্দু বলল, মঞ্জুশ্রীর সমস্ত ভার নেওয়ার পরেই দেখবে আমি অন্য মানুষ হয়ে গেছি। দেখবে, আমার সব মানসিক রোগ কেটে গেছে।

শরদিন্দু, এখনও সময় আছে ভুল শুধরে নেওয়ার—।

আমার কথার মাঝপথে শরদিন্দু বলে ওঠে, হিতোপদেশ শুনতে এখানে আসিনি, ডাক্তার। দিনের পর দিন চিঠি লিখলাম, একটা উত্তরও পেলাম না। এ থেকে বেশ বুঝতে পেরেছি, এতে ওর সম্মতি আছে। ডাকো ওকে—।

শরদিন্দুর কণ্ঠে আদেশের অগ্নি।

আমি কেমন যেন অসহায় বোধ করি। আমতা-আমতা করে বলি, এটা একেবারেই সম্ভব নয়। পরের সংসার ভেঙে—।

খুব সম্ভব। গায়ে আমার কম শক্তি নেই। জানো তো, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা।—শরদিন্দু এবারে গলার সুর যথাসম্ভব মোলায়েম করে বলে, আমি বাঁচতে চাই, ডাক্তার—আমি বাঁচতে চাই। এভাবে একটু-একটু করে একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার কোনও অর্থ হয় না।

সহসা ও কলিং বেলটা টিপে ধরে। শব্দের তরঙ্গ ওঠে। আমি বাধা দিতে পারি না।

কয়েক মুহূর্ত পরেই মঞ্জশ্রী প্রবেশ করে চেম্বারে।

কিছু বলবেন, ডক্টর?—মঞ্জুশ্রী জানতে চায়।

কাছে এসো।

সে-কথার বিরুদ্ধাচরণ করল না মঞ্জুশ্রী।

শরদিন্দু এগিয়ে যায় ওর দিকে। মুখোমুখি হয়ে থমকে দাঁড়ায়।

মঞ্জু!

বাঁকা চোখে মঞ্জুশ্রী তাকায়।

সহসা ওর একখানা হাত চেপে ধরে শরদিন্দু বলে, আমায় এভাবে কষ্ট দিয়ে কী আনন্দ পাও, মঞ্জু!

নিজের হাতখানা ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নেয় মঞ্জুশ্রী, প্রতিবাদের ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে, এসব কী বলছেন আপনি?

বিশ্বাস করো, অন্যায় কিছু বলছি না। তোমাকে একান্তভাবে নিজের করে পেতে চাই। আমার শূন্য জীবনকে তুমি ভরে তোলো, মঞ্জু!

পাগল হলেন নাকি!—মঞ্জুশ্রী প্রস্থানোদ্যত হয়।

এগিয়ে গিয়ে শাড়ির আঁচলটা চেপে ধরে শরদিন্দু কঠোর স্বরে বলে, আমার ভালোবাসার আবেদনটা তাহলে প্রত্যাখ্যান করার সাহস তুমি রাখো!

হ্যাঁ, একটা উন্মাদের সঙ্গে কথা বলতে আমি ঘৃণা বোধ করি। ছেড়ে দিন—ছেড়ে দিন আমাকে।

সেই মুহূর্তে এক বিচিত্র আকুলতা শরদিন্দুকে পেয়ে বসে। তীক্ষ্ম বিদ্রূপে মুখখানা বীভৎস করে মঞ্জুশ্রীর গলাটা চেপে ধরে দু-হাতে।

একী—একী করছেন!—মঞ্জুশ্রীর বিস্ফারিত ওষ্ঠের মাঝ দিয়ে একটা আর্তধ্বনি বেরিয়ে আসতে চায়।

ঠিকই করছি। এতকাল না-পাওয়ার জ্বালায় জ্বলে-পুড়ে আজ আর কারও প্রত্যাখ্যান সহ্য করব না। আমি তো মরেছিই, তুমি সুখে থাকো কেন!

দম নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে-করতে মঞ্জুশ্রীর গলা থেকে বেরিয়ে আসে ডক্টর—।

স্তম্ভিত বিস্ময়ে আমার দেহে চমক খেলে যায়। মঞ্জুশ্রী শরদিন্দুর নাম ধরে ডাকেনি—ডেকেছে আমাকে। আমাকে ডাকছে কেন!

ডক্টর মুখার্জি, আমাকে খুন—। —আর বলতে পারল না মঞ্জুশ্রী।

এতক্ষণে যেন নিজের অস্তিত্ব ফিরে পেলাম। মঞ্জুশ্রীকে ছেড়ে দিয়ে দেখলাম চেম্বারের চারিপাশ। না, তৃতীয় কোনও প্রাণী নেই।

তাকালাম কার্পেট-পাতা মেঝেয়।

আমার পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে মঞ্জুশ্রীর মৃতদেহ।

তাহলে আজকের এই ঘটনায় আমি দর্শক নই—আমিই নায়ক! শরদিন্দুর মানসিক ব্যাধি আমার সঙ্গে না মিললে আমি আজ তার ভূমিকায় অংশ নেব কেন!

শরদিন্দু আজ আসেনি।

মাসিক রহস্য পত্রিকা

পুজো সংখ্যা, ১৯৬২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *