2 of 3

শরণাগত

শরণাগত

কেন মা আমি তোমাকে এত চাই! তুমি শক্তি। তুমি আমার ধুতি, মেধা, পুষ্টি। কেন চাই? তুমি আমার সব চাওয়ার শ্রেষ্ঠ চাওয়া। কেন? এ-প্ৰশ্ন আমি বারে বারে নিজেকে করেছি। পৃথিবীতে কত কি-ই তো চাইবার আছে; ধন, জন, বিত্ত, মান সম্মান। ভাল লাগে না। না পেলে ক্ষোভ হয়। আবার পাওয়া হয়ে গেলে ক্লান্তি আসে। একঘেয়ে হয়ে যায়। মন আরো পেতে চায়। নিত্য নতুন, আরো আরো—এই হলো মনের ধর্ম। চেনে বাঁধা বাঁদরের মতো, চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জির মতো মনের লম্ফঝম্পের শেষ নেই। তখনই মনে হলো—

“শ্রেয়শ্চ প্রেয়শ্চ মনুষ্যমেতস্তৌ সম্পরীত্য বিবিনক্তি ধীরঃ।
শ্রেয়ো হি ধীরোঽভি প্রেয়সো বৃণীতে প্রেয়ো মন্দো যোগক্ষেমাদ্ বৃণীতে।।” (কঠ উপনিষদ্, ১।২।২)

শ্রেয় আর প্রেয় পরস্পর বিভিন্ন হলেও, দুটিই মানুষের জীবনে আসবে। বিবেকবান পুরুষ সম্যক বিবেচনায়, দুটিকে পৃথক করে প্রেয় থেকে শ্রেয়কে বেছে নেন। আর অজ্ঞানী ব্যক্তি অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি আর প্রাপ্তবস্তুর রক্ষায় প্রেয়কেই গ্রহণ করে থাকে!

আমাকে কি শেখানো হয়েছিল। তোমার প্রেয় কি হতে পারে? আর তোমার যা প্রেয় তাই তোমার শ্রেয়। সেটা কি? আপাতরমণীয় দৈহিক সুখভোগ। মত্ত হও। কি নিয়ে? স্ত্রী, পুত্র, বিত্ত। অর্জন কর, রক্ষা কর। শরীর রক্ষা কর। হৃষ্টপুষ্ট হও। কারণ, শরীরই সব। শরীর দিয়ে অর্জন, শরীর দিয়ে ভোগ।

যমরাজ নচিকেতাকে বলছেন :

“স ত্বং প্রিয়ান্ প্রিয়রূপাংশ্চ কামানভিধ্যায়ন্নচিকেতোহত্যস্রাক্ষীঃ।
নৈতাং সৃঙ্কাং বিত্তময়ীমবাপ্তো যস্যাং মজ্জন্তি বহুবো মনুষ্যাঃ।।” (কঠ উপনিষদ্, ১।২।৩)

নচিকেতা কি করেছিলেন? মানুষের প্রিয়, আপাতরমণীয়, অভিলষিত যাকিছু আছে সব পরিত্যাগ করেছিলেন। যমরাজ বলছেন, তুমি এই বহুমূল্য রত্নমালা অথবা কুৎসিত ধনবহুল পথ গ্রহণ করনি! যে পথে মানুষ সারাজীবন দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

যমরাজ লোভ দেখিয়েছিলেন বালক নচিকেতাকে, সুন্দরী স্ত্রী, পুত্রাদি প্রিয়জন, মনোহরা অপ্সরা, প্রচুর ধনরত্ন, রাজ্যসুখ। সবই দিতে চেয়েছিলেন যমরাজ।

“শতায়ুষঃ পুত্রপৌত্রান্ বৃণীত্ব, বহু পশূন্ হস্তিহিরণ্যমশ্বান্।
ভূমেমহদায়তনং বৃণীত্ব, স্বয়ঞ্চ জীব শরদো যাবদিচ্ছসি।।” (কঠ উপনিষদ্, ১।১।২৩)

-নচিকেতা, তুমি শতবর্ষ পরমায়ু-বিশিষ্ট পুত্র ও পৌত্রসকল, বহুসংখ্যক গবাদি পশু, হস্তী ও অশ্ব এবং বহু পরিমাণ স্বর্ণ প্রার্থনা কর। বিস্তীর্ণ আয়তন বিশিষ্ট ভূমি অর্থাৎ সাম্রাজ্য প্রার্থনা কর, যত বৎসর ইচ্ছা পরমায়ু প্রার্থনা কর।

না! নচিকেতার একটিমাত্র উত্তর, না ওসবে আমার কোন লোভ নেই। কেন নেই? নচিকেতা প্রেয় প্রার্থী নয়, শ্রেয় প্রার্থী। বিত্তধনের প্রলোভনে বহু মানুষ একেবারে মগ্ন হয়ে যায়! হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

যে জগতে আমার বসবাস, সে জগতের মানুষ বলবেন, দ্রাক্ষাফল টক, বলে আরেকটা শেয়াল পলায়নের পথ খুঁজছে। বলতেই পারেন; কিন্তু আমি সেই কথায় টলব না। এও এক পরীক্ষা। আমার ঠাকুর বলেছিলেন : “বিষয়ীদের সঙ্গে মিশবে না। তারা অবিশ্বাস ঢুকিয়ে দেবে।” সেই ল্যাজকাটা শেয়ালের গল্প। এক ল্যাজকাটা কায়দা করে সবকটার ল্যাজ কাটাতে চাইবে; অর্থ বিত্ত আহরণ কঠিন কোন কাজ নয়; তার চেয়ে অনেক, অনেক কঠিন, প্রলোভনের মধ্যে থেকেও প্রলোভন জয় করা। আমার ঠাকুর বলতেন : “একে সান্নিপাতিকের রোগী, তায় আবার ঘরে জলের জালা, আচারের হাঁড়ি।” ভোগের মধ্যে থেকেও ত্যাগ, মনের কতটা জোর হলে সম্ভব। দর্শন ও বিচারের দ্বারাই তা সম্ভব। দর্শন হলো, জগৎদর্শন জীবনদর্শন। রাজার ছেলে সিদ্ধার্থ। প্রশ্ন করছেন, ছন্দক! ও কি? ছন্দক বলছেন—কুমার, ঐ হলো জরা। সব মানুষেরই শেষ অবস্থা হলো ঐ। দাঁত যাবে, চোখ যাবে, শক্তি যাবে। পলিত কেশ, গলিত দেহ। সিদ্ধার্থ প্রশ্ন করলেন, ও কি? কি যাচ্ছে? ঐ মহিলারা কেন অমন শোকার্ত? –কুমার, এর নাম মৃত্যু। শ্রেষ্ঠীর শবযাত্রা। বিশাল ধনী। সুন্দরী স্ত্রী। সব ফেলে চিরবিদায়। সিদ্ধার্থ প্রশ্ন করলেন, এ কে? –কুমার, ও হলো সর্বহারা ভিক্ষুক। একসময় ও ছিল এই নগরের এক ধনী ব্যক্তি। ‘হরতি নিমেষাৎ কালঃ সর্বম।’ সিদ্ধার্থ প্রশ্ন করলেন, ও কে? –কুমার, ও এক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ। রোগটি বড় ছোঁয়াচে, তাই পড়ে আছে নগরপ্রাকারের বাইরে। মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। সিদ্ধার্থ প্রশ্ন করলেম, ও কি? –কুমার, ও হলো ক্রীতদাস। ওর প্রভু অবাধ্যতার জন্যে বেত্রাঘাত করছে।

নগর পরিক্রমা শেষে রাজার ছেলে ফিরে এলেন প্রাসাদে। বিষণ্ণ স্পৃহাশূন্য এক যুবক। নিমেষে সর্বস্ব ত্যাগ করে গিয়ে বসলেন বোধিমুলে–এর নাম জগৎ। আমি সত্য জানতে চাই। মানুষ কেন আসে? কি জন্যে এখানে আসে মার খেতে। “যা হারিয়ে যায় তাই আগলে বসে রইব কত আর? আর পারিনে রাত জাগতে হে নাথ ভাবতে অনিবার।” (রবীন্দ্রনাথ)

বুদ্ধদেব জগৎকে এইভাবে দেখলেন—একটি লোক, তাকে বাঘ তাড়া করেছে। সে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে একটা পাহাড়ে উঠে পড়েছে। একেবারে পাহাড় চূড়ায়। বাঘ সেখানেও এসে গেছে। লোকটি পেছোচ্ছে। পেছতে পেছতে সে চলে এসেছে কিনারায়। লোকটি উলটে খাদে পড়ে যেতে যেতে একটা মোটা দ্রাক্ষালতা ধরে ঝুলছে। হাত ছাড়লেই নিচে গভীর খাদ। ওপরে ওঠার উপায় নেই। হঠাৎ লোকটি দেখলে, কোথা থেকে একটা গেছো ইঁদুর এসে, সে যে দ্রাক্ষালতাটা ধরে আছে সেটাকে ধারাল দাঁত দিয়ে কাটতে শুরু করেছে। এরই মাঝে মাঝে নজর পড়ল তার হাতের নাগালের মধ্যে এক থোলো লাল আঙুর। লোকটি বাঁহাতে ধরে ঝুলছে আর ডান হাত দিয়ে একটি আঙুর তুলে মুখে পুরছে। এই হলো জীবনচিত্র।

অনুরূপ এক বর্ণনা আছে ভাগবতে। জীবন কি রকম। অপূর্ব এক তৃণভূমি। সেই তৃণভূমিতে, এক জোড়া মৃগ আর মৃগী, সুখে বিচরণ করছে। তারা তৃণ খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে। তৃণভোজীদের যেমন ধর্ম। সামনে পিছনে দুদিকে দুটি ঝোপ। একটি ঝোপের আড়ালে এক লুব্ধক! সেই ব্যাধ অগোচরে শরসন্ধান করছে। মৃগদম্পতিকে মারবে বলে। আরেকটি ঝোপে লুকিয়ে বসে আছে এক বাঘ। মৃগ আর মৃগী মনের আনন্দে বিচরণ করছে সেই বধ্যভূমিতে।

এই যখন অবস্থা, তখন আমি আমার মায়ের শরণ নেব না তো কি করব!

“সংসারদীর্ঘ রোগস্য সুবিচার মহৌষধম্।
কোহহং কস্য চ সংসারো বিবেকন বিলীয়তে।।”

আমি কে, কার এই সংসার বন্ধন! এই দৃঢ় বিচারই সংসাররূপ দীর্ঘ রোগের মহৌষধ। কারণ? বিচারই একমাত্র পথ। সংসারভ্রান্তি দূর করতে হলে বিচার চাই। নিজের সঙ্গে নিজের বিচার।

“নিত্যং বিচারযুক্তেন ভবিতব্যং মহাত্মনা।
তথান্ধকূপে পততাং বিচারো হ্যবলম্বনম্।।“

—যদি মুক্তি চাও তো সদা বিচারপরায়ণ হও। অজ্ঞানের অন্ধকূপে পড়ে আছ, বিচারই যে তোমার উদ্ধারের একমাত্র অবলম্বন। খুবই সহজ কথা; কিন্তু অতিশয় কঠিন পথ যে। ভ্রম তো মনের। কিরকম?

“সুভ্রঃ সুনাসা সুমুখী সুনেত্রা চারুহাসিনী।
কল্পনামাত্রসংমোহাদ্ রামেত্যালিঙ্গতেহশুচিম্।।”

—ভ্রান্তির উদাহরণ ভ্রান্তিবশতই কামুক পুরুষ, নারীশরীর অশুচি জেনেও আলিঙ্গন করে। ভ্রম বসে আছে তার মনে। সে ভাবতে থাকে—আহা! কী সুন্দর ভ্রূযুগল, নাসিকা কী রমণীয়, বদনকমল, কী মনোহর নেত্রদ্বয়, হাসিটুকুই বা কত মধুর! এও যেমন এক ভ্রম, আরেক বিরাট ভ্রম যা সর্বব্যাপী—

“ঘটনান্না যথা পৃথ্বী পটনান্না হি তন্তবঃ।
জগন্নাম্না চিদাভাতি জ্ঞেয়ং তত্তদভাবতঃ।।”

—মৃত্তিকা যেমন ঘটনামে, তন্তু যেমন পটনামে পরিচিত হয়, সেইরকম চৈতন্য বা ব্ৰহ্মই জগৎ। কেমন করে এই বোধে পৌঁছাব। ‘ঘট’ আর ‘পট’ নয় আসলে ঐ দুটি হলো মৃত্তিকা আর তন্তু। সেইরকম জগৎ বলে কিছু নেই সবই ব্ৰহ্ম।

“অবুৎপন্নস্য কনকে কানকে কটকে যথা।
কটকব্যক্তিরেবাস্তি ন মনাগপি হেমধীঃ।।
তথাজ্ঞস্য পুরাগার-নগনাগেন্দ্রগোচরা।
ইদং দৃশ্যং দৃগেবাস্তি ন তুন্যাপরমার্থদৃক্।।”

—যে সোনা চেনে না সে সোনার বলয়কে শুধু বলয়ই ভাববে। সেইরকম যে অজ্ঞানী, সে নগর-গৃহ-বৃক্ষ-পর্বত-সৰ্পাদি যা দেখে সেইটাকেই সত্য ভাবে। এই দৃশ্য মিথ্যা, দ্রষ্টা, চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্মই সত্য, এই যথার্থ জ্ঞান তার হয় না, কারণ সে অপরমার্থদর্শী। কেন এই ভ্রম? সে যে মায়া। ফাঁদ পেতে রেখেছে। জীব তো জড়াবেই। অত বিচার, অত মনের জোর কজনের আছে। মায়া কেমন? না,

“অবিচারিতসিদ্ধেয়ং মায়া বেশ্যা বিলাসিনী।
পুরুষং বঞ্চয়ত্যেব মিথ্যাভূতৈঃ স্ববিভ্রমৈঃ।।”

—যুক্তিহীন প্রকাশরূপিণী, বিচিত্র বিলাসকারিণী, বেশ্যাতুল্যা মায়া মিথ্যাভূত নানা বিভ্রম সহায়ে পুরুষকে বঞ্চনা করে থাকে। আবার মজা এই

“অপূর্বেয়ং হরের্মায়া ত্রিগুণা রজ্জুরূপিণী।
বয়া যুক্তো না ধাবতি বদ্ধো ধাবতি ধাবতি।।”

—তার অর্থ, যে বাঁধা আছে তাকে মুক্ত করে দিলে, সে কি করবে, দৌড়ে পালাবে। আর বাঁধা অবস্থায় তার কি হবে, সে বাঁধাই থাকবে, দৌড়তে পারবে না, কিন্তু ত্রিগুণাত্মিকা রজ্জুরূপিণী পরমেশ্বরীর মায়া কি অদ্ভুত। তিনি নিজে মুক্ত কিন্তু স্থির। ব্রাহ্মীস্থিত। তিনি পালাবার কোন কারণ দেখেন না। আর যে মায়ায় বদ্ধ সে যাবজ্জীবন দৌড়াচ্ছে। কখনো ভয়ে, কখনো লোভে, কখনো যোগক্ষেমের জন্য।

এই কারণেই আমি মায়ের শরণাগত! মা, আমি দুর্বল। আমার বিচার থেকেও নেই। আমি মুক্তি খুঁজি কিন্তু নিজেকে মুক্ত করতে পারি না। মা, তুমি আমাকে কৃপা কর। আমি ভয়ঙ্কর চেষ্টা করছি,

“হস্তং হস্তেন সৎপীড্য দন্তৈর্দন্তাশ্চ পীড়য়ন্।
অঙ্গান্যঙ্গৈঃ সমাক্রম্য জয়েদাদৌ স্বকং মনঃ।।”

—হাতে হাত, দাঁতে দাঁত, অঙ্গ দিয়ে অঙ্গ পীড়ন করে নিজের মনকে জয় করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। মা, তুমি আমাকে শক্তি দাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *